আগমনি

আজ অভিক্ষেপ-এ প্রথম মহালয়া। প্রতিবছর মহালয়া আসে। উৎসবের হাট খুলে যায় আধো ঘুমে। এক অ-দ্বিজ তাঁর উদাত্ত কন্ঠে মায়ের ঘরে ফেরার বার্তা নিয়ে উপস্থিত — ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে জেগে উঠেছে আলোক মঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।’ না ডিজিটালি পিচ্ কারেকশনের প্রয়োজন পড়ে না, রুপোলি পর্দার মিমি শ্রীময়ী প্রমুখের হাই ডেফিনেশন গুণমানে জগজ্জননীর মূর্ত প্রকাশের তাগিদ বড়ো হয়ে ওঠে না। কায়স্থ মানুষটি একসঙ্গে হয়ে ওঠেন পিতা গিরিরাজ মাতা মেনকা। পিতৃহৃদয়ের সংযত প্রশান্ত স্থিতধী অধীরতা, মাতৃহৃদয়ের শাশ্বত ব্যাকুলতায় তিনি নিজে কাঁদেন আমাদের কাঁদান। আধো ঘুমে চিন্ময়ী কন্যা উমা নিজের ঘরে আসে। মিলনের আনন্দাশ্রু তুলো মেঘ হয়ে ভাসে। অরুণ আলোর অঞ্জলি হয়ে হাসে। শরতের গন্ধ মেখে আধো ঘুমে মহালয়া আসে।

পুজো আসছে মা আসছে। কিন্তু মন ভালো নেই আমার পৃথিবীর। গভীর কালো অসুখ বাসা বেঁধেছে শরীরে। সারি সারি মৃত্যু। ঘনীভূত সন্দেহ পারস্পরিক দোষারোপ। অস্পৃশ্যতার একবিংশ শতকীয় সংস্করণ। কাজ নেই। হাসি নেই। গান নেই। ভাত নেই। অথচ এখনও স্পর্ধা আছে।ভোট আছে। কতশত ভাতা আছে। অ্যাম্বুলেন্স নেই। কচিকাঁচার মন ভালো নেই। কুমোরের চোখে জল। উৎসব আসছে।

আজ মহালয়া। এই সেদিনও তাঁরা ছিলেন যাঁদের থাকার কথা ছিল এবারেও। উদ্বৃত্ত হয়ে চলে গেলেন। বেপরোয়া কারা যেন জীবনটাকে তুচ্ছ মনে করে সামনে থেকে সাহস দেখাল। হার মানল। জানলই না অনেকে ফুরানোর তার সময় ছিল না আদৌ। অনিঃশেষ প্রতীক্ষায় রইল অগণিত। আজ মহালয়া। তর্পণ কি এবার সেইসব স্বজনদের প্রতি? যাওয়ার কথা ছিল না তাঁদের। এই উৎসবে হাতে হাত রাখত। মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে কখন যে দুটো গাল ধরে আদর করত।

‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’ শারদোৎসব আসছে। ঘরের মেয়ে ঘরে আসবে। আনন্দে উছল হৃদয়। কিন্তু মাত্র এক মাস সময়কালে দূরত্বের স্ব-আরোপিত গণ্ডি কাটিয়ে উঠতে পারব কি আমরা? বহুদিনের এই অনুশীলন সাম্প্রতিক social distancing চর্চায় বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞায় নিষিক্ত, পৃক্ত হয়েছে। মুখোশটাও মানানসই। লেয়ার বেড়েছে তিন চার পাঁচ। মাস্কে ডিসটেন্সে এবারের পুজো হবে কম-প্যাক্ট। জমজমাট। আশা করা যায়।

আজ মহালয়া। পুজো আসছে। ঘরের মেয়ে উমা তো আমাদের জগন্মাতৃকা পালয়িত্রী মঙ্গলময়ী স্নেহময়ী করুণাময়ী জননী। আবার তিনি আদ্যাশক্তি অসুরদলনী কালভয়হারিনী রূপাধারে সংস্থিতা। পৃথিবীর বাসিন্দা আমরা তাঁর সন্তান। দুঃখ শোকে বিপদে আঘাতে আমাদের আশ্রয় মায়ের স্নেহাঞ্চল, বরাভয়। আমাদের ভক্তি ভয়ের তামসিক ভক্তি নয়, শুধুই নিত্যলীলা দর্শনের অহৈতুকী নয়। নির্বাণের কল্পফলে আমাদের অভিলাষ নেই। আমরা চিনি হতে চাইনা, চিনি খেতে ভালবাসি। তাই মায়ের কাছে বারে বারে প্রার্থনা করি —

রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি

পৃথিবীর গভীরতর অসুখে আমাদের চাওয়া জ্ঞানের প্রকাশ। কর্মের উদ্‌যোগ। একতার আয়ুধে অশুভের বিনাশ। সংহতি প্রাণ।

অভিক্ষেপ-এ আজ প্রীতম মাজী। সদ্য উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ। মন্ত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য যদি মননে সাহায্য করা হয়, অব্রাহ্মণ প্রীতম প্রথাবদ্ধ শাস্ত্রের অনড় অচল নিয়মের বিপরীত পথে মননের চর্চা করে চলেছে কিশোর বয়স থেকে। পূজারি ব্যতিরেকে ওর বাড়ির দুর্গা পুজো এবার পাঁচ বছরে পড়বে। ও সহজিয়া ভক্তির আবেগে জগজ্জননীর অর্হণা করে চলেছে।

আসুন ওর কন্ঠে ভৈরবী আগমনি শুনি —

ভবানী দয়ানী মহাবাক্ বাণী

সুর-নর-মুনি জনমানী সকল বুধ জ্ঞানী।।

জগজ্জননী জগৎজ্ঞানী মহিষাসুরমর্দ্দিনী

জ্বালামুখী চণ্ডী অমরপদদানী।।

ইউ-টিউব লিঙ্ক : https://www.youtube.com/watch?v=YSzkcY45lNU

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান