মানুষ ও মানচিত্র

আনলক ফোর-এ পৌঁছে নিজেকে কি আমাদের হারামজাদা মনে হচ্ছে? অন্তত ছোটো হারামজাদা। ওই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে? চালডাল মজুত করছি। শস্য আনাজপাতি ডিম যত পারো ভরো। ডবল ডোর 345 লিটার রেফ্রিজারেটর হার মানছে। আরো কয়টির অভাব অনুভূত হচ্ছে। উঅড্-র‍্যাউব-এর কয়েকটি গুদামে রূপান্তরিত। যত পারো ভরো। লিকার চা লিকার রাম।

আপনি আমি সবাই গরম জল সহযোগে টিভি গিলছি। ফেসবুক উঅটস্অ্যাপে কত কী যে জানছি! বাতকর্মে করোনা। শব্দে জব্দ করোনা। ম্যাজিক পিল ক্লোরোক্যুইন। ৪৯ দিনের ফর্মুলায় কুপোকাত করোনা। বহুরূপী করোনা। সকাল বিকাল রাতে সুগার প্রেসার হার্টে করোনা করোনা করোনা। টম হ্যাঙ্কসের করোনা। বরিস জনসনের করোনা। পাড়ার মেয়ে মিতিন মাসির অথবা নুসরত জাহানের বাবার। হাঁচিতে কাশিতে হাসিতে করোনা। ‘হাতশুদ্ধি’ শব্দ সৃজনে করোনা। হলুদ দুধ লেবুর জল। মোবাইল মোবাইলে ইমিউনিটি ঢল। আমি তখন অমুক বাবু তমুক দেশ। দেবী শেঠি থেকে হু প্রধান ট্রেডস।

জেনে ফেলেছি কোয়ারেন্টাইন। আইসোলেশন বাসে এই বেশ ভালো আছি। কাজের মাসি বস্তিবাসীর বুড়ো আঙ্গুল দেখে ফেলেছি। দেখছি কোভিডে মনুষ্যেতরে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি। শিউরে উঠছি অজ্ঞানতায়। স্ফীত গর্বে হতাশায় স্বগতোক্তি করছি— এদেশের কিচ্ছুটি হবে না— যে সিদ্ধান্তে বারবার শ্লাঘা অনুভব করেছি। ট্যাবলেটে মেয়ের স্কুলের ম্যাডামের মুখ। পাখির ডাক শুনছি। আমলা পুত্র ছেড়ে পরিযায়ী হাঙ্গামায় যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বলছি, গোটা দেশটাকেই কোরেন্টাইনে পাঠানো উচিত। দরজা-জানলা বন্ধ। সাবধান বাতাসে ভাসছে করোনা। চোপ্ র যত বজ্জাত। চাঁদের আলোয় ঘর ফিরিস। চোখের মাথা খেয়েছিস। দেখছিস না লকডাউন চলছে। পাঁচ শতাংশ সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট গায়ে মেখে আগে বীজাণু মুক্ত হ।

লকডাউন ফোরে পৌঁছে নিজেদের কি হারামজাদা মনে হচ্ছে? এখন যখন জেনে ফেলেছেন অক্ষয়কুমারের তরতাজা থাকার রহস্য। নায়িকা ও পরিচালকের পুত্রের নাম সহ ডাক্তারের ফিরিস্তি। হাতে গরম বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট সহ এডুকেশন পলিসি। গা সয়েছে বেওয়ারিশ মৃত্যু, ইলেকট্রিক বিল। জ্যাকপট পেলে কবিতা। সুশান্ত্ রাজপুতের ম্যানেজার, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট জানা। ডিভাইসে 39 অথবা 43 তম নব সংযোজিত অ্যাপ আরোগ্য সেতু অজানা নয়। আপনার আমার সাধের চোদ্দ দিনের মহাকাব্যিক বনবাস মৃতপ্রায়। দুঃখ হচ্ছে?

আনলক ফোর। দৈনিক সংক্রমণ লাখের ঘরে। কী মনে হচ্ছে? ফিরে এসো লকডাউন। পরিযায়ী কিন্তু আবার ঘর ছেড়েছে। ওদের যূপকাঠে চড়ান। না হলে ভাত চাইবেই। আপনি আমি যদি রসেবশে শুয়ে-বসে থাকি আর ওদের সানকি ভাত শূন্য, তবে শুনতেই পারেন ওদের চিৎকার— “গাছপালা; নদী-নালা / গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত / চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী / উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি / আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ…”

আপনার-আমার অধ্যাপক মশাই ওদের প্রলাপ শুনে বলতেই পারেন— “Can the Subaltern Speak?” প্রত্যুত্তরে ধরুন অসভ্য হাভাতে কাঙাল লক্ষ লক্ষ ড্রপলেট আপনার আমার মুখে ছিটিয়ে দিল—

“ভাত দে হারামজাদা,

তা না হলে মানচিত্র খাবো।”

পালানোর পথ পাব?

হয়তো সে অনেক পরের কথা। তারচেয়ে এখন ঘুরে দেখি সেই আতঙ্ক উন্মাদনা স্বার্থপরতার দিনগুলি। নাও দেখতে পারি। কিছু কিছু দেখা আর শোনার স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত তো আমাদের। কেমন ছিলাম আমরা? আমাদের স্বদেশ? আমি ও আমার মন? নিউ নর্ম্যালে এসে ফিরে দেখা অরিন্দম সাহা সরদার-এর লকডাউন সাক্ষীচিত্র ‘মানুষ ও মানচিত্র’। আপনাকে সময় দিতে হবে মাত্র 25 মিনিট 10 সেকেন্ড। যদি হারামজাদাকে চেনা যায়।

ইউ-টিউব লিঙ্ক : https://www.youtube.com/watch?v=PVzDKaSkjuE&t=744s

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান