গাঁজাখুরি

সুশান্ত পাল

‘ফেসবুক যেমন মন পড়তে পারে’— গাঁজা তেমনি দেশ নাচাতে পারে। ওই একটু লক্ষণা অলংকার ব্যবহার করলাম। দেশ তো নাচে না। দেশবাসী নাচে। স্কুল কলেজ বন্ধ। বিধানসভা বন্ধ। ট্রেন বন্ধ প্লেন বন্ধ। কাজ বন্ধ। অথচ গাঁজা না-এর অভাব বুঝতে দেয় না। ছিলিমাধারে নৈরাশ্যহারিনী। তো এই গাঁজা বহু কেষ্ট বিষ্টুকে আপন মাহাত্ম্য দেখিয়ে জেলের ভাত খাইয়েছে। মানছি না মানব না বলে বেসুরো গান ধরলে বিফ ‘কেস’ নিয়ে হাজির হয়ে স্ক্রু-টাইটে অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাফল্য লাভ করেছে।

সাধু সন্ন্যাসী গাঁজা খান (বোধহয় সেবন করেন)। আউল বাউল ছিলিম ফাটায়। সে তো বদ্ধজীবের মধ্যবর্তী স্তর মুমুক্ষু জীবের দশা পেরিয়ে, নির্বাণের মার্গে উন্নীত হওয়ার অতীন্দ্রিয় কর্তব্য পালনের অনির্মোচনীয় তাগিদ। প্রয়োজন বিশেষে বোহেমিয়ান সাহিত্যিক সিনেমাকর মার্কামারা গায়ক চিত্রকর প্রমুখ আঁতেল বাতেল সৃষ্টির অনিবার্য প্রেরণা খুঁজে পেতে এই সৃজন বায়ু নাভিতল পর্যন্ত গ্রহণ করেই থাকেন। কিন্তু তা বলে হাত ঘুরতে ঘুরতে ভোলানাথের আদরের ছিলিমটি উঠে আসবে খান-পুত্র অথবা লাস্যময়ীর হাতে! দেশটা রসাতলে গেল মশাই। পুরাণ মহাভারত সংস্কৃতির আর কী রইল? সহবত সংযম রুচি আচার ছোটো বড়ো স্ক্রিনেই যা টিকে রইল। এ অধঃপতন কোভিড বিশ্বে ভাবা যায়। যেভাবেই হোক্ না কেন মন্ত্রী সান্ত্রি পেয়াদা লাগিয়ে ৫৯ গ্রাম গাঁজা খুঁজে বার করতেই হবে।

বুঝতে পারছেন না মশাই ৫৯ গ্রাম গাঁজায় অন্তর্ঘাতের ষড়যন্ত্র। দেশোদ্ধার, জনকল্যাণ কর্মসূচি, যেমন কৃষক থেকে ছাঁটাই কল্যাণ, সর্বোপরি ভ্যাকসিন গবেষণা বন্ধ করার বৈদেশিক চক্রান্ত। আরে লকডাউনে মন খারাপ? প্রেম নেই? দূরত্ব বিধি মেনে শরীর সরীসৃপ শীতল? বেড নেই চিকিৎসা নেই চুল্লি নেই? ফরেন লিকার তো আছে। মায় টেট্রা প্যাক দেশি আছে। অনলাইন পড়াশোনা আছে। গৃহবন্দি রবীন্দ্রজয়ন্তী আছে। মরেটরিয়ামের সুযোগ আছে। করোনা কবচ বিমা আছে। বেঁচে থাকলে আগাম মিড-ডে মিল আছে সঙ্গে অবৈতনিক কারিগরি শিক্ষা। অবশেষে রবিবাবুর তোতা মুক্ত হইবেক। ফটিক খেলনা ভল্লুক বানাইবেক।

সবার উপরে গাঁজা সত্য। তাহার ‘পরে হাসিম শেখ রামা কৈবর্ত। যা-কিছু উচ্ছিষ্ট। দেশ দেখছে। পর্দার ওপারে অ্যালগরিদম সজাগ। অবৈধ কারবারিরা রেহাই পাবে না কেউ। গাঁজারু থেকে সমপ্রেমখোর। কনস্টিপেশন থেকে ন্যাশনালিজম। ডেটা পয়েন্ট জমছে। চোদ্দো পুরুষের খোঁজ চলছে। জিনাত আমান আশা ভোঁসলে সিনিয়র সিটিজেন স্কিমে ছাড় পেয়েছেন। জয় গোস্বামীর বাপ-ব্যাটা সিলেবাসে সেঁধিয়ে এ যাত্রায় শমন এড়িয়েছে। তা বলে এলি তেলি ছাড় পাবে ভেবেছেন?

ওই সাধু সন্ত বাবা আর ছাগলদাড়ি ইন্টেলেকচুয়াল ব্যতীত ভারতীয় তরুণ তরুণী কবে গাঁজা খেয়েছে দেখান। তারা স্বামীজির একম্ অদ্বিতীয়ম্ বাণী দেহে মনে অক্ষরে মেনে চলে। পড়াশোনা একান্ত না করলে ফুটবল খেলে। যুবক যুবতি ডাক্তার হয় ব্রিজ বানায় কবিতা লেখে গিটার বাজায়। মাঠে ঘাটে কলকারখানায় সেক্টর ফাইভে কাজ করে। ঘরে বউ আনে। মাসমাহিনায় খাসির মাংস কেনে। তারা তো আর বেকার নয় যে বসে বসে গাঁজা খাবে। অ-পলিটিক্যাল ফিলগুড মতির ছেলেরা গাঁজা খাবে কোন্ দুঃখে? জেনো, তাদের বিষাদ নেই আত্মহত্যা নেই স্বপ্নের বালাই নেই। সবকিছুই তো পাওয়া হয়ে গিয়েছে সব পেয়েছির দেশে। মাঝেমধ্যে মন খারাপ করলে মোটিভেশনাল গুরু সন্দীপ মহেশ্বরী আছেন, ফেরারি বেচা ফকির রবিন শর্মা অথবা কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা গৌর গোপাল দাস আছেন।

মাঝবয়সি গৃহীরা এদেশে মূল্যবোধের চর্চা করেন অনাদ্যন্ত। জাতীয় ঐতিহ্যে যাঁদের ছাতি ফোলে তাঁরা গাঁজা টানবে কোন্ অনুপ্রেরণায়, অভাবের তাড়নায়? লকডাউনে শূন্য শূন্য লাগছে, কবিতা পাচ্ছে না? শুয়ে শুয়ে অথবা প্রায় বসে কিংবা অফিসে দিন তিনেকের উপস্থিতিতে মাইনে নেওয়ার বিবেক সংকটে ভুগছেন? ৪০ হাজারের ঘরে সোনা কিনে না রাখায় মূর্খ মনে হচ্ছে নিজেকে? অথবা কাজের মাসির ধার নেওয়া দুশো টাকা পরের মাসে কেটে অপরাধ বোধে ভুগছেন? করোনা সংক্রামিত আত্মীয়ের পাশে অর্থে দেহে কাছে না থাকায় নিজেকে অসামাজিক মনে হচ্ছে? কুছ পরোয়া নেই। ভিটামিন সি খান। আয়ুষ ক্বাথ পান করুন। নাকে নারকেল তেল লাগান। অভ্যাস থাকলে দু-চার পেগ হুইস্কি রাম ভদকা পছন্দ অনুযায়ী। লম্বা শ্বাস নিয়ে মনে মনে দশ গুনুন। ইয়োগা করুন। একটু এলটন জন বেশিটা রবি ঠাকুর শুনুন। বাজারে যান সপ্তাহে দু-তিন দিন। মাস্কবিহীন সবজিয়ালি টোটো চালককে মনে মনে সজোরে খিস্তি মেরে বাড়িতে এসে গরম জলে পরিশুদ্ধ হয়ে টিভির সামনে বসে পড়ুন। ওই শোনা যায়, ভারত আবার ফোর্বস জগতে শ্রেষ্ঠ আসন লবে। শত কোটিপতির খাতায় নাম তুলেছে আরও পনেরো। তা হলে যোগফল = ছিল একশত দুই + গত ছয়মাসে নতুন পনেরো = সাকুল্যে একশত সতেরো। একশো চল্লিশ কোটির দেশে সংখ্যাটা নিতান্তই নগণ্য। এইসকল বিলিয়নেয়ার* পুরুষবর্গের ভজনা করো। এর মধ্যে গাঁজা আসছে কোত্থেকে!

মাত্র ৫৯ গ্রাম গঞ্জিকা সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার দেশটাকে রসাতলে পাঠাল মশাই। এই সূত্রে বছর পঁচিশ আগেকার এক জনপ্রিয় হিন্দি ছায়াছবির সংলাপ মনে পড়ে গেল—

एक खटमल पूरी रात को अपाहिज कर देता है…

মশাই রাষ্ট্রভাষা রাজার ভাষা। পড়া লেখা প্র্যাকটিস করুন। আর যাই খান গাঁজা নাস্তি। ও বস্তুতে পরমের পেটেন্ট। বরং গাঁজার পার্কের নাম পরিবর্তনের দাবি জানাই। আসুন।

[*বি.দ্র. — সংখ্যা ক্রমশ পরিবর্তিত তবে পদবি নির্দিষ্ট]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান