হারামি, follow me : সোশ্যাল মিডিয়া অন্তর্যাত্রা

মৃন্ময় মুখার্জি

একটি পেট্রিডিশ। যেখানে ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিচ্ছে, খাচ্ছে, কলোনি বিস্তার করছে এবং মরছে। আপনার অনুসন্ধিৎসু মন খুঁজতে চাইল প্যাটার্ন। আপনি দুর্ভিক্ষ, খরা ও অন্যান্য দুর্যোগ সৃষ্টি করে মেপে নিলেন ব্যাকটেরিয়ার জীবনযাপন, সমীকরণ তৈরি করলেন, প্রেডিক্ট করলেন অনেক কিছু, লব্ধজ্ঞান ব্যবহার করলেন মনুষ্যকল্যাণে ও ঈশ্বরের মতো সৃষ্টির আনন্দে হাসলেন। তারপর কতকগুলো বাঁদর বা ইঁদুরকে খাঁচায় পুরলেন। তাদের আপাত বিশৃঙ্খল ব্যবহার প্রথমে কিছুদিন নোট করলেন, আবারও সমীকরণে ফেললেন, প্রেডিক্ট করার চেষ্টা করলেন, বাগ না মানলে পুরস্কার অথবা শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। একসময় তারা ট্রেনড হল। আপনি আবারও আনন্দ পেলেন। তৈরি করলেন বিহেভির‍্যাল সায়েন্স। আস্তে আস্তে বোঝা গেল পুরস্কার হিসাবে খাবার নয়, ঘণ্টাধ্বনি যথেষ্ট। খুশি হলেন প্যাভলভ। রচিত হল কন্ডিশনাল রেস্পন্সের কাব্য।

এই রিওয়ার্ড ও পানিশমেন্টের বাইনারি আদিসূত্র ব্যবহৃত হল সোশ্যাল মিডিয়ায়। সমস্ত জটিল প্রশ্নকে ভেঙে ফেলা হল হ্যাঁ অথবা না-এর উত্তরে। আপনার নির্ভেজাল আনন্দ, আঁতলামি, নিজস্বতা, কৌতূহল প্রশমিত হয়ে জন্ম নিল দুটি প্রধান অনুভূতি— চাটুকারিতায় গদগদ আনন্দ আর বিপরীতে একরাশ অভিমান অথবা ঘৃণা।

আমরা বাঁধা পড়লাম অ্যালগরিদমে— হাত-পা ও মন সহ। আমাদের জটিল নার্ভাস সিস্টেম, সেরিব্রাল কর্টেক্স, র‍্যান্ডমনেস সহজেই প্রেডিক্টেবল হয়ে গেল। ‘তুচ্ছ আমি’, ‘ক্ষুদ্র আমি’-র বাস্তব দুনিয়ার অপমানের বিপরীতে সোশ্যাল মিডিয়ার স্বীকৃতি আমাদের এনে দিল কার্নিভালের স্বাদ। বাড়ল সোশ্যাল স্ট্যাটাস, প্রতিযোগিতা। আমরা কুল হলাম। জাজমেন্টাল হলাম। ভার্চুয়াল রিয়েলিটির আসক্তিতে ডুব দিলাম। মজা হল।

ঈশ্বরেরা এই আসক্তির নাম দিলেন ‘এনগেজমেন্ট’। অতএব বাড়াতে হবে এনগেজমেন্ট। ডিজাইন করা হল নতুন ইন্টারফেস, মনোমুগ্ধকর, সমস্ত ইন্দ্রিয় প্রভাবিত। পেলাম পছন্দের রঙ, শব্দ, পছন্দের খামার— বিচরণ ক্ষেত্র। হ্যামলিনের বাঁশিতে লাইন লাগালাম অনুগত আমরা। মন দিয়ে বা মনের ভুলে পোস্ট করলাম অনুভূতিমালা খেলাচ্ছলে। পেলাম ফ্ল্যাটারিং রেস্পন্স, পাবলিক স্বীকৃতি, আরো পোস্ট, অবশেষে অভ্যাস। এনগেজমেন্ট কমলে কাতর অপেক্ষা। গুরুত্ব দাও প্রভু। পরের পোস্ট আরও এনগেজিং অর্থে লঘু করা— যা পাবলিকে খায়।

আপনি একটি মতের জন্ম দিলেন, পপুলার হল, এত পপুলেশনের কিছু শতাংশ যথেষ্ট— সমমনের মানুষ পাবেনই, এবার ধরা পড়লেন অ্যালগরিদমে, ছড়িয়ে পড়লেন আরও মানুষের মাঝে, ছোটো গ্রুপ তৈরি হল, জেদ বাড়ল আপনার, প্রটেস্ট গ্রুপ, অ্যান্টি-প্রটেস্ট গ্রুপ— তৈরি হল নতুন হিংসা, নতুন ধর্ম, নতুন প্রেম, নতুন অর্থনীতি। আরেকটি ন্যারেটিভ-এর জন্ম। আরেকটি ইজম-এর জন্ম। টোটাল ক্যাওস। নতুন পৃথিবী। আগে পৃথিবী গুঁড়িয়ে দাও, তারপর টুকরোগুলো থেকে মনের মাধুরী মিশিয়ে নতুন মূর্তি গড়ো।

রাগ-অনুরাগ, বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব, মিষ্টিহাসি-দস্যিপনার প্রতিটি অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন, প্রতিটি লাইক, প্রতিটি কমেন্ট আসলে জমা হচ্ছে। আমাদের খেলাচ্ছল-সিরিয়াসনেস আসলে ডেটা পয়েন্ট। যত বেশি প্রকাশ তত বেশি ডেটা। ঈশ্বরদের হাতে সেই ডেটার ভাণ্ডার। প্রথমে চটকানো হয় সেই ডেটা, তারপর খোঁজা হয় পারস্পরিক সম্পর্ক, তারপর লেখা হয় অ্যালগরিদম। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা মেশিন লার্নিং-এর মাধ্যমে যে অ্যালগরিদম সদা পরিবর্তনশীল, অভিযোজনে সক্ষম— আমাদের উদ্দীপনার মাত্রার পরিমাপে। ঈশ্বরেরা ঠিক করেন সেই উদ্দীপকের ডোজ— ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থে।

অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ বাড়ানোর প্রয়াসে তৈরি হয়েছিল যে সোশ্যাল মিডিয়া, এখন তা ট্রিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি— যারা আপনার অজান্তে বেচতে পারে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য। যে তথ্য প্রসেস হবে বিভিন্ন অ্যানালিটিক্স ফার্মে— স্ট্যাস্টিক্যাল অ্যানালিসিসে আপনি হয়ে উঠবেন পোটেনশিয়াল কাস্টোমার। অস্তিত্বের সঙ্কট, পারস্পরিক অবিশ্বাস, গণহত্যা, গণবিশৃঙ্খলা, বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব, মেরুকরণ, দাঙ্গা, ভোটচুরি, রাজনৈতিক পালাবদল, দেশপ্রেম বা দেশদ্রোহিতা, কেন্দ্র বা পরিধি বিষয়ে মনন— এসবের আসেট। মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্রের বন্ধনই হোক অথবা দড়িতে টান মেরে রাজাবদলের মুক্তিই হোক— সব নিয়ন্ত্রিত পারস্পরিক সম্পর্কিত তথ্যের বিস্তৃতিতে। তথ্যই এখন ক্ষমতার উৎস। অ্যালগরিদমের সমীকরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তথ্য-ক্ষমতা-অর্থ-ক্ষমতাবদল-অর্থনীতি-সামাজবদল-আসক্তি-আরো তথ্য ইত্যাদির চক্রাকার একচেটিয়া বিজনেস মডেল।

বর্তমান পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ ব্যবহার করেন কোনো না কোনো সোশ্যাল মিডিয়া। আর প্রতিদিন প্রায় গড়ে ৩ ঘণ্টা করে। যার সিংহভাগ, প্রায় ৬৮ শতাংশ ফেসবুকের দখলে। বেবি বুমার থেকে জেনারেশন এক্স, ওয়াই, জেড, আলফা, গ্রাম-শহর কেউ পিছিয়ে নেই। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের দিয়েছে অনেক কিছু— একটা কমিউনিটি ফিলিং, খুঁজে পেয়েছি আমরা বন্ধু, ছড়িয়ে দিয়েছি আমাদের সৃষ্টিসত্তা, করেছি ক্রাউড ফান্ডিং, করেছি মিছিল, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য-শিক্ষার প্রসার ঘটেছে অনেকাংশে। সাথে এনেছি অস্থিরতা, পাগলামি, মেরুকরণের আধিক্য। অ্যাট্রাকশন বা রিপালশন নইলে বুম, চেকমেট— শেষে বিভ্রান্তি, গণহিস্টেরিয়া। জায়গা নেই অন্যমতের। শুধু সাদা বা কালো। মুছে দিয়েছি ধূসর রঙ। অতএব আমরা ম্যানিপুলেটেড। আমাদের মননে প্রোপাগান্ডার বিস্তার। নাচি আমরা নাচি।

প্রোপাগান্ডা তো আগেও ছিল। নতুন কি। দোষ কার, পণ্যের না ব্যবহারকারীর? পুরনো তর্ক— বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপের মতো। ইউটোপিয়া আর ডিসটোপিয়ার দ্বন্দ্ব। সাম্যাবস্থায় বিশ্বাসীরা বলবেন সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। টেকনোলজির দ্রুত পরিবর্তন, সবটা গিলতে না পারা— সেই কারণেই এই কিম্ভূত পরিস্থিতি। সময় যাক, ঘুমোই এখন, একদিন প্রভাতে সুষম হবে সবকিছু। আপনার আপাত নিষ্পাপ মন বলবে এ তো গণতান্ত্রিক— সোশ্যাল মিডিয়া যদি গ্যাংস্টার হয় তাহলে সে তো ভয় ভালোবাসা দুটোই ছড়ায়। মানসিকতার পরিবর্তন করলেই হয়। অ্যালিগেশন আপনার সল্ভ করবেন আপনি। অন্তর্যামীরা হাসেন। মজা পান ম্যানিপুলেশানের কারিগরেরা কারবারিরা।

ধরুন আপনার মন চাইছে একটা কিছু যেটা পরিচিত সাবানের মতো না, অথচ পরিমিত ফেনা হয়, ক্যারি করতে সুবিধে, অতটা রুক্ষ না, একটু তেলতেলে, ভালো সুগন্ধ… আপনি গুগল করলেন নিজের মতো, সঠিক উত্তর পেলেন না। বিরক্ত হয়ে বন্ধুদের কাছে জানবার জন্য ফেসবুকে গেলেন। ও মা, এ কি! মুশকিল আসান। ফেসবুকের পাতায় ভেসে উঠেছে লিকুইড সোপের অ্যামাজন বিজ্ঞাপন। আপনি অনুপম রায়ের গান শুনতে ভালবাসেন। ইউ-টিউবে গেলেন, শুনলেন দু-একটা। ইউ-টিউব আপনার মনের কথা বুঝে ফেলল। রেকমেন্ড করতে থাকল আরও বেশ কয়েকটি পছন্দের গান। এবার দেখলেন রেকমেন্ডেশনের তালিকায় সৃজিত মুখার্জির নাম। সেখান থেকে পেলেন ‘হইচই’। আপনি অনুপম রায়ের দরজায় কড়া নেড়ে পৌঁছে গেলেন ‘এস. ভি. এফ.’-এর ঘরে। নিজেকে ফিট রাখতে ভুঁড়ি কমানোর দশটি টিপসের যে আর্টিকেলে ক্লিক করেছিলেন, সেখান থেকে খুঁজে পেলেন কিটোডায়েটের ফর্মুলা, তারপর স্রেফ মজা পেতে চলে গেলেন যৌনাঙ্গ সতেজ ও সুন্দর রাখার ঘরোয়া উপায়ের বিষয়টিতে, তারপর দেখলেন পবিত্র কোরান পাঠের উপকারিতা, সেখান থেকে খুঁজে পেলেন বিপুল মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে আপনার হিন্দুঅস্তিত্ব কীভাবে বিঘ্নিত, শেষমেশ হনুমান চালিশা পাঠ করে ঘুমিয়ে পড়লেন।

এভাবে দিন পেরল, সন্ধ্যে নামলে বুঝতে পারলাম ক্রমশ গাধা হয়ে যাচ্ছি। চারদিকে ভায়োলেন্স, মিথ্যার যেন প্যানডেমিক। ভালো লাগে না। মিথ্যে, সব মিথ্যে। বিশ্বাস নেই কোথাও। সব কনস্পিরেসি। নিউজ ফেক-নিউজ। ফ্যাক্ট ফ্যাক্ট-চেক। ছুঁড়ে ফেলে দেব শালা ফেসবুক, ট্যুইটার, হোঅ্যাটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম। দেখব না কিছু, থাকব না কিছুতেই। কিন্তু! হেল্পলাইন দরকার এ নেশা ছাড়ানোর। রিহ্যাব দরকার। কিছুতেই ফোকাস করতে পারছি না। অন্তরঙ্গে তিড়িং-বিড়িং বহিরঙ্গে ফুস অথবা… ‘সাইকেলের দুদিক চাকা মধ্যে ফাঁকা…’ গাধা হব না ভেড়া হব! সেন্সর দরকার। স্বাধীনতার কি হবে! রেগুলেশন দরকার। কে করবে! কোন মডেল। চীন না আমেরিকা না ইউরোপ! অঙ্ক বড়ই কঠিন।

একটি মিডিয়ার মৃত্যুতে অথবা হাতবদলে আর একটি মিডিয়া আসবে। একসময় শ্রেণিবিন্যাস করব মদের মতো হার্ডড্রিঙ্কস, সফ্টড্রিঙ্কস— আরে বিয়ারকে তো ঠিক অ্যালকোহল বলা চলে না, রেডওয়াইন স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। আততায়ীকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে দোষারোপের ইতিহাস। কনসেন্ট আর ডিসেন্ট-এর গুঞ্জন। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। ‘Can I be manipulated?’-বদলে এখন প্রশ্ন ‘Do I want to be manipulated !’

তাহলে উপায়! আরে আমরা এরকম, আপনি তো আর না। আপনি তথ্য সরবরাহ বন্ধ করুন, মুছে দিন আপনার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টসমূহ। অথবা আনপ্রেডিক্টেবেল হয়ে যান, হয়ে যান আউটলায়ার— যাকে কিছুতেই ফিট করা যাবে না পরিচিত সমীকরণে। ছোটো বিস্ফোরণ ঘটান, ঘুরে দাঁড়ান। রিফ্রেশ করুন ইচ্ছাশক্তি। আমরা আপনাকে দেখব, শিখতেও পারি কিছু। আপনার সবচেয়ে উঁচু মূর্তি বানাব একদিন, ইনশাআল্লাহ।

অ্যালেক্সা আপাতত একটু ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা’-র গল্প শোনাও।

( for further perspective watch these documentaries ‘The Great Hack’ and ‘The Social Dilemma’ on Netflix or read these books ‘Ten Arguments For Deleting Your Social Media Accounts Right Now’ and ‘You Are Not A Gadget’ written by Jaron Lanier or watch this video https://www.youtube.com/watch?v=zoi6vVGVubI )

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান