সজিনা

বিষ্ণুপ্রসাদ দাস

(১)

স্কুল ছুটির পর নিধু তিন মাথার মোড়ে ওর রামকৃষ্ণ পল্লির সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে বলে আমাকে ভয় দেখাত। কিন্তু কেন? তা আর এখন স্পষ্ট মনে নেই। আমার সঙ্গেই পড়ত নিধু, রেখা। রেখার তখনই বিয়ে হয়ে গেছিল। শাঁখা পলা পরে আসত। রেখা আর ওর বরকে নিয়ে কোনো খারাপ কথা বলেছিলাম নিধুকে। নিধু কথাটা রেখাকে গিয়ে বলে দেয়। শুনে রেখার সে কী ছি ছি ছি! তুই এত ছোটলোক জানতুম না। রেখার কাছে ছোটলোক হয়ে যাচ্ছি দেখে কথাটা নিধুরই মনগড়া এই বলে নিধুর ঘাড়েই দোষ চাপিয়ে দিই। নিধু সেই রাগেই তিন মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর আমাকে ধরবে এসপার ওসপার করবে, বলত? স্কুল ছুটির পর আমিও রোজ তিন মাথার মোড়ের দিকে না গিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে বাড়ি যেতাম। স্কুল থেকে বেরোতাম রেখা সরস্বতীদের ছত্রছায়ায়। তুই আমার সঙ্গে আছিস, বুঝলি? রেখা বলত, নিধু কিসসু করতে পারবে না। রেখার সামনে নিধু ভাবখানা এমন করত যেন ভাজা মাছ খানা উলটে খেতে জানে না। নিধুর সঙ্গে সরস্বতী রেখারা কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। ক্লাসে নিধু হয়ে পড়েছিল একঘরে। বাইরে তার শক্তি ছিল রামকৃষ্ণ পল্লির সাঙ্গপাঙ্গরা। আমি যতক্ষণ রেখা সরস্বতীর সঙ্গে থাকতাম, জানতাম আমি নিরাপদ। কিন্তু তিন মাথার মোড় অব্দি সরস্বতী রেখারা যেত না। তার আগেই আলাদা হয়ে যেতাম আমরা। আমি তারপর সিধে রাস্তা না ধরে একটা গলি দিয়ে ঘুরে গঙ্গার পাশ দিয়ে গিয়ে নবারুণ ক্লাবের মাঠে গিয়ে পড়তাম। ওই মাঠ পেরিয়ে বাড়ির রাস্তা। একদিন গলিতে ঢুকে কিছুটা হেঁটেই দেখি একটা দোতলা বাড়ির ঝুল বারান্দায় একটা অ্যালসেশিয়ান চেঁচাচ্ছে। যেন তক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। কুকুরটার চেন নেই। আমি দাঁড়িয়েই আছি। পেরোতে পারছি না। বুক ঢিপঢিপ করছে। পাশের বাড়ি থেকে এক মহিলা বেরিয়ে এসে বললেন, ও বাড়িতে এই টাইমে কেউ থাকে না সবাই আপিসে। তাই কুকুরটাকে খুলে রেখে যায়। কী সাংঘাতিক। কিন্তু আমি যাব কী করে? যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমার মেজদাকে দুমাস আগে কুকুরে কামড়েছিল। ১৪টা ইনজেকশন নিতে হয়েছিল। নাভিতে। কী কষ্ট। এসব ভাবছি, মহিলা বললেন চলে যাও কিছু করবে না, ওটা ওমনি চেঁচায়, পাঁচিল টপকাতে পারে না। আমি তবু ভয়ে ভয়ে রাস্তাটা কোনোরকমে পেরোলাম। কুকুরটার চেঁচানিতে এমন বুক ধড়পড় করছিল গলি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরেও হৃদযন্ত্রের সেই আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। প্রাইমারি স্কুল ছেড়ে হাইস্কুলে না যাওয়া অব্দি আমি রোজ ওই রাস্তা দিয়েই বাড়ি যেতাম। রেখাকে কথাটা বলতে ওর ভাইকে আমার সঙ্গে পাঠাত।

ওর ভাই সাহেব বাগানের ক্লাবঘরে বুকডন দিত। মুগুর ভাঁজত। রেখার মুখেই শোনা। গাঁট্টাগোট্টা চেহারার রেখার ভাই এরপর থেকে আমাকে গলির রাস্তাটুকু পার করে দিত। কুকুরটা যে রোজই ওখানে থাকত তা নয়। মাঝেমাঝে থাকত। আর গরগর করত। আমাদের দেখলেই। রেখার ভাই সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করত না। গলির পাঁচিলের গা ঘেঁষেই চলত। কখনও পাঁচিলের গা ভেদ করে ওঠা বটচারার পাতা ছিঁড়ে নিত। সারাটা রাস্তা রেখার ভাই, বল্টু কোনো কথা বলত না। আমিও না। মাঠের কাছে এসে কথা ফুটত। এবার যেতে পারবে? হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর আসতে হবে না তোকে। যা, সাবধানে। আমি বল্টুকে কেন যে সাবধান বলতাম! শুনে বল্টু অদ্ভুত রকমের হেসে চলে যেত। বল্টুর হাসিতে আমার আঁতে ঘা লাগত। আমি হনহন করে বাড়ির কাছে চলে আসতাম। বম্মা মানে ঠাকুমার দিদি, বম্মা বুড়ি উঠোনে তখন হয়তো একদিকে রেশনের চাল গম বেছে রেখে অন্যদিকে মোড়ায় বসে কড়াইশুঁটি ছাড়াচ্ছে। আমি একখাবলা কড়াইশুঁটি তুলে নিয়ে চিবোতাম। ইস্কুলের ড্রেস না খুলেই।

(২)

স্কুলে যেদিন লিভিং সার্টিফিকেট আনতে গেলাম ক্লাস ফোর পাশ দেবার পর, বাবা হেডদিদিকে বললেন, ওর নামটা পাল্টাব। শুনে আমি অবাক। অতনু বলেই স্কুলে সবাই এতদিন ডেকেছে। রেশনকার্ডে ওর নাম আছে কালিকাপ্রসাদ। ওর দাদুর দেওয়া নাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বাবা বলছে আবার। আমি চাই ওটাই থাক। অতনু আসলে ওর নিজের নেওয়া নাম। ওর দাদা শান্তনু। তার সঙ্গে মিলিয়ে ও অতনু করে নিয়েছিল। ভর্তি হবার সময় দাদাকে ও সেই নামটাই ফর্মে লিখতে বলেছিল। বাবার কথায় হেডদিদি সার্টিফিকেটে খসখস করে লিখে দিলেন, কালিকাপ্রসাদ চক্রবর্তী।

স্কুল থেকে বেরচ্ছি, অতনু— কে ডাকছে। ঘুরে দেখি রেখা। অদূরে একজন লোক। শেভ করা গাল কার্তিক ঠাকুরের মতো একখানা গোঁফ। আমার বর। রেখা আলাপ করিয়ে দিল। তুই কোন স্কুলে ভর্তি হলি, বুনিয়াদি? রেখা জানতে চাইছে। আমার আর পড়া হবে না। ডোমকল চলে যাচ্ছি— সাবুগাছের পাশে দাঁড়িয়ে রেখার বর। এসব কথায় তার কোনও আগ্রহই নেই। তার হাতে একটা সুটকেস, খুব ভারি নয় বোধহয়। হাতেই ধরে আছে, নামিয়ে রাখেনি। হঠাৎ রেখা কোনো জরুরি কথা মনে পড়ে গেছে সেইভাবে বলল, ও হ্যাঁ, বল্টু স্কুলের স্পোর্টসে ১০০ আর ৪০০ মিটারে ফার্স্ট হয়েছে, তোকে বলতে বলেছে। আমি বাহ্ বললাম। কিন্তু বল্টু কেন ওই খবরটা আমাকে জানাতে চেয়েছে, বুঝতে পারলাম না।

বাবার সঙ্গে স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট নিয়ে সেদিন আমি অনেকদিন পর তিন মাথার মোড় হয়েই বাড়ি ফিরেছি। নিধু বা তার সাঙ্গপাঙ্গদের কাউকেই দেখিনি। রাস্তার ওপারে, রকে বাঁদিকে চায়ের দোকানটার দিকে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম।

(৩)

হাইস্কুল থেকে বেরিয়ে কলকাতায় পড়তে গেলাম। কলেজস্ট্রিটের কাছে ব্যাপটিস্ট হস্টেলে থাকতাম। বাড়ি আসতাম শনিবার। একবার ফিরে মোল্লারহাটে গেছি খাসির মাংস কিনতে। মা বলল রেয়াজি খাসি ওখানে ভাল মেলে। বাড়িতে তখন মাংস হলে খাসিই হত। মুর্গি ঢুকত না। নিধুর সঙ্গে দেখা। অতনু— অতনু— বলে কে ডাকছে। একটা দোকান থেকে। অতনু নামটা জানে শুধু আমার প্রাইমারি স্কুলের বন্ধুরা স্যার দিদিমনি বা কোনো কোনো বন্ধুর বাবা মা। কিন্তু তারা খুব বিরল। তাদেরই কেউ ভেবে তাকিয়েছি দেখি নিধু। চিনতে পারিনি প্রথমে। কেমন বুড়োটে হয়ে গেছে। আমাদের দোকান… মানে বাবার দোকান, আমি বসছি। নিধু বাবার শাঁখার দোকান চালাচ্ছে। অনেকদিন পর কারও মুখে অতনু ডাক শুনে আমার বেশ খুশি লাগছিল। চা-ওলা যাচ্ছিল। ডেকে ২টো চা দিতে বললাম। নিধু চা একটু আগেই খেয়েছে তবু নিল। বিড়ি ধরাল। নিধুর দোকানে শাঁখাপলাই বেশি। শঙ্খও সাজিয়ে রেখেছে কয়েকটা। শাঁখার আংটিও রয়েছে কাচের শোকেসে। আমি অ্যাস্টোলজিও করি। নিধু ওর করতল আমার সামনে মেলে ধরে বলল। ওই একটু আধটু শিখেছিলাম, হাতিবাগানের এক জ্যোতিষের কাছে, তাই দিয়েই— আমি ওর দোকানের একটা বড়ো শঙ্খ হাতে তুলে নিই। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি। কানে ঠেকালাম। শঙ্খের ভেতর নাকি সমুদ্রের আওয়াজ শোনা যায়। শুনতে চেষ্টা করছিলাম। ওটা দুশো পড়বে। নিধু বলে উঠল।

(৪)

এরপর থেকে নিধুর সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যেই দেখা হয়েছে। স্টেশানের কালুর চায়ের দোকান, ট্র্যাফিক মোড় বা ব্রিজের নীচের ছোটো ছোটো মনিহারি দোকানগুলোর সামনে। দেখা হলেই নিধুর একগাল হাসি। আর একটা জিনিস খেয়াল করি, নিধু আমাকে এখন তুই না, তুমি ডাকছে। অতনু তুমি এখন কী করছো? পড়া শেষ? বা: বা:। অতনু চাকরি পেয়ে গেছ নাকি? বা: বা: মাইনেপত্তরও নিশ্চই ভালো। এসব কথার পরেই নিধু কখনও পঞ্চাশ ধার চায়, কোনোদিন, একশো হবে তোমার কাছে? আমি নিধুকে বেশ কয়েকবার টাকা দিয়েছি। অল্পস্বল্প টাকা। শাঁখার দোকান চলছে না আজকাল, প্লাস্টিকের জুতোর দোকান দিয়েছি মোল্লারহাটেই, সেকথাও ওই জানিয়েছে।

একদিন কয়েকটা জ্যোতিষীর পাথর এনে আমাকে দেখাল। নেপাল থেকে এনেছে। বেশ দাম। কিন্তু ও অল্প লাভ রেখে বেচে দিতে চায়। আমি কি কিনতে রাজি? পাথর দিয়ে আমি কী করব? নিধু তাও আমায় একটা পাথর গছিয়ে কিছু টাকা নিয়ে গেল। আমি সে পাথর নিয়ে গিয়ে আমার আলমারির লকারে ফেলে রাখলাম। আমার কোনো কাজে আসবে না জেনেই নিয়েছিলাম। এবারের টাকা গুলোও গচ্ছা গেল বুঝেই নিয়েছিলাম; বাজার করতে যারা আসে তারা জিতেই ফিরবে এক পয়সাও ঠকাতে পারবে না কোনো দোকানদার, এমনি বেশিরভাগ লোকের মুখচোখের ভাব। দোকানদারদের পারস্পরিক চোখ টেপাটেপিতে বোঝা যায় তারা কত না সুচতুর! আমি এসব চেয়ে চেয়ে লক্ষ্য করি। আর আমি বাজার গিয়ে জেনেবুঝেই ঠকি। তারা যে আমাকে মুরগি করছে সেটা যে আমি ধরে ফেলেছি, তারা বোঝে না। অথবা বুঝলেও তাদের কাঁচকলা! বেশি বুঝলেই বেশি লোকসান! বাজারের এ এক খেলা। খেলাটায় আমার মজাই লাগে। আমি ধরা দিই না।

(৫)

দাড়ি কাটছি। বারান্দায়। গ্রিলে ঝোলানো ছোটো আয়নার সামনে। অফিসে বেরব। দেরি হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে রিং হচ্ছে। অনেকক্ষণ রিং হয়ে বন্ধ হল। আবার বাজছে। ধরলাম।

অতনু?

বলছি। কে?

আমি নিধু রে।

ও: বল। আমার নাম্বার কার কাছ থেকে পেলি?

তুমিই দিয়েছিলে।

ও। আচ্ছা। তা কী ব্যাপার?

মা হাসপাতালে ভর্তি… কদিন ধরে

কী হয়েছে?

লিভার ক্যানসার

আমি কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না।

কিছু টাকার দরকার। অতনু— বলে নিধুর সে কী হাউমাউ কান্না।

কাঁদিস না।

নিধু কেঁদেই চলেছে।

দেখছি কিছু দিতে পারি কিনা।

কবে পাবো। কাল যাই তোমাদের বাড়ি? আমি চিনি। স্কুলে পড়তে বদাই একবার নিয়ে গেছিল, চিনিয়ে দিয়েছিল। তুমি সময় করতে না পারলে বোলো, চলে যাব।

না-না— আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠি। কাল অফিস থেকে ফেরার পথে— এটা তোর নাম্বার তো? আমি কল করে নেব— মা কোন্ হাসপাতালে?

নীলরতন।নিধুর নাম্বার সেভ করে স্নান করতে যাই।

(৬)

শানু। ছবি আঁকতে যেতাম একটা স্কুলে। ওর সঙ্গে সেখানেই আলাপ। আমি এখন আর ছবি আঁকতে যাই না। কিন্তু আমাদের যোগাযোগ আছে। চাকরি পেয়েছি সবে তখন। অফিস থেকে ফিরেছি। শানুর সঙ্গে দেখা। ফর্ম্যাল ড্রেসে তোমায় বেশ লাগছে! ও বলল। খুঁটিয়ে দেখছিল। আরিব্বাস, রেডটেপ! আমার নতুন জুতোজোড়া দেখে ওর প্রতিক্রিয়া ছিল এটাই। সেদিনই ঠিক করি শানুকেও রেডটেপের একজোড়া জুতো কিনে দেব। কিন্তু মাসের পর মাস যায়। এটা ওটায় মাইনের টাকা খরচ হয়ে যায়। কেনা আর হয়ে ওঠে না। গেল মাসে এল-আই-সি প্রিমিয়াম দেওয়া হয়ে গেছে। কিছু টাকা হাতে ছিল। এ মাসে ভেবেছিলাম সেটা দিয়েই শানুর জুতো কিনব। কিন্তু হায়, শানুর কপালে রেডটেপ এ মাসেও নেই! নিধুর ফোন রেখে দেবার পর আমার এই কথাটাই মনে হল।

ওয়াশরুম থেকে এসেছি। অফিস থেকে বেরব, ব্যাগে টিফিন বক্স ঢোকাচ্ছি নিধুর ফোন।

অতনু, সোদপুর কটায় ঢুকছ?

আটটা

ঠিক আছে… আমি ট্র্যাফিক মোড়ে দাঁড়াই?

ঠিক আছে। মা কেমন আছে?

অপারেশন হবে, টাকার দরকার— আবার কান্না। আমি ফোন ধরে আছি।

হাজার দুয়েক হবে? নাক টানে নিধু।

আশ্চর্য, শানুর জুতোর জন্যে ২৫০০ই সরিয়ে রেখেছিলাম।

ট্রেন থেকে নামব শানুর ফোন।

দাদা, কোথায়?

এই, নামলাম।

দেখা হতে পারে আজ?

তুই কোথায়?

কল্যাণ নগর মোড়ে।

থাকবি কতক্ষণ?

আছি।

থাক। আমি অটো ধরছি। যাচ্ছি।

কল্যাণ নগর অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে আমি। নিধুর ফোন। ফোন সায়লেন্ট মোডে রেখেছি শানুর সঙ্গে কথা বলার পর থেকে। পকেট থেকে বের করে দুবার দেখলাম। শানুকে কল করলাম। শপার্স স্টপের সামনে আয়। অটো থেকে নামার সময় ওকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়লাম। কাছে যেতে ও বলল, কী কিনবে?

দেখি।

কাউন্টারে ব্যাগ জমা করে ওয়ালেটটা নিয়ে নিলাম আর মোবাইল। তখন মোবাইল চেক করতে গিয়ে দেখি ১৬ টা মিসড্ কল নিধুর। দোকানে ঢুকে শানু আর আমি জুতো দেখতে লাগলাম। ফর্ম্যাল শু। আমার একটা জুতো পছন্দ হয়েছে। সাইজ কত? ওকে জিগেস করছি। কার? শানুও পাল্টা জিগ্যেস করল। তোর, হাঁদা।

দশ। দশ নাম্বার সাইজের জুতো এনে বললাম, পরে দেখ। কী করছো এসব! শানুর গলায় একটু সংকোচ। রেডটেপ। পছন্দ হচ্ছে না? খুব পছন্দ, কিন্তু… । আরে পরে হেঁটে দেখ। শানু হাঁটে। কি ঠিক লাগছে?

শানুর সঙ্গে ফিরি টোটোয়। স্টেশান হয়ে। ট্র্যাফিক মোড় যাই না। স্বদেশি মোড় দিয়ে ঘুরে বাড়ি ফিরি। স্বদেশির রাস্তাটা বেশ খারাপ। টোটোয় খুব ঝাঁকুনি হচ্ছে। মোবাইল চেক করি। মা ফোন করতে পারে। ফোন মোড চেঞ্জ করি। শানু আগেই নেমে গেছে। বাড়ি ঢুকছি, মা জানাল, নিধু বলে কেউ এসেছিল। আমার খোঁজে। পরেরদিন সকালেও এসেছিল ও। মাকে আগেই বলে রেখেছিলাম, বোলো আমি বাড়িতে নেই। অফিসের কাজে কলকাতার বাইরে গেছি।

(৭)

দুদিন গেছে তারপর। স্বদেশির মোড়ে একটা বিহারি ধাবায় চা খাচ্ছি। খাটিয়ায় বসেছি।

নিধুর ফোন।

ভাই, মায়ের অপারেশান করাতে পারছি না। কিছু টাকা জোগাড় করেছি। এখনও ২৫০০ মতো বাকি। তুমি কবে ফিরছ।

ঠিক বলতে পারছি না। কবে।

ধাবার পেছনেই একটা চুল্লুর ঠেক। নেশা করে লোকজন এসে ঢুকছে ধাবায়। তরকা রুটি খাচ্ছে। কেউ কেউ পার্সেল নিচ্ছে।

তুই এখন কোথায়?

নিধু খানিকক্ষণ চুপ। তারপর বলল—

ট্র্যাফিক মোড়। হঠাৎ কান্না। ভাই, ভাই রে, আমাদের কোনো শত্রুতা নেই— রেখা আর রেখার বরকে নিয়ে কথাটা তুই বলেছিলি, ভাই! আমি না! আমার ঘাড়ে চাপালি… রেখা থুতু ফেলল একদিন আমায় দেখে… সেই রাগে… আমি তিনমাথার মোড়ে… হিক্কা উঠছে নিধুর। ফোন কেটে গেল। আমি আস্তেসুস্থে চা খেতে থাকি। ফুঁ দিয়ে দিয়ে।

নিধু ভয় দেখাত। স্কুল ছুটির পর দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু ও কি সত্যিই রোজ গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত তিনমাথার মোড়ে? আমাকে একা ধরবে বলে? কোনোদিনও কেন নিধু আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা টের পেল না আমি অন্য রাস্তা ঘুরে ফিরছি? ধাবার পেছনে ঠেকে হঠাৎ চেঁচামেচি। এক মাতাল চেঁচাচ্ছে— আমার ঘরের চাবি? আমি ঢুকব কী করে, শালা?

আরেকজনের গলা— মাইরি! তোর ঘরের চাবি নিয়ে আমি কী করব?

নিয়েছিস বলেছি, বলেছি, দেখেছ? টেবিলে রেখে আমি কাউন্টারে গেলাম—। অন্যজন তাই শুনে খানিক ভাবল। ভেবে বলল। আমি তো কোনো চাবিই তোকে আনতে দেখিনি। তোদের পাশের বাড়ির একটা মেয়ে তোকে যখন দেখে তুই দেখতে পাস না, বুঝিস দেখছে, আবার তুই যখন দেখিস ওকে সে মোটেও তাকায়না। তারা কোথাও বেরলে তাদের বাড়ির চাবিই তোর মায়ের কাছে রেখে যায়। এই কথাই তো হচ্ছিল—

উঁকি মেরে দেখলাম। আমাকে দেখামাত্র একজন টলতে টলতে সরে গেল আরও পেছনের গলিতে। নিধু না? আমি উঠে এগোতে এলোপাথারি ছুটে অন্ধকারে মিশে গেল লোকটা।

(৮)

ঠেকের সেই মাতাল, যে বলেছিল, যা: বাবা, আমি কী করে জানব তোমার চাবি কোথায়… ওঁর কাছ থেকেই নিধুর ঠিকানা পেয়েছিলাম।

বিবির বাগানের কাছে নিধুদের টালির বাড়ি। গেলাম পরের দিন। এ দিকটা আগে কখনও আসিনি। কয়েকটা বাচ্চা রাস্তায় ডাংগুলি খেলছে। এটা বিবির বাগান? রিক্সো থামিয়ে জিগেস করি। হ্যাঁ। বাচ্চা ছেলেটা বলল। নিধু বলে কাউকে চেনো? ছেলেটা দুদিকে ঘাড় নাড়ল। চেনে না। পাশের একজন দোকানদার বেরিয়ে এসে বললেন, নিধু, কী? পরামানিক? আমি তো ওর পদবি জানি না। ভাবছি। পরামানিক হলে সামনের গলি দিয়ে যান। শেষ বাড়ি। পরামানিক ছাড়া আর কোনো নিধু এখানে থাকে কি না দোকানদারের কাছ থেকে জানা হল না। দরজায় ধাক্কা দিতে ভেতর থেকে কার গলা শোনা গেল। দরজাটা খুলবেন? দরজা খুলল। দরজায় দাঁড়িয়ে আমার মায়ের বয়সী একজন মহিলা। সামনে কিছুটা ঝুঁকে।

নিধু আছে?

কী দরকার । আমাকে বলতে পারো। আমি ওর মা।

কেমন আছেন এখন, মাসিমা?

না, আমার লিভার ক্যান্সার হয়নি। নিধু বলেছে তো তোমাকেও! কী চুপ কেন? পাওনাদার নও তো?

না, আমি অতনু, নিধু আর আমি প্রাইমারি স্কুলে একসঙ্গে পড়েছি।

রোজ দু চারজন পাওনাদার আসে। এই তো ছিল এখানে নিধু। ভেবেছে পাওনাদার এসেছে আবার.. কাছেপিঠেই কোথাও লুকিয়েছে। দেখোগে যাও পেছনের বাগানে হয়তো!

নিধু— ডাকি। আড়াই/তিনকাঠা জমির বাগান। এদিক ওদিক তাকাই; ঠান্ডা অনেক কমে এসেছে। ফাল্গুন পড়বে আর দিন কয়েকের মধ্যেই। সামনে একটা বড়ো সজনে গাছ। ফুলে ফুলে ভরে আছে । কত ফুল খসে ঘাসে পড়ে আছে। একটা পলিপ্যাক হবে? নিধুর মায়ের কাছে গিয়ে চাইলাম। কী করবে? সজনে ফুল নিয়ে যাব। এই সময় খুব বসন্ত হয়। মা বলে। সজনে ফুলের বড়া খাওয়া ভালো। হুমম… সজিনা ফুল, সজিনার ডাঁটা… তোমার মা ঠিক বলেন। এই নাও। নিধুর মা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট আমাকে দেয়।

প্যাকেটটা নিয়ে আমি সজনে গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান