ঝুল

সৌম্যদ্বীপ চক্রবর্তী

বাইরে কোনো শব্দ নেই, একটা গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না, শব্দ আছে ঘরের ভেতর। ঘর‍্ঘর‍্ ঘর‍্ঘর‍্ করে একনাগাড়ে হয়ে চলেছে, পুরনো সিলিং ফ্যানটা থেকে, যেন একই গান গাইছে পরপর ভাবে। খাটের চাদরটা হালকা উড়ছে ফ্যানের হাওয়ায়, তার ওপর বসে রাজুর ছেলে, কাঁচি দিয়ে কী একটা যেন সমান করে খুব মন দিয়ে কাটছে। ফ্যানের আওয়াজ আর কাঁচির শব্দ দুটো যেন ডুয়েট গানের মতো রাজুর কানে যাচ্ছে। ওদিকে রান্নাঘরে জল পড়া, খুন্তি নাড়া এসব তো রয়েছেই। ফ্যানের শব্দটা যেন সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে। চেয়ার ছেড়ে অসহ্য হয়ে বেরিয়ে গেল রাজু।

চিত্তই এখানকার একমাত্র হাতুড়ে গোছের মিস্তিরি। ছোটখাটো সব কাজ তার জিম্মায়। ফ্যানটা তখনও ঘুরছে, কিন্তু একটু সাজগোজ করেছে যেন। দেওয়ালের কোনায় কোনায় ঝুল, মাছ ধরার জালের মতো ঝুলছে। তার মধ্যেই এই ফ্যানটা… বিয়েতে কি দিয়েছিল… না কেনে? মনে পড়ে না। রাজুর ছেলে আঁকার খাতার পিছনের একটা ছবি আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছে ফ্যানের মধ্যিখানে। একটা গোল কাগজের চাক‍তি, চাঁদমালার মতো সাইজের, তাতে রামধনুর সব রং ভাগভাগ করে দেওয়া। ফ্যানের সাথে তারাও ঘুরছে। নীচ থেকে ওপরে ফ্যানের এই ঘুরন্ত চাকা নিয়ে যায় রাজুকে, খোলা মাঠ, সকলে দৌড়চ্ছে, হাতে সেই ঝাঁটার কাঠি দিয়ে তৈরি চরকি, এক পয়সা দু’পয়সার চরকি, তাতে লাগানো রংবেরংএর কাগজ। ছেলেরা দৌড়চ্ছে আর চরকি ঘুরছে, মেলার মাঝে নাগরদোলা ঘুরছে, রাজু শুয়ে মাটিতে, পড়ে গেছে, ঝন্টু তার উপর ঝুঁকে পড়ে দেখছে, তার হাতেও চরকি, তখনো রাজুর চোখের উপর বন্ বন্ করে ঘুরছে, থামতে থামতেই আবার হাওয়া, আলপিন বেঁকিয়ে ওগুলো জোড়া লাগানো কাঠিতে, জোরে ঘুরতেই কট‍্ কট‍্ করে আওয়াজ হচ্ছে। রেগুলেটর‍্টা আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিতেই ফ্যানটা জোরে ঘুরছে, আওয়াজটা আরো জোরে, ঘুরতে ঘুরতে যেন নামছে নীচে।

ঘরাঞ্চি নেই, প্রয়োজনও নেই, ঘরের কোণের একটু লম্বা টুলটা এনে দিল রাজুর বউ। আঁচল দিয়ে ঝুল ঝেড়ে রেখে দিল চিত্তর সামনে। ফ্যানটা বন্ধ করে দিল রাজু। চাকতি এখন স্থির। কয়েকটা কলকাঠি নেড়ে চিত্ত নীচের দিকে তাকিয়ে বলল, “কই সুইচ‍্টা দাও তো দেখি…” চোখ তার স্থির। রাজুর বউয়ের আঁচল বুকের কিছুটা নীচে, ওপর থেকে সুড়ঙ্গের মত খাঁজখানা স্পষ্ট। এ জিনিস আগেও দেখেছে, বহুবার দেখেছে, আজ রাতেও দেখবে।

এরা থাকত তখন চিত্তদের বাড়ির পিছন দিকে। দুপুর আলোয় কুল পাড়তে সবাই হাজির, কিন্তু গাছে উঠবে কে? চিত্ত! তিড়িং করে হনুমানের মতো প্রায় মগডালে। নীচে তখন সদ্য ফুটছে তার দেহ, ফ্রক জামাটা কিছুটা সাঁটতে শুরু করেছে তার গায়ে। পাকা দুটো কুল হঠাৎ হাত ফস্কে পড়ল তার ওপর। তার অবশ্য তখনও খেয়ালই হয়নি। কুল কুড়োতেই ব্যস্ত, “কিরে… ওই দিকের কুলগুলো আন…! পাকা হলদেটে রং ধরেছে রে… দেখ!” এরপর আরো কতবার কত কুল যে পাড়তে যায় দুপুর আলোয় তা কেবল কুল গাছটাই বোধহয় জানে। ফ্যানটা রাজুই চালু করল। এতক্ষণ বন্ধ থাকায় হালকা ঘাম জমে ছিল শরীরে, হাওয়া লাগতেই টের পায় আবার, নিজেকে একটু সামলে নেয়। চিত্তও ফ্যানের দিকে চোখ ঘোরায়। চাকতি আবার ঘুরছে।

টুলটা বেশ উঁচু। এখনো বেশ হনুমানের মত শক্তপোক্ত চেহারা রয়েছে ব্যাটার। সত্যিই গাছ হনুমান! কেমন তিড়িং করে উঠে পড়ত গাছে। ওপরের কুলগুলো পাড়তেই স্যান্ডো গেঞ্জির ফাঁক থেকে দেখা যেত পিঠের পেশীগুলো, দেখা যেত বুকের খাঁচাখানা। ইস্কুলের হাফপ্যান্ট খানার ইলাস্টিক কেটে যেত বেচারার মাঝেমধ্যেই, এত ছোটাছুটি করত! একদিন তো মগডালে উঠতে গিয়ে ফেঁসেই গেল প্যান্টটা পাছার কাছে, ভেতরটাতে কিচ্ছু নেই। ওফ! সে কী লজ্জা ওনার। এদিকে অন্যের বুকের দিকে চেয়ে থাকত কীরকম ভাবে! তখন লজ্জা নেই! এক লাফে সেদিন পুকুরে পড়ল আধল্যাংটো অবস্থায়। শেষে আবার আমাকেই গামছা আনতে হল, ভেজা গামছাটা পুরো গাখানা কামড়ে ধরেছে, আগে পিছে সব স্পষ্ট। এক দৌড়ে আমাদের বাড়ির উঠোন পেরিয়ে নিজের বাড়ি। চেহারাটায় আর আগের মত শ্রী নেই। রোদে ঘোরে তো খুব। স্যান্ডো গেঞ্জিটা পুরো পিঠের সাথে লেগে গেছে। কখন যে শেষ করবে কাজ কে জানে। একটু শরবত করে দিই বেচারাকে…


এক ফোঁটা ঘাম চিত্তর গা থেকে টপ‍্ করে কপালে পড়ল রাজুর বউয়ের, নেমে গেল তার ঠোঁট অব্দি।

কুলগাছ তলায় একলা দাঁড়িয়ে দুটো ছেলেমেয়ে। চারিদিকে বৃষ্টির ফোঁটা দাপাদাপি করছে। গাছের পাতার ফাঁক থেকে, কুলের গা বেয়ে জল পড়ছে। দু-এক ফোঁটা তাদের মাথায়, ঠোঁটে, বুকে। বৃষ্টির ছাঁটে ফ্রক জামাটা কিছুটা গামছার মতো ভিজে, হাফপ্যান্টটাও জল টানছে গাছের গা থেকে। গাছের ডালেই আবার মেলে দেয় রোদ উঠলে… পাশাপাশি ফ্রক আর হাফপ্যান্ট।

ফ্যানটা নাড়াচাড়া করায় কয়েক টুকরো ঝুল এসে পড়েছে বিছানার ওপর, এদিক সেদিক। রাজুর ছেলে বসে মাটিতে, ছবি আঁকছে আঁকার খাতার শেষ পাতায়। “কই নে এবার আরেকবার সুইচ‍্টা দে তো দেখি…” রাজুর ছেলের ছবি আঁকারই শুধু আওয়াজ, কাগজের ওপর খস‌্খস‌্ করে রং ঘষছে। সামনে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা লোক, হাতে তার একটা বড় রংবেরংএর চরকি। একটু দূরে একটা গাছের উপর বসে একটা হনুমান, প্রায় মগডালে উঠে হাত বাড়িয়ে ফল পাড়ছে, কয়েকটা ছুঁড়ছে নীচের দিকে। নীচে দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট মেয়ে, হাত বাড়িয়ে ফল লুফছে।

সুইচ‌্ দিতেই ফ্যানটা আবার চলতে শুরু করল। তবে এবার ঘরেও কোনো শব্দ নেই। বাচ্চাটার আঁকাও শেষ। ফ্যানটা আর শব্দ করছে না। রান্নাঘর থেকে গ্লাসে চামচ ঘোরাতে ঘোরাতে রাজুর বউ তিন গ্লাস শরবত নিয়ে এল। ফ্যানের হাওয়ায় অনেক দিনের জমে থাকা ঝুলগুলো উড়ে উড়ে পড়ছে বিছানার চাদরে, ঘরের এদিক সেদিক।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান