পার্থ ব্যানার্জি
ছয়ই জানুয়ারি নানা কারণে এক ঐতিহাসিক দিন। আমেরিকাতে ওয়াশিংটন ডিসিতে যে ঘটনা ঘটলো, তা আমেরিকার গণতন্ত্রের পক্ষে এক অশুভ সংকেত। ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী সমর্থকরা হাজারে হাজারে এসে ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে গিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলো। এই ঘটনা আমেরিকার ইতিহাসে বোধহয় এই প্রথম। আমরা যারা গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকার ও সারা পৃথিবীর রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছি, আমাদের কাছে এই ঘটনা ঐতিহাসিক, এবং একই সঙ্গে অতি বিপদজনক। কারণ একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গিয়ে কিছুতেই সেই পরাজয় স্বীকার করছেন না, এবং সারা দেশ জুড়ে তার সমর্থকদের প্ররোচিত করছেন সেই নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করতে, এবং সেই নির্বাচনের ফল যে কারচুপি— কোনো রকম তথ্য বা প্রমাণ ছাড়া সেই প্রোপাগান্ডা সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, এবং তার দক্ষিণপন্থী বাহিনী তাদের হাজার মিডিয়ার সাহায্যে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে একটা চরম হিংসা, ঘৃণা এবং অস্থিরতার পরিবেশ সৃষ্টি করছেন— এমন ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে আমরা কখনও দেখিনি।
ছয়ই জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকার ক্যাপিটল বিল্ডিং অর্থাৎ যেখানে আমাদের দেশের মতো সংসদ বা কংগ্রেস যেখানে সারা দেশ থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাদের অধিবেশন করার জন্য মিলিত হন, সেখানে যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের তত্ত্বাবধানে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন-এর পক্ষে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া চলছিল, সেই সময় ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ মদতে তার অতি দক্ষিণপন্থী বাহিনী ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
তারা তেমন কোন পুলিশি বাধার সম্মুখীন হয়নি যা অতি আশ্চর্য ব্যাপার। যদি এই ঘটনা এই বিদ্রোহ এবং এই বিক্ষোভ মিছিল ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার বা অন্য কোন আন্দোলনের দ্বারা সংগঠিত হতো, তাহলে পুলিশ মিলিটারি এবং সিক্রেট সার্ভিসের লোকেরা তাদের ঘিরে ফেলত, গ্রেফতার করত, এবং বড় ধরনের রক্তাক্ত সংঘর্ষ অনিবার্য ছিল— যেখানে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আহত বা নিহত হবার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকত। কিন্তু আজ অতি দক্ষিণপন্থী মিলিশিয়া, মাফিয়া এবং ট্রাম্পের সমর্থক নানা ধরনের চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা প্রায় বিনা বাধায় ক্যাপিটল বিল্ডিং-এর ভেতরে ঢুকে পড়ে তুলকালাম সৃষ্টি করতে সক্ষম হল।
এর থেকে প্রশ্ন জাগে, এই ঘটনা কি ভিতরকার কোনরকম যোগসাজশ বা পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া ঘটা সম্ভব? এই ঘটনা আরও প্রশ্ন জাগায় যে এই বিক্ষোভ এবং ক্যাপিটাল বিল্ডিং-এর ভিতরে ঢুকে পড়ে কংগ্রেসের এত বড় জরুরি অধিবেশন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া কি ভবিষ্যতে আরো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটার ইঙ্গিত বহন করছে? এবং ট্রাম্প ও তার অতি চরমপন্থী রিপাবলিকান সমর্থকরা যেভাবে আমেরিকা জুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলেছে তা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ধ্বংস করে দেওয়ার পূর্ব লক্ষণ?
ট্রাম্পের পিছনে কে কে কে জাতীয় চরমপন্থী হিংস্র শ্বেতাঙ্গ শক্তিগুলি কাজ করছে তা আমরা গত চার বছর ধরে দেখে আসছি। আমেরিকার কোণে কোণে তাদের হিংস্র নখদন্ত নতুন করে জেগে উঠেছে। অতি দক্ষিণপন্থী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি এবং তাদের হাজার মিডিয়া ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে। এরা কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে, ইমিগ্র্যান্টদের বিরুদ্ধে, এবং সমস্ত সংখ্যালঘু শ্রেণীর বিরুদ্ধে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে চায়। এরা হিটলার ও মুসোলিনির সমর্থক। এরা গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, শুধুমাত্র ক্ষমতায় আসার প্রয়োজনে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতাকে ব্যবহার করে।
ঠিক যেমন ত্রিশের দশকে জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসোলিনি ব্যবহার করেছিল। তার পরের ঘটনা আমরা সকলেই জানি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, এবং লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষের মৃত্যু। হলোকস্ট এবং কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প। আজ আমেরিকাতে ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ মদতে এবং তার রিপাবলিকান পার্টির জঙ্গি অতি-রক্ষণশীল সমানাধিকার-বিরোধী, বিজ্ঞানবিরোধী, নারীস্বাধীনতা-বিরোধী যেসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠী হিংসা ও ঘৃণা ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে ভারত, ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা এবং সারা পৃথিবীর সমান্তরাল ফ্যাসিস্ট, নাৎজি ও এই ধরনের চরমপন্থী শক্তিগুলি।
আজ যদি আমেরিকাতে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যায়, এবং ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলি যদি ভবিষ্যতে চরম ভায়োলেন্সের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে, তাহলে তা আগামী দিনে সমগ্র পৃথিবীর ধ্বংসের বার্তা বহন করে আনবে— যে বার্তা আজ আমরা ব্রাজিল, ভারত এবং আরো কিছু কিছু দেশে দেখতে পাচ্ছি। রাশিয়াতে পুতিন, তুরস্কে এরদোগান, ভারতে চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী শক্তি, বাংলাদেশ-পাকিস্তানের চরমপন্থী ইসলামিক শক্তি, এবং ইউরোপের বেশ কিছু দেশে হিংস্র রাজনৈতিক শক্তিগুলো আজ গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিতে এবং স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে উদ্যত। তারা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে আমেরিকার ঘটনাবলীর দিকে।
সেই একই দিনে আমেরিকার দক্ষিণে রক্ষণশীল জর্জিয়া রাজ্যে দুই প্রার্থী ডেমোক্রেটিক প্রার্থী সেনেট নির্বাচনে বিজয়ী হলেন। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণাঙ্গ প্রার্থী রেভারেন্ড রাফায়েল ওয়ার্নক। সেনেট নির্বাচনে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে কখনো কোনো কৃষ্ণাঙ্গ বিজয়ী হন নি। এ আর এক বিশাল ইতিহাস। এখন শোনা যাচ্ছে, জর্জিয়াতেও ট্রাম্পের জঙ্গি বাহিনী নানা সমস্যার সৃষ্টি করতে চলেছে, কারণ তারা এই ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
আমেরিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসের কতগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আমরা নিজের চোখে দেখে গেলাম। বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাস থেকে আজ পর্যন্ত যেসব ঘটনা চোখের সামনে ঘটে গেল, ভবিষ্যৎই কেবলমাত্র তার মূল্যায়ন করবে।
আমেরিকার গণতন্ত্রপ্রিয়, শান্তিপ্রিয় ৯৯% সাধারণ মানুষ যদি ট্রাম্প বাহিনীর এই আক্রমণ প্রতিহত করে আধুনিকতা ও প্রগতির মশাল বহন করে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রপ্রিয়, শান্তিপ্রিয় ৯৯% মানুষ আশার আলো দেখবে।
আর যদি না পারে, তাহলে পৃথিবীর ধ্বংস ত্বরান্বিত হবে।