সুস্মিতা পাল (চৌধুরী)
করোনা কালে কিছু জানি না জানি, বুঝি না বুঝি, একটি শব্দবন্ধ মুখে মুখে। খবরের কাগজে, দূরদর্শনে, ফেসবুকে আর শক্তিশালী পাঠশালা হোয়াটস্অ্যাপে। social distancing। বাংলায় আমরা তার সরাসরি অনুবাদ করেছি ‘সামাজিক দূরত্ব’। তোমার house hold-এর, পরিবারের, বাড়ির সদস্য নয় এমন ব্যক্তির থেকে ন্যূনতম ৬ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অবশ্যকর্তব্য আমাদের সবার। নিজেকে, পরিবারকে, সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে দূরে দূরে থাকতেই হবে আমাদের। ফিতে, রুলের প্রয়োজন নেই। ওই নিজের হাতকে কল্পনায় দুই দিয়ে গুণ করলে ৬ ফুট হয়ে যাবে। এ এক একবিংশ লক্ষ্মণগণ্ডি! বাইরে বেরোলেই বিপদ। কোভিড রাক্ষস অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ফাঁদ পেতে। আমরা বিজ্ঞানের সমর্থন, রাষ্ট্রের ঘোষণাকে হাতিয়ার করে সিংহ থেকে খিড়কি দুয়ার তাই বন্ধ করেছি অসংকোচে, নির্দ্বিধায়। বাঁচাটাই তো আসল। তাই তফাত যাও মানুষ। গরমজলে আপাদমস্তক আত্মকে (খবরদার আত্মাকে নয়)পরিশুদ্ধ করো। দূর হটো ভাইরাস। নাম তার কোভিড-উনিশ।
এখন যখন তালা খোলা সময়ে একথা লিখছি, ভাবছি , ‘সামাজিক দূরত্ব’ এ আর এমন নতুন কথা কী! আমরা তো এমনিতেই অ-সামাজিক। সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টা৩০-এর মেগা সিরিয়াল ছাড়া আমরা কে কে সামাজিক? মানে, সিরিয়ালে সবাই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ডায়লগ বলে। কতিপয় দেখে। সামাজিক দূরত্ব, বলা ভালো মনের দূরত্বের চর্চা আমরা বহু বছর ধরেই করে চলেছি।মা-বাবা ভাই-বোন বন্ধু-বান্ধবী যেন কেউ কারো নয়। দূরত্ব আর দূরত্ব। আর্থিক দায়ভার, কর্তব্য-দায়িত্ব মাঝে এসে দাঁড়ালে এযাবৎ কে বা কার ছিলাম? আত্মীয় বাড়িতে আসবে— না, রে তখন আমরা out station এ থাকব বোধহয়। পাশের বাড়িতে Ambulance— উফ্! এসব দেখলেই আমি ডিপ্রেশনে ভুগি। Alzolam 0.25 খাই যে প্রতিদিন। ঘুম আসে না। অথবা, পোস্টম্যানের জিজ্ঞাসা— তরুণ বিশ্বাসের বাড়িটা কোথায় যদি একটু বলেন— ভাই, আমি না ঠিক বলতে পারব না। আসলে নিজের এত কাজ। দুই বাহু যোগ করে না হোক, পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি থেকেও আমরা কি সামাজিক নৈকট্যে ছিলাম, অথবা, মানসিক?
মাধ্যমিক পাঠ্যসূচিতে ছিল ‘ঘর ও বাহির’। পড়েছিলাম ছোটো রবির কথা। ভৃত্য শ্যাম নিজের কর্তব্য দায়িত্ব সহজ করার জন্য রবির চারপাশে খড়ির গণ্ডি কেটে দিতেন। গন্ডির বাইরে বেরোলেই বিপদ। সীতাহরণের আদি ভৌতিক ভয় মন গ্রাস করে রাখত। এখন তো আবার রাবণরাজা সাক্ষাৎ এসে হাজির ঘরে বাইরে। রাবণের তো জানি দশটা মাথা। তার একটা নয় কোভিড-১৯। কিন্তু, আরো নয়টি বরাবরই ছিল। স্বার্থপরতা, কূপমন্ডূকতা, উচ্চাশা, লোভ, পরশ্রীকাতরতা— কতশত মাথা আত্মকেন্দ্রিকতার সীমায় আমাদের আটক করে রেখেছে দশকে শতকে। শুধু শুধু কোভিডের নামে সামাজিক দূরত্বের লেবেল সেঁটে কী লাভ!
পিঞ্জরাবদ্ধ রবি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর আজীবনের বন্ধু প্রকৃতিকে। শ্যামের গণ্ডিতে আটক রবিকে প্রকৃতি নানা ইশারায় ডাক পাঠাত। খাঁচার পাখিকে বনের পাখি ঘননীল আকাশে পাখা মেলে ওড়ার আহ্বান জানাত। কিন্তু, হায়! আজ লকডাউনে বন্দি নাগরিক আমাদের ডাক পাঠায় Amazon, Flipkart ঘোষিত রোমহর্ষক ‘ডিল’। গ্যাজেট, ফ্যাশানে অবিশ্বাস্য ছাড়ে সুখের ঠিকানা খুঁজে চলেছি। চারপাশের অভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকের কৃষকের মজুরের জীবনযন্ত্রণা, অসহ টিকে থাকাতে নির্লিপ্তি রপ্ত করে ফেলেছি। social distancing কবেই যে সম্পূর্ণ হয়েছে। যত দায় তাই ‘করোনা-গো-করোনা’ নয়।
সুতরাং,পরিপাটি খাঁচার ‘নিরালা সুখকোণে’বেশ ছিলাম। কোভিডাক্রান্ত সময় চোখে আঙুল প্রসারিত করে দেখিয়ে দিচ্ছে, ভালোই আছি। দূরে দূরে। অদৃশ্য পি.পি.ই. কিটে সর্বাঙ্গ ঢেকে। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উঠে চলেছি। তবু যে কেন মাঝে মাঝে অবুঝ শূন্যতা ছেয়ে থাকে আমাদের। হয়তো পসারির সুর ভেসে আসে কোনো এক নিভৃতে—
“চাই, চুড়ি চাই, খেলোনা চাই…….”
সৌজন্যে: EXPLORA-V VIRTUAL VERSATILITY 2020-21