গোবিন্দ সামন্ত: কৃষক আন্দোলনের এক অর্বাচীন ইতিহাস

নীলাদ্রি নিয়োগী

করোনাকালেই ভারতবর্ষ এক নতুন তামাশার সাক্ষী হল। তামাশাটি হল— কেন্দ্রীয় সরকারের আনা নয়া কৃষি বিল। আদ্যন্ত কৃষক-স্বার্থবিরোধী, কর্পোরেটের পক্ষপাতদুষ্ট বিলটির প্রতিবাদে চুপ থাকল না কৃষক সমাজও। পঞ্জাব, হরিয়ানা থেকে শুরু করে দেশের প্রায় প্রতিটা প্রান্তের কৃষক ভাইবোনেরা তো বটেই, দেশের নাগরিক সমাজও গর্জে উঠল এই কালা আইনের বিরুদ্ধে। কী এই কৃষি বিল? কৃষকদের দাবিই বা কী, সে বিষয়ে ‘অভিক্ষেপ’-এর এই সংখ্যায় একাধিক তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ রয়েছে। আমরা তাই সেই প্রসঙ্গে পুনরুক্তি না করে বরং চোখ রাখব এমন একটি গ্রন্থে, যা ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে লিখিত, প্রকাশিত এবং বহুপঠিত হয়েছিল। গ্রন্থটি— রেভারেন্ড লালবিহারী দে রচিত ‘গোবিন্দ সামন্ত’। বইটি বর্তমানে প্রাসঙ্গিক, কারণ, প্রাক-স্বাধীনতা আমলের কৃষক আন্দোলনের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে।

গ্রন্থটি রচনার প্রেক্ষাপটে একটি নাতিদীর্ঘ পুরস্কারের ইতিহাস রয়েছে। ১৮৭১ সালে উত্তরপাড়ার বিখ্যাত জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ‘Social and Domestic Life of the Rural Population and Working Class of Bengal’—বিষয়ে রচনার জন্য পাঁচশো টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্যই লালবিহারী দে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে লেখেন ‘Bengal Pessant Life’। পরবর্তীতে সেই রচনাকেই পরিমার্জিত করে দু’খণ্ডে প্রকাশ করেন এবং নাম দেন ‘Govinda Samanta’। ইংরাজি ভাষায় রচিত এই গ্রন্থটি পরবর্তীতে বাংলায় অনুবাদ এবং বহুল জনপ্রিয় হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রাগুক্ত প্রতিযোগিতায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু শ্রেষ্ঠ রচনার পুরস্কার পান লালবিহারী দে।

বাংলার নিপীড়িত ও অত্যাচারিত রায়ত বা কৃষক সম্প্রদায়ের প্রতি লালবিহারী দের অকৃত্রিম সহানুভূতি ছিল। এই বঞ্চিত কৃষকদের পক্ষ নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু মিত্র, সঞ্জীবচন্দ্র, রমেশচন্দ্র প্রমুখ সকলেই কিছু না কিছু রচনা করেছেন। লালবিহারী দে, উপরন্তু, চাষি সমাজে যাতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলিত হয়, তার জন্য নানাবিধ চেষ্টাও করেছেন। খুব কাছের থেকে দেখেছেন এই কৃষক সমাজের ওপর নেমে আসা নানান অন্যায়-অবিচার। তারই বৌদ্ধিক প্রতিফলন এই ‘গোবিন্দ সামন্ত’।

দুই খণ্ডে সমাপ্ত এই গ্রন্থটির প্রথম খণ্ডে রয়েছে কাহিনির প্রোটাগনিস্ট গোবিন্দর পরিবারের  ইতিবৃত্ত; তার পাঠশালায় সংক্ষিপ্ত ও অসমাপ্ত শিক্ষার বর্ণনা এবং গোবিন্দর পরিবারের একাধিক সদস্যের বিবাহ, মৃত্যুর সংবাদ। এ ছাড়াও এই খণ্ডের বিভিন্ন অধ্যায়ে তৎকালীন বাঙালি কৃষক পরিবারগুলির নানান রীতিনীতি, উৎসব-অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে হিন্দু বিধবার চালচিত্র, গ্রামীণ হাটের বর্ণনা, নবান্ন উৎসব ও অন্যান্য চাষ আবাদের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ এবং হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় চিন্তা চেতনার চমৎকার প্রকাশ দেখা যায়। কিন্তু আমাদের আলোচ্য বিষয় যেহেতু কৃষক আন্দোলন সম্পর্কিত, ফলে আমরা এই খণ্ডটি একটু দ্রুত পাঠ সেরে নিবিড় পাঠের অন্তর্ভুক্ত করতে পারি বরং দ্বিতীয় খণ্ডটিকে। কী আছে এই খণ্ডটিতে? এখানে আমরা দেখব, শাসকের চেহারা দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে যতই বদলাক না কেন, বদলায়নি শাসিতের শোষিত হওয়ার চিরকালীন ইতিকথা! ভূস্বামী ও নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচারের নিপুণ বিবরণই এই খণ্ডের মূল উপজীব্য। গোবিন্দ ও অন্যান্য রায়তদের প্রদেয় ভূমিকরের অতিরিক্ত একটি অন্যায্য ট্যাক্স বসান জমিদার জয়চাঁদ চৌধুরী,যাকে বলা হয় ‘মাথট’। জমিদারের পুত্রের বিবাহ উপলক্ষে কৃষকদের দিতে হবে এই কর। গোবিন্দ এই বাড়তি পাঁচ টাকা সেই মুহূর্তে দিতে পারবে না জানানোয় তার ওপর শুরু হয় লাঞ্ছনা ও অত্যাচার। কয়েকজন নিকট বন্ধুকে পাশে পেলেও সার্বিক ভাবে সকল গ্রামবাসীদের সমর্থন না পাওয়ায় কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে না তারা। বরং তাদের এই অসফল প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ প্রতিহিংসাপরায়ণ জমিদার গোবিন্দর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। সেই ঘর নতুন করে তৈরি করার জন্য গোবিন্দদের গিয়ে পড়তে হয় সুদখোর মহাজনের খপ্পরে। এই মহাজন শ্রেণির মানুষেরাও অত্যন্ত ধূর্ত ও সুযোগসন্ধানী। তারা জানে যে নিপীড়িত দরিদ্র জনগণ একান্ত বাধ্য হয়েই তাদের কাছে এসে থাকে। তারাও সুযোগ বুঝে অসহায় সেই মানুষগুলোকে ঋণের জালে আটকে ফেলে যাবতীয় সম্পত্তি গ্রাস করে নেয়।

অন্যদিকে গোবিন্দর দিদি মালতীর স্বামী মাধবের জীবনে নেমে আসে অন্যতর এক জটিল সমস্যা। নীলকর সাহেবের খপ্পরে পড়ে বেচারা। কুঠিয়াল সাহেবের নাম জন মারে। তিনি মালিক নন, ম্যানেজার। দোর্দণ্ডপ্রতাপ এই নীলকর সাহেবের অত্যাচারে গ্রামবাসী থরহরিকম্প। রায়তদের সে জোর করে নীলের চুক্তিতে আবদ্ধ করে, গরীব ও অসহায় চাষিদের জমি জোর করে কেড়ে নিয়ে নীল বোনে, অনেকের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, অবাধ্য চাষিদেরকে কুঠিতে তাদের আটকে রাখে, এমনকি গ্রামে গ্রামে প্রয়োজনে লুঠতরাজও করে। মাধবের বাবা কেশব একবার নীলের দাদন নিয়েছিল। সেই ঋণ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে যেমন, তেমনই সেই ঋণ টাকা দিয়েও মকুব করা যায় না। নীলকর সাহেবরা টাকা নিয়ে ঋণ শোধ করতে দিতেন না। তারা জোর করে নীলের চাষ করাতেন। তৎকালীন পুলিশ থেকে শুরু করে ম্যাজিস্ট্রেট, অর্থাৎ প্রশাসনের নিচতলা থেকে ওপরতলা পর্যন্ত সকলেই প্রায় ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা নীলকর সাহেবদের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের সুবাদে অথবা ঘুষ নিয়ে চাষিদের বিরুদ্ধেই সাধারণত অবস্থান নিতেন। মাঝখান থেকে ভুগতে হত চাষি ও তাদের পরিবারের। মাধবের পরিবারও এইভাবেই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মাধবকে ‘সাত কুঠির জল খাওয়ানো’ হয় অর্থাৎ তাকে একের পর এক কুঠিতে ঘুরিয়ে, অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়। সেই সময় কিছু ব্যতিক্রমী জমিদারও ছিলেন, যারা কৃষকদের পক্ষ নিয়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। কিন্তু একে তো তারা ছিলেন প্রয়োজনের তুলনায় সংখ্যায় নেহাতই নগণ্য; তার ওপর ব্রিটিশ প্রশাসন নানান ছলছুতোয় তাদের লড়াইকে দমন করে জয়যুক্ত করত তাদের স্বদেশীয় নীলকর সাহেবদেরকেই। বিদেশে কৃত্রিম ভাবে নীল প্রস্তুত হওয়ার আগে পর্যন্ত এভাবেই দেশের কৃষকদের নীলকরদের অত্যাচার সহ্য করতে হত।

গ্রন্থের একদম শেষ অংশে আমরা দেখব, ঘরের সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় দলিল পুড়ে যাওয়ায় গোবিন্দকে খুব সহজেই তার অত্যাচারী জমিদার বকেয়া ঋণের জালে ফেলে সমস্ত সম্পত্তি দখল করে নেয়। বাধ্য হয়ে ভূমিহারা কৃষক গোবিন্দকে পরিণত হতে হয় শ্রমিকে। সেখানেই, নিজস্ব ঘর থেকে বহুদূরে, গতস্বাস্থ্য গোবিন্দ, একের পর এক আঘাতে জীর্ণ হয়ে অবশেষে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে এই গ্রন্থটি হঠাৎ প্রাসঙ্গিক কেন? জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার নিয়ে তো বাংলায় বহু কাহিনি রচিত হয়েছে! আসলে একদিকে সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচার, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নানাবিধ চক্রান্ত, যুগপৎ এই দুই অনাচারের কবলে পড়ে তৎকালীন কৃষক সমাজ যেভাবে নিষ্পেষিত হয়েছিল, তারই এক সত্যনিষ্ঠ ও মূল্যবান দলিল এই গ্রন্থ। বর্তমান ভারতেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের, বিশেষত কেন্দ্রীয় সরকারে অধিষ্ঠিত সর্বভারতীয় একটি দলের নেতা মন্ত্রীদের উগ্র ফিউডাল মনোভাব এবং একই  সঙ্গে নির্লজ্জ কর্পোরেট তোষণ হঠাৎই পঞ্জাবের কোনও সম্পন্ন কৃষককে আর দাওয়ায় বসে নিবিষ্ট মনে তামাক সেবনরত গোবিন্দকে দেড়শ বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও কীভাবে যেন এক ব্র্যাকেটে এনে দেয়…

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান