কঙ্ক ঘোষ
ঘন পাহাড়ি জঙ্গল। দূর থেকে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে এক খরস্রোতা নদীর বয়ে যাওয়ার শব্দ। সন্ধে নামছে আস্তে আস্তে। গহন নিভৃতে প্রকাণ্ড, বিশালাকৃতি গাছগুলোর দীর্ঘশ্বাসের আবহসঙ্গীত। তবু জঙ্গলে শান্তি নেই। ভারসাম্যের অভাব। হরিণরা রয়েছে বেজায় ভয়ে। শোনা যাচ্ছে সরকারি ঘোষণা— বেশ কিছু বাঘ এবং সিংহ এই জঙ্গলে ছাড়া হবে। শোনা যায় আগে এই বাঘ, সিংহদের রাখা ছিল প্রাসাদপ্রতিম চিড়িয়াখানায়; সেখানে তাদের দেওয়া হত ভালো মন্দ খাবার। অতিকায়, বিশেষ পরিচর্যায় পুষ্ট এই অল্প কিছু বাঘ, সিংহের দল এবার পা রাখবে তাদের জঙ্গলে। হরিণরা ভালো করেই জানে একটাই পরিণতি— আত্মসমর্পণ। খুব সোজা হিসেব। বাঘের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সে হরিণদের গিলে ফেলবে। জঙ্গলে থাকার দ্বিতীয় কোন অপশন নেই। খাদ্য-খাদকের এই পারস্পরিক সম্পর্ক হরিণ, বাঘ থেকে দুটো ভিন্ন প্রজাতির মানুষে রূপান্তরিত হলেও গল্পের সারকথা খুব একটা পরিবর্তিত হয় না। একদল মানুষ খর্বকায়, পরিশ্রমী, পূর্বপুরুষের নেই-রাজ্যের বা যৎসামান্য উত্তরাধিকার নিয়ে রোদে পোড়া শরীরে দাঁড়িয়ে থাকা মনুষ্যেতর কোনো জীব। মুখে কাতর আর্তি। ঋণমাফের করুণ আর্জি। আরেকদল স্যুট, ব্যুট পরিহিত অতিমানবিক কর্পোরেট। গায়ে গুচি-র স্যুট, পকেটে ম.ব্ল-র পেন, সঙ্গে লুই ভুইতঁ-র ওয়ালেট, মাথায় ‘মহাপ্রভু’-র আশীর্বাদ। আপনিও জানেন এই নিওলিবেরাল আবহে কোনো থ্রিলিং ক্লাইম্যাক্স অপেক্ষা করছে না। মনুষ্যেতর প্রাণীরা নিয়মমাফিক অতিমানবিক বিজনেস মডেলের সামনে আত্মসমর্পণ করবে। কখনো সোজাসুজি, কখনো ধাপে ধাপে। কখনো ঘরবাড়ি জমি জমা বেচে, কখনো কৃষিকাজ ছেড়ে শহরে নতুন জীবিকার খোঁজে, কখনো ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করে। গুটিকতক ‘অতিমানবিক’ প্রাণীর প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশনের অরগ্যাজমিক আনন্দের মূল্য দিতে হবে ওই ‘মনুষ্যেতর’ শ্রেণিকে। মহাপ্রভুর বজ্রনির্ঘোষ শোনা যাবে তারে-বেতারে… ‘বলিদান দেনা হোগা’। পড়ন্ত বিকেলে কৃষক কর্পোরেটের মুখোমুখি, ডেভিড-গোলিয়াথের দ্বৈরথের অত্যন্ত প্রেডিকটেবল সমাপতন দেখেও আপনি চুপ করে মেনে নেবেন এবং ইতিহাসের অনিবার্যতা ধরে নিয়ে এগিয়ে যাবেন। আপনার অবচেতন গোলিয়াথকে বসিয়েছে চালকের আসনে। ডেভিড তাই খোঁচা দাড়ি, ঝোলা ব্যাগ নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে হতাশার আলপথ ধরে এগিয়ে যায়। গোধূলির আলো ঠিকরে পড়ে ওই অতিমানবিক কর্পোরেটদের ‘জাগুয়ার’ গাড়িতে। গাড়ির সামনে উল্লম্ফিত জাগুয়ার দখলের স্বপ্ন দেখে। অসম ঔদ্ধত্য। নেগোসিয়েশনের বল থাকে কর্পোরেটের কোর্টে। কৃষকের দু হাত জোড় হয়ে আসে। বশ্যতা স্বীকারের তাড়নায়। ওয়াকওভার পেয়ে উল্লম্ফিত জাগুয়ার স্মিত হাসে।
যদিও আদতে আপাত সরলীকৃত এই ছবিই শেষমেশ ভবিতব্য, তবু কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেটাইজেশনের প্রভাব বিস্তারের ইতিহাস, গতিপ্রকৃতি ঘাঁটতে গেলে বেশ জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। কৃষি ও কর্পোরেটাইজেশনের অন্তর্বর্তীকালীন সম্পর্ক ও বিন্যাস বহুমুখী। অজস্র স্তরে বিভক্ত। নয়া-উদারবাদের (নিও-লিবেরালাইজেশনের) ভূত মানুষের ঘাড়ে চাপার পর অন্তর্বর্তী সমীকরণগুলো বেশ গুলিয়ে, পেঁচিয়ে জটিল আকার নিয়েছে। বাইরে থেকে আপাত-সুখদায়ক একটা ছবিকে ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে ঢোকানো হল। কর্মসংস্থান মানেই বেসরকারিকরণ। উন্নত দেশগুলোর এই নয়া-উদারবাদী চিন্তার ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠল দ্বিতীয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। Foreign direct investment (FDI) যেন এক মায়াবী জাদুদণ্ড। গণতন্ত্রের মধ্যে খুব নিপুণভাবে সমন্বিত হল এই নয়া-উদারবাদ। বেসরকারিকরণ ধীরে ধীরে একটা সুসংহত লিগ্যাল স্ট্রাকচারের দিকে চালিত হল। প্রফিট-লসের দৌরাত্ম্যে অচিরেই মুষ্টিমেয় কিছু এই ধরণের স্ট্রাকচারড সংস্থার হাতেই ক্ষমতা কুক্ষিগত হল। বিশ্বায়নের আপেল খুড়োর কলের মত ঝোলানো হল মানুষের কাছে। বিজ্ঞাপণ সংস্থা নিয়োগ করল স্মার্ট, বুদ্ধিমান, শৈল্পিক মনন। তাঁদের তৈরি বিজ্ঞাপণের মোহমেদুরতা আমার, আপনার মস্তিষ্কে তৈরি করল কৃত্রিম ‘ডিম্যান্ড’। আমাদের চোখে তখন বিদেশি ব্রান্ডের জামাকাপড় কেনার ‘অ্যাম্বিশন’। আমাদের চোখে তখন হলিউড নায়কের ব্র্যান্ডেড অন্তর্বাস পড়ার স্বপ্ন। তরুণদের চোখে মুখে entrepreneur হবার ইচ্ছা। যুবকরা দেখল পাড়ার ঠেলাগাড়ির চপ-বিক্রেতা কাকু আমেরিকা গিয়ে নতুন দোকান খুলতে পারল না। আমেরিকার ‘ম্যাক-ডি’ কাউন্টার খুলে ফেলল আমাদের ছোটো শহরে! গ্লোবালাইজেশনে তবে যে সবাই পৃথিবী জুড়ে অবাধ বাণিজ্য করতে পারবে, এমনটা না, হতে হবে বড়ো পুঁজিপতি, ডাকসাইটে entrepreneur; তবেই ভাগ্য ঘুরবে। এক লার্জার দ্যন লাইফ ইমেজ তৈরি হল কর্পোরেটদের। সমাজ স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হল। আমরা প্রবেশ করলাম কর্পোরেট দাসত্বের এল ডোরাডোয়।
বাকি সমস্ত সেক্টরের মতো কৃষিকাজও পড়ল কর্পোরেটাইজেশনের কবলে। কৃষিকাজের প্রতিটা ধাপকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করল কর্পোরেটাইজেশন। এখানে প্রাইভেটাইজেশন আর কর্পোরেটাইজেশনের সূক্ষ্ম পার্থক্য বুঝে নেওয়া যাক। প্রোগ্রাম অন ওয়াটার গর্ভনেন্স-এর ডিরেক্টর, ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কারেন বাক্কেরের [১] বিশ্লেষণ অনুযায়ী প্রাইভেটাইজেশন অর্থে বোঝায়, মূলত মালিকানার হাতবদল— সরকারি থেকে বেসরকারি সেক্টরে। অন্যদিকে এই মালিকানা হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে যদি প্রাতিষ্ঠানিক গুণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যায় বাণিজ্য-নীতি (কার্যকরতা নির্ভর), পদ্ধতিগত কাঠামো (কস্ট বেনিফিট অ্যাসেসমেন্ট) এবং মুখ্য উদ্দেশ্যের (প্রফিট-ম্যাক্সিমাইজেশন) প্রেক্ষিতে, তখন এই মালিকানার এক পৃথক আইনি সত্তা (legal entity) তৈরি হয় যাকে কর্পোরেটাইজেশন বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, প্রাইভেটাইজেশন হল মালিকানার হস্তান্তর; আর সেই হস্তান্তরিত মালিকানা প্রফিট-ম্যাক্সিমাইজেশনের ভিত্তিতে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের ফলে এক স্বতন্ত্র আইনি সত্তায় রূপান্তরের ঘটনাকে কর্পোরেটাইজেশন ধরা যেতে পারে। এখন ফসল রোপণ করা থেকে ফসল ফলানোর পুরো কৃষিকাজের পদ্ধতিকে মূলত এই কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে— ১) বীজ কেনা ও বীজ বপনের ধাপ ২) ফসল বোনার জন্য সার, কীটনাশক ব্যবহার ৩) কৃষিকাজে যেকোনো যন্ত্রাদি ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং ৪) চাষের জমিতে জল সরবরাহ। এই প্রতি ধাপে কর্পোরেটাইজেশন অনুপ্রবেশ করেছে এবং তার প্রফিট বজায় রাখার খেসারত দিতে হয়েছে কৃষকদের।
কৃষিকাজের প্রথম ধাপ হল বীজ বোনার প্রক্রিয়া। এই বীজ বোনার প্রক্রিয়ায় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সঠিক সময়ে সঠিক খাদ্যশস্যের বীজ রোপণ করা। সাধারণত, ভারতবর্ষে গম, ডাল, বার্লি, সর্ষের মতো রবিশস্যের বীজ বোনা হয় শীতকালে এবং ফসল কাটা হয় বসন্তে। অন্যদিকে ধান, ভুট্টা, তুলো, সয়াবিন ইত্যাদি খারিফ শস্যের বীজ বপন কাল বর্ষাকালের শুরুর দিকে এবং ফসল কাটার সময় মোটামুটি সেপ্টেম্বরের শেষ বা অক্টোবরের শুরুতে। অবশ্য বিভিন্ন অঞ্চলে মনসুন বৃষ্টির তারতম্যের জন্য ফসল বোনা এবং ফসল কাটার সময় আলাদা হয়ে থাকে। ভারতবর্ষের আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটির চরিত্রের বহুবিধ বৈচিত্র্যের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক, জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন ধরণের বীজ ও শস্য রোপণের চল ছিল। এই ক্রান্তীয় জলবায়ুর দেশে এক সময় প্রায় এক হাজার বিভিন্ন ধরণের চালের উৎপাদন হত। ক্রমে ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব এবং সংশ্লিষ্ট যন্ত্রব্যবস্থার উন্নতি ধীরে ধীরে শ্রমিকের শ্রমের প্রতিস্থাপক হয়ে দাঁড়ায়। যন্ত্রের ওপর নির্ভরতা সেদিক থেকে আধুনিক কর্পোরেট স্ট্রাকচারের পূর্বসূরি বা precursor ধরা যেতে পারে। শিল্পবিপ্লবের পরপরই ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে গঠিত হয় ‘আসাম টি কোম্পানি’, যারা চা-চাষ নিয়ন্ত্রণ করত। শুরু হয় পাট এবং চা-এর মতো অর্থকরী ফসলের ওপর কর্পোরেট ধাঁচে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ। ৫০-৬০-এর শেষদিকে পৃথিবী দেখল গ্রিন রেভোলিউশন। প্রযুক্তিগত উন্নতি কৃষিকাজে যেমন ফলন বাড়াল তেমনি নিয়ে এল একাধিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ১৯৮৮-তে ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত হল নতুন সিড ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট পলিসি, যেখানে বেসরকারি সেক্টরকে উৎসাহিত করা হল বিনিয়োগের জন্য। পুঁজিবাদী আদর্শের বাণিজ্য নীতি, পদ্ধতির তিনটি মূল মন্ত্রই হল সর্বোচ্চ কার্যকরতা, কস্ট বেনিফিট এবং প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশন। ফলন বাড়ানোর তাগিদে বাজারে এল হাইব্রিড বীজের খাদ্যশস্য (High yield Varieties-HYVs), মূলত ধান এবং গম। বহুফসলির স্থানে এল একফসলি শস্য। ‘হাই ভ্যাল্যু,লো ভলিউম সিডস’। কৃষিকাজ, যা ছিল কৃষকের যাপনের মাধ্যম, সেখানে এল বাজারি ক্ষমতার আঁচ। কৃষকের কৃষিকাজের স্বাধীনতা আপস হতে শুরু হল তখন থেকেই।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান গুলোর দৌরাত্ম্য, প্রভাব বাড়ার সঙ্গে এক নতুন ট্রেন্ড দেখা গেল উন্নত দেশগুলোর মধ্যে। কর্পোরেট কাঠামোর সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির সহায়তায় এই উন্নত দেশগুলো অপেক্ষাকৃত অন্নুনত বা উন্নয়নশীল দেশের বিভিন্ন জীব-বৈচিত্র্যগত ও জিনগতভাবে শক্তিশালী ভ্যারাইটির খাদ্যশস্যের বীজ কিনতে শুরু করল। ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস ব্যবহার করে সায়েন্টিফিক পেটেন্ট ফাইলের মাধ্যমে সেইসব জিনগত ভ্যারাইটির বীজের স্বত্ব অধিকৃত হল। পরবর্তী কালে ওই বীজ এবং রোপণের জন্য আনুষঙ্গিক বস্তু চড়া লাভের বিনিময়ে বিক্রি হতে থাকল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। ‘জিন রবারি’-র ওপর ভিত্তি করে ক্রমে ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল প্রথম বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি [২]। বিজ্ঞান ও টেকনোলজির অগ্রগতি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর উন্নত প্রযুক্তির জন্ম দিল। শুরু হল জেনেটিক্যালি মডিফায়েড শস্যের চাষ-আবাদ। বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলো একটা সুসংগত ক্ষেত্র পেল পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণের। প্রথমত, হাইব্রিড, উচ্চ ফলনশীল শস্যের জেনেটিক ভ্যারিয়েশন সাধারণ খাদ্যশস্যের তুলনায় বেশ খানিকটা কম হওয়ায় কীটপতঙ্গের আক্রমণ বা রোগ-সংক্রমণের ক্ষেত্রে হয়ে উঠল ভীষণভাবে দুর্বল। স্বাভাবিকভাবে এই দুর্বল খাদ্যশস্য রক্ষা করতে গেলে সার এবং কীটনাশক ব্যবহারের মাত্রাও হল অনেক বেশি এবং বলাই বাহুল্য ব্যয়বহুল। ‘সর্বোচ্চ লাভের’ নীতি এভাবেই বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলোকে তার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করল। চাষবাসের খরচ বেড়ে যেতে থাকল ব্যাপক পরিমাণে। দ্বিতীয়ত, বড়ো বড়ো কর্পোরেট সংস্থা বৃহৎ পুঁজির জোরে ছোটো ছোটো খাদ্যশস্য ও বীজের কোম্পানিগুলোকে দ্রুতগতিতে গ্রাস করে ফেলল। অন্যদিকে এই স্বল্প সংখ্যক মনোপলি কর্পোরেট সংস্থাগুলি যুক্ত হল সহবর্তী রাসায়নিক ও ভেষজ কীটনাশক উৎপাদনের সঙ্গে। তৃতীয়ত, বড়ো বড়ো বহুজাতিক সংস্থাগুলি বৃহৎ পুঁজির সাহায্যে অত্যাধুনিক টেকনোলজির সহায়তায় খুব সহজেই জেনেটিক্যালি মডিফায়েড শস্য বীজের উৎপাদন শুরু করল, যা ছোটো ছোটো বেসরকারি সংস্থাগুলোকে খোলা বাজারের প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে দিল। বেসরকারি পুঁজির একচেটিয়া পুঁজিতে রূপান্তরের পথ সুগম হল। উৎপাদনের মাধ্যম ও ডিস্ট্রিবিউশন চেনের পুরো দখল করে নিল এই মনোপলি বহুজাতিক সংস্থাগুলো। উদাহরণস্বরূপ, ‘কার্গিল’ কোম্পানি কৃষিক্ষেত্রের সমস্ত স্তরে— বীজ উৎপাদন, বীজ সরবরাহ, সার ও অন্যান্য কৃষি সহায়ক দ্রব্যাদি উৎপাদন থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতিতে জড়িত। ২০১৩-র তথ্য অনুযায়ী [৩], মাত্র তিনটি আমেরিকার কর্পোরেট কোম্পানি— কার্গিল (Cargill), অর্চার ড্যানিয়েল মিডল্যান্ড কোম্পানি (ADM) এবং বুঙ্গের (Bunge) হাতে গোটা পৃথিবীর কৃষি বাজারের প্রায় ৫০% অধিকৃত।
গ্রিন রিভোলিউশনের পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষে হাইব্রিড বীজের চাষ শুরু হয়। ব্যপক মাত্রায় শুরু হয় সার ও কীটনাশকের ব্যবহার। ধীরে ধীরে নিও-লিবেরাল চেতনার ঢেউ আছড়ে পড়ে সার, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষি উপযোগী সামগ্রীর বাজার পরিসরে। ১৯৯২ সালে ভারত সরকার ফসফেট ও পটাশিক জাতীয় সারের উপর নিয়ন্ত্রণ আলগা করে এবং ১৯৯৭-এর নতুন পলিসির মাধ্যমে পুরোমাত্রায় সার, কীটনাশকের বাজার বেসরকারি পুঁজির জন্য খুলে দেওয়া হয়। ফলস্বরূপ, সরকারি সার উৎপাদক সেক্টরগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। সরকারি সেক্টরের নাইট্রোজেনজাত সার উৎপাদন ক্ষমতা ১৯৬১-তে মোট উৎপাদনের ৮৭ % থেকে ২০১২-য় পৌঁছয় মাত্র ২৯.৪ % তে [৪]।
ফসফেট জাতীয় সারের ক্ষেত্রেও একই প্রতিচ্ছবি দেখা গেল। সারের ইন্ডাস্ট্রির ভরকেন্দ্র বেসরকারি হাতে চলে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে সার ব্যবহারের খরচ বৃদ্ধি পেল অনেকটা। যত দিন গেছে, তত আরও আগ্রাসী হয়েছে কর্পোরেটের চাহিদা, তত শিথিল হয়েছে সরকারি নিয়ন্ত্রণ। কোভিডকালে খোলা বাজারের নগ্ন রূপ সরাসরি কৃষির উপর প্রভাব ফেলেছে, আরও ভয়ানক ভাবে। অন্ধ্র প্রদেশের গুন্টুর জেলার গরিব চাষিদের ধান চাষের জন্য একর পিছু সারের দাম গত বছরের ১১৫০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩০০ টাকা। ইউরিয়া সারের ঘাটতি বিহারে ইউরিয়া সারের ৪৬ কিলোর ব্যাগের দাম বাড়িয়েছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা [৫]। চাষের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান জল সরবরাহের এবং বিদ্যুতের ওপরেও কর্পোরেট সেক্টরের আধিপত্য অব্যাহত। বিদ্যুৎ ভিত্তিক ভূগর্ভস্থ জলসেচ ব্যবস্থা ভীষণভাবেই জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহের উপর নির্ভরশীল। ইলেক্ট্রিসিটি অ্যাক্ট ১৯৯১ এর মাধ্যমে প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর বেসরকারি হস্তক্ষেপ অনুমোদন পায়। ১৯৯৮-এর ইলেক্ট্রিসিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার ওপরেও কর্পোরেটাইজেশনকে মান্যতা দেওয়া হয়। ২০০৩ এ অবশেষে সমস্ত ইলেক্ট্রিসিটি পাওয়ার সেক্টর পুরোপুরি বেসরকারিকরণের পথে হাঁটে।
কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেটাইজেশনের সর্বোচ্চ পর্যায় দেখা গেল চুক্তি-চাষ এবং কর্পোরেট ফারমিং-এর অনুষঙ্গে। ২০০৩ এ তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারি কৃষি নীতি প্রণয়নে কন্ট্রাক্ট ফারমিংকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা ওঠে। ধীরে ধীরে অঙ্গরাজ্যগুলো সেই পথ অনুসরণ করে, খানিকটা বাধ্যতার বশে। ‘কর্পোরেট ফারমিং’ বলতে বোঝায়, কোনো কর্পোরেট সংস্থার দ্বারা কোনো জমির সরাসরি মালিকানা দখল বা লিজ নিয়ে সেই জমিতে খোলা বাজারের জন্য চুক্তি-চাষ (কন্ট্রাক্ট ফারমিং)। চুক্তি-চাষের পদ্ধতি খানিকটা এরকম— চুক্তি অনুযায়ী কৃষককে তার জমিতে কনট্রাক্টরের জন্য নির্দিষ্ট ফসল ফলাতে হবে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ ও নির্দিষ্ট মানের ফসল তুলে দিতে হবে কনট্রাক্টরের হাতে। চুক্তি-চাষের বিভিন্ন অংশীদারেরা হল— ১) মূল কন্ট্রাক্টর বা কোনো কৃষি-প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানি (পেপসিকো) ২) কৃষি সহায়ক দ্রব্য উৎপাদনকারী কোম্পানি (কার্গিল, মন্স্যান্ত) ৩) ফিন্যান্স ক্যাপিটাল (ইয়েস ব্যাঙ্ক) এবং চুক্তিবদ্ধ কৃষক। মোটামুটি ভাবে পূর্বনির্ধারিত দামে এই পুরো পদ্ধতি ঘটে, যদিও তার ব্যতিক্রম হতেই পারে। সাধারণত, কর্পোরেটের অধীনে থাকা কন্ট্রাক্টর প্রযুক্তিগত পরামর্শ ও জিনিসপত্র সরবরাহ করে, অন্যদিকে কৃষক যোগান দেন জমি এবং শ্রমশক্তি। ধরুন, ‘Lays’ বা ‘আঙ্কেল চিপস’-এর জন্য প্রয়োজন বিশেষ ধরণের আলু। এই ধরণের আলুতে জলের পরিমাণ সাধারণ আলুর চেয়ে কম। এবার এই বিশেষ ধরণের আলুর চুক্তি-চাষ ব্যাপারটা আপাতভাবে খুব সহজ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। পেপসিকো ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টর অ্যাগ্রোর ভাষায় [৬] ‘All they have to do is to grow the potatoes for us.’ সাময়িক বা শর্ট-টার্মে দেখলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষয়টা বেশ ফলপ্রদও। প্রাকৃতিক বা অন্যান্য কোনো অনিশ্চয়তার কালে হয়ত সাময়িক স্বস্তিও দিতে পারে মুমূর্ষু কৃষকদের। এই বছর, করোনার আবহে আলুর দাম কোথাও কোথাও ৪ টাকা প্রতি কেজি দরে বিক্রি করতে হয়েছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার অল্প কিছু অংশে পেপসিকো কোম্পানির চুক্তি-চাষ কিছু কৃষকদের পূর্বনির্ধারিত কেজি পিছু ৮.৪০ টাকা দরে আলু বিক্রি করতে সাহায্য করেছে, যা বিশ্বব্যাপী স্ন্যাক্সের বাজারের চাহিদা মিটিয়েছে। এখন এখানেই দুটো প্রশ্ন আসবে যে, ১) কত শতাংশ কৃষক এই সুবিধে ভোগ করলেন এবং ২) এই রোজগারে নিশ্চয়তা আর অনিশ্চয়তার অনুপাত কীরকম? শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে, বাৎসরিক ১০ মিলিয়ন টন আলু উৎপাদনের অত্যন্ত সামান্য একটা অনুপাত এই আওতায় পড়ছে। দ্বিতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: এই গোটা চুক্তি-চাষের কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের ফ্লাকচুয়েশন বা দামের ওঠানামার ওপর। কোনো কারণে পৃথিবী জুড়ে স্ন্যাক্স জাতীয় খাবারের প্যাটার্ন যদি বদলে যায়? যদি চিপস জাতীয় স্ন্যাক্সের চাহিদা কমে যায়? বা ধরুন আপনি, আমি আমরা সবাই চিপস ছেড়ে পপকর্ণের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। পেপসিকো তখন পপকর্ণের জন্য ভুট্টা খেত খুঁজবে। ওই যে, প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশন! পশ্চিমবঙ্গে না পেলে যাবে অন্য জায়গায়। ওই চুক্তিবদ্ধ কৃষকরা তখন কোথায় যাবে? আবার কৃষকরা ওই বিশেষ ধরণের আলু নিজেরা চাষ করলে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস-এর খুড়োর কল দেখিয়ে কর্পোরেট সংস্থা তা বন্ধ করে দিতে পারে এক নিমেষে। সম্প্রতি গুজরাটের নয় জন কৃষকের নামে এই মর্মে আইনি মামলাও করেছিল পেপসিকো কোম্পানি [৭]। কর্পোরেটের ঔদ্ধত্য এবং কর্মসংস্থান, মজুরির অনিশ্চয়তার অসম্ভবে বসে থাকা কৃষক কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে? গবেষকরা এই চুক্তি চাষে নিযুক্ত মূলত দুই পক্ষের ক্ষমতার পার্থক্যের কারণ হিসেবে এই পদ্ধতির অন্তর্নিহিত, সহজাত Monopsonistic exploitation [৮] কে দায়ি করেছেন। Monopsony হল এমন এক বাজারের কাঠামো যেখানে একজন ক্রেতা বেশি সংখ্যক বিক্রেতার সঙ্গে দরাদরি বা মধ্যস্থতা করেন। এই কাঠামো ক্রেতাকে বিক্রেতাদের তুলনায় সুবিধেজনক, লাভজনক অবস্থানে রাখে যেহেতু ওই বিক্রেতারা একই ক্রেতার কাছে তাঁদের দ্রব্য বিক্রি করতে চান। কৃষি এবং আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়াকরণ ইন্ডাস্ট্রিতে অল্প কিছু কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্যের ঘটনা আগেই উল্লিখিত। সুতরাং, ছোটো বা মাঝারি কৃষকরা যদি পুরোপুরি চুক্তি চাষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, তাহলে কৃষকের দরদাম করার ক্ষমতা কমতে থাকে এবং কর্পোরেট ফার্মের হাতে চলে যায় ক্ষমতার ভরকেন্দ্র।
কন্ট্রাক্ট ফারমিং-এর ফেনোমেনন লেবার ফোর্স বা শ্রমশক্তির এক নতুন বিন্যাস তৈরি করল। ভারতীয় অর্থনীতিবিদ এবং জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইকোনমিক স্টাডিজ অ্যান্ড প্ল্যানিং-এর চেয়ারপার্সন ডঃ জয়তী ঘোষ কর্পোরেট এবং কন্ট্রাক্ট ফারমিং-এর বৈশিষ্ট্য হিসেবে তুলে ধরেছেন এর অধিক শ্রমভিত্তিক সবজি জাতীয় ফসল চাষের প্যাটার্নকে [৯]। অধিকাংশ সবজি জাতীয় ফসল (আলু ব্যতিক্রম) চাষের জন্য কৃষকের কায়িক শ্রমের পরিমাণ তুলনামুলকভাবে ধান, গম জাতীয় খাদ্যশস্য চাষের তুলনায় অনেকটা বেশি। তাই কন্ট্রাক্ট ফারমিং-এ এই ধরণের ফসলের ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হল এবং মহিলা কৃষি শ্রমিকদের নিয়োগ করা হল বেশি করে। কাজের আশায় কৃষি-শ্রমিকদের পরিযান শুরু হল। শ্রম কেনার ক্ষেত্রে তৈরি হল প্রতিযোগিতা। নিয়ন্ত্রক বাজার। এই প্রতিযোগিতার বাজারে স্বাভাবিকভাবেই মজুরির ওপর কোপ পড়তে শুরু করল। ডঃ ঘোষের স্টাডিতে উঠে আসছে সেই তথ্য: এক মহিলা কৃষি শ্রমিকের মজুরি পুরুষ কৃষি শ্রমিকের মাত্র ৬০ থেকে ৭৫ %। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা দেখা গেল এই প্রসঙ্গে। চুক্তি-চাষের যান্ত্রিকীকরণ ক্রমে পুরুষ কৃষি শ্রমিকের কায়িক শ্রম প্রতিস্থাপিত করল এবং চোখে পড়ল তুলনামূলকভাবে মাথা পিছু কম মজুরিতে মহিলা কৃষি শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান। তাহলে ইক্যুয়েশনটা কী দাঁড়াল? বেশি মজুরির পুরুষ শ্রমিকের জায়গায় যন্ত্র (অর্থাৎ maximum efficiency) এবং বাধ্যতামূলক কায়িক শ্রমের চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে কম মজুরির মহিলা কৃষি শ্রমিকের নিয়োগ (বা cost benifit assesment)। সেই এক প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশন, সেই এক যুগ যুগান্তর ধরে চলে আসা শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রম গিলে লাভের অঙ্ক বাড়ানো। খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ। কর্পোরেট ফারমিং-এর অ আ ক খ। চুক্তি-চাষের সহজ পাঠ।
নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় থেকে তাহলে কর্পোরেট ভিত্তিক কৃষির কি কোনো বিকল্প নেই? অল ইন্ডিয়া কিষান সভা এবং অন্যান্য কৃষক সংগঠনগুলো বারবার কৃষক সমবায় ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছে। তাঁদের মতে কর্পোরেট সংস্থাগুলোর একচেটিয়া লাভের বিরুদ্ধে কৃষককে বাঁচাতে গেলে প্রয়োজন সরকারি হস্তক্ষেপ এবং শক্তিশালী কৃষক-সমবায় ব্যবস্থা। কেরালায় খাদ্যশস্যের শক্তিশালী জনবন্টন ব্যবস্থা (public distribution system) এভাবেই এক সুসংহত কৃষি-সমবায় ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে, যেখানে সমবায়গুলি প্রতি মুহূর্তে কর্পোরেট সংস্থাগুলির একচেটিয়া লাভের বিরুদ্ধে কৃষকদের একজোট করছে। কেরালা ভূপ্রকৃতিগত কারণে বেশির ভাগ খাদ্যশস্য আমদানি করে অন্যান্য রাজ্য থেকে। এই খাদ্যের সুসঙ্গত বণ্টনের জন্য কার্যকরী ভূমিকা নেয় কেরালার সরকারি গণবন্টন ব্যবস্থা। রেশন দোকান এবং State Civil Supplies Corporation (Supplyco)-র মাধ্যমে সরবরাহ হয় আমদানিকৃত খাদ্যদ্রব্য। আবার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় বিভিন্ন সংস্থা,সমবায় সমিতি ও মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সুসমন্বিত চেষ্টায় খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আনার পাশাপাশি চলছে কৃষকের অধিকার বুঝে নেবার লড়াই।
এরপর ধীরে ধীরে আমরা প্রবেশ করলাম আরও আগ্রাসী কর্পোরেটাইজেশনের যুগে। খোলা বাজারের দরদাম ওঠানামার সঙ্গে আরও বেশি করে সুবিন্যস্ত, সিংক্রোনাইজড হতে শুরু হল আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যবস্তুর দরদামের ওঠা নামা। ছোটো, বড়ো, মাঝারি কৃষক প্রমাদ গুনল। শেষ দুই দশকে ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করেছেন প্রায় ৩ লক্ষ কৃষক। তবু ঋণের বোঝায় ক্লান্ত কৃষকের কথা মেইন্সট্রিম মিডিয়ায় উঠে এল না। ২০১৮ র মার্চ মাস। নাগরিক সমাজ মেইন্সট্রিম মিডিয়ায় ধর্মীয় মেরুকরণের আফিম খেয়ে ঘুম ভাঙ্গা চোখে নাসিক থেকে মুম্বইয়ের রাস্তায় দেখল লাল পতাকার সমুদ্রে কৃষকের লং মার্চ। কৃষকের যন্ত্রণার নিস্তব্ধতা দেখল ভারতবর্ষ। দিকে দিকে শুরু হল অধিকারের লড়াই। কখনো দিল্লিতে, কখনো তামিলনাড়ুতে, কখনো পশ্চিমবঙ্গে। ক্রমে এল ২০২০। শুরু হল ভাইরাস যাপন। বন্ধ হল সামাজিক মেলামেশা, দোকানপাট, অর্থনীতি। পৃথিবী জুড়ে ব্যালিস্টিক মিসাইল, পরমাণু শক্তিধর দেশে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ প্রাণ হারাল। ভারতবর্ষ দেখল খেটে খাওয়া, কাজ হারানো শ্রমিকদের অনন্ত পরিযান। কবি অনুভবের ‘সস্তা মানুষ’-এর সাথে পরিচিত হলাম আমরা। থেমে যাওয়া অর্থনীতি তৈরি করল খাদ্য সংকট। শস্যাগারে জমা খাদ্যশস্য পচতে থাকে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে নামে ভারতবর্ষ। অথচ, কর্পোরেট টাইক্যুনদের সম্পত্তি প্যান্ডেমিকে বেড়ে চলে স্বচ্ছন্দে। একচেটিয়া পুঁজির সঙ্গে হাত মেলায় সরকার। দুর্বার গতিতে, রাজকীয় ঔদ্ধত্যে ফাঁকা পার্লামেন্টে পাশ হয়ে যায় নতুন কৃষি-বিল।
এই নতুন কৃষিবিলে যখন কর্পোরেটদের লাগামছাড়া আধিপত্যের বাসনায় সরকারি সম্মতি দেওয়া হল, যখন মজুতদারদের যত খুশি মজুতকরার স্বাধীনতা দেওয়া হল,তখনও গল্পটা একরকম প্রেডিকটেবলই হওয়ার কথা। ওই হরিণ-বাঘের গল্পের মতো। হরিণ বাঘের সামনে আত্মসমর্পণ করবে। মনুষ্যেতর প্রাণীরা নিয়মমাফিক অতিমানবিক বিজনেস মডেলের সামনে আত্মসমর্পণ করবে। কখনো সোজাসুজি, কখনো ধাপে ধাপে। কখনো ঘরবাড়ি জমি জমা বেচে, কখনো কৃষিকাজ ছেড়ে শহরে নতুন জীবিকার খোঁজে, কখনো ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করে। এরকমই হয়ে থাকে। তবে ব্যতিক্রম হতেই পারে, যদি কৃষকদের যৌথ শ্রেণিচেতনা, তাঁদের ঐক্যবদ্ধ অনুভব লড়াইয়ের ডাক দেয়। আপসের শেষ সীমায় পৌঁছেও তখন ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প দানা বাঁধে। রাজধানী অচল হয় কৃষকদের ধর্নায়, বিক্ষোভে। রাজধানীর আকাশ মুখরিত হয় রাষ্ট্রের অন্যায্য দাবি প্রত্যাহারের গর্জনে। আন্দোলনের প্রস্তুতি, জেদ, যৌথতা শাসকের বুকে কাঁপন ধরায়। একরোখা দাবি আদায়ের লড়াইয়ে রাস্তায় নামিয়ে আনে শাসক, কর্পোরেট, মিডিয়াকে। সিঙ্ঘু বর্ডারে, টিকরি বর্ডারে লাখ লাখ আহত ‘জাগুয়ার’ চোখে চোখ রাখে। ওয়াকওভার নয়, খেলা হবে!
“कृषिप्रधान देश, कृषि संकट पे न गौर
अब या तो आत्म्हत्या या फिर आंदोलन के और”
তথ্যসূত্র:
১.Bakker, K. (2005), Neoliberalizing Nature? Market Environmentalism in Water Supply in England and Wales. Annals of the Association of American Geographers, 95: 542-565. https://doi.org/10.1111/j.1467-8306.2005.00474.x
২.https://countercurrents.org/2020/12/how-growing-corporatization-has-harmed-farmers-and-farming/
৪.Meena, Tejendra, Corporatization of Agriculture and Its Effect (August 15, 2016), http://dx.doi.org/10.2139/ssrn.2823387
৮.Robinson J. (1969) Monopsonistic Exploitation of Labour. In: The Economics of Imperfect Competition. Palgrave Macmillan, London. https://doi.org/10.1007/978-1-349-15320-6_27
৯.http://www.macroscan.org/cur/may07/cur150507Indian_Agriculture.htm