ভারতবর্ষে কৃষক আন্দোলন ও মধ্যবিত্তের ভূমিকা

সায়ন চক্রবর্তী

‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া’— বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে। এই প্রবাদ যে বর্তমান কালের মানব জীবনে কতটা প্রাসঙ্গিক তা বোধ হয় আমরা এখনও ভেবে উঠতে পারিনি। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে যে এই তেলা মাথায় তেল দেবার প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে তা আমাদের ঝুঝে নেওয়া দরকার।

বিশ্বের সম্পদের প্রায় সবটাই কুক্ষিগত হয়ে আছে বিশ্বের জনসংখ্যার ১০% এর হাতে। বিশ্বের ধনীতম ১০% বিশ্বের সম্পদের ৮৪.৮% দখল করে রেখেছে। সবচেয়ে ধনী ১% বিশ্বের সম্পদের ৪৭% আর্থাৎ প্রায় অর্ধেক অংশের মালিক। আর অর্থনৈতিক ভাবে নিম্নতম ৫০% জনগণ বিশ্বের মোট সম্পদের ০.৪%এর মালিক। অর্থাৎ বিশ্বের নিম্নতম ৫০% জনগণ নিঃস্ব একথা বলতেই হয়।

এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ১০% জনগণ এশিয়ার সম্পদের ৮৫.৯% এর মালিক। সবচেয়ে ধনী ১% এশিয়ার সম্পদের ৪০.৬% এর মালিক। নিম্নতম ৫০% এর মালিকানায় আছে মোট সম্পদের ০.৭%, এখানেও নিম্নতম ৫০% মানুষ কার্যত নিঃস্ব। এই দেশগুলিতে সম্পদের বন্টন নীচের সারণির সাহায্যে দেখা যেতে পারে:

বিশ্বে মোট সম্পদকে যদি ১০০ টাকা ধরা হয় আর মোট জনসংখ্যা ধরা হয় ১০০ জন, তাহলে বলতে হয় ১০০ জনের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ১০ জন ৮৪ টাকা ৮ পয়সার মালিক। অন্যদিকে সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ জন ৪০ পয়সার মালিক। এশিয়া মহাদেশেও সম্পদ বন্টনের পরিস্থিতি এরকমই। ১০০ জনের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ১০ জন ৮৫ টাকা ৯ পয়সার মালিক আর সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ জন ৭০ পয়সার মালিক। সব মহাদেশ হয়তো সমান দুরবস্থায় নেই। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকার অবস্থা কিছুটা ভালো। তুলনামূলক ভালো বলতে হয় ইউরোপের চিত্র।

ভারতবর্ষে বৈষম্যের চিত্র যে ভয়াবহ, সেকথা অনস্বীকার্য। ভারতবর্ষে ধনীতম ১০% মানুষ মোট সম্পদের ৭৭.৪% এর মালিক, ধনীতম ১% মোট সম্পদের ৫১% এর মালিক। নিম্নতম ৫০% মোট সম্পদের ২.৪% এর মালিক। এশিয়ার অন্য দুটি দেশ চিন ও জাপানের অবস্থা ভারতের তুলনায় ভালো। এশিয়ার এই দেশগুলির সম্পদের বন্টন এ-রূপ:

সমগ্র বিশ্বব্যাপী যে প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে তা হল, অল্প কিছু সংখ্যক ধনী মানুষের কাছে সম্পদের কেন্দ্রীভবন। ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব। এই প্রক্রিয়া সচল থাকায় বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ সম্পদের নিরিখে নিঃস্ব। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম সম্বল তাদের নেই। যেন মনুষ্যেতরের মতো কোনো মতে দিন গুজরান করছে বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক।

কেন এই প্রক্রিয়া? এটা যে জনসংখ্যার ১০% বা ১% মানুষের স্বার্থে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু ৫০% মানুষ কেন নির্বাক সেটা ভাবিয়ে তুলছে। কেন এবং কীভাবে এই পরিস্থিতি চলেই যাচ্ছে তা ভাবতে হবে মানবজতির কোনো না কোনো অংশকে।

সম্পদ কীভাবে মানুষের মধ্যে বন্টিত হবে সেটা নিয়ে রাষ্ট্রের কিছু ভূমিকা থাকেই। রাষ্ট্র ট্যাক্স বসানো বা অন্যান্য নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে আয়ের বন্টন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা প্রভাব ফেলে সম্পদের বন্টনের ওপর। বর্তমানে দেশে দেশে রাষ্ট্র কী ভূমিকা পালন করছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

রাষ্ট্রের ভূমিকা বোঝা যায় রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক কাজের বিচার করলে। রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক হতে পারে বা নাও পারে। রাষ্ট্র জনগণের স্বাস্থ্য-শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে বা নাও পারে। এবিষয়ে দেশে দেশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ভিন্ন ভিন্ন।

রাষ্ট্র যে স্বাস্থ্য-শিক্ষার ব্যবস্থা করে তা আবার দেশে দেশে ভিন্ন হয়। কোথাও স্বাস্থ্যের জন্য রাষ্ট্র ব্যায় করে জিডিপির ১%, কোথাও ৬% আবার কোথাও ১৭%। ফলে রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক ভূমিকা দেশে দেশে এক নয়। মহামারিতেও বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন ভূমিকা পালন করল। পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি বেশ কিছু চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। এমনকি বেসরকারি হাসপাতালকে রাষ্ট্রের মালিকানায় আনা হল। চিন কিউবা ভিয়েতনামে রাষ্ট্র মহামারির মোকাবিলা সহজেই করতে পারল।

সব দেশ এই রকম ভূমিকা পালন করতে পারেনি। যারা পারেনি তাদের মধ্যে ভারতবর্ষ আছে। মহামারির মধ্যে দেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের হাল সমগ্র বিশ্ব চাক্ষুষ করল। বাঁচবার জন্য একবার তাঁদের বাড়ি ফিরে আসতে হল। তারপর পুনর্বার রুটি-রুজির জন্য কর্মস্থলে ফিরে যেতে হল। এই আসা যাওয়ায় বহু মানুষকে আটকে রাখা হল একই স্থানে। ফলত রোগ ছড়াল সহজেই। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা এই পরিকল্পনার অভাবের কথা বলছেন বারংবার। ভারতবর্ষে রাষ্ট্র কোভিড মহামারি সংক্রমণ রোধ ও মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করেনি। রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক ভূমিকা চোখে পড়েনি। অথচ, তখন অন্য কোনও ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে রাষ্ট্র।

মহামারিতে মানুষে মানুষে ভৌগোলিক দূরত্ব বজায় রাখা হয়েছিল আর তার নাম দেওয়া হয়েছিল সামাজিক দূরত্ব। এই তথাকথিত সামাজিক দূরত্ব মানুষকে সংগঠিত হবার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। মহামারিতে মানুষ এমনিতেই ভয়ার্ত ও বিপর্যস্ত। প্রতিফলে দীর্ঘদিন মানুষকে পরস্পরের থেকে দূরে রাখা সহজ হল। এই সুযোগে একের পর জনবিরোধী কর্মসূচি নামানো হল রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। জনকল্যাণকর নয় রাষ্ট্র নিল জনবিরোধী ভূমিকা।

পরিকল্পনা করা হল কীভাবে শ্রম আইন সংশোধন করে ৮ ঘন্টার বেশি সময় ধরে শ্রমজীবী মানুষকে খাটানো যায়। তার সঙ্গে যুক্ত করা হল কীভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া যায়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হল দেশের কৃষিক্ষেত্র কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা। পাশ করানো হল কালো কৃষি বিল। দেশের শ্রমজীবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল।

বিগত কয়েক বছর ধরে ১০% বা ১% মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত করার যে প্রক্রিয়া চলছিল তা আরও ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত করার আয়োজন করা হল। মহামারির সময়কে সুচতুর রূপে এই কাজে ব্যবহার করা হল। প্রতিরোধের কোনও শক্তি যাতে মাথা না তুলতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হল।

কিন্তু রাষ্ট্রের এই জনবিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াল কৃষিজীবী মানুষ। চলছে তাঁদের অবস্থান বিক্ষোভ। চেয়ে আছে দেশের মানুষ। ক্রমশ সংগঠিত হচ্ছে বিক্ষোভ। বাড়ছে মানুষের অংশগ্রহণ।

কৃষি ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সমর্থনে জনগণের আর কোন্ অংশ যুক্ত হতে পারে বা হওয়া প্রয়োজন— এই প্রশ্ন এবার আসছে। ধনীতম ১০% মানুষ আন্দোলনের মধ্যে নেই। কারণ, লড়াইটা মূলত ধনীতম  ১০% এর বিরুদ্ধে। আর্থিকভাবে নিম্নতম ৫০% মানুষ তো  লড়াই এ থাকছেই কারণ এই লড়াইয়ের সাফল্য পৌঁছবে তাদের কাছেও এবং সেই সাফল্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদের কাছে। বাকি যে মাঝামাঝি ৪০% অংশ তারা কী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে সেটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

জনগণের ধনীতম ১০%— উচ্চবিত্ত, মধ্যবর্তী ৪০%— মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্রতম ৫০%— নিম্নবিত্ত এই বিভাজনের কথা বলেছেন থমাস পিকেটি তাঁর ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ গ্রন্থে। আন্দোলনরত কৃষকদের একটা অংশ এই মধ্যবিত্তের অন্তর্গত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কৃষকদের একটা অংশ মধ্যবিত্ত এবং বাকি অংশ নিম্নবিত্ত এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। তবে কত অংশ মধ্যবিত্ত ও কত অংশ নিম্নবিত্তের মধ্যে আছে তার নিখুঁত হিসাব পাওয়া কঠিন।

জনগণের এই মধ্যবর্তী ৪০% বা মধ্যবিত্ত বিশ্ব জুড়ে সম্পদের একটা তাৎপর্যপূর্ণ অংশের মালিক। সেটা নিশ্চিতভাবে উচ্চবিত্ত ১০% এর মতো নয়। তবে নিম্নবিত্ত ৫০% শতাংশের সম্পদের ভাগ যেহেতু শূন্য, তাই সম্পদের বাকি অংশ, উচ্চবিত্ত ১০% এর অংশ বাদে, থাকছে মধ্যবিত্তের হাতে। এই তাৎপর্যে মধ্যবিত্তের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং কোন্ দিকে মধ্যবিত্ত নিজেদের দাঁড় করাবে, সেটা শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, নির্ণায়ক সিদ্ধান্ত হিসাবে কাজ করতে পারে। কয়েকটি অঞ্চলে মধ্যবিত্ত সম্পদের কত অংশের মালিক তার সুস্পষ্ট তথ্য নীচের সারণিতে দেওয়া হল। সম্পদ সম্পর্কিত এই সব তথ্য নেওয়া হয়েছে ক্রেডিট সুইস প্রকাশিত গ্লোবাল ওয়েল্থ ডাটাবুক ২০১৮ থেকে—

ভারতবর্ষে মধ্যবিত্তের আবার রয়েছে নানা স্তর (স্বাতী রমানাথন ও রমেশ রমানাথন, হিন্দুস্থান টাইমস্, ১৬ এপ্রিল, ২০১৯)। মধ্যবিত্তকে পাঁচটি উপ-শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে: ১) গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ২) পাবলিক সেক্টরের মধ্যবিত্ত ৩) শহরের প্রাইভেট সেক্টরের মধ্যবিত্ত ৪) ট্রেডার মধ্যবিত্ত ৫) উঠতি (rising) মধ্যবিত্ত। বর্তমানে এই সমস্ত অংশ মিলিয়ে মধ্যবিত্তের সংখ্যা জনগণের ৪০%। বৃহত্তম অংশ হল গ্রামীণ মধ্যবিত্ত— জনগণের ১৩.৭%। মধ্যবিত্তদের মধ্যে সবচেয়ে বর্ধনশীল অংশ হল শহরের প্রাইভেট মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তদের মধ্যে ক্ষুদ্রতম অংশ হল পাবলিক সেক্টরের মধ্যবিত্ত— জনগণের ৩%। এই হিসাব ২০১৪ সাল পর্যন্ত। উল্লেখ্য, শহরের প্রাইভেট সেক্টরের মধ্যবিত্ত রাজনীতির সঙ্গে সবচেয়ে কম যুক্ত। রাজনীতির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যুক্ত ট্রেডার মধ্যবিত্ত।

মধ্যবিত্তদের মধ্যে এই রকম ভাগাভাগি মোটামুটি ভাবে বাস্তবসম্মত। প্রাইভেট সেক্টরের মধ্যবিত্তের সাধারণত রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ কম। প্রাইভেট সেক্টরের কাজে যুক্ত থাকায় নিজের পেশার বাইরে বেরিয়ে এসে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হবার সময় কম। উপরন্তু, এই পেশায় ট্রেড ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রায় না থাকায় রাজনীতিতে যুক্ত হবার সুযোগ ও প্রয়োজনীয়তা দুই-ই কম। ট্রেডার মধ্যবিত্তকে বহু মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়। ব্যবসা টিকিয়ে রাখবার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলকারী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পাবলিক সেক্টরের মধ্যবিত্ত তুলনায় নিশ্চিন্ত অবস্থায় থাকে চাকরির নিরাপত্তার কারণে। তবে এই অংশ রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তারা রাজনৈতিক মতবাদ প্রকাশ করে থাকে, যদিও সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হবার বহুবিধ সমস্যা বর্তমান।

আয়ের নিরিখে মধ্যবিত্তকে জনগণের মাঝামাঝি ৪০% অংশ হিসাবে দেখার যে পিকেটীয় শ্রেণিকরণ, তার সঙ্গে ভারতবর্ষীয় মধ্যবিত্তের মধ্যেকার ভাগাভাগি একবারেই অসংগতিপূর্ণ নয়। যে পাঁচ প্রকারের মধ্যবিত্ত সম্পর্কে কথা বলা হল, তারা সকলেই পরিষেবা ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। পিকেটি পরিষেবা ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষদেরই একমাত্র মধ্যবিত্ত বলেছেন, তেমন নয়। কোনো দেশে আয় বা সম্পদের মালিকানার  সাপেক্ষে মধ্যবর্তী ৪০% মানুষ হল মধ্যবিত্ত। সেটা পরিষেবা ক্ষেত্রে যুক্ত মানুষের সংখ্যার সাথে এক হতে পারে, নাও হতে পারে। ভারতবর্ষে ২০১৪ সাল নাগাদ পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষের সংখ্যা কর্মরত জনগণের ৩০% থেকে ৪০% এর মধ্যেই আছে। এই অর্থে পরিষেবা ক্ষেত্রের সঙ্গে ভারতবর্ষের মধ্যবর্তী ৪০% আয়ের মানুষ প্রায় মিলে যাচ্ছে। কিন্তু, মধ্যবর্তী ৪০% যে পরিষেবা ক্ষেত্রেরই ৪০% সেটা নিশ্চিত তো নয়ই। আবার সব দেশের ক্ষেত্রে এই রকম মিল হবার নয়। পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা অথবা অন্যান্য কিছু দেশে পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষের সংখ্যা মোট কর্মরত জনসংখ্যার ৪০% এর চেয়ে অনেক বেশি। আবার আফ্রিকার দেশগুলিতে পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মরত জনসংখ্যা মোট কর্মরত জনসংখ্যার ৪০% এর চেয়ে কম। আবার সম্পদের সাপেক্ষে মধ্যবর্তী ৪০% এবং আয়ের সাপেক্ষে ৪০% একই জনগণের অংশ না হবারই কথা। এই শ্রেণি বিভাগকে যে চ্যালেঞ্জ করা যায়, একথা পিকেটি নিজেই বলেছেন। সম্ভবত বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষের তুলনামূলক আর্থিক অবস্থা বোঝবার জন্য পিকেটি এই শ্রেণিবিভাগ করেছেন। বহু জটিলতা থাকা সত্ত্বেও এই শ্রেণিকরণ যে যথেষ্ট কার্যকরী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভারতবর্ষে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের আর্থিক ওঠাপড়ার বিষয়ে পিকেটি এবং চ্যান্সেলের মতামত (Indian Income Inequality 1922 to 2015, published 2017) উল্লেখযোগ্য। পিকেটিরা দেখিয়েছেন যে, ভারতবর্ষে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি উচ্চবিত্ত ১০% এবং নিম্নবিত্ত ৫০% উভয়েরই জাতীয় আয়ে অংশ ছিল মোট আয়ের ৪০% করে। মধ্যবিত্তদের জাতীয় আয়ে অংশ ১৯৮২-৮৩ সালে বেড়ে হয়েছিল মোট আয়ের ৪৬%। তারপর তা কমতে শুরু করে। শতাব্দীর শুরুতে, অর্থাৎ, ২০০০-০১ সাল নাগাদ উচ্চবিত্ত ১০% এবং মধ্যবিত্ত ৪০% উভয়ই আবার জাতীয় আয়ের ৪০% এর মালিক হয়। তারপর ২০১৪-১৫ সালে জাতীয় আয়ে মধ্যবিত্ত ৪০% মানুষের অংশ নেমে গিয়ে ২৯.২% এ পৌঁছায়।

নিম্নবিত্ত ৫০% মানুষের অবস্থা একই রকম। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি নিম্নবিত্ত ৫০% মানুষের জাতীয় আয়ে অংশ ছিল ১৯%। ১৯৮২-৮৩ সালে তা বেড়ে হল ২৩.৬%। তারপর তা কমতে শুরু করে শতাব্দীর শুরুতে ২০০০-০১ সালে হল ২০.৬%। ২০১৪-১৫ সালে জাতীয় আয়ে নিম্নবিত্ত ৫০% এর অংশ নেমে এসে হল ১৪.৯%।এইভাবে আর্থিক ওঠাপড়ায় নিম্নবিত্ত ৫০% মানুষ এবং মধ্যবিত্ত ৪০% মানুষ একই বন্ধনীতে আছে। এবং এই বন্ধনীর ওঠানামা উচ্চবিত্ত ১০% এর ঠিক বিপরীত বা mirror image.

এই দুই শ্রেণির ওঠানামার আরও ছবি দিয়েছেন পিকেটিরা। ভারতবর্ষে নিম্নবিত্ত  ৫০%-এর প্রকৃত আয়ের cumulative প্রবৃদ্ধি ১৯৮০-২০১৫ সময়কালে ছিল ৯০%, আর মধ্যবিত্ত ৪০% এর ক্ষেত্রে সেই বৃদ্ধি ছিল ৯৪%। বিপরীতে উচ্চবিত্ত ১০% এর এই রকম বৃদ্ধি একই সময়ে ছিল ৪৩৫%। সমগ্র ভারতবর্ষে এই সময়কালে আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ২০১%। অর্থাৎ, আয় বৃদ্ধির ফল পৌঁছেছে উচ্চবিত্ত ১০% এর কাছে। একই রকমভাবে বঞ্চিত হয়েছে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষ। সুতরাং, আয় এবং সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের কাছে। দীর্ঘমেয়াদী এই পরিকল্পনায় আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিদিন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত।

উচ্চবিত্তের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যদি রুখে দাঁড়াতে হয় তাহলে তাতে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত উভয়কেই সামিল হতে হয়। কৃষক আন্দোলনে মধ্যবিত্তের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত আছেই। মধ্যবিত্তের সমস্ত অংশের অংশগ্রহণ, অন্তত নীতিগত অংশগ্রহণ নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থেই জরুরি। উচ্চবিত্ত ১০% বাকি ৯০% মানুষের উপর যে বঞ্চনা ক্রমশ চাপিয়ে দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে ৯০% মানুষকে সংগঠিত হতেই হবে, আজ অথবা কাল। ভারতবর্ষের কৃষক আন্দোলন সেই লড়াইয়ের পথ প্রদর্শক হতে পারে। কাজেই লড়াই যখন করতেই হবে ভারতবর্ষে ৯০% মানুষ এই লড়াই এ সামিল হোক। সেক্ষেত্রে সংগ্রামের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান