বাংলা: বিশ্বের বস্ত্রভাণ্ডার একটি পতনের কাহিনি

গৈরিক বসু

বাংলার বস্ত্রের খ্যাতি ছিল বিশ্ব জোড়া। আজ থেকে দুহাজার বছর আগেও বাংলার তৈরি নানান কাপড়, যথা মসলিন, সিল্ক ও অন্যান্য মিহি সুতির কাপড় পৃথিবীর নানান প্রান্তে রপ্তানি হত। ঢাকার বিখ্যাত মসলিন খ্রিস্টাব্দের প্রথম শতক থেকেই ইউরোপে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেছিল। রোম সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে সেখানকার মহিলাদের কাছে মসলিন ছিল বিশেষ পছন্দের সামগ্রী। প্রাচীন ঐতিহাসিকেরা, যথা হেরোডোটাস, টলেমি, প্লিনি সবাই তাদের লেখায় বাংলার মসলিনের উল্লেখ করেছেন। নবম শতকে আরব ভূগোলবিদ ও পর্যটক সুলেইমান, তাঁর ‘সিলসিলাত আল-তাওয়ারিখ’ গ্রন্থে বাংলাদেশের এমন সূক্ষ্ম ও মিহি কাপড়ের কথা বলেছেন, যা চল্লিশ হাত লম্বা ও দুই হাত চওড়া কিন্তু ছোটো একটি আংটির মধ্যে দিয়েও অনায়াসে চালাচালি করা যায়। সুতরাং স্মরণাতীত কাল থেকেই বাংলার বস্ত্রসম্ভার রোমান সাম্রাজ্য, মিশর, সর্বত্রই রপ্তানি করা হত।

বাংলার কাপড়ের সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্যের কথা পৃথিবীর বহু পর্যটকই তাঁদের রচনায় উল্লেখ করেছেন। মরক্কো দেশীয় ইব্‌ন বতুতা বাংলায় চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি আসেন। ঢাকার নিকটবর্তী সোনারগাঁও, যা ছিল উৎকৃষ্ট মসলিনের ঘাঁটি, তা দেখে চমৎকৃত হন। লেখেন, এমন চমৎকার ও উঁচুমানের বস্ত্র বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়। পঞ্চদশ শতকে চিনা পর্যটক ও ভিক্ষুদের লেখাতেও বাংলার সুতিবস্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। চৈনিক পর্যটক Ma Huan লিখেছেন  সোনারগাঁও এর মতো মিহি কাপড় কী করে এখানকার তাঁতিরা বানায়, তা এক বিস্ময়। ষোড়শ শতকের ইউরোপীয় পর্যটকেরা, যেমন Ralph Fitch বা Duarte Barbosa-র লেখাতেও বাংলার সূক্ষ্ম বস্ত্রের সপ্রশংস উল্লেখ লক্ষ করা যায়। ইংরেজ কোম্পানির সরকারি ঐতিহাসিক Robert Orme ১৭৫০ এর গোড়ার দিকে বাংলায় ছিলেন। বাংলার কাপড়ের সূক্ষ্মতা ও কারিগরদের দক্ষতা ছিল তাঁর কাছে এক ধাঁধা। প্রায় কোনো যন্ত্রপাতি ছাড়া কীভাবে এই কারিগরেরা এমন উৎকৃষ্ট কাপড় তৈরি করে তা ভেবে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন। বাংলার ও ইউরোপীয় তাঁতিদের দক্ষতা তুলনা করে তিনি লিখেছেন— “যান্ত্রিক ব্যাপারী দক্ষতার অভাব থাকলেও তাদের মধ্যে সার্বিক সংবেদনশীল নমনীয়তা আছে। ভারতীয় রাঁধুনিদের হাত যে কোনো ইউরোপীয় সুন্দরীদের হাতের থেকে কোমল ও সুন্দর” (Robert Orme : Historical Fragments)। তবে এটা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মসলিন বা অন্যান্য মিহিসুতোর কাপড় ছাড়াও বাংলায় প্রচুর সাধারণ মানের মোটা বা মাঝারি কাপড় তৈরি ও রপ্তানি হত।

ভারতের বস্ত্র উৎপাদনের অন্যান্য কেন্দ্রগুলি থেকে বাংলায় কিছু বিশেষ সুযোগ সুবিধা ছিল। যেমন—

   ১) উচ্চদক্ষতা সম্পন্ন কারিগর

   ২) উৎপাদনের স্বল্প ব্যায়

   ৩) জলপথে সস্তায় পণ্যপরিবহনের সুবিধা

   ৪) কৃষির উন্নত মান ইত্যাদি।

বস্ত্র উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং প্রতি স্তরেই দক্ষ মানব সম্পদের প্রয়োজন। এর ধাপ মূলত তিনটি—

• কার্পাস ও রেশম এর চাষ

• সুতো কাটা এবং

• কাপড় বোনা।

সৌভাগ্যক্রমে বাংলায় তখন দক্ষ শ্রমিকের কোনো অভাব ছিল না। ঢাকাই মসলিন এবং মুর্শিদাবাদ কাশিমবাজারের অপূর্ব সব রেশমি বস্ত্র তৈরি করত ওখানকার অত্যন্ত দক্ষ কারিগরেরা, যারা বহু শতাব্দী ধরে বংশপরম্পরায় এই দক্ষতা অর্জন করেছে। অতি সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে এরা যেসব সূক্ষ্ম এবং দৃষ্টিনন্দন বস্ত্র তৈরি করত, ইউরোপীয়রা মুগ্ধ হয়ে যেত। বাংলায় দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কারিগরদের প্রাচুর্যের কারণ এখানে বস্ত্রশিল্প একান্ত গার্হস্থ্য কুটির শিল্প। তাঁতি ও চাষি পরিবারের প্রায় প্রত্যেকেই উৎপাদনে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত থাকত। সুতো কাটা ছিল প্রধানত মেয়েদের কাজ, তারা সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুতো কাটত। এ কাজে দক্ষতা ছিল তাদের পরম্পরাগত। তাঁতিদের অনেকেই ছিল চাষি। অবসরের সময় তারা কাপড় বুনত। পরিবারের শিশুরা ও কাজে হাত লাগাত। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে বস্ত্রশিল্প ছিল শহরকেন্দ্রিক, শহরের সন্নিহিত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। বাংলার বস্ত্রশিল্প ছিল বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো ছিটানো। অবশ্য বাংলার বস্ত্রশিল্প কুটির শিল্প ছিল বলেই এই বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয়েছিল। বিকেন্দ্রীকরণের আরও একটি কারণ জলপথে সুলভে পণ্য পরিবহনের সুবিধা। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে সেটা হয়নি, কারণ সুলভে জলপথে পরিবহন সেখানে সম্ভব ছিল না।

বাংলার বস্ত্রশিল্পের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল উৎপাদনের স্থানীয়করণ (localization)। প্রতিটি জেলার কাপড়ের স্বকীয়তা ছিল যা অন্য জায়গার কাপড়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলার বস্ত্রশিল্পের স্থানীয়করণ এবং তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের দলবদ্ধভাবে বাস করার কারণ মূলত দুটো—

১) একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সহজলভ্যতা। সবথেকে সূক্ষ্ম  মসলিন তৈরি হত ঢাকা জেলাতে, কারণ ঢাকাতেই উৎপন্ন হত সব থেকে ভালো তুলো। একইভাবে কাশিমবাজারে সব থেকে ভালো রেশমি কাপড় তৈরি হত কারণ এই অঞ্চলে সবথেকে উত্তম কাঁচা রেশম উৎপন্ন হত।

২) নির্দিষ্ট অঞ্চলে তাঁতি বা কারিগরদের বংশপরম্পরায় অর্জিত কারিগরি দক্ষতা। প্রতিটি জেলায় নয়, এমনকি প্রতিটি আড়ং-এ সেখানকার তাঁতিদের বিশেষ দক্ষতা ও জ্ঞানের পরিচয় থাকত তাদের উৎপন্ন কাপড়ে।

একই রকম কাপড় বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন আড়ং-এ উৎপন্ন হত বটে, তবে কাপড়গুলি পরিচিত হত কাপড়ের নামের সঙ্গে আড়ং-এর নাম যুক্ত করে। যেমন, খাসা নামের মসলিন হতো— খাসা মালদা,  খাসা কাগমারিয়া, খাসা কুমারখালি ইত্যাদি নামে। কাপড়ের দাম নির্ভর করত কোন আড়ং-এ তৈরি, তার ওপর। যেমন— একই মাপের খাসা মালদার দাম যেখানে সাড়ে সতেরো টাকা,খাসা কাগমারিয়ার দাম সাড়ে নয় টাকা।

বাংলার বস্ত্রশিল্পের specialisation যে কতটা উঁচুতে উঠেছিল তা ঢাকা মসলিনের আলোচনাতেই বোঝা যাবে। ঢাকা জেলার সব থেকে উৎকৃষ্ট মসলিন তৈরি হত মূলত তিন চারটা আড়ং-এ— জঙ্গলবাড়ি, বাজিতপুর, তিতাবাড়ি এবং সোনারগাঁওতে। মোগল আমলে এই কয়েকটি আড়ং-এ এই শুধু দিল্লির বাদশাহ ও তাদের হারেমের জন্যে মলবুল খাস (বাদশাহি বস্ত্র) তৈরি হত। কথিত আছে, ঔরঙ্গজেব একবার তার বোন জাহান আরাকে গায়ে কিছু না পরে সম্রাটের কাছে হাজির হবার জন্য তিরস্কার করলে জাহান আরা জানান, তিনি মসলিনের সাতটি জামা পড়ে আছেন। কথিত আছে যে, নবাব আলিবর্দির জন্য তৈরি মসলিন তাঁর তাঁতি নিজের বাড়ি বাগানে শুকানোর জন্য মেলেছিলেন। একটি গোরু বাগানে ঘাস খেয়ে এসে মসলিনটিও খেয়ে ফেলে। গোরু বুঝতেই পারেনি ঘাসের ওপর কিছু মেলা আছে। তবে এইসব মসলিন ছিল অতি মহার্ঘ, তৈরি করতে সময় লাগত প্রচুর। একজন সুতো কাটুনি দিনে সর্বাধিক আধতোলা সুতো কাটতে পারত। ফলে একখণ্ড মসলিন বানাতে যত সুতো লাগত, তা কাটতে একজন কাটুনির প্রায় দুবছর সময় লাগত। ওই একখণ্ড মসলিন বুনতে একজন তাঁতি ও তার দুজন সহকারীর সময় লাগত অন্তত ছয় মাস। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে একখণ্ড উৎকৃষ্ট মসলিনের দাম ছিল চারশো টাকা। ঔরঙ্গজেবের আমলে সেরা জামদানির দাম পড়েছিল দুশো পঞ্চাশ টাকা।

আধুনিক যুগের (অষ্টাদশ শতক) প্রথম দিকে বাংলার বস্ত্রশিল্পের উৎপাদন ও সংগঠনের কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। যুগ যুগ ধরে বাংলার তাঁতি তার পরিবার নিয়ে তার কুটিরে বসে নিজের তাঁতে কাপড় বুনত। এই কুটিরই ছিল তার কারখানা। পরম্পরাগত শ্রমবিভাজন ছিল— তাঁতি কাপড় বুনত, স্ত্রী সুতো কাটত, বাচ্চারা তাদের বাবা-মাকে নানাভাবে সাহায্য করত। ব্যক্তিকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবারের শ্রম ও অল্প মূলধন হলেই চলে যেত।

বাংলায় দাদন ব্যবস্থা বস্ত্রশিল্পের অপরিহার্য অঙ্গ ও সনাতন বৈশিষ্ট্য ছিল। এশীয় বা ইউরোপীয় বণিক নির্বিশেষে সবাই দাদনি বণিক, পাইকার বা দালালকে দাদন দিয়ে বস্ত্র সরবরাহের জন্য চুক্তি করত। দাদনি বণিকেরা সেই টাকা থেকে তাঁতিদের অগ্রিম দিত এবং কী ধরনের কাপড় কতটা লাগবে, কী দামে, সেটা ঠিক করে দিত। তাঁতিরা তাদের সুবিধা মতো এই অগ্রিম দিয়ে কাঁচামাল (সুতো তুলো ইত্যাদি) কিনতে পারত, ছয় মাসের মতো পরিবারের সংস্থানও হয়ে যেত। তাঁতিদের তাদের উৎপাদন বিক্রি করার জন্য ক্রেতার খোঁজ করতে হত না। দাদনি বণিকই সব উৎপাদন নিয়ে নিত। বনিকেরাও নিশ্চিন্ত যে, তাদের যে কাপড় যতটা প্রয়োজন তা সংগ্রহ করতে কোনো অসুবিধা হবে না। তবে এই দাদন ব্যবস্থার সঙ্গে ইউরোপ বা ইংল্যান্ডের ভেরলাগ বা Putting out system এর অনেক পার্থক্য ছিল। ওসব দেশে তাঁতিকে দেওয়া হত কাঁচামাল ও তার পারিশ্রমিকের অগ্রিম। বাংলায় অগ্রিম ছিল সর্বদাই টাকায়, কখনোই কাঁচামালের নয়। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ইউরোপে উৎপাদনের প্রতি স্তরে উৎপন্ন পণ্যের মালিকানা থাকত মহাজন বা বণিকের, তাঁতিদের নয়। বাংলাতে তাঁতিই তার উৎপাদিত পণ্যের মালিক। উৎপাদনের সব সামগ্রী— তাঁত, যন্ত্রপাতি সবেতেই তার পূর্ণ মালিকানা। Max Weber এর ভাষায়, ইউরোপীয় তাঁতি Wage Earner। বাংলার তাঁতি তা নয়— মজুরির বিনিময় শ্রম সে বিক্রি করে না।

পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে ভাস্কোডাগামা ইউরোপ থেকে সোজা ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করার পর পোর্তুগিজরা ভারত মহাসাগরে মশলার বাণিজ্য করে প্রচুর লাভ করে। তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ইংরেজ East India Company এবং Dutch East India Company-র প্রতিষ্ঠা হয়। সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে কোম্পানিগুলো ইউরোপ থেকে সোনারূপো নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মশলা দ্বীপগুলিতে (ইন্দোনেশিয়া সুমাত্রা ইত্যাদি) যায়। মশলা কিনে ইউরোপে বিক্রি করবে বলে। কিন্তু তারা দেখে মশলা দ্বীপগুলিতে সোনারুপোর বিন্দুমাত্র চাহিদা নেই, আছে ভারতে তৈরি সস্তা মোটা কাপড়ের। বাংলায় প্রচুর মোটা কাপড় পাওয়া যায়, দরও সস্তা। ইউরোপীয় বণিকদের নজর পড়ল এই দিকে। বাংলার রেশমেরও ইউরোপে প্রচুর চাহিদা হবে তারা বুঝতে পারল। তখন এখানে কুঠি স্থাপন করে বাণিজ্য শুরু হল তাদের। এখান থেকে সস্তায় কাপড় কিনে নিয়ে গিয়ে মশলা দ্বীপ থেকে মশলা কেনা ও ইউরোপের বাজারের রেশম বিক্রি— এই ছিল ইউরোপীয় বাণিজ্যের প্রকৃতি। মোটামুটি  ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ।

১৬৮০ থেকে হঠাৎ করে ইউরোপে বাংলার কাপড়ের চাহিদা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে গেল। এর কোনো অর্থনৈতিক কারণ নেই। এই সময়ে ইউরোপের রুচির এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপীয়রা প্রচণ্ডভাবে ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে পড়ে এবং লর্ড, লেডি থেকে সাধারণ মানুষ সবাই মনে করতে শুরু করে ভারতের বা বাংলার কাপড় না পরলে তাদের মান ইজ্জত থাকবে না। ফলে ভারতের (প্রধানত বাংলার) কাপড়ের বিপুল চাহিদা তৈরি হলো ইউরোপে এবং ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো বস্ত্র বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে উঠল।

এই চাহিদার ফলশ্রুতি হিসেবে যদি বাংলার সনাতনী বস্ত্র প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটত, কোনো Richard Arkwright যদি বাংলাতে জন্মাতেন, তখন বাংলার বস্ত্রশিল্পের ইতিহাস অন্যরকম হত। স্বভাবগতভাবে নিশ্চেষ্ট বাঙালিরা তাদের উৎপাদন পদ্ধতি পাল্টানোর কথা ভাবেনি বা কেউ তাদের কোনো রকম উৎসাহও (incentive) দেয়নি। প্রয়োজনাতিরিক্ত শ্রমিক স্বল্প মজুরিতে পাওয়া যেত বলে, ব্যক্তিগত উৎপাদন না বাড়িয়েও, মোট উৎপাদন বৃদ্ধি করে বাংলা এই অতিরিক্ত ইউরোপীয় চাহিদা মিটিয়ে দেয়।

কিন্তু, এরপরেই আসে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব এবং পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ বণিকের হাতে রাজদণ্ড আসা। পলাশীতে ইংরেজ বিজয় ও ১৭৬৫-তে দেওয়ানি লাভ করার পর ইংরেজরাই বাংলার অর্থনীতি ও রাজনীতির সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। ইংরেজ কোম্পানি, তাদের কর্মচারী, নায়েব গোমস্তারা তাঁতিদের প্রায় ক্রীতদাসে পরিণত করে ফেলে। তাঁতিদের কোম্পানির গোমস্তাদের কাছে বাধ্যতামূলক ভাবে তালিকাভুক্ত হতে হয়। তাদের অন্য কোথাও কাপড় বিক্রি করার স্বাধীনতা আর থাকল না। পলাশী- উত্তর বাংলায় ইংরেজরা এতদিন যাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল— এশীয় ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের বণিকেরা— বিশেষ করে ডাচ ও ফরাসি— তাদের হটিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগল।

ওদিকে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে ইংল্যান্ডে অনেক সস্তায় সুতো কাটা ও কাপড় বোনা শুরু হয়ে গেল। বিদেশি তাঁতিদের তুলনায় এখানে মজুরি অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও Spinning Jenny-র উৎপাদন ক্ষমতার সঙ্গে এখানকার মাকু টাকু দাঁড়াতেই পারল না। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো ব্রিটিশ সরকার ভারতে উৎপাদিত কাপড়ের রপ্তানির ওপর উঁচু হারে শুল্ক বসিয়ে দেয়, কিন্তু ইংল্যান্ডের কাপড় এখানে ঢুকতে থাকে কোনো শুল্ক ছাড়াই। ফলে বাংলা বস্ত্রবিক্রেতা থেকে ক্রেতায় পরিণত হল। ইংল্যাণ্ডের তৈরি কাপড় শুধু বাংলায় রপ্তানির জন্য উৎপাদিত কাপড় নয়, এখানকার ব্যবহারের কাপড়ের বাজারও ধরে ফেলল। বাংলার আর্থসামাজিক জীবনে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হল। East india company-র Board of Trade তাদের প্রতিবেদনে লিখেছিল—

“A revolution so mighty and complete we conceive is hardly to be paralleled in the history of commerce.”

 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান