পোস্ট-ট্রুথের পোস্টমর্টেম

কঙ্ক ঘোষ

মহাভারতের দ্রোণ পর্বের এক মোড় ঘোরানো অধ্যায়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দ্রোণাচার্যের হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য পাণ্ডবরা নানা যুদ্ধকৌশল বিবেচনা করছেন। কৃষ্ণের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভীম যুদ্ধক্ষেত্রে অশ্বত্থামা নামক এক হাতি কে হত্যা করলেন। প্রসঙ্গত, দ্রোণাচার্যের পুত্রের নামও অশ্বত্থামা। ত্রিলোকের রাজত্বের বিনিময়েও কখনো মিথ্যা না বলা যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণের অনুরোধে দ্রোণাচার্য কে দিলেন তাঁর পুত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে ‘মিথ্যে’ মৃত্যুর খবর। কিন্তু কেমন সে মিথ্যা? যুধিষ্ঠির দ্রোণকে উচ্চস্বরে জানালেন ‘অশ্বত্থামা হত’। তারপর, গলার স্বর নামিয়ে নিখুঁত ভঙ্গিতে বললেন, আমি জানি না সে মানুষ না হস্তী (‘ইতি নারোভা কুঞ্জারোভা’)। দ্রোণাচার্য পুত্রশোকে বিহ্বল হয়ে ধ্যানে বসলেন, তাঁর শরীর থেকে ‘আত্মা’ ছুটে চলল ‘মৃত’ অশ্বত্থামার কাছে। ধৃষ্টদ্যুম্ন হত্যা করলেন দ্রোণাচার্য কে।

যথেষ্ট ব্যাকফুটে থাকা পাণ্ডবদের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অক্সিজেন জুগিয়েছিল এই রণকৌশল। অশ্বত্থামার মৃত্যুর ‘পোস্ট-ট্রুথ’ পাণ্ডবদের সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়েছিল। মহাভারতে যুদ্ধের নিছক কূটনীতি মাইথোলজি পেরিয়ে আজ প্রবেশ করেছে আমাদের যাপনে; অনেক ব্যাপ্ত, বিস্তৃত আকার ধারণ করেছে আমাদের বর্তমান সমাজবাস্তবতায়। দৈনন্দিন জনজীবনে পোস্ট-ট্রুথ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রকে ছলে-বলে-কৌশলে প্রভাবিত করছে। প্রভাবিত হচ্ছে প্রতিটা ছোটো ছোটো চিন্তা। আয়ত্ত করছে আমাদের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়া। সকালে হোয়াটস্যাপের ফরোয়ার্ডেড মেসেজ দেখতে দেখতে চোখ খোলা আর রাত্রে ফেসবুকের মনোগ্রাহী স্বচ্ছন্দপূর্ণ পোস্ট শেয়ার করার মাঝে রোজ একটু একটু করে পোস্ট-ট্রুথ, অল্টারনেট সত্যের অলি-গলি চোরাপথে বাসা বাঁধছে আমাদের মনন। সেই অল্টার-ফ্যাক্টস মানুষ-পুঁজি-যন্ত্র-বশ্যতা-অ্যালগরিদমের তাড়নায় দুর্বার গতিতে ভ্রমণ করছে, বৈজ্ঞানিক সত্য, যুক্তিবাদের বিশ্লেষণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, মন থেকে মনান্তরে, এক সমাজ থেকে অপর-সমাজে, এক ভাবনা থেকে অপর-ভাবনায়, এক শ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে।

এই জায়গায় কীভাবে পৌঁছালাম আমরা? নিছকই স্বতঃস্ফূর্ত অবগাহন? নাকি ম্যানিপুলেটেড, সুসঙ্গত কোনো অভিপ্রায়ের শিকার?

পোস্ট-ট্রুথ কী ও কেন?

প্রথমেই এই সতর্কীকরণ দিয়ে রাখা দরকার, যে পোস্ট-ট্রুথ শুধুমাত্র সত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মিথ্যা নয়। পোস্ট-ট্রুথের অন্যতম মূল আঙ্গিক হল শ্রোতার আবেগপ্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে শ্রোতার স্বাচ্ছন্দ্যবোধের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা খবর, যা কিছুটা সত্যি, কিছুটা মিথ্যে, কিছু অল্টারনেট সত্যি, কিছু প্রেক্ষিত বিহীন সত্যি এসবের সংমিশ্রণ: বস্তুগত সত্য এবং বদলিকৃত সত্যের মধ্যে চক্রাকার আসা-যাওয়া (circuitous slippage between facts and alt-facts)। অক্সফোর্ড অভিধানের সংজ্ঞা অনুযায়ী— ‘denoting circumstances in which objective facts are less influential in shaping public opinion than appeals to emotion and personal belief’। ব্রিটিশ সাংবাদিক ম্যাথিউ ড্যা’নকোনা তাঁর ২০১৭ য় প্রকাশিত বই ‘Post-Truth: The New War on Truth and How to Fight Back’ এ পোস্ট-ট্রুথ সম্পর্কে বলছেন ‘it depends less on liar, more on our response to lies’। অর্থাৎ শ্রোতার আবেগপ্রবণতার ম্যানিপুলেশন একটা বড় বৈশিষ্ট্য এই পোস্ট-ট্রুথের। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে ম্যাথিউ বলছেন ‘chosen reality that suits your emotional needs’। একটু তলিয়ে ভাবা যাক।

সাধারণত একটা ঘটনাকে মিথ্যা বলা হয় যখন তার সংশ্লিষ্ট সত্যের নিরিখে ওই ঘটনায় তথ্যগত, যুক্তিগত, ন্যায়গত (সমাজের সেই সময়ের সমষ্টিগত নৈতিকতার প্রেক্ষিতে) অন্তঃসারশূন্যতা ফুটে ওঠে যা পর্যায়ক্রমে সেই ঘটনার অস্তিত্বকে সংশয়িত ও অবিশ্বাস্য করে তোলে। এখন এই ‘মিথ্যা’ কে যদি নির্মাণ ( construct ) করা যায় একদম গোড়া থেকে, অর্থাৎ তার আপাত অন্তঃসারশূন্যতা ও অবিশ্বাসযোগ্য elements গুলোকে ঢাকার জন্য, এবং তা ক্রমাগত আমাদের মননে প্রক্ষেপ করা হয়, তাহলে? সোজা ভাবে ভাবুন। ধরুন, একটা সিনেমা দেখছেন। শুরুতেই দেখানো হল এক যুবক, রোগাপাতলা চেহারা,আরেক প্রচণ্ড শক্তিশালী একজনকে খুন করল। শুধু এই দৃশ্য দেখিয়ে সিনেমা শেষ হলে, না ওই দৃশ্য, না ওই ঘটনাটা আপনার, আমার মনে রেখাপাত করবে। কিন্তু বাকি সিনেমার চিত্রনাট্য যদি এমনভাবে বোনা যায় যাতে প্রতিটা ধাপে দেখানো যায় যে কীভাবে ওই আপাতভাবে দুর্বল ছেলেটি এই প্রবল-শক্তিধারী আরেকজনকে ধরাশায়ী করে ফেলল, তখন আমাদের শুরুতে দেখা অবিশ্বাসের অনেকটা দূর হয়, বা বলা ভালো শুরুর ওই ক্রিয়ার একটা লজিক্যাল, সুসঙ্গত প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। পোস্ট-ট্রুথের ব্যাপারটাও খানিকটা এরকম। ‘মিথ্যা’-র সুসঙ্গত নির্মাণ। ‘মিথ্যা’-র ক্রনোলজিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড গঠন। যা আগে ছিল ‘মিথ্যা’ তা এই নির্মাণ, base-স্ট্রাকচার পেয়ে হয়ে উঠল ‘alternate-facts’ বা ‘অল্টার-ট্রুথ’। আর অল্টার-ট্রুথ কে ট্রুথ বানানোর এখন অজস্র মাধ্যম। মনোপলি-মিডিয়া-খবর-সোশ্যাল মিডিয়া-অ্যালগরিদম-বিজ্ঞাপন-আপনি-আমি-আমরা-সোশ্যাল মিডিয়া-পরিবার-পাড়া-পড়শি-চেনা-অচেনা-রাজ্য-দেশ-পৃথিবী-স্যাটেলাইট-টেকনোলজি-পুঁজিবাদ-প্রফিট-লস-কোম্পানি-মনোপলি … আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে!

ব্রেক্সিট, ২০১৬ আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন : নিউ-এজ পোস্ট-ট্রুথ

২০১৬ থেকে পোস্ট-ট্রুথ গোটা পৃথিবী জুড়ে এক নতুন গতি পায় ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা (ব্রেক্সিট) এবং আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে। এই বছরই অক্সফোর্ড ডিকশনারি ‘পোস্ট-ট্রুথ’-কে ‘word of the year’ আখ্যা দেয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় ব্রিটেনের ব্রেক্সিট সংক্রান্ত গণভোট ও আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আবহে সার্বিকভাবে এই বিশেষণের ব্যবহারের আকস্মিক উত্থানের প্রসঙ্গ। তবে শব্দবন্ধ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ না হলেও পোস্ট-ট্রুথের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন উদাহরণ ছড়িয়ে আছে মানব-ইতিহাসের পরতে পরতে। কেউ কেউ মনে করেন মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার, ভাব আদান প্রদানের আদি পর্ব থেকেই এর উৎস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে নাৎসি জার্মানির ‘রাইখ মিনিস্টার অফ প্রোপাগান্ডা’ জোসেফ গোয়েবলসের সুপরিচিত তত্ত্ব : ‘একবার বলা মিথ্যা মিথ্যাই থেকে যায়, কিন্তু হাজারবার বলা মিথ্যা ধীরে ধীরে সত্যে পরিণত হয়’, কিংবা গণধ্বংসকারী অস্ত্রের ‘ভুয়ো’ অস্তিত্বের ওপর ভর করে আমেরিকার ২০০৩এর ইরাকে যুদ্ধ, বা ২০১১য় ন্যাটোর হস্তক্ষেপে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধ— অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

তখনও কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার পদার্পণ ঘটেনি আমাদের মস্তিষ্কে। ২০১৩। পা রাখল কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা। বা বলা ভালো কান পাতল। সোশ্যাল মিডিয়ার অজস্র তথ্য অনৈতিক ভাবে নেওয়া ও সেখান থেকে মানুষের আচরণগত প্যাটার্ন চিহ্নিতকরণ (Facebook–Cambridge Analytica data scandal) এবং সবশেষে ভোটের প্রেক্ষিতে তাকে প্রভাবিত করা— পৃথিবী প্রবেশ করল এক নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর ওপিনিয়ন তৈরির, তাকে ভেঙেচুরে ইচ্ছেমতো ছাঁচে তৈরির কারখানায়। সেই কারখানায় লগ্নি হতে শুরু হল ব্যাপক মাত্রায়। তৈরি হল ‘ফেক নিউজ’-এর আঁতুরঘর। ইতিউতি বিচ্ছিন্ন মিথ্যে, অর্ধসত্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগলবন্দীতে সংঘবদ্ধ, সম্মিলিত, ঘনীভূত হল। হল সুসঙ্গত, সামঞ্জস্যপূর্ণ, দৃঢ়বদ্ধ। বাহক, গ্রাহক পাওয়া গেল ready-made। এই আমার আপনার মতো অজস্র সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী। ক্রমে সেই ‘ইচ্ছেমতো ম্যানুফ্যাকচার্ড’ মতামত ছড়িয়ে পড়ল সমাজে, এই সভ্যতায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন হয়ে উঠল তার ব্যবহারিক ক্ষেত্র। ২০০৮এর অর্থনৈতিক মন্দা ও তার প্রভাবে আমেরিকার সামাজিকক্ষেত্রে হতাশা, অস্থায়িত্ব ও ভালনারেবিলিটির সুযোগে ‘ফেক নিউজ’ নিজেই হয়ে উঠল প্রতিষ্ঠান। আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনে, পরিবেশিত হল সেইসব ‘খবর’— কখনও ‘Pope Francis Shocks World, Endorses Donald Trump For President’ হয়ে কিংবা ‘WikiLeaks confirms Hillary sold weapons to ISIS’ রূপে। ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনার টেকনো-সোশিওলজিস্ট প্রফেসর জেনিপ টুফেকচি তাঁর ‘টুইটার এন্ড টিয়ার গ্যাস’ বইয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান গুলোর একটা বৈশিষ্ট্যই হল ক্রমাগত তথ্যের প্রাচুর্যে সাধারণ জনমানসকে আচ্ছন্ন করে রাখা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ভাবে বিভ্রান্তি, ভয় ও সন্দিহান করে তোলা। আবার মজার ব্যাপার হল এই ভয়, বিভ্রান্তির চোরাগলি-ই পোস্ট-ট্রুথ অনুপ্রবেশের আদর্শ ক্ষেত্র।

ম্যাসিডোনিয়ার তারুণ্য : পোস্ট-ট্রুথ ও আউটসোর্সিং

নিউ-এজ পোস্ট-ট্রুথ, আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের আবহে চলুন আপনাদের দিমিত্রির গল্প শোনাই। বছর ১৮র দিমিত্রির (নাম পরিবর্তিত) বাড়ি নর্থ ম্যাসিডোনিয়া; বুলগেরিয়া, গ্রিস, সার্বিয়া, আলবেনিয়া দিয়ে ঘেরা পূর্ব-ইউরোপের এক ছোট্ট দেশ, যার জনসংখ্যা ২ মিলিয়নের আশেপাশে। ২০১৬য় পাওয়া তথ্যানুসারে, ২০১৬ অবধি ম্যাসিডোনিয়ার জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ কর্মহীন এবং এই বেকারত্বের হার আমেরিকার তুলনায় প্রায় ৫ গুন। কিন্তু দিমিত্রি ২০১৬র শেষ ৬ মাসে উপার্জন করেছে প্রায় ৬০০০০ ইউ এস ডলার। শুধু দিমিত্রি নয়, ওর বয়সি অনেকেই একইরকম উপার্জন শুরু করেছিল সেই সময়। দিমিত্রিদের কাজ ছিল আমেরিকার নির্বাচনের আগে ফেক নিউজ তৈরি করা। ফেক নিউজের এক বিশাল আউটসোর্সিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠে ম্যাসিডোনিয়ার ছোট্ট শহর ভেল্স কে কেন্দ্র করে। আমেরিকার নির্বাচনের আগে জনমত অনুযায়ী ফেসবুক, টুইটার বা ফেক ওয়েবসাইট বানিয়ে সেখানে প্রকাশ করা হত ‘ফেক নিউজ’। এই সব আকর্ষক ‘ফেক নিউজ’ লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যেত, এবং এই প্রবল ভিউয়ারশিপ ডেকে আনত অজস্র বিজ্ঞাপন। আর বিজ্ঞাপনের pay per click মডেল থেকে দিমিত্রিদের যাবতীয় উপার্জন। Pay-per-click (PPC) হল এমন এক বিজ্ঞাপন মডেল যেখানে বিজ্ঞাপনদাতা কোনো খবরের ওয়েবসাইটের প্রকাশক বা লেখককে ওই বিজ্ঞাপনে প্রতি ক্লিক পিছু একটা নির্দিষ্ট অর্থ দেন। ফেক নিউজের ব্যাপক, বিস্তৃত ‘reach’ দিমিত্রিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টেনে আনে লক্ষ লক্ষ ইউ এস ডলার।

কিন্তু ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বিপুল মানুষের অংশগ্রহণের রহস্য কি?

একটি ফেক-নিউজের ব্যবচ্ছেদ : প্রথম ধাপ হল ইন্টারনেটে ট্রেন্ডিং কোনো বিষয় বাছাই করা। এবার ওই খবরের কিছু অংশ অন্য ফেক নিউজ ওয়েবসাইট বা বিভিন্ন মিডিয়ার থেকে সংগ্রহ করা। কখনো সরাসরি বিভিন্ন ফেক ওয়েবসাইট তৈরি করা যেগুলো আপাতভাবে কোনো পরিচিত নিউজ পোর্টালের সদৃশ। এরপরের ধাপ হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পোস্ট-ট্রুথ নির্মাণের ধাপ। খবর গুলোর খুঁটিনাটি ঘটনা ম্যানুফ্যাকচার করা ও তাকে সুসঙ্গত রূপ দেওয়া। ক্রিয়েটিভিটির অসীম ক্ষেত্র। সর্বশেষ পর্যায় হল এক আকর্ষণীয় শিরোনাম। যেমন ক্যাপ্স-লক সহকারে OMG! বা BREAKING NEWS! কিংবা নিদেনপক্ষে একটা WOW! সব মশলা পড়ে গেছে। রান্না তৈরি। এবার গরম গরম পরিবেশন। দরজায় কড়া নাড়ছে আমেরিকান ডলার। স্বপ্ন। স্বপ্ন ছুঁতে পারার স্বপ্ন। ২০১৬র আমেরিকার ইলেকশন ও সংশ্লিষ্ট ফেক নিউজের বিপুল আউটসোর্স, যুবকদের কর্মসংস্থানের দরুন ম্যাসিডোনিয়ার অর্থনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ জোরালো প্রভাব নজরে আসে। আমেরিকান ডলারের অন্তঃপ্রবাহ ভেল্সের মতো ছোটো শহরে গড়ে তুলেছে এক ক্রমবর্ধনশীল ‘নাইট-লাইফ’ ও ‘পার্টি-কালচার’। ১৬-১৭ বছরের টিন-এজারদের অনেকের কাছেই আজ শোভা পাচ্ছে BMW গাড়ি। স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক সম্পর্ক পুনর্গঠিত, পুনর্বিন্যস্ত এবং অভিযোজিত হয়েছে এই পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। ভেল্সের বছর ৪০এর ট্যাক্সি ড্রাইভার টোনির কথায় ‘কমবয়সি মেয়েরা মাচো ছেলেদের চাইতে কম্পিউটার গিক দের বেশি পছন্দ করছে’। টোনির মতো ভেলসের অনেকের কাছেই ফেক নিউজ-এর বাহক হবার সঙ্গে পারিপার্শ্বিক স্থানীয় সমাজের নৈতিকতার কোনো বিরোধ নেই। তাঁদের কাছে টিন-এজার দের ড্রাগ বা অন্য কোনো চক্রে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে ঢের ভালো ফেক নিউজের কারবারি হওয়া। এ যেন এক অনন্ত স্পাইরাল পোস্ট-ট্রুথ সমাজের বেড়ে ওঠা। যেখানে পোস্ট-ট্রুথ তৈরির পদ্ধতি পারিপার্শ্বিক সমাজে মান্যতা পেয়ে যায় আরও কোনো গ্রান্ড-পোস্ট-ট্রুথের কবলে পড়ে। মানুষকে কি তবে ‘doodlebug’ এ কামড়াল?

বিজ্ঞান ও পোস্ট-ট্রুথ

এতক্ষণের আলোচনার প্যাটার্ন দেখে এটা বুঝতে খুব অসুবিধে হয় না যে পোস্ট-ট্রুথের সঙ্গে অবজেকটিভ-ট্রুথের সংঘর্ষ, সংঘাত অনিবার্য। বিজ্ঞান হয়তো আমাদের হাতের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যা পোস্ট-ট্রুথের বিরুদ্ধে এক নির্দিষ্ট সত্যের পথ দিতে পারে। কিন্তু সামনে এক বিশাল অন্তরায়। বিজ্ঞান-মনন থেকে আমজনতার মননের অন্তরায়। একথা আজ অস্বীকার করার জায়গা নেই বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতি সমস্ত মানুষের কাছে সমভাবে পৌঁছোয়নি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি মূলত ব্যবহৃত হয়েছে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সুবিধার্থে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাইভেটাইজেশন, অবৈতনিক শিক্ষার পরিকল্পনার অভাবে পিছিয়ে পড়া, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিজ্ঞানকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। সাধারণের কাছে বিজ্ঞানের ক্রিয়াকলাপ হয়ে উঠেছে দুরূহ। বিভিন্ন পুঁজিবাদী শক্তির বা বলা ভালো প্রতিষ্ঠানের ভেস্টেড ইন্টারেস্ট শুধু তৃতীয় বিশ্ব নয়, আমেরিকার মতো আধুনিক দেশেও তৈরি করেছে এই বিজ্ঞান বিচ্ছিন্নতা। বিজ্ঞান-সংক্রান্ত পোস্ট-ট্রুথ, সিউডোসায়েন্স, ভুল তথ্য, গুজব তৈরি করেছে প্রায় দু দশক ধরে আমেরিকায় চলা ‘anti-vaccine movement’-এর। অনুঘটকের কাজ করছে আমেরিকা সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে আসা একের পর এক অবৈজ্ঞানিক বিবৃতি। চিলড্রেন্স হসপিটাল অফ ফিলাডেলফিয়ার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ পল ওফিটের জবানবন্দি ‘Science has become just another voice in the room’। তাঁর গলায় একরাশ আক্ষেপ আর হতাশা ‘It has lost its platform. Now, you simply declare your own truth’।

প্রথম বিশ্বে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির শিখরে পৌঁছানো আমেরিকার সাধারণ জনমানসের বিজ্ঞান বিচ্ছিন্নতা আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে ভয়াবহ রূপ নেবে সেটাই স্বাভাবিক। বিগত কয়েক বছরে আমাদের দেশের রাজনীতির সর্বোচ্চ স্তর থেকে, শিক্ষা-নীতি প্রণয়নের সর্বোচ্চ স্তর থেকে একের পর এক অবৈজ্ঞানিক, সিউডো সায়েন্টিফিক বিবৃতি, ব্যাখ্যা এক নতুন স্তর ছুঁয়েছে। গণেশের শল্যচিকিৎসা, রাহু-কেতু-সূর্যগ্রহণ, ডারউইনের মতবাদকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া, সম্পূর্ণ প্রেক্ষিতহীন ভাবে কোয়ান্টাম শব্দকে ঘর-বাড়ি-ভূত-ভবিষ্যতের সঙ্গে মিশিয়ে এক কিম্ভূতকিমাকার বিজ্ঞান-বিকৃতি, পুরাণ-ইতিহাস-বিজ্ঞান মিশিয়ে পুস্পক রথের আদি-এরোডায়নামিক বিচিত্র ক্রিয়াকলাপ, লিস্ট বড়ো লম্বা। যথাযথ সঙ্গত দিয়ে চলেছেন বিভিন্ন ‘মোটিভেশনাল আধ্যাত্মিক মনন’-রা। তাঁদের কারো কারো পোস্ট-ট্রুথ খুব সূক্ষ্ম, সাথে চোস্ত ইংরেজি, এক চামচ অপ্রাসঙ্গিক বৈজ্ঞানিক টার্মিনোলজি, দু চামচ মাইথোলজি, আর ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা অজস্র মিথ্যা, ভুল তথ্যের স্বেচ্ছাকৃত নিরন্তর প্রক্ষেপণ—সিউডোসায়েন্স ও পোস্ট-ট্রুথের এক কমপ্লিট প্যাকেজ।

ভারতবর্ষ, সমসাময়িক রাজনীতি ও পোস্ট-ট্রুথ

অর্থনৈতিক মাপকাঠির নিরিখে দেখলে ভারতবর্ষের মাথাপিছু গড় আয় আমেরিকার এবং ব্রিটেনের মাথাপিছু গড় আয়ের যথাক্রমে ৩ ও ৪ শতাংশের চেয়েও কম। এই অর্থনৈতিক ভগ্নাবশেষ ও ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পোস্ট-ট্রুথের চরিত্র ও অভিমুখ স্বাভাবিকভাবেই অনেক আলাদা। বিবিসি নিউজের রিসার্চ উইং-এর এক সমীক্ষাপত্রে উঠে এসেছে আরও ভয়ঙ্কর কিছু তথ্য। উগ্র জাতীয়তাবাদ উঠে আসছে ভারতবর্ষে ‘ফেক নিউজ’-এর মূল চালিকা শক্তি হিসেবে। এবং প্রথম বিশ্বের মতো শুধুমাত্র মানুষকে ভুল, বিকৃত তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো নয়, প্রান্তিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতি হিংস্র আক্রমণের জন্য জনমত সংগঠিত করেছে, করে চলেছে। ২০১৮র ওই সমীক্ষা অনুযায়ী অন্তত ৩০ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে শুধুমাত্র ফেক নিউজ প্রভাবিত ভায়োলেন্সকে কেন্দ্র করে। মাইক্রোসফট-এর আরেক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ভারতবর্ষের জনসংখ্যার অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষ এই অনলাইন ‘ফেক নিউজ’- এর সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে এসেছেন, যা গ্লোবাল এভারেজের (৫৭%) চেয়েও বেশি। পরিস্থিতির চাপে হোয়াটস্যাপকে নতুন রেগুলেশন করে ফরোয়ার্ডেড মেসেজের প্রেরকের সংখ্যা নির্দিষ্ট করতে হয়েছে সম্প্রতি।

পোস্ট-ট্রুথের দর্শন

ঐতিহাসিকভাবে সত্যি, মিথ্যে, অর্ধসত্য, আপেক্ষিক সত্য থেকে অল্টার-ফ্যাক্ট ও পোস্ট-ট্রুথের ক্রমবিবর্তন ধারা উপলব্ধি করতে প্রয়োজন পোস্ট-ট্রুথের দার্শনিক উৎসসন্ধান। অনেক গবেষক এই আপেক্ষিক সত্যের দার্শনিক উৎপত্তির কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন পোস্ট-মডার্ন তত্ত্বকে। পোস্ট-মডার্ন তত্ত্ব অবজেকটিভ রিয়েলিটির একরকম বিপরীত অবস্থান নিয়েই ব্যাখ্যা করে যে, রাজনীতি এবং জনমত গঠনের ক্ষেত্রে মূল্যবোধ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ভবিষ্যতের সামাজিক বিন্যাসের খতিয়ান ছাড়া শুধু অবজেকটিভ রিয়েলিটির ধারণা অনেকাংশে বিভ্রান্তিকর। এই প্রসঙ্গে ফ্রেডরিক নিত্চা (Nietzsche)-র চরমসত্য বা absolute truth সম্পর্কে সমালোচনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তাঁর মতে ‘there are no facts without interpretation, i.e. without selection, valuation, adoption, contextualisation, simplification, reduction of complexity, etc’। তবে interpretation বা বিশদ ব্যাখ্যা আর subjectivism বা আপেক্ষিকতার মধ্যে ফারাক সম্পর্কে তিনি সতর্ক করেছেন। তাঁর কাছে অবজেক্টিভিজমের বিপরীত প্রেক্ষিত সর্বদা সাব্জেক্টিভিজম নয়, বরং একধরণের anthropocentrism, যা কিনা মানবিক মূল্যবোধ ও অভিজ্ঞতার সম্মিলিত প্রয়াসে পৃথিবীর ব্যাখ্যা। এ গেল সত্যকে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখার, অনুভব করার দর্শন। অন্যদিকে আধুনিক পোস্ট-ট্রুথ মূলগতভাবেই শ্রোতা-নির্ভরশীল বা নির্দিষ্টভাবে শ্রোতার আবেগপ্রবণতা নির্ভর একটা phenomena। কমিউনিকেশন থিওরিস্ট ওয়াল্টার ফিশারের মতে— we are predisposed to the emotional appeal of stories because we are ‘innate story-tellers’: ‘stories are the human way of making sense of things. Narrative structures are a device the human being uses to slot information into a meaningful form’। অর্থাৎ জাগতিক সমস্তকিছুর অর্থ অনুধাবন করতে আমরা সাধারণভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই গল্পের বা একটা ন্যারেটিভ স্ট্রাকচারের আশ্রয় নিই। তাই কোনো সুবিন্যস্ত ন্যারেটিভ দেখে সংবেদনশীলভাবে আকর্ষিত হবার ঘটনাও আমাদের ক্ষেত্রে সহজাত। আর যেখানেই আবেগপ্রবণতার বাড়বাড়ন্ত সেখানেই ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং ব্যাকসিট নিতে বাধ্য। ফরাসি দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী জঁ বদ্রিয়ার ‘hyperrealism’-এর কথা এ প্রসঙ্গে উঠে আসবে। রিয়েলিটি এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, হিউম্যান ও আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর মধ্যে দোদুল্যমান এই হাইপাররিয়েলিজম মানুষকে তার বাস্তব এবং ‘simulated’ বাস্তবের মধ্যে তফাৎ করার ক্ষমতা হারিয়ে দেয়। তৈরি হয় ‘simulated reality’ বা অল্টারনেটিভ রিয়েলিটি। এর উদাহরণ তো আমার আপনার চারপাশে অজস্র। আমরা অনেকেই ভীষণ একা অথচ ভার্চুয়াল জগতে আমাদের অগুনতি বন্ধু।

সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের প্রান্তিক অবস্থানে থাকা মানুষদেরও পোস্ট-ট্রুথ গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। মার্ক্সবাদী ব্যাখ্যায় এই ঘটনাকে ‘false consciousness’ (প্রথম প্রয়োগ: György Lukács) বলে অভিহিত করা হয়। দার্শনিক, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মার্ক্স তাঁর ‘Economic and Philosophic Manuscripts of 1844’-এ এই ধাঁচের প্রবণতা কে ব্যাখ্যা করেছেন প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার জন্য তার শ্রম বিক্রী ও শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হবার প্রেক্ষিতে। প্রান্তিক শ্রমিক শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে নিজের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য এবং নিজের শ্রমজাত বস্তু (product)-র মালিকানা কখনোই ভোগ করতে পারে না। ফলস্বরূপ নিজের সৃষ্ট বস্তু এবং স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্ক গুলো থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে (alienation)। নিজের শ্রমজাত বস্তু যা বাজারে পণ্যে পরিণত হয় তা তার কাছে থেকে যায় অধরা, বিমূর্ত। এই বিচ্ছিন্নতা তার মধ্যে তৈরি করে সত্য মিথ্যার বিভ্রান্তি। সামাজিক সম্পর্ক, শোষণ সম্পর্কে তার মধ্যে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। সামাজিক-অর্থনৈতিক-মানসিক প্রেক্ষিতে সে বিভ্রান্তি, মিথ্যে, অর্ধসত্যর সঙ্গে লড়াই করার সামর্থ্য হারায়। তার সমাজবাস্তবতা উল্টে তাকে বিভিন্ন বিভ্রান্তি আঁকড়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য করে। ‘False consciousness’ তাকে ঠেলে দেয় পোস্ট-ট্রুথের অনন্ত গহ্বরে।

প্রতিরোধ ও প্রতিক্রিয়া

পোস্ট-ট্রুথ কে কাউন্টার করার পন্থা কি? হয়তো একটাই পন্থা, সত্যিকে প্রতিমুহূর্তে এবং বারংবার মানুষের সামনে তুলে ধরা। কোনো মিথ্যা যদি হাজারবার নিয়মিত প্রক্ষেপণে ‘অল্টার-ট্রুথ’-এর আকার ধারণ করে, তাহলে অবজেকটিভ ট্রুথকে তার চেয়েও বেশিবার নিয়মিত মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায় এসে বর্তায় আমাদের কাছে। তাই পোস্ট-ট্রুথের দুর্বার গতিকে রুখে দেবার লড়াইও থেমে নেই। থামতে পারে না। লড়াই জারি আছে। এক ক্রমবর্ধনশীল ফ্যাক্ট-চেক ইন্ডাস্ট্রি ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে গোটা পৃথিবী জুড়ে। তৈরি হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্ক (IFCN), যে প্রতিষ্ঠান উপদেশক এবং নিরীক্ষকের ভূমিকা পালন করছে গোটা পৃথিবীর সমস্ত ফ্যাক্ট-চেক নিউজ পোর্টাল ও ওয়েবসাইট সমূহের। আমাদের দেশে IFCN স্বীকৃত কিছু উল্লেখযোগ্য নিউজ পোর্টালের মধ্যে নাম আসবে Alt-News, Web-Qoof (The Quint) সহ আরো অনেক পোর্টালের। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৯এ OpIndia নামক পোর্টাল IFCN দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

অপরদিকে ইউরোপে ‘ফেক নিউজ’-এর প্রভাব রুখতে জার্মানি এবং ফ্রান্সের মধ্যে ২০১৯এর জানুয়ারিতে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তারও আগে জার্মানিতে ২০১৭য় নেটওয়ার্ক এনফোর্সমেন্ট অ্যাক্ট নামে এক আইন প্রণয়ন হয় যার উদ্দেশ্য ছিল সোশ্যাল মিডিয়ার ফেক নিউজ নিয়ন্ত্রণ। একইপথে ২০১৮র ২০ নভেম্বর ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি তে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল ‘the law against the manipulation of information’। ২০১৮য় ইউরোপিয়ন ইউনিয়ন এক সাধারণ গাইডলাইন প্রকাশ করে ফেক নিউজের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে। তবে শুধু ফ্যাক্ট-চেক বা আইন প্রণয়ন হয়তো যথেষ্ট নয় এই ফেক-নিউজের বিপদ থেকে মুক্ত হবার জন্য। এ এক বিষাক্ত ছোঁয়াচে রোগ। প্রবল গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের সামাজিক বাস্তুতন্ত্রে। নতুন প্রজন্ম কি তাহলে আর অবজেকটিভ ট্রুথ শুনবে না, জানবে না? বিজ্ঞানভিত্তিক সত্য কি ফুরিয়ে যাবে? তাদের বড় হয়ে ওঠা জুড়ে কি ঘিরে থাকবে আপেক্ষিক সত্যের মোহ? ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’?

তবু মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। লড়াই চলে সত্যিকে চেনানোর, জানানোর। ২০১৮য় কেরালার কন্নুর জেলায় ১৫০টি সরকারি স্কুলের অষ্টম থেকে একাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে শুরু হয়েছে ‘ফেক নিউজ’ শনাক্তকরণ ও সচতনতা বিষয়ক শিক্ষাদান। দেশে দেশে শুরু হোক এই সচেতনতার পাঠশালা। দিকে দিকে গড়ে উঠুক বৈজ্ঞানিক সত্যের ব্যারিকেড।

‘ক্যাটালগটা দেখো বরং, বলো পছন্দ কোন গড়ন’

পোস্ট-ট্রুথ এখন বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। মিডিয়া আপনাকে দুবেলা সরবরাহ করে। ফেসবুক, ওয়াটস্যাপ আপনাকে প্রতি মুহূর্তে আপনার কাঙ্খিত, কমফর্ট জোনীয় পোস্ট-ট্রুথের চাহিদা মেটায়। আপনার জ্ঞানের দৈন্য ঢাকতে পোস্ট-ট্রুথ ডেটার বিস্ফোরণ ঘটানো হয় আপনার মগজে। আপনি কখনো ভাবেন আপনি খতরে মে, কখনো আপনি প্রতিবেশীর দেয়ালে খিস্তি মেরে আসা বীর যোদ্ধা, আবার এই আপনিই দিনের শেষে কিছু খুচরো টাকার বিনিময়ে পোস্ট-ট্রুথের বাহক। আপনি নিজেই খাদক, আপনি নিজেই খাদ্য। আপনি এখন শিকারি। পরমুহূর্তে আপনিই শিকার। এই ডায়ালেক্টের মধ্যে থেকেই আপনার অল্টার্নেট ‘সত্যের’ গহ্বরে অনন্ত অভিসার।

এর মধ্যেই ঝড় আসছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অন্ধকার নেমে আসছে। রাত বাড়ছে। ভয় বাড়ছে। সত্যি, মিথ্যে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে অ্যালগরিদমের দৌরাত্ম্য। ভয়ে দরজা, জানালা বন্ধ করে দিলেন। কে যেন জানলার পাশ থেকে আপনার নজরদারি করছে। আপনি জানলার পর্দা টেনে দিচ্ছেন। দম বন্ধ লাগছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? আই. সি. ইউ. লাগবে নাকি? অবশ্যই লাগবে। এই আই. সি. ইউ. আপনাকে গিলে নেবে। প্রযুক্তিনির্ভর হতে হতে, প্রকৃতি থেকে, আপনার নিজের শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে কবে যে নিজেই এক কৃত্রিম যান্ত্রিক, উচ্ছিষ্ট, বোবা রোবটে পরিণত হয়েছেন, বুঝতে পারেননি। আপনার সবই সত্যি মনে হয়। কখনো সবটাই মিথ্যে লাগে। সত্যি মিথ্যে দুজনে গলা টিপে ধরে আপনার। আপনি দুজনকেই ভয় পান। এই ‘রশোমনীয়’ টানাপোড়েনে মৃত্যু আপনার নিশ্চিত। তাই আই. সি. ইউ.-এর দরজায় কড়া নাড়ার আগে শেষবার চিৎকার করে পরের প্রজন্মকে জানিয়ে যান— ‘passivity is not a neutral act, it’s a conscious decision to allow the state’s judgement— DEMAND THE TRUTH’।

তথ্যসূত্র

১. https://www.amazon.com/Post-Truth-New-Truth…/dp/1785036874

২. https://www.youtube.com/watch?v=LceVAOiVGgg

৩. https://www.nbcnews.com/…/fake-news-how-partying…

৪. http://downloads.bbc.co.uk/…/duty-identity-credibility.pdf

৫. Marx, K. (1932/2009). Economic and Philosophic Manuscripts of 1844. (http://www.marxists.org)

৬. Larsson, J.. “False consciousness revisited : On Rousseau, Marx and the positive side of negative education.” (2011)

৭. Heit, H. (2018). “there are no facts. . . ”: Nietzsche as Predecessor of Post-Truth?. Studia Philosophica Estonica, 11, 44-63

৮. Jayson Harsin, Post-Truth and Critical Communication, 10.1093/acrefore/9780190228613.013.757 Oxford Research Encyclopedia of Communication

৯. Reinhoud, E.L., The Post-Truth Era: Crises of Truth in (Post-)Postmodern Literature (2019) (Master thesis), https://dspace.library.uu.nl/handle/1874/384022

১০. https://www.twitterandteargas.org/

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান