মৃন্ময় মুখার্জি
A big communication gap, সরকারের সদিচ্ছা, কৃষকের দ্বিগুণ আয়, কৃষি সংকট ও সংস্কার, ফসলের বৈচিত্র্য, ধনী কৃষক, মুক্ত বাজার, নতুন স্বাধীনতার দিগন্ত, পরিসংখ্যান ও তার সুবিধাজনক ব্যাখ্যা, প্রশাসনিক-সাংবিধানিক জটিলতা, মিডিয়া, অর্থনৈতিক লাভক্ষতি, বিগ কর্পোরেট, ধনতন্ত্র, পাঞ্জাব-হরিয়ানা— এসব তর্কের মাঝে রাজধানী সীমান্তে প্রতিরোধ ছুঁয়েছে ৫০ দিন, মৃত্যু ছুঁয়েছে আরো প্রায় গোটা দশেক বেশি। তবু জেদি কৃষকের দল নাছোড়বান্দা, নতুন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অটুট। আন্দোলনের শক্তি ক্রমবর্ধমান। প্রবল শীতে খোলা আকাশের নীচে জীবনের আয়োজন। দেশজুড়ে কৃষকের অংশগ্রহণ ও সংহতি। মুক্ত বাজারে স্বাধীনতা আর সরকারি হস্তক্ষেপে শৃঙ্খল— এই দুমেরুর দর্শন উন্মোচনের পূর্বে, চলুন ফিরে যাওয়া যাক মূল বিষয়ে। বলা যাক কৃষি আইনের গল্প। মন কি বাত। গাওয়া যাক কৃষকের জমি সামলানোর গান। কত ধানে কত চাল। লঙ্গরের রুটির সঙ্গে সেঁকে নেওয়া হোক যুক্তি-প্রতিযুক্তি-প্রযুক্তির খতিয়ান। কৃষক পক্ষ, সরকার পক্ষ ও মধ্যবর্তীর মতামত সাজিয়ে দেওয়া যাক ক্রমান্বয়ে অথবা ক্রম ভেঙে। আপনি মাপতে থাকুন এই আলোচনার অবস্থান কোন্ দিকে— লেফ্ট, রাইট না সেন্টারে। খলিস্তান, মাওবাদী, আরবান নক্সাল, রিচ ফার্মার, কানাডা— ন্যারেটিভের বাইরে এসে, উদাসীন ডিজিটাল ভারত সাড়া দিন। দিশা না হোক, চলুন দৃষ্টিপ্রাপ্ত হই।
থ্যাচার মোমেন্ট, ১৯৯১ মোমেন্ট, ডি-লা-গ্রান্ডি এ-এ-এ। ২০২০-র মোদি সরকারের উপহারের ডালি। আবহমান দুর্দশা থেকে কৃষকের মুক্তি। কৃষি সংকটের সংস্কার। তিনটি তাজা আইন—
(১) THE FARMERS (EMPOWERMENT AND PROTECTION) AGREEMENT ON PRICE ASSURANCE AND FARM SERVICES ACT, 2020
(২) THE FARMERS’ PRODUCE TRADE AND COMMERCE (PROMOTION AND FACILITATION) ACT, 2020
(৩) THE ESSENTIAL COMMODITIES (AMENDMENT) ACT, 2020
নামগুলি থেকেই বোঝা যায় কৃষকের ক্ষমতায়ন, সুরক্ষা, অগ্রগতি, সুবিধা, ন্যায্য আয়ের আশ্বাস ইত্যাদির প্রতিশ্রুতি ও সম্ভাবনা। কিন্তু এত বড়ো বড়ো নাম দিয়ে তো আর স্লোগান চলে না। তাই কৃষক, গণমাধ্যমের অনুপ্রেরণায় মৌখিক নাম দেওয়া যাক— (১) চুক্তিবদ্ধ কৃষি বা চুক্তিচাষ আইন, (২) নতুন APMC আইন এবং তৃতীয়টির অর্থ অপরিবর্তিত রেখে (৩) অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন।
এই আইনগুলি ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থা সংস্কারে সহায়ক হবে। বেসরকারি সেক্টর আকৃষ্ট হবে কৃষির প্রতি। প্রাইভেট লগ্নি সাহায্য করবে নতুন বাজার, নতুন চাহিদা উন্মোচনে। তৈরি হবে কৃষক ও ক্রেতার সরাসরি সম্পর্ক। চাষিরা পাবে ফসলের সঠিক মূল্য। ঘুচে যাবে দুঃখের দিন। চুক্তিচাষ আইনের আওতায় ব্যবসায়ী সরাসরি চুক্তিবদ্ধ হবে কৃষকের সঙ্গে আইনগতভাবে এবং অভিভাবকের মতো তাকে সাহায্য করবে জমি তৈরিতে, নিখরচায় বা কম খরচায় পরিবহনে, পরামর্শ দেবে উৎকৃষ্ট উৎপাদনে এবং সবশেষে ফসল কিনে নেবে পূর্বনির্ধারিত ন্যায্যমূল্যে। দেশজুড়ে এক সুন্দর ও সুবিন্যস্ত পরিকাঠামো তৈরি হবে। Agriculture Produce Marketing Committee (APMC)-র সরকারি নজরদারিতে কৃষকেরা যে যে অসুবিধা ভোগ করে সেগুলি হল— মিডল ম্যান আড়তদারদের শোষণ, বস্তাপচা সরকারি ব্যবস্থা, অনাধুনিক Minimum Support Price (MSP)-র চক্করে ফসলের বেশি দাম না পাওয়া। নতুন APMC আইনবলে এখন কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ফসল বেচতে পারবে পছন্দ মতো যেখানে খুশি, যাকে খুশি, নিজ রাজ্যে বা অন্য রাজ্যে। যেকোনো ব্যক্তি বা সংস্থা শুধুমাত্র প্যান কার্ড থাকলেই ভাসাতে পারবে সপ্তডিঙা, তাকে অতিক্রম করতে হবে না APMC-র পুরনো নিয়মকানুন। APMC চত্বরের বাইরের বাণিজ্য হবে অতিরিক্ত করমুক্ত, রাজ্য সরকার গ্রহণ করতে পারবে না কোনো রকম কমিশন ফি, থাকবে না কোনো ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বাধা— ফসলের মূল্য নির্ধারিত হবে চাহিদা অনুযায়ী। সব টাউট এখন আউট। সরকারি APMC-র বাধ্যবাধকতা ও একাধিপত্য থেকে স্বাধীনতা উৎসাহিত করবে নতুন নতুন ব্যবসায়ীদের, মুক্তবাজারের প্রতিযোগিতায় কৃষিপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘোচাবে কৃষকের বঞ্চনার দিন। আদ্যিকালের খেরোর খাতা ছেড়ে বাণিজ্য হবে সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক, ডিজিটাল অতএব স্বচ্ছ। আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ যাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, যেমন চাল, গম, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল ইত্যাদি। কিছু বিশেষ ক্ষেত্র, যেমন যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া কেন্দ্র সরকার এগুলির সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে না। ফলে যখন তখন উৎপাদন ঘাটতিতে (কিছুদিন আগে পেঁয়াজের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের উদাহরণ মনে করুন) অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের অজুহাতে সরকার যে খাদ্যশস্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে, তার অবসান হবে। উপরি পাওনা হিসাবে এই আইনে রয়েছে আরও একটি ছাড়। থাকবে না কোনো মজুত করার ঊর্ধ্বসীমা যদি না পণ্যের বাজারি মূল্য ১০০ শতাংশ (৫০% অ-পচনশীল খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে) বৃদ্ধি পায়। এটিও উৎসাহিত করবে বড়ো ব্যবসায়ীদের কৃষিক্ষেত্রে লগ্নিতে। বড়ো কর্পোরেট সংস্থা নিজ খরচায় শস্য মজুত করতে পারবে উন্নত পরিকাঠামোয়, উৎপাদনের সমস্যাতেও বাজার থাকবে স্থিতিশীল। অর্থাৎ এই তিনটি নতুন আইনবলে, সরকারি (কম)-বেসরকারি (বেশি) ব্যবস্থাপনায় কৃষকের ঘরে লক্ষ্মী থাকবে সদা বিরাজমান।
এই সুন্দর তোফা, স্বপ্নময় সম্ভাবনা কৃষকেরা কবুল করল না। সর্ষের মধ্যে ভূতকে তারা চিনতে পারল। একদিকে খলিস্তানি, মাওবাদী, ধনী কৃষকের সামাজতন্ত্র, পিকনিক, পাঞ্জাব-হরিয়ানা কেন্দ্রিক আন্দোলন-এর অপবাদ; অন্যদিকে অসহ শীত, করোনা ও অন্যান্য অসুবিধা— তবু অটুট রইল আন্দোলন। মোদিজির MSP বজায় থাকার আশ্বাস কাজ করল না। তখন চাপে পড়ে বাপ মুখ খুলল। অনেক গড়িমসি, উভয়পক্ষের অনেক মিটিং-এর পর সরকার সম্মিলিত কৃষক সংগঠনের ২৩ দফা দাবির বিপরীতে কৃষি আইনের সংশোধনের প্রস্তাব দিল—
(১) ক্রমবর্ধমান প্রাইভেট প্লেয়ারের (আম্বানি-আদানি) চাপে APMC ক্রমশ দুর্বল হবে, কৃষকেরা তখন নতি স্বীকার করতে বাধ্য হবে বিগ কর্পোরেটের মনোপলির কাছে। নতুন প্রস্তাবে প্রাইভেট বাজারকেও, APMC-তে বাণিজ্যের মতো, করের আওতায় আনা হবে।
(২) বেসরকারি ব্যবসায়ীদের নিবদ্ধকরণ প্রয়োজন। ঘোট করলে পাখি যেন উড়তে বেগ পায়। নতুন প্রস্তাব— রাজ্য সরকার প্রয়োজনে আইন তৈরি করবে।
(৩) চুক্তিচাষে বা অন্য কোথাও সমস্যা দেখা দিলে কৃষকের নিষ্পত্তির শেষ পথ ছিল Sub-divisional Magistrate, collector বা additional collector দ্বারা গঠিত কমিটি। “No suit, prosecution or other legal proceeding shall lie against the Central Government, the State Government, the Registration Authority, the Sub-Divisional Authority, the Appellate Authority or any other person for anything which is in good faith done or intended to be done under the provisions of this Act or any rule made thereunder.” জনগণের আইনি অধিকার খর্ব করা হয়েছিল এই কৃষি আইনে। চুক্তিচাষ আইনের ধারা ১৮, ১৯ এবং নতুন APMC আইনের ধারা ১৩, ১৫-এ তা স্পষ্ট। নতুন প্রস্তাবে সিভিল কোর্টে যাওয়ার অপশান থাকবে।
(৪) চুক্তিচাষে কৃষক ও ব্যবসায়ীর চুক্তিপত্রের বিষয়টি বাধ্যতামূলক নয়। সবকিছু আস্থা, বিশ্বাস, ‘good faith’-এর ওপর দাঁড়িয়ে। আর চুক্তিপত্র থাকলেও তার আইনি দৃঢ়তা কোথায়? ক্ষমতার দুই অসমান দিক! নতুন প্রস্তাব— রাজ্য সরকার বিষয়টি দেখবে।
(৫) কৃষকের আশঙ্কা তার জমি বৃহৎ পুঁজিপতি গ্রাস করবে। সরকারের দাবি— আইনে উল্লেখ আছে কৃষিজমি থেকে কোনো লোন নেওয়া যাবে না এবং কোনোভাবেই জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না।
(৬) ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP)-এর আইনি বৈধতা। নতুন প্রস্তাব— কেন্দ্র সরকার লিখিত আশ্বাস প্রদান করবে।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন বা মজুতের ঊর্ধ্বসীমা বিষয়টি নতুন প্রস্তাবে অনালোচিত। মজুতের ঊর্ধ্বসীমা না থাকায় অন্যায়ভাবে মজুত করার প্রবণতা বাড়বে। বাজারে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করা যেতে পারে। থাকছে কালোবাজারির সম্ভাবনা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কোনো বাধাও থাকছে না। ১০০ শতাংশ (৫০% অ-পচনশীল খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে) বৃদ্ধি না পেলেই হল। ভুললে চলবে না এখানে উৎপাদকও ভোক্তা।
কৃষকেরা নাকচ করেছে সরকারের এই প্রস্তাব। আইন প্রত্যাহারের দাবি প্রতিটি কণ্ঠে। সরকার সংশোধনে, আলোচনায় আগ্রহী এখন, কিন্তু প্রত্যাহার কোনো ভাবেই সম্ভব না। আইন প্রণয়নের আগে কোনো আলোচনা হয়নি কেন! এমত অবস্থায় সরকার বল ঠেলে দিল সুপ্রিম কোর্টের দিকে। আইন প্রণয়নের ওপর আপাতত সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ। কৃষকপক্ষ সুপ্রিম কোর্ট গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে আলোচনায় বসতে নারাজ। তাদের কথায়— কৃষক সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়নি, আর সুপ্রিম কোর্টের কাজ আইনের গুনমাণ বিচার করা না, তার সাংবিধানিক বৈধতা বিচার করা। পার্লামেন্টের বিষয় পার্লামেন্টেই নিষ্পত্তি হোক। তাছাড়া প্রস্তাবিত সংশোধনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন এবং কৃষি বিষয়টিও রাজ্য সরকারের অধীনে, তাহলে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন কী? যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অবমাননা! যে আইনের ৯০% সংশোধন প্রয়োজন তা প্রত্যাহার করা হবে না কেন! জনপ্রিয় সরকারের ইগো, ইমেজ বনাম অপমানিত, উপেক্ষিত কৃষকের লড়াই।
ভক্তি সরিয়ে রেখে একটু বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই বোঝা যায়— প্রো-ফার্মার বা অ্যান্টি-ফার্মারের ঊর্ধ্বে এই আইন অবশ্যই কর্পোরেট সহায়ক। এই ধারণার চাষ হচ্ছে— নতুন কৃষি আইন APMC-র দালাল, মিডিল ম্যান, কমিশন এজেন্ট, আড়তদারের অশুভ সাম্রাজ্যের দাসত্ব, অন্যায় শোষণ থেকে চাষিকে মুক্ত করবে। আমরা আশা করতে পারি না, মুকেশ ভাই খামারে গিয়ে সরাসরি ফসল কিনছেন। কমিশন এজেন্টের মাজা ভাঙতে গিয়ে আমরা তৈরি করব নতুন শোষক। ৯০% কৃষিবাণিজ্য বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টরের হাতে। সংস্কারের নামে অজস্র অসংগঠিত ছোটো ব্যবসায়ীকে বৃহৎ কর্পোরেট হাঙরের গ্রাসের বৈধতা, এই আইন। ২২টি রাজ্যে বেসরকারি বাণিজ্য অনুমোদিত ছিল। কিন্তু আমরা সেখানে কর্পোরেট বিনিয়োগের ঢল দেখিনি। নিও-লিবারাল মুক্ত বাজারের চিন্তা না শেষে শূন্যতা ও ক্যাওস সৃষ্টি করে! ২০০৬-এ বিহারে APMC বিলুপ্তি অথবা মহারাষ্ট্রে মডেল APMC অ্যাক্ট কী পরিবর্তন আনতে পেরেছে? আমরা দেখেছি টম্যাটিনা উৎসব, রাস্তার দুধস্নান। APMC থেকে মুক্ত হবে কৃষক, জমি থেকেই না হয়ে যায়!
রোজ দেখছি মিডিয়া সার্কাস। ‘মূলধারার মিডিয়ার কাজ কি তাহলে যুদ্ধ থামার শেষে অর্ধমৃতদের খুঁচিয়ে হত্যা করা।’ ঝুঁকতে বললে তারা এখন অতি উৎসাহে হামাগুড়ি দেয়। আমদের দুর্ভাগ্য এইসব মিডিয়া আমাদের সামাজিক শিক্ষক। তাই শহুরে যুক্তিতে— মুখে পিজ্জা, হাতে আইফোন, পরনে জিন্স, চলনে ট্রাক্টর, বলনে ইংলিশ, বিদেশে বাচ্চা সম্বলিত পাঞ্জাবি ধনী কৃষকের এই আন্দোলন মানুষ থেকে, দেশের অন্য কৃষকদের থেকে বিচ্ছিন্ন। যতসব নকল রোনা-ধোনা। ‘ভারতীয় কৃষকের স্বপ্ন তাই ইউরোপিয়ান গরু হয়ে জন্মানো— পশুর একমাসের সাবসিডি ওখানে, এখানে কৃষকের একবছরের ইনকামের থেকে বেশি।’ ২০১৩-র NSSO রিপোর্ট অনুযায়ী কৃষক পরিবারের (গড়ে ৫ জন সদস্যের পরিবার) মাসিক গড় আয় ২৬৪৬ টাকা।
শান্তা কুমার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী মাত্র ৬% কৃষক MSP থেকে সুবিধা লাভ করে। আর তা কেন্দ্রীভূত বৃহৎ কৃষকের কব্জায়। তাই সরকার পলিসি বানালে তা কতিপয় সুবিধাভোগী কৃষকের জন্য বানাবে না দেশের অধিকাংশ (৮৬%) ক্ষুদ্র কৃষকের (যাদের জমির পরিমাণ ২ হেক্টরের কম) কথা মাথায় রেখে বানানো হবে! ২৩টি শস্যে MSP থাকলেও প্রধানত ধান-গম সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হয় MSP নির্ধারিত মূল্যে। সবুজ বিপ্লবের কল্যাণে পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকেরা দেশের অন্য প্রান্তের কৃষকের থেকে তুলনামূলক লাভজনক অবস্থানে আছে। পাল্টা যুক্তি ও পরিসংখ্যানে সংখ্যাটা ৬%-এর অনেক বেশি, প্রায় ২৫%। তাছাড়া পরোক্ষ সুবিধাও আছে। গত তিন বছরে MSP নির্ধারিত মূল্যে মোট সংগ্রহের ৭০% ধান, ৫৬% গম ক্ষুদ্র কৃষকের থেকে সংগৃহীত। Decentralized Procurement Scheme (DCP)-এর বিস্তারে গত তিন বছরে মোট ধান সংগ্রহে পাঞ্জাব-হরিয়ানার অবদান ৩৫%, অন্যান্য রাজ্যের অবদান ৬৫%। গমের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৬২%:৩৮%। আপনি এসব পরিসংখ্যান না মানলেও ৬%-এর অজুহাতে তো একটা ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করতে পারেন না। আর তাছাড়া কৃষিপণ্যকে অন্যান্য উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। কৃষক তো আর বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ফসল ফলাতে পারে না। বুলবুলিতে ধান খেলে সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা, বিকল্পের সম্ভার ধুয়ে জল খাওয়া যায় না। অতিরিক্ত উৎপাদন বা ঘাটতিতে অথবা বাজারের সরবরাহ ও চাহিদার ওঠাপড়ায় একমাত্র নির্দিষ্ট MSP-ই দিতে পারে কৃষককে স্থিতিশীল আয়। সরকারি গুদামে স্থিতিশীল মজুত সীমার প্রায় আড়াই গুন খাদ্যশস্য পচনরত। অন্যদিকে অভুক্ত মানুষ, পরিযায়ী শ্রমিক। সব সমস্যার সমাধান করবে বাজার— চাহিদা-সরবরাহের সমীকরণ, উন্নত বিশ্বের ব্যর্থ কপি-পেস্ট অর্থনীতির তত্ত্ব। সরকারি APMC ব্যবস্থা, মজুত-সরবরাহ উন্নত করা যেতে পারে। ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে MSP-র সুবিধা সমস্ত রাজ্যে, সমস্ত শস্যে। সরকারের কি এসব কাজ নাকি! সরকার আলু-পেঁয়াজ বেচবে না বর্ডার সামলাবে! আপনার না খেতে পাওয়াকে এখন থেকে শুধুমাত্র আপনি বিশ্ববাজারের অর্থনৈতিক সমস্যা মেনে দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন, কর্পোরেটকে আপনি তো আর ভোট দিয়ে আনেননি, তারা নিজের চেষ্টায় বড়ো হয়েছে, আর বড়ো হবার পথে ওরকম একটু-আধটু করতেই হয়।
আত্মনির্ভর কৃষি শেষে ভিক্ষানির্ভর না হয়ে যায়। কখনো চাহিদা তৈরি হলে কৃষক দেখতে পারে লাভের মুখ, কর্পোরেট তখন ভগবান। কিন্তু স্থায়িত্ব তার কতখানি, বুম খতম হলেই দয়ার পাত্র— কখনো প্রসন্ন ভিক্ষা। একটু নাটকের পারদ চড়িয়ে বলা যায় এ যেন রক্ত চুষে শেষ জীবনে বা মাঝে মাঝে রক্তদান। হাসি-মজা চাপলে দেখা যাবে উদাহারণ আছে প্রচুর।
কৃষি আইন প্রত্যাহার হলেই কি ভারতীয় কৃষি সমস্যার সমাধান হবে?
এ প্রশ্ন অবান্তর। যারা সংকট তৈরি করতে পারে তাদের কাছে আপনি সমাধান প্রত্যাশা করতে পারেন না। কৃষকের ইনকাম কম কেন— টু মেনি পিপল ইন ফার্মিং, শিক্ষা—টু মাচ লিটারেসি, স্বাস্থ্য— টু মেনি পিপল, অর্থনীতি— টু মাচ ডেমোক্রেসি। করোনা মহামারির কালে এত তাড়াহুড়োয় একের পর এক আইন প্রণয়ন কেন? ঝিনচ্যাক যুক্তির আবেশে মন বলে ওঠে চার্চিলীয় ঢঙে ‘Never waste a good crisis’। ঝরে যাওয়া কৃষকেরা সব কোথায়— কানাডায়। কৃষকের সাদা মনে কাদা ভরল কে— যতসব রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা। ‘Get big or get out’ অথবা ‘Move up or move out’।
সব ক্যালকুলেশন যুক্তিপূর্ণ ছিল, কিন্তু হয়ে গেছে মিসফায়ার।
রাজধানী সীমান্তে প্রতিরোধ অতিক্রম করেছে ৫০ দিন, সংকল্প দৃঢ় হয়েছে আরও কয়েকগুণ বেশি।