অন্তরমহল অন্বেষণে : নির্বাচিত আত্মকথায় বাঙালি নারীর আত্মনির্মাণের অভিমুখ সন্ধান 

সুলগ্না খান

|| এক || 

প্রাক্‌কথন 

“They will strip women’s rights, we will be pushed into the shadows of our homes and our voices, our expression will be stifled into silence”.[১]

১৩ আগস্ট, ২০২১ । সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্কিত এই কলমের ব্যথিত আর্তনাদ। হিরণ্ময় নীরবতার বিপক্ষে এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আফগান চিত্রপরিচালক সাহরা করিমি; আপামর বিশ্বের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের উদ্দেশ্যে। আফগানিস্তানে তালিবানি পুনর্দখলের প্রেক্ষাপটে করিমি-র আবেদন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সামগ্রিক সামাজিক পশ্চাৎমুখিতার আশঙ্কার পাশাপাশি তিনি সংশয়ান্বিত হয়েছেন উত্তর প্রজন্মের আফগান নারীর ভবিষ্যৎ বিষয়ে। আত্মপরিচয়ের উন্মুক্ত পরিসর থেকে বিচ্যুতির সম্ভাবনা করিমি-কে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে সেই অমোঘ বাক্য : “We need your voice”.[২] 

সাহরা করিমি ‘silence’ এবং ‘voice’-এর মধ্যকার আপাত অনতিদূর অথচ দুস্তর ব্যবধানকে নারীর নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভাষ্যে পড়তে চেয়েছেন। মনে রাখা দরকার এই উন্মোচন পিতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্যের জটিল ইতিহাসপ্রসূত-ও বটে। পারিবারিক বৃত্তের চাপিয়ে দেওয়া দায়িত্ববোধের গণ্ডি অতিক্রম করে, যখন-ই নারী পেতে চেয়েছে আত্মস্বাতন্ত্র্যের অধিকার; ক্ষমতার দীর্ঘলালিত সত্যের সঙ্গে সংঘাতে ‘অর্ধেক আকাশ’ তাঁর অনায়ত্ত-ই থেকে গেছে। মনে পড়তে পারে মনুসংহিতা-র সেই গর্হিত উচ্চারণ : 

“পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে। রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।।”[৩] 

কুমারী অবস্থায় পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীনস্থ; সামাজিক এক জাতীয় সংরক্ষণের এহেন বিধান নারীস্বাধীনতাকে সঙ্গত মনে করেনি। লিঙ্গবৈষম্যের পাশাপাশি মেয়েদের সহ্য করতে হয়েছে ক্ষমতাবন্টনজনিত অসমতা-র উত্তাপ। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণে বলা যায়; পিতৃপ্রধান পরিবারে নারীর দ্বিখণ্ডিত সত্তার দ্বন্দ্ব প্রকটরূপে ক্রিয়াশীল। একাধারে ব্যক্তিগত স্তরে পারিবারিক দায়িত্বপালনের বাধ্যবাধকতা, তাঁকে সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে সক্রিয় যোগদানে বাধা দেয়। উপার্জনক্ষম হওয়ার পথ রুদ্ধ করে। অন্যদিকে স্বাধীন জীবিকা গ্রহণের সিদ্ধান্ত, বাইরের পৃথিবীতে আত্মক্ষম হয়ে ওঠার সাধনা; স্বাভাবিকভাবেই ‘সুনির্দিষ্ট’ গৃহকেন্দ্রিকতায় আবদ্ধ থাকতে দেয় না।[৪] ফলত মজ্জাগত নির্ধারিত সংস্কারের প্রতাপ এবং আত্মসমীক্ষণের উপলব্ধি; পিতৃতান্ত্রিক দুর্ভেদ্যতার বিপ্রতীপে প্রত্যাখ্যানের স্পর্ধা, নারীর ‘পরিচিতি’ বয়নের মৌলিক সুরটি অনেকাংশে এই বৌদ্ধিক অন্বেষণের মধ্যে নিহিত। প্রযুক্তির বিস্ফোরণের যুগে, পুঁজিবাদী সভ্যতার আগ্রাসনের সংকটকালে; আজও ভারতের মতো দেশে নারীর অবস্থান গার্হস্থ্য দাসত্বের অথবা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র অপেক্ষা অতিরিক্ত মূল্যে বিচার্য হওয়ার অবকাশ পায় না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর অংশগ্রহণ প্রায়শই ‘অস্বীকৃতির রাজনীতি’ দ্বারা ব্যাখ্যাত হয়। তবু প্রান্তিকায়িতের প্রতিস্পর্ধী স্বর, ক্ষমতা ও আধিপত্যের মিলিত প্রকল্পের অপর প্রান্তে ব্যক্তিগত ভুবনের স্থাপত্য প্রতিষ্ঠায় থাকে অবিচল। সংরূপের শক্তিশালী পটভূমিতে তাঁর আয়ুধ হয়ে ওঠে আত্মজীবনকথা-র অভিঘাতময় বাচন। 

|| দুই || 

শাশ্বত অসঙ্গতি এবং বুদ্ধিদীপ্ত বিরোধ 

মেয়েদের তথাকথিত ‘নৈতিক চরিত্র’ অপাপবিদ্ধ রাখার জন্য সমাজকে বহু সুকৌশলী পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে। নারীপ্রতিমা নির্মাণের চিরাচরিত শাব্দিক ছক অনুযায়ী তাঁর ভূমিকা প্রায় দৈবিক মাহাত্ম্যে পর্যবসিত। ফলত এর দ্বারা তৈরি হয় বৈপরীত্যের অভিজ্ঞান; সমাজ কর্তৃক আরোপিত প্রত্যাশার বিন্যাস। কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত তাঁর ‘স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ’-এ লিখছেন রোবার্টা হ্যামিলটন-এর কথা, যিনি দেখিয়েছেন পুঁজিবাদের উত্থান কীভাবে বিপরীতার্থক যুগ্মতার আশ্রয়ে লিঙ্গ-বিভাজনের রূপরেখা প্রস্তুত করে। প্রকাশ্য এবং ব্যক্তিগত দুনিয়ার স্পষ্ট বিচ্ছিন্নতা অনেকটা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একমাত্রিক প্রতিবেদনের মতো; যেখানে নারীর স্বকীয়তাকে স্বার্থকেন্দ্রিক প্রয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কলাকৌশল ক্রিয়াশীল। শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত বিষয়টিকে উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বিচার করতে গিয়ে জানিয়েছেন : 

“………the sexual division of labour was becoming rigid and a specifically middle-class culture was emerging on the basis of this ideology of separate spheres for men and women. So, while men were firmly placed in the expanding public world of industry and politics, women’s place was defined in the private world of home and family”.[৫] 

এহেন আধিপত্যবাদের নিশ্ছিদ্র বলয়ে, মেয়েরা যখন আত্মজীবনী নামক মাধ্যমটি অবলম্বনে বিপ্রতীপ বাচনের সম্ভাবনায় নিজেদের ‘উপস্থিতির’ ঘোষণা করেন, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, জীবনকথা তাঁর মূল্যবোধকে কীভাবে আলোড়িত করে? আত্মস্বীকৃতি-র ইচ্ছায় সেই লেখনী কি ব্যক্তির সংবেদনের গণ্ডি অতিক্রম করে বৃহত্তর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক চেতনার অন্যতর বয়ান নির্মাণে সক্ষম হয়? পুরুষসর্বস্ব পৃথিবীতে যুক্তিবাদী নারীর আত্মদীপনের অধ্যবসায় প্রকৃতই ‘আধুনিক’ হয়ে উঠতে পারে কিনা, সেই বিষয়টিকে পর্যালোচনার জন্য আলোচনার এই অংশে আমরা বেছে নিয়েছি তিনটি আত্মকথা-কে; অনুরাধা মহাপাত্র রচিত ‘রুধিরপাত’, সুরমা ঘটক-এর ‘সুরমা নদীর দেশে’  এবং চন্দ্রকণা সেন লিখিত ‘নগণ্য জীবন ও ঠাকুমার খাতা’  নামক রচনাগুলিকে। 

আশাপূর্ণা দেবী কলকাতার মেয়েদের প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “তাঁরা খাঁচার জীবনমুক্ত হয়েই খোলা আকাশে স্বাধীন উড়ানের স্বাদ পেয়ে গেছেন। পুরুষ জাতির যাবতীয় অহঙ্কার চূর্ণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন কর্মক্ষেত্রে; সদর এবং অন্দর-কে পরিচালনা করছেন সুচারু দক্ষতায়। সভাসমিতিতে অংশ নিচ্ছেন, ইউনিয়ন গড়ছেন, ঝাণ্ডা উড়িয়ে স্লোগান সহযোগে মিছিলের বাস্তবতাকে আপন করে নিচ্ছেন।”[৬] অর্থাৎ প্রচলিত পদ্ধতিক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের অবসর তৈরি করে দেয় নারীর যাপিত অভিজ্ঞতা। সেই নিরিখে সুরমা ঘটক-এর আত্মবোধ নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। জন্মভূমি-কেন্দ্রিক চির-জাগরুক স্মৃতির ভান্ডার উন্মোচনের সময়ে তাঁর আত্মকথাটি শুধুমাত্র কিছু মনোরম পরপর সাজিয়ে চলা চিত্রমালা হয়ে থাকেনি। খেয়াল রাখা দরকার, তাঁর আত্মকথাটির নাম সুরমা নদীর দেশে; লিপিবদ্ধ জীবন-অভিজ্ঞতার প্রথাগত কোনও নামকরণের ধারণামুক্ত লেখক, কিন্তু সামাজিক কাঠামোর পুরুষকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে ভোলেননি। নিজের ছাত্রজীবনের কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন :

“আমি অঙ্ক খুব ভয় পেতাম। দাদামশাই বললেন, অঙ্ক ছাড়তে পারবে না। নির্বোধের মতো সংস্কৃত ছেড়ে দিলাম, এর ফলে স্কুল থেকে বি.এ. অবধি বাংলায় সবসময়ই প্রথম নম্বর পেলেও, সংস্কৃত না থাকায় বাংলায় অনার্স পড়তে পারলাম না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার টেস্টের পরে দাদামশাই মাস্টার রেখেছিলেন, বিশেষ করে অঙ্কের জন্য। বাবা মাত্র ১১ দিন পড়ার পরই এসে শিলং নিয়ে চলে গেলেন। মাস্টারমশাই বলেছিলেন, কিছুদিনের মধ্যেই তুমি অঙ্কে পারদর্শী হয়ে উঠবে। প্রতিবাদ করতে পারিনি, বাবা একা আছেন, আর আমার অভিভাবকরাও চিন্তা করলেন না — আমার কত ক্ষতি হল। তখনকার দিনে এইরকমই ছিল আমাদের মেয়েদের জীবন। বিশেষভাবে কিছু ভাবা হত না।”[৭] 

সুরমা তখন প্রতিবাদ করতে পারেননি। কিন্তু নীরবতা-কেই একমাত্র ভবিতব্য হিসেবে গ্রহণ করার প্রবণতাকেও স্বীকার করেননি। জ্ঞানৈষণা থেকে প্রাপ্ত মনন সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষিত সাপেক্ষে মূল্যবোধের পুনর্মূল্যায়নে প্রবৃত্ত হয়। অবমূল্যায়িত জীবনচর্যার দ্যোতনাকে বৌদ্ধিক ভাবনার ফসল হিসেবে দেখে, মূলস্রোতের লিঙ্গচেতনার দ্বিচারিতাকে প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্নে জর্জরিত করে। সুরমা ঘটক নির্মাণ-বিনির্মাণের গ্রহণযোগ্যতাকে বিনষ্ট হতে দেননি। বিএ পাশ করার পরে প্রাইভেটে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের হাতছানি উপেক্ষা করে, পার্টির কাজে তাঁর আত্মনিয়োগ। শিলং কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চতম কমিটির সভ্য সুরমা সংগঠনের নির্দেশে আন্ডার গ্রাউন্ডে থেকেছেন। আদর্শের পথে চলতে গিয়ে ‘নারী’ নামক অবহেলিত শ্রেণির সম্বন্ধে তাঁর ধারণা দার্শনিক পরিপুষ্টি লাভ করেছে। পরিচিত হয়েছেন নতুন জীবনবোধের সঙ্গে : 

“খাসিয়া গ্রামে গ্রামে লুকিয়ে থাকতে হত। কয়মাস পর আমরা ধরা পড়লাম, শিলং জেলের ফিমেল ওয়ার্ডে ছিলাম দশমাস চোর, খুনি, পাগলি ও পতিতা মেয়েদের মধ্যে। সমাজের নিচুতলার মানুষদের জানবার চিনবার সুযোগ হয়েছিল। আমরা বিশ্বাস করতাম এদের জীবনের জন্য এই সমাজব্যবস্থাই দায়ী, নতুন সমাজে এদের জীবনের অবসান হবে।”[৮] 

কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, নারী হয়ে ওঠে। নারী সম্পর্কে বিশ্লেষণকালে অবশ্য উল্লেখ্য মন্তব্যের উদ্‌গাতা; সিমোন দ্য বোভোয়া লিঙ্গপরিচয়ের সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক নিয়ত পরিবর্তনশীলতার ছবিগুলির দিকে স্পষ্ট নির্দেশ করেন, তাঁর ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ গ্রন্থের আলোচনায়। তিনি দেখান, সীমাবদ্ধ এলাকা এবং বিচ্ছিন্নতার মধ্যে আবদ্ধ মেয়ের কর্মপ্রবণতা, তার মন-কে অধিকার করতে পারে না। প্রশিক্ষণ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা; স্বাধীনতার জন্য তাঁর হৃদয়ে যেমন আকাঙ্ক্ষার সঞ্চারে ব্যর্থ হয়, তেমন-ই স্বাধীনতা-কে ব্যবহার করার জন্য যথাযোগ্য অভিজ্ঞতার বৃত্ত-ও সেই অর্থে প্রতিফলিত হওয়ার অবসর পায় না। ফলত নারীর গুণগুলি ক্রমশ হয়ে ওঠে প্রান্তিক, সে তাঁর দিনগুলি কাটিয়ে দেয় একাকী যাপনের শীতলতায়। ঠিক এই অবস্থান থেকে যদি তাকানো যায় চন্দ্রকণা সেন-এর আত্মকথাটির দিকে; তবে দেখতে পাই, এই সৃজনশীলতার আত্ম-উদ্ঘাটন দ্বিমুখী মাত্রায় বিন্যস্ত। একাধারে উনিশ শতকের শেষ দিকে জন্মগ্রহণ করা এক অর্ধশিক্ষিত নারী চিন্ময়ী দাসী-র নিজস্ব খাতা। বিয়ের পরে নাতবউ চন্দ্রকণা শ্বশুরবাড়ি-তে তাঁর স্বামীর ঠাকুমা, চিন্ময়ী-র এই খাতাটি উদ্ধার করেন। চন্দ্রকণা জানিয়েছেন, পরিবারের সদস্যরা ঠাকুমা চিন্ময়ী দাসী-কে নিয়ে গর্ববোধ করলেও, তাঁর সম্পর্কে প্রায় তেমন কিছুই জানত না। অতি অল্পশিক্ষিতা এই নারীর কবিত্বশক্তি, সংস্কৃতিচেতনা; যা গ্রামীণ আবহে যথার্থরূপে মূল্যায়িত হয়নি, চন্দ্রকণা তাঁর নিজের আত্মকথায় তাকে সসম্মানে তুলে ধরেছেন। এ যেন একপ্রকার লিঙ্গনিরূপিত নির্দিষ্ট ভূমিকা-র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অদৃশ্যপ্রায় চরিত্রবৈশিষ্ট্যকে নতুন পরিচয় দানের সমতুল্য। চন্দ্রকণা লেখেন : 

“ঠাকুমার নাম চিন্ময়ী। তাঁর স্বামীর পদবী বিশ্বাস। তিনি চিন্ময়ী দাসী নামে ভণিতায় নিজেকে পরিচিত করেছেন। যদিও এই খাতা কেউ দেখবে বলে তাঁর ধারণা ছিল না। ……………. গ্রামে  তাঁর ‘কবিবউ’ বলে খ্যাতি ছিল। যে-কোনও বিয়েতে পদ্য লেখার চল ছিল তখন। তাই তখন তাঁর ডাক পড়ত অভিনব পদ্য-রচনায়। তাঁর লেখা চৌতিশা তো সেই যুগের প্রেক্ষাপটে খুবই সুন্দর।  ……তাঁর জীবন ছিল দুঃখময় — তারই প্রকাশ ঘটেছে কবিতাগুলিতে। যে খাতাটি আমি পেয়েছিলাম, মনে হয় সেগুলি তাঁর শেষ জীবনের জবানবন্দি।”[৯] 

পরিবেশ পরিস্থিতির প্রতিকূলতা, সামাজিক বাধ্যবাধকতা, অন্তঃপুরের গণ্ডিবদ্ধ জীবনের সত্য; চিন্ময়ী দাসী-র প্রতিভার যথাযথ স্ফুরণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। চন্দ্রকণা নিজেই জানিয়েছেন, আদ্যন্ত সুন্দর হাতের লেখায় সমন্বিত, সংগ্রামবিধ্বস্ত জীবনের হাহাকার তাঁর কবিতাগুলিতে দার্শনিক চেতনার উদ্ভাস ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। অথচ দেখা যাবে, এই আপাত সাধারণ খাতাটির পাশেই যদি চন্দ্রকণা-র নিজের জীবন-কে রাখা যায়, তবে সেখানেও স্বকীয় নারীর রুদ্ধ কণ্ঠস্বরের বহমানতা বিদ্যমান। সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান চন্দ্রকণা; লেখাপড়ার পাশাপাশি সেতার বাজাতে শিখেছিলেন। প্রশংসিত হওয়া সত্ত্বেও সেই অনুশীলন বিবাহ পরবর্তীতে ইতিবাচক গতিমুখ লাভ করেনি। সাহিত্যপ্রেম, উচ্চতর পড়াশোনার আগ্রহ, অসুখী দাম্পত্য, কর্মজীবনের ঘাতপ্রতিঘাতের বর্ণনার মধ্যেও চন্দ্রকণার আত্যন্তিক ক্ষোভ সংগুপ্ত থাকেনি। শৈশবে ছেলের পোশাক পরে, ছেলের মতো বড়ো হওয়া লেখক সামাজিক মর্যাদায় নারীর হীনতর অবস্থানের বর্ণনা দিয়েছেন সহজ অথচ তীব্র ভঙ্গিমায় : 

“সব সময় মেয়েদের ছোট করার প্রবণতা ছিল। বাড়িতে মেয়ে জন্মালেই সকলের মুখ ভার হত। আমার মেয়ে ছোটবেলায় খুবই অসুস্থ ছিল। ওকে মুখেভাত দেওয়ার জন্য শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। মেয়ে খুবই অসুস্থ ছিল –– আমি কান্নাকাটি করছিলাম। শাশুড়ি-মা ডাক্তার ডাকলেন। পরিচিত ডাক্তার –– ওষুধ দিলেন, আর বললেন, এ মেয়েছেলে –– ওদের মরণ নেই।”[১০] 

মূল্যায়ন-অবমূল্যায়নের দ্বান্দ্বিকতায় বিপর্যস্ত চন্দ্রকণা, তাঁর সামগ্রিক জীবন পরিক্রমায় আত্ম-পরিচিতির সঙ্কটকে নানা দৃষ্টিকোণে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আদতে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর ভাববিশ্ব লিঙ্গগত মেরুকরণের অপরিহার্যতার কারণে প্রায়শই অবদমিত। মনে পড়তে পারে মান্টোর সেই বহুপঠিত গল্পের চরিত্রটির কথা, ‘খোল দো’-এর সাকিনা। রাজনৈতিক পালাবদলের বিপন্ন অন্ধকার কালপর্বে নারীর ভাগ্য শুধুমাত্র ‘নারী’ হওয়ার কারণেই জটিলতর। প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া হতে বহু-দূরবর্তী সাকিনা অর্ধচৈতন্যের প্রান্তে দাঁড়িয়ে এক ধর্ষিত নারীর অধিক কিছু নিজেকে ভাবতে পারে না। যেদিন ‘সৃষ্টির মনের কথা মনে হয় –– দ্বেষ’, যে অসুস্থ সামাজিক মূল্যবোধ ‘সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়’; তার সামনে দাঁড়িয়ে সাকিনারা নিষ্প্রাণ হাতে শুধু ইজারবন্দের গিঁট খুলে নীচের দিকে নামিয়ে দেয় সালোয়ারের ব্যর্থ আবরণটুকু। ক্ষমতাশীল উচ্চবর্গের দ্বারা সম্প্রদায় নির্বিশেষে নারীত্বের মূল্য নির্মাণের এই পরিপ্রেক্ষিতটি একটি উদাহরণমাত্র। পণ্যায়িত সভ্যতায় নারীকে শুধুমাত্র যৌনসম্ভোগের তথা প্রজননের ‘বস্তু’ হিসেবে দেখার বিপরীত প্রান্তেই দাঁড়িয়ে আছে শিক্ষিত এবং সংবেদনশীল নারীর বিকল্প চেতনার আলোকবিশ্ব। ক্ষমতাহীন সম্প্রদায়ের শ্রেণিচৈতন্যের উন্মীলন কীভাবে সম্ভব; তারই একটি পথ যেন দেখিয়ে দেন অনুরাধা মহাপাত্র, তাঁর ‘রুধিরপাত’-এ। ক্লেদাক্ত ক্ষতমুখের নীরব রক্তপাত বহন করে চলা জীর্ণ জীবনকে শুধুমাত্র সাহিত্যসাধকের সূক্ষ্ম বিবেচনাশক্তি দিয়ে নয়, একজন সমাজমনস্ক পূর্ণ নারীর বিচারধারায় তিনি বিশ্লেষণ করতে চান। আত্মদহনের মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করেন আত্মজাগরণের বীজমন্ত্র : 

“জ্ঞানের প্রসার,মনুষ্যত্বের প্রসার প্রয়োজন এবং শুরু করতে হবে একেবারে আস্তাকুঁড় থেকে। একেবারে সামান্য, সাধারণ গ্রাম, জনপদ, শহরতলীর শ্রমজীবী ও পড়ে মার খাওয়া অর্ধকাপড়ে, অর্ধাশনে, অপ্রেম ও অসম্মানের অন্ধকারে যারা আছে তাদেরকে ভালোবাসতে হবে আগে। স্বাধীনতা, বিপ্লব, নারীপ্রগতি, নারীবাদ এই শব্দগুলির মাকড়সার জাল থেকে বেরিয়ে নিজেকে একজন সামান্য নারীর স্তরে রেখে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মূল বাস্তবতাকে, সামগ্রিক পৃথিবীকে। কারণ সেই অর্থে সামগ্রিকতা ছাড়া কোনও খণ্ড সমাজকে দেখা যায় না –– নারী একজন মানুষ, শুধু যৌন অথবা অর্থস্বাধীনতায় তার পূর্ণতা আসে না; তার চাই সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, জ্ঞানের স্বাধীনতা, প্রেমের আলো –– যা তাকে স্বচ্ছ, সুন্দর, উন্নত ও পূর্ণ মানুষে পরিণত করবে।”[১১]

|| তিন || 

চেতনার পুনর্বয়ন : আত্মদীপ্ত উত্তরাধিকারের অভীপ্সা 

“সাহিত্যিক টনি মরিসন তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির বক্তৃতায় বলেছিলেন, শব্দের মাহাত্ম্য কথা। তাঁর মতে উৎপাদনের ক্ষমতাগুণে শব্দ মহিমান্বিত; তা আমাদের অন্তরে মানবিক পার্থক্য সুনির্দিষ্টতায় নির্দেশ করে। যে কারণে অন্য প্রাণীদের সাপেক্ষে আমরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করতে সক্ষম হই। তিনি জানতেন, ভাষা; গণহত্যা, যুদ্ধ বা দাসত্ব-কে ‘সত্যের’ অভিধা দিতে বাধ্য করতে পারে না। বা সে ঔদ্ধত্য প্রকাশের আকাঙ্ক্ষা-ও বহন করার কোনও দায় ভাষার নেই। শুধু এক ‘অবর্ণনীয় গন্তব্যে’ পৌঁছনোর মধ্যেই তার পরিতৃপ্তি।”[১২] 

পূর্ণাঙ্গ পৃথিবীতে নারীর মননচর্চার অধিকারের সঙ্গে বিকল্প চেতনার উন্মীলন সম্ভাবনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিপুল প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে আত্মসংশ্লেষণের পথ বেয়ে নারীর ‘ভাষা’ তাঁকে দিতে পারে ঈপ্সিত আত্মবিশ্বাসের সন্ধান। বৌদ্ধিক পাঠপ্রসূত জ্ঞানের পরিসরে নারী খুঁজে নেয় সরলরৈখিক চিন্তাচেতনার মধ্যকার অন্তর্গূঢ় দ্বান্দ্বিকতাকে। সেখানে নারীর বয়ান তাঁর সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষণবিন্দুর যথার্থ হাতিয়ার। আমরা দেখতে পাই, কীভাবে অনুরাধা মহাপাত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, তারক্‌ভস্কি বা রামকিঙ্কর বেজ-কে অনুধাবনের মধ্য দিয়ে উপলব্ধির স্তরায়নের নির্মাণ করেন। আত্মবোধের উচ্চারণে জানান দেন, “গ্রাম এসে শহর ঘিরে ফেলবে এমন বিপ্লবী বাক্য নয়, কলকাতার মধ্যে গ্রাম মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।”[১৩] 

জৈবিক পরিচয়ে নারী হিসেবে লিঙ্গ-অসাম্যের পথ বেয়ে অস্তিত্বের চিহ্ন এঁকে দেওয়ার যে স্বরভঙ্গিমা আমরা অনুরাধার মধ্যে শুনতে পাই; তা যেন আমাদের আবার একবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় টনি মরিসন-এর কাছে। ইতিহাসকে নিজস্ব বাচনে নবতর পরিপ্রেক্ষিত দেওয়ার প্রচেষ্টায় নারী নিয়ে চলে ‘প্রান্তের দিকে’, পুরুষ-সর্বস্বতার বিপ্রতীপে। অনীতা সেন-এর আত্মকথা ‘জীবনের জলছবি’ যেন সেই প্রান্তিক স্বরের নির্বাধ প্রতিষ্ঠার একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবেদন তুলে ধরে। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের জাতক, পরাধীন দেশের নাগরিক, অনীতা-র আবির্ভাব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে। একাধারে মহাত্মা গান্ধি এবং সুভাষচন্দ্র বসু; অহিংস আন্দোলন এবং সশস্ত্র বিপ্লবের বিপরীতমুখী ভাবাদর্শের পৃথিবীতে অনীতা-র ব্যক্তিগত ভাবনাবিশ্বের লালন এবং সংরক্ষণ। সেই টালমাটালের কালবেলায় নারীসত্তার সামাজিক রাজনৈতিক অনুভবের গ্রন্থনা তিনি করেছেন শৈশবস্মৃতির বর্ণনাসূত্রে। এক সর্বব্যাপ্ত বিষাদ-পৃথিবীতে; তাঁর শব্দবন্ধের মধ্য দিয়ে উঠে আসে দেশভাগের যন্ত্রণার ইতিবৃত্ত, ছিন্নমূলের হাহাকার। আর তারই মধ্যে আপন কথার বয়ানে তিনি বুনে দেন তথাকথিত সূক্ষ্ম রাজনৈতিক মেধাচিন্তার থেকে বহু দূরবর্তী এক অন্য ‘আলোকপ্রাপ্ত’ নারীর উপলব্ধির রেখালেখ্য। উদ্বাস্তু সমস্যার দীর্ণকালে; সুভাষচন্দ্র বসু-কে নিয়ে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের, প্রাণের আশ্চর্য উন্মাদনা, আশাপ্রবণতার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠতে দেখি তাঁর কলমে। সেটিও এক দলুই নারীর বাস্তব জীবনবোধের রূপকল্পে : 

“এক প্রৌঢ়া এসেছে — মায়ের সাথে কথা বলছে। কোলে একটি শিশু। মা বলছেন — তোমার নাতি? প্রৌঢ়াটি হেসে বলল — হ্যাঁ মা, আমার বেটার বেটা। ওর নাম রেখেছি সুভাষ বোস। মা একটু ভুল শুধরাবার জন্য বললেন — সুভাষ নাম রেখেছ ………… বাঃ বেশ নাম। প্রৌঢ়াটি একটু অসন্তুষ্ট হয়েই বলল — না সুভাষ না। ওর নাম রেখেছি সুভাষ বোস। সুভাষ বোস দলুই।”[১৪] 

আত্মপরিচিতি-র  বাঙ্ময়  ব্যাপকতা  শুধুমাত্র  যে  নারীর  সরাসরি আত্মবিবৃতিদানের প্রেক্ষিতকে উজ্জ্বল করেছে তাই নয়। পাশাপাশি কোনও এক ভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিচিত্রমালা রচনা করতে গিয়ে উঠে এসেছে আপাত অন্তরালবর্তিনীর জীবনচর্যার মহার্ঘ মূল্যবোধ। একদা কবি জীবনানন্দ ব্যতিক্রমী মননশীলতায় লিখেছিলেন, মা কুসুমকুমারী দাশ-এর কথা; (‘আমার মা’) যেখানে উঠে এসেছে প্রতিভা এবং আত্মবিলুপ্তির নিবিড় ভাষাচিত্র। কবির খেদ; দিনরাতের অবিশ্রান্ত কর্মব্যস্ততা, পারিবারিক সুবিশাল দায়িত্ব কুসুমকুমারী-র সাহিত্যপ্রতিভা-কে যথেষ্ট বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়নি। পুত্রের কলমে মায়ের এই স্মৃতিচারণের অপর প্রান্তে আমরা আবিষ্কার করি, নীহারিকা দাশগুপ্ত-কে। কবি-সাহিত্যিক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মা নীহারিকা দাশগুপ্ত তাঁর আত্মকথায় পুত্রের শৈশব-কৈশোরের বর্ণময় জীবন প্রতিবিম্ব রচনা করেছেন। সেখানে নানা ঘটনাপ্রবাহে দীপ্ত হয়ে রয়েছেন তাঁর কবিপুত্র। কিন্তু এরই মধ্যে নীহারিকা দেবী-র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসূত্রে গ্রথিত হয়েছে অতীত সময়, ফেলে আসা সমাজের মূল্যবান দলিল। লেখকের ব্যক্তিগত বোধপ্রসূত এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে যেন নীহারিকা প্রবহমান সময়ের সঙ্গে নিমগ্ন আলাপচারিতায় নির্মাণ করেন পারস্পরিক পরিচয়ের অবসর। রাজকণিকায় ভ্রমণসূত্রে তিনি লিখেছেন রানি নদীর কথা, নদীর সঙ্গে জুড়ে থাকা লোককাহিনির অনুষঙ্গ। রাজার সঙ্গে মতান্তরের ফলশ্রুতিতে নদীতে ডুবে রানি আত্মহত্যা করেন। নদীর মধ্যে পোঁতা মেয়ের মূর্তি যেন সেই বিষণ্ণ লোককথার স্মৃতি বহন করে চলেছে আবহমান কাল ধরে। আর এর মধ্য দিয়ে ঝাপসা হতে থাকা সময়বৃত্তে নারীর চিরকালীন বেদনাবিধুরতা-কে শাশ্বতরূপে আবিষ্কারের চেষ্টা করেন স্বয়ং নীহারিকা : 

“বাবার অমত সত্ত্বেও লুকিয়ে লুকিয়ে সেখানে একাই আমি চলে গিয়েছিলাম। রানিমূর্তি খুব স্পষ্ট নয়, তবে বোঝা যায় ঘোমটা দেওয়া পাথরের মূর্তি। পরে জার্মানিতে ব্লাউবয়রেনে মারমেডের এরকমই মূর্তি আমি দেখেছি। নারীর বিষাদ এভাবেই বিশ্ব ভরে ছড়িয়ে আছে। পুরুষের শক্তি ও প্রতিপত্তি সেদিক থেকে দেখলে, কি খুবই ক্ষণস্থায়ী নয়?”[১৫] 

মানবী বিদ্যাচর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে নারীর আত্মকথার যে মূল্য, সেখানে আত্মোন্নয়নের ধারাবিবরণীতে মুসলমান নারীর অবস্থান বহুদূর পর্যন্ত জটিলতর তাৎপর্য সমন্বিত। সৈয়দা মনোয়ারা খাতুন-এর কথা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, যিনি মুসলমান সমাজের মেয়েদের তুলনায় হিন্দু মেয়েদের অনেকাংশে অধিকতর স্বাধীন জ্ঞান করেছেন। উনিশ শতকের শেষার্ধ বা বিশ শতকের গোড়ার দিকের কালে বাঙালি মুসলমান সমাজের রক্ষণশীলতার ছবিগুলি একান্ত দুর্লভ নয়। মনোয়ারা খাতুন-এর স্মৃতির পাতা, পূর্বনির্ধারিত সমাজনির্দিষ্ট নারী প্রতিমা-র বিপরীতে, আত্মক্ষম হয়ে উঠতে চাওয়া ব্যক্তিত্বের প্রত্যয়ী প্রকাশ। তিনি রচনা করেছিলেন, অন্তঃপুরের মুসলমান নারীর তথাকথিত সম্ভ্রম রক্ষার নামে বৈষম্যজ্বালার চূর্ণ ইতিহাস। তাঁর নিজের রাজনৈতিক সচেতনতার স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ানো সামাজিক বাধার নিরিবছিন্ন সক্রিয়তার কথাও সেখানে বাদ যায়নি। সমষ্টিগত হোক বা ব্যক্তির একক ভুবন; নারীকে বঞ্চিত রাখার প্রবণতা নিজস্ব আগ্রাসনে ক্রিয়াশীল। সৈয়দা মনোয়ারা-র উত্তরাধিকারের সরণি বেয়ে আমরা উঠে আসিতে দেখি, কবি ও সাহিত্যিক হামিদা রহমান-কে। হামিদা একাধারে শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক, সাংবাদিক। বাংলাদেশের এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, জীবনের নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তিনি অর্জন করেছেন, আত্মবীক্ষার অভিজ্ঞান। উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি আত্মস্মৃতিকথার বলয়ে-ও হামিদা-র বিচরণ সহজ, নিঃশঙ্ক। ১৯৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দের প্রেক্ষাপটে যশোর শহরের মেয়ে হামিদা লিখছেন তাঁর স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতার কথা। সাতশো মেয়ের মধ্যে তাঁরা মাত্র চারজন গোটা স্কুলে মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন। ঘোড়াগাড়ির নিশ্ছিদ্র বর্মের আড়ালে, স্কুলে যাতায়াতের পথে,বাইরের পৃথিবীতে মুখ দেখানো তাঁদের জন্য একপ্রকার নিষিদ্ধ থেকেছে। [১৬] কিন্তু সামাজিক মূল্যবোধ তথা অদম্য আত্মবিশ্বাসের যৌথ প্রণোদনায় হামিদা পরবর্তী জীবনে বাম রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভের প্রতিবেশ তৈরি করেছেন। তেভাগা আন্দোলন প্রভৃতির পটভূমিতে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রতি তাঁর সমর্থনের সোচ্চার রূপটি আত্মকথায় প্রতিফলিত।[১৭] আবার অন্যদিকে একাত্তরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কবলিত বিপর্যস্ত বাংলাদেশের ভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন; ‘নারীমুক্তি’-র আন্দোলনের বহুবিধ মাত্রার অন্তরে প্রকট হয়ে থাকা নারীর বিপন্ন অস্তিত্বের সত্যটিকে : 

“শক্তি দিয়ে শক্তিকে রুখতে হয়। তাই ‘নারী মুক্তি আন্দোলনে’র নামে যখন মিটিং মিছিল হয়, আমিও তাতে অংশগ্রহণ করি আর তখন মনে মনে একই কথা ভাবি — মুক্তি কি এতই সহজ ? নারী হিসাবে যেখানে আমাদের জাতি অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অজ্ঞ, অন্ধকারে যারা নিমজ্জিত, অর্থনৈতিকভাবে যারা পঙ্গু, ধর্মীয় বেড়াজালে যারা আবদ্ধ তারা মিছিল করে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে কেমন করে স্বাধীনতা আনবে। কেবলমাত্র বড়লোকের মেয়েরাই স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের বাড়িতে যাবার সাহস রাখে। আর আমরা মধ্যবিত্ত গরীবের সন্তান তারা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মারই খাই, আর কখনও কখনও অসহ্য হলে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করি। এই তো আমাদের নারী মুক্তির ইতিহাস।”[১৮] 

|| চার || 

প্রত্যয়ী পুনর্বিন্যাসকল্পে : চিন্তন এবং পুনর্বিচার 

আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের দিশানির্ণয়ে নারীর সফল এবং সক্রিয় যোগদান; সক্ষমতা এবং অধিকারের মানোন্নয়নের প্রশ্নে একটি অনিবার্য সত্য। খেয়াল করা দরকার, নারীর সক্ষমতা, বাইরের পৃথিবীতে সৃজনাত্মক অংশগ্রহণ; শুধু নারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সেটি ছড়িয়ে যায় তাঁর নিজস্ব বৃত্তের পরিমণ্ডলে। পাশাপাশি ব্যক্তি নারীর উন্নয়নের সূচক পথ দেখাতে পারে, সমগ্র সমাজ বা দেশের সার্বিক মানব উন্নয়নের পরিকল্পনা রূপায়ণে। যদিও নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে তাঁর উন্নয়নের সম্পর্কটি এক জটিল দ্বান্দ্বিক বিন্যস্ততায় সংশ্লিষ্ট। অধিক ক্ষমতায়ন অর্থে নারীর সামগ্রিক উন্নয়ন, এমনটি নাও হতে পারে। তবে নিশ্চিতভাবে সামাজিক পরিচয়ের পাশাপাশি নান্দনিকতার পৃথিবী মেয়েদের উড়ানের আকাঙ্ক্ষাকে সাবলীল সম্প্রসারণশক্তি দান করে। ক্ষমতায়নের ভুবনকে গণ্ডিবদ্ধতার বিধিনিষেধ অতিক্রমণের ক্ষেত্রে কার্যকারী সহায়তা দেয়। আত্মোৎকর্ষের সন্ধানে নিযুক্ত নারীর বিচিত্র সৃজনক্ষমতা, কীভাবে তাঁকে উজ্জীবিত করে, এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় সুকৃতি চক্রবর্তী-র কথা। শান্তিনিকেতনের আশ্রমজীবনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বা নন্দলাল বসু-র মতো শিক্ষকদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন সুকৃতি, হয়ে উঠেছিলেন নাচে-গানে-আঁকায় বিশেষ পারদর্শী সকলের আদরের ‘হাসু’। আত্মকথার পরিমিত আয়তনে তিনি ব্যক্ত করেছেন, তাঁর অঙ্কনবিদ্যাশিক্ষার ইতিহাস, সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অনুভববেদ্য চিত্রনির্মিতির পাঠপ্রক্রিয়ার কাহিনি। রাতের দৃশ্য অঙ্কনের সময়ে রং-এর প্রয়োগ বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত সুকৃতি-কে প্রকৃতির নিজস্ব ক্যানভাস দেখিয়ে উপলব্ধির স্তরায়নে পৌঁছতে সাহায্য করেছেন মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু। সান্ধ্যকালীন পটভূমিতে আমলকী গাছের প্রাকৃতিক রূপ পরিদর্শন, সুকৃতি-কে আত্মবোধে উপনীত হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে, পথপ্রদর্শক মাস্টারমশাই-এর উপস্থিতি সংযোগে : 

“ ‘আমলকী গাছটা অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছিস, রাতের রং কিন্তু শুধুই কালো নয়। কত তারার আলোয় রাত ঝলমল করে। রাতের আকাশ আঁকতে হলে তা কালো করতে হবে এটা ভুল ধারণা।’ পরের দিন রাতের দৃশ্য আঁকতে ভুল হয়নি। এই সব শিক্ষা কি ভোলা যায়?”[১৯] 

সুকৃতি তাঁর মিতায়তন আত্মকথাটি উৎসর্গ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নন্দলাল বসু-কে। প্রকৃতির মুক্ত পরিবেশে শিক্ষাদানের রবীন্দ্র-পরিকল্পনাকে কলাভবনে নন্দলাল বসু সার্থক প্রয়োগে পরিপুষ্ট করে তুলেছিলেন। সুকৃতি-র কলমে সেই অমলিন সময়ের নির্ভার সাক্ষ্য প্রবাহিত। অথচ একমাত্রিক ধারণার কূপমন্ডূকতা যে আত্মবলে বলীয়ান নারীসত্তার স্বাভাবিক অধিকারের অন্তরায় হয়ে উঠতে তিলমাত্র দ্বিধাবোধ করে না, সুকৃতির লেখনীতে সেই রেখাচিত্রটির প্রাখর্য-ও প্রবলভাবে বিদ্যমান। নির্দিষ্ট সামাজিক লিঙ্গপরিচয়ে মেয়েদের আবদ্ধ রাখার পিতৃতান্ত্রিক কৌশল নারীমননকে-ও রেহাই দেয় না, প্রবিষ্ট হয় মজ্জাগত সংস্কারের আদলে নারীর লালিত বিশ্বাসের দুনিয়ায়; বহিল আনন্দধারা সেই প্রশ্নহীন আনুগত্যের ব্যবচ্ছেদে নির্দ্বিধ : 

“শান্তিনিকেতনে সেই ত্রিশ-চল্লিশের দশকের স্বর্ণযুগে সব মেয়েরাই নাচে গানে, ছবি আঁকাতে, লেখাপড়া, খেলাধুলা এমনকী সামাজিক মেলামেশাতেও দেশের অন্য সব অঞ্চলের মেয়েদের চেয়ে তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে ছিল। তখন শান্তিনিকেতনে আমরা যেভাবে বড়ো হয়েছি সেটা যে বাইরে অনেকের পছন্দ ছিল না সেটাও আমরা বুঝতাম। গুরুদেবকেও কম কথা শুনতে হয়নি। আমারই এক কাকিমা, তিনি বিখ্যাত ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে, রীতিমতো বিদুষী এবং ওঁর দাদা তখন শান্তিনিকেতনে থাকতেন, তিনি একদিন আমার সামনেই গুরুদেবকে অভিযোগ করে বলেছিলেন — ‘আপনি যে এইসব মেয়েদের নিয়ে সারা দেশ ঘুরে নাচ গান করে বেড়াচ্ছেন। তারপরে ওদের কি আর কোনও ছেলে বিয়ে করবে?’ শুনে তো আমি হতবাক, গুরুদেবও খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন, ওঁর মুখ চোখ লাল হয়ে গেছে। একটু পরে গুরুদেব ধীরে ধীরে বললেন—‘আমার মেয়েদের যদি কোনও ছেলে বিয়ে করতে না চায়, তবে তারা খুবই দুর্ভাগা, ওরাই হারাবে।’ ”[২০] 

বাঙালি মেয়ের অন্তঃপুরের বন্ধনমুক্তির ইতিহাস নানাবিধ সংঘর্ষ-সমন্বয়ের প্রভাবান্বিত ফলাফল। উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে এসে প্রথাসিদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আমরা মেয়েদের যুক্ত হতে দেখি। উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ, কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, স্বাধীন জীবিকাপ্রসূত জীবনের সঙ্গে ঐতিহ্যলালিত যাপনের সংঘাত; মেয়েদের সার্বিক স্বাধীনতার ধারণাটিকে নানাভাবে আলোড়িত করেছে। অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতার সঙ্গে সামাজিক সম্মান তথা গুরুত্বলাভের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কটিকে মেয়েরা যে সবসময়ে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন তা নয়, কিন্তু ‘অপর’-এর অধিষ্ঠানভূমি-ই যে একমাত্র ভবিতব্য হতে পারে না, এই চেতনাটি কিন্তু তাঁদের মনোজগৎ-কে অধিকার করতে ছাড়েনি। পাশাপাশি রাজনৈতিক সচেতনতার বৃহত্তর ক্ষেত্রকে তাঁদের আত্মপ্রতিষ্ঠার অনিবার্য উৎস হিসেবে আমরা উঠে আসতে দেখি। অহিংস আন্দোলনের পথ হোক বা সশস্ত্র সংগ্রামের সরণি; সংস্কারের অর্গল ভেঙে মেয়েরা দু-ক্ষেত্রেই নিজেদের এগিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করেনি। আর এরই পাশাপাশি একটি তৃতীয় ধারা হিসেবে যুক্ত হতে দেখা যায় মার্কসবাদী বিশ্বাসসঞ্জাত কমিউনিস্ট আন্দোলন-কে, মেয়েদের মধ্যেও চারিয়ে যেতে থাকে দিনবদলের স্বপ্ন। ফলত একাধারে সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার উদ্দীপনা এবং অন্যদিকে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দ পদচারণা; বাঙালি নারীর আত্মপরিচয় লাভের তাৎপর্যকে সঞ্জীবিত করেছে। ইতিহাসের এই বিবর্তিত বিন্যাস বেয়ে আমরা উঠে আসতে দেখি আর এক অস্তিত্ব-সন্ধানী আত্মকথাকে, চৈতালি দাশগুপ্তের নির্মেদ উচ্চারণে। 

বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত চৈতালি প্রকৃতই সৃজনশীল বাঙালি নারীর সার্থক প্রতিভূ। বহুমুখী কর্মধারার শিরোপা তাঁর করায়ত্ত। দূরদর্শনের পর্দায় তাঁর সপ্রতিভ উপস্থিতি, স্বচ্ছন্দ সঞ্চালনা, নারী-র আত্মউপস্থাপনের বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত। পশ্চিমবঙ্গে দূরদর্শন-এর প্রায় সূত্রপাতের দিনগুলি থেকেই চৈতালি তার গর্বিত সদস্য। সৃজনভাবনার বিচিত্রতায় তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে সমৃদ্ধ করেছেন, নান্দনিকতার বৈচিত্র্যে স্বয়ং হয়েছেন পূর্ণতর। বস্তুতপক্ষে চৈতালি-র অবদান নিঃসন্দেহে বহুস্বরের প্রগতিমুখী। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি নারীর সমান্তরাল অস্তিত্বের স্বরক্ষেপণেও তিনি সফল। 

উত্তরাধিকার সূত্রে চৈতালি পেয়েছিলেন রাজনৈতিক চেতনার দীক্ষা। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পিতার প্রভাবে তাঁর মধ্যে কমিউনিজমের ভাবধারা অঙ্কুরিত হয়। প্রথাবদ্ধ পড়ার বই, গল্পগ্রন্থ বা কবিতার বই-এর পাশাপাশি তিনি পড়তেন ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস’। উচ্চারণ স্পষ্ট এবং যথার্থ করার জন্য, ‘স্বাধীনতা’ আর ‘স্টেটসম্যান’ — শৈশবে বাড়িতে আসা দুটি সংবাদপত্রের সরব পাঠ ছিল তাঁর শিক্ষাপ্রক্রিয়ার অন্যতম বাহন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন ‘আধুনিক মনন ও মনুষ্যত্বের’ সঙ্গেই তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছিল ‘বাচনভঙ্গি’-র স্বতন্ত্র আদল।[২১] পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৈতালি দূরদর্শন-এর সঞ্চালিকা হিসেবে জনপরিচিতি-র সূত্রে বাঙালির অন্দরে পৌঁছেছেন স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায়। তৈরি হয়েছে প্রতিভাময়ী নারীর স্ব-নির্মাণের ভাষ্য। চৈতালি লেখেন : 

“আমার কর্মক্ষেত্রটি তখন নানা ডালপালা মেলেছে — নিত্যদিনকার ঘোষণার পাশাপাশি অনুষ্ঠান প্রযোজনায় সহযোগিতা করছি, উপস্থাপন করছি কখনও রবীন্দ্র সংগীতের সংকলিত অনুষ্ঠান, কখনও অন্তক্ষরির চটজলদি সঞ্চালনা, কখনও খেলার মাঠ থেকে সরাসরি সংযোজনা। তারই সঙ্গে শুরু হল ‘নববর্ষের বৈঠক’। লাইভ টেলিকাস্ট হবে, সে কী উত্তেজনা। ভোরবেলা শুভ্রসাজে উচ্চারণ করছি, ‘এই যে বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষটি আকাশ-প্রাঙ্গনে এসে দাঁড়াল ………… কুঁড়ি যেমন করে ফোটে, আলোক তেমনি করে বিকশিত হয়ে উঠল …………।’ অনুষ্ঠানের শেষে শিপ্রাদি (আমাদের এ. এস. ডি. শিপ্রা রায়) বলেছিলেন — ‘ভারি চমৎকার যেন উপনিষদ থেকে উচ্চারণ করলে !’ ”[২২] 

দূরদর্শন-এর ইতিহাসে সে এক উল্লেখযোগ্য কালপর্ব, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ‘স্পনসর্ড প্রোগ্রামের’ সদ্য সূচনা হয়েছে। তার আগেই ১৯৮৪-তে ‘হমলোগ’ নামক হিন্দি ধারাবাহিকটির মাধ্যমে সোপ অপেরার প্রচলন ঘটে গেছে। হিন্দি ধারাবাহিকের অনুসরণে উঠে আসছে বাংলা ধারাবাহিক সম্প্রচারের ভাবনা, কিন্তু একটু স্বতন্ত্র পথে। বাংলাসাহিত্যের অনন্য ভাণ্ডার থেকে সংগ্রহ করে পর্দায় চিত্রায়িত হল এক একটি ছোটগল্প; নির্দেশক গৌতম ঘোষ। একদিকে সোনেক্স এবং অন্যদিকে ইনফোকম-এর প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে চৈতালি জানিয়েছেন, এর দ্বারা তরুণদের প্রতিভা প্রদর্শনের পরিসর এবং সফল প্রযোজনার সুযোগ; উভয় ক্ষেত্রেই নতুন সম্ভাবনার দ্বারোদ্ঘাটন সম্ভবপর হয়েছিল। আর এই বিস্তৃত কর্মযজ্ঞের সুযোগ্য অংশীদার হিসেবে চৈতালি দাশগুপ্ত বিচ্ছুরিত হয়েছিলেন তাঁর বর্ণিল প্রতিভার নান্দনিক উৎকর্ষে। বলাবাহুল্য, এটি শুধুমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্যের খতিয়ান ছিল না, বরং বৃহত্তর বিচারে নারীর আকাশ-নির্মাণের একটি উল্লেখযোগ্য সোপান হিসেবে-ও আমরা চৈতালি-র আত্মবিবৃতিকে গ্রহণ করতে পারি। 

‘ল্যাবরেটরি’ গল্পটি সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হল, ১৩৪৭ সালের ১৫ আশ্বিন, রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনে। এই গল্পে নন্দকিশোরের কণ্ঠে আমরা শুনলাম, পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিজাত সভ্যতার ধারণায় নারীর অবস্থান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট উচ্চারণ : 

“স্বামী হবে এঞ্জিনিয়র আর স্ত্রী হবে কোটনা-কুটনি, এটা মানবধর্মশাস্ত্রে নিষিদ্ধ। ঘরে ঘরে দেখতে পাই দুই আলাদা আলাদা জাতে গাঁটছড়া বাঁধা, আমি জাত মিলিয়ে নিচ্ছি। পতিব্রতা স্ত্রী চাও যদি, আগে ব্রতের মিল করাও।”[২৩]

‘ল্যাবরেটরি’ গল্পের এই দিক্‌নির্দেশনা আমাদের পুনরায় নিয়ে যায় উনিশ শতকের সেই সময়-সন্নিকটে, যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য মানসিক ব্যবধান নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিক্ষিত বাঙালি পরিমণ্ডলে উদ্বেগের ছায়া ফেলেছিল। অন্যদিকে বিদ্বান নবীন বাঙালি পুরুষের তথাকথিত যোগ্য অর্ধাঙ্গিনী হয়ে ওঠার চাইতেও, অধিকতর মর্যাদাময় মানববিশ্বের সন্ধান বাঙালি মেয়ের চিন্তাজগতে উথালপাথাল সৃষ্টি করেছে নিঃসন্দেহে। তাই আত্মপরিচয়দানে উন্মুখ নারীসত্তা যখন কলম-কে তার হাতিয়ার বানাতে চাইল, একের পর এক আত্মকথায় আমরা আবিষ্কার করলাম বৈষম্য ও বঞ্চনার অভিব্যক্তি, প্রত্যাখ্যানের ব্যাখ্যাশৈলী। নারী আত্মকথাকার হিসাবে প্রথম উচ্চার্য নাম যাঁর, সেই রাসসুন্দরী দেবী তাঁর ‘আমার জীবন’-এ অতি সঙ্গোপনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে লেখাপড়া শেখার ইতিহাস বিবৃত করেছেন। নিজেকে ‘পিঞ্জর-বদ্ধ বিহঙ্গী’-র অতিরিক্ত কোনও অভিধায় চিহ্নিত করতে পারেননি তিনি। 

সামাজিক ক্ষেত্রে অবদমিত ‘প্রান্তিক’ নারীর একক স্বর যে কোথাও না কোথাও সমগ্রের প্রান্তিকায়নের তত্ত্ববিন্যাসে উপযোগী হয়ে ওঠে, মেয়েদের আত্মজীবনকথা তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে । মেয়েদের ভাবনাবলয়ের নিত্য নবীন বয়ন-পুনর্বয়নের মধ্যেও আমরা ইতিহাসের সেই সুনির্দিষ্ট চলন খুঁজে পাই। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে যখন অপরাজিতা দাশগুপ্ত তাঁর আত্মজীবনী-তে নিজের পিতামহী-র কথা বর্ণনা করেন; তখন এক মুহূর্তে আত্মতা ও স্বাধীনতার নিগূঢ় জটিলতাদীর্ণ নারী-ইতিহাস যেন এক পুনর্নির্মিত আখ্যান সম্ভাবনা খুঁজে নেয়। তৈরি হয় অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে কথোপকথনের অবকাশ। ইতিহাসের ছাত্র, অধ্যাপক, সোৎসাহী সাহিত্যপ্রেমী অপরাজিতা তাঁর আত্মকথায় ঠাম্মা-কে অঙ্কন করতে গিয়ে, প্রশ্ন করেন বাস্তবের অনতিক্রম্যতাকে। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের জাতক তাঁর ঠাম্মা মীনা দেবী বাড়িতেই ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি পেয়েছিলেন মার্গসঙ্গীত তথা জলতরঙ্গের মতো বাদ্যযন্ত্রের তালিম। অথচ এই সব শিক্ষাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বিবাহবন্ধনের অমোঘতায়, ‘সুগৃহিণী’ হয়ে ওঠার নিরন্তর প্রচেষ্টায় ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যায় বিদ্যা তথা ললিতকলা চর্চার আবশ্যকতার শর্তটি। অপরাজিতা-র ক্ষুব্ধ বিবৃতিতে আমরা দেখি, সহধর্মিণীর ব্যতিক্রমী গুণগুলির পৃষ্ঠপোষকতার কোনও চেষ্টাই তাঁর পিতামহ করেননি, সে আগ্রহ বা ইচ্ছা-ও হয়তো তাঁর ছিল না। এমনকি ভ্রমণপিপাসু স্বামী, স্ত্রী-কে তাঁর বেড়ানোর সঙ্গী হিসেবেও বিবেচনা করার প্রয়োজনবোধ করেননি। 

অথচ ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন দিয়ে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সংসারের চাকায় পিষ্ট হয়ে যাওয়া সেই নারী; অপরাজিতা-র ঠাম্মা, মীনা দেবী, জীবনের শেষ বছরগুলিতে ফিরে গেছেন জ্ঞানচর্চার ফেলে আসা সেই অতীতের পানে, সংহত করেছেন অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়া বৃত্তটিকে। একাগ্র সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি অনুবাদের প্রণোদনায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিজস্ব গ্রন্থ, ‘হানাবাড়ি’। শেষজীবনে প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে আত্মসিদ্ধির শিখরে পৌঁছনো সেই নারীর সৃষ্টিশীলতা; কিন্তু সেদিন-ও তাঁর স্বামীর ঔদাসীন্যের প্রাচীর ভেদ করতে পারেনি। কিন্তু নিজেকে পুনরাবিষ্কারের প্রয়াসে একনিষ্ঠ নারী, অবহেলার বা বঞ্চনার উত্তর-ও দিতে পারেন আদ্যন্ত কঠিন শীতলতায়। সেখানেই তাঁর স্পর্ধা, তাঁর দীপ্ত প্রতিবাদ। অপরাজিতা-র বাচনভঙ্গিতে অণুরণিত হয় সেই আলোকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্বময়ীর স্বর : 

“দাদুর এই জীবনভোর উদাসীনতার উত্তর কিন্তু ঠাম্মা জীবনের শেষপর্বে দিয়েছিলেন, তাঁর নিজের মতো করে। ঠাম্মার লেখিকাসত্তা আত্মপ্রকাশ করেছিল লেখালেখির থেকে দাদুর যাবতীয় উল্লেখ সচেতনভাবে বর্জন করে। এই সময় একই সঙ্গে কত কী লিখেছেন ঠাম্মা। ডায়েরি, অজস্র চিঠি, কবিতা, অনুবাদ এবং সর্বোপরি নিজের জীবনের স্মৃতিকথা ‘রীতার জীবন’। এসব লেখার কোনওটিতেই দাদু প্রসঙ্গক্রমেও নেই। এমনকী আত্মজীবনীতে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির নানা কথা এসেছে। অনুল্লিখিত থেকে গেছে শুধু স্বামীর কথা। আমার এমনও সন্দেহ হয় যে পরবর্তী একক সংসারের কথা লিখতে গেলে স্বামীর প্রসঙ্গ আনা অনিবার্য হয়ে পড়ত বলেই অসম্পূর্ণ রয়ে গেল ঠাম্মার এই স্মৃতিকথাটি। নৈঃশব্দ্যের চেয়ে কঠোরতম প্রতিবাদ আর কীই বা হতে পারত? তাই হয়তো নৈঃশব্দ্য দিয়েই স্বামীর গোটা জীবনজোড়া উপেক্ষার জবাব দিয়েছিলেন ঠাম্মা।”[২৪]

|| পাঁচ || 

উপসংহার 

নারীর ‘আত্মপরিচিতি’র প্রশ্নটি আদতে কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বিচারে হয়তো তাদের মধ্যে অবস্থানগত কিছু পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু পরাধীনতার অনুভব, বঞ্চনার অভিধা, অস্তিত্বের অবক্ষয়; নারীমাত্রেই ভিন্নতর প্রেক্ষাপট সাপেক্ষে উপলব্ধি করতে পারেন। ফলত অর্জনের সংগ্রামে তাঁদের দায়বদ্ধতা সার্বিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। 

আত্মবিরোধে ক্ষতবিক্ষত জীবনের বিশিষ্টতা খুঁজে নেওয়ার কাজে, মেয়েদের লেখা আত্মস্মৃতিগুলির ভূমিকা অপরিসীম। একান্ত পরাধীন বা তথাকথিত স্বাধীন জীবনের অন্তরস্থিত দ্বিচারিতা, বৈপরীত্য কখনও সামগ্রিক সরবতায় আবার কখনও বা অন্তরালবর্তী নৈঃশব্দ্যের বর্ম ভেদ করে সূক্ষ্ম ক্ষোভের আকারে এই আত্মকথাগুলিকে আশ্রয় করেছে। সব ক্ষেত্রেই যে মেয়েরা আত্মানুসন্ধানে সফল হয়েছেন এমন নয়। ঐতিহ্যলালিত সংস্কারের ভার তাঁদের উপলব্ধির দিগন্তকে বিস্তৃত হতে দেয়নি। কিন্তু তারই মধ্যে প্রতিনিয়ত মুখোশ পালটে ফেলা প্রবল প্রতিপক্ষ পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, প্রতিরোধকামী নারীর একক ‘স্বর’-কে বারবার সোচ্চার হতে দেখা যায়। মননশীলতা যখন অবদমনের ভাবাদর্শের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে উপনীত হয়েছে, নারী একরৈখিক অসামঞ্জস্যের চৌহদ্দি অতিক্রম করে, খুঁজে নিতে চেয়েছে তাঁর নিজস্ব আকাশ। আলোচ্য আত্মকথাগুলির মধ্য দিয়ে, পূর্বনির্ধারিত প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে এসে, নারীর জিজ্ঞাসার বহুস্বরিক উদ্ভাসনের সম্ভাবনা সক্রিয় হয়ে ওঠে। লিঙ্গভেদ এবং লিঙ্গসাম্যের পারস্পরিক জটিল অন্তর্দ্বন্দ্ব পৌঁছে দেয় মান্যতাপ্রাপ্ত সত্যের প্রতিস্রোতে, অন্যতর কথোপকথন প্রকল্পের দিকে। আর এর মধ্য দিয়ে নারী খুঁজে চলে তার নিজস্ব ভাষার আয়ুধ, স্বতন্ত্র উপস্থিতির ব্যঞ্জনা। কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘কন্যাবর্ষে’ কবিতার ভাষায় বলা যায়, সে চায়, ‘আসুক আমার মধ্যে প্রতিভূ আমার’। 

তথ্যসূত্র

১। https://www.thewrap.com/afgan-filmmaker-Sahraa-Karimi-letter-world-should-not-turn-its-back-on-us/ 

২। ওই।

৩। সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত, ‘মনুসংহিতা, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৯, পৃ. ২৪৮

৪। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, ‘পরিবার ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, কলকাতা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ২০০৫ সংস্করণ, পৃ. ১৯-৬২

৫। Sarmistha Dutta Gupta, ‘Identities and Histories : Women’s Writing and Politics in Bengal’, Kolkata, Stree, 2010, P. 21-22

৬। আশাপূর্ণা দেবী, ‘কলকাতার মেয়েরা এখন তখন’, দ্র. আরএকআশাপূর্ণা, কলকাতা, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, মাঘ ১৪০১, পৃ. ৮৪ 

৭। সুরমা ঘটক, ‘সুরমা নদীর দেশে, কলকাতা, অনুষ্টুপ সংস্করণ ২০১২, পৃ. ৯৩-৯৪

৮। ওই, পৃ. ১০৮

৯। চন্দ্রকণা সেন, ‘নগণ্য জীবন ও ঠাকুমার খাতা, কলকাতা, গাঙচিল, ২০১৩, পৃ. ১৭৫-১৭৬

১০। ওই, পৃ. ১৬৯

১১। অনুরাধা মহাপাত্র, ‘রুধিরপাত, কলকাতা, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ২০১৫, পৃ. ৬২

১২। উদিসা ইসলাম অনূদিত, ‘নারী নোবেল বিজয়ীদের বক্তৃতা, ঢাকা, ভাষাচিত্র, ২০১১, পৃ. ৫৪-৬০

১৩। অনুরাধা মহাপাত্র, ‘রুধিরপাত, কলকাতা, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ২০১৫, পৃ. ১০

১৪। অনীতা সেন, ‘জীবনের জলছবি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, রূপকথা প্রকাশন, ২০১৩, পৃ. ২১

১৫। নীহারিকা দাশগুপ্ত, ‘মায়ের শৈশব, কলকাতা, প্রথম দে’জ পাবলিশিং সংস্করণ ২০১৭, পৃ. ২১

১৬। হামিদা রহমান, ‘জীবন স্মৃতি, ঢাকা, নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৯০, পৃ. ৬

১৭। ওই, পৃ. ৫৪

১৮। ওই, পৃ. ১৫৮

১৯। সুকৃতি চক্রবর্তী, ‘বহিল আনন্দধারা, কলকাতা, কারিগর সংস্করণ ২০১৬, পৃ. ৮২

২০। ওই, পৃ. ৭৮-৭৯

২১। চৈতালি দাশগুপ্ত, ‘চৈতালিকেয়ার কথা, কলকাতা, সপ্তর্ষি প্রকাশন, ২য় সংস্করণ, ২০১২, পৃ. ২৪

২২। ওই, পৃ. ১০০

২৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ল্যাবরেটরি’, দ্র. গল্পগুচ্ছ, কলকাতা, বিশ্বভারতী-সংস্করণ ১৩৬৯, পৃ. ৬৯৬

২৪। অপরাজিতা দাশগুপ্ত, ‘ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, কলকাতা, গাঙচিল, ২০১৪, পৃ. ১০৬

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান