সুশান্ত পাল
পঁয়তাল্লিশ নম্বরের ভানুমতী
“ ‘হুজুর শুধালেন, ‘তু কীস্তী’, ‘তুই কে?’
‘সে বলল, ‘মা খু চিহ্ল্ ও পঞ্জম্ হস্তম্’ অর্থাৎ ‘আমি তো পঁয়তাল্লিশ নম্বরের।’ ”[১]
সৈয়দ মুজতবা আলী-র ‘দেশে বিদেশে’ ভ্রমণ-আখ্যানে উপস্থিত চরিত্র দুটির প্রথমজন আফগানিস্তানের আমীর হবীবু উল্লা। দ্বিতীয়জন জালালাবাদের জেলে বন্দি এক হতভাগা কয়েদি। বেচারা জানে না তার অপরাধ কী? পালিয়ে যাওয়া এক কয়েদির হিসেব মেলানোর জন্য পাহারাওয়ালা তাকে ধরে বেঁধে শাসিয়ে শিকল পরিয়ে, দিয়েছে সরকারি নম্বর পুরিয়ে। গোবেচারা মানুষটি ‘হয়তো ভেবে নিয়েছিল রাস্তার যে-কোনও লোককে রাজার হাতী যখন মাথায় তুলে নিয়ে সিংহাসনে বসাতে পারে তখন তাকে জেলখানায়ই বা নিয়ে যেতে পারবে না কেন?’[২] বাদশাহের পাহারাওয়ালা তার মাথায় এক মন্ত্র গেঁথে দিয়েছে, ‘আমি তো পঁয়তাল্লিশ নম্বরের।’ তার নামধাম সাকিন-ঠিকানা, দৈনন্দিন বেঁচে থাকা, জীবন, অস্তিত্বের সার কেন্দ্রীভূত হয়েছে ওই এক উচ্চারণে — ‘আমি পঁয়তাল্লিশ নম্বরের।’ পরিচয়ের এই ভানুমতীতেই সে ঘুরে মরেছে সারা জীবন।
আমরা কি ব্যতিক্রমী?
নামধামাদি পদবির সহাবস্থানে সামাজিক অবস্থানের অভিজ্ঞানকে আমরা কি বয়ে নিয়ে চলি না আমৃত্যু? জন্মসূত্রে অর্জিত সামাজিক উচ্চাবচতার চিহ্ন আমার সম্মতির পরোয়া না-করেই কি পরিচয়ের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যায় না? সে পদসোপানের ওপর তলায় কি মাঝের অথবা জলঅচল অস্পৃশ্যতায় হোক না কেন? অথচ, পরিচিতি নির্মাণের ক্ষেত্রটি তো হওয়া উচিত স্বোপার্জিত; পরম্পরা অনুক্রম, পবিত্র রক্ত বিশুদ্ধ বংশের মৌরসি পাট্টায় নয়। অর্থাৎ, জন্ম নয় কর্ম, রীতি-আচার গোত্র নয়, শিক্ষায় সংস্কৃতিতে অর্জন হওয়া উচিত পরিচয় নির্মাণের নৈর্ব্যক্তিক নিরিখ।
কিন্তু, সমাজ তা মানে না। মুখে অবশ্য নবজাগরণ, বিপ্লবের কথা বলে। মুখ থেকে বর্ণশ্রেষ্ঠ-র জন্ম আর পা থেকে চাঁড়ালের আবির্ভাব গালগল্প বলে ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়। ‘ভদ্রলোক’ ‘প্রগতিশীল’ পরিচয় উল্লেখে কবিতা আবৃত্তি করে — ‘শুনহ মানুষ ভাই…।’
সত্যি কী তাই! এখনও তো পরিচয় বলতে বুঝি ধর্ম-বর্ণ-জাত-লিঙ্গের রকমভেদে শিক্ষা কর্মে আধিপত্য ও বঞ্চনার ব্যস্তানুপাতিক প্রথাগত নির্ধারণ। জীবনে, সমাজের সর্বত্র বর্ণহিন্দুর আধিপত্যবাদ। উৎপাদনের উপায়, উপকরণ কুক্ষিগত করার আবহমান প্রক্রিয়া। ফলত জাতি-বর্ণ, শ্রেণির জটিল পারস্পরিকতা তৈরি হয়। অধিপতি জাতি-বর্ণ নিজের শ্রেণি পরিচয় আড়াল করে সময়-সুযোগ মতো পৃথক কৌশল অবলম্বন করে। সংস্কৃতায়নের টোপ ঝুলিয়ে রেখে বর্ণবৈষম্যের বাস্তবকে প্রচ্ছন্ন রাখে। সত্ত্বগুণের প্রভায় তামসিক গুণপিষ্ট জনতাকে পুনরুদ্ধার করার কার্যক্রম গ্রহণ করে।
এগিয়ে আসে রাষ্ট্র। সমাজের বর্ণবাদী অধিপতি দল এবং ধন-সম্পদে প্রভুত্বকারী শ্রেণিটি যেহেতু নির্বিশেষে এক, তাই সামাজিক কর্মসূচি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে অভিন্ন হয়ে যায়। তৈরি হয় পরিচয়ের বিভিন্ন থাক। প্রত্যেক বর্গের স্ব-স্ব দাবি উত্থাপিত হয়। কখনও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতায় কখনও রাজনীতির প্রয়োজনে বাহ্যিক হস্তক্ষেপে। আশু পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি যাকে বলে। রাষ্ট্রের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন বর্গের পৃথক পৃথক দাবি প্রায়শ পরস্পর বিরোধী হয়। এভাবে দেওয়া-নেওয়া কাড়াকাড়িতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্থিতাবস্থা বজায় থাকে। প্রান্তিক বর্গের নেতৃত্বের যে অংশ নিজেদের দাবি আদায়ে সরব হয়ে রাষ্ট্র-ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগ করেন, তাঁরাও সংস্কৃতায়নের এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের জটিল প্রক্রিয়ায় অঙ্গীভূত হয়ে পড়েন। প্রান্তিকতার, বঞ্চনার অতীত ইতিহাস ভুলে যেন তখন তাঁরা নবীন বর্ণবাদী! শ্রেণি ও বর্ণের মিলিত রসায়ন নতুন ভারতীয় সমাজ নির্মাণ করেছে এভাবে।
নতুন ভারতবর্ষ সকল পরিচিতিকে নিজের নিজের ক্ষেত্রে বজায় রেখে, কখনও কখনও আপৎকালে তাদের ছাপিয়ে একমাত্রিক পরিচয় নির্মাণের সংগঠিত রাষ্ট্রিক উদ্যোগে শামিল হয়েছে। ‘ধর্ম’ ও ‘জাতীয়তাবাদী’-র সমানুপাতিক পরিচয়। আপনি হিন্দু — ভারতবর্ষ আপনার পিতৃভূমি। অন্যথায় বিধর্মে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের অনুগ্রহের অথবা রোষের জিম্মায়।
বেচারা নিমলার সাধারণ গ্রাম্যমানুষটির পরিচয়ের একটিমাত্র প্রতিমান ছিল — ‘আমি তো পঁয়তাল্লিশ নম্বরের।’ একবিংশ শতকের ভারতবাসী আমাদের পরিচয় বহুধাবিভক্ত। আধার প্যান পরিষেবা প্রাপ্তির জমা-খাতার কত জটিল বিন্যস্ত সংখ্যার সঙ্গে চোখের মণি দশ আঙুলের ছাপ নির্মাণ নয়, নিবন্ধীকৃত করে আমাদের পরিচয়। সংখ্যা সত্তা মিলেমিশে একাকার।
পরঃ পরঃ সদা!
“আমার হাতের সামনে ‘গণশক্তি’ প্রকাশিত ‘ডায়াল’ টেলিফোন নম্বরের তালিকা পড়ে ছিল। সেখানে লেখক, শিল্পী ও সমালোচক শীর্ষকে প্রথম একশ’টি নামের মধ্যে অন্ততপক্ষে নব্বুইটি নাম বাংলার উচ্চবর্ণ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যদের; তিনটি নাম মুসলমানদের ও বাকি সাতটি নামের জাতি-পরিচয় পদবি দেখে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে, কেউ যদি গ্রামাঞ্চলে জাতীয় কর্মসংস্থান প্রকল্পে (একশ’ দিনের কাজ) কর্মরতদের একটি মাস্টার-রোল পরীক্ষা করেন, তাহলে দেখা যাবে তার মধ্যে প্রায় একশ’ শতাংশই দলিত, আদিবাসী, অন্যান্য নিম্নবর্ণের মানুষ বা মুসলমান। আমরা এ কথা বলতে পারি যে, বংশানুক্রমিক পেশার নীতিতে কিছু বদল ঘটলেও একটি মূল বিভাজন অব্যাহত আছে। সেই বিভাজন হল, কায়িক শ্রম ও মানসিক শ্রমের মধ্যে বিভাজন। ১৯১১ সালে যে জাতিগুলি মূলত কায়িক শ্রমে নিযুক্ত ছিলেন, আজকেও তাঁরা মোটামুটি ভাবে তা-ই আছেন। আবার বাংলায় ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থরা যেখানে কলম ধরা বা মানসিক শ্রমে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁরাও সেই অবস্থানে রয়েছেন।”[৩]
পাঠক আপনারা বলতে পারেন, পরিসংখ্যান যাই হোক বাংলার সমাজ জীবনে একটা ‘ফিল গুড’ আবহ আবহমান বিরাজিত। মুসলমানের বাড়িতে পানি খেতে গা ঘিনঘিন করলেও স্ব-ধর্মে নীচুজাতের সঙ্গে পংক্তিভোজন তো চলে। মহারাষ্ট্র তামিলনাড়ুর মতো বাবু বাংলায় ছুঁয়ে দিলে ছায়া মাড়ালে জাত যায় না। সবর্ণ বিবাহ অনুশাসন নয়, অসবর্ণে সমাজপতির চোখ রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে না। কথায় কথায় অনার কিলিং হয় না। দৈনিক সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন, পারিবারিক তথা পেশাদার ঘটককুল সেফটি ভাল্ব্-এর কাজ করে। অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ ব্যতিক্রমী পরিগণিত হয়ে সর্বসুখশান্তিস্থিতি বজায় রাখে। এক বেঞ্চে ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে জলসচল জলঅচল ভেদাভেদ এখানে নেই। দলিত রাঁধুনির তৈরি মিড-ডে মিল গ্রহণে আপত্তি মৃদুতর। সরকারি সংরক্ষণ, কর্মসূচি, ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলের প্যাঁচপয়জারে সংস্কৃতায়নের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে ক্ষমতায়ন। অর্থনৈতিক রাজনৈতিক অধিকার অর্জন এখানে মূল লক্ষ্য, বর্ণবাদের অনুসরণে অন্তঃজাতির মধ্যে উপজাতি গঠন করে জাতে-ওঠা নয়। পরিচয় নাকি এখন সর্বার্থেই গণতান্ত্রিক। নাগরিক অধিকারের নিক্তিতে তুল্য মূল্য।
বস্তুভিত্তি কোন্ সত্য, দিক নির্দেশ করছে?
অবশ্যই বামপন্থী শ্রেণি-রাজনীতির ইতিবাচকতা আছে। ভূমিসংস্কার, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ক্ষমতার বি-কেন্দ্রীকরণ অধিকার সচেতন করেছে নিম্নবর্গীয় জনগণকে।
তবু, স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার মূলকেন্দ্র তথা উপকেন্দ্রে এযাবৎ কর্তৃত্ব স্থাপন করে চলেছেন কাঁরা? বৃহৎ নৃ-তাত্ত্বিক বৈচিত্র সম্পন্ন প্রগতিশীল বাংলায় স্বাধীনতা-উত্তর সময়কালে ক্ষমতাধরদের জাতি-বর্ণ ভিত্তিক পরিচিতির পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিন জাতের আধিপত্য — ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ। তাঁরা নিশ্চিত যোগ্য। সামাজিক বিধান, সম্পত্তি-শ্রেণির অনুকূল বিন্যাস সুদূর অতীত থেকে তাঁদের সহায়। কিন্তু, পিছিয়ে পড়া মানুষের দুর্ভোগের স্থিতাবস্থার যুক্তি কী? নৃ-তাত্ত্বিক পরিচিতি? মাথা ও নাকের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের মাপজোক? বিধাতার অভিপ্রায়ে স্বভাবত অ-সভ্য অ-শুদ্ধ জাতি তকমায়? পূর্ব-জন্মের কৃতকর্মের ফল? আশ্চর্যের কিছু নেই যে, একজন কলম চালাতে জন্মায় একদল লাঙল ধরতে। ঋগ্বেদের পুরুষ সূক্তের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট বর্ণে হিন্দুদের পরিচিতি তো ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত। এমনকি সর্ব-সাম্যের ইসলাম ধর্মেও এর ব্যত্যয় দৃষ্ট নয়। সৈয়দ, শেখ, পাঠান, মুঘল, শাহ-ফকির, মোমিন, পটুয়া — মর্যাদার কত বিচিত্র স্তরবিন্যাস।
গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে প্রগতির সূত্র প্রধানত এই স্তরবিভাজন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সাংবিধানিক পরিচয়ে (নাগরিক) সর্বজনীনতা থাকলেও সামাজিক পরিচয় (ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গ) আমাদের ব্যক্তিপরিসর ও জনজীবনের নিয়ন্তা। রাজনীতি অর্থনীতিরও। রাষ্ট্র, সংবিধান ও সমাজ আছে সহাবস্থানে। চলছে বোঝাপড়া। সমাজ রাষ্ট্রের মারফত সংবিধান পরিবর্তন করতে তৎপরতা দেখায় মূল বর্ণবাদী বিন্যাস অটুট রেখে। এবং শ্রেণি-কাঠামোয় হস্তক্ষেপ না করে।
অতএব ‘স্বজন শ্রেয়ঃ…’
নামে আসে যায়
নাম: কমল কিশোর খোসলা। চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত। তিন সন্তানের জনক। ছাপোষা। ঠাকুরমা-ঠাকুরদা প্রদত্ত নাম, প্রদর্শিত রীতি-আচার বহন করে চলেছেন, যেমন বছর ষাটের প্রত্যেক ভারতীয় অনুসরণ করে চলেন। কিন্তু গোল বাঁধল ছোট ছেলের নামে। পিতামহী নাম রেখেছেন চিরৌঞ্জি লাল। যুবক চিরৌঞ্জি আবার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। ডাক এসেছে মার্কিন মুলুক থেকে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করার। সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের পক্ষে চিরৌঞ্জি লাল নাম সেকেলে ও আনস্মার্ট। পানওয়ালার পক্ষে তা মানানসই হতে পারে। শেষে হলফনামা দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার যুবক ঘোষণা করে আত্মনাম — চিরাগ খোসলা।[৪]
অনেকে অবশ্য অপর কৃৎকৌশল অবলম্বন করে। বহুর মধ্যে অনন্য পরিচয় স্থাপনে উচ্চারণ ভঙ্গিতে আমদানি করে বাংলা দল-বিধি (শব্দ উচ্চারণে মুক্ত দল ও রুদ্ধ দলের অবস্থান) বহির্ভূত আত্মপ্রবঞ্চনা। পাঠক শুনে থাকবেন বাংলা ব্যক্তিনাম ‘চেতনা’ (চে-ত-না)-র ‘চেত্-না’ রূপে উচ্চারণ। অথবা অগস্ত্য (অ-গস্-ত) আভিজাত্যের দেমাক ছড়ায় ‘আ-গস্-তা’-য়।
২০০১, ৫ মার্চ। এই লেখক পৌঁছে গিয়েছেন হুগলি জেলার আরামবাগে, গ্রামের এক স্কুলে। যোগদান করবে সহকারি শিক্ষক পদে। প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে উপস্থিত আছেন গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। বিদ্যালয়ের উন্নতিতে যাঁর পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। মাননীয় ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিতি পর্বের সূচনা একটি নির্বিষ প্রশ্নে — নাম কী? — সুশান্ত পাল। সেই সূত্রে দ্বিতীয় প্রশ্ন — জাতিতে কী? হয়তো অবচেতনে বাসা বাঁধা আত্মশ্লাঘা থেকে স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর বেরিয়ে এল — ‘জেনারেল কাস্ট’।
খ্রিস্টাব্দ ২০১৫ অথবা ২০১৬-র কোনও এক সময়। কথা চলছিল বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য প্রাবন্ধিক তথা প্রগতিশীল মানুষটির সঙ্গে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আমার এক সহপাঠী। ও পেশায় অধ্যাপক। বুদ্ধিজীবী মানুষটি কথায় কথায় বলে উঠলেন — ‘ওর পদবি দাস না? স তো? তাহলে বৈদ্য নয়। সিডিউল কাস্ট। কোটায় চাকরি পেয়েছে।’ ভাগ্যিস জীবনানন্দের দাশ বানানে ‘শ’ আছে। সজনীকান্ত দাস (স-সংযুক্ত) সম্পর্কে প্রগতিশীল মানুষটির মূল্যায়ন অবশ্য জানা হয়নি আজও। তিনি কি কোটার সাহিত্যিক?
করোনায় ত্রস্ত আপামর বিশ্ব। অচেনা ভাইরাস অজান্তে থাবা বসিয়েছে বাতাসে। এমন সময় ২ সেপ্টেম্বর ২০২০, চূড়ান্ত বর্ণবাদী আক্রমণের মুখোমুখি হলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপিকা। ‘মুর্মু’ জাত চিহ্নিত করে অধ্যাপিকার দক্ষতা, যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হল। করোনা ভাইরাসের সমসাময়িক রূপ নভেল হলেও জাত বিদ্বেষের বীজাণু প্রচ্ছন্নে প্রকাশ্যে নিজেকে অভিব্যক্ত করেই চলে। কখনও কখনও নখ দাঁত বার করে। অবশ্য ছেলেমানুষ থাকার সময় থেকেই তো বর্ণবাদী সমাজ অধ্যাপিকা-কে বুঝিয়ে দিয়েছে তিনি অপর: ‘চলতি কথায় ‘ছেলে-মানুষ’ থাকার সময়ই আমায় বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে আমি প্রান্তিক মানুষ মাত্র। শুধুই মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার বা অনুমতি — কোনোটাই আমাকে দেয়নি বাঙালি ভদ্রলোক সমাজ। যাঁরা মনে করেন জাতভিত্তিক আত্মপরিচয় গঠন এক ধরনের বিভক্তিকরণের রাজনীতির জন্ম দেয়, তাঁদের জানাই যে আমার জন্মগত, জাতভিত্তিক পরিচয়ই আমাকে সামাজিক দৃষ্টিতে চিরকালীন অপর করে চিহ্নিত করার ফলেই আমার আজকের এই অবস্থান। এই অপরায়নের বোধের জন্ম হয় আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে তখন। হঠাৎই ক্লাসের মাঝে আমাকে দাঁড় করিয়ে ক্লাস টিচার জিজ্ঞাসা করেন আমি ‘এস টি’ কিনা। হতভম্ব আমি। আমি যে এমন দুটি শব্দের ধারক-বাহক এমন কোনও কথাই তো জানায়নি মা-বাবা।’[৫]
আমি চাঁড়াল
বাংলায় দলিত টলিত বলে কিছু নেই। দলিত সাহিত্য বলে কিছু হয় না। ও আম্বেদকরের মহারাষ্ট্রে পেরিয়ারের দক্ষিণ-ভারতের সাহিত্য শাখা। সমাজপতিরা বলে থাকেন অথবা বলতে চেয়েছেন — অস্পৃশ্যতা এখানে কোনও দিন সমাজ জীবনের নিয়ন্ত্রক ছিল না। চণ্ডাল-কে ছুঁলে অশুচি হত না। চণ্ডালের জন্য গ্রামের প্রান্তে পল্লি ছিল না। ভাঙা-পাত্র মৃত-বস্ত্রেই তার একমাত্র অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল না। ছত্রধারণ, পাদুকা গ্রহণের অধিকার তাদেরও ছিল। স্বয়ং মহাপ্রভু ব্রাহ্মণ ও চণ্ডালকে সঙ্গে করে পংক্তিভোজন করেছেন। হরিনাম সংকীর্তনে প্রেমের জোয়ারে মিলিয়েছেন, তিনি মিলিয়েছেন। প্রেমের ঠাকুর স্পষ্টত বলেছেন — পবিত্র মনে চণ্ডাল যদি কৃষ্ণের প্রতি আত্মসমর্পিত হয়, সে ক্ষেত্রে দ্বিজ-র শ্রেষ্ঠত্ব সেই কুলপ্লাবী ভক্তির কাছে পরাভূত হয়। কবিগুরু ঋষি গৌতমের বাণীতে ভর্তৃহীনা জবালার গোত্রহীন সন্তান সত্যকামকে ব্রাহ্মণত্বের মর্যাদায় উন্নীত করার আখ্যান রচেছেন :
“অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত।
তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত।”
(‘ব্রাহ্মণ’ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তাই, পণ্ডিতজন বলেন বাংলায় দারিদ্র্য বঞ্চনা শোষণের ইতিহাস আছে, কিন্তু অচ্ছুতের প্রতি তুচ্ছতার দলন নেই। অন্ত্যজনের গল্প উপন্যাস রচনার জন্য কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি ছিল, আনন্দ দে’জ সাহিত্য অকাদেমি আছে। কল্পনায় ভর করে দলিতের যাপন অভিজ্ঞতা নির্মাণ করেছেন, করবেন প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিকেরা। চমকে উঠে তাই দেখি, বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ‘দলিত’ সাহিত্যের সংকলনে বাংলার কোনও দলিত লেখকের গল্প উপন্যাস কবিতার স্থান সংকুলান হয়নি। মায় চর্যাপদ, অদ্বৈত মল্লবর্মণ। বাংলাদেশের নারীর আত্মজীবনীতে প্রান্তিকতা, অবদমন, আঁতের কথা অথবা তার বিরুদ্ধে নীরব দ্রোহ একাডেমিক পরিসরে বা প্রকাশক মহলে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্তি এবং ব্যবসার পুঁজি রূপে স্বীকৃতি পেলেও দলিত মহিলার আত্মকথা এ বাংলায় ব্রাত্য।
কিন্তু এ বাংলায় ঘটেছে লোধা কন্যা চুনি কোটালের আত্মহনন। বর্ণবাদী সমাজের শিকড় যে কত গভীরে, চেতনে-অবচেতনে বিস্তার তার ডালপালা, তার জ্বলন্ত নিদর্শন চুনি কোটালের আত্মহত্যা। একজন প্রান্তিকতম নারীর যন্ত্রণা কী করে প্রকাশ করবেন উচ্চবর্গের সু-সাহিত্যিক। নিঃসীম দারিদ্র্য, জাতি-বর্ণ, লিঙ্গের অবস্থানে জন্ম যাঁর কাছে অভিশাপ, আমরা কি পাঠ করেছি তাঁর আত্মকথা — ‘কোন্ লগ্নে কোন্ তিথিতে যে এই মাটির পৃথিবীতে এসেছিলাম জানি না। নিশ্চয়ই সেই মুহূর্ত ভালো ছিল না। আর কীসের প্রয়োজনে যে আমাদের মতো ছেলেমেয়েরা আসে তার উত্তর আজ খুঁজে পাই না।’[৬] অথবা, কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়ালের আত্মজবানি — ‘জন্ম তারিখ মনে রাখেনি বাবা-মা। ঐ শ্রাবণ মাসে হয়েছে, অমুকের ছেলের থেকে নয় দিনের ছোটো এরকম।’[৭]
আজন্ম যাদের বয়ে বেড়াতে হয় নিম্নবর্ণে ভূমিষ্ঠ হওয়ার অভিশাপ, তাঁরাই তো নিজের কলমে লিখবেন তাঁদের জীবনযাপনের ইতিবৃত্ত। যাঁরা ‘আধপেটা খেয়ে মাঠে ঘাটে গোরুবাছুরের সাথে ঘুরে’[৮] মানুষ হয়েছেন, পুরুত ঠাকুরের উঠান পর্যন্ত যাওয়ার অধিকার ছিল যাঁদের,[৯] মেয়েবেলা থেকে যাঁদের হায়ার কাস্টের দুধফুটে শিশুরা তাচ্ছিল্যের নজরে দেখে, তাঁরাই বলবেন নিজের মুখে নিজের অস্তিত্বের কথা। কোন্ সামাজিক প্রথা তথা বর্ণবাদী হীনম্মন্যতায় চণ্ডালকে হতে হয় নমঃশূদ্র, কেন সামাজিক অস্পৃশ্যতা থেকে মুক্তি পেতে ‘ঠাকুর’ পদবি গ্রহণ করতে হয়,[১০] সাঁওতাল জাতিকে তার চিরাচরিত ‘সারনা ধরম’ পরিত্যাগ করে ‘সাফা-হোড়’ (হিন্দুকরণ) হয়ে যেতে হয় — পর্বান্তরের এই আখ্যান রচনা করবেন স্বয়ং দলিত লেখক। দলিত সত্তাকে অনবরত যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, অথবা ধেয়ে আসা উচ্চবর্গীয় ইতরতা, তার ব্যক্তি ও যৌথ অভিজ্ঞতা প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিকদের আছে কি?
আপনি ‘ঠিক সাঁওতালদের মতো দেখতে’[১১] নন; আপনারা কী ঠাকুর — রবি ঠাকুরের ঠাকুর, না উপাধি পাওয়া ঠাকুর?[১২] অথবা ‘তোকে তো দেখলে সিডিউল কাস্ট মনে হয় না’ … ‘তুই কিশোরী আমনকার চিনিস![১৩] বিপরীতে — ‘ঠাকুর মশায় কিন্তু একদম ব্রাহ্মণের মতো দেখতে, দেখলেই ভক্তি আসে।’[১৪]
দলিত সাহিত্য গড়ে উঠবে ধেয়ে আসা এই হিংস্রতা নগ্ন করার লক্ষ্যে। এবং তা রচনা করবেন স্বয়ং দলিত মানব-মানবী। মনে রাখতে হবে — ‘যে দলিত জন্তু জানোয়ারের ছাল ছাড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে সেই দলিতের অভিজ্ঞতা কল্পনার জোরে অন্য বর্ণের লেখক কীভাবে লিখবেন? অস্পৃশ্যের মনের ক্ষুব্ধতার ছবি নিরুপায় কল্পনায় কেমন করে আঁকা সম্ভব?’[১৫] দলিত সাহিত্য প্রকাশ করবে প্রান্তিক অবদমিত শোষিত মানুষের সংকট লড়াই। দিনবদলের জন্য সে সমবেত হবে সমাজ পরিবর্তনের বৃহত্তর শ্রেণিসংগ্রামে। এবং বর্ণবাদী সমাজের আপাত স্পৃশ্যতার ভদ্রতার মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলে সোচ্চারে ঘোষণা করবে — হ্যাঁ আমি চাঁড়াল।
সংস্কৃত নন্দনতত্ত্বে বিবৃতি হলেও দলিত মানবী কবিতা লিখবেন, লিখে চলবেন :
“অহিংসার পাঠ নিতে বাঘের জঙ্গলে যাই জনাকীর্ণ নগর সভ্যতা ছেড়ে
হায় বাঘ! শ্বা-পদ শব্দ এসে লজ্জা দেয় মানব সমাজে
দাঁত নখ সবই আছে দু’জনার
হয়ে যাক পরীক্ষায় এবার কার দাঁতে কত তেজ কার নখে বেশি তীক্ষ্ণধার” [১৬]
‘আদিবাসীরা নাচবে না…’
‘আমরা দেখতে চাই, আদিবাসীরা অর্থনৈতিকভাবে সমান সাহায্য পাচ্ছে। আমরা দেখতে চাই, আদিবাসীরা মুক্তি পেয়েছে ঠক ও জালিয়াতদের থেকে, অত্যাচারী জমিদার ও মহাজনদের থেকে, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং লোভী আধিকারিকদের থেকে। আমরা যেন দেখতে পাই, আদিবাসীরা পেশাদার ও অভিজ্ঞ ডাক্তারদের থেকে সব রকম চিকিৎসাজনিত সাহায্য পাচ্ছে। বিদ্যালয় নিশ্চিতভাবে স্থাপন করা প্রয়োজন এবং সেখান অসার সাক্ষরতার প্রসার না ঘটিয়ে উপযোগী হাতের কাজ, যেমন কাঠের কাজ, কৃষিপদ্ধতি বিষয়ের শিক্ষা দেওয়া হয়। আত্মসম্মানবোধ যেন ক্ষুণ্ণ না হয় এবং প্রতিবেশীরা যাতে সম্মান করে — এই একই চেতনা প্রতিবেশীদের মধ্যেও জাগিয়ে তুলতে হবে। আদিবাসীদের গান, নাচ, উৎসব ও আনন্দ যারা লুণ্ঠন করতে চাইছে, সেই সব আগ্রাসী মানুষদের হাত থেকে যেন আমরা আদিবাসীদের রক্ষা করতে পারি।’[১৭]
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে রচিত Aboriginal গ্রন্থের উপসংহারে আদিবাসী সত্তা সংস্কৃতি অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সরকার তথা নাগরিক উচ্চবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ভেরিয়ার এলুইন।
অরণ্য পাহাড় নৃত্য সংগীত শিকার উৎসবে অনাবিল আনন্দের মুক্ত-স্বাধীন জীবনচর্যার সঙ্গে ওতপ্রোত আদিবাসী পরিচিতি সত্তা। তার অস্তিত্বের শিকড় ব্যক্তি নাগরিকতার বিপ্রতীপে গোষ্ঠী চেতনায়। আদিবাসী নাচে-গানে উৎসবে অনুষ্ঠানে দলের প্রাধান্য, ব্যক্তি সেখানে গৌণ। অথচ, আধুনিক উন্নয়ন ব্যক্তি অভিমুখী ও ব্যক্তি, সমাজ, জীবনদর্শন নিরপেক্ষ। এক ছাঁচে সবাইকে গড়তে চায়। কলকারখানা উপনগরী শহুরে-বাংলায় রচিত পাঠক্রমে গড়ে ওঠা স্কুল ইত্যাদি হল উন্নয়নের সমার্থক। কল্যাণকর রাষ্ট্র সমষ্টি জীবনবোধে আচার সংস্কৃতিতে হস্তক্ষেপ করে প্রান্তিক জনজাতির কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে আদিবাসীদের প্রকৃতিদত্ত অধিকারে, জল জমি জঙ্গলে থাবা বসায় অগ্রগতির কর্তব্য পালনে।
সংগীতকার মঙ্গল মুর্মু তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁর দল রাষ্ট্রপতির সামনে পুতুল নাচ নাচবে না। রাষ্ট্র তাঁদের বাসভূমি কেড়েছে জমি দখল করেছে। মহান ভারত তাঁর বাসভূমি গোড্ডায় গড়ে তুলবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। নিজেদের সমাধিস্থলের ভিত্তিপ্রস্তরে সান্তালরা নাচবে গাইবে! বিনীত অথচ দৃঢ় প্রত্যয়ে মঙ্গল মুর্মু রাষ্ট্রপতিকে তাঁর অ-সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন — ‘এই যে লোকেরা আপনার পাশে বসে রয়েছে তারা আপনাকে বলেছে যে এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের ভাগ্য বদলে দেবে, কিন্তু ওই একই লোকগুলোই আমাদের বাধ্য করেছে আমাদের বাড়িঘর আর গ্রামছাড়া হতে। আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, কোথাও ফসল ফলানোর জায়গা নেই আমাদের। কী করে এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের জন্যে ভাল হবে? আর কী করেই বা আমরা আদিবাসীরা নাচব আর খুশি হব? যদি না আমাদের ঘরবাড়ি আর জমি ফেরত দেওয়া হয়, আমরা নাচ গান করব না। আমরা আদিবাসীরা নাচব না। আদিবাসীরা না…’[১৮]
প্রকৃতপক্ষে, আদিবাসী অস্তিত্ব নাগরিক বাঙালির কাছে গোষ্ঠী জীবনধারা রূপে নয়, টুকরো টুকরো চিত্রকল্পে হাজির হয়। আদিবাসী অর্থে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় কালো রঙের সিমি গারওয়াল, ‘আগন্তুক’-এ মমতা শংকরের আদিবাসী রমণীর কোমর জড়িয়ে আগুন ঘিরে নাচ; বোহেমিয়ান ঋত্বিকের সেলুলয়েডে আদিম বুনো সারল্যে মুক্ত স্বাধীন জীবনের পদচারণায় রণবাদ্য মাদলের প্রতীকায়ন; অথবা কবিতায় মহুয়ার দেশে দেবদারু বৃক্ষরাজির নিরিবিলি প্রচ্ছায়ে জেগে ওঠে কথাকলি ছন্দ — নাগরিক ক্লান্তি অপনোদনে মহুয়া ফুলের মাদকতা। হয়তো খোয়াই থেকে কেনা আদিবাসী পুরুষ-নারীর মুখোশ; লোকসংস্কৃতির মেলায় মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে দেখা ‘ছউ’-পালা। ক্ষেত্রবিশেষে রামকিঙ্কর বেইজের সাঁওতাল দম্পতির স্থাপত্যশৈলী। সবমিলিয়ে নাগরিক পরিচয়ে আদিবাসী অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রোমান্টিসিজম।
আদিবাসীর ক্ষুধা আছে — বেমালুম ভুলে যায় সবাই। ভাবে মহুল মাতনে ওরা নেচে-গেয়ে হেসে-খেলে দিন কাটায়। সস্তায় আদিবাসী নারী সম্ভোগ করা যায়। বেগার খাটানো যায় খনিতে জমিতে মিছিলে। আদিবাসীরা কি শুধুই নাচবে গাইবে বিভেদকামী রাজনীতির অর্থনীতির কার্যক্রমে?
লডু, কুমটি গাতা মাঝিরা কিন্তু আত্ম পরিচয়ের নতুন ইতিহাস নির্মাণ করেছেন। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়নের বিরুদ্ধে নিজেদের পাহাড় অরণ্য নাচ-গান সংস্কৃতিকে আগলে রেখে, সমরূপ একমাত্রিক প্রগতির রাষ্ট্রীয় যজ্ঞের সমিধ না হয়ে। আত্মসমর্পণ নয় প্রতিরোধ।
এ আখ্যান রক্তমাংসের আদিবাসী মানুষের। বাস্তবের। বর্তমান শতকের প্রথম দুই দশক ২০০৯-১১-১৩ — এই সময়কালের ঘটনা। এক পাহাড় রাজা ও তাঁর সন্তানসন্ততির আখ্যান। হাজার আটেক, অথবা কিছু বেশি আদুল-গা মানুষ একদিন সমস্বরে জানিয়ে দিলেন, তাঁরা আত্মা বিক্রি করবেন না। সে কী! বৈদিক ঔপনিষদিক কাল থেকে আত্মার একচ্ছত্র অধিপতি, আত্মার পেটেন্ট তো ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অবশ্য আত্মন্-এর স্বত্ব সম্প্রসারণ ঘটেছে। দেশপিতা, বণিককুলপতি, গোটামাহিনার মোটা পুরুষকুল ব্রহ্মানন্দভোগী আত্মারাম হয়েছেন। জাতির হিতার্থে আত্মস্থ দেশজনক দেশ-দেশান্তরের সওদাগরকে আত্মার বন্ধনে বেঁধেছেন। কর্মোদ্যোগী বণিক আত্মাবলম্বনকে আত্মসাৎ করেছেন। মোটামাহিনা নায়েবকুল আত্মোন্নতির মন্ত্র আত্মীভূত করে কখনো-সখনো মেলানকলি আত্মিক সংকটে ভোগেন। সুতরাং আত্মা কুলীনের সম্পত্তি। কোথাকার কোন্ অচ্ছুত আনপড় জনজাতি উড়ে এসে জুড়ে বসে আত্মায় ভাগ বসায়?
ওঁরা ডোঙ্গরিয়া কন্ধ। আদিম জনজাতি। নিবাস ওঁদের পশ্চিম ওড়িশার নিয়মগিরি পর্বতে। ওঁদের রাজা নিয়মরাজা। সন্তানদের তিনি দিয়েছেন নদী পাহাড় অরণ্য। ঝরনা হরিণ অর্কিড গেকো ছত্রাক ফার্ন। ফলমূল কতশত পাখি ভেষজ সঞ্জীবনী গাছ-গাছড়া। বংশধারা নাগাবলীর মিষ্টি জল। ওঁরা ওঁদের প্রেম-আচারে নাচে-গানে কৃষিকাজে প্রশান্ত। ঋতুমতী প্রকৃতির সুর-ছন্দে জীবন গেঁথেছেন। রোদ বৃষ্টি আকাশ নদী লালমাটি শ্বাপদ জীববৈচিত্রে আশ্চর্য জীবনধারার আবাস নিয়মগিরিকে নেশাতুর মাদকতায় জড়িয়ে ওঁরা। প্রিমিটিভ জংলি ডোঙ্গরিয়া কন্ধ।
ঠাকুরমা ঠাকুরদাদার বাসভূমি নিয়মগিরি পর্বত অরণ্যে ওঁদের অধিকার প্রজন্মান্তরের। নিয়মরাজার সন্তান তাঁরা। অন্য রাজার আইন খাটবে কেন সেখানে? এদিকে রাষ্ট্ররাজের আছে উন্নয়নের নজরদোষ। প্রজাদের সমুদায় জাগতিক পারলৌকিক সমৃদ্ধি সাধন তাঁর প্রধান কর্তব্য রূপে বিবেচিত, কনস্টিটিউশনে লিপিবদ্ধ। তাই প্রিমিটিভ জংলির মুখে হাসি ফোটানোর তরে ডাক পড়ল আলাদিনের। সঙ্গে এল চল্লিশ চোর।
এল বেদান্ত অ্যালুমিনা। আদিম জনজাতিকে ফ্যান টিভি মোবাইল তথা আধুনিক সুশিক্ষিত আদব কায়দায় উন্নীত করার সুমহান দায়িত্ব পালন করতে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে। জাতভাই পস্কো আগেই পা রেখেছেন ওড়িশায়। নিয়মগিরি পর্বতের পাদদেশে লাঞ্জিগড়ে গড়ে উঠল পরিশোধনাগার। নিয়মগিরি পর্বতে রয়েছে যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ৭০ মিলিয়ন টন উৎকৃষ্ট বক্সাইট। বেদান্তের লক্ষ্য ঘোষণা হল — Mining Happiness। বক্সাইট খননে হাসি ফুটবে প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে। ঝকঝক করবে অ্যালুমিনিয়াম। প্রস্তরের সর্বশেষ বিবর্তন।
কিন্তু, স্বভাব যায় না মরলে। জংলি মূর্খ তাঁর যাবতীয় টোটেম নিয়ে সেই আদিমতায় থাকতে চাইল। নিয়মগিরি পর্বত তাঁদের মা। মায়ের বুক চিড়ে রক্ত মাংস ছিঁড়ে উন্নয়নের বক্সাইট উত্তোলনের পথে প্রতিরোধ তৈরি করল আদিম সাহস। আকাশচুম্বী অভ্রভেদী রত্নশোভিত নয়, পর্বত অরণ্য নদী ঘেরা নিয়মগিরি তাঁদের দেবালয়। দেবপ্রাঙ্গণকে তাঁরা সমতলবাসীর মতো রক্তাক্ত হতে দেবেন না। নিয়মরাজার সাকুল্যে কমবেশি আট হাজার সন্তান বুনো হাসি মুখে রুখে দাঁড়িয়ে বললেন — নিয়মগিরি আমাদের আত্মা, আত্মা আবার বিক্রি হয় না কি?
আত্মার অবলোপ, রূপকথার অবসান অস্বীকার করে সিরকাপাদি কুনাকাদু বাটুরিয়ার ডোঙ্গরিয়া কন্ধ তাঁদের গাছপাথর লতাপাতা ঝরনায় ঘেরা বাসভূমি আগলে রাখল। রাষ্ট্ররাজা নত হল তার নাছোড় অবাধ্য প্রজার কাছে। কর্পোরেট বন্ধুও তো আর সবসময় জেতে না। মাঝেমধ্যে বন্য সরীসৃপের ভয়ে উন্নয়ন-আমোদ তার কনভেয়ার বেল্ট গোটায়। বুনো জেদে অবশেষে পাততাড়ি গোটায় Vedanta।
নটে গাছটি সহজে মুড়োয় না। প্রিমিটিভ ট্রাইবালরা রাষ্ট্রের ‘হ্যাঁ’-তে ‘না’ বলার স্পর্ধা দেখান। ডোঙ্গরিয়া কন্ধ লডুর মুখে শুনি — ‘আমো আত্মা আছে জীবো। নিয়মগিরি আমো মন্দিরো। নিয়মগিরি আমো আত্মা।’[১৯]
আমাদের সত্তা-র অবলম্বন কোথায়?
‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা …’
‘ঢের খাবি তো অল্প খা’
জীবন অভিমুখ বদলে গেছে। নতুন সময় আজ নতুন জীবনবোধ প্রতিষ্ঠায় সদা উদ্গ্রীব, তৎপর, অস্থির, অর্থের এক নতুন তাৎপর্য নির্মাণে। নতুন পরিচয় প্রতিষ্ঠায় সে ধাবমান। আজ তার নতুন আত্মপরিচয় — পণ্যমানুষ। অর্থের ব্যঞ্জনা দু-দিক থেকেই প্রতিষ্ঠিত। পণ্যের প্রতি ধাবিত মানুষ। মানুষ পণ্যের ক্রীতদাস। পণ্যের উদ্ভাবনী প্রসারক। জীবন একটাই। তাই উল্লাসে রভসে মৈথুনে নিংড়ে নিতে হবে নিঃশেষে। সাধ্য সীমার বাঁধন ছাড়িয়ে ডুব দিতে হবে পণ্যসাগরে। বাজার ছেঁচে রং-বেরঙের পণ্যে ঘর ভরিয়ে তুলতে হবে। তারপর ভরে উঠবে রিসাইকেল বিন। উত্তর-আধুনিক ডাস্টবিন। ইএমআই-এর পর ইএমআই বলে দিচ্ছে আমি আপনি যুগন্ধর মানুষ। মানিব্যাগে বেসরকারি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ঘোষণা করছে আমার আপনার ক্রেডিবিলিটি। আপাদমস্তক, সর্বার্থে আমাদের বিক্রয়লভ্য গ্রহণযোগ্যতা। সিবিল স্কোর প্রতিষ্ঠা করেছে নতুন পরিচয় — আমি আপনি বাজার-মানুষ।
একেই বোধহয় বলে জাতে ওঠা।
না, জাতি পরিচয় মুছে যাওয়া?
তথ্যসূত্র :
১) সৈয়দ মুজতবা আলী, ‘দেশেবিদেশে’, কলকাতা, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩৬৪ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা — ১০৬
২) পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা — ১০৪-০৫
৩) সন্তোষ রাণা, কুমার রাণা, ‘পশ্চিমবঙ্গে দলিত ও আদিবাসী’, কলকাতা, গাঙচিল, পৃষ্ঠা — ১৬
৪) দিবাকর ব্যানার্জি (পরিচালিত), ‘খোসলা কা ঘোসলা’ (চলচ্চিত্র), ভারত, ২০০৬
৫) মেরুনা মুর্মু, ‘ভারত মাতার ইতর সন্তানের আপন কথা’ : নীড় (কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল সম্পাদিত), কলকাতা, ২০১৭ (অষ্টাদশ সংখ্যা, ত্রয়বিংশতি বর্ষ), পৃষ্ঠা — ১১
৬) চুনি কোটাল, ‘আত্মকথা’ : নীড়, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা — ৫
৭) কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল, ‘আমি কেন চাঁড়াল লিখি’, কলকাতা, চতুর্থ দুনিয়া, ২০২১, পৃষ্ঠা — ৭
৮) ওই, পৃষ্ঠা — ১৪
৯) লিলি হালদার, ‘আমার শৈশব’ : নীড়, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা — ৩৩
১০) কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা — ৪৫
১১) মেরুনা মুর্মু, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা — ১৪
১২) কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা — ৬৮
১৩) ওই, পৃষ্ঠা — ৮৬
১৪) ওই, পৃষ্ঠা — ৮৯
১৫) শরণকুমার লিম্বালে, ‘দলিত নন্দনতত্ত্ব’ (মৃন্ময় প্রামাণিক অনূদিত), কলকাতা, তৃতীয় পরিসর, ২০১৭, পৃষ্ঠা — ১৬৫
১৬) কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল, ‘চণ্ডালিনী ভণে’ (৩৯ সংখ্যক কবিতা), কলকাতা, প্রত্যুষ পাবলিকেশন, ২০১৫, পৃষ্ঠা — ৫৩
১৭) ভেরিয়ার এলুইন, ‘আদিবাসী’ (ভাষান্তর ও সম্পাদনা : ঋত্বিক মল্লিক), কলকাতা, সেতু প্রকাশনী, ২০১২, পৃষ্ঠা — ৬৫
১৮) হাঁসদা সৌভেন্দ্র শেখর, ‘আদিবাসীরা নাচবে না’ (দময়ন্তী দাশগুপ্ত অনূদিত) : আদিবাসীরানাচবেনা, কলকাতা, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা, ২০২০, পৃষ্ঠা — ১৬২
১৯) টবি নিকোলাস (পরিচালিত), ‘মাইন: স্টোরি অফ এ সেক্রেড মাউন্টেন’ (তথ্যচিত্র), ভারত, ২০০৯
সহায়ক গ্রন্থ :
তথ্যসূত্রে উল্লেখিত গ্রন্থ এবং
১) কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর (সম্পাদনা), ‘বাংলার নমঃশূদ্র’ (প্রথম ভাগ), কলকাতা, কে এন টি এ এ, ২০২১
২) দেবেশ রায় (সংকলন ও সম্পাদনা), ‘দলিত’, নতুন দিল্লি, সাহিত্য অকাদেমি, ১৯৯৭
৩) নরহরি কবিরাজ, ‘কাকে বলে উত্তরাধুনিকতাবাদ’ (ভাষান্তর : চিররঞ্জন সেনগুপ্ত), কলকাতা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, ২০১৪
৪) নির্মলকুমার বসু, ‘হিন্দুসমাজের গড়ন’, কলকাতা, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কার্তিক ১৪১৫ বঙ্গাব্দ
৫) পরিমল ভট্টাচার্য, ‘সত্যি রূপকথা : সভ্যতা, উন্নয়ন ও ওড়িশার এক উপজাতির জীবন সংগ্রাম’, কলকাতা, অবভাস, ২০১৫
৬) পি সাইনাথ, ‘দলিত ভারত’ (ভাষান্তর ও সম্পাদনা : দেবু দত্তগুপ্ত), কলকাতা, সেরিবান, ২০১৯
৭) প্রকাশ কারাত, ‘পরিচিতি সত্তার রাজনীতির চ্যালেঞ্জ’, কলকাতা, এন বি এ, ২০১২
৮) বি টি রণদিভে, ‘জাত বর্ণ শ্রেণী এবং সম্পত্তিগত সম্পর্ক’, কলকাতা, এন বি এ, ২০১২
৯) মহাশ্বেতা দেবী (সম্পাদনা), ‘শবর লোকগান ও লোককথা’ (সংকলন ও অনুবাদ : প্রশান্ত রক্ষিত), নতুন দিল্লি, সাহিত্য অকাদেমি, ২০১৩
১০) রতন খাসনবিশ (সম্পাদনা), ‘উত্তর আধুনিকতা ও মার্কসবাদ’, কলকাতা, পিপলস বুক সোসাইটি, ১৯৯৭
১১) শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিৎ দাশগুপ্ত (সম্পাদনা), ‘জাতি, বর্ণ ও বাঙালি সমাজ’, কলকাতা, নয়া উদ্যোগ, ১৯৯৮