সসীমকুমার বাড়ৈ
মানুষের গুণাবলি, বিশ্বাস, চেহারার অভিব্যক্তি ও সচেতনতায় ব্যক্তি বা সমষ্টির পরিচয় প্রকাশ পায়। এবং আত্মপরিচয়ের শক্তি ব্যাবহারিক প্রয়োগে হয়ে উঠতে পারে গঠনমূলক বা ধ্বংসাত্মক। মানুষের পরিচয় গভীরভাবে সম্পৃক্ত আছে দেশ, কাল, জাতি, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বা গোষ্ঠীগতভাবে সে সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু কিনা এমন কতগুলি আপেক্ষিক ক্ষেত্রের ওপর। অর্থনৈতিক অবস্থাও একটি বড়ো নির্ণায়ক শক্তি। তবে সংখ্যালঘু কিংবা সংখ্যাগুরু শব্দ দুটি সব বিষয়েই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। তা শুধু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যেই সীমিত থাকে না; ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন থেকে রাষ্ট্রিক চরিত্রে তার প্রতিফলন দেখা যায়। বিপরীতে সংখ্যালঘুদের মনে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আভিঘাতে জন্ম দেয় ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা এবং হীনম্মন্যতা। সংখ্যালঘুর এই ধরনের অদৃশ্য নিরাপত্তাহীনতা বা হীনম্মন্যতা প্রভাব ফেলে পরিচয়-সূচকে। দীর্ঘদিন এমন আত্মপরিচয়ের ঘোর সংকট অতিবাহিত করে আসছে ভারতবর্ষের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অধিবাসীরা। এই ক্ষুদ্র ভাষা-সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে প্রবহমান আত্মপরিয়ের সংকট সম্বন্ধে আমাদের ধ্যান ধারণা অত্যন্ত সীমিত। অথচ বলা যেতে পারে পরিচয়ের সংকট এই সংকর জনগোষ্ঠীর উদ্ভবের কাল থেকেই। নাগরিকত্ব প্রশ্নে অস্থিরতা ও সিদ্ধান্তহীনতার সঙ্গে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, বর্ণের সংখ্যালঘুত্ব ক্রমশ তাদের বিচ্ছিন্ন এবং বিপন্ন করে তুলেছিল। সর্বোপরি তাদের জিনের দুটি সত্তা: অ্যাংলো এবং ইন্ডিয়ান সংকরায়ন হলেও পরিচয়ে তা কখনোই সম্পৃক্ত হতে দেয়নি। মিশ্র সত্তায় বিপরীতমুখী অভিঘাত তাদের মানসিকভাবে করে রেখেছে এক দেশহীন, লক্ষ্যহীন গন্তব্যের অভিযাত্রী। তাদের অস্থির মানসিকতার অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা সৃষ্টি হয়েছে কল্প পিতৃভূমির ডায়াস্পোরা। ফলে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতো আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের উদাসীনতা তাদের সংকটকে আরও প্রগাঢ় করেছে।
এযাবৎ প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ধরা হয় আফ্রিকার কেনিয়া মানুষের আদিমতম পুরুষের বসবাস বা উৎপত্তিস্থান। কেনিয়ার তুজেন পাহাড় গুহায় সাত মিলিয়ন বর্ষ আগের মানুষের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। খুব সঙ্গত কারণেই মেনে নিতে হয় সেখান থেকে আদিম মানব গোষ্ঠীগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। খাদ্য, বাসস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলবায়ু ভেদে মানুষের গাত্রবর্ণ থেকে শুরু করে ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস গায়ের রং গড়ে উঠেছিল। সে হিসেবে আর্য, অনার্য, শক, হুন বা পাঠান-মোগল এক দেহে লীন হওয়াও ছিল অনেক পরের ঘটনা। আদিপুরুষেরা তার অনেক আগেই ভারতীয় মূলনিবাসীতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। যুগে যুগে ভাগ্যান্বেষী মানুষ ভারতে এসেছে আর এ দেশের জল মাটিতে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা এদেশে উৎপন্ন হয়ে একদেহে লীন হলেও তাদের মধ্যে অ্যাংলো এবং ইন্ডিয়ান সত্তা কখনও একাত্ম হতে দেয়নি। তারা যতটা না ভারতীয় তার থেকে বেশি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রয়ে গেছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে কবে থেকে এই গোষ্ঠীর উৎপত্তি? ভারতে এই মিশ্র জাতির মানুষের হদিশ করতে গেলে ফিরে যেতে হয় পোর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামার মালাবার কোস্টের কালিকট (বর্তমান কোজিকোড)-এ অবতরণ কাল ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে। তখন থেকে বেনিয়া পোর্তুগিজদের আনাগোনা এদেশে বাড়তে থাকে, কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বসবাসের ফলে স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে থা করে। ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে আলফান্সো দে অ্যালবুকুয়েরকি (Alfanso de Albuquerque) গোয়া দখল করে। পরবর্তীতে গোয়ার গভর্নর পোর্তুগিজ অধিবাসীদের ভারতীয়দের সঙ্গে বিয়েতে উৎসাহ দিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। এভাবে জন্ম নেয় লুসো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়, যারা ধর্মীয় বিশ্বাসে খ্রিস্টান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। প্রাথমিকভাবে তারা ভারতে পোর্তুগিজ কলোনিতে থাকত, বিশেষভাবে গোয়া, দমন এবং দিউ, মাঙ্গালোর, কোরলাই, সিলভাসা, কেপ কোমোরিন এবং কোচিন ফোর্টে। লুসো-ইন্ডিয়ানরা ক্যালকাটা, মাদ্রাজ, বোম্বাই প্রভৃতি স্থানেও ছড়িয়ে পড়েছিল কালক্রমে। এই মিশ্র জাতির মধ্যে ভারতীয় বর্ণপ্রথারও প্রভাব পড়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ে, যেমন নতুন ব্রাহ্মণ খ্রিস্টান সম্প্রদায়। মিশনারিদের দ্বারা ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের মধ্যেও জাতপাতের বিভাজন ছিল। কিন্তু কালক্রমে লুসো-ইন্ডিয়ানরা ভারতীয় হয়ে যায়, ইউরোপীয় পোর্তুগিজ-ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূতরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের পর্যায়ভুক্ত হয়। লুসো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের আলাদা অস্তিত্ব বর্তমানে বিবেচনায় রাখা হয় না। কোম্পানি আমলে অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা ছিল যে ব্রিটিশ অফিসার ও সৈনিকদের স্থানীয় স্ত্রী থাকবে এবং তাদের ইউরেশিয়ান সন্তান থাকবে। কারণ এদেশে ব্রিটিশ মহিলা সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। অধিকাংশ ব্রিটিশ নাগরিকদের দেশ থেকে বউ নিয়ে আসার অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। এমনকি কোম্পানি এ দেশীয় বাচ্চা প্রতিপালনের জন্য কিছু ভাতা পর্যন্ত দিত। গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি আধিকারিকদের এ দেশে ব্যবসা বাণিজ্য করে তাদের ভাগ্য ফেরানোর সুযোগ করে দেয়। প্রথম দিকে মিশ্র সম্প্রদায় নিয়ে বিশেষ সমস্যাও ছিল না। এই সম্প্রদায়ের বর্তমান নাম অনেকগুলো নামের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে হয়েছে। প্রথমে যে সমস্ত ব্রিটিশ নাগরিক ভারতে বাস করত তাদেরই বলা হত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং ব্রিটিশ-ভারতীয়দের সংমিশ্রিত বংশধরদের বলা হত ইউরেশিয়ান। মিশ্র বংশধরদের পরবর্তীতে পরিচয় দাঁড়ায় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হিসেবে। এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে গোড়াপত্তনের পর থেকেই। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দ অবধি এই সংকর সম্প্রদায় ব্রিটিশ হিসেবেই পরিচিত হত এবং সমাজিকভাবে গ্রহণ করা হত। ভারতীয় সংবিধানের ৩৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে ভারতে বসবাসকারী বংশধর যাদের পিতৃপুরুষ ইউরোপীয় এবং মাতৃকুল ভারতীয় তাদের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শব্দবন্ধনী Government of India Act, 1935 থেকে গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ পিতৃকুল ভারতীয় হলে তাকে আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বলা যাবে না।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে-কোনও গোষ্ঠীর পরিচয় সংকটে কোনও-না-কোনও ভাবে লুকিয়ে থাকে তাদের এক বা একাধিক বিষয়ে সংখ্যালঘুত্ব। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা ধর্মীয় খ্রিস্টান সংখ্যালঘু। কিন্তু তারা ভারতীয় খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের থেকে বিশেষভাবে আলাদা, কারণ তারা ভাষা সংখ্যালঘুও। তারা কোনও ভারতীয় ভাষা গ্রহণ না করে ইংরাজিকে মাতৃভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ফলে ভাষায়ও তারা ভারতীয় কোনও বৃহৎ ভাষা বা অঞ্চলিক ভাষায় সম্পৃক্ত হতে পারেনি। এবং প্রতিবেশী ভাষাগোষ্ঠীর কাছে ভাষা-সংস্কৃতিতে অচিন থেকে গেছে। তাতে যেমন নিজেদের বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে, তেমনি ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরাজি শিক্ষায় তারা অসামান্য অবদান রাখতে পেরেছে। মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে তাদের অবদান সর্বোতভাবে স্বীকৃত। ভারতেই একমাত্র ক্যাথলিক মিশনারি পরিচালিত স্কুলের সংখ্যা ৫৪,৯৩৭টির মতো। অন্যান্য মিশনারিদের পরিচালিত স্কুল ধরলে সংখ্যাটি বড় অঙ্কে পৌঁছায়।
কিন্তু এই গোষ্ঠী কখনও ভারতীয় জনগোষ্ঠী সমূহের মধ্যে শিকড় বিস্তার করতে পারেনি। দেশীয় ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরাও মাতৃভাষা হিসেবে ইংরাজি গ্রহণ করেনি। শুধু ভাষাই নয় খাদ্য, পোশাক, সংস্কৃতিতে তারা ইউরোপীয়দের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছে, ফলে মাটির সঙ্গে শিকড়ের সংযোগ গড়ে ওঠেনি। মিশনারিরা চেয়েছিল মূলত ধর্মান্তরিত আদিবাসীরাও যেন ইউরোপীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করে — খাদ্য, পানীয়, নাম, লোকসংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে আংশিক সফল হলেও ধর্মান্তরিতরা খুব বেশি শিকড় হারায়নি। যারা হারিয়েছে তাদের জনবিচ্ছিন্নতা বেড়েছে বই কমেনি। অর্থাৎ খ্রিস্টান অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ভারতীয় ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানরা ব্যাবহারিক জীবনে আচার-আচরণে এক হতে পারেনি। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান উৎপত্তির প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম শাসনে এদেশীয়দের মধ্যে কাস্ট বিচার বা জাতপাত বিচার সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গ ছিল। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পরিচয়ের সঙ্গে শুধু ধর্মই নয়, সে শিয়া-সুন্নি কিনা বা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র কিনা তাও গণ্য হত। লুসো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে নিও-ব্রাহ্মণ খ্রিস্টান জাতীয় কিছু কাস্ট ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে তেমনটি দেখা যায়নি। এই মিশ্র প্রজাতির মানুষ কোন্ জাত বা গোত্রভুক্ত হবে তা নিয়ে দ্বিধা ছিল। যদিও তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হিন্দু-মুসলিম সমাজচ্যুত খ্রিস্টান হয়েই জন্মাত, কিন্তু খ্রিস্টানের মধ্যে ক্যাথলিক, ব্যাপটিস্ট, প্রোটেস্ট্যান্ট বা ইভানজেলিকাল ভাগগুলো তখনও সেভাবে গড়ে না ওঠায় ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার বর্ণবাদী দ্বিধা ছিলই। জাতাপাত সমস্যাও ভারতীয়দের সঙ্গে মেলামেশায় অন্তরায় ছিল। ১৮৫৭-য় সিপাহি বিদ্রোহে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সোসাইটি ইংরেজদের পক্ষে দাঁড়ায়, ফলে ইংরেজদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়ে যায়, এবং চাকরিতে সংরক্ষণ বা অগ্রাধিকার পায়। উলটো দিকে ভারতীয়দের চোখে তারা হয়ে ওঠে অবিশ্বাসী। তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরো হ্রাস পায়। তাদের পরিচয়ে ভারত বিরোধী তকমা বরাবরের জন্য লেগে যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের তীব্রতা যত বৃদ্ধি পেতে থাকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের পরিচয় সংকট তত প্রকট হতে থাকে। ব্রিটিশ ঐতিহ্য, ভাষা-সংস্কৃতির ধারক বাহক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস দলের বিপক্ষে গিয়ে বরাবর ব্রিটিশদের সঙ্গে থেকেছে।
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের অবহেলার ইতিহাস দীর্ঘ। শুধু ভারতীয়রাই অবহেলা করেনি বরঞ্চ মূল অবহেলা-বঞ্চনা এসেছিল ব্রিটিশদের পক্ষ থেকেই। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের অষ্টম অধ্যাদেশে বাংলায় ক্যালকাটার বাইরে বসবাসকারী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থার বাইরে রাখা হয়েছিল। তারা ক্যালকাটার বাইরে মুসলিম শাসন ব্যবস্থায় নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ করে এবং তাদের সামাজিক অবস্থা আরো খারাপ হয়। সমাপতন ঘটে কোম্পানি কর্তৃক মিশনারিদের ভারতে আসার অনুমতি দান। রক্ষণশীল মিশনারিরা ব্রিটিশ পুরুষদের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ভারতীয় মহিলাদের বিয়ের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতে থাকে। দেশীয় নারীদের এমনকি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নারীদের শিক্ষা, দীক্ষা, আচার, আচরণের নিম্নমান তুলে ধরতে থাকল। ইতিমধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে সুয়েজ খাল খননের ফলে ভারত-ইংল্যান্ড যাতায়াতের সময় অনেকটা কমে যায়। তখন শীতের সময় দলে দলে ব্রিটিশ যুবতিরা জাহাজ ভর্তি করে স্বামী লাভের আশায় ভারতে পাড়ি জমাতে থাকে। সে দেশের অনেক পতিতাও স্বামী আকাঙ্ক্ষী দলে ভিড়ে থাকত। ফলে শ্বেতাঙ্গ মহিলার অভাব অনেকটা মিটে গেল। মিশ্র বিয়ের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকল। মিশনারিরা মিশ্র বিয়ের ব্যাপারে সংশয়ের বাণী শোনাতে থাকে। যেমন, মিশ্র বিয়েতে ব্রিটিশদের সামাজিক, বৌদ্ধিক, বংশধরের শারীরিক গঠনের অবক্ষয় হবে। পাশাপাশি মিশনারিদের নীতি শিক্ষায় মিলিটারি ব্যারাকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নাচ গানের আসর ১৮৩০-র মধ্যে বন্ধ হয়ে আসে। ব্রিটিশ অভিজাত শ্রেণি মিশ্র বিয়ে, মিশ্র মানুষদের সামাজিককরণে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। ফলে সারা দেশেই ব্যাপক হারে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অবৈধ সন্তানের উদ্ভব হল। বিশাল সংখ্যক স্বীকৃতিহীন ব্রিটিশ-ভারতীয় নারীর সন্তান অবৈধ বলে পরিগণিত হতে থাকল। তাদের মাত্র ৫৪ শতাংশ খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষায়নে সামাজিককরণ হল বটে কিন্তু কালক্রমে মিশ্র মানুষের খ্রিস্টায়ন দ্রুত হারে কমতে থাকল। রক্ষণশীল ব্রিটিশ আধিকারিক-সৈনিকরা দেশে ফেরার আগে তাদের ভারতীয় স্ত্রী-সন্তান সান্ততিদের নিয়ে যেতে প্রায়শই অনীহা প্রকাশ করত। সামগ্রিকভাবেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকল। সরকারি সুযোগ সুবিধা সংকুচিত হয়ে আসছিল, তখন কলকাতার বিখ্যাত ইউরেশিয়ানরা ‘ইষ্ট ইন্ডিয়ান কমিটি’ গঠন করে তাদের অভিযোগের সুরাহা করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দরখাস্ত পাঠায়। সমস্যা প্রতিকারে জন উইলিয়াম রিক্কেটস-এর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮৩৩-এ আইন পাস করে ভারত সরকারকে চাকরিতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নিয়োগে বাধ্য করে। ফলশ্রুতিতে পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ, রেল, ফরেস্ট দপ্তরে চাকরিতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নিয়োগ হতে থাকল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে অফিসার ও সেনাদের পরিবারের সঙ্গে প্রচুর সংখ্যক মেয়েরা আসা শুরু করে, তখন মিশ্র বিয়ের প্রয়োজনীতা একেবারেই হ্রাস পেয়ে যায়। সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকে একাধিক আইন প্রণয়নে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের থেকে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি যেমন দূরে সরে গেল তেমনি তাদের প্রতি ভারতবাসীরাও বিরাগভাজন হল। তাদের জাত মান কুল সবেই অবনমন ঘটল।
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা বোধ হয় ইন্ডিয়ানদের থেকে ইউরোপীয়দের দ্বারাই বেশি অবহেলার শিকার। জাতপাত বিভক্ত ভারতীয় গোরা হিন্দু সমাজের মেয়েরা ইউরোপীয় বা ব্রিটিশদের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলে সমাজচ্যুত হত। হিন্দু যুবকরাও মিশ্র বিয়ে করলে সমাজে ফিরতে পারত না, এমনকি তাদের বংশধরদের জন্যও দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ থাকত। আমরা মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাহিনি কমবেশি জানি। ভারতীয়দের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বৈরী বাতাবরণ তৈরি হত। সামাজিক উদাসীনতা, অবহেলার কারণগুলো চলতেই থাকত। অন্যদিকে প্রাথমিক ভাবে মিশ্র বিবাহিতদের বা বংশধরদের ব্রিটিশ হিসেবে গ্রহণ করলেও পরবর্তীকালে তারা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিচয়ে যে গোষ্ঠী হল, তারা না-ঘরকা না-ঘাটকা। শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের আভিজাত্যের কাছে এই মিশ্র প্রজাতির মানুষেরা ছিল দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক এবং তাদের রক্তের সম্পর্ক দাঁড়ায় অপাংক্তেয় আলো আঁধারিতে। এমনকি স্বামী-স্ত্রী দুজনেই সাদা চামড়ার হলেও তাদের শ্বেতাঙ্গ সন্তান ভারতে জন্ম নিলেই ইংল্যান্ডে সমমর্যাদা পেতে অন্তরায় হত। বরঞ্চ দেশীয় অভিজাত জমিদার, জায়গিরদার, রাজা, বাদশা, নবাবরা খাতির যত্ন ভালই পেত। এই সমস্ত তাঁবেদারদের বড়ো বড়ো উপাধি দেওয়া ছিল বেনিয়া ব্রিটিশ শাসকদের একটি রাজনৈতিক চাল। ব্রিটিশ উপাধি প্রাপ্তির গল্প এখনও তাদের গর্বিত বংশধরদের মুখে মুখে প্রায়শই শোনা যায়। অন্যদিকে ধারাবাহিকভাবে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের বিভাজনরেখা ক্রমশ চওড়া হয়। শ্বেতাঙ্গ অফিসার-সৈনিকদের আবাস, ক্লাব, বিনোদন কেন্দ্র থেকে শুরু করে যৌনপল্লী পর্যন্ত ছিল আলাদা। মাইকেল ক্যারিট নামে এক ব্রিটিশ কমিউনিস্ট আই সি এস আমলার আত্মকথন ‘A Mole In The Crown’-এ শ্রেণি বিভাজনের দীর্ঘ বিবরণ পাওয়া যায়। ক্যালকাটা ক্লাবের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য শুধু ব্রিটিশ আভিজাত্য থাকলেই চলবে না, গায়ের রঙও ছিল বিবেচ্য। কলকাতায় শ্বেতাঙ্গ সাহেবদের জন্য কড়েয়া লেনে আলাদ যৌনপল্লী ছিল। প্রথম দফায় যে সব ‘ইংরেজ মেমসাহেব’ এদেশে এসেছিল তাদের কাজই ছিল বাড়ি থেকে দেশি ‘বিবি’-দের বিতাড়ন করা। শ্বেতাঙ্গ মহিলারা আসার আগে ইংরেজ পুরুষদের সঙ্গে ভারতীয় নারীরা স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করত, বিয়ে থা হত। পরে অনেক ‘বিবি’ই বাধ্য হয় যৌন ব্যবসায় নাম লেখাতে। তাদের গর্ভে জন্মানো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা অধিকাংশই সামাজিক স্বীকৃতি পায়নি। ইংল্যান্ডে রক্ষণশীল ইংরেজ সমাজের ভয়ে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বংশধর ও ভারতীয় স্ত্রীদের এদেশে ফেলে ইংল্যান্ড চলে যায়। সামগ্রিকভাবে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও ভারতীয় নারীদের সঙ্গে ব্রিটিশ পুরুষের যৌন সম্পর্ক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক ছিল, যা অনেক ক্ষেত্রে যৌন অরাজকতায় পর্যবসিত হয়েছিল। তাদের সন্তানেরা এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সন্তানরাও স্বাভাবিকভাবে ব্রিটিশ সামাজিক স্বীকৃতি পায়নি। পরিণতিতে সামাজিক অস্থিরতা ও আত্মসংকটের ধারা প্রবাহিত হচ্ছিল গোষ্ঠী সৃষ্টিকাল থেকেই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সমস্ত মুখ্য ক্ষমতা ছিল সাদা চামড়ার আমলা, মিলিটারি, আধিকারিকদের হাতে। ভারতীয় আই সি এস-দেরও ক্ষমতায় বর্ণবৈষম্য ও অবিশ্বাসের শিকার হতে হয়েছে। আপাতত একটি ইউরোপীয় নৈতিকতার মোড়ক ছিল ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ ব্রিটিশ আমলার এদেশে আগমনের উদ্দেশ্য ছিল সুখের সাগরে অবগাহন করা এবং অর্জিত প্রভূত সঞ্চয়ে দেশে ফিরে আয়েশি অবসর যাপন। ফলে পাশ্চাত্য নৈতিকতার প্রশ্নটি ছিল স্বদেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ, পরাধীন ভারতে সেই ইংরেজ যথেচ্ছাচার করত। দুর্নীতি ছিল সর্বব্যাপী। কিন্তু ইংরেজ সমাজ অ্যাংলোদের যেন সচেতনভাবে আউট হাউসে রাখত। অন্যান্য দেশের শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরাও ইংরেজদের চোখে সমমর্যাদা সম্পন্ন ছিল না। রক্তের অবিমিশ্রতা ও আভিজাত্যের প্রশ্নে মিশনারি এবং ব্রিটিশ সমাজের নীতি পুলিশ সর্বদা সজাগ থাকত। পরোক্ষভাবে তারা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ব্রিটিশ রক্তের অধিকার প্রায়শই অস্বীকারই করত।
সর্বার্থেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের পরিচয় সংকট তীব্র হল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে। দ্বিজাতি তত্ত্বে ভারতবর্ষকে বিভাজিত করে ইংরেজ পাকাপাকিভাবে ইংল্যান্ডে ফিরে গেল। কিন্তু অল ইন্ডিয়া অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন দেশভাগের বিরোধিতা করে। তখন অবিভক্ত ভারতে প্রায় তিন লাখের মতো তাদের জনসংখ্যা। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফ্রাঙ্ক অ্যান্টোনি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সমাজে ও মিলিটারিতে তাদের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে তাদের প্রতি ব্রিটিশদের বৈষম্য ও বঞ্চনার তীব্র সমালোচনা করেছিল। তারা বেতন ও ভাতা, পদমর্যাদা সর্বক্ষেত্রেই ইংরেজদের বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তাদের ক্ষোভ ছিল যে ব্রিটিশ বংশোদ্ভূতদের সঙ্গে ব্রিটিশরাজ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। স্বাধীনতার সময় তাদের দু-কুল সংকটের দোলাচল তীব্র হয়েছিল। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য দেখাল। তারা পিতৃপুরুষের দেশে চলে যতে চাইল। তাদের অধিকাংশই ইংল্যান্ড আগে কখনও চোখে দেখেনি। তবু ইংল্যান্ড বা নিদেনপক্ষে কমনওয়েলথের কিছু দেশ হয়ে দাঁড়াল তাদের মাতৃভূমি সমতুল্য। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের কাছে ইংল্যান্ড হল ডায়াস্পোরা (Diaspora) বা স্বদেশ। সুখে থাকার আশায় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল শিক্ষিত অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ অবধি ক্রমান্বয়ে ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে পাড়ি জমিয়েছে। যারা রয়ে গেছে তারাও স্বপ্ন দেখে কোনোদিন পিতৃভূমিতে পদার্পণ করবে। যদিও ব্রিটেন তাদের প্রতি বিশেষ কোনও সৌজন্য বা আতিথেয়তা দেখায়নি। সে দেশে তাদের সামাজিক স্বীকৃতি মোটেই শ্বেতাঙ্গ পিতৃপুরুষের সমান নয়। সেখানে গেলে প্রতিপদে প্রতিনিয়ত ইন্ডিয়ানত্ব খসিয়ে ফেলতে হয় অথচ তাদের গাত্রবর্ণ কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। ইংল্যান্ডেও তারা ‘লিটল ইন্ডিয়া’র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। খোদ ইংরেজদের জাতে ওঠাও হয়ে ওঠে না কিছুতেই। যারা ভারতে রয়ে গেছে তাদের অধিকাংশের শরীর পড়ে রয়েছে ভারতে, মন পিতৃভূমি ইংল্যান্ডে কিন্তু সেখানে তাদের জন্য অভ্যর্থনা-তোরণ সাজিয়ে রাখেনি কেউ। ভারত তাদের নাগরিক হিসেবেই যোগ্য সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩৬৬(২)-এ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের যেমন সংজ্ঞা নিরুপিত হয়েছে তেমনি অনুচ্ছেদ ৩৩১ এবং ৩৩৪(বি)-তে যথাক্রমে রাষ্ট্রপতি দ্বারা লোকসাভায় দুজন ও রাজ্যপাল দ্বারা বিধান সভায় একজন করে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানকে মনোনীত সদস্য করার সংস্থান ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে দশ বছরের জন্য এই সুবিধা ছিল কিন্তু তা ২০১৯ পর্যন্ত বহাল ছিল। সংখ্যালঘু হিসেবে নিরাপত্তা সহ অন্যান্য সযোগ সুবিধার সংস্থান আছে সংবিধানে। এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পরিচালিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কৃতি অন্যান্য ভারতীয়দের মতোই প্রতিপালন করতে পারে। National Commission for SCs (Article 338) অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সাংবিধানিক ও অন্যান্য আইনি রক্ষাকবচগুলো নিরীক্ষণ ও সুনিশ্চিত করে। এবং তাদের কাজকর্ম সম্বন্ধে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করে। এতদ্সত্ত্বেও তাদের হৃদয়ে দেশ প্রশ্নে নিত্য দিনের হাহাকার। অ্যাংলোদের মধ্যে সব সময়ই ভারতীয় সত্তার চেয়ে অ্যাংলো সত্তা প্রকট। বিদেশে গিয়ে তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইন্ডিয়ান সত্তা ভুলে যেতে চায়। লুকাতে চায় গায়ের রং এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গাত্রবর্ণ কী হবে তা নিয়ে সব সময় উৎকণ্ঠিত থাকে। স্বাভাবিকভাবে সেই সব দেশে ক্রমশ তাদের ইন্ডিয়ান সত্তা লীন হয়ে যাচ্ছে। খাদ্য, পানীয় সব কিছু থেকেই ইন্ডিয়ানত্ব ঘুচাতে তারা মরিয়া।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও ভারতে বসবাসকারী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের আত্মপরিচয়ের সংকট পুরোপুরি কাটেনি। অথচ ভারতে কিংবা বাহির বিশ্বে তাদের সফলতা কম নয়। শিল্প-সাহিত্য-মিউজিকে তাদের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। রাস্কিন বন্ড (লেখক), রুডিয়ার্ড কিপলিং (নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক), জোয়ানা লামলি (অভিনেত্রী), নর্মান প্রিচার্ড (মেডেল জয়ী অলিম্পিয়ান)-র মতো অসংখ্য সফল মানুষ উঠে এসেছে এই মিশ্র সম্প্রদায় থেকে। মাউরিক বার্কার ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে প্রথম এয়ার মার্শাল, এ পর্যন্ত সাত জন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ওই পদ অলংকৃত করেছে। জর্জ ফার্নান্ডেজ-এর মতো বহু প্রভাবশালী নেতা মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে সফল কলকাতার ওব্রায়েন পরিবারের কথা সবাই জানে। ভাষা ভিত্তিক সংখ্যালঘু এই সম্প্রদায়টির দেশ গঠনে অবদান বিশাল। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্য থেকে ভারতীয় সমাজে যেমন একটি অভিজাত শ্রেণি উঠে এসেছে তেমনি বড়ো একটা অংশ এখনও গরিব এবং নিম্নবিত্ত। কলকাতার পরিত্যক্ত বিপজ্জনক বো ব্রাকে বসবাসকারী গরিব দুঃস্থদের সংখ্যা বরঞ্চ সারা দেশে অনেক বেশি। তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় শুধু বড়ো দিনে এবং ইংরাজি নববর্ষে। ইদানীং এই গরিব অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে কিছুটা দেশি হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। মাতৃভাষা ইংরাজির সঙ্গে হিন্দি, বাংলাতেও তারা কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। আঞ্চলিক ভাষা জানার ফলে কাজ কর্ম পেতে সুবিধা হচ্ছে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই সম্প্রদায়ের প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশের ঢাকা, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান প্রায় দুই লক্ষ (২০১৬), যা এই উপমহাদেশের মধ্যে সব চেয়ে বেশি। ভারতে বর্তমানে আছে দেড় লক্ষের কাছাকাছি। উপমহাদেশের অন্য একটি দেশ পাকিস্তানে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার কারণে তাদের সদস্য সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়ে নিঃশেষ হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। এই মানুষগুলি আজকাল কিছুটা অন্যান্যদের সঙ্গে বিয়ে থার সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। ফলে রক্ত এবং সংস্কৃতিতে ধারাবহিকভাবে ধূসর হয়ে আসছে অ্যাংলো সত্তা।
সারা পৃথিবীতে খোপে খোপে আটকে আছে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তারা কেউ জনজাতি, অন্য দেশ থেকে বিতাড়িত জনগোষ্ঠী, অভিবাসী জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী অথবা এমন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতো মিশ্র রক্তের মানুষ। তেলে জলে খাপ না খাওয়ার মতো তাদের সত্তা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে আছে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে Nathan Glazer & Daniel P. Moynihan তাঁদের বিখ্যাত বই ‘Beyond The Melting Pot’-এ দেখিয়েছেন আমেরিকান সমাজে কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, পুয়েরতোরিকান, ইতালিয়ান, ইহুদি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী আলাদা আলাদা সত্তা নিয়ে বিরাজ করছে। ঔপনিবেশিক শাসনে দেশে দেশে সৃষ্টি হয়েছে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান, মেতিস, বুরঘের, স্পানিশ ফিলিপিনো, মেস্তিযো, লুসো-এশিয়ান-এর মতো কত মিশ্র জাতির সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। তারা খুঁজে চলছে তাদের পিতৃপুরুষের দেশ, যা তাদের বাস্তব দেশ নয়। ইহুদিরা যেখানেই জন্মাক না কেন তাদের মাতৃভূমি বা দেশ ডায়াস্পোরা হল ইজরায়েল। তেমনি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের কল্পদেশ হল ব্রিটেন কিন্তু সে দেশটি তারা কিছুতেই খুঁজে পায় না। পেলেও সত্তায় মেলে না সে দেশের জলবায়ু, মানুষের সঙ্গে। শারীরিক মানসিক দ্বন্দ্বে পরিচয়হীন বিশ্বপথিক মানুষগুলো কিছুতেই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। কেবলই তাদের মাথায় বেজে চলে শূন্যপথে হাঁটার গান —
“…আমরা ঘুরে বেড়াই যেন অন্য পথিকের বেশ
কোথাও ফিরি না আর
শব্দের গড়া অচিন আমাদের আছে একটি দেশ…”
(‘ছায়ার ঘর’, নির্বাচিত গল্প, সসীমকুমার বাড়ৈ)