চিত্রিতা বসু
পরিচিতির বিস্তৃত অভিধার কেন্দ্রবিন্দু হল ‘আত্ম’ বা ‘Self’। আধার কার্ড-ভোটার কার্ডের অগুনতি পরিচিতি-সংখ্যা আমাদের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয় সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, পুঁজিপ্রধান পরিপার্শ্বের দর্পণ ব্যক্তিকে যেভাবে প্রতিফলিত করে, বা যে দাঁড়িপাল্লায় তার পরিচয় নির্ধারিত হয়, আমাদের আন্তর্বায়োমেট্রিকও কি একই কথা বলে? বিজ্ঞান বা দর্শন বিভিন্ন ছাঁচে মানুষের অন্তর্গঠন পর্যালোচনা করেছে, কিন্তু যদি অনধিগম্য আঁতের অভিজ্ঞান সংগ্রহ করতে হয় তাহলে আগ্রহী পাঠককে বসতে হয় কবিতার অন্ধকারের পাশে। কারণ সাহিত্যের যে সংরূপে রচয়িতা তাঁর আত্মগত ক্ষয়কে অক্ষয় করে তুলতে পারেন, তাই কবিতা। অথচ, সেই নির্মাণটি জন্ম নেওয়ার অব্যবহিত পরই কবির আত্মঘোষণা নৈর্ব্যক্তিক হয় ওঠে। কবিতার বই খুলে পাঠক পড়তে থাকে তার নিজস্ব হৃদয়-প্রতিফলন।
১
ডাফনা ওয়সারম্যান পরিচিতির বাহ্যিক অবয়বটিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এইভাবে : ‘Identities are the traits and characteristics, social relations, roles, and social group memberships that define who one is.’[১] ‘পরিচয়’ বা ‘Identity’ হল একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নির্মাণ, যা ব্যক্তিকে কোনও বিশিষ্টতায় সংজ্ঞায়িত করে। লিঙ্গ, বয়স, ভাষা, ধর্ম, পেশা, অর্থ, শিক্ষা, জাতি ইত্যাদি অসংখ্য সামাজিক খোপ তথা স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে নিজেকে বসিয়ে নিয়ে মানুষ একাধিক পরিচয় পেয়ে থাকে। ওয়সারম্যান আরো বলছেন, কোনও মানুষ আগে যা করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে, বর্তমানে যা করছে এবং ভবিষ্যতে যা করবে বলে স্থির করেছে — এই সবই ব্যক্তির পরিচয় নির্দেশ করতে পারে। সময় এবং পারিপার্শ্বিকতার ফ্রেমে কারোর আদর্শ, চাহিদা এবং নির্বাচন এক ধরনের পরিচিতি দান করে। তাই এই বিষয়টি প্রয়োজন এবং সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ত পরিবর্তনশীল।
দার্শনিক জন লক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে প্রত্যেক মানুষের সহজাত অধিকার এবং স্বাধীন স্বতন্ত্র অস্তিত্বের সপক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। চিন্তন এবং চিন্তাশীল সত্তা সম্বন্ধে সচেতনতার কারণেই সমাজ-নির্দিষ্ট পরিচিতির সংজ্ঞা থেকে মানুষ মূলগতভাবে আলাদা। বাহ্যিক জগতের কাঠামো মানুষের অন্তর্গত ‘self’-কে অর্থপূর্ণ তাৎপর্য দান করে ঠিকই কিন্তু ব্যক্তির সামাজিক অভিধা এবং স্বগত অভিধার মাঝখানে একটি প্রবেশক দরজা থাকে যা পার করে এসে ব্যক্তিমানস সামাজিক মানুষ হয়ে ওঠে। তাই অন্তর্লোকের পরিচিতির নিয়ম কানুনের ক্ষেত্রে আত্ম-সমীক্ষণের লেন্সই শেষ কথা বলে। দর্শন এবং মনোবিজ্ঞানে ‘আত্ম’ বা সেলফ-কে মূলত একটি মানসিক নির্মাণ হিসেবে দেখা হয়েছে। এরিকসন ‘আত্মপরিচয়’-এর একটি সুসংহত ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক :
‘Identity formation employs a process of simultaneous reflection and observation, taking place on all levels of mental functioning, by which the individual judges himself in light of what he perceives to be the way in which others judge him in comparison to themselves and to a typology significant to them; while he judges their way of judging him in light of how he perceives himself in comparison to them and to types that have become relevant to him.’[২]
অর্থাৎ, আত্মপরিচিতির প্রধান দিক হল নিজের সম্পর্কে সম্যক ধারণা। আমাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতার সারবস্তু প্রত্যাশা-হতাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, প্রেম-অপ্রেম, নীতি-অনীতি এই বাইনারিগুলো তৈরি করে, যেগুলো ব্যক্তিত্বের অন্যতম স্তম্ভ। সহজাত স্বভাব-বৈশিষ্ট্য মানুষের প্রবণতার জন্য দায়ী, কিন্তু ব্যক্তির ‘আমিত্ব’ যুগপৎ গঠন ও প্রকাশিত হয় বহির্জগতের সঙ্গে তুল্যতামূলক আদান প্রদানের মধ্যে দিয়েই।
মহাকাব্যের বিশালতা ও আড়ম্বর ত্যাগ করে সংহত শরীর পাওয়ার পর কবিতা অনেকাংশে আত্ম-ঘনিষ্ঠ হয়েছে। মন্ময় বা বিষয়ীগত (Subjective) পদ্য, ব্যক্তিগত ভাবানুভূতি যেখানে উপজীব্য তাকে কবিতা হয়ে ওঠার জন্য নিশ্চিতভাবেই ব্যক্তি ও সমষ্টির অসেতুসম্ভব দূরত্ব পার করে সর্বজনীন হয়ে উঠতে হয়। কবির আত্ম-পরিচয় তথা ‘self-identity’ তাঁর সৃষ্ট পাঠকৃতিতে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার সংকীর্ণতা অতিক্রম করে শিল্পপাঠের অনিবার্য শর্তেই পাঠকের স্বানুভবকে স্পর্শ করে।
বাংলা কাব্যসাহিত্যের ধারাস্রোতে কবির আত্মপ্রকাশের একেবারে প্রাথমিক সিঁড়ি ছিল ‘ভণিতা’। প্রাচীন ও মধ্যযুগের তন্ময় কাব্যসাহিত্যে দেবস্তুতি, দেবোপম শাসকের অপার করুণার প্রশস্তির পর নেহাতই গুরুত্বহীন গৌণ ছাপোষা কবির নাম-ধাম-বংশপরিচয় ক্বচিৎ-কদাচিৎ লাভ করেছি। অনেক ক্ষেত্রে আবার সবটাই হেঁয়ালির আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আসলে ব্যক্তি পরিচয়ের থেকেও সামাজিক রাজনৈতিক পরিচয়টাই সামন্ততান্ত্রিক যুগে অধিক প্রকাশ্য ছিল। সাহিত্য রচনাই হত রাজা বা সামন্তপ্রভুর অর্থান্যকূল্যে, তাদের মনোতুষ্টির উদ্দেশ্যে। স্বকীয় প্রেরণার তাগিদ থেকে শিল্প সৃষ্টির অনধীন পরিসর সেকালে ছিল বলে মনে হয় না। ফলত পোশাক-আশাকের ব্র্যাণ্ডট্যাগের অতি ক্ষুদ্র তথ্যের মতোই কবির স্ব-পরিচয় তথা ‘ভণিতা’ কাব্যের বিপুল বপুর এক কোনায় লেগে থাকত। সময়ের দীর্ঘ পথ পার করে কাব্য সাহিত্য খোলনলচে বদলেছে। বিহারীলাল চক্রবর্তীর সময় থেকেই কবিতায় যে আত্মমুখীনতার জার্নি শুরু হয়েছে, রবীন্দ্রকবিতায় তার ক্রমপরিণত রূপ দেখতে পাওয়া যায়, আবার বাংলা কবিতার সামূহিক পরিবর্তন ঘটেছে তিনের দশকে — কবিতার এই ধারা বিবর্তনের ইতিহাস খুবই আলোচিত বিষয়, যার পুনরুল্লেখ বাহুল্যমাত্র। কিন্তু পঞ্চাশ এবং তার পরবর্তী সময়ের কবিতায় ‘আমিত্ব’ বা ‘আত্মপরিচয়’-এর পরিধি ঈশ্বরচেতনা, আস্তিক্যবাদ এবং প্রেম-বিরহ-শোক — এই কয়েকটি বহুচর্বিত বিষয়কে আত্মস্থ করে চেতনা এবং ইন্দ্রিয়াতীত অবচেতনের সুররিয়াল অলিগলি ঘুরে আসতে শুরু করল। এর প্রেক্ষাপটে ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ তত্ত্ব, প্রতীকবাদ, ইমেজিজম, পরাবাস্তববাদী দর্শন এবং ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব নিশ্চিতভাবেই কাজ করেছে, কিন্তু কোথাও তত্ত্বলব্ধ জ্ঞানের আরোপিত প্রয়োগ দেখা যায়নি। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের ঐতিহ্যকে কবিতার আত্মায় রেখে, বিষয়গত পুনরুক্তি ঘটিয়েও বাংলা আধুনিক কবিতা প্রকৃতিগত প্রবৃত্তি, আত্মসচেতনতা, আত্মসংকট, ইন্দ্রিয়ানুগত উপলব্ধির বহু মাত্রা শব্দের ফোকাসে এনেছে। ভাবের আবেশ বা অতিলৌকিক কল্পলোকের অবিশ্বাস্য জগৎ নয়, জীবনের ইতিউতি অভিজ্ঞতা অবচেতনের নির্জনতায় যে স্বর-তরঙ্গ তোলে, সেই শরীরহীন অনুভব নিরালোক অন্তর্জগৎ থেকে উঠে এসেছে। আধুনিক কবিতার এই আত্মবিশ্লেষণী দিকটি নির্বাচিত কিছু কবিতার পরাপাঠের মাধ্যমে স্পর্শ করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
২
গভীর ক্লান্তির ধূসর দিগন্তে অপেক্ষমান মানুষের অবলম্বন হয়ে উঠতে পারে জাগতিক কোনও মানুষ। কিন্তু তারও আগে যে অবয়বহীন হাত মানুষের পাশে দাঁড়ায় তা সম্ভবত ব্যক্তির অন্তর্নিহিত নির্বেদ পুরুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় যে পুরুষ ঔপনিষদিক আদর্শের সংযুক্তির কারণে ‘জীবনদেবতা’ অভিধা পেয়েছেন। সেই পুরুষ যেন অন্তরে বসে কবিকে জীবনলীলায় নানা ভূমিকায় অভিনয় করিয়ে চলেছেন। এক্ষেত্রে ‘পুরুষ’ লিঙ্গ-বাচক শব্দ নয় বলাই বাহুল্য। নারী-পুরুষ দুই রূপেই এর ছায়া বিভিন্ন কবিতায় আমরা দেখতে পাই, যেমন :
১। ‘ওহে অন্তরতম মিটেছে কি তব সকল তিয়াষ আসি অন্তরে মম’ (‘জীবনদেবতা’, কাব্যগ্রন্থ : চিত্রা)
২। ‘দুয়ারে বাহিরে যেমনি চাহি রে মনে হল যেন চিনি — কবে, নিরূপমা, ওগো প্রিয়তমা, ছিলে লীলাসঙ্গিনী?’ (‘লীলাসঙ্গিনী’, কাব্যগ্রন্থ : পূরবী)
উপনিষদ এবং পারিবারিক ঐশীবোধের প্রভাবে রবীন্দ্র-কবিতা তথাকথিত আস্তিক্য ভাবধারার প্রচারক হয়ে উঠেছে। কিন্তু দ্বৈত সত্তার বৃহত্তর সত্তাটি কেবল আধ্যাত্মিক বা প্রেমজ প্রেরণা — এমনটা মনে হয় না, বরং চেতনার দ্বিবিধ স্বতন্ত্র মুখ, আত্মমোক্ষণের অবলম্বন। পঞ্চাশ পরবর্তী কবিতায় যে আত্মপ্রতিফলন বা আত্মপ্রক্ষেপণ চোখে পড়ে তার ভাষিক নির্মাণ, বিষয় বা আমেজগত দিকগুলো রবীন্দ্র-অনুগমন করে না ঠিকই, কিন্তু আত্মগত সংলাপের কবিতান্তর্ভুক্তি রবীন্দ্রকবিতায় যেভাবে ঘটেছে, পঞ্চাশ পরবর্তী কবিরা নিশ্চিতভাবেই সেই উত্তরাধিকার গ্রহণ করেছেন এবং চিন্তনের জটিল পাকদণ্ডির শাব্দিক রূপ দিয়েছেন। যেমন শঙ্খ ঘোষের ‘সত্তা’ কবিতাটিতে দেখতে পাই, না-মানবী, না-অলৌকিক এক চলিষ্ণু মানুষ, নৈঃশব্দ্যের প্রহরীর মতো আলো জ্বেলে এগিয়ে যেতে থাকে। ‘স্মরণ, বিস্মরণতার ঊর্ধ্বে’ অনুভূতি-নিরপেক্ষ এর অবস্থান সব সময় মানুষের চিন্তনশীলতা জানান দেয়, নিশ্চিত করে অস্তিত্বের বোধ। এটাই ব্যক্তির ‘Self’ তথা ‘অহং’। সে মনের ভেতর-ঘরে দৃশ্যমান, খুব ধীর বা স্থিতধী নয়, কখনও ছিন্নমূল কখনও বা ভরসাহীনা :
‘তবে কে ও? তবে কে ও? কোথায় চলেছে ও অর্ধরাতে অন্ধকারে অবিশ্বাসিনী? শব্দগুলি অন্ধকার, নীরব, নিঃশ্রেয় — এখনও না, আমি সীমার প্রান্তে আসিনি…।
…
কিন্তু কেন? নিঃস্ব পদ্ম টানে প্রবল টানে ভেসে কোথায় যেতে কোথায় ডাকে কে গো কে গো — এ যদি হয় সত্তা তবে অস্তিত্বের মানে থাকা, কেবল থাকা, তুমি বিশ্বগোচর থেকো।’[৩]
‘আমি আছি’ এই বিশ্বাসটি মননের নিভৃততম প্রকোষ্ঠে থাকলেও বেশ সোচ্চারে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। আবার ‘আমি নাও থাকতে পারি’ এই সংকটটিও অনুচ্চার থাকে না।
জন্মের পর কেবল একটিমাত্র অভ্যাস যেটি সমস্ত প্রতিবর্ত ক্রিয়া সমেত আমৃত্যু অটুট থাকে, তা হল বেঁচে থাকা। সংবেদনশীল মানুষের কাছে বেঁচে থাকার অর্থ প্রাত্যহিক দিনক্ষয় নয়, ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যতা নিয়ে জেগে থাকা, উপলব্ধির ক্যাকটাসে বসে অন্তর্ভুবনের অসংখ্য ছোটো বড়ো সুনামি নিশ্চলভাবে গ্রহণ করা। এর বিপ্রতীপে ‘মৃত্যু’ যা এক অর্থে হিম শীতল সমাপ্তি অন্যদিকে সত্যের মতো অনস্বীকার্য নিশ্ছিদ্র বিশ্রাম, যার স্বাদ নদীর ওপরিতলে ঘন তমিস্রার মতো নীরব, স্থির। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার তাঁর ‘Being and Time’ গ্রন্থে অস্তিত্বকেন্দ্রিক দুই রকম বোধের কথা বলছেন :
‘One of forgetfulness of being (a limited awareness of the true nature of existential ultimate concerns including death) and one of mindfulness of being (full awareness of the immense of death and ultimate existential concerns) which is described as authentic.’[৪]
হাইডেগার কথিত ‘authenticity’ বা অস্তিত্বের অনিত্যতার প্রতীতী আত্মস্থ করে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা বিভিন্ন কবির কবিতাতে ঘুরে ফিরে এসেছে। কবিতায় জীবন ও মৃত্যুর ঘনিষ্ঠ অনুক্রম, কেবল অস্তিত্বের স্থায়িতা এবং অস্থায়িতার বাইনারিতে সীমিত নেই, অনর্গল অতিবাহনের মনোটোনাস শ্রমসহ অস্তিত্বের নানাবিধ বাক্যাতীত অনুভব শব্দে বোনা হয়েছে, যা দর্শনের সীমারেখার অতীত। যেমন আলোক সরকারের ‘মৃত্যুভূমি’ কবিতাটিতে দেখি জেগে থাকা তথা বেঁচে থাকায় অভ্যস্ত পা বারবার ডুবে যায় নদীতটের চোরাবালিতে। কিন্তু পা তুলে আবারও কবি হাঁটতে থাকেন অনিত্য মৃত্যুসংকুল পথে। বেঁচে থাকার সংবিৎ মনের অবতমসে নারকেল-বট-অশ্বত্থের একাকী দাঁড়িয়ে থাকার ক্লান্তি ও নিমগ্নতা নিয়ে আসে :
‘…যা কিছু হিম জেগে-থাকা তাই কি গহন বিদেশি মাঠ, গোধূলিমেঘ। টেনে তুলি পা ফেলতেই আবার ডুবল পা। ভারি ঠাণ্ডা! এতো ভালো লাগছে যেন ভয় করছে শিরশিরিয়ে উঠছে সারা শরীর’[৫]
যাত্রার শেষটা দূর অজানিত দেশের অজ্ঞেয় রহস্যে আবৃত। ঠিক কোথায় গিয়ে যে থেমে যেতে হবে তারও ঠিকানা নেই। অন্তহীন চলন যে শেষমেশ কী তাৎপর্যে পৌঁছে দিতে চায় অনিশ্চিত সেই উত্তরটিও। যদি গ্রীষ্মের তাপের মতো মৃত্যু এসে পায়ের কাছে ছায়া ফেলে তাহলেও নিরুদ্বেগ থেকে যেতে হবে — এটাই ধ্রুব সত্য। মৃত্যু সম্পর্কে অজ্ঞানতা বাস্তব জীবনের পক্ষে অসম্ভব, নিজ অস্তিত্বের ধ্বংস সম্ভব — এই ধারণাটিকে বিস্মৃত হওয়ার একটি উপাদানস্বরূপ ধর্মকেন্দ্রিক কিছু লৌকিক বিশ্বাসে আত্মার বহুজন্মের কথা বলা হয়। আত্মবিনষ্টির সত্যটিকে গ্রহণ করার থেকে আত্মার রূপান্তরের কাহিনিটি অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক। কিন্তু যুক্তি শৃঙ্খলে আবদ্ধ আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মন রূপকথার কল্পলোক থেকে বেরিয়ে এসে স্বনির্ভর হয়েছে। উৎপল কুমার বসুর ‘হাঁস চলার পথ’ কাব্যগ্রন্থের ১১ সংখ্যক কবিতায় দেখি মৃত্যু তথা অস্তিত্বের সমাপ্তি অগ্রাহ্য করে সোচ্চার আত্মঘোষণা :
‘বড়ো ভুল হয়ে গেছে, হায় সখা, দু’হাতের রেখা বুঝে ফেলে অন্যায় হয়ে গেছে। এবার তাহলে কী করা? কী জন্য প্রস্তুত হচ্ছ — এই প্রশ্নটুকু আমি তো নিশ্চয় তোমাকে করতে পারি। তোমাদেরও। উত্তর দেবে কি দেবে না সে তো স্বধর্ম নির্ণয় করে। বহু মিষ্টতার কথা মনে পড়ে।
……
আমি শুধু ব্যক্তি বিশেষের কথা বলি — তাঁর অধৈর্যের চিৎকার লিপিবদ্ধ করে যাই।’[৬]
অনতিক্রম্য সত্যকে অস্বীকার না করেও জীবন থেকে মৃত্যুর উত্তরণটিকে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। যাপনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাবি জুড়ে জুড়েই তৈরি হয় সামগ্রিক জীবন, প্রতিটি দিনই অর্থপূর্ণ হওয়ার আবেদন নিয়ে আসে, প্রয়োজন সংকুলানের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার যে তাৎপর্য পাওয়া যায় তা জীবনধারণের একপ্রকার আশ্রয়ও বটে। অনতিক্রম্য সত্যকে অস্বীকার না করেও জীবন থেকে মৃত্যুর উত্তরণটিকে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। আত্মসচেতনতা এবং নির্বিৎ দৃষ্টিকোণ যুগ্মভাবে মানুষকে এই বিষয়ে আমরণ বেঁচে থাকার প্রেরণা দিয়ে চলে।
৩
সভ্য সমাজের প্রোটোকলের বাইরে ইচ্ছা, অনিচ্ছা, ঈর্ষা, ভয়, যৌনতার মতো অসংখ্য হিসেব বহির্ভূত প্রবৃত্তি জমা হয়ে থাকে ইদ স্তরে। এ সমস্তই সুপার ইগোর সুদৃশ্য আস্তিনের অন্তরালে ক্রমাগত পিছিয়ে কোণঠাসা হতে থাকে, যাদের টুকরো-টাকরা খবর সচেতন মন কেবল মাত্র স্বপ্ন বা বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে পেয়ে থাকি। আল মাহমুদের ‘বিষয়ী দর্পণে আমি’ কবিতাটিতে নিজের দাঁত নখ বের করা প্রবৃত্তিকে প্রতিবিম্বিত হতে দেখতে পাই। অনির্দিষ্ট ক্রোধ স্বভাবত বহুগামী, যে-কোনও সুন্দর-অসুন্দর, ন্যায়-অন্যায়ের অপেক্ষা করে না। যা কিছু একসময় ভালোবেসেছিল, বিধ্বংসী ঘূর্ণঝড়ের মতো সেসব ছিঁড়ে উপড়ে নিতে চায়। পশুর খোলস দেহ থেকে খুলে নিতে চাইলেও, এই অশুভ প্রবৃত্তির পৌনঃপুনিক প্রত্যাবর্তন এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সেই সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা তো বটেই, আত্মভর্ৎসনাও বিফল হয়ে যায়। গভীর বিস্ময়ে নিজেকেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে এই পাশবিক তাড়না কি স্বভাবজ নাকি মুহূর্তের দুর্বলতা? কিছু সময় পর রক্ত শীতল হয়ে এলে আত্মগ্লানির বিষ অন্তঃকরণকে বিদ্ধ করতে থাকে :
‘ক’বার তাড়িয়ে দিই, কিন্তু ঠিক নির্ভুল রীতিতে আবার সে ফিরে আসে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরে তার সেই মুখখানি কুটিল আয়না হয়ে যায় নিজেকে বিম্বিত দেখি যেন সেই মুহুর্তমুকুরে’[৭]
শিশুর সারল্য প্রশ্নাতীত, কিন্তু শিশুর কর্মকাণ্ডের দুর্বোধ্যতাও অস্বীকার্য নয়। শৈশবে অনেকেই খেলার ছলে জীবিত প্রাণীকে আঘাত করে, ফড়িং, প্রজাপতি প্রভৃতি কীটপতঙ্গের ডানা ছিঁড়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে মৃত্যুর দৃশ্য। খেলার বয়স ফুরিয়ে আসার পর প্রাণের মূল্য বুঝতে পারলেও ছদ্মরূপে আমাদের ভেতর নিহিত থেকে যায় অনন্ত শৈশব, সরলতা এবং স্বেচ্ছাচারিতার মিশ্র রূপ, যে কারণে অ্যাকশনধর্মী ছবির চাহিদা এত বেশি। অপরকে যন্ত্রণা দেওয়া বা কেউ যন্ত্রণা পাচ্ছে — এমন দৃশ্য দেখা আনন্দ অথবা সহমর্মিতার জন্ম দেয়। সচেতন কবি সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন:
‘কখনো অসৎ থাবা অকস্মাৎ উত্তোলিত হলে দেখি সেই বিম্বিত পশুর দর্পিত হিংস্র চোখ আমাকেই লক্ষ্য করে জ্বলে চিবুক লেহন করে, সে অলীক মুহূর্তের ক্রোধ জয় করে দেখি আমি, কেবলই আমার মধ্যে যেন এক শিশু আর পশুর বিরোধ’ [৮]
নিজের ভেতর স্যাডিস্ট শেডটি তীক্ষ্ণতর হয়ে ওঠে, আঘাত নামিয়ে আনতে চায়। কিন্তু এইরকম অসহনীয় চিত্তবিক্ষোভে কোনও বাহ্যিক উপকরণ নয়, মানুষ নিজেকেই স্থির বিন্যাসে নিবিড় করে বাঁধতে চায়। নৈর্ব্যক্তিক নিরাবয়ব দুই হাত মায়ের মতো বা প্রিয়ার মতো, আত্মপীড়নের বেত্রাঘাত থেকে মোমসদৃশ vulnerable সত্তাকে রক্ষা করে। এই আত্মশুশ্রূষা একপ্রকার ডিফেন্স মেকানিজম বলা যেতে পারে। মৃদুল দাশগুপ্তের ‘ভ্রমর স্মরণে এলে’ কবিতাটিতে দেখতে পাই যন্ত্রণাবিদ্ধ আত্মপ্রতিফলন, যেখানে প্রতিফলক ব্যক্তির অবচেতন নিজেই। আত্মশুশ্রূষায় উদ্যত মুখর ভ্রমর, যা মগ্নতার প্রায়ান্ধকার থেকে আলোর দিকে ছুটে আসে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া সারবে বলে :
‘নিজের ছায়ার সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে আমি অজস্র আঘাতে এখন কল্পনা করি দুটি হাত, তারা যেন শূন্য থেকে নেমে আমার মস্তকে বসে কিছুক্ষণ। ভ্রমর, স্মরণে এলে, এইভাবে। সম্ভাষণে যেন বলি, এখনই সময়, আমার শুশ্রূষা করো, অনিদ্রা সারাও।’[৯]
আত্মমন্থন করে উঠে আসে অশাব্দিক সংলাপ। অভিজ্ঞতার ক্লেদাক্ত সঞ্চয় এবং আত্মদংশনের বিষ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়িয়ে তোলে সন্তাপ। তবে অবচেতনে হাহাকার বা আর্তির প্রকাশ নেই, আছে কেবল ব্যক্তির বিগত দিনের ভ্রান্তির নীরব অতীত-ভারাতুর স্মৃতিচারণা। এই চিন্তাস্রোত থেকে ধীরে ধীরে নিজের কাছেই আত্ম-উন্মোচন ঘটে, কবিতা হয়ে ওঠে এই অন্তর্নিহিত কথপোকথনের প্রকাশস্থল।
৪
মানব-পৃথিবীর মননগত দৈন্য এবং যান্ত্রিকতা অনুভূতিপ্রবণ সত্তাকে আঘাত করে এসেছে, দশকের পর দশক অতিবাহিত হয়, কিন্তু ইতিহাস, অবক্ষয়ের ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্যুত হয় না। কাজেই বহির্মুখী বস্তুনিষ্ঠ চেতনার সঙ্গে বিরোধ বাঁধে অন্তর্মুখী মগ্নচৈতন্যের। ‘সকল লোকের মাঝে বসে / আমার নিজের মুদ্রাদোষে / আমি একা হতেছি আলাদা’ জীবনানন্দের এই স্বীকারোক্তি দৃশ্যত সহজ বটে, কিন্তু নিজের ভেতরে এই সঙ্গতিহীনতার বোধ নিয়ে বেঁচে থাকা খুব একটা সহজসাধ্য নয়। কারণ বিচ্ছিন্নতার বোধ কেবল সমাজ থেকেই বিচ্যুত করে এমন নয় ব্যক্তির সেলফ-ও ক্রমাগত অন্তর্মুখী হতে থাকে। ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘জিরাফের ভাষা’ কাব্যগ্রন্থের ১৮ সংখ্যক কবিতাটিতে দেখি ভিড়ের আঁশটে গন্ধ থেকে বাঁচতে অবচেতন একা হতে চাইছে :
‘রেখেছি আত্মার জন্যে সুসজ্জিত সামান্যই মাছ মাংস কিছু। অনিদ্রার এলাকায় আজ একা হেঁটে পৌঁছে গেছি আমি তো বলি না শুধু : নিঃসঙ্গতা, এই বিষবৃত্ত থেকে, বুঝি শুধু বেরোতে হবেই — তোমার জীবন থেকে মিনিট দশেক তুমি আমাকে দেবে কি?’[১০]
কবি চিৎকারবিমুখ, মানববিমুখ নন। অসংখ্য ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে পরিশ্রান্ত চেতনার দীর্ঘ শীতঘুমের প্রয়োজন পড়ে, কারণ ‘যেখানে পায়ের ছাপ পড়ে দেখি সেখানেই রক্ত ফুটে ওঠে’। মনোবিজ্ঞানে ‘theory of alienation’-কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এইভাবে :
‘It is assumed that an individual’s alienation develops within the context of an ongoing relationship between himself and some other entity—a person, group, society, or culture, for instance. The experience of alienation is brought about through a decline in the quality of one’s relationship with a particular context, and this perceived deterioration evokes dissatisfaction with the present situation and a yearning for something better which has been either lost or as yet unattained.’[১১]
সুতরাং, বিচ্ছিন্নতা বা এলিয়েনেশনের অনুভব পরিপার্শ্ব এবং নিজের সম্পর্কে যে অব্যক্ত অসন্তোষ তৈরি করে তার ফলস্বরূপ আসে বিকল্প রাস্তার সন্ধান, যে পথে অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে সাময়িক অবকাশ মিলতে পারে। জীবনানন্দ থেকে শুরু করে আধুনিক কবিদের কবিতায় দেখি এই বিকল্প বারবার ‘জ্বর’, ‘ঘুম’ বা ‘মৃত্যু’-এর রূপক লাভ করেছে। ঘুম এবং মৃত্যু সমার্থক না হলেও দুটিই মানব ঘনিষ্ঠ পৃথিবীর থেকে সাময়িক বা সম্পূর্ণ বিচ্যুতির নামান্তর। ভাস্কর চক্রবর্তীরই অন্য আরেকটি কবিতায় দেখি :
‘এখন বিকেল; জ্বর একশো দুই। ঘুমে টানছে বুজে আসছে চোখ — মনে হচ্ছে, মশাল জ্বলছে আর চারপাশে মিছিল চলেছে — আমি কি মৃত্যুর পর পৃথিবীতে জন্মালাম এসে?’[১২]
দৈনন্দিন কাজের মধ্যে থেকেও বিচ্ছিন্নতাবোধ তিক্ত কষাটে জ্বরের মতো শরীর ছাড়তে চায় না। ব্যক্তি খুব সচেতনভাবে মেধার যন্ত্রণাকে সাধারণ মানুষের মেইনস্ট্রিম থেকে বিবিক্ত করে রাখতে চাইছে — এমনটা একেবারেই নয়, বরং নিজেকে সামাজিক পরিচিতির খাপে বসাতে না পারার জন্যই এই মানসিক দহন :
‘কেন আমি এতটাই বোবা? আমার বাঁচার কথা হাত-পা ছুঁড়ে কেন আমি বলতে পারি না?’[১৩]
অনন্য রায়ের ‘আলোর অপেরা’ কাব্যনাট্যের ১৭ সংখ্যক কবিতায় দ্বন্দ্ব কণ্টকিত বাস্তবের যুগবিস্তারী অন্ধকার থেকে অবসর নিয়ে হারিয়ে যাওয়ার আর্তি উঠে আসে। একদিকে হাতছানি দেয় শস্য জনয়িতা মাটির সোঁদা গন্ধ, প্রাচীন অথচ সদাতরুণ স্বচ্ছতোয়া — ইতিহাসের সামগ্রিক ওঠাপড়ার ঘাত-প্রতিঘাতেও যে জল নির্বেদ থেকেছে বরাবর, অথবা জলপাই অরণ্যের ঘনপিনদ্ধ ছায়ার আলো-আঁধারি মাদকতা অন্যদিকে নিয়মনিষ্ঠ বহির্জগতে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে কংক্রিট ও নথিপত্রের আগ্রাসী জঞ্জালের শিকল। কাঁটা-কম্পাসে মাপা মানুষের জ্যামিতিক যাপন অবিচ্ছিন্নভাবে ব্যতিক্রমহীন সরলরেখায় চলতে থাকে। কেবলমাত্র সামাজিক প্রতিযোগিতা নয়, ব্যক্তির নিজের বস্তুসচেতন সত্তাটিই ‘অর্থ’, ‘কীর্তি’, ‘স্বচ্ছলতা’-এর অপূরণীয় চাহিদা মূলত নির্মাণ করে, তাকে ঢুকিয়ে দেয় এমন একটি রেস কোর্সে যেখানে জন্ম, জনন, প্রতিষ্ঠা এবং ব্যয়বহুল মৃত্যু — এই চারটি চেক পয়েন্ট বেঁচে থাকার মানদণ্ড হয়ে ওঠে। প্রত্যেকটা মানুষ এই সমাজে ‘মেটিরিয়াল’ ছাড়া আর কিছুই নয়, জেলখানায় যেমন কয়েদিরা সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত হয়, একইভাবে বস্তুনিষ্ঠ সমাজ প্রতিটি মানুষের বিক্রয়মূল্য ঠিক করে রাখে।
কবি যাতে অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো ছুটে যেতে পারেন, তাই পূর্ব প্রস্তুতি স্বরূপ কমলালেবুর মতো পুরু পশমি খোলসে মুড়ে নিতে চান শিশুর ভ্রূণের চেয়েও মৃত্যুপ্রবণ সত্তাকে। সদাজাগ্রত রক্তাক্ত অবচেতনকে বলেন ‘ঘুমোও তুমি, অবগুণ্ঠিত স্মৃতির মতো’। এই ‘ঘুম’ বাস্তবত এক এস্কেপ-রুট, যা একইসঙ্গে পরম প্রার্থিত অথচ অপ্রাপণীয় বা ‘unattained’। জাগ্রত চেতনাকে ছুটি দিয়ে কবির অবচেতন ফিরে যায় বিস্মৃতির অন্ধকার জর্জরিত প্রত্ন-যুগে, যেখানে ক্ষমতার দাম্ভিকতায় চিৎকৃত খিলান বা স্তম্ভগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শীতল এবং মূক হয়ে গেছে। তাজমহলের শুভ্র দেওয়াল অত্যাচারিত শিল্পীদের রক্তের ছোপ শোষণ করে নিয়ে কবেই নিরুত্তাপ হয়ে গেছে, ঘুমের ভিতরও থাকে এই উদ্বেগহীন নীরবতা। অতীত যতই সরব হোক, স্মৃতিতে তার অভিঘাত প্রায় নির্মূল হয়ে যায়। কবির কাঙ্ক্ষিত ‘ঘুম’ তথা এলিয়েনেশন বর্তমানকে আত্মস্থ করে নেবে সর্বগ্রাসী ব্ল্যাক হোলের মতো :
‘ঘুমোও তুমি, অবগুণ্ঠিত বিস্মৃতির মতো যেখান দিয়ে লাক্সনপ্রাচীন ছুটে গেছে চূর্ণ বিচূর্ণ দ্রুত ব্রহ্মাণ্ডের দিকে আর পরিদৃশ্যমান তোমার ব্রোঞ্জের বিশাল বিস্তৃত শ্বেতপাথরের খিলানের মতো তোমাকে করে দিক দীর্ঘ গোলাকার।’[১৪]
অতীত ও প্রকৃতির মধ্যে অনুরূপ স্তব্ধতা রয়েছে যেখানে দু-দণ্ডের বিশ্রাম আত্ম বা ‘Self’-এর অনুরণন ঘটায়। বোদলের-এর কবিতাতেই প্রথম এই প্রত্নপৃথিবীর শৈবালসিক্ত ঘ্রাণ অনুভব করা গিয়েছিল।তাঁর বহুপঠিত ‘Correspondences’ সনেটটির প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধার করা যেতে পারে —
‘Nature is a temple in which living pillars Sometimes give voice to confused words; Man passes there through forests of symbols Which look at him with understanding eyes. Like prolonged echoes mingling in the distance In a deep and tenebrous unity, Vast as the dark of night and as the light of day, Perfumes, sounds, and colors correspond.’[১৪]
(অনুবাদক : William Aggeler, 1954)
অরণ্যের আলো-আঁধারির বর্ণদ্বৈত, নিস্তব্ধতার ঝিম ধরানো নিস্বন ভিড়াক্রান্ত সত্তাকে সনাতন নির্জনতা ফিরিয়ে দেয়। সময় ও বাস্তবের সম্মুখীন হতে গিয়ে মানুষকে অন্তর থেকে ক্রমাগত রিক্ত হতে হয়। আত্ম অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াটি প্রাথমিকভাবে সামাজিক মূল্যায়নের ওপর নির্ভর করলেও, কিছু মানুষ স্ব-প্রবণতায় অন্তর্মুখে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়। কবিতায় চিত্রিত হয় আত্মনিমগ্ন নিঃসঙ্গতার এক পরাবাস্তব পৃথিবী।
পরিচিতির সামাজিক শর্তাবলির চাপিয়ে দেওয়া অভ্যাস থেকে যে ছায়াঘন আত্মপরিচয় সর্বদা বিচ্ছিন্ন থেকেছে তাই আমরা কবিতায় সরব হতে দেখলাম। জীবনের পরিবর্তমানতা প্রতিদিন বদলে দিচ্ছে ব্যক্তি এবং ব্যক্তিত্বের সংজ্ঞা। কৈশোর, মনের শরীর থেকে ঝরিয়ে দেয় অনুপলব্ধির ভার, কেড়ে নেয় শৈশবের ‘পক্ষীরাজ ঘোড়া’-র মতো মেঘে মেঘে নির্ভার উড়ে চলার মানসিক স্বাধীনতা। পরিবর্তে রেখে যায় কিছু প্রশ্ন যা অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের উৎস ও বিকাশের সঠিক যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা খুঁজতে চায়। কিন্তু এর উত্তর দর্শন বা বিজ্ঞান কেউই সামগ্রিকভাবে দিতে পারে না। কবিতার কোনও তাত্ত্বিক দায় নেই, কিন্তু বিশুদ্ধ অনুভবের কাছে কবিতা বিশ্বস্ত এবং ন্যায়নিষ্ঠ। তাই আধুনিক কবিতায়, ‘আমিত্ব’ এর অনালোক বৃত্ত খানিকটা হলেও চেতনার সম্মুখে এসেছে।
তথ্যসূত্র :
১। Mark R. Leary, June Price Tangney (ed.) : ‘Handbook of Self and Identity’ : London : ‘The Guilford Press’ : Page no. 69
২। Erikson, Erik H : ‘Identity : Youth and Crisis’ : New York : ‘Norton’ : 1968 : Page No. 15-25
৩। শঙ্খ ঘোষ : ‘শ্রেষ্ঠকবিতা’ : কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং : প্রথম প্রকাশ, এপ্রিল ১৯৭০ : ষোড়শ সংস্করণ, ২০১৬ : পৃষ্ঠা — ২৬
৪। Laurie Jo Moore & Mila Goldner-Vukov : ‘Psychiatria Danubina’ Vol. 21, No. 4 : ‘THE EXISTENTIAL WAY TO RECOVERY’ : Medicinska naklada – Zagreb, Croatia : 2009 : Page No. 456
৫। আলোক সরকার : ‘কাব্যসমগ্র’ (দ্বিতীয় খণ্ড) : কলকাতা : দিয়া পাবলিকেশন : প্রথম দিয়া সংস্করণ ২০১২ : পৃষ্ঠা — ২২৮
৬। উৎপল কুমার বসু : ‘কবিতাসংগ্রহ’ : কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং : প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ২০১৭ : পৃষ্ঠা — ১৩৩
৭। আল মাহমুদ : ‘শ্রেষ্ঠ আল মাহমুদ’ : কলকাতা : নয়া উদ্যোগ : প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ : পুনর্মুদ্রণ ২০০৮ : পৃষ্ঠা — ৪৯৯
৮। তদেব
৯। অরুণাংশু ভট্টাচার্য, অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পা) : ‘পরাবাস্তব কবিতা’ : কলকাতা : লুব্ধক : প্রথম প্রকাশ ২০১৮ : পৃষ্ঠা — ১৩৬
১০। ভাস্কর চক্রবর্তী : ‘কবিতাসমগ্র’ (দ্বিতীয় খণ্ড) : কলকাতা : ‘ভাষাবন্ধন প্রকাশনী’ : প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ২০১০ : পুনর্মুদ্রণ ২০১৭ : পৃষ্ঠা — ১৪০
১১। Daniel Stokols : Psychological Review, Vol. 82, No.- 1 : ‘Theory of Alienation’: University of California : Page. 27
১২। ভাস্কর চক্রবর্তী : পূর্বোক্ত : পৃষ্ঠা — ১৪১
১৩। তদেব
১৪। Charles Baudelaire : ‘Fleurs du Mal’ : Released under Creative Commons (http://creativecommons.org/licenses/by-nc/3.0/us/) : Page no. 25