“আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না” — মনস্তত্ত্বের আলোতে পরিচিতি 

 গৈরিক বসু 

‘পরিচিতি’ (identity) শব্দের অনেক মাত্রা। এ যেন পেঁয়াজের খোসা — স্তরের পর স্তর। অভিধানগত ভাবে পরিচিতি হল স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক ও মূল্যবোধ মিলিয়ে এক মনন, যা একজনকে অন্যের থেকে আলাদা করে। 

পরিচিতি অনেক রকমের আছে — বাবা, ছেলে, বন্ধু, ছাত্র সবগুলোই আমি, কিন্তু কোনোটাই ধ্রুবক নয়। কিছু পরিচিতিজ্ঞাপক লক্ষণ আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যেমন উচ্চতা, গায়ের রং, জাতি, মাতৃভূমি ইত্যাদি। কিছু আবার নিয়ন্ত্রণাধীন, যেমন রাজনৈতিক সচেতনতা, ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিকতা প্রভৃতি, যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যবহার (behaviour) এবং কাজ (action) নির্ধারণ করে প্রতিমুহূর্তে এবং প্রতি পদক্ষেপে। আমার পরিচিতি তৈরি হয় আমার ক্ষমতা ও জীবনের উদ্দেশ্যর মাধ্যমে এবং সেই উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর জন্য আমার ক্ষমতা ব্যবহার করার উপযুক্ত পরিবেশ আমি পেলাম কিনা। 

১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্রয়েড হিমশৈল (Iceberg Model) তত্ত্বের মাধ্যমে মানুষের মনোজগৎ-কে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তাঁর মতে মানুষের চিন্তা, অনুভূতি, ব্যবহার মূলত নির্ভর করে তার অজ্ঞান (unconscious) মনের ওপর। হিমশৈলের নীচের অংশের মতই মনের এই অংশটি দেখা যায় না।   

সচেতন (conscious) ও অবচেতন (pre-conscious) মনের তত্ত্বটি যে পুরোপুরি ফ্রয়েড সাহেবের আবিষ্কার তা নয়। তবে একথা অনস্বীকার্য যে ফ্রয়েড সাহেবই এই তত্ত্বটিকে মনস্তত্ত্ব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনেন। সচেতন মন সেই সমস্ত চিন্তা, অনুভূতি দিয়ে তৈরি যা আমরা দেখতে পাচ্ছি বা জানতে পারছি — ফ্রয়েড একেই বলেছেন হিমশৈলের চূড়া। যেমন আমার খিদে পেল এবং আমি খেলাম। হিমশৈলের এই চূড়ার ঠিক নীচেই রয়েছে আমাদের অবচেতন (pre-conscious) মন। এখানে আমাদের সেই চিন্তা ও অনুভূতির বাস যা নিয়ে আমরা এই মুহূর্তে সচেতন নই কিন্তু খুব সহজেই তাকে সচেতন মনের স্তরে তুলে আনা যায়। যেমন ধরুন আপনি আপনার ইমেল আইডি নিয়ে এই মুহূর্তে চিন্তা করছেন না, কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করলে আপনি তা অনায়াসে মনে করতে পারবেন। হিমশৈলের সবথেকে নীচের অন্ধকারময় অঞ্চলে রয়েছে আমাদের অজ্ঞান (unconscious) মন। এই মন তৈরি হয় লুকোনো স্মৃতি, আঘাত, সহজাত প্রবৃত্তি ইত্যাদি নিয়ে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। ফ্রয়েড সাহেবের মতে এই অজ্ঞান মনই হল আমাদের ব্যবহার এবং আচরণের মূল উৎস। অবচেতন মনে হালকা আবেগের অভিজ্ঞতা থাকতে পারে কিন্তু ভয়ংকর এবং তীব্র আবেগ যাদের দাবিয়ে রাখতে হয় তারা অবচেতন থেকে অজ্ঞান স্তরে চলে যায়। অপেক্ষা করে কোনও অসতর্ক মুহূর্তের যখন তার কালো ছায়া পড়ে আমাদের বর্তমানের কোনও অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায়, যার জন্য পরে আপনাকে অনুশোচনা করতে হতে পারে। উদাহরণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনেই — ছেলের ওপর আপনি অতি সামান্য কারণে চোটপাট করলেন (যা আপনার স্বভাব বিরুদ্ধ, পরে অনুশোচনা করবেন) কিন্তু তার মূল কারণ লুকিয়ে আছে একমাস আগে অফিসে বসের কাছে সবার সামনে অপমানিত হওয়া। আপনার অজ্ঞান মন সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাকে ধরে রেখেছিল। আপনি শান্ত মানুষটি চেষ্টা করেও সেই মুহূর্তে ওই আবেগের বিস্ফোরণকে বাধা দিতে পারেননি। 

ফ্রয়েড মানুষের ব্যক্তিত্ব (Personality Theory) কে আবার Id, Ego এবং Superego — এই ধারণা গুলির মাধ্যমেও ব্যাখ্যা করেছেন। Id হল শিশুসুলভ সহজাত প্রবৃত্তি, যেমন শরীরের অবস্থা উপেক্ষা করেও মিষ্টি খাওয়া চালিয়ে যাওয়া। Id বাস্তব, যুক্তি ইত্যাদি বিশেষ মানে না, আমাদের মনের অজ্ঞান স্তরেই এর অবস্থান। Ego হল Id-এর সংশোধিত রূপ। বাস্তব পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে আপনার সাবধানী প্রতিক্রিয়া। Ego সামাজিক বাধ্যবাধকতা, সমাজে আপনার অবস্থান ইত্যাদি বুঝে ক্ষণিকের ভালো লাগা বা আবেগের বহিঃপ্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর পরে আসে Superego, যা শুধু বাস্তব পরিস্থিতিকেই বিচার করে না আপনার ভেতর যে নীতিবাগীশ সত্তাটি বা পূর্বজদের দেওয়া সংস্কার আছে, তাকে বিবেচনা করে আপনার প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করে। এমনটা ঘটতেই পারে যে আপনার Id-এর যে সংশোধিত প্রতিক্রিয়াটি Ego নির্ধারণ করেছিল, আপনার Superego আবার তার রাশ টেনে ধরে তাকে প্রকাশ করতে বাধা দিল। Superego দু-ভাবে কাজ করে — আপনার বিবেক এবং আপনি আদর্শগতভাবে নিজেকে যেখানে দেখতে চান। আপনার শিশুকাল কীভাবে কেটেছে এবং বাবা-মায়ের সংস্কার আপনার Superego গড়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করে। 

আরেক বিখ্যাত মনোবিদ এরিক এরিকসন দেখিয়েছেন মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনের মোট আটটি পর্যায় আছে — যা শিশুকাল থেকে শেষ বয়স পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতি পর্যায়েই আমরা কিছু না কিছু মানসিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হই — যা আমাদের ওপর ভালো বা মন্দ প্রভাব ফেলে। আপনি এই দ্বন্দ্বগুলির যত ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারবেন, আপনার ব্যক্তিত্ব তত সুগঠিত হবে, জীবনের ওঠাপড়া কম গায়ে লাগবে। এবার দেখা যাক এরিকসনের মতে জীবনের এই পর্যায় গুলি কী কী — 

১) প্রথম পর্যায়টি জন্ম থেকে ১৮ মাস বয়স পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়ের প্রধান দ্বন্দ্ব বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের। শিশুটি জগৎ সম্পর্কে বিশেষ ওয়াকিফহাল নয়। তাকে ভরসা করতে হয় তার দেখাশোনা করা লোকগুলির ওপর। যদি তারা ঠিক মতো দেখাশোনা করেন তাহলে শিশুটি বিশ্বাস করতে শেখে। শিশুটির চাহিদা যদি এই সময় ঠিক মতো না মেটানো যায় তার মধ্যে অবিশ্বাস, সন্দেহ, উদ্বেগ, ভয় ইত্যাদি জন্ম নিতে পারে। এগুলি তার পরবর্তী জীবনের ওপর নিশ্চিতভাবে খারাপ প্রভাব ফেলে। 

২) এই পর্যায়ে বিস্তৃত ১৮ মাস থেকে তিন  বছর বয়স পর্যন্ত। এখন শিশুর ধীরে ধীরে স্বাধীন হওয়ার সময় — তাকে মোকাবিলা করতে হবে লজ্জা এবং সন্দেহ নামক অসুবিধাগুলিকে। এই স্তরে গঠিত হয় তার ইচ্ছাশক্তি। যদি শিশুটিকে অতিরিক্ত সমালোচনা বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়, সে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং তার আত্মবিশ্বাস কমে। এই সময় শিশু জামাকাপড় পড়তে শেখে, খেলতে শেখে, নিজে খেতে শেখে, এবং বাছতে (choice) শেখে। বাবা-মাকে ঠিক করতে হয় ঠিক কতটা স্বাধীনতা তারা শিশুটিকে দেবেন তাকে আত্মনির্ভরশীল এবং আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠার জন্য। 

৩) এই পর্যায়ের মূল দ্বন্দ্ব উদ্যোগ এবং অপরাধবোধের। ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত বিস্তৃত এই পর্যায়ে শিশু দ্রুত বেড়ে ওঠে, তার সামাজিক মেলামেশা বাড়ে, স্কুল যাওয়া শুরু হয়। কিন্তু প্রচুর প্রশ্ন করা শুরু করে — বাবা-মা যদি সেগুলো উপেক্ষা করেন তাহলে শিশুর মনে অপরাধবোধ তৈরি হয়। তার মনে হয় সে বাবা-মায়ের বিরক্তির কারণ। এই অপরাধবোধ যত বাড়ে সে তত নিজেকে গুটিয়ে নেয় বা বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রাসী হয়ে ওঠে, তার আত্মনিয়ন্ত্রণ কমে। সুতরাং এই পর্যায়ে উদ্যোগ এবং অপরাধবোধের সূক্ষ্ম সমন্বয় বাঞ্ছনীয়। 

৪) এই পর্যায়ে বয়ঃসন্ধিকালের শুরু — ৫ বছর থেকে ১৩ বছর। সে এখন লেখাপড়া শিখেছে, নিজের কাজ নিজে করতে পারে। শিক্ষকরা ও সমবয়সী বন্ধুরা এই পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখনই বোঝা যায় সে কোন্ কাজে বেশি দক্ষতা সম্পন্ন — ছবি আঁকা, খেলা, পড়াশোনা ইত্যাদি। সমাজ তাকে তার সাফল্যের মর্যাদা দিতে শুরু করেছে। তার এই সহজাত দক্ষতা বা ভাললাগাকে বাবা-মা বা শিক্ষকেরা যদি অতিরিক্ত বাধা দিতে শুরু করেন সে নিজেকে হীন বলে মনে করবে, নিজের দক্ষতার প্রতি সন্দেহ জন্মাবে — তার ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ কখনোই হবে না। এই পর্যায়ের মূল বিষয় হল দক্ষতা অর্জন। 

৫) এবারে আসছে বয়:সন্ধিকাল থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর্যায় — ১৩ থেকে ২১ বছর। এই পর্যায়ে তৈরি হয় নিজের পরিচিতি, Career-এর দিশা নির্দেশ পাওয়া যায়, স্বাধীনতা বাড়ে, সম্পর্ক তৈরি হয় — এককথায় সামাজিক ভূমিকা নির্দিষ্ট হওয়ার দিকে এগোয়। এই সময় শুরু হতে পারে তার ভূমিকা নিয়ে বিভ্রান্তি — Identity Crisis। সে তার জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। বাধা পেলেই শুরু হয় বিদ্রোহ, জীবনের লক্ষ্য নড়ে যায়। 

৬) এই পর্যায় ২১ থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত থাকে। এই সময়েই জীবনের বড় দ্বন্দ্বগুলি — সামাজিক এবং ব্যক্তিগত প্রাধান্য লাভ করে। আমরা জীবন ভাগ করে নিতে শিখি, লম্বা Commitment-এ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই। এই পর্যায় ভালোভাবে কাটাতে পারলে জীবন অনেক নিরাপদ। নাহলে একাকিত্ব, অবসাদ ঘিরে ধরে। 

৭) ৪০ থেকে ৬৫ পর্যন্ত এই পর্যায় হল পরিণত কাল। এই সময়ের জীবন সকলকে নিয়ে চলার।  আপনার কাজের কুশলতা বেড়েছে, জীবনের অভিজ্ঞতা বেড়েছে, সন্তান প্রতিপালন করছেন — সমাজে আপনার অবদান ও প্রতিষ্ঠা আছে। এগুলো না হলে কিন্তু আপনার জীবন পচা ডোবার মতো — কিছুতেই আপনি উৎসাহ পান না, কোনও কিছুতেই নিজেকে জড়াতে ভয় পান। 

৮) বাকি জীবনটি হল এরিকসনের ভাষায় অষ্টম এবং অন্তিম কাল। আপনি পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখেন, জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেব কষেন। আপনার সামাজিক কার্যকারিতা ও অবদান ক্রমশই কমে আসছে। এরিকসন বলেন, এই সময় আপনি ভুগতে পারেন অপরাধবোধে, যার থেকে আসবে অবসাদ ও নৈরাশ্য। 

আপনার পরিচিতি বদলাতে থাকে প্রতি মুহূর্তে নিজের কাছে, সমাজের কাছে। পরিচিতি হল এক আয়না মহল — যেদিকে তাকাবেন দেখবেন নতুন নতুন ছবি, একই ছবির নানা রূপ।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান