আমার (Rarh)-chive 

অমৃতেশ বিশ্বাস 

‘পরিচয়’ শব্দটা কানে গেলেই এখনও মনে পড়ে কলেজ স্ট্রিটের ভাঙাচোরা, থামওয়ালা বিশাল বাড়ির ওই দু-তলার পরিচিত ছবিটা। ছোট্ট একটা ঘুপচি মতন ঘর, আধো-অন্ধকার। একটা টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে, ‘কারেন্ট’ নেই, কিন্তু “এখুনি চলে আসবে”। টেবিলের ওই দিকে জেঠু বসে আছেন, গম্ভীর। সামনে তাড়া তাড়া গিজগিজে অগোছলো কাগজ। বাবার বন্ধু সেই ‘জেঠু’ ‘পরিচয়’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক। কলকাতায় গেলেই বাবার হাত ধরে অবশ্যই একদিন ওখানে যেতাম। এই রুটিনের কোনও নড়চড় ছিল না।

কাজেই, ‘পরিচয়’ শব্দটা, আমার কাছে বেশ বড়ো বয়েস পর্যন্ত ছিল একটা পত্রিকার নামবিশেষ, আর ছোটোবেলার ঝাপসা খাপছাড়া কিছু স্মৃতি। 

তবে, ব্যক্তি-গত অভিজ্ঞতা, প্রথা-গত আর পুঁথি-গত বিদ্যের অত্যাচারে ওই শব্দটার মানে এখন অনেকটাই বদলে গেছে। তবে, এই লেখায় পাঠকগণকে নিশ্চিতভাবে আমি ওই প্রথা-পুঁথিগত অত্যাচারের যন্ত্রণা অযথা ভোগ করাতে চাই না। বরং, ঐ ‘ব্যক্তি-গত অভিজ্ঞতা’র অল্পস্বল্প এই ছোট্ট লেখায় share করতে চাই। হয়তো এই ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন অনেকেই হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন। তাঁদের কাছে এই লেখা কেবলমাত্র পরিচিত ঘটনাবলির পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই আগেই ক্ষমাপ্রার্থী। 

‘পরিচয়’, ‘নির্মিত পরিচয়’ আর ‘পরিচয় নির্মাণ’-এর সাক্ষী তো, একদিক থেকে দেখতে গেলে, আমরা সবাই-ই। এ যেন আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের সঙ্গীসাথি। খুব ছোটোবেলায় যখন আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করত, তোমার নাম কী? সাত-তাড়াতাড়ি নাম বলতাম। ওই নামটাই ছিল আমার পরিচয়। ছোট্ট একটা নাম, আর কিছু নয়। তারও পরে বলতে শিখলাম ‘ভালো নাম’। সেই নামের সঙ্গে পদবিও আছে। পদবি আমার পরিচয়কে আরও সংকুচিত করল। সীমাবদ্ধতার দিকে একটু একটু করে এগোতে শুরু করলাম। কিন্তু এখানেও সমস্যা। একই নাম আর পদবি-র একাধিক চরিত্র থাকার দরুন পরিচয়ের যাত্রাপথে জুড়তে শুরু করলাম বাবা/মা, বাসস্থান, পাঠশালা প্রভৃতি আরও কত কি! তারও পরে, সহজে নিজেকে চিহ্নিত করার জন্য কর্মস্থলও যুক্ত হল। অতএব বলা চলে, ‘সঠিক’ পরিচয় আসলে ক্রমাগত ‘সটীক’ এক সংকোচন-প্রক্রিয়া মাত্র। ‘IT (Chapter Two)’ সিনেমার শেষে সেই Pennywise-এর এক্কেবারে কুঁচকে যাওয়ার মতন অবস্থা প্রায়! ভারতবর্ষের একাধিক স্থানে, বোধহয় এই কারণেই, নামের সঙ্গে পদবি ছাড়াও জন্মস্থান, জন্ম-দাত্রী/দাতা, শৈশবধাম ইত্যাদির উল্লেখ করার রেওয়াজ এখনও যথেষ্ট আছে। ‘আমি মানুষ’ বলায় যে বিশালতা, যে ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতা, কেবল সে পরিচয়ে বিশেষ কাউকে খুঁজতে চাওয়া দুঃসাধ্য নয়, অসাধ্য। ইংরেজিতে ‘what is your name’ যেমন জানতে চাওয়া হয়, ঠিক তেমনই ফরাসি ভাষায় জানতে চাওয়া হয়, ‘comment vous appelez-vous’ এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কিন্তু সহজেই ‘তোমার নাম কি’ — এই জাতীয় একটা কাজ চালানো গোছের অনুবাদ করা চলে না। গুগল্‌-এ অনুসন্ধান করাকালীন নজরে পড়ল, ফরাসি ওই বাক্যবন্ধনীর আক্ষরিক অনুবাদ ইংরেজিতে হওয়া উচিত ‘how do they call you’… । ফরাসি ভাষার এক অধ্যাপকের কাছে শুনেছিলাম উক্ত বাক্যবন্ধনীর মূল ভাব, ‘how do you you introduce yourself’ — এরকমটা বলা যেতে পারে। যাই হোক, একটা ব্যাপার পরিষ্কার আমার কাছে, নিজের পরিচয় কখনোই আমি নিজে তৈরি করছি না। পরিচয় তৈরি হচ্ছে ঐ ‘they’ অথবা ‘তাঁদের’ মাধ্যমে যাঁরা আমার কণ্ঠোদ্গীর্ণ কিছু শব্দ শুনে আমায় অবিরাম কুঁচকে দিচ্ছেন। মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য জীবদের মধ্যে এইরকম কোনও প্রথা আছে কিনা জানা নেই। তবে, ভয়নিচের তত্ত্বানুযায়ী অন্যান্য জীবকুলের নিজ নিজ ভাষা বর্তমান। আমরা ‘সামাজিক’ পশু হওয়ার সূত্রে আর আমাদের ভাষার দৌড়াদৌড়ি-র জন্য প্রত্যেকেরই এইভাবে একটা পরিচয় গড়ে ওঠে এবং তা অবশ্যই স্বাভাবিক নিয়মে নয়। তা সত্ত্বেও এই নির্মিত পরিচয় মানবজীবনের দৃষ্টিভঙ্গিতে সহজাত প্রবৃত্তির মতোই একটা অতি, অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু… 

আমার জীবনে এই ‘নির্মিত পরিচয়’ এইখানেই থেমে থাকেনি। 

আমার জন্ম রাঢ়বঙ্গে, সাঁকতোড়িয়া-ডিসেরগড় অঞ্চলে। যাঁরা আমায় জন্ম দিয়েছিলেন তাঁরা দু-জনেই এই অঞ্চলে এসেছিলেন পেশাগত কারণে এবং দু-জনেই শিক্ষাকর্মের সঙ্গে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁ‘they’র এবং আরও অন্যান্য‘they’র মাধ্যমে যখন আপাত স্বাভাবিক আর সাধারণ নিয়মে আমার পরিচয় গড়ে উঠছে তখন কিছু কিছু ঘটনা অন্তত আমার কাছে ‘অ’-স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। ছোটোবেলায় বিভিন্ন আড্ডায়-জমায়েতে মা-বাবা সমেত অনেককেই বলতে শুনতাম, “জন্মসূত্রে আমি অমুক জায়গার” / “আমার জন্ম তমুক জায়গায়” / “আপনি আসলে কোথাকার” / “আরে, আপনি তো আমাদেরই লোক” ইত্যাদি এইরকম আরও অজস্র বাক্যবন্ধনী। আমার বেড়ে ওঠার জায়গাটাও আসলে একটা campus যেখানে আমার মা-বাবা-র মতোই পেশাগত কারণে আসা মানুষজন থাকতেন। Campus-এর বাইরের জগৎ-টা আবার একেবারেই আলাদা। বাজার-হাট, দোকান-পাট, স্থানীয় বাসিন্দায় ভরপুর, সরগরম এক গঞ্জবিশেষ। Campus-এর পাঁচিলটা সবসময়ই মনে করিয়ে দিত জন্মসূত্রে ভিতরের লোকজনেরা অমুক-তমুক স্থানের। ভালো কথা। তাহলে সেই হিসেবে আমিও জন্মসূত্রে সাঁকতোড়িয়া-ডিসেরগড় অঞ্চলের? নাঃ, গাণিতিক সূত্রের মতো এই নিয়ম সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় যে! কখনও-সখনও স্থানীয় ভাষায় কথা বলে ফেললে, আমায় শুনতে হত, ‘ভালো বাংলা’-টা বলতে শিখতে হবে। তখন তো মনে হয়েইছে, এখন আরও বেশি করে মনে হয়, সে আবার কী বস্তু? [‘ঠাকুর’মশাই ঠিক এইভাবেই যে ভেবেছেন, তা অনেক পরে জেনেছি] 

আঞ্চলিক কথ্য বাংলা উচ্চারণ ব্যক্তিগত হাসি-ঠাট্টা-মশকরা-য় চলতে পারে, কিন্তু সেটাই যে আমার সর্বসময়ের সঙ্গী হয়ে উঠবে বা উঠতে পারে, সে ভাবনার গুড়ে বালি! আমার পরিচয়, আমি কাদের সন্তান, তাঁরা কি বা কোন্‌ কোন্‌ কর্মের সঙ্গে যুক্ত এবং তাঁদের জন্মস্থানের ভিটেমাটির ওপর নির্ভরশীল! একই সূত্র এক জায়গায় মান্যতা পাচ্ছে, আরেক জায়গায় লঙ্ঘিত হচ্ছে! জন্মসূত্রে আমি কী, আমি কে ও কেন? Irrational নয়, পুরোপুরি non-rational এই theory-র থই খুঁজে পাই না এখনও। বলতে দ্বিধা নেই যে, জীবনের এতগুলো বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও, সাঁকতোড়িয়া-ডিসেরগড় অঞ্চলের অনতিদূরে আসানসোল শিল্পনগরী-তে পাকাপাকি বাসস্থান গড়ে ওঠার পরেও, জীবন-সঙ্গিনী হিসেবে রাঢ়বঙ্গেরই একজনকে পাশে পাওয়ার পরেও, আমার দুর্ভাগ্য, আমি এখনও সেই তাঁ‘they’র নির্মিত পরিচয়েই পরিচিত। আমার রাঢ়বঙ্গ, আমার হয়েও আমার নয় — আমার পরিচয় সেই না-জানা, না-দেখা অঞ্চলগুলোয় লুক্কায়িত যেখানে আমার মা-বাবা জন্মেছিলেন, খেলা করেছিলেন, বড়ো হয়েছিলেন!  আশ্চর্যের, বড়োই আশ্চর্যের! 

‘সংস্কৃতির বিশ্বরূপ’ বইয়ে গোপাল হালদার মহাশয় ব্যবহৃত ‘শিষ্টসাহিত্য’ শব্দটা হয়তো এ বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করলেও করতে পারে। আমার ব্যক্তিগতভাবে ভীষণভাবে মনে হয়, ঊনবিংশ-শতকীয় Victorian Morality এবং অনুকরণ/অনুসরণপ্রিয় একটা বিশেষ জাতির গা-জোয়ারি Renaissance আন্দোলন [এই অযাচিত ধৃষ্টতার জন্য মার্জনা করবেন] এই জাতীয় সূত্রাবলি তৈরির জন্য প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ ভাবে দায়ী। আমার জীবন দিয়ে উপলদ্ধি করছি, এই নির্মিত পরিচয়-টা আসলে এক অদ্ভুত ক্ষমতার খেলা। সুবিধেমতন পালটে নিলেই হল! Netflix-এ একটা তথ্যচিত্র আছে, ‘How to become a Tyrant’… আমার নির্মিত পরিচয়-এর কালানুক্রমিক, স্থানানুক্রমিক যাত্রাপথে আমি ঐ তথ্যচিত্রের একাধিক উদাহরণ মিলিয়ে দিতে সক্ষম! 

এবারে আসি পরিচয় নির্মাণ-এর কথায়। 

তখন প্রাথমিক স্কুলে পড়ি। অন্যান্য অনেকগুলো দিনের মতোই আমাদের বাড়িতে নিয়মমাফিক চাঁদের হাট বসেছে। ECL-প্রদত্ত কোয়ার্টার [বাগানবাড়ি বললেও অত্যুক্তি হবে না] ‘নামী’ আর ‘দামি’ অতিথি-অভ্যাগত-য় ঝলমল করছে। তবে, ঐ বিশেষ দিনে কবিতা, গান, মশকরা নয় — সবাই নিজ নিজ বক্তব্যে ‘এই অঞ্চলের মানুষজন কতটা পিছিয়ে’ তা প্রমাণ করতে ব্যস্ত! ‘এই অঞ্চল’ অর্থাৎ, যে অঞ্চলে আমি জন্মেছি। হঠাৎ এমন অদ্ভুত বিষয় নিয়ে আলোচনা কেন? পরে জেনেছিলাম, আঞ্চলিক এক তথাকথিত স্বনামধন্যা শিক্ষাবিদ দৃঢ় চিত্তে দাবি করেছেন, এরা [আমার রাঢ়ের, আমার চারিপাশের মানুষজনেরা] এখনও নাকি পাঁচশো বছর পিছিয়ে আছে! সভ্য হতে সময় লাগবে। সেই সময়ে আমার শরীরের প্রতিটা খাঁজে, পরতে পরতে শিষ্টসাহিত্যের মোড়ক। আষ্টেপৃষ্ঠে তাই জড়িয়ে বেঁচে আছি পরজীবী উদ্ভিদের মতো। প্রত্যেক ব্যক্তির প্রত্যেকটা বাক্য ছিল ‘বেদ’বাক্যস্বরূপ। সত্যিই তো! এঁরা তো প্রত্যেকেই এখানে কেবলমাত্র পেটের দায়ে কাজ করতে আসেননি। প্রত্যেকের আপাত ব্যবহারে প্রতিফলিত হত/হয় এক মহান ব্রত! ‘পিছিয়ে পড়া’ মানুষজনদের মহৎ শিক্ষায় শিক্ষিত করা। তাদের জানানো ভালো সাহিত্য কী, ভালো নাটক কাকে বলে, ধ্রূপদ-সঙ্গীতের নিগূঢ় অর্থ, modern art বলতে কী কী বোঝায় ইত্যাদি আরও কত কি… প্রত্যেকেই যেন মেকলে সাহেবের এক-একজন প্রতিমূর্তি — “এই অঞ্চলের” মানুষজনদের আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে হবে, তাদের শেখাতে হবে, শেখাতেই হবে আদব-কায়দা-রুচি, “শ্লীল-অশীল”-এর ফারাক! বলাবাহুল্য, এই কথোপকথনে আমার নিকটাত্মীয়েরাও ছিলেন যথেষ্ট বাঙ্ময়। 

Campus-টাকে colony হিসেবে ধরা গেলে, তখনকার আমি, এই অমৃতেশ, ‘colonial hegemony’-র সু-ফসল ছিলাম প্রায়। মনে করতাম পৃথিবীর যে- কোনও রণে-বনে-জঙ্গলে ‘পিছিয়ে পড়া’ ‘মুখ্যু-সুখ্যু’দের আদি-অকৃত্রিম দুঃখহরণ উদ্ধারকর্তারা আমার চারিপাশে বিপদভঞ্জন-বলয়ের মতন বিরাজমান। 

মনে কখনও প্রশ্নও জাগেনি, ‘পাঞ্জাবি’ কী করে ‘আমাদের’ পোশাক, ‘আলু’ কীভাবে ‘আমাদের’ খাদ্য? কৃষ্টি আর সংস্কৃতি-র ফারাক তো দূর অস্ত, ‘কৃষ্টি’ যে কী তাই জানতাম না। ‘সংস্কৃতি’ বলতে বুঝতাম হাতেগোণা গুটিকয় লোকেদের স্মরণে সন্ধ্যাসর। তারপরে, ‘অপসংস্কৃতি’-র [???] ঠেলায় আস্তে আস্তে এগিয়ে চলা তো ছিলই। 

আমার জন্মস্থানের আশেপাশের স্থানীয় মানুষজনদের একটা ‘অতি, অতি সাধারণ’ [প্রাগুক্ত] নির্মিত পরিচয় তো ছিলই, কিন্তু, দেখা গেল, সেই নির্মিত পরিচয় অগ্রাহ্য করে আরেক পরিচয় লেপে দেবার এক আপ্রাণ প্রচেষ্টা… খানিকটা অতিবাস্তব, খানিকটা উদ্ভট। পরিচয় নির্মাণকালীন আঞ্চলিক মানুষজনদের সঙ্গে মেলামেশার সময়ে বি‘শিষ্ট’রা নিজেদেরকে কেবল উজাড় করে দিচ্ছেন, কেননা গ্রহণের তো কিছুই নেই। যাঁরা মহৎ কাজে ব্রতী হয়েছেন তাঁদের জানার পরিধিটাই তো শেষ কথা! অপর-কে আত্ম-স্বরূপ করে তুলতে না পারলে কাজের কাজ আর কি হল? 

খাপছাড়া কিছু বিষয় নিয়ে যে সামান্য কথা হত না, তা নয়। যেমন, বাউল গান-ছৌ-রামকিঙ্কর-পালামৌ-টাঁড়বারো এবং… 

ধোপদুরস্ত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এইসব আকস্মিক অনুপ্রবেশ উপেক্ষা করা না গেলেও, কথা-ব্যাখ্যা-আলাপ-আলোচনা সেই একতরফা-ই। শোনার বালাই নেই, কেবল বলা আর বলা — প্রায় সবসময়েই। আংশিক বা পুরোপুরি promote করার মানসিকতা একধরণের বহুস্তরীয় ঔপরিকতার অস্তিত্বকে আরও পোক্ত করে। “সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।” 

আমার অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধ পরিসরে, এই সেদিনও, ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে, এক অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলাম! পুরুলিয়া জেলার বরান্তি গ্রামে। এই গ্রামের অনতিদূরে একটা বাঁধ-কে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বেশ কয়েকবছর ধরেই। বলাবাহুল্য, “সহরের বাব্যুরা”, “বাঙ্গালিবাবুগুলা” [এখানে বলা দরকার, সংযোগ-স্থাপনের জন্য বাধ্য হয়ে একাধিক জাতির মানুষজনদের বাংলা বলতেই হয়] ঘুরতে যেমন আসেন, তেমনই ব্যবসাও ফেঁদে বসেছেন এই অঞ্চলের আনাচে-কানাচে। স্বভাবতই, বরান্তি গ্রামের ভিতরের কাঁচা রাস্তা দিয়ে এখন অনেক বড়ো বড়ো গাড়ি যাতায়াত করে। জনপদের বাচ্চা-কাচারা তো বটেই, গৃহপালিত পশু-পাখিরাও রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে অভ্যস্ত হওয়ায় মাঝে-মধ্যেই ব্রেক কষতে হয় গাড়িগুলোকে। এমনই হঠাৎ ব্রেক কষতে বাধ্য হওয়া কোনও গাড়ির ভিতর থেকে উক্তি এসেছিল,

“অসভ্য, বুনো, গেঁয়ো… ” ইত্যাদি আরও অনেক কিছু… অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রতি। 

ফলে, স্থানীয় জনরোষ এবং গ্রামের রাস্তা অবরোধ… গাড়ি দেখলেই ঢিল ছোঁড়া ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। 

গালিগালাজ-ঝগড়াঝাঁটি হতেই পারে, কিন্তু যুগ-যুগান্ত ধরে পোষণ করা আর সযত্নে লালন-পালন করা বিশেষ মনোভাব লক্ষ করার মতো বিষয়! এই বিষয়ে কিছু উদ্ধৃতি বোধহয় বিষয়টাকে আরেকটু বোধগম্য করে তুলতে পারে — 

“বুদ্ধদেবের সময়ে উত্তর ভারতবর্ষের আর্য্য জনপদ বা রাজ্যের নামের একটা তালিকা প্রাচীন পালি সাহিত্যে পাওয়া যায়; এই তালিকায় বাঙলা দেশের নাম নেই।” 

এবং,

“বুদ্ধদেবের পরেকার বৌধায়ন-ধর্মসূত্রে স্পষ্ট বলা হ’য়েছে যে, উত্তর ভারতের আর্য্য ব্রাহ্মণ, বাঙলা দেশে এলে পরে তাঁকে স্বদেশে ফিরে’ প্রায়শ্চিত্ত ক’র্‌তে হবে; অনার্য্য দেশ ব’লে বাঙলার প্রতি উত্তর ভারতের আর্য্যেরা এমনি বিরূপ ছিল। এ দেশের সম্বন্ধে (তখনকার দিনে তা’রা পশ্চিম-বঙ্গকেই ভালো রকম জান্‌ত, তাই পশ্চিম-বঙ্গের কথাই তা’রা বলে গিয়েছে) আর একটা বদ্‌-নাম এই ছিল যে, এখনকার লোকেরা ভারী রূঢ় আর অভদ্র। জৈনদের প্রাচীন বইয়ে মহাবীর-স্বামীর সম্বন্ধে বলা হ’য়েছে যে, তিনি ‘লাঢ়’ আর ‘সুব্‌ভ’ দেশে অর্থাৎ রাঢ় আর সূক্ষ্ম দেশে (অর্থাৎ পশ্চিম-বাঙ্গালায়) গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানকার লোকেরা তাঁ’র ওপর কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল।” [দ্রঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা] 

এইভাবেই চিন্তন-পদ্ধতির মধ্যে বহুদিন ধরেই কিছু প্রায়োগিক ধারণা এমন মজ্জাগত হয়ে উঠেছে যা পুনর্বিবেচনা করতে গেলে নিজেদেরকে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার আরও অবাক লাগে, যখন আমাদেরই মতন কেউ কেউ বলে ওঠেন, “তুমি হ’চ্ছ ‘সেই’ এবং এইজন্যে তোমার গর্ব হওয়া উচিত” বা “আমি ‘ওই’, তাই আমি গর্বিত” ইত্যাদি। [পুনরায় মনে করিয়ে দিই, আমার অভিজ্ঞতা রাঢ়বঙ্গ-কেন্দ্রিক] আগে যে ট্র্যাডিশনের কথা উল্লেখ করেছিলাম, তার খেই ধরেই বলছি, অপরত্বমূলক বিদ্বেষ এমনই জায়গায় পৌঁছেছিল যে ঐতরেয়-আরণ্যক-এ আমাদের ‘মানুষ’ পরিচয়টাকেই খারিজ করে ‘বয়াংসি’ বা পাখি বলা হয়েছে! এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে নিজেদেরকে অপর হিসেবে ভাবতে বেশ ভালোই লাগছে। বিস্মৃতির চিতায় ছাই হয়ে আবার ফিনিক্স পাখির মতো নবজন্ম হবে আমাদের, পরিচয় নির্মিতি-প্রক্রিয়া তো শুরু হয়েই গেছে… ক্ষেতি নেই। 

‘পরিচয় নির্মাণ’ করা হয়/হয়েছে/হচ্ছে এইভাবেই। একটু নজর করলে এটাও দেখা যায় যে, ‘বৌদ্ধিক’ এবং ‘আর্থিক’ ব্যবসা-বাণিজ্যেও রাঢ়ের ‘বিকৃত’ আর ‘বিক্রীত’ পরিচয় ক্রমাগত নির্মাণ করা হচ্ছে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে। 

আমাদের অঞ্চলে অতি প্রাচীন জনপদগুলোর কিছু কিছু এখনও নিজেদের অস্তিস্ত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সেইরকমই এক জনপদ ‘সাঁওতাল মৌঠা’। খুব বেশি না হলেও কম-বেশি গোটা পঁচিশেক বাড়ি-ঘর। ‘বাঁধনা পরব’ [গৃহপালিত গোরু-কেন্দ্রিক এক উৎসব]-এর দিনকয়েক পরেই এখানে আরেকটা উৎসব হয় যার নাম ‘ধানসিং পরব’। উচ্চারণ শুনে লিখছি, ভুল হলে ক্ষমা করবেন। এই ‘পরব’ বা উৎসব নিয়ে কিছু বলা আমার পক্ষে চরম ধৃষ্টতা হবে, কেননা আমি এ বিষয়ে কিচ্ছুটি জানি না। তবুও, এই পরবের মূল বিষয়টা আমার কাছে যথেষ্ট আকর্ষণের। 

                ছবি ১. ‘সাঁওতাল মৌঠা’ লেখা ফলক

স্কুলের সহপাঠীর শ্বশুরবাড়ি ওই জনপদে। আচমকাই একটা নেমন্তন্ন জুটে গেছিল বরাত জোরে! সাধারণত ঐ ‘পরব’-এ ‘বাইরের লোক’ বড়ো একটা থাকে না। আমার ধারণা, এখনও অনেকেই জানেন না যে এরকম একটা উৎসব বহুল প্রচারিত ‘বাঁধনা’ উৎসবের পরে পরেই পালিত হয়। উপরন্তু, উক্ত জনপদ এতটাই অন্তরালে যে তথাকথিত ‘সভ্য’ সমাজ এখনও তা টের পায়নি। কতদিন যে পাবে না, বলা অসম্ভব। 

যাই হোক, অনুষ্ঠানের কথায় আসি। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল একটা গাছ পুজো। এই উৎসবে জনপদের প্রতিটি মহিলা ও পুরুষ অংশ নেন। একজনও বাদ যান না — পুজো, কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মানা, নাচ, গান, তাল-বাদ্য ইত্যাদিতে সক্রিয় অংশ নিতে দেখা যায় তাঁদের। একটা ঘেরা জায়গায় একটাই গাছ এবং সেই গাছ-ই আরাধ্য।

ছবি ২ এবং ৩. ধানসিং পরবে বৃন্দনৃত্য ও গাছ-পুজো

নিজের মনেই বিড় বিড় করছিলাম, “গাছ-পুজো? আচ্ছা… কি গাছ ওটা?…” ইত্যাদি। বন্ধু-পত্নী পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। বলে উঠলেন, এটা ‘সাত ভাই চম্পা’-র পুজো। কথাটা কানে যেতে না যেতেই ব্রহ্মতালুতে মনে হল রেডিও বাবা তাঁর পজিটিভ আর নেগেটিভ দুই টিকি নিয়ে শক্‌ দিয়েই চলেছেন ক্রমাগত! তারপরে বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদে জর্জরিত সেই বন্ধু আর বন্ধু-পত্নী অনুষ্ঠান চলাকালীনই আমাকে ভিড়িয়ে দিলেন বেশ কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির সঙ্গে। জানতে পারলাম এই অনুষ্ঠান বহু প্রাচীন। কবে যে এর উৎপত্তি কেউ জানেন না। অপেক্ষাকৃত কমবয়েসি একজন বললেন ঐ জনপদে তিনশো-চারশো বছর ধরে এই অনুষ্ঠান পালন করা হয়। অন্যান্য একাধিক জনপদে এই অনুষ্ঠান আরও প্রাচীন। সাত ভাই চম্পা-র যে গল্প ছোটোবেলা থেকেই পড়ে বা শুনে আসছি — সেই গল্পই, আলাদা নয়। গাছটা আসলে সেই গাছেরই প্রতীক যে গাছে “টুলটুলে সাত চাঁপা আর এক পারুল ফুটিয়া রহিয়াছে।” 

পরে, বাড়ি ফিরে পাতা ওল্টালাম ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এক বিশেষ বইয়ের। ভূমিকায় লেখা,

“অতএব বাঙ্গালীর ছেলে যখন রূপকথা শোনে তখন কেবল যে গল্প শুনিয়া সুখী হয়, তাহা নহে — সমস্ত বাংলা দেশের চিরন্তন সুরটি তাহার তরুণ চিত্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়া, তাহাকে যেন বাংলার রসে রসাইয়া লয়।” 

এবং, 

“ …দক্ষিণাবাবুকে ধন্য। তিনি ঠাকুরমা’র মুখের কথাকে ছাপার অক্ষরে তুলিয়া পুঁতিয়াছেন… ”

বইটার নাম ঠাকুরমার ঝুলি। ভূমিকার লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। 

তাই তো, এইভাবেই তো আমাদের বাংলার পরিচয় গড়ে উঠেছে/ উঠছে/ উঠবেও। এই কারণেই তো বুনো রামনাথ যেমন তেঁতুলের টক, কুচোমাছের ঝাল, শাক দিয়ে অন্ন ভক্ষণ করতেন, ঠিক তেমন মানসিকতা নিয়েই পঞ্চদশ শতকের Columbian Exchange-এর পরে আমরা আলু, টম্যাটো দিয়ে ভাত খাই। বাংলার পুকুরে এই কারণেই তো জনৈক মেমসাহেবের জামার ভাঁজে লুকিয়ে পাড়ি দিয়ে আসা ‘আমাদের’ কচুরিপানা ভাসে। ‘পাঞ্জাবি’ আর ‘লুঙ্গি’ বাঙালির একেবারে ‘নিজস্ব’ ঘরোয়া পোশাক হয়ে উঠতে দ্বিধাগ্রস্ত হয় না কখনোই। এই কারণেই তো মাদার টেরিজা আদতে কখন বাঙালি হয়ে যান নিজের অজান্তেই, Dandy Comics-এর Desperate Dan আর Korky the Cat ‘আমাদের’ ঘরের ছেলে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, আমাদের রান্নাঘরের ‘বাহাদুর বেড়াল’, কৃত্তিবাসের রাম যেন “এক্কেরে আপনার লোক”। 

যাক গে, অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে লাভ নেই। একটা হিন্দি সিনেমার নাম দিনকয়েক আগে চোখে পড়েছিল, ‘জাজমেন্টাল হ্যায় কেয়া?’ এই বিচার করার মানসিকতাটা এখন বোধহয় আরও প্রকট এবং প্রবল। বহুদিন আগে গণসংগীত শিল্পী অজিত পাণ্ডের গাওয়া একটা গানের লাইন শুনেছিলাম — “আমি মানুষ / আমার যা কিছু চিন্তা-ভাবনা মানবতার জন্য”। মূল গানের শিরোনামটা বোধহয় ছিল “আমার জীবনের অর্ধেকটা উৎসর্গ করব কাকে”। জানতে ইচ্ছে করে, এগুলো সবই কি কথার কথা? কিছু বাঁধা-ধরা মহলের শ্রবণেন্দ্রিয় পরিচর্যার জন্য? রাস্তাফেরিয়ান মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ায় গায়ক বব মার্লের বাড়িতে দুষ্কৃতী হানার ঘটনা সবাই জানি। চিন্তন-প্রক্রিয়ায় ইথিওপিয়ার কোনও মানুষকে আবার মসিহা করে তোলা যায় নাকি? অথচ, ভাগ্যের নিদারুণ পরিহাস দেখুন। বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, বর্তমান চেহারার অন্যতম প্রথম মানুষ বিবর্তিত হয়েছেন এই ইথিওপিয়াতেই!

তাই, এখনও অপেক্ষা করে আছি, কবে “সমস্ত বাংলা দেশের চিরন্তন সুরটি” আমাদের “চিত্তের মধ্যে প্রবেশ করিয়া,” তাকে উত্তর-মানবতার রসে রসিয়ে নেবে… নিজেদেরকে সামাজিক ‘পশু’র বদলে সামাজিক ‘জীব’ বলা পরিচয়-সচেতন প্রাণীকুল নিজেদেরকে পৃথিবীর ‘মানুষ’ বলে ভাববে আর ভাবাবে।

ধান সিং পরবের কিছু মুহূর্ত দেখুন : https://youtu.be/FIzyDrQge0k

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান