কুমারজিৎ মণ্ডল
অর্থনীতিবিদ হিসাবে অমর্ত্য সেনের খ্যাতি জগৎজোড়া। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত – এমন অনেক মণিমাণিক্য তাঁর মুকুটে শোভা পায়। তবে অর্থনীতির বাইরে সমাজ বিজ্ঞান এবং দর্শনের বিবিধ শাখায় তাঁর গতিবিধি অবাধ। তিনি সব অর্থেই একজন পরিপূর্ণ নাগরিক বিদ্বজ্জন। তাঁর এই বহুমুখী সারস্বত চর্চার সম্যক পরিচয় বর্তমান আলোচ্য বইটির ছত্রে ছত্রে লিপিবদ্ধ আছে। বইটির নাম ‘পরিচিতি ও হিংসা’। বইটির প্রথম আত্মপ্রকাশ ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরাজি অবতারে “Identity and Violence: Illusion of Destiny”। বাংলা অনুবাদের প্রকাশ ২০১০ খ্রিস্টাব্দে।
এই বইটি অমর্ত্য সেনের পরিচিতি বিষয়ক একাধিক বক্তৃতার সুগ্রন্থিত সমাহার। ২০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন সভাসমিতিতে তিনি এই বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা ব্যক্ত করে আসছেন। আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাব এই সময়পর্বে সামাজিক এবং জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে হিংসার ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একাধিকবার সংঘটিত হয়েছে। কখনও সেটা রূপ নিয়েছে ধর্মীয় সন্ত্রাসে, কখনও বা জাতি দাঙ্গায়। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের আমেরিকার ৯/১১ সবার স্মৃতিতে সজীব আছে। তার ওপর যুগোশ্লাভিয়া, রোয়াণ্ডা, সুদান, আল-কায়দা, আবু ঘারিব জেল ইত্যাদি পারিপার্শ্বিক ঘটনাক্রম এই বইয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে স্থান পেয়েছে। এইসব বিবিধ হিংসার ঘটনার মধ্যে বিশ্লেষণের নিরিখে একটা যোগসূত্রের সফল অনুসন্ধান বর্তমান বইটির প্রধান আকর্ষণ। লেখক এই যোগসূত্র খুঁজেছেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে – স্বচ্ছ যুক্তির নিরন্তর উপস্থাপনার মাধ্যমে।
এই বইয়ের ‘কথারম্ভ’ লেখক শুরু করেছেন মানুষের নিজের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করার সমস্যার কথা দিয়ে। কিন্তু সেই সমস্যা অনেক গুণ বেড়ে যায় যখন মানুষ নিজের ব্যক্তি পরিচয়ের বাইরে গিয়ে ব্যষ্টির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সচেষ্ট হয়। লেখকের অনুনকরণীয় ভাষায়,
“নিজের সমরূপ হবার ধারণা থেকে আমরা যখন কোনও এক সমষ্টি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে একটি পরিচয় ভাগ করে নেবার ধারণার দিকে দৃষ্টি ফেরাই (সামাজিক পরিচয়ের ধারণায় যেটা প্রায়ই হয়ে থাকে) তখন জটিলতা আরও বাড়ে। বস্তুত বহু সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয় বিভিন্ন গোষ্ঠী সংক্রান্ত পরিচিতি-অনুষঙ্গের নানান পরস্পরবিরোধী দাবির সঙ্গে জড়িত, কারণ পরিচয় সম্বন্ধে ধারণা অনেকভাবেই আমাদের চিন্তা ও কাজকে প্রভাবিত করে।”
অমর্ত্য সেন এই বইটিতে মানব সমাজে প্রচলিত বহু পরিচয়ভিত্তিক গোষ্ঠীর প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বের রসায়নকে আলোচনার মূল জায়গায় রেখেছেন। তার নিজের অনবদ্য বিশ্লেষণ এখানে উল্লেখনীয়,
“আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা নিজেদের অনেক সমষ্টির অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করি – আমরা প্রত্যেকটির সদস্য। ……… একই ব্যক্তি একই সময়ে সমষ্টিগুলির প্রত্যেকটির অন্তর্ভুক্ত এবং প্রত্যেকটিই তাঁকে একটি বিশিষ্ট পরিচয় দেয়। এর মধ্যে কোনওটিই তাঁর একমাত্র পরিচয় বা একক সদস্যভুক্তির বর্গ বলে ধরা যাবে না। আমাদের অনিবার্যভাবে বহুমাত্রিক পরিচিতির ফলে যে-কোনও বিশেষ প্রসঙ্গে আমাদের বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও বন্ধনগুলির তুলনামূলক গুরুত্ব সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
অতএব চয়ন করা ও যুক্তি ব্যবহার করা মানুষের জীবনযাপনে কেন্দ্রীয় দায়িত্ব। এর বিপরীতে কোনও এক তথাকথিতভাবে অদ্বিতীয় – অনেক সময় সংঘাতপ্রবণ-পরিচয়, যেটি নাকি আমাদের থাকার কথা, এবং যেটি আমাদের ওপর বিশাল (এবং অত্যন্ত বেয়ারা) দাবি করে থাকে, তার সম্বন্ধে এক অবশ্যম্ভাবিতার বোধ লালন করে হিংসার প্রবর্তন করা যায়। তথাকথিত অনন্য এক পরিচয় আরোপ করা অনেক সময়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ‘সংগ্রামী শিল্পকলা’ সূচিত করার মূল উপাদান।”
ওপরে বর্ণিত মানুষের বহুমাত্রিক পরিচিতি যৌক্তিক বিচারে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। কারণ এটা তার সমাজে বেঁচে থাকার মূল রসদ। সমাজ যত জটিল হয়েছে তত এই পরিচিতির মাত্রা বিস্তার লাভ করেছে। আধুনিক মানুষ তাই পরিচিতির বহুমাত্রিকতাকে স্বাভাবিক যাপনের অঙ্গীভূত করেছে। কিন্তু এটাই কি শেষ সত্য? এমনটা হলে তো বর্তমান বইটি প্রকাশের প্রয়োজন ছিল না। বিভিন্ন হিংসার ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মানুষ কোন্ আশ্চর্য বিভ্রমে তার বহুমাত্রিক পরিচয় অস্বীকার করে সংকীর্ণ একমাত্রিক পরিচয়ে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলে। তখনই সে তার ওই একক পরিচয়ের বাইরের মানুষদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে। শুরু হয়ে যায় হিংসা–প্রতিহিংসার পর্যায়ক্রমিক আবর্তন।
নিজের কিশোর বয়সে সাক্ষী থাকা একটি ঘটনা লেখককে তাড়া করে বেড়ায়। তখন ওনার বয়স ১১ বছর। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে দেশভাগের প্রাক্কালে ঢাকা শহরে তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চলছে। কাদের মিঁয়া নামে এক অল্পবয়সী মুসলমান গরিব দিনমজুর লেখকদের পাড়ায় কাজের সন্ধানে এসেছিলেন। হঠাৎ একদল ক্ষিপ্ত হিন্দু জনতার হাতে ছুরিকাহত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় লেখকদের বাড়ির বাগানে প্রাণ বাঁচাতে ঢুকে পড়েন। কাতরভাবে বালক লেখকের কাছে জল চান। লেখকের চেঁচামেচিতে ওনার বাবা বেরিয়ে এসে কাদের মিঁয়াকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু তাঁকে বাঁচানো যায়নি, হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। লেখক বালকের বিহ্বল দৃষ্টিতে দেখেছেন কীভাবে সেদিন ঢাকার মানুষজনের আশ্চর্য রূপান্তর হল। কিছুদিন আগেও যারা সবাই ছিল ভারতীয়, ছিল সহনাগরিক তারাই হঠাৎ একদিন দানবীয় উন্মত্ততায় পরস্পরকে নিকেশ করতে উদ্যত হল। কারণ তাদের অন্য সব বহুমাত্রিক পরিচিতি গৌণ হয়ে গেল। মুখ্য হয়ে উঠল তাদের ধর্মভিত্তিক পরিচিতি। এ যেন মালুফের কথার ফলিত উদাহরণ। মালুফ তাঁর ‘ইন দ্য নেম অফ্ আইডেন্টিটি’-তে লিখেছেন — “মানুষ — সে যে অবস্থা বা সামাজ বা ধর্ম থেকেই আসুক না কেন — খুব সহজেই একজন কসাইতে রূপান্তরিত হতে পারে। কারণ মানুষের যে হিংস্র আদিম পরিচিতির প্রাদুর্ভাব চারদিকে তা এই রূপান্তরে সাহায্য করে।”
কিন্তু অমর্ত্য সেন মালুফের মতো এতটা নিরাশ হতে রাজি নন। তিনি এইরকম ঘটনার মধ্যে মানুষের বহুমাত্রিক পরিচিতিবোধের স্খলন দেখতে পান – যার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেন মানুষের বৌদ্ধিক স্থূলতা এবং যুক্তিবোধের অকর্মণ্যতাকে। বর্তমান বইটির প্রথমভাগে লেখক মানুষের পরিচিতি সংক্রান্ত একমাত্রিক চিন্তাসূত্র এবং ধারণাগুলির অসারতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি ইতিহাস থেকে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত উত্থাপন করে খ্রিস্টান প্রধান পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং মুসলিম প্রধান প্রাচ্য সভ্যতার মধ্যে নিবিড় সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের উল্লেখ করেছেন। এই আদানপ্রদান আবার ক্ষেত্রবিশেষে কেমন করে পশ্চিমি সভ্যতাকে সুযোগ করে দিয়েছে নিজের আধিপত্য বিস্তার করার এবং অন্যদের মানসিক ভাবে তাদের অনুবর্তী করে তোলার – সে আলোচনা বইটি থেকে উপরিপাওনা। বইটির দ্বিতীয়ভাগে লেখক বহুমাত্রিক সংস্কৃতি সম্বন্ধে তাঁর ধারণাকে পরিবর্ধিত করেছেন এবং তার লালন ও পোষণ কেমন করে হবে সে বিষয়ে একটা রূপরেখা দিয়েছেন।
বর্তমান বইটির সারস্বত প্রেক্ষাপটে আছে স্যামুয়েল হটিংটনের ‘দ্য ক্লাস অফ্ সিভিলাইজেশনস্ অ্যান্ড দ্য রিমেকিং অফ্ দ্য ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ নামক বহু পঠিত কিতাবটি। হটিংটন তাঁর রচনায় বিশ্বের জনতাকে নির্বিচারে একক পরিচয়ের ভিত্তিতে বর্গীভূত করার পক্ষে সওয়াল করেছেন। হটিংটনের ক্ষেত্রে একক পরিচিতি নির্ধারিত হয়েছে ধর্ম অথবা সভ্যতার ভিত্তিতে বর্গীকরণের মাধ্যমে। তিনি সমকালীন বিভিন্ন হিংসার ঘটনাকে দেখেছেন মুসলিম জনগোষ্ঠীর আধুনিকতা বিদ্বেষী মনোভাব ও আচরণের ফলশ্রুতি হিসাবে। যদিও হটিংটনের লেখা সারস্বত সমাজকে উদ্দেশ্য করে, তাই যুক্তিতর্কের বিধান তিনি মেনেছেন। কিন্তু তাঁর রচনার নির্যাসের সঙ্গে জিহাদি মুসলিম বা অন্যান্য মৌলবাদী ভাবধারার নৈকট্য চোখে পড়ার মতো। কারণ মৌলবাদীরাও মানুষের বহুমাত্রিক পরিচিতি মুছে দিয়ে তাকে একমাত্রিকতায় বেঁধে রাখতে চায়। অমর্ত্য সেন কলম ধরেছেন এই একক পরিচিতি ভিত্তিক তত্ত্বের বিপ্রতীপে বহুমাত্রিক পরিচিতির যৌক্তিক কাঠামো নির্মাণ করতে।
এরপর প্রশ্ন ওঠে এই বহুমাত্রিক পরিচিতির নিরিখে জননীতির চেহারা কী হবে? লেখক বইটিতে সে ব্যাপারে কিছু দিক নির্দেশিকা দিয়েছেন। তিনি সরকারি অর্থ সাহায্যে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, শিখ প্রভৃতি ধর্ম সম্প্রদায়ের জন্য স্কুল নির্মাণ ও তার পরিচালনার বিরুদ্ধে। কারণ এসব স্কুলের পাঠক্রমের মধ্যে সাধারণত ছাত্রছাত্রীদের বহুমাত্রিক পরিচিতিকে গৌণ করার প্রয়াস থাকে। এর ফলে তাদের সার্বিক মানবিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। দ্বিতীয়ত, কোনও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সুধী সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রতিনিধিত্ব কম আছে – এই আছিলায় – তাদের ধর্মগুরুদের সেই সমাজের মুখপাত্র হিসাবে মান্যতা দেওয়াকে লেখক ভুল বলে মনে করেন। কারণ এই ধর্মগুরুরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অনুগামীদের একমাত্রিক পরিচিতিকে নিরঙ্কুশ মনে করে।
তবে ‘পরিচিতি ও হিংসা’ র পাঠ শেষ করার পর একটা প্রশ্ন মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারে। মানুষের কেন বহুমাত্রিকতা থেকে একমাত্রিকতায় স্খলন হয়? এই স্খলনের ধাপগুলি কী? অমর্ত্য সেন যেন বোঝাতে চেয়েছেন এই স্খলন সাময়িক। সত্যিই কী তাই? আমাদের দেশে বিগত এক দশক ধরে যে হিন্দুত্বের আস্ফালন চলছে তা নিশ্চিতভাবেই বহুমাত্রিকতা থেকে একমাত্রিকতায় অবনমন। এটা কী নেহাতই সাময়িক! নাকি এই অবনমনের পথরেখা তৈরি করেছে আমাদের মজ্জাগত বিশ্বাস, যা যুক্তির শৃঙ্খলাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে। প্রশ্নটা সহজ হলেও উত্তর অজানা।