“জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের” — সুবর্ণরেখা 

অদ্রিজা কারক 

‘সুবর্ণরেখা’ আসলে ইতিহাসের সঙ্গে ঋত্বিকের চুক্তিপত্র। কাহিনীর অন্তঃস্থলে ঋত্বিক যেন জীবনের অবিশ্রান্ত যাত্রার মন্তাজ আঁকতে চেয়েছেন এই সিনেমার মধ্য দিয়ে। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পায় ‘সুবর্ণরেখা’। 

রবীন্দ্রনাথের ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটি ঋত্বিককে আজীবন ‘নতুন বাড়ি’-র স্বপ্ন দেখিয়েছে। যা তাঁর একান্ত ঈপ্সিত। এই ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটিই ‘সুবর্ণরেখা’ সিনেমাটির অবয়ব নির্মাণ করেছে। এই ‘নতুন বাড়ি’-র খোঁজ যেন ঋত্বিকের দৈনন্দিন খুঁজে চলার অংশ হয়ে উঠেছে। এই খোঁজ, সত্তার খোঁজ, পরিচিতির খোঁজ। দেশভাগের প্রভাবে এক লহমায় ভূমিহীন, পরিচিতিহীন হয়ে যাওয়া জাতির প্রতিনিধি হয়ে ঋত্বিক যেন ‘শিশুতীর্থ’-এ ভর করে প্রতিনিয়ত খুঁজে চলেছেন তাঁর নতুন আশ্রয়, নতুন পরিচিতি। 

‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটি প্রকৃতপক্ষে আমাদের এক যাত্রাপথের দিক্-নির্দেশনা দেয়। যে যাত্রার যাত্রী সমগ্র সভ্যতা। সেই সভ্যতার ‘আলোর পথযাত্রী’ হয়ে উঠবার আখ্যানই হল ‘শিশুতীর্থ’। ঋত্বিকও তাঁর সিনেমার মধ্য দিয়ে একইভাবে নিরন্তর ‘আলোর পথযাত্রী’-দের আখ্যান বর্ণনা করেছেন। ‘সুবর্ণরেখা’ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র দেশভাগ‌। দেশভাগের কারণেই সিনেমার চরিত্রগুলির আখ্যান সূচনা হয়েছে। সিনেমাটির গভীরে অনুসন্ধান চালালে দেখতে পাই, আলোর দিকে এই যাত্রার সাক্ষী হয়েছে সমস্ত চরিত্রগুলিই এবং আমাদের অজানতেই ঋত্বিক সেই যাত্রায় সঙ্গী করে তুলেছেন আমাদেরও। 

“রাত কত হল?/ উত্তর মেলে না।” 

‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটির এই প্রথম দুটি চরণ ‘হরপ্রসাদ’ চরিত্রের মুখে ফিরে এসেছে বারবার। বিজন ভট্টাচার্য অভিনীত ‘হরপ্রসাদ’ চরিত্রটির যাত্রা এখানে একেবারে ভিন্নধর্মী। সিনেমাটির প্রথম দিকে আমরা দেখি, হরপ্রসাদ এমন একটি চরিত্র কোনও সংকটই যাকে আদর্শের পথ থেকে স্খলিত করতে পারে না। সন্তানদের ‘খাব, খাব’ চিৎকার শুনে আত্মহত্যা করা স্ত্রীর মৃতদেহ দাহ করে দুই অভুক্ত শিশুর হাত ধরে তিনি বলতে পারেন, 

“অন্ধকারই শেষ হতে পারে না, আমি আলো খুঁজতে যাচ্ছি।” 

আবার এই হরপ্রসাদই পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোন, 

“গড্ডলিকা প্রবাহই সত্য, ভোগই মুক্তির পথ।” 

এই হরপ্রসাদের কণ্ঠেই ঋত্বিক অন্ধকার থেকে যাত্রা শুরুর ইঙ্গিত দিয়ে যান ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটির ওই দুটি চরণের মাধ্যমে। যে পথের শেষ কোথায় তা অনির্বচনীয় হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে। এই অসীমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেই হরপ্রসাদ চেয়েছে তার এতদিনকার সমস্ত আদর্শ বিস্মৃত হয়ে ভোগের জগৎএর স্বাদ নিতে। অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে এই যাত্রাকেই রবীন্দ্রনাথ ধরে রেখেছেন তাঁর কবিতায় — 

“রাত কত হল?                                                                                                                              উত্তর মেলে না।                                                                                                                           কেননা, অন্ধ কাল যুগযুগান্তরের গোলকধাঁধায় ঘোরে,                                                                               পথ অজানা —                                                                                                                              পথের শেষ কোথায় খেয়াল নেই।” 

সিনেমার একেবারে শেষ ভাগেও ঈশ্বরের যাত্রাপথের সাক্ষী হয় হরপ্রসাদ। সীতার আত্মহত্যার সমস্ত দায় ঈশ্বর মাথা পেতে নিলে হরপ্রসাদ ঈশ্বরের ‘realization’-কে মিলিয়ে দিয়েছেন ‘শিশুতীর্থ’-এর যাত্রাপথের অন্তিমের শেষ দ্বারোদ্ঘাটনকে। যে দ্বারের ওপারে শুধুই আলো, শুধুই পবিত্রতা, যেখান থেকে স্খলিত হবার ভয় নেই। তাই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে হরপ্রসাদ বলেন, 

“ক্ষুদিরাম নিজের গলায় হাসতে হাসতে দড়ি পরিয়ে দিয়েছিল। তার জানা ছিল, সে কী? সেই ছিল তার মেরুদণ্ড। আর আজ আমরা এই ক্ষুদিরামের দল, আমরা জানিই না যে আমরা কী? তাই লড়াই করাকে মনে করি মার খাওয়া। আর শহিদ হওয়াকে বলি পথকুকুরের মৃত্যু। ঈশ্বর এটা রিয়েলাইজ করেছে। তাই বলছে আর কি — মাতা, দ্বার খোলো।” 

সমাজের ক্রমশ অবক্ষয়ের কারণে জনগণের একান্ত নিজস্ব সত্তা বিপন্ন। দেশভাগ সমস্ত শ্রেণিভেদে এক লহমায় সবার সত্তাকে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে ওঠবার স্বকীয়তা হারিয়েছে তারা। এভাবেই হরপ্রসাদ বারবার ‘শিশুতীর্থ’-এর চরণগুলি উদ্ধৃত করে যেন আলোর দিকে যাত্রার দৃশ্যকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছেন। 

‘শেষের কবিতায়’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : 

“কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।                                                                                                  তারি রথ নিত্যই উধাও                                                                                                              জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,                                                                                                চক্রেপিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।”

মহাকালচেতনার গভীর নির্জন পথে রবীন্দ্রনাথ অন্ধকারের উৎস সন্ধানে নিমগ্ন হয়ে থেকেছেন। মহাকালেই কবি খুঁজতে চেয়েছেন অবক্ষয়ের ইঙ্গিত। তাই কবির  মনে হয়েছে মহাকাল যেন সৃষ্টির আদিকালকে ছুঁয়ে উগ্রচণ্ডা লোলজিহ্বা মহাকালীর প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। তিনি লিখছেন, 

“দিগন্তে একটা আগ্নেয় উগ্রতা                                                                                                               ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে আর নেভে —                                                                                                               ও কি কোনও অজানা দুষ্টগ্রহের চোখ-রাঙানি!                                                                                          ও কি কোনও অনাদি ক্ষুধার লেলিহ লোল জিহ্বা!” 

রবীন্দ্রনাথের এই মহাকালের ধারণাকে ঋত্বিক তাঁর সিনেমাতে যেন রক্তমাংসের রূপ দিয়েছেন। ‘সুবর্ণরেখা’ সিনেমার একটি দৃশ্যে আমরা দেখি, কিশোরী সীতার সামনে হঠাৎ বজ্রপাতের মতো চলে আসে ‘মহাকালী’রূপী এক বহুরূপী। সীতার আজীবন ঈপ্সিত যে মন্ত্রোচ্চারণ গান, ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায়’, তার দৃশ্যায়নের পরেই আবির্ভাব হয় ঐ বহুরূপীর। মহাকাল যেন চোখে আঙুল দিয়ে সীতার করুণ পরিণতির দিক্-নির্দেশ করে দিয়ে যান। 

‘শিশুতীর্থ’-র যাত্রাপথ আসলে যেন ‘ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা’-র মতোই। সত্তার অভিমুখে ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়েই অথচ নিরবচ্ছিন্ন নয়, বিক্ষিপ্ত তার চলন। সভ্যতার অন্ধকারই বারবার ইতিহাসের চলাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে কিন্তু তা সত্ত্বেও চলন থামেনি। ‘সুবর্ণরেখা’র কাহিনিও এই আলো-অন্ধকারের মধ্য দিয়ে বয়ে চলার কথা বলে। এই চলার পথের পেছনে ফেলে আসা সভ্যতা ধীরে ধীরে পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। রবীন্দ্রনাথ তাই লিখছেন : 

“বিক্ষিপ্ত বস্তুগুলো যেন বিকারের প্রলাপ,                                                                                           অসম্পূর্ণ জীবলীলার ধূলিবিলীন উচ্ছিষ্ট —                                                                                          তারা অমিতচারী দৃপ্ত প্রতাপের ভগ্ন তোরণ,                                                                                          লুপ্ত নদীর বিস্মৃতিবিলগ্ন জীর্ণ সেতু,                                                                                              দেবতাহীন দেউলের সর্পবিবরছিদ্রিত বেদী,                                                                                      অসমাপ্ত দীর্ণ সোপানপঙক্তি শূন্যতায় অবসিত।” 

এ যেন স্পষ্টতই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের চিত্র এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। ঋত্বিক এই ধ্বংসাবশেষের চিত্র অঙ্কন করেছেন সুনিপুণ দক্ষতায়। ঈশ্বরের ঘাটশিলার বাসস্থানের পাশে ব্রিটিশ নির্মিত এক ভগ্নস্তূপ এরোড্রামের দৃশ্যকল্প নির্মাণ করেছেন পরিচালক। ঐ ভগ্নস্তূপের ভাঙা এরোপ্লেন, পাইলটদের ক্লাবঘর এসবই যেন একইসঙ্গে প্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্বের এবং নিশ্চিহ্ন হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। নির্মাতার মুন্সিয়ানা এখানেই যে, ঐ ধ্বংসস্তূপকে তিনি অবলীলায় দৃশ্যায়িত করেছেন সীতা-অভিরামের খেলার জায়গা হিসেবে। এখানেও তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন সেই অমোঘ সত্য — সভ্যতা নিশ্চিহ্ন হয় না, রূপান্তর ঘটে মাত্র। 

“পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী।                                                                                     হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।                                                                                 দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে                                                                             সঙ্কটদুঃখত্রাতা।” 

যুগে যুগে অসীম যাত্রার আরাধনাকেই তো শাশ্বত মানতে চেয়েছেন কবি। রবীন্দ্রনাথ নিরন্তর যাত্রাপথের অন্তিমের আলোকবর্তিকার সন্ধান করেছেন। ঋত্বিকও একইভাবে তাঁর সিনেমায় নিরন্তর সন্ধান চালিয়েছেন প্রভাতের সেই রবিরশ্মির। তাই সিনেমার প্রথমেই সীতা গ্রাম ছেড়ে আসার পর তার ‘নতুন বাড়ি’ খোঁজে। ‘নতুন বাড়ি’-র এই খোঁজ সিনেমা জুড়ে নিরন্তর ব্যতিব্যস্ত করে তোলে আমাদেরও। সভ্যতার রূপান্তর সূত্র অক্ষুণ্ণ রেখে সীতা ও অভিরামের ছেলে বিনুও একইভাবে খুঁজে পেতে চায় তার স্বপ্নের বাড়িকে। ঈশ্বরের কাছে যেন ‘নবজাতক’ হয়ে বিনুই ধরা দিয়েছে। আর বিনুর খোঁজ জারি রয়েছে তার আজন্ম ঈপ্সিত ‘নতুন বাড়ি’-র জন্য। আর এই খুঁজে চলার সাক্ষী থেকেছে রবি ঠাকুরেরই গান — 

“আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই,                                                                  লুকোচুরি খেলা।” 

এ গানই যেন পথশেষের প্রাপ্তির বর্ণনা দেয় এই চলচ্চিত্রে। যেন মনে হয়, এর জন্যই এত পথ হাঁটা যুগ-যুগান্তর ধরে। ঈশ্বর অবশেষে সেই পথশেষের সূর্যটুকু খুঁজে পায় বিনুর মুখের ‘মামা’ সম্বোধনে। সে শত অবক্ষয়ের মাঝেও নতুন করে বাঁচার স্বাদ পায়। অলক্ষ্যে কেউ যেন তাকে সোচ্চার সাবধানবাণী দেয় — 

“মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ” 

তাই আবারও জীবনে বিশ্বাসী হয়ে বিনুর হাত ধরে সে এগিয়ে যায় অনন্ত মহাজীবনের পথে। পথের অন্তিমে থাকা দ্বারের ওপারের পৃথিবীর সন্ধান সে পায়। এইখানেই যেন আরও বেশি করে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান রবীন্দ্রনাথ ও ঋত্বিক। দুজনেই যেন সমস্বরে বলে ওঠেন — 

“সকলে জানু পেতে বসল —                                                                                                               রাজা এবং ভিক্ষু, সাধু এবং পাপী, জ্ঞানী এবং মূঢ় —                                                                            উচ্চস্বরে ঘোষণা করলে —                                                                                                                  ‘জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের!’ ” 

সত্তাভিমুখী সভ্যতার অনুসরণের এই যাত্রাপথের শেষে প্রতিবারের মতোই নতুন সভ্যতা রচনার রসদ খুঁজে নেন ঋত্বিক। অনন্ত এই খোঁজ, অনন্ত এই যাত্রাই ঋত্বিকের শিল্পসৃষ্টিকে অবয়ব দিয়েছে বারবার। এখানেই তাঁর সত্তার খোঁজের সার্থকতা।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান