জীবনানন্দ, অস্তিত্ববাদ ও রবীন্দ্রনাথের ‘ফাল্গুনী’ : কিছু বিচ্ছিন্ন সংলাপ 

শুভদীপ সরকার 

 

“দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয়…” 

কেউ কাউকে তেমন করে আর ধরে রাখতে চাইছে না। গ্রহগুলোও চাইলে ছিটকে যেতে পারে। নিজেদের কক্ষপথ তৈরি করতে পারে। অন্তত করাটাই স্বাভাবিক।  গ্রহদের আবর্তনের সঙ্গেই আমরা সেই হাজার বছর ধরেই পাল্লা দিয়ে পালাচ্ছি। এই পালানোর শেষ নেই। কেবলই শুরু আছে। আমরা যখন ছিলাম না কিংবা কিছুদিন পর যখন থাকব না তখন আমাদের আজকের এই থাকাটার মানে খুঁজতে গিয়ে নিদারুণ ক্লান্ত হচ্ছি। হাজার হাজার বছর আমরা পথ হেঁটে চলেছি এই মানেটাকে খপ করে ধরার জন্য। কিন্তু  আমাদের নাকি কোনও প্রি-এক্সিস্টেন্ট বেঁচে থাকার মানে নেই! জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এরকম কোনও মানে আদপে কেউ তৈরি করে দেয় না! এই স্বস্তির জগৎ থেকে যখন আমরা বিচ্যুত হয়েছি তখন সিসিফাসের অভিশাপ আমাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়েছে। এক ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে আমাদের জীবন সদৃশ পাথরকে কেবলই ওপরে তুলে চলেছি।  যতই তুলি না কেন আবার সে নীচেই গড়িয়েই আসে। নীচে আসাটাই তার দস্তুর। 

‘হায় চিল’ কবিতায় প্রথমে চিলটি কাঁদতে কাঁদতে ওড়ে — “তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!” আমরা বুঝতে পারি এখানে চিলের কান্নাটা প্রাইমারি। কবিতার শেষে গিয়ে তা উলটে যায় — “তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে” — আমরা ক্রমশ একটা লুপ কল্পনা করে নিতে পারি। এখন কান্নাটা সেকেন্ডারি। এই লুপের আবর্তনটাই মুখ্য। এর থেকে মুক্তি নেই তবে!  “অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় — / আরো-এক বিপন্ন বিস্ময় / আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে; / আমাদের ক্লান্ত করে” —  লোকটার সব ছিল — “বধূ শুয়েছিলো পাশে — শিশুটিও ছিলো; প্রেম ছিলো, আশা ছিলো” তবু “কাল রাতে — ফাল্গুনের রাতের আঁধারে / যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ / মরিবার হ’লো তার সাধ”; কেন মরতে চায় লোকটা? এই নিরন্তর আবর্তনে কোনও মানে খুঁজে পায় না তাই? যখন সে হঠাৎ মুছে যাবে তখন ১০০ বছর পর তার অস্তিত্ব আর কেউ মনে রাখবে না বলে? সিসিফাস কিংবা ইডিপাসেরও কি এই মৃত্যুর স্বাদ জেগেছিল? 

সিসিফাসের কাছে সেদিন পাহাড় চূড়া থেকে ঝাঁপ দেবার চয়েস ছিল। ইডিপাস যে ছুড়ি দিয়ে নিজের দৃষ্টিশক্তি অন্ধ করেছিল সেই একই ছুড়ি নিজের হৃদয়ে বিদ্ধ করতে পারত। এই স্বাধীনতা, আত্মহত্যার অধিকার, সাধ সবই সেদিন তাদের জন্য মজুত।  তাদের জীবনের মানে, বিস্ময় সবই  চূড়ান্ত ভাবে বিপন্ন সেদিন। “সিন্ধুশব্দ বায়ুশব্দ রৌদ্রশব্দ রক্তশব্দ মৃত্যশব্দ এসে / ভয়াবহ ডাইনীর মতো” তাদেরও তো ভয় দেখিয়েছিল। 

কিন্তু এই মানে-হীনতার যন্ত্রণা থেকেও তারা কি সেদিন কোনও মানে খুঁজে পেয়েছিল? যতবার পাথর গড়িয়ে পড়ত তাকে আবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তোলার উদ্যম কোথায় পেত সিসিফাস? ইডিপাস তারই মাতৃগর্ভজাত সন্তানের স্পর্শে জীবনের কোন্ মানে খুঁজে পেয়েছিল? কিংবা মৃত্যু শব্দের এত আয়োজনের মধ্যে ইতিহাসযান কবিতার শেষে গিয়ে জীবনানন্দ কীভাবে বলতে পারেন — “এর পর আমাদের অন্তর্দীপ্ত হবার সময়”? কিংবা “নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো / এখনো নারী মানে তুমি”? 

কাম্যু বলেছিলেন “There is but one truly serious philosophical problem and that is suicide”। না এলেই ভালো হত অনুভব করতে করতেই আরও গভীরতর লাভের সন্ধান পেয়ে যাই আমরা। সবাই নয়। কেউ কেউ নিশ্চয়ই। আত্মঘাত থেকে এই যে জীবনের তটে উঠে আসার আপ্রাণ লড়াই এটাই কি তবে আমাদের জীবনের মানে। কোনও দেবতা নয় ঈশ্বর নয়, সুপ্রিম ফোর্স নয় আমরাই আমাদের জীবনের একমাত্র নিয়ন্তা এটাই কি আমাদের জীবনের মানে? রণরক্ত সফলতা সত্য কিন্তু বর্মের ভার যে আমাদের হাতেই এটাই কি তবে জীবনের মানে? 

 

সমাজ এবং সাহিত্য, এদের কে কাকে কতটুকু প্রভাবিত করে, কার অধিকার বেশি এ নিয়ে আলোচনা দীর্ঘকালের। আর এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতেই উদ্ভব বেশ কিছু সাহিত্যিক মতবাদেরও। সমাজের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন পরিস্থিতি এবং যুগরুচি সাহিত্যকে বেশ কিছু পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি এই সমস্ত  সাহিত্যিক মতবাদগুলিও সাহিত্যের বিশেষ এক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। সাধারণত এই সকল সাহিত্যিক মতবাদগুলির জন্ম হয়েছে কোনও এক বিশেষ দার্শনিক পরিমণ্ডলে এবং পরে তা সাহিত্যিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহণ করেছে। ফরাসি তথা ইউরোপীয় শিল্প ও সাহিত্যে বিশ শতকের ২০ ও ৩০-এর দশকে সাড়া ফেলেছিল এরকমই এক সাহিত্যিক মতবাদ ‘পরাবাস্তবতাবাদ’ বা ‘surrealism’। যদিও ‘সুররিয়ালিজম’ শব্দটি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি কবি গিইয়োম আপলিনের প্রথম ব্যবহার করেন, তবে সাহিত্য শিল্পের ক্ষেত্রে এই আন্দোলন শুরু করেন আঁদ্রে ব্র্যতঁ। ব্র্যতঁ ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ডাডাবাদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে রচনা করেন  ‘manifeste du surrealisme’ (১৯২৪)। বাস্তবতার সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াসকেই আপলিনের সুররিয়ালিজম বলে চিহ্নিত করেছেন। বাংলার প্রতিশব্দে এইজন্য একে অধিবাস্তববাদ বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। যুক্তির অনুশাসনের বাইরে যে এক মগ্নচৈতন্যের অধিবাস্তব জগৎ রয়েছে, সেই জগৎ-এর রহস্য যথাযথভাবে তুলে ধরাই ছিল ‘surrealist’ আন্দোলনের লক্ষ্য। ব্র্যতঁ প্রস্তাবিত পরাবাস্তববাদী আলোচনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ফ্রয়েডের স্বপ্নমনস্তত্ত্ব বিষয়ক পর্যবেক্ষণসমূহ ও তাঁর অবচেতন মনের ধারণাকে। ব্র্যতঁরা বললেন যে স্বপ্নে যেমন অর্ধচেতন ও অবচেতন জগৎ ধরা পড়ে নানা এলোমেলো চিত্রে, তেমনই সাহিত্য যদি প্রকৃত বাস্তবকে তুলে ধরতে চায় তাহলে তাকেও চেতন মনের যুক্তি শৃঙ্খল কাটিয়ে হতে হবে স্বতঃব্যক্ত বা autometic রচনা। যেখানে চিন্তা, কল্পনা, স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার। এই চিন্তাধারায় শামিল হয়ে কবিতা তথা শিল্পের আঙ্গিকগত নানা পরিবর্তন লক্ষ করা যেতে লাগল। যুক্তিনির্ভরতার পরিবর্তে আবেগই হল শব্দ, প্রতীক ও চিত্রকল্প ব্যবহারের ধারক। স্বপ্নের slide show-এর মতো একটি প্রতীক বা ছবি অন্যটিকে replace করতে লাগল। আর সব মিলিয়ে তৈরি হল এক অন্য বাস্তবতা। অনুষঙ্গ ও ইঙ্গিতের সমন্বয়ে গড়ে উঠল নতুন অর্থময়তা। 

এই যে প্রাতিষ্ঠানিক কোনও নিয়মের বন্ধন স্বীকার না করে নিজের সৃষ্টিকে তার প্রবণতা অনুসারে তৈরি হতে দেওয়া এটা একদিক থেকে আধুনিকতারই অন্যতম শর্ত। আর নিজের সময়ে রবীন্দ্রনাথের থেকে বড়ো আধুনিকমনস্ক বোধহয় খুব কম ব্যক্তিত্বই ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যে বিশেষত নাটকে বাস্তবের প্রতিরূপ নির্মাণে কোনও দিন স্বস্তিবোধ করেননি। অন্যদিকে বিশশতকের শুরু থেকেই কবিতা ও চিত্রকলার হাত ধরে ইউরোপের নাটকে যে বাস্তবকে অস্বীকার করার প্রবণতা এসেছিল তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ছিল না এমন ভাবারও কোনও কারণ নেই। একাধিকবার ইউরোপে গেছেন তিনি, ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ভ্রমণের সূত্রে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। ১৯১৩-এর পর থেকে রবীন্দ্রনাথ একজন আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক ও ভাবুক। তবে পরাবাস্তবতাবাদ বা সুররিয়ালিজম এই নির্দিষ্ট ফ্রেমে হয়তো রবীন্দ্রনাথ ‘ফাল্গুনী’ নাটক লেখার সময় পরিচিত ছিলেন না। কারণ ‘ফাল্গুনী’ নাটক গ্রন্থরূপে প্রকাশ পাচ্ছে ১৯১৬-তে। আর ১৯১৭-তে গিইয়োম শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করছেন। আসলে সাহিত্য আগে না তত্ত্ব আগে এই বিতর্কের এটা একটা উত্তর হতে পারে। একজন স্বতঃস্ফূর্ত সাহিত্যকের, শিল্পীর যা কাজ রবীন্দ্রনাথ আজীবন তাইই করে গেছেন। সেই সাহিত্যের বিভিন্ন কোণে রয়ে গেছে যে ভাবনা তাই পরবর্তীকালে হয়তো ভিন্ন দেশে ভিন্ন সময়ে কোনও মতবাদের রূপ লাভ করেছে। পরবর্তী সময়ে সমালোচকেরা সেই মতবাদের দৃষ্টিতে তাঁর সাহিত্যকে বিচার করেছেন কিংবা উলটোটা। এক্ষেত্রেও আমরা খানিকটা সেরকম কাজই করব। 

‘সূচনা’-অংশ এবং ‘গীতিভূমিকা’ বাদ দিলে ‘ফাল্গুনী’ নাটকটি চারটি দৃশ্যে বিভক্ত। প্রথম দৃশ্যের নাম ‘সূত্রপাত’, দ্বিতীয় দৃশ্যের নাম ‘সন্ধান’, তৃতীয় দৃশ্যের হল ‘সন্দেহ’, আর চতুর্থ দৃশ্য ‘প্রকাশ’। প্রথম দৃশ্যের পটভূমি পথ, দ্বিতীয় দৃশ্যের ঘাট, তৃতীয় দৃশ্যের ঘটনা ঘটছে মাঠে আর চতুর্থ দৃশ্যের গুহাদ্বারে। ঠিক slide show-এর মতো একটি দৃশ্য অন্য একটি দৃশ্যকে replace করতে করতে এগিয়ে চলেছে। এবং আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যগুলি কোনও যৌক্তিক পারম্পর্যে সম্পর্কযুক্ত নয়। চারটি দৃশ্যে বিন্যস্ত এই নাটকে আমরা সেই অর্থে কোনও একটি নির্দিষ্ট কাহিনি কাঠামোকেও দাঁড় করাতে পারব না। নাটকটির গ্রন্থপরিচয় অংশে আমরা দেখছি নাটকটি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশ হচ্ছে। এর সূচনা অংশ ‘বৈরাগ্যসাধন’ শিরোনামে সবুজপত্রের ১৩২২ সালের মাঘ সংখ্যায় মুদ্রিত হয়। মূল নাটকটি আগেই ১৩২১ সালের চৈত্র মাসে সবুজপত্রে মুদ্রিত হয়েছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে মূল নাটকটি প্রকাশ হবার দীর্ঘ দশ মাস পরে রবীন্দ্রনাথ এই সূচনা অংশটি লেখা জরুরি মনে করলেন কেন? ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এবং ৩১ জানুয়ারি বাঁকুড়ার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য ‘ফাল্গুনী’ নাটকের দুটি অভিনয়ের ব্যবস্থা করা হয়। এক সন্ধ্যার দর্শকদের পক্ষে মূল নাটকটি ছোটো হয়ে যাচ্ছে বলে রবীন্দ্রনাথ তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক একটি সূচনাপর্ব জুড়ে দেবেন বলে স্থির করেন — “ভাবচি ফাল্গুনীরই একটা Introduction গোছের Scene জুড়ে দেব — সেটা ছোট হবে — তাতে মেয়ে থাকবে না — আর যারা দেরিতে আসবে তাদের Disturbance ঐটের ওপর দিয়েই যাবে। এটা রাজা রাজসভাসদদের ব্যাপার হবে” (রবীন্দ্রবীক্ষা ১৪, ৪০, পত্র ১২)। এখান থেকে অনুমেয় যে নিতান্তই প্রয়োজনের খাতিরে তিনি সূচনা অংশটি লিখেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি এতটাও সরল নয়। আলোচ্য নাটকটির অর্থ বুঝতে অসুবিধা হতে পারে বলে তিনি মনে করছিলেন, এবং হয়তো এই নাটকের বিষয়ের সঙ্গে প্রতিদিনকার জীবনের কোনও সম্পর্ক না থাকার অভিযোগ উঠতে পারে বলে মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই রবীন্দ্রনাথের রচনার দুর্বোধ্যতা নিয়ে অভিযোগ উঠতে শুরু করে। শুরু হয়েছিল সাহিত্যের সঙ্গে বাস্তবতা ও নীতির সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক, যার কেন্দ্রে ছিল রবীন্দ্রভাবনার সমালোচনা। বিপিনচন্দ্র পালের ‘সাহিত্যে বস্তুতন্ত্রতা’ (বঙ্গদর্শন/বিজয়া অগ্রহায়ণ ১৩১৯), রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের ‘লোকশিক্ষক’ বা ‘জননায়ক’ (প্রবাসী জ্যৈষ্ঠ ১৩২১) , ‘সাহিত্যে বাস্তবতা’ (সবুজপত্র মাঘ ১৩২১), রবীন্দ্রনাথের ‘বাস্তব’ (সবুজপত্র শ্রাবণ ১৩২১) প্রভৃতি রচনা এই বিতর্কেরই ফসল। ‘বাস্তব’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক নিয়ে যা বলছেন তা এখানে ভীষণভাবেই প্রাসঙ্গিক — “কবি যদি একটি বেদনাময় চৈতন্য লইয়া জন্মিয়া থাকেন, যদি তিনি নিজের প্রকৃতি দিয়াই বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবপ্রকৃতির সহিত আত্মীয়তা করিয়া থাকেন, যদি শিক্ষা অভ্যাস প্রথা শাস্ত্র প্রভৃতি জড় আবরণের ভিতর দিয়া কেবলমাত্র দশের নিয়মে তিনি বিশ্বের সঙ্গে ব্যবহার না করেন, তবে তিনি নিখিলের সংস্রবে যাহা অনুভব করিবেন তাহার একান্ত বাস্তবতা সম্বন্ধে তাঁহার মনে কোন সন্দেহ থাকিবে না।” বেশ বোঝা যায় বাস্তব শব্দটিকে একটি প্রসারিত অর্থে ধরছেন রবীন্দ্রনাথ যা কিনা বিপিনচন্দ্র পাল রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের বাস্তবের ধারণা অপেক্ষা আলাদা। ‘ফাল্গুনী’-র মধ্যে আসলে সেই রাবীন্দ্রিক বাস্তবতারই প্রকাশ, যা আমাদের প্রতিদিনকার বাস্তবতার খোলস ছেড়ে প্রকাশ করে অন্য কোনও ব্যাপ্ততর বাস্তব, অধিবাস্তব। সে বাস্তবের মধ্যে আসলে নিজের প্রকৃতি দিয়ে বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবপ্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করার চেষ্টা আছে। 

গল্পের নির্যাসে তাই এই বাস্তবতার সন্ধানেই খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে যায় পরাবাস্তবতার মায়াজাল।  নাটকটির শুরুতেই এক অভিযানের কথা। যুবকদল বেরিয়ে পরেছে মান্ধাতার আমলের বুড়োকে ধরতে। সেই বুড়োর অন্তরালে চিরনবীন লুকিয়ে আছে। চন্দ্রহাসের দল তা সঠিক ভাবে না জানলেও সর্দার তা জানে। সেই জন্যেই সর্দার তাকে নিয়ে বসন্ত উৎসব করতে চায়। সর্দারকে বিশ্বাস করে চন্দ্রহাসের দল তাই বুড়োর সত্য আবিষ্কারে পথে বেরিয়েছে। কিন্তু এই আদ্যিকালের বুড়োকে ধরা সহজ নয়। শীতের মতো সে পালিয়ে বেড়ায় — 

        “বালক।। আমি পারলুম না। কিছুতে তাকে ধরতে পারলুম না।

        কাকে ভাই।

        বালক।। ওই তোমরা যে বুড়োর খোঁজ করছিলে তাকে।

        তাকে দেখেছ নাকি।

        বালক।। সে বোধ হয় রথে চড়ে গেল।

        কোন দিকে।

         বালক।। কিছুই ঠাওরাতে পারলুম না। কিন্তু, তার চাকার ঘূর্ণিহাওয়ায়  এখনো  ধুলো উড়ছে।”  

শেষে এক অন্ধ বাউল তাদের পথের সন্ধান দেয়। কিন্তু অন্ধ বাউলকে সঙ্গে নিয়ে যুবকদলকে ছাড়িয়ে বুড়োর সন্ধানে গুহার উদ্দেশ্যে চন্দ্রহাস নদীর ওপারে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে বাউল ফিরে এলেও চন্দ্রহাস ফেরে না। অনেক পরে চন্দ্রহাস ফিরে আসে। বলে যে সে বুড়োকে দেখেছে। সে এখনই আসবে। দেখা গেল গুহা থেকে কেউ একজন বেরিয়ে আসে। সে সর্দার ছাড়া আর কেউ নয়। তাকে এখন বালক মনে হচ্ছে। চন্দ্রহাসের হার হল। বুড়োকে সে ধরতে পারল না। বুড়োর অস্তিত্বই যে নেই। দূর থেকে যাকে জরা মৃত্যু বলে মনে হয় কাছে গেলে তারই বালক রূপ চোখে পড়ে। জীবনের অখণ্ড প্রবাহে যৌবন চিরন্তন। বার্ধক্য জীবনের একটা ছদ্মবেশ মাত্র — সেটাকে খসিয়ে দিলেই মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে নতুন জীবন। 

গল্পের এই যে নির্যাস তাকে আমাদের রোজকার বাস্তবতার মনন দিয়ে ধরতে গেলে পুরো বিষয়টিকেই অ্যাবসার্ড বলে মনে হবে। কিন্তু আমাদের চোখে দেখা বাস্তবই বাস্তবতার একমাত্র রূপ, তাতো নয়। বাস্তবের যে নিজস্ব একটা উদ্ভটত্ব আছে যা আমদের সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে তা আমরা ভুলে যাই। একজন শিল্পী তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত খুঁজতে চান। তারই মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার করতে চান জীবনের গভীরতর দিকটির। আলোচ্য নাটকটিতেও আমরা দেখতে পাই চারপাশের মৃত্যু জরার পরিবেশেও যৌবনের চিরপ্রবহমানতার গভীরতর সত্যকে ধরতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ রচনা করছেন এমন একটা জগৎ-এর যেখানে আমাদের প্রতিদিনকার যুক্তি শৃঙ্খলের আবরণ প্রায় নেই। আর নেই বলেই আমাদের যুক্তির সীমাবদ্ধতা সেই সত্য সন্ধানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। সেই অধিবাস্তবস্তার জগৎ-এর মায়াজালই পাঠককে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের গভীরতর সত্যের দিকে। আসলে এই নতুন জগৎ-এর প্রমাণ করবার কোনও দায় নেই। তার কাজ শুধু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। আর এখানেই আমাদের রোজকার যুক্তিবোধের জগৎ থেকে এই জগৎ-এর পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়। তাই যে বাস্তবতার জগৎ দিয়ে আমাদের গুহা থেকে সর্দারের বালক হয়ে বেরিয়ে আসাতে অস্বস্তি বোধ করি বোঝার চেষ্টা করি না আমাদের বাস্তবতার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে, সেই আমারাই কখন হারিয়ে যেতে থাকি এই ব্যাপ্ততর বাস্তবতার প্রকৃত স্বরূপকে বুঝতে পেরে। একজন ভালো শিল্পীর এর থেকে বেশি আর কিবা করার থাকতে পারে। রবীন্দ্রনাথ পেরেছেন। আমাদের দৈনন্দিন জগৎ-এর কৃত্রিম আবরণ সরিয়ে নতুন এক কোনও অধিবাস্তবের জগৎ রচনা করে আমাদের গভীরতর এক জীবন সত্যের কাছাকাছি টেনে আনতে। জীবনানন্দ তাঁর কবিতাতেও আসলে অনস্তিত্বের জগৎ ছেড়ে অস্তিত্বের এই জগৎ-এ বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন। বেশ বোঝা যায়। 

জীবনানন্দ যখন বলেন তাঁর নিজের মুদ্রাদোষে একা হয়ে যাবার কথা তখন তার মধ্যে কাব্যিকতা থাকলেও প্রতিবাদ আছে আরও বেশি করে। আমার মতো একমাত্র আমিই। যখনই এই কথাটা বলে দেওয়া হল তখনই বাকিদের চিন্তা মতাদর্শের বিরুদ্ধে একটা জোরালো লড়াই ঘোষণা করে দেওয়া হল। কিন্তু এই ব্যতিক্রমী ‘আমি’ রাজনীতির ময়দানে যখন শাসকের রূপ লাভ করে তখন সে আর একা থাকে না। মুদ্রাদোষের দোহাই দিয়েও নয়। কালে কালে একনায়কতন্ত্রের জসম তার শরীরে এসে মিশে তার কানে কানে বলে যায় ‘কে বলেছে তুমি একা?’ সেও কিছুক্ষণ বাদেই ভয়ানক ভাবে বুঝতে পারে যে সে একা নয়। একা হতে পারে না। তখন তার একা হবার প্রক্রিয়ায় যত রকমের সহায়ক উপকরণ থাকতে পারে সে মুছতে শুরু করে। তার নিজের সৎ প্রতিবাদী অতীত ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়া মাত্রই ছাত্রদের ক্যালানো ইত্যাদি ইত্যাদি উপকরণ আর কি। একা হওয়া যাবে না কোনও মতেই। নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে এমনটাই হয়ে আসছে। যখন প্রথম শুনেছিলাম যে বিড়ালের নটা জীবন তখন ভারি অবাক হয়েছিলাম। তখন বিষয়টাকে অতিলৌকিক অপেক্ষা ভয়ংকর ভাবে বাস্তবসম্মত মনে হয়েছিল। রাস্তায় বিড়ালের থেকে সবল প্রাণীর মৃতদেহ দেখলেও আমি কোনও দিন তেমনভাবে বিড়ালের মৃতদেহ দেখিনি। এই একটা কারণে এই প্রাণীটিকে আমি যুগপৎ ঘৃণা এবং সম্মান দুইই করি। অদ্ভুত রকমের ডিফেন্স মেকানিজ্ম এই প্রাণীটির। চট করে বোঝা যাবে না। আসলে বিড়াল ওই ভাবে বসে থাকে না চুপচাপ। নিজের বেঁচে থাকার প্রোবাবিলিটিকে বাড়িয়ে নেয়। এই ভড়ংটা ওর স্বাভাবিক। 

আমরা কেউই তেমনভাবে বিড়াল হতে পারব না। নটা জীবন ছিনিয়ে আনা একটা ভয়ংকর প্র‍্যাক্টিস। আমাদের লৌকিক জীবনের অতিলৌকিক স্তরে এই চিন্তন আমাদের ধারণার অতীত। তবু হেরে যেতে আমরা প্রত্যেকেই ভয় পাই ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ কার কাছে হারছি সেটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না। এই গুলিয়ে যাওয়াটার মধ্যেই জীবনের সব রহস্য আর তার সমাধান। এই সার সত্য জেনেছি। বিড়াল খুব পরিষ্কার তার থট প্রসেসে। তার চোখগুলো দেখলে বোঝা যায়। এটা ভাবলেই বেশ বোঝা যায় ‘তপস্বী’ আদতে বিড়ালের উপাধি, আর আমরা বিড়াল হতে পারব না। 

কবিতাতে আমরা “মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও” এইটুকু বলতেই পারি। অন্তত বললে তা দেখতে ভালো লাগে। বেশ নরম, কোমল, মোলায়েম। বৃষ্টির মতো। যারা বাস্তবিকই এই কাজটা করেন তারাও কবিতাই লেখেন। অক্ষরে নয় হয়তো। কিন্তু কবিতাই লেখেন। জীবন একেবারেই রবীন্দ্রনাথের ‘পত্রপুটে’র ৩ নম্বর কবিতার সেই পঙক্তির মতো — “ডান হাতে পূর্ণ কর সুধা / বাম হাতে চূর্ণ কর পাত্র”। জীবনানন্দ তবু জন্মে লাভই হয়েছে বলেছিলেন মনে আছে। মেঠো ময়দানে তিনি নয় তাঁর বোধ বলে ওঠে তাই — “মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়;” আমরা বরং বলি “মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।” 

সহায়কপঞ্জি : 

১। অশোক সেন, ‘রবীন্দ্রনাট্য পরিক্রমা, এ মুখার্জি, কলকাতা, ১৩৬৪ বঙ্গাব্দ 

২। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ‘রবীন্দ্রনাট্য পরিক্রমা, ওরিয়েন্ট বুক, কলকাতা, ১৩৬১ বঙ্গাব্দ 

৩। কুন্তল চট্টোপাধ্যায়, ‘সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, রত্নাবলী, কলকাতা, অক্টোবর ২০০৪  

৪। ড. দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্রনাট্য সমীক্ষা রূপকসাংকেতিক, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, জুন ২০০২ 

৫। প্রমথনাথ বিশী, ‘রবীন্দ্রনাট্য প্রবাহ, ওরিয়েন্ট বুক, কলকাতা, ১৯৬৬ 

৬। শান্তিকুমার দাশগুপ্ত, ‘রবীন্দ্রনাথের রূপকনাট্য, প্রজ্ঞা বিকাশ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০০৩ 

৭। সৌমিত্র বসু, ‘অন্য ভাবনায় রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুনী, বিদ্যা প্রকাশনী, বারাসাত, আগস্ট ২০১২

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান