তালিবানি শাসনে আফগান নারীর অস্তিত্ব-সংকট

সুকন্যা সরকার মিত্র

এক 

একটি মেয়ের জন্ম থেকে বড়ো হয়ে ওঠা, জীবন যাপন সবই নির্ভর করে সমাজের গঠন, কাঠামো ও প্রকৃতির ওপর। নারী নির্যাতন ও তার প্রতিকারের চেষ্টা, নারীর সমানাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আলোচনা, ভাষণ, অঙ্গীকারের অন্ত নেই কিন্তু আমাদের সমাজে নারীর অবস্থা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থেকে গেছে। আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের জন্ম মানে পরিবারের প্রতি ভয়, নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা, আর সারা জীবনের পরনির্ভরশীলতা। সমাজ নিজের প্রয়োজনে ছোটো খাটো পরিবর্তন এনে মেয়েদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দিলেও মূল কাঠামোতে কোনও পরিবর্তন আনতে পারে না,  বদলায় না  সমাজের মানসিকতাও। 

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষপ্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টায় নারীকে নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার থাকলেও তাকে সমানাধিকার দেওয়ার ভয় অবিরাম তাড়া করে বেড়ায়। স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে মেয়েদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা তাই প্রায় একই রকম। নারীর স্থান পুরুষের পরেই থেকে গেছে প্রাচীনকাল থেকে। নারীর প্রাণান্তকর চেষ্টা সত্ত্বেও, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তথাকথিত রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করা সত্ত্বেও তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা, তাঁদের দাবিকে আজও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। কারণ নারী শোষিত, উপেক্ষিত, নিষ্পেষিত এবং অবদমিত। এই বিষয়টি সর্বকালের সর্বজনস্বীকৃত। নারীর শোষণ ও লাঞ্ছনা, নারীর মেধার অবমূল্যায়ন এবং নিষ্ঠুর লিঙ্গ-বিভাজন নারী জাতির কাছে দেশ-কাল নির্বিশেষে একটি জ্বলন্ত সমস্যা। 

নারীবাদকে নানা অছিলায় পদদলিত করে আসছে যত সমাজ তার অন্যতম হল আফগান সমাজ। এই সমাজে — 

একজন শিক্ষিত নারী কখনও বেতনভুক সরকারি কর্মচারী হবার যোগ্য দাবিদার নয়।

একজন শিক্ষিত নারী কখনও কোনও সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য হতে পারেন না।

একজন সংস্কৃতি মনস্ক নারী কখনও সঙ্গীত চর্চা ও নৃত্য চর্চা করতে পারেন না।

একজন শিক্ষিত নারী কখনও সংবাদ পাঠিকা হতে পারেন না, সঞ্চালিকা হতে পারেন না। এমনকি বেতার সম্প্রসারণে তাঁর কণ্ঠ ভেসে উঠতে পারে না।

একজন নারী কখনও খেলাধুলায় অংশ নিতে পারেন না।

এই সমাজে নারী শুধুই ভোগ্যবস্তু, নারীর কাজ সন্তানের জন্ম দেওয়া। 

এই হল এক ঝলকে তালিবানি শাসনে আফগান নারীর সামাজিক মূল্যায়ন। তাদের ভবিষ্যৎ। আজকের এই জ্বলন্ত সমস্যার ওপর আলোকপাত করাই বর্তমান নিবন্ধের লক্ষ্য।  

দুই             

তালিবানি শাসনে মহিলাদের নিয়ে আলোচনার আগে আমাদের তালিবানদের ইতিহাস পর্যালোচনা করা দরকার। তালিবানদের উদয় হল কোথা থেকে? পাশতো ভাষায় ‘তালিবান’ শব্দের অর্থ ‘ছাত্রদল’। নামেই স্পষ্ট ছাত্র আন্দোলন হিসেবে এই দলটির সূত্রপাত হয়। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকার একটা বড়ো অংশের মানুষ পাশতুন সম্প্রদায়ভুক্ত। ১৯৮০-এর শেষ দিকে আফগান মুজাহিদিনরা সোভিয়েত সেনাকে দেশ থেকে তাড়াতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের লড়াই থামাতে পারেনি। যুদ্ধদীর্ণ আফগানিস্তানে অপরাধ, দুর্নীতি, মেয়েদের লাঞ্ছনা বেড়েই চলছিল। সেই সঙ্গে বিদেশি দখলদারিত্বের ফলে পাশতুন-এর মত নানা সম্প্রদায়ের মানুষ নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিতে বসেছিল। সেই সময় কান্দাহারে, মূলত পাশতুন অধ্যুষিত এলাকায়, মাদ্রাসা খুলে বসলেন মোহাম্মদ ওমর। এই মাদ্রাসায় ৫০ জন ছাত্রকে নিয়ে শুরু হলো তাঁর আন্দোলন। দলটির নাম হল ‘তালিবান’। উদ্দেশ্য ছিল, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে পাশতুন অধ্যুষিত এলাকায় ইসলামি শরিয়তি শাসন প্রতিষ্ঠা করা। 

প্রথমে তালিবানের এই প্রয়াস বিপুল জনসমর্থন পেয়েছিল। একদিকে বিদেশি শক্তির আগ্রাসনে, অন্যদিকে ঘরের মাটিতে মুজাহিদিনের বাড়বাড়ন্তে আফগানিস্তানের মানুষ তখন ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। পাশতুন অধ্যুষিত এলাকায় তালিবানের শাসন তাদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। তবে স্বপ্ন ভাঙতে দেরি হল না। ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে এল তালিবানের নৃশংস রূপ। মানুষ বুঝতে পারল কট্টর শরিয়তি আইন চালু করতে কতটা বেপরোয়া তারা। এই শাসনে চুরির সাজা ছিল অঙ্গচ্ছেদ, পুরুষদের দাড়ি রাখা ছিল বাধ্যতামূলক, মেয়েদেরকে পা পর্যন্ত বোরখা দিয়ে ঢাকতে বলা হয়েছিল। দশ বা তার বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুল যাওয়া বন্ধ করা হয়েছিল, টেলিভিশনে গান-সিনেমা সবকিছুর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, কারণ সেগুলি ইসলামবিরোধী। বাড়ির নাবালিকা মেয়েদের জোর করে বিয়ে করার জন্য তুলে নিয়ে যাওয়া হত। এদের পেছনে ছিল সৌদি আরবের মদত। এই পর্যন্ত আলোচনা থেকে মোটামুটি অনুমান করা যেতে পারে, তালিবানদের মহিলাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কী রকম হতে পারে!

তিন 

চলতি বছরে ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালিবান। ঠিক তার দু-দিন আগে সমাজ মাধ্যমে একটি আফগান শিশুর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে ছোট্ট মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলছে “আমাদের কেউ হিসাবে রাখে না কারণ আমাদের জন্ম আফগানিস্তানে।” সামনের ভবিষ্যৎ নিয়ে এই শিশুটির মতো আফগানিস্তানের অনেকেই আতঙ্কে আছেন। নারীদের মধ্যে এই আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি কারণ তাঁরা ইতিমধ্যে তালিবানি শাসনের সঙ্গে পরিচিত। 

২০২১-এ কি পরিবর্তিত তালিবানি শাসন দেখবে আফগানিস্তান? মেয়েদের স্বাধীনতা কি থাকবে? আফগানিস্তানের ইতিহাস তা বলছে না। তালিবানি শাসনে নারী-স্বাধীনতা তো দূরস্থান, নারী অধিকার রক্ষা কঠিন হয়েছে বারবার। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি আফগানিস্তানে প্রথম দফায় ক্ষমতা দখল করার পরেই তালিবানদের লক্ষ্য ছিল বিশুদ্ধ ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। তারা যে বিধি-নিষেধ জারি করেছিল মহিলাদের ক্ষেত্রে তার পরিধি ছিল পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। মেয়েদের ঘরে থাকাই ছিল বিধেয়। পরিবারের কোনও পুরুষ সঙ্গে থাকলে বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার অনুমতি মিলত মেয়েদের। এই নিষেধের সূত্র ধরে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার বা পরিবারের বাইরে কোনও কাজকর্মে অংশ নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রশাসনিক কার্যকলাপ এবং বিদেশি সংস্থায় যুক্ত থাকার ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোরভাবে প্রযোজ্য হয়েছিল। যদিও হাসপাতালের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ছাড় দেওয়া হত। 

তালিবান শাসকদের দাবি ছিল তারা মেয়েদের শিক্ষাদানের বিরোধী নয়। কিন্তু এই শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলাম সম্মত হতে হবে। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, অপরিচিত নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশায় রাশ টানাই ছিল এই সব আয়োজনের মূল লক্ষ্য। সেই কারণে বাসে উঠেও মেয়েদের বসতে হত একেবারে পেছনের আসনে। মাঝখানে পর্দা টেনে পুরুষ যাত্রীদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এমনকি শহরাঞ্চলে মহিলাদের প্রথাগত স্নানাগার বা হামামগুলিকেও তালিবানি ফতোয়ায় বন্ধ করা হয়েছিল। এই ধরনের বিধি-নিষেধ আফগান মহিলাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। এর ফলে মহিলাদের মানসিক ক্ষত সৃষ্টি হয়। এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে পাথর ছুড়ে হত্যা করার মতো ঘটনাও প্রকাশ্যে এসেছিল।  

আফগান মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন সর্দার-ই-কাবুলি গার্লস হাই স্কুলের অধ্যক্ষা নাসরিন সুলতানি। এর ফলে তাঁকে তালিবানদের হুমকির মুখেও পড়তে হয়েছে। নাসরিনের কথায়, এত বছর ধরে মেয়েদের পড়াশোনা করতে উৎসাহ জুগিয়ে এসেছেন তিনি। এখন তাদের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন এবং চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে মেয়েদের উদ্ধার করতে পারেননি। বাড়ির বাইরে মেয়েরা বেরোতে পারছে না। কান্দাহারের তালিবান জঙ্গিরা আজিজি ব্যাংকে কর্মরত ৯ জন মহিলা কর্মীকে ভয় দেখিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। হুমকি দেওয়া হয় কাজে না আসার জন্য। ১৯৯৬-২০০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম তালিবান শাসনেও মহিলাদের শিক্ষা ও কাজের অধিকার ছিল না। তাই মধ্যযুগীয় সেই শাসন ফিরে আসার আশঙ্কায় ভুগছেন আফগান মহিলা অধিকার কর্মীরা। 

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারকে মহিলাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেছেন মহিলা অধিকারকর্মী ফাইজা কুফি। তাঁর মতে, আফগানিস্তানের মহিলাদের শিয়রে এখন বিপদ। গত ২০ বছরে মেয়েরা অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকারে। জিহাদিদের সঙ্গে মহিলাদের জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানতে পেরেছেন। এই পরিস্থিতিতে আরও এক নির্দেশ জারি করেছে তালিবানরা। এবারে স্থানীয় ধর্মীয় নেতারা বিবৃতি জারি করে ১৫ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের এবং ৪৫ বছরের কম বয়সী বিধবাদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছে। তারা তাদের যোদ্ধাদের সঙ্গে এইসব মেয়েদের বিয়ে দেবে এবং পাকিস্তানের উজিরিস্তান-এ ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হবে। এক তালিবান সাব-কমান্ডারের মুখে শোনা যায় যে, ১৮ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের বাড়িতে রাখা উচিত নয়। এটা পাপ, তাদের অবশ্যই বিয়ে করতে হবে।

চার 

তালিবানের তেত্রিশ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে। সেই তালিকায় নেই কোনও মহিলা। রয়েছেন এক ঝাঁক মৌলবি ও মোল্লা। ফলে প্রশ্ন ওঠে, এই শাসনে মহিলাদের স্থান কোথায়? এই শাসনে মহিলারা মন্ত্রী হতে পারবেন না? তালিবানদের মতে, এটা হলে মহিলাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করা হবে। স্বভাবতই এর বিরুদ্ধে কাবুলে হেরাট সহ বহু স্থানে মহিলারা প্রতিবাদে নেমেছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা হলে, তালিবানি মুখপাত্র সৈয়দ জেক্রুল্লাহ হাসিমি বলেন, ক্যাবিনেটে মহিলাদের কোনও প্রয়োজন নেই, মহিলাদের কাজ শুধু সন্তান জন্ম দেওয়া। 

কাবুল দখলের পর তালিবানদের তরফে বলা হয়েছিল যে তারা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করবে। কিন্তু বাস্তব অন্যরকম। কাবুলে রাস্তায় মহিলা বিক্ষোভকারীদের আন্দোলনের খবর করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন মহিলা সাংবাদিকরা। কাবুলের রাস্তায় পাকিস্তান ও আইএসআই বিরোধী মিছিলে গুলি চালানো হয় এবং মিছিলের খবর করতে যাওয়া সাংবাদিকদের আটক করে মারধর করা হয়। এই ঘটনার নিন্দা করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এই অবস্থায় আমরা যতটুকু খবর পাচ্ছি তা সংবাদমাধ্যম ও নেট দুনিয়ার দৌলতে। তাই আজ ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে যাতে খবর না ছড়িয়ে পড়তে পারে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অনেক বড়ো খবর হয়তো ওই দেশে চাপা পড়ে আছে।

পাঁচ 

গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল এই তালিবানি শাসনে তা ভেঙে পড়তে বসেছে। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আফগানিস্তানে তালিবানি শাসনে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অধিকার ছিল না। কিন্তু এবার কাবুলের দখল নেওয়ার পরেই তারা জানিয়ে দেয় মেয়েরা স্কুল কলেজে যেতে পারবে। তবে শরিয়তি আইন যেন ভঙ্গ না হয়, অর্থাৎ হিজাব পরতে হবে। তারা আরো বলেছে, ছেলে ও মেয়েদের আলাদা বসতে হবে এবং মাঝে পর্দা থাকবে। কিন্তু পরবর্তীকালে এর সাথে তারা আরও একধাপ সংযোজন করে যে, শুধু হিজাব নয় অবোয়া ও নিকাব পড়তে হবে মেয়েদের। বস্তুত, সার্বিক শিক্ষা সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাই অন্যরকম। মুখ্যমন্ত্রী শেখ মৌলবি নুরুল্লা মুনির জানিয়েছেন, পিএইচডি, মাস্টার্স ডিগ্রির কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ মোল্লা ও তালিবান নেতাদের পিএইচডি, মাস্টার্স এমনকি হাইস্কুলের ডিগ্রিও নেই। কিন্তু তারাই তো সমাজের নেতা। ফলে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস রুম পুরো ফাঁকা। এই তালিবান ফতোয়ার প্রতিবাদ করেছেন অধ্যাপকেরাও। 

এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া কিছু তথ্য উল্লেখ করা যেতে পারে। সংস্থাটি বলেছে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে যখন তালিবান সরকারের পতন হয় তখন সেখানে কোনও মেয়ে শিশু স্কুলে যেত না। যদিও ওই বছর প্রায় ১০ লাখ ছেলে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ফলে প্রশ্ন ওঠে নারী শিক্ষায় তাদের ভয় কোথায়? সাধারণভাবে যে-কোনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রবণতা হল নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু এই অবস্থা বিশ্বজুড়ে বদলাতে শুরু করেছে। পুরো বিশ্বই এখন বুঝতে পারছে সমাজের অগ্রগতির জন্য নারীর অগ্রগতি আবশ্যক। কিন্তু ২০০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা তালিবান এই পশ্চাৎপদতা থেকে বের হতে পারেনি। নারীর ক্ষমতায়নের কথা তারা ভাবতেই পারে না। যেখানে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তালিবান শাসনকালে  একজন নারীও স্কুলে যেতে পারছিল না সেখানে ইউনেস্কোর তথ্য অনুসারে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১২৪ জন ছেলের বিপরীতে ৮৩টি মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে ৭০ জন ছেলের বিপরীতে মেয়ে ভর্তি হয় ৪০ জন। বদল আসে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে উচ্চশিক্ষায় ৫ জন পুরুষ শিক্ষার্থীর বিপরীতে মহিলা ছিলেন ২ জন। আর ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে ১৪ জন পুরুষ শিক্ষার্থীর বিপরীতে মহিলা শিক্ষার্থী ছিল ৫ জন। 

তালিবানি শাসনে সংস্কৃতি চর্চার পরিসরটিও রুদ্ধ হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সংগীত স্কুলগুলিও। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে আফগান মহিলাদের জনপ্রিয় অর্কেস্ট্রা দল ‘জোহরা’। কাবুলের একটি অনাথ আশ্রমের বাসিন্দা ১৩-২০ বছরের কিশোরী ও তরুণীদের নিয়ে ফরাসি সংগীতের দেবীর নামে করা হয়েছিল অর্কেস্ট্রা দলটি। সঞ্চালিকা ছিলেন ২৪ বছরের নেগিন খপ্লক। তিনি ছিলেন দেশের জনপ্রিয় মহিলা দলের মুখ। সনাতন আফগানি ধারার পাশাপাশি পশ্চিমি সংগীত পরিবেশন করত ‘জোহরা’। সিডনি অপেরা হাউজ থেকে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর অধিবেশনে, বিশ্বের নানা প্রান্তে সংগীত পরিবেশন করেছেন এই দলের সদস্যরা। অনেক প্রশংসা ও সম্মান অর্জন করেছেন তাঁরা। কাবুলে তালেবান রাজ কায়েমের পর আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছেন নেগিন। দেশ ছাড়ার আগে নিরাপত্তার কারণে নষ্ট করে ফেলেছেন ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে তৈরি হওয়া জোহরা-র সমস্ত ইতিহাস। 

আর এক মহিলা আফগান পপস্টার আরিয়ানা সৈয়দ দেশ ছেড়েছেন তালিবানরা যদি তাঁকে অপহরণের চেষ্টা করে সেই সম্ভাবনার আশঙ্কায়। তিনি এয়ারপোর্টে নিজের ম্যানেজার তথা বাগদত্তাকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন, যদি তাঁকে তালিবানরা চিনতে পেরে জীবিত অবস্থায় তুলে নিয়ে যেতে চায় তখন তাঁর বাগদত্তা যেন আরিয়ানার মাথায় একটা গুলি করে। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে কাবুলের স্টেডিয়ামে হিজাব ছাড়াই মুক্তকণ্ঠে গান করেছিলেন এই আরিয়ানা।  

শুধু সঙ্গীত নয় নৃত্যকেও স্তব্ধ করা হয়েছে এই শাসনে। তালিবানরা মহিলাদের নৃত্যকলা-কে কোনও মূল্য দিতে চায় না। ফাহিমা মিরজেই হলেন আফগানিস্তানের একমাত্র ও প্রথম নারী, যিনি ঘূর্ণমান মঞ্চের নৃত্যশিল্পী। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাহীনতার কারণে বহু কষ্টে তিনি ফ্রান্সে পাড়ি দিয়েছেন। মালিনা সুলিমান-এর মতো চিত্রশিল্পীকেও দেশ ছাড়তে হয়েছে। 

এই তালিবানি যুগে মহিলারা কোনও খেলাধুলায় অংশ নিতে পারবে না বলে বলা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশন-এর সহায়তায় আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে এসে আশ্রয় নিয়েছে আফগান মহিলা ফুটবল দলের ৩২ জন সদস্য ও তাদের পরিবার। শুধু মহিলা ফুটবলাররাই নয় মাত্র ১৮ বছর বয়সী বক্সার সীমা রেজাই নিজেকে খুব কষ্ট করে গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর প্রশিক্ষণও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি বদ্ধপরিকর যে তিনি থামবেন না।

ছয় 

সব পশ্চাৎপদতার পরেও ২০০১ খ্রিস্টাব্দে শূন্য থেকে শুরু করা আফগান নারীদের বর্তমান অবস্থায় আসাটা নিশ্চিতভাবেই অগ্রগতি। আর এই অগ্রগতি যে শুধু সরকারি কিংবা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের অর্থ সাহায্য বা সদিচ্ছার কারণে হয়েছে এমনটা বিবেচনা করা ঠিক নয়। এই সাফল্যের মূল দাবিদার আফগান নারীরাই। কারণ সংস্কার ভেঙে তাঁরা এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন। নারীরা শিক্ষিত হওয়ার তাড়না বোধ করেছেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতেও তাঁদের অকুতোভয় মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। তাঁরা এই পরিস্থিতিতে হার মানতে নারাজ। তাঁরা সাফ জবাব দিয়েছেন যে তাঁরা আর কুড়ি বছর পিছিয়ে যাবেন না। ভয় করবেন না বরং মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করবেন। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, তালিবানি বন্দুকের সামনেও অকুতোভয় আফগান মহিলা। তাঁরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন। নেট মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া একটি ভিডিওতে এক আফগান মহিলাকে বলতে শোনা যায় “পাকিস্তান বা তালিবান, পঞ্চশির দখল করার অধিকার কারও নেই।” গায়িকা থেকে সাংবাদিক সকলেই তালিবানি শাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। 

সবশেষে বলতে হয়, একটি স্বাধীন দেশে নাগরিক আইন ভঙ্গ না করে, কারোর ক্ষতি না করে যে-কোনও কিছু করার অধিকার নারীর রয়েছে। কিন্তু অতীতের তালিবান আমলে আফগান নারীরা সেই অধিকার পায়নি। তাই আসন্ন তালিবানি আমলেও তা পাওয়া যাবে, এটা দুরাশা। হয়তো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছোট্ট মেয়েটির কথাই বাস্তবে রূপায়িত হবে। চূড়ান্ত হতাশ হয়ে ওই মেয়েটি বলেছে, “আমাদের কথা কেউ ভাবে না। ইতিহাসের পাতায় ধীরে ধীরে আমাদের মৃত্যু হবে।” এই প্রশ্ন ওঠা তো সংগত যে, নারী প্রশ্নে তালিবান কি এবারও পূর্ববর্তী পথেই হাঁটবে? ইতিহাসের দিক থেকে বিবেচনা করলে ‘হ্যাঁ’ ছাড়া অন্য কোনও উত্তর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। 

“আনারের রক্তাক্ত দানার মতো লোহিত হরফ দিয়ে লেখা আমার ভাগ্যের হালখাতা তার ছিদ্রময় প্রতিটি পাতা, জলন্ত অঙ্গার হয়ে যেন পুড়ছে আমার হৃদয়” 

                                                             (‘অগ্নিরোগ’ : ওয়াসেফ বাখতারি)

সহায়তা : 

গ্রন্থ

১. ‘আফগান নারী’: হাসান মুহাম্মদ সানাউল্লাহ, ঢাকা, আবরণ প্রকাশন, ২০১৯            

২. ‘আফগানিস্তান অতীত ও বর্তমান’: ড. গোলাম কিবরিয়া ভুঁইয়া, ঢাকা, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ২০১২

৩. ‘তালিবান আফগান ও আমি’: সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, পত্রভারতী,২০১৪                                

পত্রপত্রিকা (মুদ্রণ ও ডিজিটাল) — 

আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়, জি নিউজ (বাংলা), বিবিসি বাংলা, সংবাদ প্রতিদিন। 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান