দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট চরিত্রগুলির আত্মপরিচয়ের সংকট 

নীলাদ্রি নিয়োগী 

এক 

‘Identity and Violence: The Illusion of Destiny’ বইটির শুরুতেই অমর্ত্য সেন এক মজার গল্প বলেছেন। সেই সময় তিনি কেমব্রিজে ট্রিনিটি কলেজের অধ্যক্ষ। কিছুদিন বাইরে কাটিয়ে যখন ইংল্যান্ডে ফিরছিলেন, তখন হিথরো বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন অফিসার অনেকক্ষণ ধরে তাঁর ভারতীয় পাসপোর্টটি খুঁটিয়ে দেখে তাঁকে একটি সূক্ষ্ম দার্শনিক প্রশ্ন করেন। জানতে চেয়েছিলেন, ট্রিনিটির অধ্যক্ষ তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিনা। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন শ্রীসেন সেই অধ্যাপকের আতিথ্য পেয়েছেন। প্রখর রসবোধের অধিকারী অমর্ত্য সেন তখন নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করেন, তিনি নিজেকে নিজের বন্ধু বলে দাবি করতে পারেন কিনা! খানিক চিন্তার পর সিদ্ধান্তে আসেন, তিনি নিজের সঙ্গে মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণই করে থাকেন, ফলে উত্তরটি ইতিবাচকই হবে। 

নেহাতই কৌতুকের ছলে তিনি ঘটনাটি বিবৃত করলেও কয়েকটি প্রশ্ন, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই ঔপনিবেশিক মনে উঁকি দিয়ে যায়। প্রথম বিশ্বের এক প্রাক্তন-সাম্রাজ্যবাদী দেশের একজন অজ্ঞাতকুলশীল (অথচ এখনও প্রভুমনস্ক) অফিসার, ভারতীয়দের ঠিক কী চোখে দেখেন? সেই দেশের সর্বোৎকৃষ্ট কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনও তৃতীয় বিশ্বের মানুষ কি শিক্ষকতা করবার উপযুক্ত নন? একজন মানুষের বাহ্যিক কোনও পরিচয়, তার অভ্যন্তরীণ পরিচিতিকে কতদূর অবধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? সর্বোপরি, অমর্ত্য সেন যে পরিস্থিতির কথা লিখেছেন, সেই সময় তাঁর যে আত্মপরিচয়ের সংকট দেখা দিয়েছিল; তাকে আমরা ঠিক কোন্ খোপে রাখব — অস্তিত্বের সংকট, নাকি অস্মিতার সংকট? নাকি একসঙ্গে দুটোই? 

আমাদের আলোচ্য প্রবন্ধে প্রথম তিনটি প্রশ্ন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করবার খুব বেশি অবকাশ নেই; কিন্তু শেষ প্রশ্নটিতে খানিকটা আলোকসম্পাত করে, তারই সূত্র ধরে আমরা মূল বিষয়ের গভীরে ঢুকতে পারি। যখন একজন ব্যক্তির নিজস্ব পরিচয়ের অনুভূতি হয়ে ওঠে নিতান্তই অনিশ্চিত ও অনিরাপদ, তখনকার সেই অনুভব বা মানসিক অবস্থাকে বলা যেতে পারে Identity crisis বা অস্মিতার সংকট। অন্যদিকে অস্তিত্বের সংকট হল — Existential crisis; এটি একইসঙ্গে existential dread নামেও পরিচিত। খুব সম্প্রতি আফগানিস্তান দেশটি তালিবান অধিকৃত হবার পর সেখানকার অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ ভাবে এই সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। যেখানে টিকে থাকাই বস্তুত অসাধ্য, সেখানে অন্যান্য বিষয় অনেকাংশেই তুচ্ছ মনে হতে পারে। যদিও এই অস্তিত্বই আবার বহুক্ষেত্রে সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে শুধুমাত্র ব্যক্তি-পরিচিতির কারণে। তা ধর্ম হতে পারে, জাত হতে পারে, এমনকি গায়ের রং বা অর্থনৈতিক অবস্থা হওয়াও বিচিত্র না। জার্মান নাৎসি বাহিনীর হাতে ইহুদিদের হত্যালীলা থেকে শুরু করে এই উপমহাদেশে প্রাক্-স্বাধীনতা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা; এমনকি বর্তমান সময়েও নির্বিচারে দলিতদের গণপ্রহারে নরমেধ বা শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের হাতে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির সংহনন — সবই কিন্তু জড়িয়ে আছে পরিচয়ের ওপরেই ভিত্তি করে! ফলে এই অস্তিত্বের সংকট নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত অস্মিতার সংকটের সঙ্গেই। অমর্ত্য সেন উক্ত বইটির ‘বিভ্রম থেকে হিংসা’ প্রবন্ধে যথার্থই লিখেছেন — “যে সুসংবদ্ধ সমাজের বাসিন্দারা স্বাভাবিক প্রেরণায় তৎক্ষণাৎ ও সম্মিলিতভাবে পরস্পরের জন্য অভাবনীয় উপকার করতে পারে সেই একই সমাজেই দূরাগত অভিবাসীদের জানলা দিয়ে ইট ছোড়া হয়। সমাজে অন্তর্ভুক্তিবোধের অভিশাপ ও আশীর্বাদের পাশাপাশি সমাজ বহির্ভূত করে রাখার বৈরীভাবটিও জারি থাকে।… পরিচয়বোধের সঙ্গে যুক্ত চর্চিত হিংসার স্ফুরণ সারা পৃথিবী জুড়ে বারংবার ক্রমবর্ধমান মাত্রায় সংঘটিত হচ্ছে।”[১] 

এই আত্মপরিচয়ের সংকট প্রসঙ্গে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলি বেছে নেবার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। তাঁর সাকুল্যে চারটি উপন্যাস রয়েছে— ‘আগামী’, ‘তৃতীয় ভুবন’, ‘গগন ঠাকুরের সিঁড়ি’ এবং ‘বিবাহ বার্ষিকী’। অদ্ভুত ভাবে, চারটিতেই যে মূল প্রোটাগনিস্ট চরিত্র, তারা নিরন্তর এই সংকটের সঙ্গেই বসবাস করেন। বস্তুত এই নানামাত্রিক সংকটের চেহারা থেকেই যেন একটু একটু করে মানুষগুলিকে চিনে নেওয়া চলে। তাদের কথা, তাদের ভাবনা তথা আত্মকথন, সবেতেই নিজস্ব পরিচিতি নিয়ে একটা নেই-আঁকড়া অনুসন্ধান আছে। যেন তারা প্রাণপণে বুঝে নিতে চাইছে নিজেকে, নিজেদের এবং সেইসঙ্গে সময় ও সমাজটাকেও। তাদের সমভিব্যাহারে পথ হেঁটে পাঠকও খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতেই পারেন সংকটের সেই ধূসরিমা বিস্তার। 

দুই 

চেতনাপ্রবাহ রীতিতে লেখা ‘গগন ঠাকুরের সিঁড়ি’ উপন্যাসটি প্রকৃত প্রস্তাবে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়েরই মাউথপিস ক্যারেক্টার নিশানাথের যুগপৎ অস্মিতার ও অস্তিত্বের সংকটের এক ধারাক্রমিক বিবরণ। ১৯৬১-৬২ খ্রিস্টাব্দে ‘বিংশ শতাব্দী’ পত্রিকায় যখন উপন্যাসটি লিখিত এবং প্রকাশ হচ্ছে, তখন ইতিহাসে আলগোছে চোখ রাখলে দেখব — ভিয়েতনামে সেইসময় সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা প্রচণ্ড আক্রমণ করছে। এদিকে ভারত-চিন সীমান্ত জুড়ে চলছে সংঘর্ষ। বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লবী অংশের নেতা ও কর্মীদের ওপর ক্রমাগত ধেয়ে আসছে আঘাত। ফলত এই প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসটিতে আগাগোড়াই রাজনৈতিক ইন্টারভেনশন, একজন কমিটেড কমিউনিস্ট লেখকের লেখনীতে অবধারিত ও অমোঘ ভাবে থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত। প্রোটাগনিস্ট নিশানাথের ভাবনা ও অ্যাক্টিভিটি দিয়েই বয়ন করা হয়েছে ‘গগন ঠাকুরের সিঁড়ি’-র সামুহিক চালচিত্র। আর ন্যারেটর যেহেতু সে নিজে, এবং ভাবুক সেই উত্তমপুরুষ যেহেতু তন্নিষ্ঠ ভাবে উৎখনন করে চলে নিজের মগ্নচৈতন্য; ফলে উপন্যাসটিতে সংলাপের চেয়েও ইন্টারনাল মনোলগের ব্যবহারই অনেক বেশি পরিলক্ষিত হয়। এক কথায় বলতে গেলে, ‘গগন ঠাকুরের সিঁড়ি’ আসলে নিশানাথের আত্মবিশ্লেষণ, আত্মউন্মোচন এবং তার পরিপার্শ্বকে দেখার-বোঝার ও মূল্যায়ন করার এক অল্টারনেটিভ ডিসকোর্স। 

গোটা উপন্যাস জুড়েই নিশানাথের মধ্যে একটা অস্থিরতা লক্ষ করা যায়। সারা দুপুর ঘুমিয়ে সন্ধ্যায় জেগে উঠে, প্রথম ঘুমঘোরে সময়টাকে ভোর বলে মনে হয় তার। সেই অবস্থাতেই বাইরে বেরিয়ে আসে। রাস্তায় প্রথম দেখা ভদ্রলোকের সঙ্গে সাকুল্যে দেড় খানা সংলাপ বিনিময় হলেও সেই ভদ্রলোকের ভাবনাচিন্তার স্তরকে সে বুঝে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে। শুধু তাই না, এরপর থেকে যত মানুষের সংস্পর্শে এসেছে, প্রত্যেকের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কেই আপন মনে বিশ্লেষণ করেছে নিশানাথ। তার আচরণে, এবং, এমনকি কথাবার্তায়ও বহু ক্ষেত্রেই অন্যমনস্কতা, অধিকন্তু অসংলগ্নতা প্রকাশ পেলেও সে ছিল গভীর ভাবে অন্তর্দর্শী এবং সমাজ তথা রাজনীতি সচেতন এক ব্যক্তি। তার ভাবনা জগতের আপাত অসামঞ্জস্যতার মধ্যেও অন্তর্লীন ছিল একটা প্রখর র‍্যাশনাল মনন। এতদ্সত্ত্বেও হীনম্মন্যতায় ভোগা নিশানাথ অদ্ভুত রকমের আত্মাভিমানীও ছিল। প্রায় প্রতিটা মানুষের আচরণে সে অপমানিত বোধ করে। বস্তুত এই অপমান-বোধ তার অবসেশনে পরিণত হয়েছিল। রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্য স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রকর্তৃক চূড়ান্ত অপমানিত হয় সে — চাকরি যায় তার। আদালতেও দু-বার, একবার আসামিরূপে, আরেকবার সাক্ষীরূপে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যথেষ্ট লাঞ্ছিত হতে হয় তাকে। সেই অভিজ্ঞতায় এতটাই মর্মস্পর্শী গ্লানি ছিল, যে পরবর্তীতে অবচেতনেও বারবার কোর্টের কাল্পনিক সওয়াল জবাবের মহলা দিতে থাকে সে। 

নিশানাথের সান্ধ্য অভিযানে চোখ রাখলে দেখব — চায়ের দোকানের বালক কর্মচারী, বাসস্টপের ভিখিরি, বাসের অন্ধ ব্যক্তি, সিটে বসে থাকা যুবক, কন্ডাক্টর, বারের ওয়েটার, এক দেহজীবী রমণী ও পার্কের যুবক-যুবতি — প্রত্যেকের কোনও-না-কোনও আচরণে নিশানাথ অকারণে অপমানবোধ করেছে এবং তাদের প্রায় সবাইকেই সে নিজেও পালটা অপমান করেছে। এই প্রসঙ্গে তার অতিমৌলিক ধারণাটি নিম্নরূপ — 

‘আসলে আমি তো জানি কী অকারণে আর উপলক্ষ তৈরি করে মানুষ অন্যকে অপমান করে তার প্রতি মুহূর্তে লাঞ্ছিত-অপমানিত অস্তিত্বকে সে এইভাবে খানিক হালকা করার সুযোগ খোঁজে। অপমানিত হওয়া আর অপমান করা — এই তো আধুনিক জীবন।’[২] 

এই আধুনিক অসুখের ভিক্টিম সে নিজেও। এক অসুখী চেতনা থেকে তার মনে হয়, সে বড়ো দেরিতে জন্মেছে। একদা ‘শব্দ’ নিয়ে তার ফ্যাসিনেশন ছিল। কিন্তু এখন তার মনে হয়, এই মুহূর্তে এমন কোনও শব্দ নেই, যা সে প্রথম উচ্চারণ করতে পারে। অতি ব্যবহারে শব্দ আজ শুধুই ‘কথা’ — যা তার আদৌ ভালো লাগে না। কারণ কথা বড় হালকা — সমুদ্রের ফেনার মতো। পারস্পরিক কথোপকথনে তাই তার আজ অনীহা। 

নিঃসঙ্গ নিশানাথ ছায়া ভালোবাসে। চৌরঙ্গির পুকুরের ধারে বসে জলে প্রতিফলিত নানান ছায়ার সঙ্গে সময় কাটায় সে। মিউজিক না, ছায়াকেই মনে করে হায়েস্ট ফর্ম অব আর্ট। একটা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আকৃতি আমাদের চোখের সামনে থাকে, আমরা আমাদের স্মৃতি, বোধ, অনুষঙ্গ দিয়ে তা অনুভব করতে পারি। সৌন্দর্য, বাস্তবতা ও নন্দনতত্ত্বের নির্যাস নিয়ে ছায়া যে শিল্প গড়ে — তা স্বতঃস্ফূর্ত, অনায়াস এবং সেখানে একই সঙ্গে গভীর জটিলতা ও আদিম সারল্য। ছায়ার পাশাপাশি জীবন ও মৃত্যু নিয়েও তার নিজস্ব দর্শন রয়েছে। প্রতি মুহূর্তের বিচারে নিজেকে যাচাই করে; প্রতিটি আচরণে, ভাবনায় আর প্রতিক্রিয়ায় অনবরত আত্মবিশ্লেষণ করে, অনতিক্রম্য কিছু স্ববিরোধ পেরিয়ে, নিজের সত্তার গহন গোপনে পৌঁছে সে উপলব্ধি করেছে — 

‘যে জানে সভ্যতা ভূমিষ্ঠ হয়েছে মানুষের অপরিমেয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার পাপে আর তার প্রায়শ্চিত্ত হবে অনিবার্য আত্মহননে; ইতিহাস যার কাছে উচ্চাঙ্গের পরিহাস, মানবিক মূল্যবোধ যার চোখে অপরিচিত ভাষার স্বরলিপি, সভ্যতা যার আত্মাকে গ্লানি গ্লানি গ্লানিতে চুবিয়ে নিঃশ্বাস রুদ্ধ করেছে। যার প্রেম নেই, শ্রদ্ধা নেই, বিশ্বাস নেই, বিশ্বাসহীনতার স্পর্ধা নেই; এই বর্তমানটা যার কাছে অজ্ঞাত স্বপ্ন এবং যে বেঁচে আছে এক অলৌকিক ছায়ার জগতে একা, একেবারে একা —’ [৩] 

বেদনাদীর্ণ এই আত্মোপলব্ধির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটা বাক্য, অনুত্তর এক জীবন সংকটকেই প্রতিভাত করে। আধুনিক যুগের অবক্ষয় ও অন্তর্লীন উৎকণ্ঠা এবং সেইসঙ্গে একটা গোটা প্রজন্মের একযোগে আত্মপ্রতারণা নিশানাথকে বেপথুমান করে তোলে। সে ক্রমে আরও বুঝতে পারে, এক বিলম্বিত প্রাচীন ক্লান্তি ও অবসাদ তাকে ধীরে ধীরে অবসন্ন করবে — অথচ, যা এককালে তাকে উত্তেজিত, ক্ষিপ্ত ও উদভ্রান্ত করত। আর কী অদ্ভুত, এই পাপবোধ ও হীনম্মন্যতা এখন সে উপভোগ করতে শুরু করেছে। মনস্তত্ত্বের পরিভাষায় একেই ডিপ্রেশন বলা হয়ে থাকে। অবসাদগ্রস্ত যূথভ্রষ্ট এই যুবা সারারাত ধরে গোটা পৃথিবীকে অভিযুক্ত করে যায়। নিশানাথের সময়চেতনাও চূড়ান্ত ইউনিক। সে বিশ্বাস করে— সময় হল একটা স্থির, অকম্প্র ব্যাপার, তা কখনোই প্রবাহিত হয় না। সময় কেউ হরণ করতেও পারে না। আমরা জানি না কবে ও কীভাবে তার শুরু; অথচ সময় আছে! সব কিছুকে জড়িয়েও সময় সমস্ত ব্যাপার থেকে আলাদা। 

পারিবারিক জীবনে নিশানাথ সুখী না। তার আইনজীবী পিতা আর চিকিৎসক দাদা আর্থিক এবং সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও সে তাদের শ্রদ্ধা করতে পারে না। সে বোঝে যে পেশার কারণেই তার বাবা ও দাদাকে অনেক অন্যায় কাজ করতে হয়, বা, অন্তত প্রশ্রয় দিতে হয়। মা এবং বৌদি সম্পর্কেও সে উচ্চ ধারণা পোষণ করে না। সে জানে মানুষের সঙ্গে মানুষের যাবতীয় সম্পর্কবোধের ভিত্তি উৎপাদন ব্যবস্থা। ফলে স্বার্থকে কেন্দ্র করে যে ঘনিষ্ঠতা, তাকে সে ঘৃণা করে। সাংসারিক নানা ব্যাপারে সে তার মা ও বৌদির তুচ্ছ কিছু ধূর্তামি দেখতে দেখতে ক্লান্ত। এদিকে শুধু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কই না, এই সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গেও ব্যক্তির সম্পর্ক কোনও দিনই তার মতে ইতিহাসসম্মত, উদার ও যথার্থ হয়নি। এই না হওয়ার কারণ, নিশানাথের মতে — মানুষের অসম্ভব উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং মানুষে মানুষে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা। সে মনে করে, এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও প্রতিযোগিতা, পৃথিবীকে রেনেসাঁসের দুই অমোঘ উপহার। 

পরিবারের মধ্যে একমাত্র তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সাধনার সঙ্গেই তার কিছু অর্থপূর্ণ কথা-বিনিময় হয়। নিশানাথের ভাই ও সাধনা দুজনেই সিপিআই(এম) দলের কর্মী। তারা গ্রামে থেকে পার্টির কাজ করে। সিপিআই দলের সমর্থক (যদিও উপন্যাসে স্পষ্ট উল্লেখ নেই) নিশানাথের সঙ্গে সাধনার রাজনীতি নিয়ে তুমুল তর্ক হয়। সাধনা সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী। মানুষের ওপর এবং তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর তার অটুট আস্থা। কিন্তু নিশানাথ খুব কাছ থেকে ব্যর্থতা দেখেছে। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর যখন মনে হয় — সব ভুল; আর সেই উপলব্ধির পর যখন মাঝ বয়সে পৌঁছে চাকরির চেষ্টা করতে হয়, আবার কাউকে সেই ভুলের মাশুল দিতে বাধ্যত আত্মহত্যা করতে হয়; তখন দীর্ঘদিনের সেই লড়াই ও আত্মত্যাগকে অর্থহীন মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। নিশানাথ নৈরাজ্যবাদী তো নয়ই, এমনকি নিহিলিস্টও নয়। কিন্তু সামবায়িক স্বপ্নভঙ্গের পর অবধারিত কিছু নেতিবাদী ভাবনা তাকে এক ব্যাধিগ্রস্ত বাতিক উপহার দিয়েছে। তাই চরম বিপদের মুখে দাঁড়িয়েও সাধনাদের নিরুদ্বেগ থাকার ঔদ্ধত্য তার সহ্য হয় না। 

সাধনা আসলে শান্তি আন্দোলনের সমর্থক। গ্রামে গ্রামে সে এই আন্দোলনকেই ছড়িয়ে দিতে চায়। একদিকে ধনতন্ত্রের প্রলোভন ও অন্যদিকে তার পীড়ন সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই পৌঁছে দিতে চায় সে। কিন্তু তার মুখে ‘লড়াই’, ‘সংগ্রাম’, ‘বাস্তবতা’ এইসব ক্লিশে শব্দ শুনে নিশানাথের বমি পায়।  চারপাশের সাবভার্সন প্রত্যক্ষ করে তার মনে হয়, মানুষের হাতে অপরিমিত বিধ্বংসী শক্তি থাকলেও পৃথিবীতে আজ আর বীরত্ব নেই, আছে শুধু হত্যা। বর্তমান ভোগবাদী সভ্যতা জীবনকে আরও লোভনীয় এবং মৃত্যুকে আরও দ্রুত ও অনিবার্য করেছে। উপন্যাসটির প্রতিটি ছত্রে নিশানাথ আসলে এই অবক্ষয়ের অলাতচক্রকেই অ্যাড্রেস করতে চেয়েছে ও নিরভিমান যন্ত্রণা বুকে চেপেও তাকে নিজস্ব কায়দায় কাউন্টার করে গিয়েছে। 

তিন 

দেবেশ রায়, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্ববন্ধু ভট্টাচার্য প্রমুখ সমালোচকের মতে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘তৃতীয় ভুবন’ থেকেই তাঁর রচনার নতুন স্টাইল গড়ে উঠেছিল। জয়তী নাম্নী এক তরুণীর জীবনে একদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা এবং তারই সূত্রে ক্রমাগত তার আত্মউন্মোচন — এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য। জয়তীর সলিলকি অনুসরণ করলে দেখা যাবে সে নিজেই নিজেকে একাধিক সত্তায় পুনরাবিষ্কার করেছে। এখানে তার আত্মপরিচয়ের বোধ সরাসরি সংকটের মুখে পড়ে যখন সে একটা পরিচয় থেকে আরেকটা পরিচয়ে শিফ্‌ট করছে। বাড়িতে সে একরকম। কর্মস্থল সুহাসিনী বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা জয়তীর আরেক চেহারা। আবার স্কটিশ চার্চ কলেজে ছাত্রী এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সে অন্যরকম। সর্বোপরি আসাদের প্রেমিকা হিসেবে তার সম্পূর্ণ আলাদা এক নিভৃত পরিচয়। যদিও এতরকম ভাবে নিজেকে চিনে নেবার বা বুঝে নেবার প্রয়াস সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত প্রতিটা সত্তার ভেতরেই এক অনির্দেশ্য ঐক্য রয়েছে। আসলে নতুন চাকরিতে ঢুকে সদ্য উপার্জন করা এবং আসাদের প্রতি এক গভীর ভালোবাসাই তার মধ্যেকার যাবতীয় চাপল্য ও উচ্ছ্বাসকে সরিয়ে রেখে তাকে জটিল, সূক্ষ্ম এবং স্থিতপ্রজ্ঞ করে তোলে। স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যে দায়িত্ব তাকে নিতে হয়, সেটা তাকে আরও পরিণত করে। ফলে বাড়িতেও যেমন তাকে আর্থিক নানান কর্তব্য পালন করতে হয়, তেমনই কলেজেও তার পূর্ববৎ ছাত্রীসুলভ প্রীতিমুগ্ধতা কোথাও গিয়ে খানিকটা খর্ব হয়। তার চিন্তনবিশ্বে একটা বড়োসড়ো পরিবর্তন আসে প্রেমের স্পর্শে এবং একইসঙ্গে সেই সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সামাজিক ও পারিবারিক কিছু প্রতিবন্ধকতার জন্য। সবটা মিলিয়ে সে প্রাণপণ প্রাতিস্বিকতা বজায় রাখতে চাইলেও নানাভাবে তার ব্যক্তিপরিচয়ের ঈষৎ অবলোপ ঘটে যায়। অন্তরাত্মকথনের মাধ্যমে তা পূর্বাপর বিশ্লেষিত হওয়ায় পাঠকও জয়তীর এই জার্নির শরিক হতে পারে। 

পরিবারের সকলের সঙ্গে জয়তীর সম্পর্কের ডাইমেনশন আলাদা আলাদা। বাবার প্রতি এক দূরত্ব মিশ্রিত শ্রদ্ধা। ও ভালোবাসা। মায়ের প্রতি কিছুটা বিরক্তি, অনেকটা করুণা। এবং ভালোবাসা। বোন বিল্কুর গাম্ভীর্য, জেদ ও ব্যক্তিত্বের কারণে তার প্রতি কখনও রাগ, কখনও সম্ভ্রম, এমনকি কখনও ভয়। এবং অবশ্যই ভালোবাসা। আর ছোটো ভাই ননুর পাকাপাকা কথা ও অবাধ্যতার জন্য স্নেহমিশ্রিত কৌতুক এবং তার ছেলেমানুষির জন্য একপ্রকার ঈর্ষা — এই হল বাড়ির সবার প্রতি জয়তীর মনোভাব। এ ছাড়াও তার দিদি অসবর্ণ বিয়ে করে বাড়ি থেকে বিতারিত হওয়ায়, জয়তীর ওপর তা গভীর ছাপ রেখে যায়। ব্রাহ্মণ সেই পরিবারে কায়স্থ ছেলেকে বিয়ে করা নিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হতে সে দেখেছে, সেখানে একজন মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করলে তার পরিণতি কী হতে পারে ভেবে জয়তী অসম্ভব এক পীড়া ও অস্থিরতা বোধ করে। বিশেষত তার দাদা দাঙ্গার সময় শান্তিমিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে মুসলিমদের হাতেই মৃত্যুবরণ করার পর থেকে জয়তীর মা ও বাবা যে চোখে প্রাগুক্ত সম্প্রদায়কে দেখে থাকে, সেক্ষেত্রে আসাদের সঙ্গে তার প্রেমের প্রসঙ্গ সে বাড়িতে কীভাবে উত্থাপন করবে, তা বুঝতে পারে না। ফলে তার কাছে এই পরিচিতির সংকট আবার দ্বিবিধ। নিজেকে নিয়ে তো তার অনবরত ভাবনাচিন্তা রয়েছেই, তার ওপর প্রেমিকের ধর্মীয় পরিচয়ও জয়তীকে একটা অনিবারণীয় অন্তর্বিপ্লবের সম্মুখীন করে তুলেছে। 

স্কুলের সিনিয়র কলিগ চারুদি ও হৈমদির তুচ্ছতা, পারস্পরিক হিংসা ও অশ্লীল আচরণ জয়তীর মূল্যবোধকে নাড়া দেয়। সে দুজনকে প্রাথমিক ভাবে ঘৃণা করলেও তাদের সাংসারিক ট্র্যাজেডি শুনে এইসব হীন আচরণকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করতে শুরু করে। শকুন্তলা যেভাবে একজনের কথা অন্যের কাছে বলে ঝগড়ায় ইন্ধন যোগায়, সেটাও তাকে ব্যথিত করে। আবার সবার চেয়ে ব্যতিক্রমী, রাজনীতি করা প্রতিবাদী মেয়ে শর্বরী তাকে উদ্বুদ্ধ করে। স্কুলের উন্নতিসাধনে শর্বরীর যে লড়াই ও প্রচেষ্টা, তাতে যথাসাধ্য তাকে সাহায্য করে। হেডমিস্ট্রেস বনদির শাসন, তর্জন থেকে শুরু করে অসহায়তা — সব কিছুই সে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুধাবন করার চেষ্টা করে। নিজের মনকে যেমন অত্যন্ত দুরূহ মুহূর্তেও সে নিপুণ ভাবে ব্যবচ্ছেদ করতে পারে, তেমনই স্কুলের সকলকে নিয়েই তার অক্লান্ত উৎখনন। তবে অনবরত এই বিশ্লেষণ (আত্ম-পর নির্বিশেষে) এবং বহুক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা তাকে যথেচ্ছ যন্ত্রণাও দেয়। সংশয়বিযুক্ত জয়তী ভাবে :  

‘সব কিছুকেই এমন তুচ্ছ আর মামুলি মনে হয় কেন? খুব একটা জ্যান্ত মানুষের মতো আমি টান হয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কোনও প্রত্যয়ের কথা বলতে পারি না কেন? নানা সংশয় আর দ্বন্দ্বে সব কিছুকে চিরে চিরে বিশ্লেষণ করার এই নিরন্তর প্রয়াস কেন? আমার কী হল? আমি কি মরে যাচ্ছি? আমি কি পালাতে চাইছি?’[৪]

বস্তুত দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যে ‘আত্মসনাক্তকরণের আকুতি’ থেকে কথাসাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন, তারই ফলশ্রুতি জয়তী। সে নিঃস্পৃহ নিরাবেগে নিজের সঙ্গে সঙ্গে গোটা দুনিয়াটাকেই বুঝে নিতে চায়। সাধ্যমত বদলাতেও চায় বৈকি। তার আজন্মলালিত শিক্ষা, রাজনৈতিকবোধ ও সচেতনতা এবং কলেজের সিনিয়র প্রকাশদা, মায়াদি এক্ষেত্রে তার সহায়। মেধাবী, ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ, নিজের স্বাস্থ্য ও কেরিয়ার সম্পর্কে উদাসীন প্রকাশদা অমোঘ ভাবে জয়তীকে প্রভাবিত করেছে। আপন দ্বিধা ও দ্বন্দ্বে বিভোর জয়তী পড়াশোনা থেকে রাজনীতি সবেতেই প্রকাশদার পরামর্শ নিয়েছে। কিন্তু প্রেমের সমস্যায় তারা এক অনিবার্য নির্ভরতায় পরস্পরের সঙ্গে অন্বিত। আসাদকে নিয়ে জয়তী তার অনুভূতি ও কনফিউশন প্রকাশদাকে জানায়। আবার প্রকাশদাও তার ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি জয়তীকে শুনিয়ে হালকা বোধ করেন। উভয়ের যৌথ বেদনাই আবার তাদের জীবন ও প্রেমের হিরন্ময়তা সম্পর্কে উদ্ভাসিত করে তোলে। 

শেষ পর্যন্ত প্রকাশদার পরামর্শে ও নিজের মনের অন্তঃস্থলকে ক্যালাইডোস্কোপে ফেলে খুঁটিয়ে দেখে সে সিদ্ধান্তে আসে। এক মনোজাগতিক দৃঢ়তা অর্জন করে জয়তী আত্মগত ভাবে নিজেকে বোঝাতে থাকে — 

‘সমন্বয় করতে হবে। … দায়িত্বপালন করবে মানুষ হিসেবে — অন্যের যা প্রাপ্য, তা দেবে। নিজেকেও বঞ্চিত করবে না। বেশি দিয়ে বা কম দিয়ে মহৎ সাজার প্রলোভন জয় করবে, পক্ষপাতিত্বের কোনও মোহ রাখবে না।’[৫] 

এই আত্ম-আবিষ্কারই তাকে প্রকৃত অর্থে করে তোলে জয়তী। বাড়িতে শৈশব ও কৈশোরের উচ্ছলতায় মোড়া প্রথম ভুবন পেরিয়ে; স্কুলের দিদিমণি হিসেবে দায়িত্ববান এবং কলেজের ছাত্রী হিসেবে যুগপৎ স্বেচ্ছাচারী ও সমাজ-রাজনীতি-সচেতন সত্তার দ্বিতীয় ভুবনকেও অতিক্রম করে; সে পৌঁছে যায় আসাদকে কেন্দ্র করে তার আবহমান ভালোবাসার তৃতীয় ভুবনে। তখন সে আর নিছক নিজেকে নিয়ে ভাবছে না; বিশ্বআত্মন্ তার মননে যে সার্বত্রিক চেতনা জাগ্রত করে দিয়েছে, সেটাই তার নিজস্ব তৃতীয় ভুবনকে করে তুলেছে ফলবান ও সমৃদ্ধ। 

চার 

দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ উপন্যাস ‘বিবাহ বার্ষিকী’ ১৯৭৭ সালে শারদীয় ‘কালান্তর’-এ প্রকাশিত হয়। এক সৎ, আদর্শবান ও কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী মণিমোহন এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তার রাজনৈতিক অবস্থান ও ভাবনাচিন্তা; সংসারের এক টুকরো ছবি এবং তার বন্ধুদের সঙ্গে সমকালীন সমাজ-রাজনীতি নিয়ে তর্ক-আলোচনা অনুস্যূত হয়েছে উপন্যাস জুড়ে। মণিমোহন আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত। পার্টির হোলটাইমার হিসেবে উপার্জনও তার সামান্য। স্ত্রী কনক স্কুলে চাকরি করে এবং সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব হাসিমুখে সামলায় বলে মণিমোহনের পক্ষে নিশ্চিন্তে রাজনৈতিক ও সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা সহজ হয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং কমিউনিস্ট-সুলভ কিছু আদর্শরক্ষা ও ত্যাগের কারণে তার সংসারে, বিশেষত সন্তানদের মধ্যে নানান অভাব-অনুযোগ থাকলেও এই দম্পতি শুধুমাত্র ভালোবাসা, হাস্যপরিহাস ও এক আয়ত সারল্য দিয়ে সংসারে সতত শান্তি বজায় রেখেছিল। 

যে সময়ে ‘বিবাহ বার্ষিকী’ লেখা হয়েছিল, ইতিমধ্যে বাংলার রাজনৈতিক চালচিত্রে বহু ঘটনা ও দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। দু-দুটো যুক্তফ্রন্ট হয়েছে, নকশালবাড়ি আন্দোলন দগদগে ঘায়ের মতো সমাজ-মানসে পরিস্ফুট। কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআই এর কোয়ালিশন হয়েছে; ৭০-৭১ এর চরম সন্ত্রাসময় পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন এবং ৭২-এ নির্বাচনের নামে প্রহসনও হয়ে গেছে। ৭৫-এ ইন্দিরা গান্ধি জরুরি অবস্থা জারি করলেন — যা এই উপন্যাসের অন্যতম নিয়ন্তা তথা আলোচ্য বিষয়। এই জরুরি অবস্থাকে বৃহত্তর স্বার্থে সিপিআই (উপন্যাসে মণিমোহন ও ব্যক্তিজীবনে দীপেন্দ্রনাথ যে দলের হোলটাইমার ছিলেন) সমর্থন জানায় এবং এই নিয়ে তাদের শরিকদল সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে সংঘাত চরমে পৌঁছায়। উপন্যাসে এই প্রসঙ্গ একাধিকবার নানান আলোচনা ও প্রতর্কে ঘুরেফিরে এসেছে। এছাড়াও ৭৭-এর নির্বাচনে সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট বিপুল সাফল্য লাভ করে এবং সেই বছরেই সিপিআই দলে আরও ভাঙন দেখা যায়। এই সমস্ত ইতিহাসের এক নির্ভরযোগ্য দলিল হয়ে উঠেছে ‘বিবাহ বার্ষিকী’। রাজনৈতিক এই ভাঙাগড়া এবং তারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে সমাজের দ্রুত বদলে যাওয়াকেই দীপেন্দ্রনাথ তুলে ধরতে চেয়েছেন মণিমোহনের বাচন ও আত্মকথনের মধ্যে দিয়ে। মানবিক মূল্যবোধের অভাবনীয় অবক্ষয় মানতে যারপরনাই কষ্ট হয় মণিমোহনের। সেই সঙ্গে নিজেকে চিরে চিরে দেখার এক অদম্য বাসনায় দীপেন্দ্রনাথের অন্যান্য উপন্যাসের প্রোটাগনিস্টদের মতোই মণিমোহনও যথেচ্ছ আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মক্ষয় করে যায় অনবরত। এই উপন্যাসে মণিমোহন শুধুই ব্যক্তিপরিচয়ের সংকটের মুখোমুখি হয় না, তার রাজনৈতিক পরিচিতিও এক প্রত্নআঁধার গূঢ়ৈষণার সম্মুখবর্তী হয়। 

নিজের সংসারের ছোটো গণ্ডিতে অবশ্য মণিমোহন প্রাণপণ চেষ্টা করেন কোনও মালিন্য ঢুকতে না দেবার। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার্থী, অন্তর্মুখী অথচ পরিণতমনস্ক কন্যা মিতু এবং নার্সারিতে পড়া দুরন্ত ও একইসঙ্গে মেধাবী, তার্কিক শিশুপুত্র বাবুয়াকে নিয়ে মণিমোহন-কনকের সংসার। ভাইবোনের নানা খুনশুটিতে এবং তাতে তাদের মা ও বিশেষ করে বাবার ঘৃতাহুতিতে ছদ্ম কলহের পরিস্থিতি উপর্যুপরি সবসময়ই তৈরি হলেও পরিবারে একটা নিরবচ্ছিন্ন হাস্যমধুর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকে। অথচ তাদের দুই সন্তানের জন্মই অসম্ভব বিঘ্নসংকুল এক ‘হওয়া না-হওয়া’ সময়ে। বাষট্টিতে মিতুর জন্মের সময় চিনের সঙ্গে ভারতের গন্ডগোল আর কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে অভিযান; আবার সত্তরে বাবুয়ার জন্মের সময় কমিউনিস্টদের নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি, পথেঘাটে বোমা-পিস্তলের ত্রাস। এহেন ঝঞ্ঝা-বিধ্বস্ত সময় পেরিয়েও সেই দম্পতি আপ্রাণ চেষ্টা করেন তাদের সন্তানদের এই সর্বগ্রাসী অন্তর্ঘাত থেকে রক্ষা করতে। সবসময় পারেন না। লোহার বাসরের কোনও এক ছিদ্রপথ দিয়ে ভোগবাদী সমাজের দুষ্প্রতিরোধ্য হাতছানি অবুঝ শিশু বাবুয়ার নাগালে এসে যায়। তার বন্ধু সুপ্রতীক তাকে ক্যাডবেরি খাওয়ায়, টিভি দেখানোর প্রলোভন দেখায়। মণিমোহন যখন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে কমিউনিস্টরা ক্যাডবেরি খায় না, তখন সে তীব্র প্রতিবাদে জানায় যে অমিয় কাকু কমিউনিস্ট হওয়া সত্ত্বেও নিজে ক্যাডবেরি খায় এবং তাকেও খাওয়ায়। শুধু তাই না, আবেগদৃপ্ত কণ্ঠে সে জানায় — বাবার মতো কমিউনিস্ট হতে চায় না, সে আনন্দমেলার কমিকসে পড়া টিনটিন হতে চায়। মণিমোহন বুঝতে পারেন পণ্যমোহমুগ্ধতা অলক্ষ্যে কীভাবে শিশু মনেও চারিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে বুঝতে পারেন, যে ঐকান্তিক নিষ্ঠায় তিনি নিজের সন্তানের মধ্যে একটা কমিউনিস্ট পরিচয়কে গেঁথে দিতে চাইছেন, স্বাধিকারপ্রমত্ত বস্তুবাদী বিশ্ব সেই পরিচিতিকেও নিরবধি ঠেলে দিচ্ছে অবিকল্প সংকটের মোহনায়। 

সমকালীন রাজনৈতিক বৈরিতা যে কতদূর নির্মম ও পাশবিক ছিল, তার প্রমাণ অবনের ঘটনাটি। মণিমোহনদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের অবন তার সঙ্গীদের নিয়ে এসে মণিমোহনকে অহেতুক অপমান করে যায়। মণিমোহনের হাতের লেখা নকল করে একটি প্রেমপত্র লিখে তাকে ব্ল্যাকমেল করবার চেষ্টা করে যাতে তিনি পরের দিন পার্টির রিভিউ মিটিং-এ না যান। প্রাথমিক ভাবে সমাজ, পরিবার ও নিজের সম্মানের কথা ভেবে মণিমোহন ব্যতিব্যস্ত হলেও, এমনকি আত্মহত্যার কথা ভাবলেও, পরে প্রত্যাহারপ্রবণ দৃঢ়তায় তিনি সেই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসেন। অবন খানিক তর্ক ও হুমকি প্রদর্শন করলেও নিষ্পাপ নিরুদ্বেগ মণিমোহন অব্যবস্থিতচিত্ত-ভাবে এই হোক্স প্রতিহত করেন। বামফ্রন্টের ভাঙন ও শরিকি ঝামেলায় ব্যতিব্যস্ত থাকার কালেও কংগ্রেসের কিছু মূল্যবোধহীন ও নিম্নরুচির রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পরিচায়ক এই ঘটনা। 

মণিমোহনের সততা ও মানবিকতার পরিচয় পাওয়া যায় বাংলাদেশ থেকে আগত আজীবন কমিউনিস্ট কর্মী শত্রুঘ্নদার পরিচর্চায় ও প্রযত্নে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা এই প্রবীণ নেতা প্রায় সারাজীবন জেল অথবা আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে শেষ পর্যন্ত মুজিব হত্যার ঘটনা ঘটলে ঘৃণায় দেশ ছাড়েন। সরকারি নিরাপত্তাকে প্রত্যাখ্যান করে স্বেচ্ছায় বেছে নেন অবর্ণনীয় বস্তির মর্মন্তুদ পরিবেশকে। আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার এই অশ্লীল প্রতিযোগিতার সময়ে, যখন কেউ মানুষের জন্য কিছু করলেও তা অধিকাংশ সময়েই দীর্ঘস্থায়ী হাততালি কুড়োবার এক কায়েমি প্রচেষ্টা হিসেবে বোঝা যায়, তখন শত্রুঘ্নদার মতো মানুষের গুরুত্ব মণিমোহন আরও বেশি করে অনুভব করে থাকেন। আত্মপীড়নে চিরঅভ্যস্ত এই প্রৌঢ় মানুষটির অন্নক্লিষ্টতা প্রত্যক্ষ করে মণিমোহন সিদ্ধান্ত নেয় চাঁদা তুলে তাকে কিছু সাহায্য করবেন। কিন্তু যাদের থেকে সাহায্য পাবেন ভেবেছিলেন, তারা প্রায় প্রত্যেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও কেউই এই মহৎ উদ্যোগে এগিয়ে আসে না। পেটি বুর্জোয়া আত্মকেন্দ্রিকতা এবং তাৎক্ষণিক ভাবে বাঁচার বিলাস এই ভোগবাদী সময়ে সকলকেই নির্মম ভাবে গ্রাস করেছে। 

ইন্দ্রদার বাড়িতে সদ্য আলাপি এক ভদ্রমহিলা, দূর্বা, তাকে সাহায্য করতে চান। কিন্তু মণিমোহন সবিনয়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি টাকা নিয়ে রসিদ দিতে পারবেন না। যদিও পরে দূর্বার যুক্তির কাছে তাকে হার মানতে হয় যখন দূর্বা বোঝান — বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাকে সাহায্য করা মানে আসলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেই সাহায্য করা; এবং মণিমোহনের ব্যক্তিগত নৈতিকতার জন্য তিনি এই মহৎ অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে চান না। অসততা ও প্রবঞ্চনার আবছা অনির্ভরযোগ্য সমাজে সবেমাত্র আলাপ হওয়া এক ব্যক্তিকে কীভাবে এতটা বিশ্বাস করে বড়ো অঙ্কের অর্থসাহায্য করতে প্রবৃত্ত হলেন দূর্বা? উত্তরটা লুকিয়ে আছে জোন বায়েজের গান শুনতে শুনতে মণিমোহনের অশ্রুপাতে। দূর্বা উপলব্ধি করেন, সুদূর ভিয়েতনামের দুর্ভাগ্যপীড়িত কিছু মানুষের কথা ভেবে যে মানুষটি তদ্গত ভাবে নীরবে চোখের জল ফেলতে পারেন, তার এমপ্যাথি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে না। তাকে নিঃসন্দেহে ভরসা করা যেতে পারে। নির্লোভ, নিঃস্বার্থ মণিমোহন শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঝাড়গ্রামের কোনও আদিবাসী অঞ্চলে গিয়ে কৃষকসভা বা ইউনিয়নের কাজ করবার। নিজের আপাত-নিশ্চিন্ত জীবনকে বর্জনের দ্বান্দ্বিকতায়, পরিত্রাণের এক বিকল্পহীন আকাঙ্ক্ষায় প্রাত্যহিক পরিচয়কে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে এক অজানা সংকটকে নির্দ্বিধায় আমন্ত্রণ জানান মণিমোহন।

পাঁচ 

দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ও প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আগামী’ (১৯৫১)। দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে রচিত এই গ্রন্থটিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে প্রপাগ্যান্ডা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে কিছুটা অতিরিক্ত আবেগ, অবাস্তব ঘটনাবলি এবং উদ্দেশ্যমূলকতা এখানে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে আপাত সরল কাঠামোর এই উপন্যাসেও সনাতন মাঝি চরিত্রটির ধর্মীয় পরিচিতির মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় এক অনতিপ্রকট জটিলতা। চাষি, জোলা, কুমোর, বাগদিদের নিয়ে হিন্দুদের সমৃদ্ধ পুবের গাঁ এবং মুসলমান জেলেদের পশ্চিম গাঁ দীর্ঘকাল ধরে পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করেছে। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে খুব প্রয়োজন ছাড়া তাদের যোগাযোগ না থাকার কারণে যুদ্ধ, দাঙ্গা, মন্বন্তরের কোনও কুপ্রভাব সেই দুই গ্রামে আগে পড়েনি। সেহেন প্রায় ইউটোপিয়ান গ্রামদ্বয়ে কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে গেল এবং সৃষ্টি হল দাঙ্গা-পরিস্থিতি — তারই পরম্পরীণ ধারাক্রমিক বিবরণী এই উপন্যাস। 

দুই গ্রামের মিল দেখানোর জন্য লেখক এমন কিছু প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন, যা সবসময় বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। একই সময় প্রায় একই কায়দায় যেভাবে বাইরের থেকে আগত কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের প্ররোচনায় দুই গ্রামের মানুষই একযোগে হিংস্র ও উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তা খানিকটা আরোপিত মনে হয়। অর্জুন ও আফজলের আবাল্য সখ্য সামান্য উস্কানিতে চুরমার হয়ে যায় এবং ব্যক্তিজীবনের ট্র্যাজেডিকে স্বীকার করে নিয়েও তারা পরস্পরের রক্তপিয়াসী হয়ে ওঠে। দুই ধর্মের দুই প্রতিনিধি — ছিনিবাস মুখোটি ও নছিব হাজি মোল্লার উৎসাহ উদ্দীপনায় আরও দ্রুত হিংসা ছড়িয়ে পরে। একমাত্র গ্রামের নারীরা এর বিরোধিতা করে। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাদের স্বর নিয়ামকের ভূমিকায় পৌঁছাতে আদৌ পারে না। অথচ গ্রামের পত্তন হয়েছিল অর্জুনের পিতা জনার্দন এবং আফজলের পিতা জলিলের উদ্যোগে ও পরিশ্রমে। তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, নির্ভরতার উত্তরাধিকার এতদিন দুটো গ্রাম সফল ভাবে বহন করে যাচ্ছিল। কিন্তু নোয়াখালি, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও কলকাতার দাঙ্গার ভাইরাস শহুরে বাবুদের মারফৎ দেরিতে হলেও অভ্রান্ত ঢুকে যায় পুবের ও পশ্চিমের গাঁয়ে। নিকটবর্তী জনপদ রুপালীর গঞ্জের নিবারণ মোক্তার কয়েকশো বিঘে সোনা ফলানো জমি হস্তগত করে জমিদার হবার কূট-অভিপ্রায়ে এই দাঙ্গা লাগাতে চায়। ওদিকে আকবর চৌধুরীও মুসলমানদের প্ররোচিত করতে থাকে দাঙ্গা লাগিয়ে হিন্দুদের খুন ও বিতারিত করে নবাবি পাওয়ার প্রত্যাশায়। গ্রামের সরলবিশ্বাসী মানুষগুলো সহজেই এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ধ্বংসকামী হয়ে ওঠে। 

এই হিংসার আবহের বিপ্রতীপে লেখক সনাতন মাঝি ও মমতাজ চরিত্রদুটিকে আনেন। এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যৌবনে তাদের প্রণয় ও বিবাহের জন্য উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই যথেষ্ট হেনস্তার শিকার হয়। শেষ পর্যন্ত নানাস্থান ঘুরে এসে অবশেষে এই দুই গ্রামের কাছে আশ্রয় ও গ্রামবাসীদের অপরিসীম ভালোবাসা পান। এই দম্পতি আসলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক। অর্জুন ও আফজল দলবল নিয়ে এসে তার ধর্ম ও অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুললে সনাতন কোনও সম্প্রদায়ের পক্ষভুক্ত না হয়েই নিজের মাঝি পরিচয়কে তুলে ধরে। পরপর দু-দুটি এনকাউন্টারই প্রায় একে অন্যের অনুপূরক। 

“ নন্দ সরাসরি প্রশ্ন করে বসল, ‘তুমি তো হিন্দু মাজি বাই?’ 

ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়ল মাঝি। 

‘তবে? তবে তুমি অইলা মুসলমান?’ ঘৃণায়, হিংসায়, বিস্ময়ে যেন আর্তনাদ করে উঠল সবাই। 

আবার স্মিত মুখে ঘাড় নাড়ল বুড়ো। 

‘তবে তুমি কী?’ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল তারা। 

বুড়ো তাকাল বুড়ির দিকে। বুড়ি এক ঝলক তার মুখের দিকে চেয়ে নিয়ে বলল, ‘বুড়া কয়, হ্যা অইল মাজি — আর কিছু না।’ ”[৬] 

এই পরিচয় নিয়ে আয়না-সদৃশ দ্বন্দ্ব-সমাস এবং জিজ্ঞাসার দেওয়াল জারি থাকে আফজলের দল এসে যখন তাকে জেরা করে, সেই সময়েও। 

“ আফজল বলল, ‘তুমি তো মুসলমান?’ 

ঘাড় নাড়ল মাঝি। 

কী কইলা? মুসলমান নও তুমি?’ ঘৃণায় যেন শিউরে উঠল তাদের স্বর, ‘হিন্দু?’ 

হাসিমুখে ঘাড় নাড়ল বুড়ো। 

‘তবে তুমি কী? আল্লা না বাদশা।’ 

ওদের উপহাসের উত্তর দিল বুড়ি। সে বলল ‘বুড়া কয়, হ্যায় অইল মাজি। মুরুক্ষু মাজি — জাইত্‌ ধর্মের কথা জানেও না — বোঝেও না কিসু।’ ”[৭] 

আত্মপরিচয়ের যে সংকট অহরহ দীর্ণ করেছে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষিত, সচেতন প্রতিটি চরিত্রকে, সেখানে দাঁড়িয়ে এই মৃত্যুত্তীর্ণ বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা নিজেদের পরিচয়কে সমসময়ের কলুষতায় ঘুলিয়ে উঠতে দিলেন না কী অসম্ভব যুক্তিকঠিন আন্তরিকতায়! অথচ তাদেরই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল একটা নির্দিষ্ট পরিচয়ের। পৃথক দুই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে অনাবশ্যক বৈরিতার্জনের চেয়ে যে-কোনও এক পক্ষ নেওয়াই তো ছিল সমীচীন ও নিরাপদ। কিন্তু তারা, ভ্রাতৃহত্যার সালতামামির মাঝেও নিরুদ্বেগ স্থিরতায়, নিজস্ব নির্বাচনে নিজেদের উত্তরণ ঘটালেন মানবতার অঙ্গনে। 

ছয় 

দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার, জগতে অস্তিত্বশীল হওয়া বোঝাতে একটা নতুন শব্দ ব্যবহার করেছিলেন — ডাজায়েন (Dasein); যার ইংরাজি অর্থ করা যায় being there বা presence। ডাজায়েন এবং আমাদের এই চেনা জগতের মধ্যে একটা অবিছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। জগৎ সম্পর্কে উদ্বেগ (বা care) প্রতিটি মানুষের অস্তিত্বের মূল কথা। আর দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রধান চরিত্ররা প্রত্যেকেই জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নিরবধি চিন্তাশীল। ফলে তাদের জীবনে যতই সংকট থাকুক না কেন, দার্শনিক প্রস্থানে তারা প্রত্যেকেই প্রবল ভাবে অস্তিত্ববান। তীব্র অবসাদে ভুগলেও নিশানাথের মধ্যে নিজের Being বা সত্তাকে চিরে চিরে, খুঁড়ে খুঁড়ে দেখার একটা উদগ্র বাসনা রয়েছে। সে তার পরিপার্শ্বকে সম্যক ভাবে বুঝে নিতে চায় অনুক্ষণ। তাই অনেক সময় কথায় ও কাজে অন্বয় না থাকলেও তার ভাবনার জগতে একটা অন্তর্লীন সামঞ্জস্য খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। নিশানাথের মননের কেন্দ্রীয় অভিভব জুড়ে একটা একমুখী সরণ প্রত্যক্ষ করা যায়, যা তাকে আত্মপরিচয়ের বিবিধ সংকট থেকে ক্রমশ নিয়ে যায় সুদূরপরাহত কোনও খর-জাগর অনুভবের জগৎ-এ। 

আবার জয়তী সবসময় তার self বা আত্মনের অনুসন্ধান করে চলেছে। সে একাধিক পরিচয়ে নিজেকে আবিষ্কার করে, প্রকৃত প্রস্তাবে সে কে — এই মৌল প্রশ্নের দিকে ধাবিত হয়েছে। বাম রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত জয়তীর জীবনে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রভাব এতটাই নিয়তস্পৃষ্ট যে জীবনের প্রতিটি বাঁকে সে দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপটকে ছুঁয়েই বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে নিতে চায় — 

· ‘জয়তী দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়েছে সত্যি। কিন্তু আরও কত বড় কর্তব্যের টান, টান আর দ্বন্দ্ব তার সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে একথা যদি জানতেন, তাহলে কি প্রকাশদা তার ওপর এভাবে রাগ করতে পারতেন?’[৮] 

· ‘এত করে মানুষ কোথায় পৌঁছয়? জীবন কতটুকু। কত ছোট! কত সীমাবদ্ধতায় ভরা! দেশ, মানুষ, ভবিষ্যৎ, তার প্রেম, আসাদ, ভাল লাগা আর কর্তব্যের দ্বন্দ্ব — এ সবও তো একদিন থাকবে না।’[৯] 

· ‘মন চায়, একথা ভেবে গর্ব। অথচ শরীর চায় — এ চিন্তায় এত লজ্জা কেন?… আপন দ্বিধা আর দ্বন্দ্বে জয়তী বিভোর।’[১০] 

· ‘দুঃখ হচ্ছে, ভালও লাগছে। দুঃখবোধ আর ভাল লাগা — এই দুই বিরোধী মনোভাবের মধ্যে নতুন জয়তীর জন্ম হচ্ছে।’[১১] 

উদাহরণ না বাড়িয়েও বলা যায়, জয়তীর এই আত্মখনন, দ্বন্দ্বের ভাঙাচোরা অ্যাসফল্ট পেরিয়েই পৌঁছে যায় দৃঢ়পিনদ্ধ আত্মোপলব্ধির দিকে। 

দেকার্তের প্রবাদপ্রতিম উক্তি ‘Cogito, ergo sum’ (I think, therefore I am), অর্থাৎ আমি চিন্তা করতে পারি, সুতরাং আমার অস্ত্বিত্ব আছে — বিষয়টি অনিবার্যতই মিলে যায়মণিমোহনের জীবন চর্যার সঙ্গে। তার ভাবনা, কথা, আচরণ — সব কিছুরই একটা সুনির্দিষ্ট ছাঁদ রয়েছে। স্থিতধী, চিন্তাঋদ্ধ মণিমোহন দলীয় আনুগত্য মেনেও নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছেন কেবলমাত্র সচেতন ‘বিয়িং’-এর লালনকারী বলে। তবুও তার রাজনৈতিক পরিচয় যখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তখন সামান্য হলেও আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে তার। বিপক্ষ দলের (কংগ্রেস) কর্মীদের সঙ্গে বাদানুবাদের সময় তো বটেই; এমনকি একই ফ্রন্টের বড়ো শরিক দলের (সিপিআইএম) সমর্থক, তারই বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কও একটা সূক্ষ্ম ক্রাইসিসের সামনেই ঠেলে দেয় মণিমোহনকে। নিজের চরিত্রের প্রতি নিষ্প্রশ্ন নির্ভার আস্থা, পরিবারের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা ও কর্তব্য এবং দল তথা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তাকে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে। 

আর সনাতন মাঝি দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলির মধ্যে একমাত্র নির্বাক চরিত্র হলেও আদৌ নীরব না। চোখের ভাষা, মুখের হাসি আর দীর্ঘদিনের জীবনসঙ্গী মমতাজের অনুবাদে সেও হয়ে ওঠে বাঙ্ময়। উন্মত্ত আত্মহারা দাঙ্গাকারীদের মুখরতায় যখন ‘প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে’, যখন সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে এমনকি তাদের দাম্পত্যেরও ধর্মীয় পরিচয়; তখনও এক আশ্চর্য সহনশীলতায় সনাতন আত্মদীপ জ্বেলে আলোকিত করে তোলে নিজের মাঝি পরিচয় — আসলে যা মানবতারই নামান্তর। 

তথ্যসূত্র : 

১. অমর্ত্য সেন :  ‘পরিচিতি ও হিংসা : কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স : প্রথম আনন্দ সংস্করণ জুলাই, ২০১০ : তৃতীয় মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১৬ : পৃষ্ঠা- ২ 

২. দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় : ‘উপন্যাস সমগ্র: কলকাতা : একুশ শতক : প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০০৩ : প্রথম একুশ শতক সংস্করণ, মার্চ ২০০৮ : পৃষ্ঠা- ১৮৬ 

৩. তদেব : পৃষ্ঠা- ১৯১ 

৪. তদেব : পৃষ্ঠা- ১৩১                  

৫. তদেব : পৃষ্ঠা- ১৪৬ 

৬. তদেব : পৃষ্ঠা- ২৮ 

৭. তদেব : পৃষ্ঠা- ৩০ 

৮. তদেব : পৃষ্ঠা- ৫৫ 

৯. তদেব : পৃষ্ঠা- ১০৫ 

১০. তদেব : পৃষ্ঠা- ১২২ 

১১. তদেব : পৃষ্ঠা- ১২৫

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান