ধনতন্ত্রের পরিচিতি : আর্থিক বৈষম্য 

সহদেব 

 বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থা সাধারণভাবে ধনতান্ত্রিক। বিশ্বের মোট ১৯৫টি দেশের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া বাকি সব ধনতান্ত্রিক। তাই সমগ্র বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থা মোটের ওপর ধনতান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থা। 

ধনতন্ত্র শব্দকে ইংরাজিতে capitalism বলা হয়। ‘ধন’ শব্দটা আসলে ধনসম্পদ বা সম্পদ শব্দের সমার্থক বা তার ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। অর্থাৎ ব্যবস্থার কেন্দ্রে রয়েছে সম্পদ। ইংরেজি শব্দ capitalism-কে  বাংলায় বলা হয় পুঁজিবাদ। পুঁজি সম্পদের বিশেষ অংশ। পুঁজি হল সম্পদের সেই অংশ যা পুনরায় সম্পদ সৃষ্টি করে। পুঁজি বিনিয়োগ করে সৃষ্টি হয় সম্পদ। বাংলায় ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদ দুটি একই ব্যবস্থার নাম। নাম থেকে মনে হয় ব্যবস্থাটার লক্ষ্য হল আসলে সম্পদ সৃষ্টি। ব্যবস্থা মূলত পরিচালিত হয় সম্পদের রক্ষণ এবং সম্পদ সৃষ্টির জন্য।

বিশ্বে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শুরু ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে। সময়টা ১৭৫০ বা তার কিছু পরে। শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে যা শুরু হয় তাকে ইংরাজিতে বলা হয়  industrial capitalism। এই আর্থিক ব্যবস্থায় শিল্প গড়ে উঠতে শুরু করে। প্রধানত যে শিল্প গড়ে ওঠার সঙ্গে এই ব্যবস্থা গড়ে উঠল তা হল বস্ত্রবয়ন বা টেক্সটাইল শিল্প। তার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকল রাসায়নিক শিল্প। বস্ত্র শিল্পের সঙ্গে তা কিছুটা সম্পর্কিত ছিল। 

এই উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রধান হল শিল্প উৎপাদন। এই ব্যবস্থার পূর্বে যে ব্যবস্থা ছিল তা সামন্ততন্ত্র এবং মার্কেন্টাইলিজম। এই ব্যবস্থায় উৎপাদন তো হতই। তবে  বাণিজ্যের গুরুত্ব ছিল বেশি। শহর থেকে শহরে বাণিজ্য, রাজ্য থেকে রাজ্যে বাণিজ্য, দেশ থেকে দেশে বাণিজ্য।  প্রথমে সব দেশ একই দ্রব্য বাণিজ্য করত না। প্রতিযোগিতাও ছিল না। পরে বিভিন্ন দেশ একই দ্রব্য বাণিজ্য করার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠল প্রতিযোগিতা। বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা। 

শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে যে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন হল তাতে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ল। সম্পদ সৃষ্টি বাড়ল। মানুষের সঙ্গে সম্পদের সম্পর্ক পরিবর্তিত হল। 

ক্লাসিক্যাল অর্থনীতি বিষয়ের শুরু ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে অ্যাডাম স্মিথের লেখা গ্রন্থ ‘An Inquiry into the Nature and Sources of Wealth of Nations’ প্রকাশ করার সঙ্গে। ব্যবস্থার কেন্দ্রে আছে সম্পদ। তাই সম্পদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক খুঁজতে পারা জরুরি। ধনতন্ত্রের শুরুর সঙ্গে সঙ্গে স্মিথের ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিরও শুরু।

ধনতন্ত্রের শুরু কার্যত প্রথম শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে। প্রথম শিল্প বিপ্লবই সাধারণভাবে শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত। তারপর আরও তিনটে অর্থাৎ মোট চারটি শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। সাধারণভাবে বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে শিল্প বিপ্লব হয়েছে। বলা হয় বিভিন্ন  invention-কে innovation এ রূপান্তরিত করে শিল্প বিপ্লব বাস্তবায়িত হয়েছে। 

প্রথম শিল্প বিপ্লবের শুরু ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ বা তার কিছু পরে। প্রথম শিল্প বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি ছিল বাষ্পচালিত যন্ত্রের ব্যবহার। এর ফলে হস্তচালিত তাঁতের পরিবর্তে এল বাষ্পচালিত তাঁত বা পাওয়ার লুম। জেমস ওয়াটের বাষ্পচালিত ইঞ্জিনের আবিষ্কার সেই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পাওয়ার লুমের ইতিহাস সময়ের সাপেক্ষে দীর্ঘ ইতিহাস। প্রথম শিল্প বিপ্লবের মূল শিল্প ছিল বস্ত্রবয়ন শিল্প। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল রাসায়নিক শিল্প।

দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের শুরু ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি ছিল বিদ্যুৎ, ইস্পাত এবং পেট্রোলিয়ামের আবিষ্কার। মাইকেল ফ্যারাডের বিদ্যুৎ এবং টমাস আলভা এডিসনের বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রের আবিষ্কার এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। তিতুসভিলের পেট্রোলিয়াম আবিষ্কারও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বিদ্যুৎ, ইস্পাত (বেসেমার) এবং পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার পরিকাঠামো, যানবাহন ইত্যাদির ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম হয়। নগরায়ন দ্রুত হারে বাড়তে থাকে।

প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব যে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছিল তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অর্থ হল একজন শ্রমিক একই সময়ে আরও বেশি উৎপাদন করতে পারা। হস্তচালিত তাঁতে একজন শ্রমিক নির্দিষ্ট সময়ে যা উৎপাদন করতে পারত পাওয়ার লুমে ওই একই সময়ে তার চেয়ে অনেকটাই বেশি উৎপাদন করতে পারে। বিদ্যুত, ইস্পাত এবং পেট্রোলিয়ামের আবিষ্কারের পর উৎপাদনশীলতা আরও  বাড়ল শুধু নয়, উৎপাদন ব্যবস্থা আরও  বৈচিত্রময় হয়ে উঠল। এই অর্থে যে, এই আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে আরও নতুন শিল্প গড়ে উঠতে লাগল। যানবাহন, রাস্তা, পরিবহণ, রেল এবং টেলিকম ইত্যাদি সব মিলিয়ে পরিকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হল। নির্দিষ্ট শিল্পের শ্রমিক ও কাঁচা মাল সহজলভ্য হলে। উৎপাদনশীলতা বাড়ল এবং উৎপাদন খরচ কমল।

তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের শুরু ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে। ইলেকট্রনিক্স এবং কম্পিউটারাইজেসন তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের চালিকা শক্তি। এই দুটি বিষয় একত্রে শিল্পে অটোমেশন নিয়ে আসে। অটোমেশন কথাটার অর্থ হল উৎপাদনে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যা শ্রম নিয়োগ যথাসম্ভব কমাতে পারে। অর্থাৎ শ্রম নিয়োগের পুনরাবৃত্ত ব্যয়ের পরিবর্তে এই প্রযুক্তির ব্যবহারের এককালীন ব্যয় আখেরে উৎপাদনের দীর্ঘকালীন ব্যয় কমায়।  প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের উৎপানশীলতা বৃদ্ধির চেয়ে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের উৎপাদনশীলতা শ্রমিকের হাত থেকে আয় এবং সম্পদ কেড়ে নিয়েছে আরও বেশি করে।

প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধি একই  হারে হয়েছিল নাকি অনেকটা পার্থক্য ছিল — সমগ্র বিশ্বের ক্ষেত্রে সেই তথ্য পাওয়া কঠিন। তবে সাম্প্রতিক কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও মজুরি বৃদ্ধির হারে বড় পার্থক্য দেখা গেছে। 

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের শুরু ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এই শিল্প বিপ্লবের চালিকা শক্তি ডিজিটালাইজেশন। এই শিল্প বিপ্লবে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে তথ্য প্রযুক্তিকে। বিশ্ব জুড়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্বে আছে বিগ ফাইভ বা বিগ টেক। বিগ টেকরা হল  FAMAG — ফেসবুক, আমাজন, মাইক্রোসফট, অ্যাপেল এবং গুগল। শরীরী দ্রব্য এরা প্রায় প্রস্তুত করেই না। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। আয় এবং সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে কিছু মানুষের হাতে। 

প্রথম শিল্প বিপ্লব থেকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পর্যন্ত ধনতন্ত্রের যে রোডম্যাপ তাতে আয় এবং সম্পদের কেন্দ্রীভবন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। তাই ধনতন্ত্রের আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত আছে আর্থিক বৈষম্য।

ধনতন্ত্রের শুর থেকেই আর্থিক বৈষম্য উল্লেখযোগ্য আকার ধারণ করতে থাকে। সমগ্র বিশ্বের আর্থিক বৈষম্যের নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া কঠিন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য Michael Moatsos এবং Joery Pratern এর লেখা ‘Income Inequality Since1820’ (2014) শীর্ষক প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে লেখকগণ ১৮২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আয়ের গিনি সহগের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের আয়ের বৈষম্যের ছবি তুলে ধরেছেন। 

এই প্রবন্ধে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাতে সমগ্র বিশ্বকে একটি অর্থনীতি ধরে নেওয়া হয়েছে। প্রবন্ধে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বের আয়ের গিনি সহগের মান ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ছিল ৪৫, ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দেও ছিল ৪৫ (মাঝে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তা হয়েছিল ৩৮)। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে তা আবার নেমেছিল ৩৬ এ। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে আয়ের গিনি সহগ ছিল ৪০, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তা ছিল ৪৪, ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ছিল ৩৮। ১৯৬০, ১৯৭০, ১৯৮০, ১৯৯০ বছরগুলিতে আয়ের গিনি সহগ যথাক্রমে ছিল ৩৮, ৩৭, ৩৬ এবং ৩৯। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে এই সহগের মান দাঁড়ায় ৪৫।

ওপরের তথ্য থেকে বলা যায় যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময় থেকে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত আর্থিক বৈষম্য সবচেয়ে কম ছিল। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আর্থিক বৈষম্য উচ্চ পর্যায়ে ছিল। 

সম্প্রতি পিকেটি এবং চ্যান্সেলদের ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি রিপোর্ট, ২০২২’ প্রকাশ হয়েছে। পিকেটিদের মতে (৫২ পাতা) ১৮২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। এই সময়কালের মধ্যে বিশ্বের আর্থিকভাবে উচ্চতম ১০% এর আয় বিশ্বের মোট আয়ের ৫০% থেকে বেড়ে ৬০% তে পৌঁছেছে। অন্যদিকে,একই সময়ে, আর্থিকভাবে নিম্নতম ৫০% এর আয় মোট আয়ের ১৪% থেকে নেমে ৭% এ নেমেছে। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তা আরও নেমে ৫% এ পৌঁছায়, আবার ২০২০ খ্রিস্টাব্দে ৭% এ পৌঁছায়।

পিকেটিরা বলেছেন বিশ্ব জুড়ে আর্থিক বৈষম্যের বিভিন্ন মাপকাঠি আছে। তার মধ্যে অন্যতম হল গিনি সহগ। বিশ্ব গিনি সহগ বা global Ginni index অনুসারে বিশ্বে আর্থিক বৈষম্য দু-বার শীর্ষে পৌঁছেছিল। দুবারই তার মান ছিল ০.৭২, প্রথমবার ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে আর দ্বিতীয়বার ২০০০ খ্রিস্টাব্দে।

ব্যবস্থাটাই এমন যে সময়ের সঙ্গে আয় এবং সম্পদ কুক্ষিগত হতে থাকে কিছু মানুষের হাতে। আর্থিক বৈষম্য তাই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিচিত সত্তা। 

জাতীয় আয়ের প্রধান দুটি অংশ হল মুনাফা এবং মজুরি। ধনতন্ত্রের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মালিকের মুনাফা বাড়তে থাকে। জাতীয় আয়ে মুনাফার অংশ বাড়লে মজুরির অংশ কমতে থাকে। ধনতান্ত্রিক আর্থিক ব্যবস্থায় মুনাফা ক্রমশ কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হতে থাকে। 

মুনাফা বৃদ্ধির হার বাস্তবায়িত হতে হলে উৎপাদিত দ্রব্য বাজারে বিক্রি হতে হবে। কিন্তু মজুরি ক্রমশ কমে যেতে থাকলে উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ যারা এই উৎপাদিত দ্রব্য কিনবে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে না মজুরির উৎপাদিত দ্রব্যের বৃদ্ধির হারের থেকে কম হারে বৃদ্ধির জন্য। অর্থাৎ খোদ চাহিদার অভাবে বিক্রি হয় না উৎপাদিত দ্রব্য।

চাহিদার অভাবে উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি না হলে মন্দা হতে পারে। আর্থিক বৈষম্য বিশ্বে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে চূড়ান্ত আকার ধারণ করার পর ১৯৩০ এর দশকে মহামন্দার বা great depression-এর কবলে পড়ে সমগ্র বিশ্ব। মন্দার শুরু ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে,আর তা চলেছিল এক দশক ধরে। এই মহামন্দায় বিশ্বে আর্থিক বৃদ্ধি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশকে ছুঁয়েছিল মহামন্দা। একই রকমভাবে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের বৈষম্য বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের মন্দা। 

মহামন্দা পর্যন্ত ছিল ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক চলা। অ্যডাম স্মিথের মত অনুযায়ী বাজারের অদৃশ্য হাত বা invisible hand ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখত। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার দরকার ছিল না। কিন্তু মহামন্দার পর ধনতন্ত্রকে সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিষয়টা গুরুত্ব পেতে থাকে। 

ধনতন্ত্রকে এই সংকট থেকে মুক্ত করার জন্য যে অর্থনীতিবিদ প্রথমেই এগিয়ে এসেছিলেন তিনি হলেন জন মেনার্ড কেইন্স। তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘General Theory of Employment Interest and Money’ প্রকাশ হয় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে। কেইন্সের বিখ্যাত কথাটা হল, মন্দার কারণ হল ‘lack of effective demand’, অর্থাৎ চাহিদার অভাব মন্দার কারণ। চাহিদার  অভাব মানে হল ক্রয়ক্ষমতার অভাব। কেইন্সের মতে এই চাহিদার অভাব ঘোচাতে  রাষ্ট্রকে মাঠে নামতে হবে। সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে টাকা খরচ করবে। সেই টাকা মানুষের কাছে আয় হিসাবে পৌঁছে চাহিদা বাড়াবে। একই সঙ্গে কর কমালে তাও চাহিদা বাড়াবে। এই পদ্ধতির নাম fiscal measures। এইভাবে চাহিদা বাড়ানোর পদ্ধতিতে সংকট থেকে মুক্ত হবে ধনতন্ত্র। এটা ছিল কেইন্সের মত। আর একে বলা হয় কেইন্সের দাওয়াই। 

কেইন্সের fiscal measure ছাড়াও আর একটি পদ্ধতি আছে তার নাম monetary measure। যার মাধ্যমে অর্থনীতিতে টাকার জোগান বাড়ানো হয়। টাকার জোগান বাড়ালে তা মানুষের হাতে পৌঁছে চাহিদা বাড়াবে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান বললেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল রিসার্ভ ব্যাংক মহামন্দার সময়ে টাকার জোগান যথেষ্ট বাড়ায়নি। ফলে মন্দা আরও গভীর আকার ধারণ করেছিল। তৎকালীন ফেডারেল রিসার্ভ ব্যাংকের গভর্নর কথাটা মেনে নিয়েছিলেন। 

বিশ্বের প্রথম মহামন্দা থেকে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি মুক্ত হয়েছিল কেইন্সের দাওয়াই-এর মাধ্যমে — একথা শুধু অর্থনীতিবিদেরা নয়, সমগ্র বিশ্ববাসী মনে করেন। রাষ্ট্র তথা সরকারের হস্তক্ষেপে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছিল মহামন্দার। তবু এই মন্দা চলেছিল প্রায় এক দশক। কেড়ে নিয়েছিল বহু মানুষের জীবন-জীবিকা।

কেইন্সের দাওয়াই বিশ্বকে মন্দার হাত থেকে রক্ষা করেছিল এমনটা কী বাস্তবে সম্ভব? কেইন্স মাল্টিপ্লাইয়ারের কথা বলেছেন। সরকার যদি ১ টাকা ব্যয় করে তাহলে কার্যত ক্রয় ক্ষমতা ১ টাকার চেয়ে বেশি বাড়ে। কতটা বেশি বাড়বে তা নির্ভর করে মানুষ ওই ১ টাকার কতটা সঞ্চয় করবে আর কতটা ব্যয় করবে। যত ব্যয় করবে তত ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে, কারণ সেই ব্যয় আবার মানুষের হাতে আয় হয়ে যাবে। কিছু কিছু দেশ সরকারি খরচ বাড়িয়েছে। বিশেষত ইউরোপের দেশগুলিতে সরকারি খরচ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল সরকার GDP-র কত শতাংশ ব্যয় করতে পারে আর তা দিয়ে সমগ্র অর্থনীতির চাহিদার হাল ফেরানো কী সত্যিই সম্ভব? 

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ধনতন্ত্রকে সংকটের হাত থেকে রক্ষা করেছিল পরিষেবা ক্ষেত্র বা Service Sector। সার্ভিস বা পরিষেবা বিষয়টার গুরুত্ব আছে। বর্তমানে পরিষেবার সঙ্গে বহু রকমের পেশা যুক্ত আছে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হবার আগেও পরিষেবার গুরুত্ব ছিল তবে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিষেবার গুরুত্ব আরও বেড়েছে। 

রাজতন্ত্রের সময়ে যে ঘোড়ার গাড়ি চলত তা ছিল তখনকার পরিবহণের অন্তর্গত। বর্তমানে যানবাহন অনেক রকমের। তার মধ্যে আছে  রেল, রাস্তার পরিবহণ এবং উড়ান। এসবই বর্তমান পরিবহণের অন্তর্গত। যানবাহন পরিষেবা ক্ষেত্রের বা সার্ভিস সেক্টরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পরিবহণ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মানুষ অথবা দ্রব্য পৌঁছে দেয়। তাতে মানুষ কিছু উপযোগ পায়। এই উপযোগ পাওয়াটাই পরিবহণ থেকে পাওয়া পরিষেবা। 

দ্রব্য এবং পরিষেবা উভয়ই উপযোগিতা বা উপযোগ (utility) দেয়। কোনও নির্দিষ্ট দ্রব্য নির্দিষ্ট উপযোগ দেয়। টেবিল একটি নির্দিষ্ট উপযোগ দেয়। অন্য কোনও দ্রব্য সেই উপযোগ দিতে পারে না। আবার পরিবহণ একটি পরিষেবা যা নির্দিষ্ট উপযোগ দেয়। অন্য পরিষেবা পরিবহণের উপযোগ দিতে পারে না। আবার দ্রব্য থেকে পাওয়া উপযোগ এবং পরিষেবা থেকে পাওয়া উপযোগ এক নয়।

ইকনমিক কাউন্সিল অব কানাডা (তাদের প্রকাশিত Employment in service sector, Ministry of Supply and Services, Canda, Ottawa, 1991)-তে  লিখেছে যে দ্রব্য এবং পরিষেবার পার্থক্য চারটি : ১) দ্রব্য শরীরী, পরিষেবা অশরীরী, ২) দ্রব্যের উৎপাদক এবং ভোগকারী সংস্পর্শে আসে না, পরিষেবার উৎপাদক ও ভোগকারীকে সংস্পর্শে আসতেই হয়, ৩) দ্রব্য হস্তান্তরযোগ্য, পরিষেবা হস্তান্তরযোগ্য নয় এবং ৪) দ্রব্য সংরক্ষণ করা যায়, পরিষেবা সংরক্ষণ করা যায় না। পরিবহণের পরিষেবা যখন যানবাহন চলছে তখনই পাওয়া সম্ভব, তাকে সংরক্ষণ করা যায় না, যিনি যানবাহন  চালাচ্ছেন এবং যিনি চড়ছেন তাদের এক সঙ্গেই থাকতে হয়।

ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শুরুর পর থেকে পরিষেবা ক্ষেত্র বা সার্ভিস সেক্টর সংগঠিত হয়েছে আরও বেশি করে। শিল্পে কারখানায় উৎপাদনের সঙ্গে গড়ে উঠেছে পরিষেবা ক্ষেত্র। টেবিল তৈরির কারখানায় টেবিল তৈরির জন্য কাঁচা মাল কিনতে হয়। তার জন্য তৈরি হয়েছে পারচেস ডিপার্টমেন্ট। আবার টেবিল তৈরির পর তাকে বিক্রি করার জন্য তৈরি হয়েছে সেলস ডিপার্টমেন্ট। শিল্প গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে factory বা কারখানা গড়ে ওঠার পাশাপাশি গড়ে উঠেছে সেলস বা পারচেস বিভাগ,যারা পরিষেবা ক্ষেত্র বা সার্ভিস সেক্টরের অন্তর্গত। 

পারচেস বা সেলস বিভাগের কর্মীরা সরাসরি উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে না। কাঠ থেকে যে টেবিল তৈরি হচ্ছে সেই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কারখানার শ্রমিক অংশগ্রহণ করে। সেলস বা পারচেস বিভাগের কর্মীরা তা করে না। ফলে কারখানার অভ্যন্তরে যে শ্রমিক কাজ করে কাঠকে টেবিলে রূপান্তরিত করেকেবলমাত্র তার বা তাদের শ্রম কাঠে যুক্ত হয়ে টেবিল তৈরি হয় এবং তাদের শ্রম কাঠে নিহিত হয়ে টেবিলের মূল্য তৈরি হয়। 

কারখানায় যে শ্রমিক কাজ করে তাদের শ্রম নিহিত হয়ে যেহেতু টেবিলের মূল্য তৈরি হয়, তাদের শ্রম থেকেই সম্পদ তৈরি হয়। আর তাদের শ্রম থেকেই আসে উদ্বৃত্ত মূল্য যা শ্রমিকের তৈরি কিন্তু শ্রমিককে যার মূল্য দেওয়া হয় নি। পারচেস বা সেলস বিভাগের কর্মীরা যেহেতু টেবিল তৈরিতে অংশগ্রহণ করে না তাদের শ্রম টেবিলে নিহিত হয় না এবং তা থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য নিষ্কাশন করা সম্ভব হয় না। 

পারচেস এবং সেলস বিভাগ নিয়ে যে পরিষেবা ক্ষেত্র আছে তার কর্মীরা সম্পদ সৃষ্টি করে না, শোষিতও হয় না। সমস্ত পরিষেবা ক্ষেত্রের মধ্যে যেসব পেশা আছে তার কোনোটিই যেহেতু দ্রব্য প্রস্তুত করে না তাই তার কর্মীরা সম্পদ সৃষ্টি করে না,শোষিত হয় না। সম্পদ যে সৃষ্টি করে না সে শোষিতও হয় না। পরিবহণ শিল্পেও তাই কোনও দ্রব্য উৎপাদন হয় না এবং সম্পদ সৃষ্টি হয় না।

বিশ্বে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হবার পর যিনি সম্পদের উৎস ও প্রকারভেদ খুঁজতে গিয়ে ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রের সূচনা করেছিলেন সেই অ্যাডাম স্মিথ সুস্পষ্টভাবে তাঁর বইয়ের ‘productive labour and unproductive labour’ নামক পরিচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, যে দ্রব্য উৎপাদনে সম্পদ সৃষ্টি করে সে productive labour এবং পরিষেবা ক্ষেত্রে যে সম্পদ সৃষ্টি করে না সে unproductive labour।

শিল্পের বিকাশের জন্য দরকার পরিবহণ ব্যবস্থার। শিল্প বিপ্লবের আগেও ছিল পরিবহণ ব্যবস্থা। শিল্প বিপ্লবের পর পণ্যের চলাচল এবং শিল্প সম্পর্কিত মানুষের চলাচলের জন্য আরও পরিবহণের প্রয়োজন হল। বিশেষত দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের পর পরিবহণ ব্যবস্থা বিশেষভাবে উন্নত হতে থাকল । পরিবহণ বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে তৈরি হল। কোথাও তা তৈরি করল রাষ্ট্র। আবার কোথাও তা তৈরি করল শিল্পপতি নিজেই। সার্ভিস সেক্টরে প্রচুর মানুষ নিযুক্ত হতে থাকল। দ্রব্য বা পণ্য ক্রয় করার মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকল। সংকট মুক্তি হতে থাকল ধনতন্ত্রের।

শিল্পে উন্নতির জন্য প্রয়োজন ব্যাংকিং ব্যবস্থার। কাঁচা মাল কিনতে নগদ প্রয়োজন। ব্যবসা শুরুর জন্য ঋণ প্রয়োজন। প্রয়োজন মেটাতে বিশ্ব জুড়ে গড়ে উঠেছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ব্যাংকিং ব্যবস্থা সার্ভিস সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। পুঁজি বলতে বর্তমান কালে সাধারণভাবে টাকার অঙ্কে উৎপাদনের উপায়কে বোঝায়। এই টাকাকে ফিনান্স ক্যাপিটাল বলা হয়। শব্দটা প্রথম ব্যবহার করছিলেন এডল্ফ হিলফার্দিং। পরবর্তীকালে লেনিন বিশদে তার ব্যাখ্যা করেন। পুঁজি ফিনান্স ক্যাপিটাল আকারে থাকলে তা একচেটিয়া পুঁজির দিকে ধাবিত হয়। সম্পদ এবং আয় কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হওয়া সহজতর হয়। 

সার্ভিস সেক্টর ছাড়া আরও দুটি সেক্টর আগে থাকতেই ছিল ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে। সে দুটি হল প্রাইমারি সেক্টর — কৃষি এবং সেকেন্ডারি সেক্টর — শিল্প (কারখানা)। সার্ভিস সেক্টর এগোতে এগোতে আরও দুটি সেক্টরের জন্ম দিয়েছে। সে দুটি হল কোয়াটার্নারি সেক্টর এবং কুইনারি সেক্টর। পরিবহণ এবং ব্যাংকিং সার্ভিস সেক্টরের মধ্যে পড়ে। কোয়াটার্নারি সেক্টরের মধ্যে আছে ইনফরমেশন টেকনোলজি আর কুইনারি সেক্টরের মধ্যে আছে শীর্ষ আমলা ও এক্সিকিউটিভ। কুনারির লোগোটাই হচ্ছে I am your boss। গবেষণাও কুইনারির মধ্যে পড়ে। 

এখানে বড় আকারের পরিচিতির কথা আছে। সেকেন্ডারি সেক্টর — ব্লু কলার, টার্সিয়ারি বা সার্ভিস সেক্টর — হোয়াইট কলার, কুইনারি সেক্টর — গোল্ডেন কলার। এখানে কলারের ধারণাটা জামার কলারের মতোই। এই কলারের ধারণা আসলে পরিচিতিরই ধারণা। 

বর্তমান কালে সার্ভিস সেক্টর একটা বড় অংশ অধিকার করে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে গড়ে GDP-তে সার্ভিস সেক্টরের অংশ ৬৩.৬%। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮০%, যুক্তরাজ্যে ৭৯.২%, ফ্রান্সে ৭৮.৮%, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ৭০.৯%, জাপানে ৬৮.৭%, চিনে ৫১%, ভারতবর্ষে ৬১.৫%।

সার্ভিস সেক্টর সমস্ত বিশ্বে জনসংখ্যার ৪৫.৫% মানুষকে কর্মসংস্থান দিয়েছে( ২০১৪)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ৭৯.১%, যুক্তরাজ্যে ৮০.৪% (২০০৬), ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ৬৬.৬% (২০১০), ভারতে ৩১%।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সার্ভিস সেক্টরে নিযুক্ত ছিল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ৬৪%, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ৭০%, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ৭৬%, ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ৭৯%, ২০১০ খ্রিস্টাব্দে ৮৪% ( উৎস: InformIT,  July25, 2013)। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে, বিশেষত উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে, এইভাবে সার্ভিস সেক্টর বেড়েছে। 

সার্ভিস সেক্টর এইভাবে বড়ো অংশের মানুষের কর্মসংস্থান জুগিয়েছে। কিন্তু সার্ভিস যেহেতু সম্পদ তৈরি করতে পারে না সার্ভিস সেক্টর সম্পদ সৃষ্টিতে অবদান রাখতে পারে না। সম্পদ সৃষ্টি না করতে পারলে তার ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির GDP-তে অবদান গণনা করা যায় কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। আবার সার্ভিস সেক্টর আয়ে অবদান রাখে কিন্তু সম্পদ সৃষ্টিতে অবদান রাখে না এই বিরল ঘটনার তাৎপর্য অর্থনীতিবিদগণ নিশ্চিতভাবে নজর করবেন। 

ধনতন্ত্রের শ্রমবিভাগ জীবিকার সংখ্যা বাড়িয়েছে। ধনতন্ত্রের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সার্ভিস সেক্টর অসংখ্য জীবিকার জন্ম দিয়েছে। আর অসংখ্য জীবিকা তৈরি করেছে অসংখ্য পরিচিতি সত্তার ভিত্তিভূমি। ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার আগে যা ভাবনার মধ্যে আসেনি। পরিচিতি সত্তার এবং তার রাজনৈতিক উত্থান ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকেই উদ্গত শুধু নয়, সার্ভিস সেক্টর তার ভিত্তিকে আরও দৃঢ়বদ্ধ করেছে। 

সার্ভিস সেক্টরের মাধ্যমে সংকট মুক্তি হওয়াতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়কালকে ধনতন্ত্রের সুবর্ণযুগ বলা হয়। উল্লেখযোগ্য হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কাল থেকে ৮০-র দশক পর্যন্ত আর্থিক বৈষম্য কমেছিল বিশ্ব জুড়ে। দেশগুলির জাতীয় আয়ে ক্রমশ বেড়েছিল মজুরির অংশ, কমেছিল মুনাফার অংশ। ভারতবর্ষেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এখানে মজুরির অংশের মধ্যে যুক্ত আছে সার্ভিস সেক্টরের মাহিনা। ৭০-এর দশকে যে অটোমেশন শ্রমনিয়োগ কমিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল,সার্ভিস সেক্টর তাকে অনেকটা কমিয়েছে। ৭০-এর দশকের শেষ থেকেই শুরু পরিচিতির রাজনীতি। অর্থাৎ ধনতন্ত্রের সুবর্ণ যুগে একই সঙ্গে অবস্থান করে তুলনায় কম বৈষম্য, সার্ভিস সেক্টর এবং পরিচিতির রাজনীতির উত্থান। 

তারপর ৯০-এর দশক থেকে আর্থিক বৈষম্য তার পুরানো রূপ ধারণ করতে থাকে। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে আর্থিক বৈষম্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমানে ২০২০ খ্রিস্টাব্দে আর্থিক বৈষম্য তার ১০০ বছর আগেকার অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছে। ধনতন্ত্র তার পরিচিতি সত্তা-কে বজায় রেখেছে। 

ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদ তার আর্থিক বৈষম্যের পরিচিতিকে ধারণ করে বয়ে নিয়ে চলেছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর পর তার সাময়িক সমাধান সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু আবার ফিরে আসছে আর্থিক বৈষম্য। কারণ তা ধনতন্ত্রের পরিচিতি। 

আবার আর্থিক বৈষম্য থেকে কী আসতে পারে মন্দা? মহামন্দার পর এসেছে মন্দা। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে মন্দা এসেছিল তবে তা মহামন্দার তুলনায় গভীরতায় অনেক কম ছিল। বৈষম্য বাড়তে থাকলে আবার কী গভীর মন্দা আসতে পারে?  প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।

গভীর মন্দা আবার আসলে সার্ভিস সেক্টরের দাওয়াইতে আর সারানো সম্ভব নয়। সার্ভিস সেক্টর তার উন্নয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বরং সার্ভিস সেক্টরকে কমিয়ে আনার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে কোনও কোনও দেশে। ভারতবর্ষও এরকমই একটি দেশ। 

আর্থিক বৈষম্য যদি ধনতন্ত্রের পরিচিতি হয় তাহলে তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়তে থাকবে। ধনতন্ত্র এখন আর আর্থিক বৈষম্য কমিয়ে আনার  কথা আদৌ ভাবছে কী? হয়তো সেই প্রয়োজন ফুরিয়েছে ধনতন্ত্রের। আগের মত ক্রয় ক্ষমতা হ্রাসের কারণে বাজার হারানোর, আর তাই মুনাফা বাস্তবায়িত করার, আশঙ্কা আর হয়তো অনুভব করছে না ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার চালকেরা। ৮০-র দশকের পর তিনটি দশক ধরে  আর্থিক বৈষম্য বাড়তে থাকায় শীর্ষ স্থানীয় শিল্প মালিকদের আয় এবং সম্পদ ক্রমশ বেড়েছে বহুগুণ। আর্থিক ভাবে দুর্বল মানুষের আয় এবং সম্পদ কমছে। বিগত দু-বছরে  মহামারির আনা মন্দা প্রমাণ করে দিয়েছে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ জীবন ও জীবিকা হারালেও শীর্ষ শিল্প মালিকের আয় এবং সম্পদ তো কমেইনি বরং তা বেড়েছে। তাহলে বাজার ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ছোটো হতে থাকলেও সম্পদ এবং আয় কিছু মানুষের হাতে কুক্ষিগত হওয়ার প্রক্রিয়া কোনওভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। আগামী দিনে মন্দা এলেও শীর্ষ সম্পদের অধিকারীদের কোনও ক্ষতি হবার আশঙ্কা থাকবে না। তাই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মন্দা দূর করার কথা ব্যবস্থার পরিচালকরা আর হয়তো ভাববেনই না। 

কোথায় যাচ্ছে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ? সম্পদের রক্ষণ এবং সম্পদ সৃষ্টি যে ব্যবস্থার লক্ষ্য তা কি পারবে সাধারণভাবে মানুষের জীবন জীবিকার সুরক্ষা দিতে? সময় হয়তো একদিন তার জবাব দেবে। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে যেতে পারে অনেক।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান