পি সাইনাথ (ভাষান্তর : দেবু দত্তগুপ্ত)
মালকানগিরি (ওড়িশা) : এইমাত্র সর্বশক্তিমান এবং আমলাতন্ত্রের আধিভৌতিক এক সত্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হল মাঝি ধুরুয়া। হ্যাঁ, ক্ষুদে অফিসার প্রয়োজনীয় গাম্ভীর্যের সঙ্গে তাকালেন–সরকারি নথিতে দেখা যাচ্ছে, যে, তুমি একজন আদিবাসী কিন্তু তোমার ভাই নয়। মালকানগিরির ধুরুয়া উপজাতির মাঝি ধুরুয়ার কাছে এই দুর্বোধ্য ধাঁধার উত্তর খুঁজে বার করা সত্যিই কঠিন ব্যাপার। তবুও নাছোড়বান্দার মতো সোজা কথাটা বোঝাতে চাইল সে — যদি আমি উপজাতি হই, তাহলে আমার নিজের ভাইও তো উপজাতি হবে।
এইসব ছেঁদো যুক্তিতে বিরক্ত হয়ে সেই অফিসার জানাল, কী করে যে সেসব বোঝাই তোমাকে? লিখতে পড়তে তো কিছুই জানো না তুমি!
সরকারি নথিতে তাদের নামের বানানে একটা ছোট্ট ভুল আছে বলে, এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায় এই ‘ধুরুয়া’রা সিডিউলড্ ট্রাইব হিসাবে তাদের প্রাপ্য কোনও সুযোগ-সুবিধাই পাচ্ছে না! এই উপজাতিদের নামের বানানটা সঠিকভাবে কী হবে — এই ভয়ংকর সমস্যার সমাধান না হওয়ার কারণে এই অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। যখন মাঝি ধুরুয়া প্রথম আমাকে এটা বলল তখন সম্পূর্ণ অবাস্তব মনে হয়েছিল। কিন্তু যথার্থ বাস্তবই ছিল এই সমস্যাটা।
আমরা দুটো সরকারি নথি দেখালাম। প্রথমটা দিল্লি থেকে প্রকাশিত সিডিউলড্ ট্রাইবদের সরকারি তালিকা। দ্বিতীয়টা, ভুবনেশ্বর থেকে প্রকাশিত ওড়িষ্যার সিডিউলড্ কাস্ট, আর ট্রাইবদের সম্পর্কিত নানা তথ্য-পরিসংখ্যান সংক্রান্ত পুস্তিকা। দুটি দলিলেই এই নির্দিষ্ট আদিবাসী গোষ্ঠীর নাম লেখা হয়েছিল ‘ধারুয়া’ (Dharua)। যদিও সংশ্লিষ্ট উপজাতিরা নিজেদের ‘ধুরুয়া’ই বলত (আঞ্চলিক দলিলেও তাদের ‘ধুরুয়া’ বলেই উল্লেখ আছে)।
আমলাতান্ত্রিক এই ছোট্ট একটা ভুল, ‘ইউ’-এর পরিবর্তে ‘এ’, এই অক্ষরটাই এই উপজাতি গোষ্ঠীর প্রাপ্য সমস্ত সরকারি সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে।
— আমরা তোমার ভাইকে আদিবাসী বলে মেনে নিতে পারছি না। সেই আমলা মাঝিকে বলল — তোমার ভাইয়ের কাগজপত্র বলছে সে একজন ‘ধুরুয়া’। অথচ আমাদের রেকর্ডে এই নামে কোনও উপজাতি নেই। আমাদের নথিতে আছে শুধু ‘ধারুয়া’।
মাঝি তখন মরিয়া হয়ে জানাল যে– তার নিজের সার্টিফিকেট লেখা আছে ‘ধুরুয়া’। কিন্তু তাকে তো আদিবাসী বলে স্বীকার করা হয়েছে, তাহলে তার ছোটো ভাইকে কেন করা হবে না?
সেই অনড় চেয়ারটা জানাল–আমি সেসবের কিছু জানি না। এখন আইন পালটে গেছে।
|| দুই ||
ওড়িশার উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাকুল্যে ন-হাজারের কম ‘ধুরুয়া’ আছে। তার মধ্যে বেশির ভাগই মালকানগিরি আর কোরাপুট জেলায় বাস করে। লোক গণনার সময়েও এই উপজাতিদের নামের বানানে ‘ধারুয়া’ লেখা হয়। সর্বোচ্চ আর সর্বনিম্ন স্তরের সরকারি রেকর্ডে এদের নামের দু-ধরনের বানানই নথিভুক্ত করা আছে। এতদ্সত্ত্বেও বহু বছর ধরে এ নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি। একই সঙ্গে দুটো বানান-ই পাশাপাশি চলেছে। এভাবেই চলে আসছিল, অথচ মাত্র বছরখানেক আগে কিছু ক্ষুদে আমলা এই প্রশ্নগুলি তুলতে শুরু করে।
সিডিউলড্ কাস্ট আর ট্রাইব গোষ্ঠীগুলির কাছে কাস্ট সার্টিফিকেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। চাকরি কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভর্তির ব্যাপারে সংরক্ষণের সুযোগ নেওয়ার জন্য এগুলিই অত্যন্ত জরুরি ব্যাপার।
এই সুবিধাগুলি চাইতে গিয়ে ধুরুয়ারা হঠাৎ করেই জানতে পারল, তারা আর সিডিউলড্ ট্রাইব হিসাবে তালিকাভুক্ত নয়। বয়স্ক ধুরুয়াদের অনেকেরই যেমন মাঝি; তাদের প্রায় সকলেরই কাস্ট সার্টিফিকেট আছে। কিন্তু এই নতুন বানান-বিভ্রাট উদ্ভট পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। — সরকারিভাবে আমার বাবা আর আমি ট্রাইবাল কিন্তু আমার ছোটো ভাই তা নয়। এটা কী করে হয়? এ বিস্ময় কাটে না, তাই আমাকে প্রশ্ন করে মাঝি ধুরুয়া। মাঝি আমাদের তার সার্টিফিকেটের কপি দেখায়। তাতে ‘অরিজিনাল’ আর ‘জেনুইন’ বলে সরকারি শংসাপত্রের সিলমোহর লাগানো।
|| তিন ||
মালকানগিরির বড়ো শহরে মাঝি আর তার ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়। মাথালি ব্লকের ধুরুয়া উপজাতি গোষ্ঠীর কিছু তরুণ যুবক তারা যে সত্যিই উপজাতি, এই বিষয়ে মরিয়া হয়ে তাদের সম্ভাব্য নিয়োগকর্তাদের বিশ্বাস করানোর চেষ্টাও চালিয়েছে। কিন্তু এই যে ‘এ’ আর ‘ইউ’-এর সামান্য তফাত, সেটাই অলঙ্ঘনীয় প্রতিবন্ধক হয়ে রইল তাদের উপজাতি হওয়ার পথে।
আমি নিজের সরকারি সার্টিফিকেটটাও দেখালাম প্রমাণ হিসাবে — বীতশ্রদ্ধ মাঝি বলল। তবুও প্রমাণ হিসাবে সেটা গ্রাহ্য হল না।
সত্যি সত্যি যে আমরা ট্রাইবাল; সেটা প্রমাণ করার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্রটা এবার দেখলাম। ‘রেকর্ড অফ রাইটস্ ফর মালকানগিরি ট্রাইব’। যেখানে একের পর এক ট্রাইব হিসাবে নথিভুক্ত আছে ‘ধুরুয়া’ উপজাতিদের নাম। শুধু তাই নয়, তহশিলদারের দপ্তরে কাস্ট-সার্টিফিকেটের জন্য ‘ধারুয়া’ বলে উপজাতিদের কোনও আবেদনপত্র জমাও পড়েনি।
আর এটা এমন কিছু অবাক হওয়ার বিষয়ও নয়, এক সরকারি কর্মচারী বললেন, — কেন না ‘ধারুয়া’ বলে কোনও ট্রাইব সত্যিই তো আর এখানে নেই। সরকারি আমলারাই এই নতুন ট্রাইবটা তৈরি করেছে! পরিহাসচ্ছলেই এ কথাটা বললেন সংশ্লিষ্ট এলাকার একজন। কী অবিশ্বাস্য ক্ষতি হতে পারে একটা সামান্য বানান ভুলের জন্য!
এবারে সমস্যাটা আরও তীব্র হল। জেলা দপ্তরে কিছু করণিকের শূন্য পদে নিয়োগের নোটিশ জারি হল। এমনিতেই ওড়িশার বেকার সমস্যা তীব্র। তার মধ্যে তীব্রতম সমস্যায় পীড়িত মালকানগিরি। উড়িষ্যার জনসংখ্যা ৩ কোটি ২০ লক্ষ। কর্মহীনের সংখ্যা ১৫ লক্ষ।
ধুরুয়াদের মধ্যে সামান্য কয়েকজন ম্যাট্রিকুলেট। তারা সকলেই ভাগ্যান্বেষণে মরিয়া। সকলেই চাকরির সন্ধানে আছে; মাঝি জানাল আমাদের। অথচ ছোটো-বড়ো কোনও চাকরি কিছুই পাচ্ছে না। ফলে চন্দা, মঙ্গলা, গোপাল ধুরুয়া আরও অনেকেই চূড়ান্ত হতাশা নিয়ে ফিরে আসছে।
শূন্যপদগুলির জন্য প্রার্থী হিসাবে পর্যন্ত আমাদের নাম বিবেচনা করা হল না! তীব্র খেদের সঙ্গে গোপাল তাদের দুঃখের কথা জানাল, ধুরুয়া উপজাতিদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭ শতাংশেরও কম। এরমধ্যে হাতেগোনা এই সামান্য শিক্ষিতরাও যদি চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় তবে উপজাতি উন্নয়নের কথা বলে কি লাভ? অথচ এই অকিঞ্চিৎকর সমস্যাগুলির সমাধান করা যায়। অন্তত একবার তারা সেই সৌভাগ্যের মুখ দেখল।
মালকানগিরির নতুন তহশিলদার হয়ে এলেন আর কে পাত্র। বিচক্ষণ এবং সহানুভূতিশীল একজন, সরকারি কর্মচারী হিসেবে দুর্লভ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। মাত্র কয়েক মাস তিনি এই অঞ্চলে এসেছেন, নজরে আসামাত্র খুব দ্রুত উদ্যোগী হলেন। সরকারি দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটেঘুঁটে নিশ্চিত হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি লিখলেন — মালকানগিরিতে ‘ধারুয়া’ বলে কোনও ট্রাইব নেই। যারা আছে তাদের বলা হয় ‘ধুরুয়া’।
|| চার ||
ভুবনেশ্বরের এক সরকারি কর্তাব্যক্তি আমাকে পরে বলেছিলেন যে — এটা সম্পূর্ণ অবাস্তব হলেও ঘটনা যে, এদের অতি তুচ্ছ সমস্যা সমাধানেও বাইরের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়। আমরা এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করেছি যেখানে নিজস্ব উদ্যোগে আদিবাসীরা নিজেদের কোনও কিছুই সুরহা করতে পারে না। আইনি পথেও এটা সম্ভব হয় না। যখন এই ধরনের সমস্যা আসে, তারা অসহায়, নিরুপায় হয়ে পড়ে। আমলাতন্ত্রের কাছে পৌঁছানোর কোনও রাস্তাও জানা নেই তাদের। নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা অক্ষম, ফলে শিক্ষিত তরুণ এবং উদ্যোগী হওয়া সত্ত্বেও মাঝির ভাই আর বন্ধুদের চাকরি হল না। আর এই বঞ্চনা এমন একটা জেলায় চলছে যেখানে সাধারণভাবে সাক্ষরতার হার ১৬ শতাংশের কাছাকাছি আর উপজাতিদের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ।
মালকানগিরিকে ছোটখাটো উপজাতি-ভারত বলা যায়। ওড়িশার ৬২ টা উপজাতি গোষ্ঠীর প্রায় সকলেরই প্রতিনিধিত্ব আছে এখানে। অন্ধ্র আর মধ্যপ্রদেশ থেকেও চলে আসে অনেক গোষ্ঠী। প্রতিটি উপজাতি গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা আছে।
এই প্রসঙ্গে সরকারি এক প্রতিনিধি বললেন — প্রধান সরকারি ভাষায় উপজাতিগোষ্ঠীগুলির অদ্ভুত সব উচ্চারণভঙ্গি অনুসারে নামধাম, বক্তব্য রেকর্ড করার ক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা দেয়।
এইসব উপজাতি গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষার অদ্ভুত সব উচ্চারণভঙ্গির সঠিক অনুলেখনে প্রধান সরকারি ভাষার নানান ঘাটতি আছে। ‘ধুরুয়া’-কে ‘ধারুয়া’ লেখার মধ্যে দিয়ে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তেমন সব গুরুতর সমস্যা দেখা দেয় এই বহুবিচিত্র বাচনভঙ্গির কারণে। আবার অদ্ভুতভাবে উপজাতি নয় এমন বেশ কিছু যুবক নিজেদের সিডিউলড্ ট্রাইব বলে পরিচয় দিয়ে সার্টিফিকেট জোগাড় করেছে। আর এই সার্টিফিকেট পেতে যে খুব কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে, এমনও নয়।
|| পাঁচ ||
এই ঘটনাগুলি পূর্বতন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বাঙালি হিন্দুদের ক্ষেত্রে বেশি। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধের পর মালকানগিরিতে এদের অনেকের পুনর্বাসন হয়। মালিকানার দলিল সমেত সরকার থেকে জমি পায় এরা। জমি পাওয়ার উপায়টা হচ্ছে; এখানে জমি পেয়েছে; তার পাট্টা দেখালে দলিল সহজেই পাওয়া যায়। বাঙালি হিন্দু কিংবা এইরকম জমির মালিকদের জমি রেজিস্ট্রি করতে কোনও অসুবিধা হয় না। আর কাস্ট সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য লাগে উদ্বাস্তু হিসেবে পুনর্বাসনের কাগজপত্র।
এরা দলিল লেখকদের শুধু বলে যে, তারা কোনও একটা নির্দিষ্ট সিডিউলড্ কাস্ট বা ট্রাইবের অন্তর্ভুক্ত। ডিড রাইটারের কাজ হচ্ছে জমির মালিকানার কাগজপত্র পরীক্ষা করা। আর এই ক্ষেত্রে কাগজপত্রগুলো ঠিকই থাকে। আবেদনকারীর জাত যাচাই করাটা এদের দায়িত্বে পড়ে না। তারা দলিল ইস্যু করে তাতে জাতপাতের ভুয়া ঘোষণা দেওয়া থাকে। আবার এই দলিলের ভিত্তিতে আবেদনকারী সহজেই পুনর্বাসন আর কাস্ট সার্টিফিকেট পায়।
বিপরীত দিকে অধিকাংশ উপজাতিই হয় ভূমিহীন, নয়তো পাট্টা না পাওয়া জমির অধিকারী। ফলে তাদের পক্ষে এই সব কাগজপত্র পাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। আবার তথাকথিত উঁচু জাতের মানুষরা এই সব কাগজপত্র সহজেই জোগাড় করতে পারেন। ফলে নানা ধরনের সুবিধা তারাই ভোগ করে। প্রকৃত ট্রাইবালদের চাইতে তাদের বেশি শিক্ষাদিক্ষা এই সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার পথকে সুগম করে।
আলোচ্য ঘটনায়, মাঝি ধুরুয়া আর তার ভাইয়ের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। বিশেষত ধন্যবাদার্হ মালকানগিরির সেই সরকারি অফিসারটি। কিন্তু ভুবনেশ্বরের সরকারি কর্তাটি নিজেই বললেন যে, সংবাদপত্রে প্রকাশ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলি খুব দ্রুত তৎপর হয়ে ওঠে। নিশ্চিত ভাবেই এই তৎপরতা বছরখানেক আগে শুরু হতে পারত যখন উপজাতিরা নিজেরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে সরব হয়েছিল। কিন্তু আমাদের ব্যবস্থাটা দরিদ্রদের কোনও প্রশ্নেই সাড়া দেওয়ার মতো নয়। বিশেষ করে আদিবাসী আর হরিজনদের ক্ষেত্রে সরকারি এই বধিরতা আরো তীব্র আর নিশ্ছিদ্র।
(কৃতজ্ঞতা : কবিতাদত্তগুপ্ত, ক্যাম্প)