ব্রহ্মচারী শুভব্রত মহারাজ
মানুষের যথার্থ স্বরূপ বা পরিচিতি সম্পর্কে অনুসন্ধান সেই সৃষ্টি থেকেই হয়ে আসছে। এটি একটি জীবনব্যাপী সাধনা। একটু একটু করে মুনিঋষিদের মহাপুরুষদের তপস্যা বা সাধনলব্ধ জ্ঞানের দ্বারা পরিপুষ্ট হয়ে আমরা সেই পরম লক্ষ্যকে জানতে পেরেছি। কিন্ত শুধু কিছু তথ্য জেনেই সেটিকে বোঝা যাবে না। তার জন্য চাই মনন ও সাধন। তখন আসবে অনুভূতি ও উপলব্ধি। বাক্য-মনের অতীত অবস্থা যা অনুভূতিলব্ধ একটি বিজ্ঞান — যাকে আমরা আধ্যাত্মিকতা বলে অভিহিত করে থাকি। জীবনতাৎপর্য অন্বেষণে উদ্ভূত প্রশ্ন ও বোধের সঞ্চারে মূল আলোচনায় প্রবেশ করব। এ যেন সাগরকে একটি পাত্রে ধরে রাখার চেষ্টা :
কে আমি? কি জন্য জন্মেছি? কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাবো? কেউ জানি কেউ বা জানিনা কেউ জেনেও বুঝতে চাই না কেউ বা সময় থাকতে ভাবিনা কেউ বা ভাবতেই চাইনা ভয়ে কেউ বা জাগতিক আকর্ষণে আসল আনন্দের সন্ধান পাই না
যুগে যুগে আসে মহামানব জানিয়ে দিতে মোদের প্রকৃত পরিচয় সৌভাগ্যবান যারা বুঝতে পারে বাকিরা স্রোতে ভেসে থাকে।
জীবন রহস্যের উত্তর কি সহজে মেলে? শুধু পিপাসুরাই তেষ্টা মেটানোর আনন্দ পায়।
মানুষের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ একটি গল্প বলতেন। সেই ভেড়া আর সিংহ শাবকের গল্প। একটি সিংহ শাবক মাতৃহারা হয়ে ভেড়াদের মধ্যে বড়ো হচ্ছিল। তাই তার আচরণ ভেড়াদের মতোই হয়ে যাচ্ছিল। এমত অবস্থায় আর একটি সিংহ সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। সে ওই সিংহটিকে ভেড়াদের সাথে ঘাস খেতে দেখে ও তাদের মতো আচরণ করতে দেখে অবাক হল। পরে তাকে পাশে নিয়ে গিয়ে একটি নদীর জলে তার চিত্র দেখাল। দেখা মাত্র সেই সিংহটি তার নিজের আসল পরিচয় বুঝতে পারল।
আমরাও মায়ার জগতে সিংহস্বরূপ হয়েও অজ্ঞানতাবশত নিজেদের ভেড়া মনে করছি। তাই যুগে যুগে ভগবান অবতার বা মহাপুরুষেরা পৃথিবীতে আসেন আমাদের প্রকৃত স্বরূপকে চিনিয়ে দিতে।
প্রাচীন যুগের ঋষি থেকে শুরু করে রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, জিশু, মহাপ্রভু হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ মা সারদা ও স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ মহাপুরুষেরা সময়ে সময়ে ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছেন ও আমাদের সামনে মনুষ্য জীবনের আদর্শ তুলে ধরেছেন।
বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, গীতা, কোরান, বাইবেল, কথামৃত ইত্যাদি প্রায় সব শাস্ত্রই মানুষের প্রকৃত স্বরূপ বা পরিচিতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “মনুষ্য জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল ভগবানলাভ।” ভগবানলাভ বা ঈশ্বরলাভ বা আত্মানুভূতি বা আত্মদর্শন বা মোক্ষলাভ বা মুক্তি ….. যে নামেই আমরা অভিহিত করিনা কেন মূল ব্যাপারটি কিন্ত একই, অর্থাৎ সোজা ভাবে বললে যা দাঁড়ায় সেটি হল আমাদের প্রকৃত সত্তাকে জানা। জ্ঞানের দ্বারাই হোক বা ভক্তির দ্বারাই হোক বা যোগের দ্বারাই হোক বা নিষ্কাম কর্মের দ্বারাই হোক আমাদের সেই প্রকৃত স্বরূপকে জানতে হবে। ঠাকুর বলতেন যে, যো সো করে ভগবানকে জানতে হবে। ভগবানকে জানা অর্থে নিজেকে আবিষ্কার করা বা জানা। সেই জানার জন্যই যত রকমের সাধনা সেবা জপ ধ্যান প্রার্থনা ইত্যাদি। স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, “জীবাত্মাতেই অনন্ত শক্তি নিহিত আছে: পিপীলিকা থেকে উচ্চতম সিদ্ধপুরুষ পর্যন্ত সকলের মধ্যে সেই আত্মা — তফাত কেবল প্ৰকাশের তারতম্যে।” তিনি আরো বলেছেন, “Each soul is potentially divine.” শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত: আমরা নিত্য শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত আত্মা। সাধুতা পবিত্রতা আমাদের স্বভাব। এগুলি সুপ্ত হয়ে আছে। এগুলিকে জাগাতে হবে তাহলেই আমরা আমাদের প্রকৃত সত্তাটিকে উপলব্ধি করতে পারব।
মানুষের মনের ভিতরে দুটো দিক আছে। একটা দিকে জমে রয়েছে পবিত্রতা, শ্রদ্ধা, অহিংসা, প্রেম, সহানুভূতি, সত্য, ভালোবাসা, দয়া, ক্ষমা, নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি মহৎ গুণগুলি।
কিন্ত মনের ভিতরে আর একটি দিকে জমে রয়েছে অহংকার, ঘৃণা, হিংসা, ক্ষোভ, কপটতা, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ঈর্ষা, লালসা ইত্যাদি নিন্দনীয় দোষগুলি।
মনের ভিতরে এই গুণগুলি ও দোষগুলি ঘুমন্ত বা সুপ্ত আছে। আমরা মনের যে দিকটিকে বেশি প্রকাশ করব সেই অনুযায়ী আমাদের চরিত্র গঠন হবে। এবং তার প্রভাব পড়বে সমগ্র সমাজের ওপর। একজন মানুষের তিনটি অবস্থা আছে। পশুত্ব, মনুষ্যত্ব ও দেবত্ব। পাশবিক প্রকৃতি, মানবিক প্রকৃতি ও দৈবপ্রকৃতি।
মনের ওই ঘুমন্ত দোষগুলিকে আমরা যদি জাগিয়ে দিই বা জীবনে প্রকাশ করি তাহলে আমরা পাশবিক স্তরে থাকব। পশুত্ব আমাদের মধ্যে বিরাজ করবে। তার ফল কতটা ভয়ানক সেটা সমাজের এই মুহূর্তের চেহারাটা দেখলেই বোঝা যাবে।
কিন্ত মনের মহৎ গুণগুলি-কে যদি আমরা জীবনে অনুশীলন করে ফুটিয়ে তুলি তাহলে আমরা মানবিক স্তরে বিরাজ করব। তখনই আমরা প্রকৃত মানুষ হব। তখন আমরা মনুষ্যত্ব লাভ করব। নীতিবান, চরিত্রবান মানুষে পরিণত হব। তার প্রভাব পড়বে সমগ্র মনুষ্য সমাজের ওপর। সুন্দর এক মানব পরিবার তখন থাকবে। এইরকম সদ্গুণগুলির বিকাশ করাই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য। এই গুণগুলি যখন আমরা সত্য সত্যই জীবনে ফুটিয়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হব একমাত্র তখনই আমরা আধ্যাত্মিকতা অভ্যাসের যোগ্যতা অর্জন করতে পারব। এখন সেটাই আমাদের একমাত্র সাধনা হোক। এই আধ্যাত্মিকতার সাধনাই আমাদের সেই প্রকৃত পরিচিতির উন্মেষ ঘটাবে। আমরা সেই নিত্য শুদ্ধ মুক্ত অবস্থা লাভ করব। এই অবস্থা লাভ করতে হলে মনুষ্য মনের কতটা উচ্চ-অবস্থা তৈরি হয় তা স্পষ্ট করে আমরা ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’-র একটি অংশের ভাবার্থর দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝতে পারব :
“যিনি কাহাকেও ঘৃণা করেন না, যিনি সকলের মিত্র, যিনি সকলের প্রতি করুণাসম্পন্ন, যাঁহার নিজস্ব বলিতে কিছু নাই, যিনি সুখে দুঃখে সমভাবাপন্ন, ধৈর্যশীল, যিনি অহংকারমুক্ত হইয়াছেন, যিনি সদাই সন্তুষ্ট, যিনি সর্বদাই যােগযুক্ত হইয়া কর্ম করেন, যতাত্মা ও দৃঢ়-নিশ্চয়, যাহাঁর মন ও বুদ্ধি আমার প্রতি অর্পিত হইয়াছে, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত।”
স্বামী বিবেকানন্দ কী সুন্দরভাবে আমাদের শাশ্বত পরিচিতি স্মরণ করে দিয়ে বলছেন,
“ ‘অমৃতের পুত্র’ — কী মধুর ও আশার নাম! হে ভ্রাতৃগণ, এই মধুর নামে আমি তোমাদের সম্বোধন করিতে চাই।
তোমরা অমৃতের অধিকারী। ……. তোমরা ঈশ্বরের সন্তান, অমৃতের অধিকারী — পবিত্র ও পূর্ণ। মর্ত্যভূমির দেবতা তোমরা ! ……..
ওঠো, এসো, সিংহস্বরূপ হইয়া তোমরা নিজেদের মেষতুল্য মনে করিতেছ, ভ্রমজ্ঞান দূর করিয়া দাও।
তোমরা অমর আত্মা, মুক্ত আত্মা — চির-আনন্দময়। তোমরা জড় নও, তোমরা দেহ নও, জড় তোমাদের দাস, তোমরা জড়ের দাস নও।”