পরিচিতির সাত সতেরো 

পার্থ সারথি বণিক

রিয়াকে যেমন দেখেছি  

ট্রেনের কামরায় ভিড়ের চোখে রিয়া এক উনিশ কুড়ি ছোঁয়া ছিপছিপে তরুণী। কলেজ ছাত্রী হবেও বা! হবে কি? নাকি সাতাশ আঠাশ! নারী শরীরে বয়স লুকোচুরি খেলে; উৎসুক সহযাত্রীর চোখে রিয়ার সম্ভাব্য পরিচয় অনেক অনুমানের জন্ম দেয়।   

কাজের জগৎ-এ রিয়ার একটা আপাত-স্থির পরিচয় আছে বটে! সেখানে সে কোমরে ওড়না বাঁধা এক রং মিস্ত্রির ‘জোগাড়ে’ । বড়ো মিস্ত্রির ফরমায়েশে দেয়ালে রোলার চালায়, দরজার ফ্রেম মোছে, দিনের শেষে মেঝেতে ছিটকে পড়া রং সাফ করে, হাত পেতে রোজের টাকা নেয়। তারপরে ঘরে ফেরার ট্রেন ধরতে দৌড়োয়।

রং-চং এর সাত সতেরো রিয়া বোঝে না, তবু রামধনুর মতো সাত রঙা অস্তিত্ব তার। লোকাল ট্রেনে গুরাপে ফিরতে ফিরতে রিয়া ধীরে ধীরে মা হয়ে ওঠে। একটার পর একটা স্টেশন পেরোয়, আর কাজের জগৎ-এর খোলস খুলতে থাকে। বুকের দুধে ব্লাউজ ভিজে যায়। বাড়িতে বাচ্চা দুটো অপেক্ষা করছে। 

পরিচিতির লঘু-গুরু 

সেদিন সকালে ট্রেন লেট ছিল। কাজের বাড়িতে ঢুকতে বড্ড দেরি হয়ে যাবে, রোজের টাকা কাটা যাবে, তাই ট্রেন থেকে নেমে রিয়া দৌড় দেয়। তাড়াহুড়োয়, স্টেশনের টয়লেটে যেতে সে ভুলে যায়। সে ভুলে যায় কাজের বাড়ির মালকিন তাকে বাড়ির টয়লেট ব্যবহার করতে দেবেন না। কারণ, শরীরে সে মেয়ে। তার ‘পিরিয়ড’ হয়।  

এমন ভুল সে আরও একদিন করেছিল। কাজ করতে করতে জল তেষ্টা পেয়েছিল, তাই, সে পানি চেয়েছিল। গৃহকর্তার চোখ কয়েক মুহুর্তের জন্য ওর মুখে থমকে যায়! রিয়া বুঝতে পারে ‘পানি’ ওর পরিচয়কে মুহুর্তে ‘লঘু’ করে দিয়েছে। রিয়া সংখ্যালঘু।  

এ পোড়া দেশে জল আর পানি কিছুতেই যে মিলতে নেই!   

পরিচয়ের স্থিতি ও গতি 

রিয়া নামের আড়ালে তবে ক-টা রিয়ার অস্তিত্ব আছে? তাদের তৈরি করল কে? একদিকে তার জন্ম পরিচয়, আর অন্য দিকে আমাদের চোখ, আমাদের মনের অন্তর্লীন সংস্কার। এই সব কিছুই রিয়াকে সৃজন করছে। মায়ের কোলে জন্মের পর রিয়াকে আমরা প্রতিদিন গড়ছি, প্রতিদিন ভাঙছি, আবার গড়ছি। ট্রেনে, বাসে, সমাজে, ফ্যান্টাসিতে। জন্মের স্থাণুবিন্দু থেকে রিয়ার পরিচয় সেই যে গতিশীল হয়েছে, এখনও নতুন নতুন মাইলফলক ছুঁয়ে চলেছে। 

ছিন্নভিন্ন যে পরিচয় 

রিয়ার এখনকার প্রতিবেশী কাকার ঠাকুরদাদা পূর্ব বাংলার জলে হাওয়ায় মহিরুহ সদৃশ ছিলেন। ‘৪৬-’৪৭ এ দাঙ্গা-দেশভাগ তাঁকে ছিন্নমূল করল। কাঁটাতারে নিজের দেশ হয়ে গেল বিদেশ।  কপর্দকহীন উদ্বাস্তু পরিচয়ের দ্বিধা, অপমান হল তার নতুন পোশাক। ভবিষ্যৎ-হীন এক শূন্য অস্তিত্ব নিয়ে তিনি বাকি জীবনটা বেঁচে ছিলেন।[১]  

তাঁর সন্ততিকুল কলেরা মড়ক অপুষ্টি যৌন-পীড়ন পেরিয়ে কেউ কেউ সমাজবিরোধীর পরিচিতি পেয়েছে, কেউ পেয়েছে বেশ্যার তকমা, কেউ বা কলকারখানার শ্রমিক; আর কেউ স্রেফ ঘোড়ার ঘাস কেটেছে। এর মধ্যেই কেউ বা কঠিন অধ্যবসায়ে নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে খুঁজে পেয়েছে, সমাজে সম্মানিত হয়েছে;  আর কোনও কোনও তারা নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে মেঘের আড়ালে ঘুমোতে গেছে।   

সাম্রাজ্যবাদ, ক্ষমতার রাজনীতি, ধর্মের জেহাদ, সন্ত্রাসবাদ, জাতিগত (ethnic) হিংসা এভাবে দেশে দেশে মানুষকে বারবার ইতর করেছে, হাড়িকাঠে বলির পাঠা করেছে। মানুষের পরিচিতির এইসব পরিবর্তনের দায় কার, তা নিয়ে সমাজ শৌখিন বিতর্ক করে, পরীক্ষার খাতায় আর চায়ের টেবিলে চর্চা চলে। ‘মানুষ’ পরিচয়ের অবনমন কিন্তু হতেই থাকে। দেশে দেশে। তার যেন কোনও শেষ থাকতে নেই। 

আসল পরিচয় 

কীভাবে আমি সমাজে পরিচিত? সমাজ যে দৃষ্টিকোণ থেকে আমাকে দেখে, আমাকে মূল্যায়ন করে, সেভাবেই! আপনাদের দেখার ভঙ্গিই হল আমাদের পরিচয়। জন্ম-পরিচয় অথবা পেশা-পরিচয় ঘোষণা করা নামটা তো খোলস মাত্র!  

একটা বিশেষ সময়ের সমাজ-মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ব্যক্তি আর শ্রেণি হিসেবে আমাদের আপেক্ষিক গুরুত্ব। আর ওই গুরুত্বটাই আমাদের আসল পরিচয়ের শংসাপত্র। আপেক্ষিক বলছি, কারণ, সমাজের চোখকে তো প্রভাবিত করে সমসাময়িক যুগের সংস্কার, বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি-অর্থনীতি-ন্যায়নীতি! তাই, পরিচিতির গুরুত্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। পরিচিতি এক গতিশীল মানসিক ক্রিয়া, সমাজ মনের মধ্যে তার সংকোচন প্রসারণ চলতেই থাকে। তাকে দিশা দেয় যুগের সংস্কৃতি। একটা মানুষের পরিচয়ের প্রথম বীজটি যদি থাকে তার জিনে, তবে, তার ব্যক্তি ও শ্রেণি পরিচিতিটুকু চেহারা পেতে থাকে যুগের সাংস্কৃতিক জলবায়ুতে। 

সংকট 

চণ্ডীর বাবার ছিল কাঁচা ভাগাড়ের কাজ। গর্ত খুঁড়ে মৃত শিশুকে কবর দেওয়া, কাঁটা গাছ দিয়ে সেই গর্ত ঢেকে রাখা, সেখান থেকে শেয়াল তাড়ানো ছিল তার বংশগত পেশা। বাবার মৃত্যুর পর মেয়ে চণ্ডী নিজের কাঁধে তুলে নেয় সে দায়িত্ব, আর একদিন তারই জ্ঞাতি গুষ্টি গাঁয়ের লোক ‘বাঁয়েন’ বলে দেগে দিয়ে তাকে গাঁ ছাড়া করে দেয়।  ডাইনি হয়ে গেলে তাকে পুড়ে মরতে হত; কিন্তু যে মেয়ে বাঁয়েন হয়ে যায় তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, নইলে শিশুদের অমঙ্গল হয়। তাই চণ্ডী বাঁয়েনকে, ভগীরথের মা-কে, তার সমাজ বাঁচিয়ে রাখল। শুধু বদলে দিল তার পরিচয়, তার সামাজিক গুরুত্ব।[২] 

পরিচিতির পরিবর্তনের সঙ্গে এল চণ্ডীর জীবনে তীব্র সংকট — স্বামী সন্তান হারানোর যন্ত্রণা, খিদে আর ভয়ঙ্কর একাকিত্ব। আমাদের আজন্ম লালিত সংস্কার জীবনের মূল স্রোত থেকে আমাদেরই আশেপাশের কত মানুষকে এ ভাবে প্রতিদিন প্রান্তিক করে তুলছে! বদলে যাচ্ছে  পরিচয়। 

ভাষা যখন পরিচয় 

বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত বিধবা, বাঁজা, লঙরখানা, কালো, ল্যাংড়া, নাটা, কানা, মেয়েলি, স্ত্রীবুদ্ধি, হিজড়ে, সমকামী ইত্যাদি শব্দগুলো যে পরিচিতি বহন করে তা তথাকথিত সুশীল সমাজে আজও ধরে রেখেছে বহু মানুষের অপমান আর মানসিক বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণাকে।   

আপনার উচ্চারণে কি আঞ্চলিকতার প্রকাশ আছে? আপনি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছেন মানে, আমাদের চোখে আপনি শহর-সংস্কৃতির কেন্দ্র থেকে দূরে এক প্রান্তবাসী, অসংস্কৃত, অমার্জিত অস্তিত্ব। পরিচয়ে আপনি খাটো। আমাদের সমাজ-মন এভাবেই ভাবে। আপনার সেই প্রান্ত-ভাষায় আমি পদ্য করতে পারি, ফেসবুকে তার আবৃত্তি পোস্ট করে সংস্কৃতির ঢাক বাজাতে পারি। খাটোকে বুকে টেনে নেওয়ার মহত্ত্বে আমি শহরের নিশ্চয়তায় বসে মহীয়ান হব! আমার ব্যক্তি পরিচয়ে নতুন পালক গাঁথা হবে। আপনি থাকবেন অসংস্কৃত আবছায়ায়, খর্বকায় পরিচিতিতে। 

লিঙ্গ পরিচয় 

লিঙ্গ চিহ্ন মানুষের একটা পরিচয় বটে!  সময় পালটায়, রাষ্ট্র-ব্যবস্থা অর্থ-ব্যবস্থা পালটায়, লিঙ্গ-গুরুত্বও পালটায়। পতি পরম গুরু থাকেন না, রমণীও থাকেন না ‘রমণ’-এর লক্ষ্যবস্তু হয়ে।[৩] “তৃতীয় লিঙ্গ” তার অবমাননার ধারাবাহিক ইতিহাস নিয়ে জন সমক্ষে উঠে আসে। পরিচয় পালটাতে থাকে। 

পরিচয় বহুমাত্রিক 

পরিচয় তাই বহুমাত্রিক। লোক কাহিনির নায়ক কৃষ্ণ নগরের রক্ষাকর্তা, তুখোড় প্রেমিক, চতুর রাজনীতিক, বীর যোদ্ধা, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা। নায়কের পরিচিতির এই  বহুমাত্রিকতা  সময়ের  গণ্ডি  পেরিয়ে  ভারতীয়  জনসংস্কৃতিতে আজও বহমান।[৪] 

লোক কাহিনির চরিত্ররা সেই বহুমাত্রিক পরিচয়কে যেমন ধরে রাখে, পরিচয়ের গুরুত্বও কিন্তু তেমনই সময়ের এবং স্থানের সাথে সাথে বদলেও  যায়। কোথাও মহিষাসুর লোক কাহিনিতে থেকে যান অসুরদলনী দেবীর স্বামী হয়ে[৫], আবার কোথাও দুর্যোধন দেবত্বে উঠে আসেন।[৬] আর, আমরা যারা পেশায় অর্থ কৌলীন্যের বিচার করি তাদের বদান্যতায় দেবতা বিশ্বকর্মার কৌলীন্যে অবনমনের দাগ পড়ে।[৭]   

কে তুমি? ডক্টর জিকিল, না, মিস্টার হাইড? [৮] 

কোনটা আসল পরিচয়? ডক্টর জিকিল, না মিস্টার হাইড? নাকি বিপরীতধর্মী দুটোই? এই যে একটা পরিচয়ের মধ্যে একাধিক পরিচয় সহাবস্থান করল, টানাপোড়েন তৈরি করল, একটা মানুষকে অন্য মানুষ করে তুলল, এ কি নিছক কাহিনি? নাকি মানব প্রকৃতি উদ্ঘাটনে ব্রতী বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রচলিত সমাজনীতির সংঘর্ষে ঘনিয়ে উঠল এ কাহিনি?  

মনোবিজ্ঞান যত মানব প্রকৃতির অন্দরে আলো ফেলেছে, মানুষ হিসেবে মানুষও তত স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছতর পরিচিতি পেয়েছে। ফ্রয়েড [৯] ও ফ্রয়েড-পরবর্তী গবেষণা একই অঙ্গে ডক্টর জিকিল আর মিস্টার হাইডের উপস্থিতিকে চিনিয়েছে। কার্য-কারণ সম্পর্কে আস্থা রেখে মানুষ  আত্মনিয়ন্ত্রণকারীর পরিচিতি পেয়েছে।  

এই কার্য-কারণ সম্পর্ক যে যান্ত্রিক নয়, ভীষণ ভাবে মানবিক, সেই বোধ প্রাচীন ভারতের সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের ছিল বলেই তাঁরা মানুষের সত্য পরিচয়ের সন্ধানে জন্ম পরিচয়ের গণ্ডিকে অতিক্রম করেছিলেন।[১০] বৃহতের মধ্যে ব্যক্তিকে বিছিয়ে দিতে বলেছিলেন। মানুষের পরিচয়কে খুঁজতে আমাদের সেই পথেই হাঁটতে হবে।

শেষের দু-একটা কথা এবং সূত্র : 

১। উদ্বাস্তু পরিচয়ের অবমাননা বাংলা চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটকের মতোই ধরে রেখেছেন রাজা মিত্র, তাঁর ‘একটি জীবন’  চলচ্চিত্রে।  

২। ‘বাঁয়েন, মহাশ্বেতা দেবী।   

৩। “অর্জুন:  চিত্রাঙ্গদা রাজকুমারী

                      কেমন না জানি

               আমি তাই ভাবি মনে মনে।

                   শুনি স্নেহে সে নারী,

                   শুনি বীর্যে সে পুরুষ,

          শুনি সিংহাসনা যেন সে সিংহবাহিনী…” ( চিত্রাঙ্গদা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)  

সিংহবাহিনী এবং অর্ধনারীশ্বর-এর ধারণাকে আমরা যে ভুলে থাকতেই ভালোবাসি, তার মধ্যে এক লিঙ্গ রাজনীতি হয়তো কাজ করে।  

৪। নায়কের পরিচয় কৃষ্ণ চরিত্রটিতে যেভাবে পাওয়া যায় সেই ভঙ্গিকে জনপ্রিয় ভারতীয় সিনেমা আজও উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে চলেছে।   

৫। কর্ণাটকের দেবী দয়ামাভা ও দেবী দুর্গামাভার কাহিনি। Census of India,1961, সূত্র : ‘The Earth Mother’, Pupul Jayakar, Penguin। 

৬। পরুভাজি পেরুভিরুথি মালান্ডা মন্দির, কোল্লাম জেলা, কেরালা। এখানে দুর্যোধনের পুজো আজও হয়। সূত্র :  TIMESOFINDIA.COM। 

৭। যে সমাজে দেহের শ্রমকে মর্যাদা দেওয়া হয় না সেখানে বিশ্বকর্মার কৌলীন্যে ঘাটতি দেখা যায় বই-কি!   

৮। ‘The Strange Case of Dr. Jekyll and Mr. Hyde’, (1886), R L Stevenson। 

৯। স্টিভেনসন তাঁর বই প্রকাশ করছেন ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। আর, সিগমুন্ড ফ্রয়েড অবচেতন মনের উপস্থিতির কথা জানাচ্ছেন ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে; Id, Ego, Super-ego — শব্দগুলোকে ব্যবহার করে অবচেতনের আরও  বিশদ ব্যাখ্যা দিচ্ছেন ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে। ফ্রয়েডের আলোয় স্টিভেনসনের সেই কাহিনির বহু আলোচনা হয়েছে। পরবর্তীকালের মনোবিজ্ঞান ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে ‘জন চেতনা’- য় আরো স্বচ্ছ আলো ফেলেছে।   

১০। “অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত।

       তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত।” (‘ব্রাহ্মণ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান