মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
‘মহাভারতের মহারণ্যে’ একদা এক অমোঘ প্রশ্ন জেগে উঠেছিল এক মহাবীরের হৃদয় মথিত করে। কে আমি? সূতপুত্র নাকি কৌন্তেয়? আমি কি প্রথম পার্থ? আমি কি ক্ষত্রিয় না শূদ্র? শত্রু না মিত্র? অজেয় পরাক্রমী রাজা এবং দানবীর বহু বিভূষণে ভূষিত মানুষটিরও অন্তর্নিহিত প্রশ্ন একটিই। সে প্রশ্ন পরিচিতির প্রশ্ন। আজ গোটা দুনিয়া জুড়ে যাবতীয় হিংসার প্রধান কারণ এই পরিচিতির সংকট। সেই পরিচিতি যা নির্ধারিত হয় জন্মমুহূর্তে। আজ এই সময়ে “গরব সে কহো হম হিন্দু হ্যায়” বলে যে ভিড় দেশের সহনাগরিককে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে হত্যায় উদ্যত, অন্য এক পরিসরে সেই ভিড় অপর হিন্দুকে জাতপরিচয়ে একই ভাবে আক্রমণ করে।
পরিচিতি তত্ত্বের অতিসরলীকরণে ধরে নেওয়া হয়েছে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর পশ্চাৎপদতা নির্ভর করে মূলস্রোতের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতায়, তাই জুড়ে দেওয়ার একমাত্র উপায় মূলস্রোতের সামাজিক সাংস্কৃতিক ভাবনাকে তার ওপর ঢেলে দেওয়ায়। হিন্দু নামক যে পরিচিতির জন্ম ভারত ইতিহাসের মাঝপথে সেটিকে উপস্থাপনে বার বার একটি অতি পুরাতন সংস্কৃতিকে টেনে আনা হয় এবং বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সুকৌশলে এ দেশের আদি বাসিন্দাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর গিয়ে তাদের হিন্দু করার চেষ্টা চলে। এই মুহূর্তে এ দেশের প্রধান জনজাতি গোষ্ঠীগুলিকে হয় খ্রিস্টান নয় হিন্দু এই দুই পরিচয়ে বিভক্ত করার প্রবল উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। অমর্ত্য সেন তাঁর পরিচিতি ও হিংসা সংক্রান্ত অনন্য গ্রন্থতে দেখিয়েছেন কীভাবে ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ভাষিক প্রাদেশিক পরিচিতি মানুষে মানুষে ভয়াবহ হিংস্রতা তৈরি করে, আবার যাঁরা এই দ্বন্দ্বকে থামাতে চাইছেন তাঁরাও এই পরিচিতিকেই বজায় রেখে সমন্বয়ের চেষ্টা করেন। ফলে আবারও বিবাদের সম্ভাবনা থেকে যায়।
ভারত এবং আরও কিছু দেশে শিক্ষা ও চাকরির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংরক্ষণের কারণে পরিচিতি রাজনীতি এক বিপুল আকার ধারণ করেছে। সুযোগ না-পাওয়ার দায় রাষ্ট্রের ওপর না-বর্তিয়ে তার জন্য শক্র চিহ্নিত হচ্ছেন সংরক্ষিত জনগোষ্ঠী। সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত বহুকালের সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নটি হারিয়ে যাচ্ছে।
সংরক্ষিত গোষ্ঠীর প্রতি সাধারণের মনোভাব দ্বিবিধ। বহুজনের কাছে সংরক্ষিত গোষ্ঠীর পশ্চাৎপদতার কারণ সে গোষ্ঠী নিজেই, কারণ তারা হয় অতি সরল নয় অতি চালাক, শিক্ষায় অনাগ্রহী, জনজাতি হলে নেশাগ্রস্ত, মুসলমান হলে দেশদ্রোহী, গোঁড়া ইত্যাদি। যাঁরা এভাবে ভাবেন না, তাঁরাও খানিকটা করুণার দৃষ্টিতে দেখেন। বিশেষ করে জনজাতিদের। এদের ছেলেমেয়েরা ভাষা সংস্কৃতি এবং অবজ্ঞার বিপুল পাহাড় পেরিয়ে মূলস্রোতে কোনও রকম সাফল্যের পরিচয় দিলে একধরনের পিঠচাপড়ানি জোটে, কিন্তু দপ্তরে তাদের নিয়ে যে আলোচনা চলে, ‘সোনার টুকরো’ ইত্যাদি, সেখানে আর যাই থাক, প্রীতি নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা আদি বাসিন্দাদের সমাজ ভাবনা ও সংস্কৃতির প্রতি মূলস্রোতের কোনও শ্রদ্ধাবোধ নেই।
সম্প্রতি সাঁওতাল গবেষক সংগঠক বড়ো বাসকি বলছিলেন, সাঁওতাল গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে নেতা উঠে আসার এক প্রধান অন্তরায় এই সমাজের অন্তর্নিহিত সমতা, যেখানে যে-কোনও সিদ্ধান্তে সবাই মিলে উপনীত হতে হয়। নেতাকে অনুসরণ করতে হয় না। সংখ্যগুরু লঘুর ভাবনাও এখানে আসেনা। এই আশ্চর্য সমাজবোধ তাদের, যাদের এখনও সরকারিভাবেও উপজাতি বলা হয়, কীসের উপজাত কেউ জানেন না। এই গোষ্ঠীর ভিতরকার অসামান্য কিছু বৈশিষ্ট্য পরিচিতি রাজনীতিতে অন্যভাবে দেখা হয়। সাঁওতাল পরিচয়ে যে মানুষটি বাঁচেন তাঁকে বিচার করা হয় তার শ্রেণিগত অবস্থান থেকে অর্থাৎ তিনি পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর মানুষ। কিন্তু সত্যিই কি যাদের ভাবনা এত এগিয়ে থাকা তারা শুধুই পশ্চাৎপদ!
আসলে যে-কোনও পরিচয়কে একটি বিশেষ খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে পারলে মূলধারার কিছু সুবিধা আছে। আর তারই ফলে আজকে আমরা গোটা দুনিয়া জুড়ে রাজনীতির প্রধান বিষয়টি দেখছি পরিচিতির লড়াই। একজন মানুষ একটি বিশাল দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েও তার প্রধান পরিচয় তৈরি করা হয়েছে দেশের নাগরিকের চেয়েও বেশি বিশেষ ধর্মীয়গোষ্ঠীর মানুষ হিসাবে এবং পরিকল্পিতভাবে তার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ তৈরি করা হচ্ছে, যার অবশ্যম্ভাবী ফল ঘটছে গণহত্যা এবং প্রান্তিকীকরণ। অদ্ভুতভাবে এই সমীকরণটি বদলে বদলে যায়। এককালে উগ্রপন্থার প্রধান দায় ছিল শিখ জনগোষ্ঠীর, এখন কিন্তু তারা কৃষক আন্দোলনের মুখ।
হিন্দু এবং মুসলমান এই দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বরাবরের মত দ্বান্দ্বিক অবস্থানে ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিভেদমূলক রাজনীতির এক বিরাট অবদান আছে আমরা জানি। আজ এদেশে মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী ও দেশদ্রোহী এবং এই ভাবনাটিকে আধুনিক যান্ত্রিক সমাজমাধ্যমে এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে একজন মুসলমান তার কথা বলা শুরু করলেই সে কথা শোনার আগেই তার বিশেষণগুলি চিহ্নিত হয়ে যায়। একজন মেয়ে তার নিজের পরিচিত পরিবারের অবদমনের সঙ্গে লড়াই করে শিক্ষা বাহনে এক বৃহৎ দুনিয়ায় পৌঁছে দেখে সেখানে তাকে চিহ্নিত করা হয় সংখ্যালঘু হিসাবে এবং পদে পদে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে হয়।
পরিচিতির রাজনীতি এক সমস্যা অথচ এই মুহূর্তে দুনিয়াজুড়ে অবদমিত শোষিত-বঞ্চিত এবং ক্রমাগত প্রান্তে ঠেলে দেওয়া জনগোষ্ঠীর কাছে টিকে থাকার বা ক্ষমতায় পৌঁছানোর কখনও কখনও এটাই একমাত্র উপায়। দেশজুড়ে দলিত জাগরণ আজ সেই পথেরই দিশারি। জাতপাতের রাজনীতি নিয়ে অনেকেই বিরক্ত কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের যাপনে এই জাত ব্যবস্থা এই সাম্প্রদায়িকতা এমনভাবে বিরাজমান যে রাজনীতিতে চলবে না এমন কথা বলার কোনও অবস্থা নেই।
এর বিপ্রতীপে দলিতদের হিন্দু ধারায় ধরে রাখার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে। ধর্মীয় নেতারা একাজে অগ্রগামী। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাসে তাৎমাটুলির মানুষেরা জাতে ওঠার জন্য সামূহিক পৈতে গ্রহণ করে। সবার ওপরে মানুষ সত্য কিন্তু তার ওপরে বর্ণ ব্যবস্থা একথা ভারত রাষ্ট্রে প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ধর্মই এর দ্বারা প্রভাবিত। ব্রাহ্মণ্যধর্ম থেকে বেরিয়ে আসা খ্রিস্টান নিজেকে ব্রাহ্মণ খ্রিস্টান বলেন, আবার সাম্যবাদী ইসলামেও আমি সৈয়দ এবং উঁচু জাত একথা শোনা যায়। আম্বেদকরের ভাষায় বর্ণব্যবস্থার চারতলা বাড়ি, যেখানে কোনও সিঁড়ি নেই, তাকে টিঁকিয়ে রাখছেন কিন্তু নীচের তলার মানুষেরাই।
সাম্প্রদায়িকতার বিষময় পরিণাম কিন্তু অল্প দিনের নয়, ব্রিটিশকে আমরা দোষ দিয়ে থাকি কিন্তু সেই কোন্ কাল থেকে এখনও পর্যন্ত বাংলার যে-কোনও গ্রামে গেলেই দেখা যাবে ধর্মে-বর্ণে বিভক্ত বসতি। ব্রাহ্মণপাড়া, মাঝিপাড়া, ডোমপাড়া, মুসলমান পাড়া। মহানগরীতেও পার্কসার্কাস মেটিয়াবুরুজ বিশেষভাবে চিহ্নিত। ওরা এবং আমরা এই পরিচিতি। মাঝখানে অদৃশ্য দেয়াল। কিন্তু তার মজবুত ইটগুলো আরও টকটকে হয়ে ওঠে রুটি বেটির প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে’ এই চমকপ্রদ সমীকরণটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অস্পৃশ্যতা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ কিন্তু বহুলাংশেই উচ্চবর্ণীয় সমাজে বর্তমান। তাই বহু স্কুলে বা অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে মুসলিম বা আদিবাসীদের চায়ের কাপ আলাদা থাকে। অবশ্য হিন্দুরা উলটো কথা বলে। মুসলমানের মেয়ে আজান শুনে মাথায় কাপড় দিলে ওরা বড়ো গোঁড়া অথবা ওদের দাড়ি টুপি বুঝিয়ে দেয় ওরা মুসলমান। কিন্তু শাঁখা-সিঁদুর হিন্দু না বুঝিয়ে কী বোঝায় জানি না। সেটাতো এক মুহূর্তও খোলা হয় না।
মেলামেশা গ্রামাঞ্চলে তাও বা সম্ভব। এ পাড়া ওপাড়া বিভক্ত হলেও সব ছেলেমেয়েরা একই হাই স্কুলে যায়। পাশাপাশি বসে পড়ে, মিড ডে মিল খায়, পরীক্ষা দেয়, খেলে। শহরে স্কুল অনেক বেশি। ফলে পৃথককরণ আরও বেশি। তবে তারই মধ্যে ভালবাসার কথা এলেই লাভ জিহাদের গল্প শুরু হয়ে যায়। মুসলমান গোরু খায়, কিছু হিন্দু শূকর আর ক্রিশ্চানে দুটোই খায়, কিন্তু যে খায় তার সাদা চামড়া হলে তার সাতখুন মাপ। তার ওপর ইতিহাসের তথ্য পরিবেশনের সমস্যা তো আছেই।
আবার আমরা সবাই ভারতীয়, আমরা একই দেশে বাস করি, আমাদের মধ্যে ভেদাভেদ নেই, এই চটজলদি সমাধান আর টিকছে না। সব ধর্মের কথা এক না বলে সত্য বলা ভালো সব ধর্মের কথা এক নয়, তাহলে এতগুলো ধর্ম হত না। কোনও ধর্মের অবতার রাষ্ট্রনায়ক মুহাম্মদ অথবা বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ, কোথাও বা গৃহত্যাগী রাজপুত্র সিদ্ধার্থ, কোথাও ছুতোরের ছেলে জিশু। সব ধর্মেই মানুষের বাঁচার পথ আছে, ভালোবাসার কথা আছে, সেগুলোকে শ্রদ্ধা করতে ক্ষতি কি? আমার গোষ্ঠীই সর্বশ্রেষ্ঠ (গরবসে কহো), তাই আমি বাকি সকলকে ধ্বংস করার অধিকারী — এহেন অনাসৃষ্টির প্রতিবাদেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পরেই নিজের গোষ্ঠীর মানুষের হাতেই প্রাণ দিয়েছিলেন অহিংসা ও সত্যের ধারক মহাত্মা গান্ধি।
অপর পরিচিতি সম্পর্কে আমাদের কিছু সিদ্ধান্ত আছে যেটা পারিবারিকভাবে অর্জিত। ব্রাহ্মণের বাড়িতে ছোঁয়াছুঁয়ির ঐতিহ্যে শুদ্ধাচারের পরাকাষ্ঠা হল ভাতের হাঁড়িতে হাত লাগলেই সর্বনাশ। তারপর মুসলমান বা জনজাতিদের সম্পর্কে গান্ধি ও রবীন্দ্রনাথ যাই বলে থাকুন শেষ কথা হল পাশের বাড়ির গিন্নির পিসতুতো ভাইয়ের শালা কী বলেন।
এই গ্রাম্যতা থেকে, সংকীর্ণতা থেকে আমাদের মুক্তি নেই। জন্মসূত্রে আমার গোষ্ঠীর না হলেই তুমি অন্যজন, তুমি ব্রাত্য, তুমি বিপজ্জনক সে আমাদের চেহারা, ভাষা, সংস্কৃতি যতই এক হোক। আবার যেখানে বৈচিত্র, সেখানেও আমি সন্দিগ্ধ। বিবিধের মাঝে মহান মিলন আমরা খুঁজে পাই না আর।
বিভিন্ন পরিচিতি-কে নিয়ে প্রকৃতির মতো বৈচিত্রময় একটা জগৎ আমরা গড়ে নিতে পারছি না। সবাই সবার মতো থাকলে চলবে না। বাজার সংস্কৃতির চাপে সবাই একরকম, এক পোশাক, এক সাজ, এক গাড়ি, এক সাবান, এক শখ, এক স্বপ্ন — এই একমাত্রিকতায় আমরা একমাত্র স্বচ্ছন্দ। এ বড়ো কঠিন সময়। “তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা মন জানো না।” আমিই বা কতটুকু জানি এই মনে কতটুকু গান্ধি, রবীন্দ্রনাথ, রোকেয়া, লালন।
জানিনা কী আমার পরিচয়! আমি যদি মেয়ে তবে চিরশঙ্কিত থাকি ঘরে বাইরে, যদি সংখ্যার বিচারে লঘু তবে নিজ বাসভূমে পরবাসী, ইস্কুলে শাসকের ভাষার দাপটে কোণঠাসা, আমার ভাষায় বিজ্ঞান পড়ে না কেউ, যে গাছটিকে দেবতা বলে জেনেছি তাকে সমূলে উৎপাটিত করে ধর্মের জয় ঘোষিত হয়।
“পরিচয়? কেন পরিচয় চাও প্রভু? ওই ওরা বসে আছে অন্ধকার বনচ্ছায়ে সকলেই ঋদ্ধপরিচয়? বনে ভরে আগুনকুসুম — আপন সোপানে কারা জলস্রোতে দেখেছিল মুখ? বুকে জ্বলে আগুনকুসুম — আমি যে আমিই এই পরিচয়ে ভরে না হৃদয়? কেন চাও আত্মপরিচয়?…. “
(‘জাবাল সত্যকাম’ : শঙ্খ ঘোষ)