প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রাষ্ট্র-চিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় 

মনমিত ভট্টাচার্য্য 

রাষ্ট্র একটি সংগঠন যা সরকার ও জনগণ দ্বারা গঠিত এবং অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের দিক থেকে এর উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, প্রতিষ্ঠানগত বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ পৃথক। রাষ্ট্র নির্দিষ্ট একটি ভৌগোলিক অবস্থানের মধ্যে তার নিয়ম কানুন বলবৎ করতে পারে, এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল এর ‘সার্বভৌমত্ব’ ক্ষমতা, যেটি অন্যান্য সংগঠনগুলোর থেকে এই সংগঠনটিকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা ক্ষমতার অধিকারী করেছে। 

আমরা যদি পাশ্চাত্য রাজনীতিকে একটু পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখব, রাষ্ট্র নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসে। প্লেটো ও অ্যারিস্টটল-এর দার্শনিক চিন্তাধারা থেকে।  প্লেটো-র মতে, আদর্শ রাষ্ট্র একটি গণরাজ্য, যা তিন ধরনের গুণ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত — কারিগর, সহায়ক ব্যক্তি ও philosopher king। Philosopher king বলতে আমরা বুঝি যে রাষ্ট্র চালনাকারী জ্ঞান, মূল্যবোধ, যুক্তিবোধের গুণসম্পন্ন দার্শনিক ব্যক্তি। অ্যারিস্টটল-এর চিন্তাধারায় প্রকাশ পায় — রাষ্ট্র হচ্ছে মানবজাতির একটি সংগঠন। যেহেতু প্রত্যেক সংগঠনের একটা উদ্দেশ্য আছে, ঠিক সেই রকম রাষ্ট্রের একটি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য আছে এবং সেটি হল মানব জাতির ভালো করা। ‘কল্যাণকর রাষ্ট্র’ শব্দবন্ধ তাই রাষ্ট্রের আলোচনায় বারংবার উচ্চারিত।

ষোড়শ শতাব্দী থেকে রাষ্ট্র নিয়ে আধুনিক ধারণা গড়ে ওঠে। যার নিদর্শন আমরা নিক্কলো মাকিয়াভেল্লি  ও জাঁ বদ্যাঁ-র লেখায় পাই। বদ্যাঁ সুস্পষ্ট ভাবে বলেছেন, সার্বভৌমত্বের ক্ষমতা যেন জনগণের হাতে থাকে। কিন্তু, তার সঙ্গে আবার এও বলেছেন যে, প্রথাগতভাবে জনগণ যেন তাদের প্রতিনিধিত্ব কোনও কর্তৃত্বের কাছে সমর্পণ করে, যাকে আমরা sovereign বলি। আসলে এখানে রাজার শাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন বদ্যাঁ, যে মতবাদকে আমরা Divine Rights of the Kings বলে জানি। 

সপ্তদশ শতকের রাষ্ট্রচিন্তাবিদ রুসো এবং লক নিয়ে আলোচনা করা যাক। জাঁ-জাক রুসোর চিন্তাধারায় social contract বা সামাজিক চুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এই সামাজিক চুক্তির দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন যে, রাষ্ট্রশাসক তার শাসন করার অধিকার প্রাপ্ত করেছেন জনগণের দ্বারা সম্পন্ন এক চুক্তিতে। এই চুক্তি অনুসারে যদি শাসক জনগণের কল্যাণের দিক বিবেচনা না করেন, তাহলে জনগণ সেই শাসকের পরিবর্তে অন্য কোনও শাসককে শাসনের দায়িত্ব প্রদান করতে পারে। লকের মতানুযায়ী, রাষ্ট্র চালনার দায়িত্বের অধিকার রাজা স্বয়ং ঈশ্বেরর কাছ থেকে প্রাপ্ত করেছেন এবং রাজা কোনও ভাবেই তার প্রজাদের প্রতি দায়বদ্ধ নন। লকের চিন্তাধারা অনুসারে রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে যা আমরা State of nature বলে জানি, সেখানে জনগণের জীবন, সম্পত্তি কোনও কিছুই সুরক্ষিত ছিল না, বা আইন ছিল না তাদের রক্ষা  করার জন্য। সেজন্য জনগণ রাজি হয়েছিল শাসক গঠনের কাজে। যাতে সুস্থভাবে জীবন যাপন করা যায়।

ঊনবিংশ শতকের হেগেল-এর চিন্তাধারা অনুসারে নৈতিক কর্মের সর্বোচ্চ সীমা হচ্ছে রাষ্ট্র। হেগেলের মতে রাষ্ট্র এমন একটি সংস্থা যা ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের কাজে নিয়োজিত। তিনি রাষ্ট্রকে সর্বশক্তিমান সংস্থা হিসাবে অভিহিত করেন। তাঁর মতে রাষ্ট্র হবে এমন, যেখানে রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের জন্য জনগণ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকে। তাঁর মতে, ব্যক্তি বিশেষের কল্যাণকামনা এবং বিশেষের সঙ্গে সার্বিক স্বাধীনতার সমন্বয় হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্রের মূল কথা। হেগেল রাষ্ট্রের যে স্বরূপ অঙ্কন করছেন তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় রাষ্ট্রের দুটি স্তম্ভ — দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ও জাতীয়রাষ্ট্রের তত্ত্ব।  তিনি রাষ্ট্রকে কোনও চুক্তির ফল বলে মনে করেন না।  তাঁর মতে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়ে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে মিলেমিশে বসবাস করা। আর তার পরিণতি হচ্ছে বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত সামাজিক সংগঠন রাষ্ট্র।

জেরেমি বেন্থাম উপযোগিতার দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রকে বিচার করে বলেন যে, রাষ্ট্রের প্রকৃত আদর্শ হচ্ছে অধিকতম সংখ্যাকে হিতসাধন করা। রাষ্ট্র ভালো কি মন্দ তা বিচারের মানদণ্ড হচ্ছে এটাই। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের বহু সংখ্যক মানুষের হিতসাধনের ক্ষমতা। 

মার্কস অনুযায়ী রাষ্ট্র হচ্ছে মানুষের বিচ্ছিন্ন দশার সব চাইতে স্পষ্ট নমুনা, একটা রাজনৈতিক বিমূর্তিকরণ, সমস্ত বাস্তব সংঘাত ধরা-ছোঁয়ার অধিক এক প্রতিষ্ঠান, যার সামনে মাথা নত করে জনগণ তার চরিত্র বুঝতে না পেরে। তাঁর মতে রাষ্ট্র একটি শ্রেণি শোষণের হাতিয়ার। আধুনিক রাষ্ট্রের নির্বাহীরা সমগ্র বুর্জোয়াদের সাধারণ কাজ সামলানোর একটা কমিটি ছাড়া কিছু নয়। মার্কসের মত, অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মতোই রাষ্ট্রের উৎপত্তির উৎস হচ্ছে শ্রম বিভাজন। মার্কস ভেবেছিলেন যে, পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে রাষ্ট্র স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারে। কিছু এশীয় দেশের প্রসঙ্গ টেনে তিনি রাষ্ট্রের দাপট ভিন্ন অন্য চরিত্রের সম্ভাবনার কথাও সম্ভব বলে ভেবেছেন। যেমন ভারত, চিন, রাশিয়ার পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কিছু জায়গায় স্বৈরতান্ত্রিকরা অসংখ্য ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের পিতা হিসাবে আবির্ভূত হত, আর তা দিয়ে তাদের সাধারণ ঐক্যের প্রকাশ ঘটাত। রাজনীতির অবস্থান থেকে রাষ্ট্র এবং সমাজের গঠন দুটো আলাদা জিনিস নয়।  রাষ্ট্র হল সমাজের গঠন।  রাষ্ট্র যদি সামাজিক অশুভ শক্তির অস্তিত্ব মেনেও নয়, তাহলে তার দোষ চাপিয়ে দেয় প্রাকৃতিক আইনের ঘাড়ে, যার বিরুদ্ধে মানুষের কিছু করার ক্ষমতা নেই।  এভাবে ইংল্যান্ডে দারিদ্র্য ব্যাখ্যা করা হয় প্রাকৃতিক বিধি দিয়ে। ইংল্যান্ড দারিদ্র্যকে ব্যাখ্যা করে গরিবের বড়ো মতলবের ফলাফল হিসেবে। খুব সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে মার্কসের তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্র কোনও কল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং শক্তির উন্নত প্রতিষ্ঠিত একটি কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান।  প্রাচীনকালে রাষ্ট্র ছিল না। আদিম সমাজ ছিল রাষ্ট্রহীন সাম্যবাদী। পরবর্তী কালে ব্যক্তিগত সম্পত্তি উদ্ভব হওয়ায় মানুষে মানুষে মতভেদ বা শ্রেণিদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে শোষণ ও বলপ্রয়োগের প্রয়োজনে সমাজে এক বিশেষ শক্তি হিসেবে মানুষই রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে। মার্কসীয় ধারণা অনুসারে রাষ্ট্র শ্রেণি-শাসনের একটি সংস্থা, এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে শোষণ করার যন্ত্রবিশেষ। মার্কস-এঙ্গেলস সমাজ বিকাশের ৫টি পর্যায়ের কথা বলেছেন : ১) আদিম সাম্যবাদী সমাজ, ২) দাস সমাজ, ৩) সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং ৪) সমাজতান্ত্রিক সমাজ। তবে শোষণের যন্ত্র হিসাবে রাষ্ট্রের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে যদি সমাজতান্ত্রিক সমাজে শোষণের অবসান ঘটে। এর ফলে রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ঘটবে। অতঃপর গড়ে উঠবে ৫) শ্রেণিহীন শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ। এই সাম্যবাদী সমাজে মূলনীতি হবে প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী শ্রম দান করবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ভোগ করবে।  

আমরা বিংশ শতাব্দীর শেষ ও একবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই বলতে হবে নৈরাজ্যবাদ বা অরাজকতাবাদ, যা এক ধরনের রাজনৈতিক দর্শন। এই মতবাদ মনে করে রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত ও ক্ষতিকর।  তার পরিবর্তে দরকার রাষ্ট্রবিহীন সমাজ।  নৈরাজ্যবাদকে সংস্থারপন্থী ভাবধারার আদর্শবাদ হিসেবে ধরা যায়। বেশিরভাগ নৈরাজ্যবাদী অর্থনীতিতে প্রাধান্য দেয় সমবায়কে। ব্যাক্তিগত ও সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রের ন্যূনতম হস্তক্ষেপের পক্ষে সওয়াল করেন তাঁরা। নৈরাজ্যবাদ ব্যক্তিকে কেন্দ্রে রাখে। বাজার অর্থনীতি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদকে সমর্থন করে। একটু বলা দরকার যে, ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন-উত্তর আমেরিকায় নৈরাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটে। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শ্রমিক আন্দোলন ও প্রাণী-অধিকার আন্দোলন নৈরাজ্যবাদে নতুন মাত্রা যোগ করে। একটি গুরুত্বপূর্ণ সাম্প্রতিক নৈরাজ্যবাদ হল মুক্ত ভালোবাসা। এ প্রসঙ্গে জোসিয়া ওয়ারেনের নাম উল্লেখযোগ্য। মুক্ত ভালোবাসা নারী অধিকারকে বিস্তৃত করে। প্রথাগত বৈবাহিক আইন ও জন্ম-নিয়ন্ত্রণের পরিপন্থী মুক্ত ভালোবাসা।

এবার আমরা আসি ভারতীয় দার্শনিকদের রাষ্ট্রতত্ত্বের আলোচনায়। প্রথমে কৌটিল্য। কৌটিল্যের রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি ‘অর্থশাস্ত্ৰ’ থেকে। অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, রাজা স্বেচ্ছাচারী না হয়ে প্রজাদরদি হবেন। কৌটিল্যের মতে প্রজাদের মঙ্গল, সমৃদ্ধি ও সুখ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রজাকে সক্রিয় থাকতে হবে। কৌটিল্য রাষ্ট্রকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করে এর সাতটি অঙ্গের কথা বলেছেন।  এগুলো হল — স্বামী, অমাত্য, পুর, জনগণ, কোশ, দণ্ড ও মিত্র।  কৌটিল্যে বর্ণিত স্বামী বা রাজার সঙ্গে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর বর্ণিত রাষ্ট্রের দার্শনিক রাজা-র মিল রয়েছে। কৌটিল্যের সঙ্গে আমরা রুশোর একটা জায়গায় মিল পাই — তা হল জনগণের সম্মতি ও গ্রহণযোগ্যতার ওপর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে আছে। কৌটিল্য রাষ্ট্রের শক্তি প্রসঙ্গে বলেছেন যে, রাজা তথা রাষ্ট্রের শক্তি তিন প্রকার — ১) মন্ত্র শক্তি: মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ ক্ষমতা। ২) প্রভু শক্তি: বাস্তব সম্পদ ও বলপ্রয়োগ ক্ষমতা। ৩) উৎসাহ শক্তি: রাজার ব্যক্তিগত দৈহিক ও উদ্যোগ ক্ষমতা। এই তিন ধরনের শক্তি প্রয়োগের দ্বারা রাজা যে সফলতা অর্জন করেন তা হল মন্ত্র, প্রভু, উৎসাহ সিদ্ধি। 

ভারতের জাতীয়তাবাদ চিন্তাধারা প্রসঙ্গে বলতে গেলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন প্রকৃত পথিকৃৎ। বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্বে বিশেষত বেঙ্গল রেনেসাঁর পূর্বে ভারতে জাতীয়তাবাদের অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে অনেকেই বিতর্ক করেছেন। সন্দেহ নেই, তিনি জাতীয়তাবাদকে উপলব্ধি করেছেন এবং ধর্মের স্তরে উন্নীত করেছেন। তিনি মাতৃদেবীর সঙ্গে মাতৃভূমি-কে চিহ্নিত করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হিন্দু জাতীয়তাবাদ কিনা তা নিয়ে চারদিকে বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হল, বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দু পথের মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নীতি বুঝতে পেরেছিলেন এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হিসাবে তাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন একটি নতুন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শের স্রষ্টা, যা তাঁর সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্রোতের চাহিদার ফসল। ঋষি অরবিন্দ ঠিকই বলেছেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি ভাষা, সাহিত্য এবং একটি জাতি তৈরি করেছিলেন।  বঙ্কিম ভেবেছিলেন যে ইউরোপের মতো ভারতের উত্থান কেবল জাতীয়তাবাদের সাহায্যেই সম্ভব হবে। তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে, ইংরেজি শিক্ষার যৌক্তিক উপাদান, যা জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার ভিত্তি, তা হিন্দু সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে নি। জাতীয়তাবাদের ইউরোপীয় ধারণা এবং জাতীয়তাবাদের ভারতীয় ধারণার মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদ বা দেশপ্রেমের ধারণা সবার কল্যাণের প্রতি ভালোবাসার আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।’ 

অরবিন্দ ঘোষের চিন্তাধারার মধ্যে ভারতীয় অধ্যাত্মচিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়। শ্রী অরবিন্দের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতীয়রা ব্রিটিশদের বিস্তৃত আমলাতান্ত্রিক কাঠামো অনুসরণ করলেও ভারতের আধ্যাত্মিক পরম্পরার থেকে তা একান্তই পৃথক। অর্থাৎ অরবিন্দের উপলব্ধিতে জাতীয়তাবাদের একটি আধ্যাত্মিক লক্ষ্য ছিল। তিনি মনে করতেন, ভারতীয় আধ্যাত্মিক চেতনা বিশ্বের বিবিধ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম। শ্রী অরবিন্দ চেয়েছেন আমাদের প্রাচীন ধর্ম, দর্শন, শিল্প ও সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন, যা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সঠিক দিশা দেখাতে পারবে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারতে জাতীয়তাবাদ’ (১৯১৭) গ্রন্থে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন যে, জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল সম্পূর্ণভাবে একটি যান্ত্রিক প্রচেষ্টা। যা উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধি অর্জন নিশ্চিত করে। জাতীয়তাবাদের ধারণার সঙ্গে শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্য যুক্ত হওয়ার ফলে পারস্পরিক বিদ্বেষ, অপছন্দ এবং ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে সামাজিক দৈনিক পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে মানুষের জীবনকে নিরাপত্তাহীন করে তোলে।  

রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদকে স্বার্থপর হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে শক্তির দম্ভে জাতীয়তাবাদীরা দুর্বল, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভের প্রচেষ্টার চালায়। যার স্বাভাবিক ফলাফল সাম্রাজ্যবাদ এবং প্রাণঘাতী যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয় মানবতা। প্রকৃতপক্ষে ইউরোপীয় ফ্যাশন-এর জাতীয়তাবাদ ভারতে প্রযোজ্য হতে পারে না। কারণ, ইউরোপে ব্যক্তিদের মধ্যে কোনও জাতের পার্থক্য নেই। কিন্তু ভারতীয়রা জন্মায় বর্ণবৈষম্য সঙ্গে করে। সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর তিরস্কার অব্যাহত রেখে তিনি যোগ করেন যে জাতীয়তাবাদ থেকে জন্ম নেওয়া এই parochialism মানুষের স্বাধীনতার অন্তরায় এবং প্রাকৃতিক স্বাধীনতা এবং আধ্যাত্মিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেছেন, জাতীয়তাবাদের প্রশস্ত অজুহাত আমাদের অনেক অপরাধের দিকে পরিচালিত করে। অমানবিক চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদ আমাদের শুধুমাত্র সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিক নিয়ে যাবে। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রত্যাখ্যান করার জন্য জোর দিয়েছিলেন। 

এবার গান্ধিজির রাষ্ট্র চিন্তার ওপর আলোচনা করা যাক। তাঁর মতে, পশ্চিমি দেশগুলো ছিল সহিংসার প্রতীক। নাগরিকদের কাছ থেকে আনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র জবরদস্তি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সহিংস ব্যবস্থা প্রয়োগ করে। তিনি বলেছেন যে, একটি রাষ্ট্রের কাছে সহিংসতা বা জবরদস্তি কোনও ভাবেই কল্পনা করা যায় না।  তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেছিলেন যে রাষ্ট্রের অধিকার ক্ষমতার অর্থ হল আরও বেশি সহিংসতা বেশি মাত্রায় জোর প্রয়োগ করা। আইন শৃংঙ্খলা রক্ষার নামে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার বিপুল ক্ষমতা অর্জন করে এবং এর ফলে নির্মম রূপে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে। ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব হয়। গান্ধিজি পশ্চিমি মডেলের রাষ্ট্রকে এই ভিত্তিতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে, এটি সহিংস বা জবরদস্তির প্রতিনিধিত্ব করে। গান্ধিজি বিশ্বাস করতেন যে, জোর প্রয়োগ করে কিছু করা যায় না। ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও কাজ করতে বাধ্য করাও যায় না। তিনি ব্যক্তির স্বাধীনতা প্রসারের জন্য রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি গান্ধির এই ভালোবাসায় তাঁকে নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকদের সঙ্গে তুলনা করেন অনেক রাষ্ট্রচিন্তক। যেহেতু গান্ধিজির রাষ্ট্রের প্রতি কোনও বিশ্বাস ছিল না যা হিংসা এবং জবরদস্তির মূর্ত প্রতীক, তাই তিনি এই রাজনৈতিক সংগঠনের অন্য কোনও শাখাকে সমর্থন করেননি। তিনি অবশ্য এ কথা ও বলেছেন যে বর্তমান রাজনৈতিক সংগঠনগুলো, যেমন আইন সভা — বিগত দিনের চেয়ে ভালো। সবার শেষে গান্ধিজির রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে মতামত নিয়ে আলোচনা করা যাক। সার্বভৌমত্ব মানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জবরদস্তি শক্তি। গান্ধিজি এই শক্তির প্রতি তীব্র আপত্তি করেছিলেন। কারণ, সর্বোচ্চ জবরদস্তি ক্ষমতা ব্যক্তির স্বাধীনতাকে নির্মমভাবে হরণ করে। সার্বভৌমত্ব বল দ্বারা আনুগত্য গ্রহণ করে।  রাষ্ট্রের এই ধরনের ক্ষমতা, বলার অপেক্ষা রাখে না, গান্ধির অনুমোদন পেতে পারে না। গান্ধিজি বরং প্রচলিত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের নয়, জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বের একজন প্রবল সমর্থক ছিলেন। যা অবশ্যই সহাবস্থিত মানবতার।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান