গোপাল চন্দ্র সিনহা
‘পরিচিতি’ শব্দটি নামে ক্ষুদ্র হলেও এক অর্থে বিশাল। দেশ, মানুষ, বর্ণ, জাতি, সমাজ, ধর্ম — সমস্ত ক্ষেত্রেই এই শব্দটির প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। এ বিষয়ে পণ্ডিত মহলে বিতর্ক থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার। আবার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন যুগের ‘পরিচিতি’-র রকমফের ঘটাও অস্বাভাবিক নয়। এখানে দেশ অর্থে ভারতবর্ষ এবং যুগ বলতে আদি-মধ্যযুগকে আলোচনার ক্ষেত্র হিসেবে ধরা হয়েছে। আলোচনার মূল বিষয় সমাজ। বলা বাহুল্য, সুপ্রাচীন কাল থেকেই সমাজের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত বর্ণব্যবস্থা ও জাতিভেদ প্রথা, যা এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয়।
[এক]
প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ে প্রবেশ করার আগে ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে আদি-মধ্যযুগ বলতে সাধারণভাবে কোন্ সময়কে ধরা হয় এবং সেই সময় কালে ভারতের রাজনৈতিক চালচিত্র সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। আদি-মধ্যযুগের সময়কাল নিয়ে পণ্ডিত মহলে কিছুটা মতদ্বৈধতা রয়েছে। তথাপি গুপ্ত-উত্তর যুগ অর্থাৎ আনুমানিক ৫৫০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে সাধারণভাবে এই পর্যায়ে ধরা হয়ে থাকে। অবশ্য কোনও কোনও ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে কিছুটা ভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন।[১] যাই হোক না কেন, আলোচ্য পর্বে সমগ্র ভারতবর্ষ কোনও একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শক্তি দ্বারা শাসিত হত না। আঞ্চলিক ভিত্তিতে গঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা সেগুলি শাসিত হত। এই রাজনৈতিক শক্তিগুলির মধ্যে বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরে উল্লেখযোগ্য রাজবংশ গুলি হল — প্রতিহার, চৌহান, গাহড়বাল, চন্দেল্ল, পাল ও সেন এবং দক্ষিণে বংশগুলি হল বাতাপির চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, পল্লব ও চোল। উল্লেখ্য, আলোচ্য পর্বে সমগ্র ভারতবর্ষে একটি সুনির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তির অভাব সত্ত্বেও সামাজিক ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছিল বর্ণ ব্যবস্থা ও জাতিভেদ প্রথায়।
তথ্য ছাড়া ইতিহাস অচল। স্বাভাবিকভাবেই সমকালীন ও প্রায় সমকালীন যুগের সাহিত্যিক ও শিলালৈখিক উপাদানের আলোকে আদি-মধ্যযুগের বর্ণব্যবস্থা ও জাতিভেদ প্রথার বিষয়টি নেড়েচেড়ে দেখা যেতে পারে। আলোচ্য পর্বের ইতিহাসাশ্রয়ী কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক উপাদান, যথা — বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’, জিন সেনের ‘হরিবংশ পুরাণ’, বিজ্ঞানেশ্বরের ‘যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির’ ওপর টীকা, মেরুতুঙ্গের ‘প্রবন্ধচিন্তামণি’, সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ এবং পুরাণগুলির মধ্যে ‘অগ্নিপুরাণ’, ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’ ও ‘বিষ্ণুধর্মোত্তরপুরাণ’ — এ ব্যাপারে বিশেষ কাজে লাগে। এছাড়াও স্মৃতি ও ধর্মশাস্ত্রমূলক কিছু গ্রন্থ, যথা — মেধাতিথির ‘মনুভাষ্য’, অপরার্কের ‘যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিভাষ্য’ এবং ‘মনুস্মৃতি’-র ওপর রচিত গোবিন্দরাজের টীকাগ্রন্থ থেকেও এ বিষয়ে তথ্য সংগৃহীত হয়ে থাকে। সাহিত্যিক উপাদান ছাড়াও বাংলার বৃহৎচট্টিবন্না নামে গ্রামে প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় দশম শতকের একটি তাম্রলেখতেও বর্ণ ও জাতি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে।
[দুই]
এখন বিষয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যাক। প্রথমেই যে প্রশ্নগুলি আমাদের কৌতূহল উদ্রেক করে সেগুলি হল ‘বর্ণ’ ও ‘জাতি’ কী? এই দুয়ের মধ্যে প্রকৃত সম্পর্ক কী? কখন ও কীভাবে এগুলির উদ্ভব ঘটল প্রভৃতি। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, ঋগ্বৈদিক যুগ (আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এর শেষ দিকে চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা ভারতীয় সমাজের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, যার ইঙ্গিত মেলে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত ‘পুরুষসূক্ত’-তে। চতুর্বর্ণ বলতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রকে বোঝায়। উল্লেখ্য, তৎকালীন আর্য সমাজ চারটি বর্ণে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে। বৈদিক যুগের পরবর্তীকালের স্মৃতি গ্রন্থ ‘মনুসংহিতা’-য় স্পষ্টভাবেই বিধান দেওয়া হয়েছে — ব্রাহ্মণের কর্তব্য অধ্যয়ন, অধ্যাপনা ও পূজার্চ্চনা করা, ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য দেশ শাসন, দেশরক্ষা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ; বৈশ্যের কাজ ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং শূদ্রের কর্তব্য ওই তিন বর্ণের সেবা করা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বর্ণ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ রং হলেও সামাজিক ভেদাভেদের যে চিত্র ওপরে প্রতিফলিত হয়েছে তা রং-এর ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি — সামাজিক অবস্থান ও কর্মের ভিত্তিতে এর উদ্ভব ঘটেছিল। বর্ণ ব্যবস্থা আর এই ছক প্রথমে গড়ে উঠেছিল আর্যাবর্তে (উত্তর ভারত) এবং পরবর্তীকালে খুব সম্ভবত খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে তা সম্প্রসারিত হয়েছিল দ্রাবিড় সভ্যতার কেন্দ্রস্থল দক্ষিণ-ভারতে।
এখন প্রশ্ন হল বর্ণের সঙ্গে জাতির সম্পর্ক কী? এর সঙ্গে যে প্রশ্নটি জড়িত তা হল ‘বর্ণ’ ও ‘জাতি’ এই দুটি বিষয়ে এক না ভিন্ন? এদের বর্তমান অবস্থানই বা কি? বলাবাহুল্য, এ বিষয়ে পণ্ডিতরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এ এল ব্যাশামের বক্তব্য হল, ইংরাজিতে ‘কাস্ট’ (caste) শব্দটিকে যে বর্ণ ও জাতি উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।[২] যুক্তি হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন যে সামাজিক মানদণ্ডের বিচারের caste অর্থাৎ জাতির উত্থান ও পতন দুই-ই আছে। অপরদিকে প্রধান চারটি বর্ণ যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র সুদৃঢ় ও স্থায়ীভাবে যুগ যুগ ধরে বিরাজমান। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, জাতি গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের সূত্র ধরে — বর্ণ থেকে এর উদ্ভব ঘটেনি। মানুষের বিভিন্ন শাখা ও গোষ্ঠীর পরস্পর যোগাযোগের ফলে এক বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ধারা গড়ে ওঠার সূত্র ধরে এর উদ্ভব বলে তিনি মনে করেন। তাঁর কাছে অবশ্য মনে হয়েছে প্রথমে উদ্ভব ঘটে ‘বর্ণ’ (class)-র এবং তারপর ‘জাতি’ (caste)-র।
এ এল ব্যাশামের অভিমতের সঙ্গে অনেকাংশে সহমত প্রকাশ করেছেন নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, আপাতদৃষ্টিতে মনে করা হয় বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথা একই মুদ্রার দুটি দিক। কিন্তু বাস্তবে এ দুটি বিষয় পৃথক ও স্বতন্ত্র। কারণ বর্ণভেদ হল একটি বিশেষ আদর্শগত দৃষ্টিকোণ থেকে সমগ্র জনসমাজকে কয়েকটি ভিন্ন মর্যাদার শ্রেণিতে বিভাজন। তিনি মনে করেন প্রাচীন শাস্ত্রকাররা তৎকালীন সমাজকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র — এই চতুর্বর্ণের বিভক্ত করার যে প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন তা নিছক আদর্শমূলক, কোনও যুগেই যার অস্তিত্ব ছিল না। বাস্তবে যা আছে তা হল অসংখ্য জাতি। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, জাতি বলতে বোঝায় একটি বিশেষ পেশার ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীকে, যারা নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই বিবাহ (অন্তর্বিবাহ) করে, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যারা নিজস্ব সামাজিক আইনের দ্বারা পরিচালিত, যাদের অধিকার ও কর্তব্যের ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট এবং যারা পেশাগত ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ধরনের সার্বভৌমত্ব ভোগ করে।[৩]
বর্ণাশ্রম প্রথা তথা বর্ণ বিন্যাসের বিষয়টি আরও স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন নীহাররঞ্জন রায়। তিনি লিখেছেন যে প্রাচীন ধর্মসূত্র ও স্মৃতিগ্রন্থের লেখকরা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র এই চতুর্বর্ণের কাঠামোর মধ্যে সমস্ত ভারতীয় সমাজব্যবস্থাকে বাঁধতে চেষ্টা করেছিলেন। এরপর তিনি জোরের সঙ্গেই বলেছেন ‘এই চাতুর্বর্ণপ্রথা অলীক উপন্যাস’ ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ ভারতবর্ষে এই চতুর্বর্ণের বাইরে অসংখ্য বর্ণ, জন ও কোম বিদ্যমান ছিল এবং প্রত্যেক বর্ণ, জন, কোমের ভিতরে ছিল অসংখ্য স্তর-উপস্তর, যেগুলিকে স্মৃতিকারেরা ‘অভিনব অবাস্তব উপায়ে’ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, সেই মনু-যাজ্ঞবল্ক্যের সময় থেকে শুরু করে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে রঘুনন্দন পর্যন্ত এর অবিরাম চেষ্টা চলেছে।[৪] একথা অবশ্য ঠিক যে স্মৃতিকারদের রচনার মধ্যে সমসাময়িক বাস্তব সামাজিক অবস্থা কিছুটা প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু যে যুক্তি পদ্ধতির আশ্রয়ে এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা নেওয়া হয়েছে এবং সমাজের যে বিচিত্র বর্ণ, উপবর্ণ ও সংকরবর্ণের সৃষ্টি করা হয়েছে তা একান্তই ‘অনৈতিহাসিক’ ও ‘অলীক’ বলে মনে করেছেন নীহাররঞ্জন রায়। বলাবাহুল্য, অনৈতিহাসিক হওয়া সত্ত্বেও আজও আর্য-ব্রাহ্মণ্য ভারতীয় সমাজ এই যুক্তি পদ্ধতিতে বিশ্বাসী।[৫]
‘বর্ণ’ ও ‘জাতি’-র পরিচিতি (identity) নিরূপণ করতে গিয়ে রামশরণ শর্মা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। বর্ণ ও জাতির মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য তিনি খুঁজে পাননি। তিনি মনে করেন বৈদিক যুগে গৌরবর্ণ আর্য ও কৃষ্ণবর্ণ অনার্যদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের উদ্দেশ্যে প্রথমে বর্ণ কথাটি ব্যবহৃত হত। পরে সামাজিক অবস্থান ও পবিত্রতার নিরিখে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র — এই চারটি বর্ণ তথা বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে এবং তাদের বিভিন্ন কর্তব্যকর্ম নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, এই চারটি বর্ণ ছাড়াও অস্পৃশ্যদের কখনও কখনও অসৎ শূদ্র বলে মনে করে তাদের ‘পঞ্চম বর্ণ’ বলা হত।[৬]
যাই হোক না কেন, মূল বর্ণ চারটি হলেও জাতির সংখ্যা কিন্তু হাজার হাজার। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা অনুসারে ভারতে দুহাজার রকম শুধু ব্রাহ্মণই আছে। এই হাজার হাজার জাতিগুলিকে কোনও না কোনও বর্ণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[৭] আর এস শর্মার অভিমত হল, ‘জাতি’-র অর্থ হল জন্ম। আর জাতি নির্ধারিত হত জন্মের ভিত্তিতে, কর্মের ভিত্তিতে নয়। বর্ণ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য হত। তাঁর কাছে মনে হয়েছে প্রারম্ভিক পর্বে বর্ণকে এক বড়ো একক হিসাবে গণ্য করা হত এবং এক বর্ণের মধ্যে অনেক জাতি হতে পারত। কিন্তু আদি-মধ্যযুগে বর্ণ ও জাতির মধ্যে পার্থক্য দূরীভূত হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলায় প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় দশম শতকের একটি তাম্রফলকে উল্লেখিত ৩৬টি বর্ণ অধ্যুষিত বৃহৎচট্টিবন্না নামে একটি গ্রামের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এখানে ছত্রিশ বর্ণ বলতে ছত্রিশ প্রকার জাতিকে বোঝানো হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। আবার ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’-এ শতাধিক বর্ণের উল্লেখ আছে, যাদের অধিকাংশই বর্ণে রূপান্তরিত উপজাতীয় মানুষ।
বর্ণ ব্যবস্থার প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল যথাক্রমে বিবাহ ও সামাজিক সংসর্গ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ, বংশানুক্রমিকতা ও শ্রেণিপর্যায়। বলাবাহুল্য দীর্ঘদিন ধরে এই বৈশিষ্ট্যগুলি একইভাবে বহমান থেকেছে। বস্তুত, সব বর্ণের মধ্যে বিবাহ এবং নিম্ন বর্ণের কাছ থেকে খাদ্য গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা বর্ণ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। জন্মগত ও বংশানুক্রমিকভাবে এই বিশ্বাস প্রতিবর্ণের মধ্যে ক্রিয়াশীল। একবার কোনও ব্যক্তি ব্রাহ্মণ হিসাবে জন্মগ্রহণ করলে তিনি ও তাঁর বংশধরগণ ব্রাহ্মণ হিসাবেই পরিগণিত হবেন। অন্য বর্ণের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে সত্য। এখানে আরও উল্লেখ করা দরকার যে চারটি প্রধান বর্ণ এবং সেগুলির অধীনে যে অসংখ্য জাতি আছে সেগুলি নিজ নিজ ধর্মীয় আচারের পদমর্যাদা অনুসারে সাজানো। এ প্রসঙ্গে রামশরণ শর্মার দৃঢ় অভিমত হল, ভূতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় সমাজের স্তরবিন্যাস বিচার করা উচিত — পবিত্রতা, কঠোরতা ও বংশানুক্রমের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়।
[তিন]
বর্ণব্যবস্থার উদ্ভবের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জিজ্ঞাসু পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারে সাধারণত চারটি তত্ত্ব উত্থাপিত হয়ে থাকে [৮] —
প্রথম তত্ত্ব অনুযায়ী সহজাত প্রবৃত্তি ও প্রতিভার ভিত্তিতে সমগ্র মনুষ্য সমাজকে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। প্রসঙ্গত বলা যায় আধ্যাত্মিকতা, বৌদ্ধিক গুণাবলি, উৎপাদনের কাজে দক্ষতা, সামরিক দক্ষতা প্রভৃতির ভিত্তিতে এই বর্ণবিভাজন ঘটে থাকে। এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে একথা বলা বাঞ্ছনীয় হবে যে, যে-সামাজিক বস্তুগত পরিবেশে মানুষ জন্মগ্রহণ করে ও প্রতিপালিত হয়ে থাকে তার ওপর গুরুত্ব আরোপ না করে কেবল সহজাত গুণাবলির ওপর জোর দেওয়া যথোচিত নয়। বলা বাহুল্য, বর্ণব্যবস্থাকে যারা জিইয়ে রাখতে চান এই তত্ত্ব তাঁদের স্বার্থকেই চরিতার্থ করে।
দ্বিতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী বর্ণ ব্যবস্থার উদ্ভবের পিছনে পবিত্রতা ও অপবিত্রতার ধারণা কাজ করেছে বলে মনে করা হয়। ব্রাহ্মণকে উচ্চস্তরের পবিত্র এবং শূদ্রকে অপবিত্র বলে গণ্য করার ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু এই তত্ত্ব সর্বজনগ্রাহ্য নয়।
তৃতীয় তত্ত্ব অনুযায়ী বর্ণের উদ্ভব ঘটেছে ভারতের আদিম উপজাতিগুলির কাছ থেকে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার হিসেবে। এরকম মনে করা হয় যে প্রত্যেকটি উপজাতি অসংখ্য কুলে বিভক্ত। একটি কুলের সদস্যগণ সংশ্লিষ্ট উপজাতির মধ্যে, কিন্তু ভিন্ন কুলে বিরাজ করার রীতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। যখন এই ধরনের একটি উপজাতি বর্ণ হিসেবে ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থায় মিশে যায় তখনও সে নিজ উপজাতি অথবা বর্ণের মধ্যেই বিবাহ করে। এরপর সে ধীরে ধীরে অন্যান্য বর্ণের সঙ্গে সামাজিক সংযোগ স্থাপন করা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। এই ভাবেই বিবাহের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে নিম্নবর্ণের সঙ্গে উচ্চবর্ণের সামাজিক সংযোগ রক্ষার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় এবং এর সূত্র ধরে স্বাভাবিকভাবেই বর্ণব্যবস্থার উদ্ভবের ক্ষেত্র প্রশস্ত হয়।
বর্ণব্যবস্থার উদ্ভবের চতুর্থ তত্ত্ব হিসাবে কিছু পণ্ডিত শ্রম বিভাজনকে নির্দিষ্ট করে থাকেন। এরকম বলা হয়ে থাকে যে, উৎপাদনের বৃদ্ধি ঘটাতে গিয়ে পেশাভিত্তিক শ্রমবিভাজনের প্রয়োজন বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল। এর সূত্র ধরেই বর্ণব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। এই তত্ত্বের কিছু যৌক্তিকতা আছে বলে রামশরণ শর্মার মনে হয়েছে। তিনি মনে করেন যে শ্রমবিভাজন এমনভাবে প্রবর্তিত করা হয় যাতে ব্রাহ্মণ তথা পুরোহিত এবং ক্ষত্রিয় তথা যোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়। অপরদিকে এই দায়িত্ব কেবল বৈশ্য ও শূদ্রদের হাতে ন্যস্ত হয়।
[চার]
বর্ণ থেকে জাতিতে উত্তরণ ঘটল কীভাবে সে বিষয়ে এখন আলোকপাত করা যাক। উল্লেখ্য, আদি-মধ্যযুগের অনেক আগে মৌর্য ও মৌর্যোত্তর যুগ থেকে এই উত্তরণ ঘটতে থাকে এবং ওই ধারা পরবর্তীকালেও বহমান থাকে। এই উত্তরণের পিছনে সাধারণভাবে কয়েকটি বিষয় কাজ করেছিল বলে মনে করা হয় —
প্রথমত, মৌর্য-উত্তর যুগে বিদেশি বিভিন্ন জাতি, যথা — গ্রিক, শক, পার্থিয়ান, কুষাণ প্রভৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে। বিদেশিদের সঙ্গে পূর্বতন উপজাতিদের সমন্বয়ের ফলে জাতির সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
দ্বিতীয়ত, শাস্ত্রকারগণ কর্তৃক প্রদত্ত বর্ণসংকর তত্ত্বের সূত্র ধরে অসংখ্য জাতির উদ্ভব ঘটেছিল। এই তথ্য প্রতিফলিত হয়েছে ‘মনুসংহিতা’ ও কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ। এই গ্রন্থগুলিতে চারটি প্রধান বর্ণের মধ্যে অনুলোম (উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে নিম্নবর্ণের কন্যা) এবং প্রতিলোম (উচ্চবর্ণের কন্যার সঙ্গে নিম্নবর্ণের পুরুষ) বিবাহের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন সংকর (বর্ণসংকর) বা মিশ্র জাতির উদ্ভব ঘটে। উল্লেখ্য, ব্রাহ্মণকন্যা ও শূদ্রপুরুষের বিবাহের ফলে উদ্ভূত সন্তান ‘চণ্ডাল’এবং ব্রাহ্মণপুরুষ ও শূদ্রকন্যার বিবাহের সূত্রে জাত সন্তান ‘নিষাদ’ বলে পরিগণিত হত। এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে যে, গুপ্ত ও গুপ্ত-উত্তর যুগে চণ্ডাল অস্পৃশ্য জাতি বলে পরিচিত ছিল। চণ্ডালরা যে অস্পৃশ্য ছিল গুপ্তযুগে, এদেশে আগত চিনা পর্যটক ফা-হিয়েনের বিবরণে তার উল্লেখ আছে। আবার ‘অগ্নিপুরাণ’-এ বলা হয়েছে যে চণ্ডালরা ঘাতক বৃত্তির মতো নিম্ন পেশার অধিকারী, যারা বাস করে গ্রামের সীমানার বাইরে। নবম শতকের মানুষ মেধাতিথি তাঁর ‘মনুভাষ্য’-তে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহ সূত্রে সৃষ্ট বর্ণসংকর তত্ত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
তৃতীয়ত, দীর্ঘকাল ধরে কিছু কারিগর বা শিল্পী তাদের পেশা বা বৃত্তি অনুসরণ করে চলতে চলতে বৃত্তি ভিত্তিক বেশকিছু জাতির উদ্ভব ঘটে। এই ধরনের কিছু জাতি হল কৃষক, গোয়ালা, ছুতোর, জেলে নাপিত প্রভৃতি।
চতুর্থত, গুপ্ত ও গুপ্ত-উত্তর যুগে ব্যাপকহারে ভূমিদান এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও নগরের অবক্ষয়ের সূত্র ধরে এক নতুন অর্থব্যবস্থার উদ্ভব হয়, যার প্রভাব পড়েছিল বর্ণব্যবস্থা ও জাতি প্রথার ওপর — এমন মত প্রকাশ করেছেন রামশরণ শর্মা। তাঁর কাছে মনে হয়েছে, এই পর্বে কারিগর ও ব্যবসায়ীদের গতিশীলতা নষ্ট হয় এবং বৃত্তির ক্ষেত্রে বংশানুক্রমিকতা বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে বিশেষ কিছু শিল্পের নাম বিশেষ বিশেষ বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। এর সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় প্রথার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং ভোজন ও বিবাহের ক্ষেত্রে বর্ণব্যবস্থা আরও কঠোর হয়। এইভাবে বর্ণ ব্যবস্থা ক্রমশ সামাজিক স্তরভেদের রূপ ধারণ করে।
পঞ্চমত, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর দৃষ্টিকোণ থেকেও বর্ণ থেকে জাতিতে উত্তরণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে কিছু কিছু পণ্ডিত কর্তৃক। খ্রিস্টীয় পঞ্চম ও সপ্তম শতকের মধ্যবর্তী সময়কালে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নগরের অবনতির কারণে সামাজিক ও স্থানগত গতিশীলতা হ্রাস পায়। এর ফলস্বরূপ জাতিপ্রথা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় বলে রামশরণ শর্মা মনে করেন। তাঁর কাছে মনে হয়েছে যে, বংশানুক্রমিক বৃত্তি, সবর্ণ বিবাহ, দূরযাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত থাকার কারণে ওই প্রথা কঠোর হতে থাকে।
[পাঁচ]
বিস্তৃত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গেছে যে গোড়ার দিকে ‘বর্ণ’ ও ‘জাতি’ এই দুটি পৃথক বলে মনে হলেও সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এগুলির মধ্যে পার্থক্য দূরীভূত হয়ে যায়। বস্তুত, আদি-মধ্যযুগের সূচনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বর্ণ ও জাতির মধ্যে প্রভেদ বিনষ্ট হয়। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন যে, বৈদিক যুগ থেকেই শাস্ত্রকাররা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রর সমন্বয়ে চতুর্বর্ণ প্রথার কথা বললেও এটি কোনও যুগে আক্ষরিক অর্থে বাস্তব ছিল না। একটি সামাজিক আদর্শ হিসাবে এই ধারণা বিরাজমান ছিল। আদি-মধ্যযুগে সেটিও বজায় রাখা সম্ভবপর হচ্ছিল না।[৯] এর একটা বড়ো কারণ ছিল সম্ভবত তৎকালীন ধর্ম ভাবনায় বিশেষ করে বৈষ্ণব ও শৈব সম্প্রদায় সমূহের ক্ষেত্রে চতুর্বর্ণ প্রথা খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। তথাপি পূর্ববর্তী যুগগুলির ন্যায় পেশাদার জাতিসমূহের অভাব এযুগেও ছিল না।
বর্ণ বা জাতি, যাই বলি না কেন, গুপ্ত-উত্তর তথা আদি-মধ্যযুগে এর সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য, ‘অনুলোম’ ও ‘প্রতিলোম’ বিবাহের সূত্র ধরে উদ্ভূত মিশ্র জাতির বৃদ্ধির ধারা আদি-মধ্যযুগে বহমান ছিল। ‘যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি’-র টীকাকার বিজ্ঞানেশ্বর বলেছেন যে, আলোচ্য পর্বে মিশ্র জাতির সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে ছিল সীমাহীন। যাদবপ্রকাশের ‘বৈজয়ন্তী’ গ্রন্থে চারটি প্রধান বর্ণ (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র), বারোটি অনুলোম ও প্রতিলোম জাতি এবং তাদের আটচল্লিশটি শাখা-প্রশাখা মিলিয়ে মোট চৌষট্টি জাতির উল্লেখ আছে। সংকরজাতিসমূহকে আবার উত্তম, মধ্যম ও অধম — এই তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
উত্তম সংকর জাতির সংখ্যা হল কুড়ি। এগুলি হল — করণ (লেখক), অম্বষ্ঠ (বৈদ্য, বৃত্তি চিকিৎসা, তত্ত্বের দিক থেকে বৈশ্য), উগ্র (বৃত্তি ক্ষত্রিয়ের, কিন্তু বাস্তবে কৃষিজীবী শূদ্র), মাগধ (সূর্ত বা চারণ বা সংবাদবাহক), গান্ধিক বণিক (যে বণিক গন্ধ দ্রব্যের বিক্রয়ের বৃত্তি গ্রহণ করে), নাপিত, কর্মকার, গোপ, তৈলিক, কুম্ভকার, কাংসকার, শঙ্খকার, দাস (কৃষিজীবী), বারুজীবী (বারুই), মোদক, মালাকার, গায়ক, রাজপুত, তাম্বুলি (তামলি) ও সূত (বৃত্তি অনুল্লেখিত)। ওই গ্রন্থে উল্লেখিত মধ্যম জাতির সংখ্যা বারো। এগুলি হল — স্বর্ণকার, সুবর্ণ বণিক, রজক, আভীর বা আহির (গোয়ালা), তৈলকার, ধীবর, তক্ষণ (খোদাইকার), নট, শেঠন্ডিক, শারাক (সম্ভবত সরাক-এর সঙ্গে অভিন্ন), শেখর ও জালিক। অধম সংকর উপবর্ণের সংখ্যা নয়টি। এগুলি হল — চণ্ডাল, ডোলাবাহী (দুলে), মলেগ্রাহী,মল্ল (মালো), কুড়ব, তক্ষ, চর্মকার ও ঘট্টজীবি (খেয়াঘাটের রক্ষক বা মাঝি)।
আদি-মধ্যযুগেরই অপর একটি গ্রন্থ ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’-এ ওপরের উপবর্ণ বা জাতিগুলির বেশিরভাগেরই উল্লেখ আছে। কিন্তু এতে বিন্যাসের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। উল্লেখ্য, এই গ্রন্থটিতে উত্তম, মধ্যম ও অধম — এই তিনটি সংকর জাতি বা উপবর্ণের পরিবর্তে সৎ শূদ্র ও অসৎ শূদ্র বর্ণের দুটি বিভাজন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, আদি-মধ্যযুগে শুদ্রদের বর্ণ সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। যাই হোক না কেন, সৎ শূদ্র পর্যায়ের জাতিগুলি হল — করণ, অম্বষ্ঠ, বৈদ্য, নাপিত, মোদক, তাম্বুলি, মালাকার, কর্মকার, কুবিন্দক (তাঁতি), কাংসকার, কুম্ভকার প্রভৃতি। অসৎ শূদ্র পর্যায়ের জাতিগুলি হল — তৈলকার, চর্মকার, স্বর্ণকার, কোটক (ঘরামি), মল্ল (মালো), কৈবর্ত, রজক, কসাই, শৌণ্ডিক, পৌণ্ড্রক (পোদ), উগ্র (আগরি/আগুরি) প্রভৃতি। অসৎ শূদ্র পর্যায়ের নিচে অবস্থান করত কিছু জাতি, যথা — চণ্ডাল, ব্যাধ, কোল, হাড়ি, ডোম, জোলা, সাপুড়ে, বাগদি, মলেগ্রাহী প্রভৃতি।
আনুমানিক খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে রচিত ‘বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ’-এ বর্ণের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, বৈশ্য রমণীদের সঙ্গে নিম্নবর্গের মিলনের সূত্র ধরে উদ্ভূত হয়েছে সহস্র মিশ্রবর্ণ। অবশ্য বর্ণগুলির কোনও স্পষ্ট বিবরণ এতে লিপিবদ্ধ হয়নি।
আদি-মধ্যযুগের অসৎ শূদ্র বা অস্পৃশ্যদের সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই যুগের প্রথম দিকের স্মৃতি আইনগ্রন্থগুলিতে বারো রকমের অস্পৃশ্যদের উল্লেখ আছে। এগুলিতে অস্পৃশ্যতা চিহ্নিত হয়েছে গো-ভক্ষক হিসাবে। স্মৃতিগ্রন্থগুলিতে অস্পৃশ্যদের তালিকাভুক্ত যে নামগুলি পাওয়া যায় সেগুলি হল — ভেদ, ভিল, চণ্ডাল, চর্মকার, বরাট, বরুড়, দাস, নট, রজক প্রভৃতি। প্রসঙ্গত বলা যায় আরবি পর্যটক আলবিরুনির বিবরণেও ভধতু, হাড়ি, ডোম, চণ্ডাল প্রভৃতি অস্পৃশ্য জাতির নাম উল্লেখিত হয়েছে।
অসৎ শূদ্র বা অস্পৃশ্যদের ব্যাপকহারে সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ কী, সে বিষয়ে প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক। এ বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়াও কঠিন। আর এস শর্মা অবশ্য এ ব্যাপারে কিছু সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন। তাঁর বক্তব্য হল, বেশিরভাগ অসবর্ণ ছিল অনগ্রসর উপজাতিভুক্ত। হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় তাদের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছিল ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রসার ও হিন্দু ভাবাপন্ন বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের মধ্যে দিয়ে।[৯] যুক্তি হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন যে, বৌদ্ধ চর্যাপদে ডোম, নিষাদ, কাপালিক প্রভৃতির উল্লেখ আছে, যারা বাস করত গ্রামের বাইরে টিলার ওপরে এবং ব্রাহ্মণদের কাছে তারা ছিল অস্পৃশ্য। এমনও হতে পারে এদের মধ্যে কিছু কিছু উপজাতীয় মানুষ এতই অনগ্রসর ছিল যে, হিন্দু সমাজে তাদের সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ সম্ভবপর না হওয়ায় তাদের অস্পৃশ্য বলে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। যেহেতু আদি-মধ্যযুগের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির যথেষ্ট হারে সম্প্রসারণ ঘটেছিল সেহেতু অস্পৃশ্য বর্ণের যথেষ্ট সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছিল — এমন মত প্রদান করেছেন রামশরণ শর্মা। কিছু ক্ষেত্রে আবার বৃত্তি থেকেও বর্ণের উদ্ভব ঘটেছিল। উল্লেখ্য, আলোচ্য সময়ের গ্রন্থাদিতে মিশ্রবর্ণরূপে অভিহিত নাপিত, মোদক, সূত্রকার, চিত্রকার, মালাকার, স্বর্ণকার, তাম্বুলিক প্রভৃতি নিঃসন্দেহে উদ্ভূত হয়েছিল বিভিন্ন বৃত্তি থেকে।
ধর্মীয় বিষয় তথা ধর্মবন্ধনকেও আলোচ্য পর্বে উচ্চ ও নীচ উভয় শ্রেণির হিন্দুদের মধ্যে বড়ো সংখ্যা বৃদ্ধির একটি কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। বিন্ধ্যপর্বতের দক্ষিণাংশের ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এরকম বলা হয়ে থাকে যে আলোচ্য সময়কালে ধর্ম-সম্প্রদায়ের আধিক্য ও বর্ণের সংখ্যা বৃদ্ধি — এই দুয়ের মধ্যে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল এবং প্রথমটি ছিল দ্বিতীয়টির সহায়ক। বস্তুত, এই সময় ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ধর্মীয় আচার, খাদ্য, পোশাক প্রভৃতি গৌণ বিষয় নিয়ে বৌদ্ধ, জৈন, শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের প্রত্যেকটি নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রত্যেকটির নেতৃত্ব দিতেন এক একজন গুরু। এ ব্যাপারে রামশরণ শর্মার সিদ্ধান্ত হল, “ক্রমশ ধর্ম সম্প্রদায়ভুক্ত সভ্যদের আচরণ হয়ে উঠল বর্ণভুক্ত মানুষের মতো। নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁরা হলেন অন্তর্বদ্ধ। অন্য সম্প্রদায়ের সভ্যদের সঙ্গে একসঙ্গে বসতে বা আহারাদি করতেও তারা ধীরে ধীরে অস্বীকার করতে লাগলেন। মধ্যযুগের শেষ দিকে ওই সম্প্রদায়গুলি পূর্ণাঙ্গ বর্ণের রূপ গ্রহণ করে।”[১০] প্রসঙ্গত বলা যায় কর্ণাটকের লিঙ্গায়ত বা বীরশৈবরা এবং উত্তর-ভারতের রাধাস্বামীরা স্বতন্ত্রবর্ণ রূপে আত্মপ্রকাশ করে।
আদি-মধ্যযুগের একটি উল্লেখযোগ্য জাতি হিসাবে আবির্ভাব ঘটে কায়স্থদের। খ্রিস্টীয় নবম শতক থেকেই সাহিত্য ও লেখমালায় কায়স্থদের উল্লেখ দেখা যায়। একাদশ শতকের মধ্যে তারা একটি প্রভাবশালী জাতিতে পরিণত হয়। অনুমিত হয় ঘনঘন ভূমিদান ও ভূমি বিভাগ থেকে উদ্ভব ঘটেছিল কায়স্থদের। উল্লেখ্য, একটি নতুন শিক্ষিত শ্রেণি হিসেবে উদয় হয়েছিল কায়স্থদের। তবে বর্ণ ব্যবস্থায় এই শ্রেণির স্থান এখনও সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়নি। এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।
সুতরাং একটা বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, আদি-মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজে প্রচলিত বর্ণ ব্যবস্থায় যথেষ্ট পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। সর্বাপেক্ষা লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছিল বর্ণের সংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রবর্ণ তথা চতুর্বর্ণ প্রথা। আলোচনা প্রসঙ্গে আরও বোঝা সম্ভব হয়েছে যে, ভারতের তুলনায় আদি-মধ্যযুগে মিশ্রবর্ণ (সংকর জাতি) ও অস্পৃশ্য বর্ণ/জাতিগুলির সংখ্যা দ্রুতগতিতে ও সুবিশাল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
টীকাওসূত্রনির্দেশ:
১) এখানে উল্লেখ করা যায় যে রামশরণ শর্মা ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘সোশ্যাল চেঞ্জেস ইন আর্লি মিডেইভ্যাল ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের সময়কাল নির্দিষ্ট করেছেন ৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ। আবার নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট করেছেন। এরপর ৭৫০ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ ‘আদি মধ্যযুগাভিমুখী’ এবং এরপর থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে ‘আদি মধ্যযুগ’ বলে অভিহিত করেছেন। বলাবাহুল্য, যুগ বিভাগের ক্ষেত্রে পণ্ডিতদের মধ্যে সময়ের এই সাধারণ তারতম্য থাকতেই পারে।
২) এ এল ব্যাশাম, ‘দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া’, কলকাতা, রূপা অ্যান্ড কোম্পানি, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা : ১৪৯-৫০ দ্রষ্টব্য।
৩) নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ‘প্রাচীন ভারতীয় সমাজ’, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ২০০১, পৃষ্ঠা : ২৬-২৭।
৪) নীহাররঞ্জন রায়, ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ (আদিপর্ব), কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, বৈশাখ ১৪০০, পৃষ্ঠা : ২০৯ দ্রষ্টব্য।
৫) ওই, পৃষ্ঠা : ২১০।
৬) রামশরণ শর্মা, ‘পার্সপেক্টিভস ইন সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক হিস্ট্রি অফ আর্লি ইন্ডিয়া’ (অনুবাদ : অঞ্জন গোস্বামী), ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা : ৪০ দ্রষ্টব্য।
৭) ওই।
৮) ওই, পৃষ্ঠা : ৪২-৪৩ দ্রষ্টব্য।
৯) রামশরণ শর্মা, ‘সোশ্যাল চেঞ্জেস ইন আর্লি মিডেইভ্যাল ইন্ডিয়া (আনুমানিক ৫০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ)’, দিল্লি, ১৯৬৯, পৃষ্ঠা : ২৭-৩২ দ্রষ্টব্য।
১০) ওই, পৃষ্ঠা : ৩৩ দ্রষ্টব্য।