সাহাবুদ্দিন
“সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, / রেখেছ বাঙালি করে মানুষ কর নি” — ‘চৈতালি’ কাব্যে (১৩০২ বঙ্গাব্দ) বলা রবীন্দ্রনাথের এ কথাগুলোর বয়স নয় নয় করে শতাব্দী পেরিয়ে গিয়েও কেটে গেল আরও আড়াই দশক। প্রায় একশো তিরিশ বছর পেরিয়ে এসেও রবীন্দ্র-আক্ষেপ কতটা কাটল, অর্থাৎ বাঙালি কতটা মানুষ হয়ে উঠল সে উত্তরের অনুসন্ধান অবশ্য এ আলোচনার অভীষ্ট নয়। তবু কথামুখেই কথাগুলো রাখলাম, কারণ এই আক্ষেপই যেন আজ অন্য সুরে মনকে নাড়া দিয়ে প্রতিনিয়ত বলছে — রেখেছ মুসলমান করে বাঙালি (ভারতীয়) কর নি। অবশ্য, এর বিপরীত ভাষ্য-নির্মাণ করেও বলা যেতে পারে থেকেছ মুসলমান হয়ে ভারতীয় হওনি। কোন্ ভাষ্যটি কতটা সঠিক তা অবশ্যই বিতর্কের বিষয়, এবং তা অবশ্যই আমাদের আলোচনায় আসবে। কিন্তু আজকের ভারতে এ দেশের সিংহভাগ মানুষ যে দুটি সম্প্রদায় (হিন্দু- মুসলমান)-কে ঘিরে, তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের সুস্থিতির স্বার্থেই যে এ দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলমানের পরিচয়-সংকট কাটানো জরুরি তা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না।
বলতে দ্বিধা নেই, কোটি কোটি মুসলমান একই বাংলার মাটি ও জল-হাওয়ায় লালিত হয়েও, একই ভাষা ও কৃষ্টির ফসল হয়েও, শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য এক শ্রেণির বাঙালি হিন্দুর চোখে আজও যেমন রয়ে গেল শুধু মুসলমান হয়ে, তেমনি একই কথা খাটে ভারতের প্রেক্ষিতেও। সেখানেও এই একটি মাত্র সম্প্রদায়ের মানুষ বহু ভারতীয়র চোখে আজও যেন শুধুই মুসলমান।
মুসলমানরাই পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ২০১১-এর আদমশুমারি অনুযায়ী প্রায় ১৮৯ মিলিয়ন (বর্তমানে প্রায় ২১৩ মিলিয়ন) যা ভারতীয় জনসংখ্যার ১৪.৫ শতাংশ (বর্তমানে ১৫.৫ শতাংশ)। এমনকি মুসলমান জনগোষ্ঠী হিসেবে পৃথিবীর সাপেক্ষে এ দেশেই তারা সংখ্যার বিচারে তৃতীয় (সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের ১০.৯ শতাংশ) — ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরেই। অথচ এই বিপুল জনসংখ্যার পরিচয়-সংকট এতটাই তীব্র, ব্যাপ্ত ও বহুমুখী যে তার সুলুকসন্ধান করতে গেলে চক্ষু চড়কগাছ হতে বাধ্য।
আলোচনার শুরুতেই বলে রাখি, ভারত শুধু একটা ভূখণ্ড মাত্র নয়, ভারত একটা ধারণা, একটা দর্শন, একটা আত্মপরিচিতির প্রতিকৃতি। আর সেই আত্মপরিচিতি তথা ভারতীয়ত্বের ভিত্তি এত ঠুনকো নয় যে বহির্বিশ্বের মতাদর্শ ও কৃষ্টির আগমন তার অনিষ্ট করতে পারে; বরং যুগ যুগ ধরে নানান মতাদর্শ ও কৃষ্টির অন্তঃস্রোত (যার জন্ম এ দেশের মাটিতেই হোক কিংবা তা বহির্বিশ্ব থেকে আগত হোক) তাকে আরও পুষ্ট, আরও সমৃদ্ধ করেছে। এই ঐতিহাসিক তথ্য ও সত্যকে উপলব্ধি করেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মপরিচিতি নিয়ে ‘The Religion of Man’-এ বলছেন যে তাঁর পরিবার ছিল ‘হিন্দু মুসলমান ও ব্রিটিশ — এই ত্রিবেণীসঙ্গম’-এর ফলশ্রুতি। সুখের কথা, এ দেশের সিংহভাগ মানুষ আজও ভারতের বহুত্ববাদী, সমন্বিত ঐতিহ্য ও সহাবস্থানের পরম্পরাকেই ভারতীয়ত্বের ভিত্তি বলে মানে। আর মানে বলেই তারা মুসলমানকেও তার স্বকীয় ধর্মীয় পরিচিতির সঙ্গেই ভারতীয় পরিচিতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মান্যতা দেয়। ভারতীয় হিসেবে সবচেয়ে গর্বের এটাই যে বিভেদকামী শক্তি আজও এ দেশে নিছক এক প্রান্তিক শক্তি, বহুত্ববাদী আত্মপরিচিতিতে বিশ্বাসীরাই এখনও এ দেশের মূলস্রোত। তাহলে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের পরিচয়-সংকট নিয়ে এ আলোচনা কেন? কারণ, বিভেদকামী শক্তি কলেবরে যতই ক্ষুদ্র হোক, অভিঘাতে মারাত্মক । মনের গভীর গোপন তলদেশে যুগ যুগ ধরে ঘুণপোকার মতো বাসা বেঁধে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিস্তার করে সামাজিক সুস্থিতি নষ্ট করাই তার কাজ। তাই সে শক্তির মূলোচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত এ চেষ্টা জারি থাকা দরকার।
হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সেই বিভেদকামী শক্তি, যা উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে মানসিক দূরত্ব তথা মনস্তাত্ত্বিক সংঘাতের মূলে, তার ডিএনএ টেস্ট করা মোটেও স্বস্তিদায়ক কাজ নয়। আর এই চূড়ান্ত অস্বস্তিকর কাজটি যেদিন এ দেশে আর করার প্রয়োজন হবে না সেদিনই হবে ভারতীয় হিসেবে সবচেয়ে আনন্দের দিন। কিন্তু এই অযাচিত অথচ (এই সময়ে) অতি প্রয়োজনীয় এই কাজটি করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের একশ্রেণির মানুষের মানসিকতা নিয়ে কিছু কথা বলতেই হবে, যা শুনতে বেশ অপ্রিয়। কিন্তু সত্য অপ্রিয় হলেও সত্যই। তাকে এড়িয়ে না গিয়ে বরং তার মুখোমুখি হয়ে পারস্পরিক সম্পর্কের যুগান্তলালিত অসুস্থতার ওষুধ সন্ধান অনেক বেশি দরকারি। উভয় সম্প্রদায়ের বিভেদকামী মানুষের পারস্পরিক অজ্ঞতা, এবং সেই অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত মনোবিকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর এই ভাষ্য-নির্মাণের প্রচেষ্টায় কাউকে আহত করার বিন্দুমাত্র অভিপ্রায় নেই। বরং আত্মসমালোচনার এই আরোগ্যযাত্রার শরিক হয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণেও এ দেশের দুই মুখ্য সম্প্রদায়ের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন প্রশমিত হলে এ চেষ্টা সার্থক হবে ।
জানি, এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কোনও আলোচনাকে সম্পূর্ণতা দেওয়া সহজ কাজ নয়; সে দাবিও এখানে নেই। বরং এ দেশের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করা এ দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পারস্পরিক নৈকট্যের স্বার্থে লেখাটির পুরোটা পড়ার পর যেকোনও ইতিবাচক পরামর্শ পেলে ঋদ্ধ হব, এবং তখনই এ প্রচেষ্টা পূর্ণতা পাবে।
(১)
কতটা পথ পেরোলে তবে ভারতীয় হওয়া যায়? হাজার বছর ধরে এ দেশের মাটিতে পথ হেঁটে, এ দেশের মাটিকেই আপন সত্তার স্বদেশ ভেবেও এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আজও শেষ হল না ভারতের কোটি কোটি মুসলমানের। জন্মসূত্রে এ দেশে না জন্মেও মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল যিনি জীবনের প্রথম ২৩ বছর তাঁর জন্মভূমি (আয়ারল্যান্ড)-তে কাটানোর পরে স্বজন-পরিজন ছেড়ে মনপ্রাণ ঢেলে এ দেশের মানুষের ভগিনী নিবেদিতা হয়ে উঠলেন, তিনি কি আমাদের চেয়ে কম ভারতীয়? জীবনের প্রথম ১৮টা বছর আলবেনিয়ায় কাটলেও পরবর্তীতে ভারত তথা পৃথিবীর মা হয়ে ওঠা মাদার টেরিজার চেয়ে বেশি ভারতীয় কে? আর একাডেমিক পরিসরে ভারতীয়ত্বকে সঙ্গে নিয়ে ভারততত্ত্ব (Indology) নির্মাণের সর্বপ্রথম কৃতিত্ব যদি কাউকে দিতেই হয় তাহলে তিনিও তো জন্মসূত্রে ভারতীয় নন। মেগাস্থিনিস (খ্রি:পূ: ৩৫০-২৯০)-এর চারখণ্ডের ‘ইন্ডিকা’ আর আল বিরুনি (খ্রি: ৯৭৩-১০৪৮)-র ‘তহকক-ই-হিন্দ’ (‘ভারতের ইতিহাস’)- কে মনে রেখেই বলছি, প্রকৃত অর্থে ভারততত্ত্বের জনক তো উইলিয়াম জোনস আর উইলকিনসন, যাঁদের দেখানো পথ ধরেই ভারততত্ত্বকে বিশ্বের দরবারে কৌলীন্যের নিরিখে হাজির করলেন জার্মান চিন্তাবিদ ম্যাক্স ম্যুলার। ঋগ্বেদকে সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য ভাষায় অনুবাদের কৃতিত্ব তো এই জার্মান সন্তানেরই। এঁদের ক্ষেত্রে যুক্তি দেখানো যেতেই পারে যে একটা দেশের ইতিহাস ও কৃষ্টি নিয়ে গবেষণায় খ্যাতি লাভ করলেই সেই দেশের একজন হয়ে ওঠা যায় না। কিন্তু উপনিষদকে সংস্কৃত থেকে ফারসিতে অনুবাদ করে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেবার প্রথম কৃতিত্ব যাঁর, যাঁর ফারসি অনুবাদ থেকেই উপনিষদের পশ্চিমি ভাষায় অনুবাদের মহার্ঘঞ যাত্রা, সেই শাহজাদা দারাশুকোকে কী বলা হবে? জন্মসূত্রে ভারতীয় হয়েও, ভারতীয় কৃষ্টিকে সত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেও দারাশুকো ও তাঁর উত্তরসূরিরা আজও অনেকের চোখে ভারতীয় নন? তারা নেহাতই বহিরাগত, মুসলমান? তাহলে ভারতভূমির প্রাগার্য জনগোষ্ঠীর কাছে আর্যদের কী পরিচয়? অবশ্য ইদানীং আর্যদেরকেও এদেশীয় প্রমাণ করার অনৈতিহাসিক অপচেষ্টার হাস্যকর হিড়িক দেখা যাচ্ছে ভারতকে হিন্দুভারত (ওরফে হিন্দু পাকিস্তান) বানানোর কারিগরদের মধ্যে। কথায় কথায় দেশীয়-বহিরাগত, হিন্দু-মুসলমান, প্রকৃত ভারতীয়-ছদ্মভারতীয়, দেশপ্রেমী-দেশদ্রোহী — ইত্যাদি নানান পরিচিতির পরিভাষা নিয়ে এখন জেরবার এই একশো তিরিশ কোটির দেশ, যা কিনা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র তথা সেকুলার রাষ্ট্র। ভাবখানা এমন যেন অশিক্ষা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব — এসবের চেয়ে এ দেশে এখন মানুষের, বিশেষত মুসলমানের, পরিচিতিই সবচেয়ে বড়ো সংকট।
ছাত্রজীবনে বন্ধুদের কাছে প্রতিনিয়তই শুনেছি — “তোকে ঠিক মুসলমানদের মতো মনে হয় না”। শুনতে আশ্চর্য লাগবে, আজ মধ্য-চল্লিশের চৌকাঠ পেরিয়েও সেই একই কথা শুনতে হয়, এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত, প্রগতিশীল চিন্তার বাহক হয়ে যাঁরা নানা সভা-সমিতি ও ভাবগম্ভীর আলোচনা-চক্রের আয়োজন করেন তাঁদের মুখেও। এ যুগের বিপণন-মুখী ভোগবাদী (consumerist) দর্শন বলে, একই কথা ক্রমাগত শোনাতে থাকলে মানুষ নাকি সেটাই নিজের অজানতে বিশ্বাস করতে শুরু করে দেয়। এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নিয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা না দেখিয়েই বলছি, মাঝেমাঝেই একই প্রশ্ন শুনতে শুনতে কেন জানি মনে হয় সত্যিই আমি মুসলমান তো? না কি ভারতীয় হিসেবে নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করার বর্ধিত দায় পালন করতে করতে ধর্মীয় পরিচিতি ও তার যাবতীয় কৃষ্টিগত চিহ্নকে লুকিয়ে রাখাটাকেও প্রাত্যহিক যাপনের অঙ্গীভূত করতে হবে? এ দেশের প্রাক্তন বিদেশ তথা আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদকে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়েও কেন লিখতে হয় ‘Visible Muslim Invisible Citizen’-এর মতো গ্রন্থ? একটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শুধু মুসলমানের ধর্মীয় ও কৃষ্টিগত দৃশ্যমানতার সঙ্গে তার ভারতীয়ত্বকে ব্যস্তানুপাতে রাখার এই মনোবিকার আর কতকাল?
যে সমস্ত দৃশ্যমান চিহ্ন অমুসলিম জনগোষ্ঠীর চোখে একজন বাঙালি তথা ভারতীয়কে তার জাতিসত্তার ঊর্ধ্বে মূলত মুসলমান করে তোলে, তা খায় না গায় মাখে জানি না, তবে নিজেকে মনেপ্রাণে বাঙালি তথা ভারতীয় হিসেবে জানতে, দেখতে ও ভাবতে অভ্যস্ত একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে ভাবি মুসলমান মানে কি তাহলে শুধু মাথায় ফেজটুপি, গলায় তাবিজ, মুখে দাড়ি, আর মহিলাদের হিজাব? সত্যি বলতে কী, আজও এ দেশের গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, টিভি কিংবা ওয়েব সিরিজ — সর্বত্র মুসলমান চরিত্র মানেই এইসব চিহ্নের দৃশ্যমানতাকে আবশ্যক হিসেবে হাজির করার হাস্যকর রীতি রয়েছে। যদিও এই চিহ্নগুলিকে বহন করা বা না করা এ দেশের সংবিধান অনুযায়ী একজন স্বাধীন নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয় তথা ধর্মীয় স্বাধীনতার অন্তর্গত, তবু বলব গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, নাটকে লাগাতার এমন ধর্মীয় চিহ্নবাহী চরিত্র দেখে প্রশ্ন জাগে ভারতবর্ষের মতো বৈচিত্রময় দেশে মুসলমানের এমন একমাত্রিক অবয়ব নির্মাণ আদৌ সম্ভব?
মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে শিয়া-সুন্নির চিরায়ত বিরোধ শুধু নয়, সুন্নিদের মধ্যেও রয়েছে হানাফি, মালেকি, সাইফি, হানাবালি, ওয়াহাবি, বারলেভি ইত্যাদি। আবার শিয়াদের মধ্যে রয়েছে বোহরা, খোজা, আহমদিয়া ইত্যাদি। আবার আর্থ-সামাজিক কৌলীন্যের নিরিখে রয়েছে আশরাফ (সেখ, সৈয়দ, পাঠান, মোগল) ও আজলাফ বা আতরাফ (ভারতের হিন্দু সমাজ থেকে আসা ধর্মান্তরিত মুসলমান)। এর সঙ্গে রয়েছে এ দেশের আঞ্চলিক ভাষা ও কৃষ্টির দ্যোতনা, যা একজন বাঙালি মুসলমানকে আলাদা করে একজন উর্দুভাষী মুসলমানের থেকে। মুসলমান হয়েও একজন বাঙালি মুসলমান বরং তার প্রাত্যহিক যাপনে একজন বাঙালি হিন্দুর অনেক কাছাকাছি। এরই প্রত্যক্ষ ফলশ্রুতিতে ধর্মে আলাদা হয়েও ভাষাতে অভিন্ন হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত প্রয়াসে উর্দুসাম্রাজ্যবাদী পাকিস্তানি কৃষ্টি থেকে বেরিয়ে এসে অধুনা বাংলাদেশের জন্ম। এখানেই শেষ নয়, একজন কাশ্মিরি মুসলমান একজন গুজরাটি বোহরা বা খোজা মুসলমানের থেকে তার কৃষ্টি ও যাপনরীতিতে আলাদা, আবার একজন উত্তর ভারতের মুসলমান একজন দক্ষিণ ভারতীয় মুসলমান এক নয়। মজার কথা, মহম্মদ(সঃ) ইসলামে সমস্তরকম শ্রেণিভেদের বিরুদ্ধে ইসলামি সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের কথা বললেও এই সব গোষ্ঠীগুলির অনেকেই অন্য গোষ্ঠীকে প্রকৃত মুসলমান হিসেবে মান্যতা দেয় না। যেমন রক্ষণশীল দেওবন্দিরা আহমদীয়দের মুসলমানই মনে করে না। তাই এ দেশে অমুসলিমদের চোখে মুসলমান পরিচিতির যে হাস্যকর একমাত্রিকতার ছবি তা মূলত অজ্ঞতা ও কল্পনাপ্রসূত।
একমাত্রিক মুসলমান-পরিচিতির যে ভ্রান্ত মিথ, তার বিপ্রতীপ ভাষ্য লিখছেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মুশিরুল হাসান তাঁর অসামান্য গবেষণা-গ্রন্থ ‘Legacy of a Divided Nation’-এ। সেখানে এ দেশের মুসলমানদের সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট বলছেন — “They speak numerous dialects and languages, and observe wide-ranging regional customs and local rites despite the intervention of the Islamists”. তার মানে এ দেশে ইসলামের বহুমাত্রিক যাপন যেমন সত্য, তেমনই সত্য “intervention of the Islamists”। তথাকথিত “islamists”-দের “intervention” এবং কংগ্রেসের অভ্যন্তরের তথাকথিত হিন্দু-ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশের রাজনৈতিক কারসাজিতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভর করে ভারত-ভাগ হয়ে গেলেও শেষ হয়ে যায়নি এ দেশের মুসলমানের বহুমাত্রিক যাপন ও অমুসলমানদের সঙ্গে তার সহাবস্থানের উজ্জ্বল পরম্পরা। তথাকথিত সেকুলার রাজনীতির বাহকদের অপরিণামদর্শিতার ফলশ্রুতিতে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীদের প্রবল উত্থানের মধ্যেও এ দেশের সিংহভাগ মানুষ আজও ভারতের বহুত্ববাদ ও সহাবস্থানের ঐতিহ্যকেই ভারতীয়ত্বের চিহ্ন হিসেবে বিশ্বাস করে। সেখানে মুসলমানের একমাত্রিক পরিচিতির ভ্রান্ত মিথ নেই, নেই তার ধর্মীয় পরিচিতিকে কথায় কথায় সামনে এনে কোণঠাসা করার অপপ্রয়াস।
প্রশ্ন হল, অমুসলিম সহনাগরিকের সঙ্গে সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে এই বহুমাত্রিক ভারতীয় মুসলমানের প্রতিনিধি কে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার বস্তুনিষ্ঠ প্রচেষ্টা থেকেই খাজা আহমেদ আব্বাস লিখছেন এক অনবদ্য লেখনী “মাওলা বখশ ভী এক হিন্দুস্তানি হ্যায়”, যার রেফারেন্স আমরা পাচ্ছি মুশিরুল হাসানের ‘Legacy of a Divided Nation’-এ। সেখানে আহমেদ আব্বাসের বলা কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমাদেরও জিজ্ঞাসা — “… when people discuss India’s Muslims I wonder who are we talking about. Maula Bakhsh?Jinnah and Co.? Or Hakku?”
কে এই মাওলা বখশ? কে এই হাক্কু? দ্বিজাতিতত্ত্বের পরিসর থেকে দূরে সাধারণ ভারতীয়র প্রতিনিধি, যার বাস জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অগণিত খেটে খাওয়া ভারতীয়র মধ্যে। খাজা আহমেদ আব্বাস তাঁকে দেখতে পান সারা ভারত জুড়ে : “Maula Bakhsh, a peasant, lives in Tamil Nadu and speaks Tamil. In Andhra Pradesh he speaks Telegu. In Bengal his language is Bengali.” মুশকিল হল, ধর্মীয় পরিচিতির পোশাক পরিয়ে যখন একমাত্রিক মুসলমানের ভ্রান্ত মিথকে হাজির করা হয় তখন মাওলা বখশ বা হাক্কুর মতো এই শ্রেণির মুসলমান (যারা এ দেশের মুসলমানদের সিংহভাগ)-এর কথা মাথাতেই রাখা হয় না। তাই আহমেদ আব্বাসের আবারও প্রশ্ন — “Do we think of such a Muslim for whom I have invented the name Maula Bakhsh?…Jinnah, Khalikujjaman, Maulana Azad, the Aga Khan, M.C. Chaghla and Raja of Mahmudabad….were Muslims. So were Hakku, the elderly grandmother of our locality. She was a weaver. She prayed five times a day. She was so deeply moved by one of Gandhi’s speeches that after Allah and his Prophet she would repeat the name of the Mahatma. At the age of seventy she stitched her own khadi coffin, because she did not want her body to be wrapped and then buried in a foreign cloth.”
আপন সত্তার সঙ্গে এত গভীরভাবে এ দেশকে মিশিয়ে নেবার পরও এই হাক্কু কিংবা মাওলা বখশ ভারতীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে শুধুই মুসলমান? সুখের কথা, এ দেশের সিংহভাগ অমুসলিম সহনাগরিকের চোখে এরা প্রকৃত অর্থেই ভারতীয়। কিন্তু দুঃখের কথা, আজও পাকিস্তানের পথে হেঁটে এ দেশকে হিন্দু ভারত বানানোর স্বপ্নে বিভোর যারা, যারা তথাকথিত প্যান-ইসলামের প্রতিস্পর্ধী প্যান-হিন্দুতত্ত্বের ধারক, তাদের চোখে শুধু এই হাক্কু কিংবা মাওলা বখশ নয়, প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত, প্রগতিশীল চিন্তার ধারক যেসব মুসলমান তাদের মুখগুলিও ধরা পড়ে না। যারা বহুবিবাহ, তাৎক্ষণিক তিন তালাক, নারীকে অচলায়তনে আবদ্ধ রাখা, ইত্যাদির কথা চিন্তার মধ্যেই আনতে পারেন না, তাঁদেরকে আজও এ দেশের গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, নাটকের চরিত্র হিসেবে বিশেষ তুলে আনা হয় না।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, ইসলামি যাপনের চিহ্নকে সঙ্গে নিয়ে যাঁরা ইসলামি যাপনে অভ্যস্ত অথচ মনেপ্রাণে নিজেদেরকে ভারতীয়র বাইরে কিছু ভাবতেই পারেন না, তাঁদের ভারতীয়ত্ব অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সহনাগরিকের তুলনায় কি নেহাতই ফিকে? আর ফেজটুপি, তাবিজ, দাড়ি, হিজাব কোনোটিই যাঁদের নেই, অথচ যাঁরা একেশ্বরবাদী, অপৌত্তলিক এবং নামাজ-রোজা-জাকাতে অভ্যস্ত, আবার সেইসঙ্গে গান-বাজনা, চলচ্চিত্র, চারুকলা, অভিনয় ইত্যাদিতে থাকেন এবং প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী, সেই অগণিত ভারতীয়কে তাহলে কী বলা হবে? তারা কী তাহলে মুসলমান নয়? তাদের আলাদা করে কেনই বা বলা হবে ভারতীয় মুসলমান কিংবা মুসলমান ভারতীয়? কোনও দিন তো তেমন কাউকে বলতে শুনিনি উনি ভারতীয় শিখ বা শিখ ভারতীয়, ভারতীয় বৌদ্ধ বা বৌদ্ধ ভারতীয় কিংবা খ্রিস্টান ভারতীয়! শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের পাগড়ি, দাড়ি, ও তাঁদের নিজস্ব আঞ্চলিক পোশাক তো তাঁদের ভারতীয় হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি? আবার যাঁরা মাথায় টুপি পরে নামাজ-রোজা-জাকাতে আছেন আবার সংগীতসাধনাতেও আছেন (যেমন ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ কিংবা ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁয়ের মতো ভারতীয়), তাঁদের কী বলা হবে?
আসলে মুসলমানের পরিচয়ের পরিভাষা নির্মাণের দায়িত্ব নিজেরাই নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন অমুসলিম জনগোষ্ঠী। তাঁদের চোখে তারা কখনও “ভালো মুসলমান”, কখনও “খারাপ মুসলমান”, যার সবটাই তাঁদের নিজের মতো করে দেখা। সলমন খুরশিদ তাঁর “Visible Muslim Invisible Citizen”-এ বিষয়টি নিয়ে বলতে গিয়ে ইংরেজি পত্রিকা “Indian Express”-এ প্রকাশিত হর্ষ মান্দারের নিবন্ধ “Minority Space” নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন :
“While the hardliner’s ‘good muslim’ eats only vegetables, chants ‘Bharat Mata ki jai’, is seen nowhere near a cow, and speaks chaste Hindi; the elite left-liberal’s ‘good muslim’ eats biryani, kebabs, recites urdu poetry, and organises ghazal evenings.That is only how far ‘good Muslim’ should express his / her identity.”
একজন মানুষের নৈতিক মতাদর্শ ও প্রাত্যহিক যাপনই তার ভালো-মন্দ পরিচয়ের দ্যোতনা বহন করবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তা তো নীতিগতভাবে সব মানুষের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কিন্তু সেই ভালো-মন্দ হওয়ার শর্তগুলো শুধু একজন মুসলমানের ক্ষেত্রে আলাদা হয়ে যাবে কেন? শুধু তাই নয়, সেই শর্তগুলো আবার এ দেশেরই বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ বিভিন্ন পরিভাষায় নিজেদের মতো করে চাপিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের দেখার চোখ, রুচি ও মর্জি অনুযায়ী একজন মুসলমানের পরিচিতির ভালো-মন্দ ! সত্যি সেলুকাস…!
যদি এই তথাকথিত ভালো-মন্দের পরোয়া না করে এ দেশের সংবিধানকে বিন্দুমাত্র অমান্য না করে নিজস্ব ধর্মীয় চিহ্ন ও পোশাককে সঙ্গে নিয়ে কেউ প্রাত্যহিক যাপনে অভ্যস্ত হন (যেমন, একজন শিখ, একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু, একজন জৈন শ্রমণ, কিংবা নাগা সন্ন্যাসী), তাহলে তাঁদের পরিচিতি নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও, একজন ফেজটুপি কিংবা হিজাবে অভ্যস্ত স্বাধীন ভারতীয় নাগরিক অনেকের চোখেই ‘অতিমাত্রিক মুসলিম’ হয়ে যান। সলমন খুরশিদের প্রাগুক্ত গ্রন্থে ইরিনা আকবরের বলা কথা থেকে নেওয়া উদ্ধৃতিতে তারই প্রতিধ্বনি — “When he/she begins to defend the burka or the topi, let alone wear one, he/she becomes ‘too Muslim’ for comfort.”
আর সেই ‘অতিমাত্রিক মুসলিম’ হওয়ার চিহ্নগুলিকে সরিয়ে রেখে বা নিতান্তই ব্যক্তিগত পরিসরে সেগুলোকে ব্যবহার করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ডাক ইদানীং শোনা যাচ্ছে অনেক রাজনৈতিক নেতার মুখেও। তথাকথিত হিন্দু ভারত গড়ার কারিগরদের প্রবল উত্থানে পাছে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ভোটে টান না পড়ে তাই তথাকথিত সেকুলার দলগুলিও এখন চাইছে মুসলমানরা বেশি বেশি করে মিছিল-মিটিং ভরিয়ে দিক, কিন্তু ফেজটুপি আর হিজাবের মতো মুসলমানি চিহ্নটাকে ঘরে রেখে আসুক। সম্প্রতি উত্তর-ভারতের একজন রাজনৈতিক নেতার এমনই ডাক (“By all means come in large number to our rallies. But don’t come with your skullcaps and burka”) শুনলে তাজ্জব হতে হয়। হর্ষ মান্দার বিষয়টির উল্লেখ করছেন ‘Indian Express’-প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধ ‘Minority Space’-এ, যা স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে মুসলমানদের পরিচয়-সংকট ও রাজনৈতিক অসহায়তা নিয়ে বিতর্কের নানান অভিমুখ উসকে দেয়। আর সেই ধারাবাহিক বিতর্কে অংশ নিয়েছেন এ দেশের অনেক বিশিষ্ট নাগরিক (রামচন্দ্র গুহ, মুকুল কেশভান, অপূর্বানন্দ, সুভাষ পালশিকর, ইরিনা আকবর, সৈয়দ হামিদ প্রমুখ)। সেখানে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ যেকোনও ধর্মীয় পোশাক কিংবা চিহ্নের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করতে গিয়ে বোরখা আর ত্রিশূলকে এক গোত্রে রেখে বলছেন, সেকুলার ভারতে এসব অনাবশ্যক। উদাহরণ হিসেবে তিনি লন্ডনের মেয়র সাদিক খানকে সামনে এনে বলছেন — “Sadique Khan does not wear a skullcap, and his wife does not wear a burkha either… they have identified themselves as being in favour of gender equality as well as cultural diversity”.
কিন্তু পাশ্চাত্যের সেকুলারিজমের ধারণা আর ভারতীয় সেকুলারিজম যে এক নয় তা রামচন্দ্র গুহের মতো উচ্চতর ঐতিহাসিকের অজানা থাকার কথা নয়। এ দেশে ধর্মীয় যাপন ও রীতিনীতি যতক্ষণ কারোর ক্ষতির কারণ না হচ্ছে ততক্ষণ তাতে ভিন্নধর্মাবলম্বী তো বটেই, এমনকি রাষ্ট্রও কোনও প্রকার হস্তক্ষেপ করে না। এটাই এ এদেশের সেকুলারিজমের ভিত্তি। তাই কে বোরখা পরবে আর কে ত্রিশূল ধরবে তা নিয়ে কারোর নাক গলানোকে ভারতীয় সেকুলারিজম বরদাস্ত করে না। সত্যি বলতে কী, এ দেশ তা করছেও না, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শুধু একটি মাত্র সম্প্রদায়ের প্রকাশ্য ধর্ম-যাপন নিয়ে কিছু মানুষের বড্ড বেশি মাথাব্যথা নিয়ে। যখন একজন রাজনীতি-তাড়িত ভারতীয় তথাকথিত হিন্দু ভারত রচনাকে অ্যাজেন্ডা করে মুসলমানদের ধর্মীয় যাপনের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তখন অবাক হওয়ার কিছু দেখি না, কিন্তু যখন তথাকথিত সেকিউলারপন্থীরা এ নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করে বলেন ওগুলো ঘরের ভিতর রেখে এসে পাবলিক মিটিং-এ অংশ নিন, তখন অবাক লাগে বই-কি !
তাই এই বিতর্কে অংশ নিয়ে এই সুবিধাবাদী মানসিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হর্ষ মান্দার বলছেন — “ ‘Emancipation’ cannot be forced upon people with calls for invisibility. Liberalism implies respecting the right of everyone, including a jain monk or a burkha-clad Muslim woman to attend public rally”। অবশ্য তার মানে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে এ আলোচনা বোরখার পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও সওয়াল। ব্যক্তিগতভাবে আজকের পৃথিবীতে বোরখাকে কেউ অনাবশ্যক বলে মনে করতেই পারেন, কিন্তু যতক্ষণ না মনোজগতের অন্দরমহল থেকে এর অপ্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কারোর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া আসবে (যেমন, ইতিমধ্যেই এ দেশের সিংহভাগ মুসলমানের মধ্যে তা এসে গেছে বলেই তারা বোরখা ব্যবহার করেন না) ততক্ষণ তার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারিও তো তালিবানি মানসিকতারই আর এক রূপ।
শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় চিহ্নের দৃশ্যমানতা নিয়ে এই শুচিবাই জন্ম নিচ্ছে, কারণ এক মনস্তাত্ত্বিক চশমার ভিতর দিয়ে সেই সম্প্রদায়ের দিকে তাকানো হচ্ছে। আর সে চশমার নাম বিদ্বেষ, যাকে ঔপনিবেশিক ভারত ব্রিটিশের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী শুধু একবার চোখে পরে নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, প্রয়োজন মতো আজও বাড়িয়ে চলেছে সেই চশমার পাওয়ার। আর এই “metaphor of visibility” নিয়ে মুকুল কেশভান লিখেছেন তাঁর বিতর্কিত গ্রন্থ ‘Looking through Glass’। রামচন্দ্র গুহ যেমন লন্ডনের মেয়রের উদাহরণ টেনে তাঁর ফেজটুপি-বর্জিত সেকুলার চেহারাকে দেখাচ্ছেন, তেমনি মুকুল কেশভান কানাডার প্রখ্যাত শিখ রাজনৈতিক নেতার উদাহরণ এনে তাঁর পাগড়ি-শোভিত চেহারাকে সামনে আনছেন। কিংবা ভারতের ভূতপূর্ব ক্রিকেটার, বর্তমানে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নভজ্যোত সিং সিধুর প্রসঙ্গ টেনে একগুচ্ছ প্রশ্ন তুলে বলছেন — “What progressive purpose is served by asking muslim men to put their skullcaps away? Does being visibility make them less Indian?”
(২)
মুসলমানদের প্রতি এদেশের অমুসলমান সহনাগরিকদের তরফে যে অভিযোগ প্রায়শই ছুড়ে দেওয়া হয় তা হল, তাদের শরীরটা ভারতে থাকলেও মন তথা হৃদয় পড়ে থাকে আরব-ভূমিতে। জন্মভূমিকে পুণ্যভূমি না ভেবে মক্কা-মদিনার মাটিকে পুণ্যভূমি ভাবে যারা তারা আবার ভারতীয় নাকি? এভাবেই মুসলমানদের ভারতীয়ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার একটা অতিসরলীকৃত, অসুস্থ রীতি এ দেশের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভীষণভাবেই চোখে পড়ে। এ যেন অনেকটা মা-বাবার প্রতি ভক্তিনিষ্ঠ সন্তানকে মুর্খের মতো প্রশ্ন করা — “বাবা আর মায়ের মধ্যে একজনকে ছাড়তে হলে কাকে ছাড়বে?” প্রত্যেকটি সম্পর্কই যে নিজের নিজের জায়গায় বিশিষ্টতা নিয়ে আমাদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে, কেউ যে কারোর বিকল্প হতে পারে না, এই সহজ সত্যটা বোঝার জন্য পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই, শুধু দরকার একটা সহজ মন আর একটু সদিচ্ছা। অথচ যাঁদের তরফে এই সদিচ্ছা ও সহজ মনের হদিস পাওয়া যায় না, তাঁরাই আবার অত্যন্ত সহজ মনের অধিকারী হয়ে পড়েন, এবং রীতিমতো আপ্লুত হয়ে অন্য দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখদেরকে তাঁদের জন্মভূমির বাইরে এই ভারতভূমিতেই (যা তাঁদের কাছে জন্মভূমি না হয়েও পুণ্যভূমি) অতিথির মর্যাদায় আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বলা বাহুল্য, এটার মধ্যে অন্যায় কিছু নেই, বরং এটাই স্বাভাবিক, কারণ পৃথিবীর সব ধর্মাবলম্বী মানুষই তাদের নিজস্ব ধর্মমতের উৎপত্তিস্থলকে (তা তাঁদের জন্মভূমি হোক বা না হোক) পুণ্যভূমি মনে করেন। সারাবিশ্বের খ্রিস্টানদের কাছে ভ্যাটিকানের বাইরেও জেরুজালেম পবিত্র স্থান। তার মানে কি তাদের জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসায়, তাদের স্বদেশপ্রেমে ঘাটতি আছে? শুধু তাই নয়, জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাস বা টেম্পল মাউন্ট ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান — তিনটি সেমিটিক ধর্মের মানুষের কাছেই অতি পবিত্র পুণ্যভূমি । সমস্যা কি তাহলে শুধু মুসলমানদের বেলায়? যে সহজ মন নিয়ে দেখলে বিষয়টি নিয়ে কোনও সমস্যাই থাকে না, সেই সহজ মন ও স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর অসামান্য বই “ইসলাম ধর্মের রূপরেখা”-তে বিষয়টির যথার্থ উত্তর দিয়েছেন : “ভারতের বাইরে দূরদেশে বসবাসকারী বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বন্ধুদের হৃদয়ে পবিত্র ভারতের প্রতি — যেখানে করুণাময় গৌতমের চরণধূলি আজও বিদ্যমান — সেইরকমই ভালোবাসা বর্তমান যা ভারতীয় মুসলমানের রয়েছে আরব দেশের প্রতি।”
আসলে মুসলমানদের তথাকথিত আরব-প্রীতি নিয়ে এইসব অযৌক্তিক ও হাস্যকর অভিযোগ করার সময় খেয়াল থাকে না ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় আন্দোলনে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের আত্মত্যাগের কথা, খেয়াল থাকে না যে ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের পর কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ও সক্রিয়তার আগে পর্যন্ত ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মূলত ছিল মুসলমান-নেতৃত্ব, খেয়াল থাকেনা দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে যত স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম খোদিত আছে তার সিংহভাগই (৯৫,৩৩০ জনের মধ্যে ৬১,৯৪৫ জন অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ) মুসলমান, খেয়াল থাকে না আজীবন গান্ধি-অনুগত, এবং জিন্না তথা পাকিস্তান-প্রস্তাব ( যা গান্ধিকে অন্ধকারে রেখে জিন্নার সঙ্গে নেহেরু ও প্যাটেলের পূর্ণ সম্মতিতে মাউন্ট ব্যাটেন বাস্তবায়িত করেন)-বিরোধী, স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্রান্তিকালে একটানা ছ-বছর (১৯৪০-৪৬) জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মৌলানা আজাদের জন্মও খোদ মক্কায়।
এখানেই শেষ নয়। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেও এ দেশের মুসলমানদের পিছু ছাড়ল না বন্দেমাতরম-বিতর্ক, যার এখন নবতর পরিভাষা “ভারত মাতা কি জয়”। দেশকে মাতৃরূপে পূজা করার এই রীতি হিন্দুধর্মের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ হলেও ইসলামের সঙ্গে খাপ খায় না। কারণ, মুসলমানরা একমাত্র নিরাকার ঈশ্বর ছাড়া আর কাউকেই (তা সে জন্মদাত্রী জননীই হোক, আর অন্য কোনও সত্তাই হোক) বন্দনা করে না। তার মানে এই নয় জন্মদায়িনী মা, কিংবা জন্মভূমির প্রতি তাদের ভক্তি বা প্রেমে ঘাটতি আছে। কারণ “বন্দেমাতরম” কিংবা “ভারত মাতা কি জয়” বলে দেশকে মাতৃরূপে পূজা করে দেশপ্রেম প্রকাশের যেমন নাগরিক অধিকার আছে, তেমনি “জয় হিন্দ” কিংবা অন্য কোনও দেশপ্রেম-সূচক শব্দবন্ধ ব্যবহার করেও দেশপ্রেমের প্রকাশ দেখানোর সংবিধান-সঙ্গত অধিকার আছে। এই বিষয়টিরই বাস্তবসম্মত প্রতিফলন ঘটেছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর বহুত্ববাদী চরিত্রে, যেখানে “জয় হিন্দ” ধ্বনি ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ভারতীয়র বীজমন্ত্র। এই বিষয়টি আবারও প্রতিফলিত হল এ দেশের বহুত্ববাদী আত্মপরিচিতির দ্যোতক হিসেবে “জনগণমন”-কে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণের মধ্য দিয়ে। তাছাড়া, দেশপ্রেমের বঙ্কিমি পরিভাষা (“বন্দেমাতরম”) নির্মাণের আগে পর্যন্ত কি ভারতীয়র দেশপ্রেম তথা আত্মপরিচিতির কোনও পরিভাষা ছিল না? নেহাত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃপূজার আদলে নির্মিত দেশপ্রেমের পরিভাষা মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে মুসলমান পরিচিতিকে অভারতীয় বলে প্রতিপন্ন করার এই মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত আর কতকাল?
আরও একটা অভিযোগে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ দেশভাগ-উত্তর মুসলমান সমাজ ও তাদের ভারতীয় পরিচিতি। তা হল, মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি নাকি সব মিনি পাকিস্তান আর সেই অঞ্চলের মুসলমানরা আসলে ভারতের মধ্যেই এক একটা মিনি পাকিস্তানের নাগরিক। সেখানে নাকি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে (ভারত-পাক ক্রিকেট ম্যাচেও) পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে। প্রথমেই বলে রাখি এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে দেশদ্রোহিতার আইন মোতাবেক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু এমন কত শতাংশ ক্ষেত্রে এই লজ্জাজনক ঘটনা ঘটছে তা না দেখে সমগ্র মুসলমান জনগোষ্ঠীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর এই প্রবণতা দেশের পক্ষে কতটা কল্যাণকর তা বোধহয় দেশপ্রেমিক হিসেবে সবার মনে রাখা উচিত। সাধারণীকরণের এই অসুস্থ প্রবণতা অসংখ্য মুসলমান সহনাগরিক, যাঁরা নিজেদেরকে মনেপ্রাণে ভারতীয় ভাবেন, তাঁদের ওপর কতটা মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত আনতে পারে তা ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করি। এ যেন অনেকটা তাৎক্ষণিক তিন তালাক (যার সমর্থন কোরানের কোথাও নেই)-কে এ দেশের প্রায় ১৯ কোটি মুসলমানের যাপনের অঙ্গ ভাবার মতই সাধারণীকণের অসুস্থ প্রবণতা। তবু বলব,এই ধরনের পাকিস্তান-প্রীতির অভিযোগ যে সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ওঠে সেই সম্প্রদায়ের দায় এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। কারণ, ভারত-পাক সম্পর্কের চাপা টেনশন যখন দুই দেশের মধ্যের প্রাত্যহিক বিষয়, তখন যে সম্প্রদায়ের কতিপয় মানুষের সঙ্গে ধর্মের ভিত্তিতে ক্ষমতার বাঁটোয়ারায় দেশভাগের মতো বিষফোঁড়ার যন্ত্রণা আজও আমাদের নিত্য সঙ্গী, সেই সম্প্রদায়ের তরফে বিক্ষিপ্তভাবেই বা তেমন ঘটনা ঘটবে কেন, যাতে পাকিস্তান-প্রীতির মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ ওঠে? এই ধরনের বিষয় যতই অল্প হোক, ভারতীয় মানসে তার মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত মারাত্মক হতে বাধ্য। অবিশ্বাসের বীজ বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকেই রোপিত হয়। এতে সবচেয়ে ক্ষতিটা হয় তাদের, যারা এমন অঘটনের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও শুধু মুসলমান পরিচিতির জন্য সংখ্যাগুরুর অবিশ্বাসের শিকার হয়। একবার সন্দেহের পাত্র হয়ে গেলে সন্দেহ যে তার পিছু ছাড়ে না, তা তো মনস্তত্ত্বের গোড়ার কথা। তাই অবিশ্বাসের শিকার এই ধর্মীয় (মুসলমান) পরিচিতির প্রতি সন্দেহের সংক্রমণ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের তরফে শুধু রক্ষণশীলদের মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ থাকে না, তা ছড়িয়ে পড়ে বাকিদের মধ্যেও।
আসলে সমস্যা যে শুধু রাজনৈতিক নয়, তা যে মনস্তাত্ত্বিক তা নানানভাবে নানান অনুষঙ্গে বেরিয়ে আসে। রক্ষণশীল অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির কারবারিরাই কি শুধু মুসলিম-ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলেন? তাঁরা যে চলবেন সেটাই তো স্বাভাবিক, কারণ এটা তাঁদের ঘোষিত নীতি। মুসলমানি চিহ্ন, মুসলমানি কৃষ্টি তাঁদের কাছে শুধু অভারতীয়ই নয়, কারোর কারোর কাছে তা রীতিমতো দৃশ্যদূষণ, আবার অনেকের কাছে সাংস্কৃতিক দূষণ। কিন্তু যাঁরা কথায় কথায় সেকুলার তথা প্রগতির ধারক বলে নিজেদের দাবি করতে ছাড়েন না, তাঁরা তাঁদের সমমানসিকতার মুসলমান সহনাগরিককে বাড়ি ভাড়া দিতে, জমি কিংবা বাসস্থান বিক্রি করতে গিয়ে ঢোক গেলেন না কি? অথচ সমাজের প্রায় সর্বস্তরেই শোনা যায় মুসলমানরা নাকি নিজেদের এঁদো গলির মধ্যযুগীয় “ঘেঁটো” থেকে বেরোতে চায় না। কিন্তু বেরিয়ে আসতে চাইলে তাকে গ্রহণ করছে কে? দারিদ্র্য ও অশিক্ষা অবশ্যই এর নেপথ্যের একটা কারণ, কিন্তু সেটা এ দেশের বহু অমুসলিম জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও তো প্রযোজ্য, এবং তার দায় সংশ্লিষ্ট সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রও এড়িয়ে যেতে পারে না। কিন্তু যাঁরা দারিদ্র্য ও অশিক্ষাকে জয় করে তথাকথিত মুসলিম “ঘেঁটো” থেকে বেরিয়ে আসতে চান তাঁদের কি কাছে টেনে নিচ্ছে একুশ শতকের ডিজিটাল ভারতের প্রগতিশীল সমাজ? এ নিয়ে রীতিমতো উদাহরণ তুলে ধরে ইরিনা আকরের স্পষ্ট আক্ষেপ :
“Actor Imran Hasmi, hardly the stereotypical Muslim, was denied a flat in Mumbai because he is Muslim. Muslims don’t choose to live in ghettoes, which are ‘medievalist’ because the authorities deny them proper civic amenities”.
ইমরান হাসমির মতো সেলিব্রিটির যদি এই হাল হয়, তাহলে সাধারণের কথা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। যাঁরা এগুলিকে নেহাত বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দায় এড়াতে চান, তাঁদের জ্ঞাতার্থে সবিনয়ে জানাই অসংখ্য সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও এটা প্রত্যক্ষ ও নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতা। না, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, কিংবা মহারাষ্ট্র নয় আমাদের এই রাজ্যে যেখানে স্বাধীনতার পর দীর্ঘ চার দশক ধরে বামপন্থী শাসন চলেছে সেখানেও ছবিটা বিশেষ আলাদা কিছু নয়। খোদ দক্ষিণ কলকাতায় যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কথায় কথায় প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ আন্দোলনে নামে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই বহু মুসলমান ছাত্র, গবেষক সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে উপযুক্ত বাসস্থান না পেয়ে বাধ্য হন পার্কসার্কাস, মেটিয়াবুরজ, তোপসিয়া, এন্টালি, খিদিরপুরের মুসলিম-অধ্যুষিত তথাকথিত “ঘেঁটো”তেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথা গুঁজতে। এমনকি, মফসসলেও ছবিটা আলাদা নয়। তথাকথিত মধ্যযুগীয় মুসলিম “ঘেঁটো” নিয়ে এক-একটা মুসলিম এলাকা মুসলমান পরিচিতি নিয়ে (না কি নিয়ে চলতে বাধ্য হয়ে?) তথাকথিত প্রগতিশীল পরিচিতির ঝাঁ-চকচকে অট্টালিকার চড়া আলোর পাশে কেরোসিন-শিখার মতো টিমটিম করছে বছরের-পর-বছর।এদেরকে মধ্যযুগীয় মুসলিম “ঘেঁটো” না বলে বোধহয় আধুনিক বস্তি বলাই ভালো। যেন এরা ভারতীয় সমাজের তথাকথিত প্রগতির antithesis ।
মুসলমানি পরিচিতি ও যাপনরীতির প্রতি তথাকথিত প্রগতিশীলদের একুশ-শতকীয় বিরূপতার মনস্তাত্ত্বিক শিকড় যে কত গভীরে প্রোথিত তার নজির বস্তি থেকে অট্টালিকা সর্বত্র। এ নিয়ে নিয়াজ ফারুকি ফারহা নাকভী, নাজিয়া এরাম প্রমুখ তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিংড়ে দিয়েছেন তাঁদের অসামান্য লেখনীতে। ফারহা নাকভির ‘Working With Muslims’ এবং নাজিয়া এরামের ‘Mothering a Muslim’ তো এক্ষেত্রে যেকোনও পাঠকের জন্য দিগদর্শন। আর যাঁরা একটু গবেষণা-ধর্মী একাডেমিক আগ্রহ নিয়ে পড়তে চান তাঁদের জন্য নিয়াজ ফারুকির ‘An Ordinary Man’s Guide to Radicalism : Growing up Muslim in India’ এক মর্মান্তিক দলিল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, গবেষক থেকে শুরু করে সমাজের তথাকথিত প্রগতিশীল চিন্তকরাও এখন ভাবছেন মুসলমানত্ব নিয়ে। অনেকের কাছে তো ইতিমধ্যেই তা ইসলামোফোবিয়া। এ নিয়ে কটাক্ষ, কটূক্তির শেষ নেই, কিন্তু মুসলিম সমাজের অভ্যন্তর থেকে কেউ এই সমাজের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাগুলি দূর করার লক্ষ্যে এগিয়ে এসে কোনও সামাজিক-সাংস্কৃতিক উদ্যোগ নিলে সেটাকেও অনেকে সন্দেহের চোখে দেখেন। অনেকে তাকে সাম্প্রদায়িক ক্রিয়াকলাপ হিসেবে দেগে দিতেও ছাড়েন না। রামমোহন, বিদ্যাসাগর কি হিন্দু সমাজের সংস্কার করেছিলেন সাম্প্রদায়িক ছিলেন বলে? চূড়ান্ত সদিচ্ছা ও প্রত্যাশা নিয়ে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের তথাকথিত প্রগতিশীলদের হাতে এ বিষয়ে নেওয়া কর্মসূচি-সংক্রান্ত প্রচার-পুস্তিকা বা পত্র-পত্রিকা তুলে দিলে অনেকে তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন কারণ তাতে মুসলিম-গন্ধ লেগে আছে। আবার অনেকে চক্ষুলজ্জার খাতিরে তা গ্রহণ করলেও কোনও দিন পাতা উলটেও দেখেন না। ভাবখানা এমন যে এই পিছিয়ে থাকা মুসলমানরা আবার কী এমন লিখেছে যে তা পড়ে সময় নষ্ট করতে হবে! কেউ কেউ আবার পত্রিকার কোনও এক সংখ্যায় লেখা দিয়ে ধন্য করলেও পরবর্তী সংখ্যাকে নানান অছিলায় এড়িয়ে চলেন। আর পত্রিকা উদ্বোধনে আমন্ত্রিত হলে তাঁদের উপস্থিতি নৈব নৈব চ। কেউ কেউ তো আবার আর এক কদম এগিয়ে এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বানচাল করতে নিছক সন্দেহের বশে এদের বিরুদ্ধে সমাজ-মাধ্যমে কুৎসা ছড়িয়ে এক প্রতি-সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস সৃষ্টিতেও পিছপা হন না। অবশ্য ব্যতিক্রমকে শ্রদ্ধা জানাতেই হবে, শ্রদ্ধা জানাতে হবে সেইসব অমুসলিম সহৃদয় ব্যক্তিদেরকে, যাঁরা এই অসুস্থ মনস্তত্ত্ব থেকে দূরে, এবং এই সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসেন।
মজার কথা এটাই যে সাংবিধানিক নীতিনয়ম লঙ্ঘন না করেও এই একটিমাত্র সম্প্রদায়ের স্বাধীন যাপনরীতি তাঁদেরই সহগরিকদের দৃষ্টিতে ভারতীয়ত্বের ঊর্ধ্বে শুধুমাত্র মুসলমানত্বের চিহ্ন হয়ে উঠলেও মুসলমানদের কাছ থেকে পাওয়া খ্যাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ভাষা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সংগীত, চিত্রকলা ইত্যাদি যেগুলি নিজেদের প্রাত্যহিক যাপনে আত্মীকৃত হয়ে গেছে (জেনে বা না জেনে) সেগুলি নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠে না। রীতিমতো শেরওয়ানি কিংবা সালোয়ারে সুশোভিত হয়ে ইরানি সুগন্ধি ছড়িয়ে সুস্বাদু মোগলাই কিংবা বিরিয়ানি-কাবাব খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বহু ভারতীয়কে বলতে শুনি — “যাই বলুন দাদা, এই মুসলমানগুলোকে ঠিক নেওয়া যায় না”। ভারতীয় সংস্কৃতির নির্মাণ-বিনির্মাণের আবহমানতা নিয়ে অজ্ঞতা কতটা শিখরস্পর্শী হলে নিজের অজান্তে নিজেরই অস্থি-মজ্জা-ধমনির সঙ্গে মিশে যাওয়া মুসলমানি কৃষ্টিকে এমন অস্বীকারের মূঢ়তা দেখা যায়!
যে সহনাগরিক বেনারসে সন্ধ্যারতির সময় বিসমিল্লা খাঁর সানাই শুনে মোহিত হচ্ছেন, কিংবা বড়ে গোলাম আলির কন্ঠজাদুতে সরস্বতী বা শিবস্তোত্র শুনে আত্মমগ্ন হয়ে পড়ছেন, সেই বিশিষ্ট সহনাগরিকেরও মুসলমানদের সম্পর্কে বিরূপ কথা বলার সময় সেসব খেয়াল থাকে না। খেয়াল থাকে না শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে এ দেশে যত গীতিকবিতা ও ভজন লেখা হয়েছে রাম এবং কৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে তার একটা বিরাট অংশ মুসলমান কবিদের লেখা। কাজী নজরুল ইসলামের রচিত শ্যামা সংগীতের উচ্চতা বাংলায় আর কোনও শ্যামা-সংগীত লেখক ছুঁতে পেরেছেন? আর বাংলার বাইরে ভজন তথা ভক্তিগীতি রচয়িতা সালবেগ, বেকাল, নাইদা ফাজিল — এঁদের কথা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয় যখন মুসলমানদের সম্পর্কে নানান অতিসরলীকৃত ও অপমানসূচক মন্তব্য করা হয়। এমনকি, খেয়াল থাকে না যার সামনে বসে এমন বিষোদ্গার করা হচ্ছে হয়তো তিনিও একজন মুসলমান। হঠাৎই তা খেয়াল হয় যখন, তখন তো তূণ থেকে তির বেরিয়ে গেছে। তাই বেশ একটু অপ্রস্তুত হয়েই আবার ড্যামেজ কন্ট্রোলের ভঙ্গিতে বলতে হয় — “না মানে ইয়ে আর কী… দেখুন ব্যতিক্রম আছেই, তা না হলে কী আর জগৎ চলে? এই দেখুন না আপনাকে দেখে কে বলবে আপনি মুসলমান?” হায়রে মুসলমানত্ব !
(৩)
সত্যি কথা বলতে কী, ইসলামকে শিখণ্ডী করে পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য জঙ্গিগোষ্টী। সরাসরি ধর্মকে হাতিয়ার করে জঙ্গিপনার এমন নজির আর কোনও ধর্মের ক্ষেত্রে সেভাবে দেখা যায় না। কিন্তু সেই সব জঙ্গিগোষ্টী মিলে সারা বিশ্বের মুসলমান জনসংখ্যার কত শতাংশ হবে? কত শতাংশ মুসলমান সেই ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসকে সমর্থন করেন? বরং ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃত জেহাদের যে স্বরূপ (অন্তরের পাশবিক বৃত্তি তথা বাইরের অন্যায় ও অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ), তা থেকে সহস্র যোজন দূরে এই নারকীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই তাঁরা সরব। অথচ সেই জঙ্গিবাদের খাঁচাবন্দি হয়ে তারই কদর্য ধাঁচে সহনাগরিকের দৃষ্টিতে বাঁধা পড়ছে মুসলমানত্ব। কোটি কোটি মুসলমান, যাঁরা এই নারকীয় জেহাদি জঙ্গিপনাকে শুধু ইসলামের বিকৃতিই নয়, সেইসঙ্গে মনে করেন ইসলাম-বিরোধী, সেই সিংহভাগ মুসলমান আজ শুধুই ব্যতিক্রমের দলে! একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মূলস্রোতকে ব্যতিক্রম আর ব্যতিক্রমকে মূলস্রোত ভাবার এই মনোবিকার মনে করায় শেক্সপিয়াররে ‘ম্যকবেথ’ নাটকের সেই বিখ্যাত উক্তি — “Fair is foul and foul is fair”, যার মধ্যে নিহিত নৈতিক স্খলন তথা আসন্ন ট্র্যাজেডির অমোঘ ইশারা।
মুসলমান-বিদ্বেষী সহনাগরিকের চেতনস্তরে মুসলমান মানেই আজকাল তালিবান, আইসিস, বোকোহারাম, লস্কর-ই-তৈবা, হিজবুল, মুজাহিদিন ইত্যাদি নানান জঙ্গিগোষ্ঠীর দ্যোতনা। আর অবচেতনে মুসলমান মানেই এক ভয়ংকর, কিম্ভূতকিমাকার বড়ো অচেনা ও অযাচিত কিছু একটা। চেতনস্তরের অভিব্যক্তি আসলে সহনাগরিকের অবচেতনের অবয়বকেই হাজির করে, যাকে হয়তো নানান সামাজিক অনুষঙ্গ, তথাকথিত ভদ্রতা ও শিষ্টাচার কোনও ক্রমে ঢেকে রাখে।একটু সুযোগ পেলেই সে বেরিয়ে পড়ে নিজের আসল চেহারা নিয়ে। আর যদি সেখানে একটু রাজনৈতিক মদত তথা অনুকূল পরিসর পাওয়া যায় (যেমন মাঝেমধ্যেই স্বাধীনতা-উত্তর সেকিউলার ভারতে হিন্দুত্ব আর ভারতীয়ত্বকে সমার্থক ভেবে হিন্দু ভারত তৈরির তোড়জোড় চলে) তাহলে তো কথাই নেই। রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে মুসলমানদের ওপর আরোপিত অপরত্বের ধারণা সেঁটে দিয়ে তাদেরই কাছ থেকে নেওয়া নানান কৃষ্টিগত রেসিপিতে পুষ্ট হয়ে নিজেই নিজেকে অস্বীকারের এই আত্মধ্বংসী প্রবণতা আর কতকাল?
যুগ যুগ ধরে নানান সংস্কৃতির সম্মিলিত স্রোতে পুষ্ট ভারতীয়ত্বের যে অবয়ব নির্মিত, তাতে মুসলমানি কৃষ্টিও যে এক অনন্য ও অবিচ্ছেদ্য ধারা সে সম্পর্কে না জানা, অথবা জেনেও বালিয়াড়িতে মুখ গুঁজে ঝড় অস্বীকারের ধৃষ্টতা নিয়ে তথাকথিত হিন্দু ভারত তৈরির এই অভিযাত্রায় কখন যেন নিজের পাশের বন্ধুটিই শামিল হয়ে পড়েন তা দেখে বন্ধু থেকে হঠাৎ সহনাগরিক (না কি শুধুই মুসলমান?) হয়ে যাওয়া মানুষটি যে বড়ই অসহায়! যেন এক ভ্রাম্যমাণ একাকিত্বের ধারক হয়ে পথ হাঁটতে হাঁটতে সে তখন ভাবতে থাকে — আর পাঁচজন সাধারণ ভারতীয়র থেকে সে কি তাহলে আলাদা? দ্বিজাতিতত্ত্ব তথা দেশভাগ-বিরোধী মৌলানা আজাদ, আব্দুল গফফার খান, কিংবা শহিদ আসফাকুল্লা খান, কিংবা আজাদ-হিন্দ বাহিনীর আবিদ হাসান বা শাহনাওয়াজ খানের উত্তরাধিকার বহনের গর্ব নিয়ে যতই নিজেকে মনেপ্রাণে ভারতীয় ভেবে সে পথ হাঁটুক, তার জন্য বরাদ্দ পরিচয় “মুসলমান ভারতীয়”, কিংবা “ভারতীয় মুসলমান” অথবা শুধুই “মুসলমান”। আর যদি আর একটু অনুকম্পা হয় তাহলে তাকে চিহ্নিত করা হবে “প্রগতিশীল মুসলমান”, ”সাংস্কৃতিক মুসলমান” কিংবা নিদেনপক্ষে “ভালো মুসলমান” ইত্যাদি সব বাছাই করা শব্দবন্ধে। অর্থাৎ সে যেমনই হোক, মুসলমান পরিচিতিকে এড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি, একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রীর কৃতিত্বে শিলমোহর দেওয়ার সময়েও অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা-কর্মকর্তার মুখ থেকে সচেতনভাবে বা অবচেতনে বেরিয়ে আসে তার মুসলমান পরিচিতি। মুসলিম লেখক, মুসলিম পাঠক, মুসলিম বুদ্ধিজীবী, মুসলিম স্থপতি, মুসলিম চিত্রশিল্পী ইত্যাদি শুনতে শুনতে কান পচে গেল। মেধা-ও যে হিন্দু-মুসলমান হতে পারে এ দেশের অনেকই তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন।
দু-জন সহনাগরিকের স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ কথোপকথনের মধ্যে হামেশাই শোনা যায় একজন কথার ফাঁকে হঠাৎ করেই অনাবশ্যকভাবে আরেকজনকে বলে ফেলছেন — “যার কথা বলছি তিনিও মুসলিম, আপনাদেরই স্ব-জাতি”। হায়রে “স্ব-জাতি”! কী আষ্টেপৃষ্ঠেই না জড়িয়ে আছো তুমি অমুসলিম সহনাগরিকের অবচেতনে! যিনি স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ কথোপকথনের মাঝখানে এমন কথা অনায়াসেই বলে ফেলেন, তিনি হয়তো অনেক সময় অত কিছু ভেবে বলছেন না, তাঁর কাছে হয়তো এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু যাঁকে বলা হচ্ছে তাঁর কাছে এই অযাচিত শব্দবন্ধ শুধু অনাবশ্যকই নয়, তার মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত যে কী সাংঘাতিক, তা যিনি তা বলছেন তিনি বুঝবেন না। যদি বুঝতেন তাহলে হয়তো এ দেশে মুসলমানকে অনাবশ্যকভাবে এমন আলাদা ভাবার মনোবিকার অনেকটাই দূর হত। কারণ, এই ছোটো ছোটো বিষয়গুলিই অবচেতনে ঘুমিয়ে থাকে বড়ো বড়ো ব্যাপারের নেপথ্য-কারণ হয়ে।
মহম্মদ রফির অসামান্য গায়কিতে অনন্য সব গান শুনতে শুনতে কিংবা শাহরুখ-সলমন-আমির-ইরফান খানদের অভিনয় দেখতে দেখতে, কিংবা আব্দুল কালামের মিসাইল প্রযুক্তির উৎকর্ষ নিয়ে ভাবতে ভাবতে কারোর মনে তাঁদের মুসলমান পরিচিতি এভাবে ভেসে ওঠে কি? এঁদের মেধা ও সৃজনের ওপর তো কেউ তাঁদের মুসলমান পরিচিতির রাবার ষ্ট্যাম্প সাঁটতে পারেনি! জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ দেশেরই কোটি কোটি মানুষ পরম আদরে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাঁদের প্রতিভাকে। ইউসুফ খানকে যে সময়ে নাম নিতে হয়েছে দিলীপ কুমার,হতখন তো দেশভাগ-পরবর্তী টালমাটাল সময়। কিন্তু আজও কেন ইমরান হাসমি মুম্বইয়ে তাঁর পছন্দসই এলাকাতে বাসস্থান পাবেন না? অর্থাৎ গ্রহণ-বর্জন সবটার পিছনে কদর্য রাজনীতি যেমন আছে, তেমনি তার শিকড় প্রোথিত অসুস্থ মনস্তত্ত্বে, যাকে আজও উপড়ে ফেলা যায়নি।
তাই অমুসলিম ভারতীয় নারীকে বিবাহ করার দায়ে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও মুসলমান পুরুষকে শিকার হতে হয় তথাকথিত ‘লাভ জিহাদ’-এর। শুধু হিন্দু ভারত রচনার কারিগরদের হাতে নয়, রীতিমতো আদালতের রায়েও প্রাপ্তবয়স্ক দু-জন নরনারীর বিবাহ যখন ‘লাভ জিহাদ’-এর নামে অবৈধ ঘোষিত হয়, তখন মনে পড়ে ‘গরম হাওয়া’ (১৯৭৪) সিনেমার সেই হতভাগ্য চরিত্র সেলিম মির্জার কথা, যে কালান্তক দেশভাগের পর পাকিস্তান না গিয়ে কোটি কোটি মুসলমানের মতো ভারতকেই তার সত্তার স্বদেশ জ্ঞান করে সর্বস্ব খুইয়েও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতের শ্রমজীবী জনজীবনের মূলস্রোতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থেকে যাওয়া ছাড়া অন্যকিছু ভাবতেই পারে না। আর তথাকথিত গো-রক্ষকদের হাতে নির্যাতিত মহম্মদ আখলাখের মতো মুসলমানদের করুণ পরিণতি দেখলে মনে পড়ে শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পে একাধারে গফুরের তরফে পুত্র-স্নেহে গোপালন আর হিন্দু জমিদারের প্রবল প্রতাপে সেই গোরুর অভুক্ত থাকার মর্মস্পর্শী ছবি। কিন্তু “Truth is stranger than fiction” — কাহিনির চেয়ে সত্য আমাদের আরও বেশি আশ্চর্য করবে সেটাই স্বভাবিক।
সলমন খুরশিদের লেখা গ্রন্থ ‘Visible Muslim Invisible Citizen’-এর কথা আগেই বলেছি, কিন্তু যেটা বলিনি তা হল, এই অসামান্য বইটির একটি উপ-শিরোনাম (sub-title)-ও আছে। সেটি হল ‘Understanding Islam in Indian Democracy’, প্রমাণ করে এ দেশে মুসলমানদের সম্পর্কে জানতে, বুঝতে এবং তাদেরকে প্রকৃত ভারতীয়ত্বের বোধ নিয়ে কাছে টানতে এ দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হিন্দুদেরকে এখনও অনেক পথ হাঁটতে হবে। কতকাল সে হাঁটা চলবে জানি না, কিন্তু যেটা নিশ্চিত জানি তা হল, সে হাঁটার পথে পরস্পরকে বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দায় সবচেয়ে বেশি। তার মানে কি সংখ্যালঘু হলেই সাতখুন মাফ? তাদের তরফে কোনও দায় নেই? অতিবড় আহাম্মকও সে দায় অস্বীকার করতে পারে না। এবং সে প্রসঙ্গে অবশ্যই আসব। কিন্তু আপাতত দেখা যাক সংখ্যাগরিষ্ঠ তার দায় কীভাবে নিয়েছে।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন তাঁর ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ (১৯২৩)-এ, নেতাজি সুভাষ তাঁর রাজনৈতিক যাপন ও সিদ্ধান্তে (বিশেষত অন্তর্ধান-পরবর্তী জীবনে এবং আজাদ-হিন্দ বাহিনীতে) সংখ্যাগুরুর তরফে যে বর্ধিত দায়ের বাস্তবসম্মত প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন তার নজির আজকের ভারতে কোথায়? দেশের অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে মনোভাব, তা মুসলমানদের প্রতি তাদের মনোভাব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বলা বাহুল্য, মনোভাবের এই দ্বিচারিতাতেই নিহিত বাঙালি তথা ভারতীয় মুসলমানের পরিচয়-সংকট। আর সেই সংকটে নতুনতর মাত্রা এনেছে এ দেশের রাজনৈতিক চালচিত্র, যেখানে মুসলমান জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্রে রেখে চলছে একদিকে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীদের তরফে ‘হিন্দু ভারত’ তৈরির রাজনীতি, অন্যদিকে তথাকথিত সেকিউলার দলগুলির সেকিউলার ভারতকে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা। অবশ্য তথাকথিত সেকিউলারপন্থীদের চেষ্টার পিছনেও কাজ করে ভোটব্যাংক অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সখংখ্যালঘু-তোষণের আর এক রাজনীতি। এই দ্বিমুখী রাজনীতির টানাপোড়েনের জটিল আবর্তে সাম্প্রতিকতম সংযোজন সিএএ এবং এনআরসি, যা মুসলমানদের মধ্যে তাদের পরিচয়-সংকটের চিন্তাকে প্রত্যক্ষ বিপন্নতায় পর্যবসিত করেছে। ইতিমধ্যে অনেকে আত্মহত্যাতেও মুক্তি খুঁজেছেন।
সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে গত আড়াই বছর ধরে অনেক চর্চা হয়েছে, এবং হচ্ছে। সে আলোচনা বৃহত্তর পরিসর দাবি করে। ভিন্ন পরিসরে সে আলোচনার ইচ্ছে জিইয়ে রেখে এ আলোচনায় ইচ্ছাকৃতভাবেই দৃষ্টি রাখছি মুসলমানদের পরিচয়-সংকটের মূলত মনস্তাত্ত্বিক দিকটিতে। বলতে দ্বিধা নেই, এই মনস্তাত্ত্বিক সংকটের অন্যান্য আনুষঙ্গিক কিছু কারণ থাকলেও এর শিকড় মূলত ধর্ম ও কৃষ্টির পার্থক্যের মধ্যেই। সে পার্থক্য প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারতে থাকলেও তা এত বিষময় ছিল না। পার্থক্যকে সঙ্গে নিয়েই ছিল সহাবস্থানেরও ঐতিহ্য। ‘কালান্তর’-এ সেকালের এই দ্বন্দ্ব ও সহাবস্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন :
“মধ্যযুগে মুসলমান রাজশক্তির সঙ্গে হিন্দুদের ধর্মবিরোধ ঘটেছিল। সেই সময় ধারাবাহিকভাবে সাধুসাধকদের জন্ম হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকে মুসলমান ছিলেন, যাঁরা আত্মীয়তার সত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন করতে বসেছিলেন। তাঁরা পোলিটিশান ছিলেন না, প্রয়োজনমূলক পোলিটিকাল ঐক্য তাঁরা সত্য বলে কল্পনাও করেন নি। তাঁরা একেবারে সেই গোড়ায় গিয়েছিলেন যেখানে সকল মানুষের মিলনের প্রতিষ্ঠা ধ্রুব। অর্থাৎ তাঁরা ভারতের সেই মন্ত্রই গ্রহণ করেছিলেন যাতে আছে, যারা সকলকে আপনার মধ্যে এক করে দেখে তারাই সত্য দেখে।”
বলা বাহুল্য, ‘সকলকে’ বলতে তাঁরা শুধু হিন্দু-মুসলমান বুঝতেন না, বুঝতেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই। জগন্নাথ যে জগৎ-এর নাথ সেখানে যেমন তথাকথিত ম্লেচ্ছ মুসলমানও থাকে, তেমনি কোরানের প্রথম সুরাতে আল্লাকে বলা হচ্ছে ‘রাব্যিয়াল আলামিন’ (‘জগতের প্রভু’), ‘রাব্যিয়াল মুসলিমিন’ (‘মুসলমানদের প্রভু’) নয়। মুশকিল হল, যে মুক্তমন এই সহজ সত্যকে বোঝে তার নজির প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারত বার বার দেখালেও কায়েমি স্বার্থে ব্রিটিশরাজ ভারতীয়দের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন ও বিদ্বেষকে জটিলতর সামাজিক ব্যাধির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিরল কৃতিত্ব দেখাল। আর ঔপনিবেশিক হ্যাংওভারে আক্রান্ত ভারত সেই ব্যাধি থেকে আজও মুক্ত হল না। আর মুক্ত হল না বলেই দ্বিজাতিতত্ত্বের জুজু দেখিয়ে কতিপয় ব্যক্তির হঠকারী সিদ্ধান্তে নেওয়া দেশভাগের দায় আজ ভারতেই থেকে যাওয়া কোটি কোটি নিরীহ সাধারণ মুসলমানের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতি চলে। তাদেরকে কথায় কথায় জোর গলায় বলে দেওয়া যায় — হয় মুসলমানি কৃষ্টি ও যাপন বর্জন করো, নতুবা পাকিস্তান চলে যাও।
পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে যদি কোটি কোটি সাধারণ মুসলমান নিজের মনের গভীর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পেত তাহলে ভারতে থেকে যাওয়া মুসলমানের সংখ্যা পাকিস্তান চলে যাওয়া মুসলমানের সংখ্যার চেয়ে বেশি হত কি? তৈরি হত কি ‘গরম হাওয়া’ সিনেমার সেলিম মির্জার মতো মর্মান্তিক চরিত্র? আর সাদাত হাসান মান্টোর মতো মুসলমান, যাঁরা চূড়ান্ত মনস্তাত্ত্বিক দোলাচল আর আকাশছোঁয়া বিপন্নতাকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান চলে গেলেন, কিংবা আব্দুল গফফার খানদের মতো সাচ্চা গান্ধিবাদীদের যখন নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জিন্নার শাগরেদ (গফফার খানের নিজের ভাষায় ‘wulf’)-দের সামনে ছুঁড়ে দিয়ে কংগ্রেসের তরফে বাধ্য করা হল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে মিশে যেতে, তখন তাঁদের কী করুণ পরিণতি হয়েছিল তা কি এ ভারত ভুলে যাবে?
(৪)
আসলে ধর্মীয় পরিচিতিকে পুঁজি করে তাকে কায়েমি স্বার্থে কাজে লাগানোর কদর্য রাজনীতির কারবারি যাঁরা, তাঁরা নিজেরা ব্যক্তিগত যাপনে কতটুকু মুসলমান আর কতটুকু হিন্দু তা জিন্না, নেহেরু সহ এ সময়ের বহু রাজনৈতিক নেতাকে দেখলেই বোঝা যায়। অথচ তাঁদেরই সিদ্ধান্তের শিকার হয় উভয় সম্প্রদায়ের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। বিভেদকামী রাজনৈতিক নেতাদের মতাদর্শ-তাড়িত হয়ে কখনও তারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে মারদাঙ্গা করে, কখনও বা রাতারাতি দেশহীন উদ্বাস্তু হয়ে যায়। কিন্তু যেসব নেতাদের মদতে তাদের এই দশা, সেই রাজনীতির কারবারিরাই আবার অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে একটা দেশকে দু-টুকরো করে রাষ্ট্রনায়ক হবার সাধ মিটে গেলে দুটি পৃথক দেশকেই ধর্মনিরপেক্ষ তকমা দিতে এগিয়ে আসেন। ভারতীয় সংবিধানে ‘সেকিউলার’ শব্দটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনেক পরে (১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ৪২তম সংশোধনীতে) সংযোজন করা হলেও আম্বেদকরীয় খসড়ার মূল স্পিরিটে সমস্ত ধর্মীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে সকল ভারতীয়র জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃতি দেওয়ার নজির ছিলই। আবার, ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েও সদ্যজাত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান রূপে জাতির উদ্দেশ্য তাঁর প্রথম বক্তৃতাতে স্বয়ং জিন্না তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্র-কাঠামো নির্মাণের কথা একটিবারের জন্যও বললেন না । তাঁর সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতার পরতে-পরতে ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষণা দেখলে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে এই মানুষটিই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের কারিগরদের অন্যতম। সেই বক্তৃতার কিছু কিছু অংশে যেন সদ্য কংগ্রেসে যোগদানকারী সেই পুরোনো জিন্না, যাঁকে ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় আন্দোলনে এক সময় বলা হত “Ambassador of Hindu-Muslim Unity”। সেখানে তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা :
“You are free to go to your temples, you are free to go to your mosques or to any other place of worship in this State of Pakistan. You may belong to religion or caste or creed — that has nothing to do with the business of the State.
Now I think we should keep that in front of us as our ideal, and you will find that in course of time Hindus would cease to be Hindus, and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual, but in political sense as citizens of the State.”
এ যেন নিজেই নিজের বিরুদ্ধে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো নিজের ভস্ম থেকে নিজের নতুন অথচ পুরোনো অবস্থানের পুনর্জন্ম।ইতিহাস সাক্ষী, পাকিস্তান তৈরির মাত্র কয়েক মাস পরেই এই পুনর্জন্ম নেওয়া জিন্নার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল এই ধর্মনিরপেক্ষ উদারতার অহংকার। পাকিস্তান চলতে লাগল তাঁর জন্ম-ইতিহাসের নেপথ্যে লুকিয়ে থাকা দ্বিজাতিতত্ত্বের ঠিকুজি নিয়েই। আর ভারত সেই দ্বিজাতিতত্ত্বের ঠিকুজিকে বেশকিছু কাল ঠান্ডা ঘরে সরিয়ে রাখতে পারলেও তার মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তিটাকে সম্পূর্ণ উপড়ে ফেলতে পারল না। একশ্রেণির মানুষের মন তথা জিনের মধ্যে তা থেকে গেল। শুধু অনুকূল পরিবেশ পেলে সুযোগ মতো মিউটেশনের জন্য ঘাপটি মেরে বসে থাকল ভারতকে পাকিস্তানের প্রতিস্পর্ধী হিন্দু পাকিস্তান বানানোর স্বপ্ন নিয়ে।
এই দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষ এতটাই শক্তিশালী যে এর মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাতে দীর্ণ এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের জটিল আবর্তে ভারত ভেঙে তৈরি তিনটি দেশেরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিচয়-সংকট আজ নতুন মাত্রা পেয়েছে। তাই এ আলোচনার অভিমুখ যদিও ভারতীয় মুসলমানের পরিচয়-সংকট, তবু বর্তমান পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, এমনকি মায়ানমারের সংখ্যালঘু মানুষের পরিচয়-সংকটের প্রতিও পরোক্ষ দিক্-নির্দেশ। কারণ দেশভাগ-পরবর্তী উপমহাদেশে নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাতারাতি সংখ্যালঘু তকমা পাওয়া সাধারণ মানুষ ( যাঁরা সকলেই অবিভক্ত আইডেন্টিটিতে ভারতীয়), তাঁদের ব্যক্তিগত কোনও দায় নেই এই নতুনতর পরিচয়-সংকটের নেপথ্যে।
সাংবিধানিকভাবে সেকিউলার রাষ্ট্র ভারতে মুসলমানের পরিচয়-সংকট নিয়ে এ যুগের পত্রিকা ‘Indian Express’-এ প্রকাশিত যে বিতর্কের কথা আগেই বলেছি, তার সঙ্গে প্রায় একশো বছর আগে ঔপনিবেশিক ভারতে বাংলা পত্রিকা ‘বর্ষবাণী’ ও ‘বুলবুল’-এ প্রকাশিত হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে ধারাবাহিক পত্র-বিতর্কের মধ্যে বিশেষ কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে না। গত একশো বছরেও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অচলায়তনে যে বিশেষ কিছু বদল হয়নি, তা বোঝানোর দায় থেকেই একশো বছর আগের সেই ঐতিহাসিক বিতর্কের নির্যাসকে কিছুটা সামনে আনছি।
ঔপনিবেশিক ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে একশো বছর আগের পত্র-বিতর্কে অন্নদাশঙ্কর রায় (লীলাময় রায় ছদ্মনামে) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ওয়াজেদ আলী, মীজানুর রহমান, ইব্রাহিম খাঁ, এমদাদ আলী প্রমুখের বয়ান থেকেও উঠে আসে হিন্দু-মুসলমান পরিচিতি ও সম্পর্কের মনস্তাত্ত্বিক রসায়নের জটিল আবর্ত। ‘বর্ষবাণী’ (৩য় সংখ্যা, ১৩৪২ বঙ্গাব্দ)-তে এই পত্র-বিতর্কের শিরোনাম যদিও ছিল ‘সাহিত্যের আর একটা দিক’, ‘বুলবুল’-সম্পাদক এর পুনঃপ্রকাশ ঘটান ‘অবাঞ্ছিত ব্যবধান’ নাম দিয়ে। সেখানে এমদাদ আলী ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলমানদের প্রতি হিন্দু-মনস্তত্ত্বের প্রকৃত চেহারা নিয়ে কোনও রাখঢাক না করে স্পষ্ট লিখছেন — “আসলে হিন্দুর মনের ইচ্ছা, ভারতের পলিটিক্যাল জীবনে মুসলমানদের অপাঙক্তেয় করে রাখা। চারিদিক হতে সেই চেষ্টা চলছে সেই মতলব নিয়েই। ধর্ম ও সমাজের দ্বন্দ্ব তাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে রাজনীতির চষা ক্ষেতে।”
একশো বছর আগের পত্র-বিতর্কে বলা এমদাদ আলীর কথাগুলিই যেন প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে আজকের ভারতে যখন ‘Indian Express’-এ ‘Minority Space’ শিরোনামে হর্ষ মান্দার বলেন :
“Muslims are today’s castaways, political orphans with no home, for virtually every political party.
…Worse, many consider that they are now politically untouchable.”
হিন্দু-মনস্তত্ত্বের এই মুসলিম-বিরাগের উদাহরণ হিসেবে এমদাদ আলীর কথায় রয়েছে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এর উল্লেখ। চিত্তরঞ্জন দাশের তরফে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ ঘোচানোর লক্ষ্যে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ (১৯২৩) তৈরির চেষ্টাতে মুসলমানদের সদিচ্ছা সত্ত্বেও হিন্দু-মনস্তত্ত্বের চূড়ান্ত উষ্মা ও অসহযোগিতাকে সামনে এনে তিনি যা বলছেন তাতেও সেই মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার কথা :
“হিন্দু-মুসলিমের বিরোধ চোখের পলকে মিটবার নয়।… এর সমাধান আসবে দুই দলের মনের গুহা থেকে, বাইরের হাত মেলামেলি বা অনুগ্রহের হাসি লাভ করে নয়।”
আসলে এ দেশে নবাগত ইসলামি সাম্যের ছত্রছায়ায় হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানরা হিন্দু যাপনের চিহ্নকে প্রাত্যহিক যাপনে যতটা মুছে ফেলেছে, খ্রিস্টানরা ততটা করেননি। ফলে খ্রিস্টানদের তুলনায় মুসলমান-বিরাগ হিন্দু-মনস্তত্ত্বে অনেক বেশি প্রবল। তাছাড়া, খ্রিস্টানদের তুলনায় মুসলমান জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়াটা কখনও মুসলিম-বিদ্বষ আবার কখনও মুসলিম-তোষণের ভোট-রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। তাছাড়া, ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয় আন্দোলন দানা বাঁধার আগে তথাকথিত এলিট হিন্দু-মানস মুসলমান শাসনের অবসান ঘটাতে ব্রিটিশের তৈরি জুতোয় পা গলিয়ে দীর্ঘদিন পথ হেঁটেছে। আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খ্রিস্টানদের প্রতি বীতরাগ থাকলেও এ দেশেরই তথাকথিত নিম্নবর্ণ থেকে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের প্রতি ততটা বিতৃষ্ণা হিন্দুদের নেই, কারণ তাঁরা তাদের নবার্জিত ধর্মীয় কৃষ্টি ও যাপনরীতিকে কিছুটা বিসর্জন দিয়েও হিন্দু ধর্ম, কৃষ্টি ও তার আধিপত্যকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং ধর্মান্তরিত মুসলমানদের চেয়ে অনেক সহজেই মেনে নেন। ধর্মাশ্রয়ী কৃষ্টির এই হিন্দু আধিপত্যের নমুনা বহু বিপ্লবীর হাতে মাতৃপূজার আদলে নির্মিত স্বাদেশিকতার দীক্ষাতে পুরোমাত্রায় ছিল, যা শেষ পর্যন্ত মুসলমান বিপ্লবীদেরকে অনেকাংশেই দূরে সরিয়ে দেয়। আর এই মনস্তাত্ত্বিক-রাজনীতির জটিল আবর্তকে বুঝেই ওয়াজেদ আলী খুব আক্ষেপের সঙ্গে লিখছেন :
“মুসলিমকে আপনি ভিন্ন জাতি মনে করেন না, তথাপি গির্জায় যেতে আপত্তি না থাকলেও মসজিদে প্রবেশ করতে আপনার মন সরবে না।… হিন্দুর পৌত্তলিক অনুষ্ঠানে ক্রিশ্চানের স্থান নেই, মুসলিমেরও না।… তবে কেন মুসলিম আপনার পর, ক্রিশ্চান আপনার আপনজন? জোসেফ ঘোষের মতো মুসলিমেরও আবদুল্লা চ্যাটার্জি, দীন মোহাম্মদ গাঙ্গুলি আছে এবং থাকতে পারে। ক্রিশ্চান সমাজ হিন্দুর থেকে স্বতন্ত্র, মুসলিমও তাই। তবে কেন শুধু মুসলিম আপনার অনাত্মীয়? কেন বাঙালী জাতির সমস্যা আলোচিত হয় মুসলিমের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে,…?”
অন্নদাশঙ্কর রায় লীলাময় রায় ছদ্মনামে এই মনস্তত্ত্বগত রাজনৈতিক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ বাতলেছেন হিন্দু-মুসলমানের মিলনে সত্যিকারের আধুনিক, প্রগতিশীল ও মুক্তমনা মানুষ হওয়ার সাধনায়। এবং তিনি স্বীকার করেছেন, তেমন মানুষ হওয়া খুবই কঠিন, অন্তত ভারতের মতো সংস্কারাচ্ছন্ন, ধর্মাশ্রয়ী দেশে। তাই রবীন্দ্রনাথের রেফারেন্স টেনে তিনি লিখছেন :
“মুসলমান বলতে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় মোল্লা মৌলানা বোঝেননি। বুঝেছেন তাজমহলের স্থপতি, হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের গুণী, উর্দু সাহিত্যের স্রষ্টা, উত্তর-পশ্চিম ভারতের পোষাক ও সহবতের অগ্রণী, ভূমি রাজস্ব প্রণালীর উদ্ভাবক ইত্যাদি…”
এই আদলে মুসলমানদের কথা মনে রাখলে হিন্দুদের পক্ষে মুসলমানদের কাছে টানার কাজটা অনেক সহজ হত। হয়তো তাতে রক্ষণশীল মোল্লা কিংবা গোঁড়া পুরোহিতরা বিশেষ শামিল হবেন না, কিন্তু রক্ষণশীলতা-বর্জিত সে মিলনের যাত্রায় তাঁরা বিশেষ অনিষ্টও করতে পারবেন না। আর সেই আশাবাদ ও বিশ্বাস থেকেই অন্নদাশঙ্কর রায় বলতে পারেন :
“Modern মন সব দেশে সব সম্প্রদায়েরই আছে।… সে চায় না গরুর গাড়ির সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ির সমন্বয় ঘটাতে না পেরে বাধ্য হয়ে এরোপ্লেন ভ্রমণ। সে এরোপ্লেন ভালোবাসে বলেই গরু ঘোড়ার প্রতি তার বিতৃষ্ণা।
দেশের অগ্রসর দল যদি ধর্ম নির্বিশেষে মিলিত হয়, তবে প্রগতি-বিরোধীদের গ্রাম্য দলাদলি হিন্দু-মুসলিম বিরোধরূপে দীর্ঘকাল আমল পাবে না — কিন্তু অগ্রসর দলকে মনে রাখতে হবে যে চাপে পড়লে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল গ্রাম্য দলের মোড়ল হবে না।”
অন্নদাশঙ্কর যে ‘Modern মন’-কে আবাহন করছেন হিন্দু-মুসলিম সমস্যার মুশকিল আসান হিসেবে তার স্বরূপ বোঝা দরকার, কারণ সমস্যাটি রাজনীতির আবর্তে চলে গিয়ে অধিকতর ঘোরালো হয়ে গেলেও তা মূলত মনস্তাত্ত্বিক, যা নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও আক্ষেপ চেপে রাখেননি। হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের জটিল আবর্তে যুগান্তরের প্রত্যাশী রবীন্দ্রনাথ ‘কালান্তর’-এ বলছেন — “মানুষের মনের সঙ্গে মনের রফানিষ্পত্তি করাই হল গোড়ার কথা।…. কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের মিলনের উদ্দেশ্যে পরস্পরের মনের চিরাগত সংস্কারের পরিবর্তন করা সহজ নয়। সমস্যাটা সেইখানেই ঠেকেছে। হিন্দুর কাছে মুসলমান অশুচি, আর মুসলমানের কাছে হিন্দু কাফের —।”
সাধারণত আধুনিক মন বলতে বোঝানো হয় সেই মুক্তমনকে, যে মন পুরোনো অচলায়তনে আঘাতকারী নতুনকে গ্রহণ করতে কুন্ঠিত হয় না, যদি তা আগামীর পক্ষে যুক্তিসিদ্ধ ও কল্যাণকর হয়। কিন্তু অন্নদাশঙ্করের মতে এই বৈশিষ্ট্যেটুকুই ‘Modern মন’ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে তাকে হতে হবে সংবেদী ও মানবিক। আর তা হতে পারলে “গান্ধীর মতো হিন্দুর সঙ্গে গফুর খাঁর মতো মুসলমানের এবং Andrews-এর মতো ক্রিশ্চানের বুঝাপড়া হওয়া সম্পূর্ণ সম্ভব”।
সম্ভব কিনা তা সময়ই বলবে। কিন্তু সময়ের গর্ভ থেকে সেই সদর্থক সম্ভাবনাকে প্রসব করাতে হলে সব দায় শুধু সংখ্যাগুরুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে চলবে না, সংখ্যালঘুকেও এগিয়ে আসতে হবে তার নিজস্ব তাগিদেই। কারণ চুম্বক কেন কাছে টানছে না, সেই অভিযোগ করার আগে নিজেকে চৌম্বক পদার্থ হওয়ার দায়টুকু নিতে হবে। প্রশ্ন হল, সে দায় কি সংখ্যালঘুর তরফে সব সময় ঠিকঠাক পালিত হচ্ছে? সে দায় পালনের সদিচ্ছার পাল্লাটা কার দিকে ভারি? মুসলমান হিন্দুকে গ্রহণের ব্যাপারে যতটা এগিয়েছে তথাকথিত এলিট হিন্দু-মানস কি ততটা এগিয়েছে? আর আধুনিকতা তথা প্রগতির পথে মুসলমান কি আজও বুঝতে পেরেছে গ্রহণ করা মানে কিন্তু গ্রাস করা নয়? গ্রহণ করা আর গ্রাস করার মধ্যে যে পার্থক্য, সেই পার্থক্যের বোধ নিয়ে আজকের সেকিউলার ভারতে সংখ্যালঘু-পরিচিতির তথাকথিত বিপন্নতা ভুলে যদিও বা কতিপয় মুসলমান হিন্দুর কাছে এগিয়ে যেতে চায়, তথাপি তথাকথিত এলিট হিন্দু-মানস কি ইসলামকে বোঝার চেষ্টা করে? বলা বাহুল্য, তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণির হিন্দুরা তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছ থেকে উৎপীড়িত হয়ে অস্তিত্বের সংকট থেকে যতটা এগিয়েছে ইসলামি সাম্যের ছত্রছায়ায় আশ্রয় পেতে, তার সিকিভাগও তথাকথিত এলিট হিন্দু-মানস ইসলামকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করেনি। অর্থাৎ হিন্দু ঠিক ততটুকুই ইসলামের কাছে এগিয়েছে যতটুকু তার নিজের স্বার্থে তাকে দরকার। ঔপনিবেশিক ভারতে খিলাফতের সময় থেকেই সেই ট্র্যাডিশন চলছে। নেহাত রাজনৈতিক স্বার্থে পরস্পরের প্রয়োজনে ওপরিতলের ঐক্য যে কত ঠুনকো তার প্রমাণ ইতিহাস বার বার দিয়েছে, এবং দিচ্ছে।
আজও একজন মুসলমান হিন্দু-ধর্মাশ্রিত উৎসবে যেভাবে মেতে উঠে তাকে সর্বজনীন করে তুলতে এগিয়ে আসেন, তা কি হিন্দুদের তরফে ইসলাম-আশ্রিত উৎসবে দেখা যায়? যে সব হিন্দু বন্ধুরা তাঁদের পূজা-কেন্দ্রিক উৎসবে মুসলমানের সক্রিয় ভূমিকা ও অংশগ্রহণ দেখে রীতিমতো আপ্লুত হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছবিকে ফ্রেম-বন্দি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করেন, তাঁদের কতজন মনে রাখেন সেই মুসলমান বন্ধু তথা সহনাগরিককে ইদের শুভেচ্ছাটুকু জানাতে? ব্যক্তিগতভাবে অনেককে আক্ষেপ করতে শুনেছি, সেইসব হিন্দু বন্ধুরাও ইদের শুভেচ্ছাটুকু জানানোর শিষ্টাচার দেখাননি, যাঁরা বহুবার ইদে মুসলমান বন্ধুর বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়েছেন, কিন্তু অনিবার্য কারণে (যেমন কোভিড পরিস্থিতি) কখনও বা বাড়িতে তাঁদেরকে ডাকা সম্ভব হয়নি। এমনকি, মুসলমান বন্ধু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইদের শুভেচ্ছা জানালেও অনেকে তার প্রত্যুত্তরেও শুভেচ্ছা জানানোর সৌজন্য পর্যন্ত দেখান না। কারণ, হয় তাঁর এ বিষয়ে চূড়ান্ত অনীহা, নতুবা ইসলামি উৎসব সম্পর্কে অজ্ঞতা। অনীহা এবং অজ্ঞতা দুটোই যে আকাশছোঁয়া তার প্রমাণ মহরমের মতো একটি শোকের দিনেও এঁদের অনেকে মেসজ করেন — “হ্যাপি মহরম”। আর অন্যান্য ইসলামি উৎসবগুলি ক্যালেন্ডারে নেহাতই একটা ছুটি উপভোগের দিন, যা নিয়ে হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করা হিন্দু সহনাগরিকের অবজ্ঞাসূচক প্রতিক্রিয়া — “কাল ওই মুসলমানদের কী যেন একটা আছে।” অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। এমন অনেক অ-মুসলমান বন্ধু আছেন যাঁরা মুসলমানদের প্রতি এই অনীহা তথা উদাসীনতা নিয়ে যথেষ্ট পীড়িত বোধ করেন। এমনকি অনেকের কাছ থেকে এই অপ্রীতিকর উদাসীনতা নিয়ে লেখার আবেদনও আসে।
মুসলমানকে কাছে টানতে, মুসলমানের কৃষ্টি ও যাপনকে সম্মানের সঙ্গে জানতে যে সদিচ্ছাটুকু প্রয়োজন, তার অভাবের নেপথ্যে যে হিন্দু-মনস্তত্ত্ব তাকে রবীন্দ্রনাথ বলছেন “মানসিক অবরোধ”। মানসপ্রকৃতির এই অবরোধের নেপথ্য কারণ নিয়ে তিনি যা বলে গেছেন ‘কালান্তর’-এ তা কালের সীমা পেরিয়ে হিন্দু-মুসলমানকে আজও মানসিকভাবে কাছাকাছি আনতে পারেনি। হিন্দুর তরফে মুসলমানের কাছাকাছি আসার অনীহা নিয়ে ররবীন্দ্রনাথ বলছেন :
“হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরো কঠিন। মুসলমান ধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ। আহারে ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করে না, হিন্দু সেখানেও সতর্ক। তাই খিলাফৎ উপলক্ষ্যে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারে নি। আচার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, সেইখানেই পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে।”
আসলে আচার আর ধর্মীয় দর্শন দুটো আলাদা জিনিস। ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার দার্শনিক ভিত্তিতে, এমনকি তন্ত্র ও যোগাশ্রয়ী আধ্যাত্ম-যাপনে সকল মানুষের সমান প্রবেশাধিকার। সেখানে কোনও বর্ণভেদ-জাতিভেদ নেই। কিন্তু যখনই হিন্দু তার সেই সনাতন যাপন থেকে সরে এসে হয়ে উঠল আচার-সর্বস্ব, তখনই সে দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর তুলে ধরল নিজের চারপাশে।
(৫)
কিন্তু মুসলমান হিন্দুর মতো আচার-সর্বস্ব না হলেও ধর্মমতের ব্যাপারে চূড়ান্ত রক্ষণশীল। তাই সে চায় নিজের ধর্মমত অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে, কারণ নিজের কলেবর বৃদ্ধিতেই তার আনন্দ। জন্মপরিচয়ের বৃত্তে আবদ্ধ তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দু তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণির হিন্দুকেই যদি জায়গা না ছাড়ে তাহলে সে তার চোখে যে ম্লেচ্ছ, অশুচি, সেই মুসলমানকে কী করে জায়গা ছাড়বে? অর্থাৎ নিজেকে ছড়িয়ে দেবার অভীপ্সা নিয়ে অন্যকে গ্রহণ করার নামে গ্রাস করতেও মুসলমানের আচারে বাধে না, কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার অছিলায় অন্যের ছোঁয়া এড়িয়ে আচারের প্রাচীরের মধ্যে গুটিয়ে থাকতে হিন্দু সিদ্ধহস্ত। ঔপনিবেশিক ভারতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জমিদারের কাছারিতে মুসলমানদের বসতে দিতে জাজিমের একপ্রান্ত তুলে দেবার যে দৃশ্য দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন, আজকের ভারতে সে জাজিম ততটা দৃশ্যমান নয় ঠিকই, কিন্তু মনের গভীর গোপন কোণে এক অদৃশ্য জাজিম তুলে দেওয়ার হিন্দুয়ানি অভ্যেস আজও রয়ে গেছে। তাই বিষয়টি বহু বছর আগের রবীন্দ্র-ভাষ্যে আজও তাঁর মনস্তাত্ত্বিক প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পায় — “ধর্মনিয়মের আদেশ নিয়ে মনের যে-সকল অভ্যাস আমাদের অন্তর্নিহিত সেই অভ্যাসের মধ্যেই হিন্দু-মুসলমান-বিরোধের দৃঢ়তা আপন সনাতন কেল্লা বেঁধে আছে;…”।
বিরোধের সেই ‘সনাতন কেল্লাকে’ গুঁড়িয়ে দিতে পারে যে মুক্তমন তথা প্রগতির সাধনা, তাকে সঙ্গে নিয়ে উভয় সম্প্রদায়েরই যে কতিপয় মানুষ এগিয়ে এসেছেন, এবং আসছেন তাঁদের জন্য রক্ষণশীলদের তরফে তিরস্কার আর ফতোয়া ছাড়া কিছু জুটেছে কোনও দিন? বলতে দ্বিধা নেই, ফতোয়া জারির যজ্ঞে হিন্দুর চেয়ে মুসলমান সহস্র যোজন এগিয়ে। আর সেটা যদি নারী-কেন্দ্রিক হয় তাহলে তো কথাই নেই। গোঁড়া মুসলমানের চোখে একজন প্রগতিশীল মুসলমান আজও কোণঠাসা, একঘরে। অর্থাৎ খোদ মুসলমানের চোখেই সে বিধর্মী, কাফের।
সেকিউলার রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মুসলমানের দায় কি তাহলে শুধু ইসলামি যাপনের বহিরঙ্গের চিহ্ন বহন করা আর প্রগতির টুঁটি টিপে ধরা? কোরানের অন্তর্নিহিত সত্যের অনুধাবন ও প্রাত্যহিক যাপনে সেই সত্যের প্রতিফলন কতটুক? যে ফেজটুপি-দাড়ি-হিজাব ইত্যাদি মুসলমানি চিহ্নের দৃশ্যমানতা নিয়ে এত বিতর্ক, এত গেল গেল রব, তাকে ঢেকে রাখার জন্য যে অমুসলিম ফতোয়া ইদানীং মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে, তা সেকিউলার রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নৈতিকতার পরিপন্থী ঠিকই, কিন্তু এই বহিরঙ্গের চিহ্ন তথা পোশাকের ডিজাইন নিয়ে কোরানের কোথাও কোনও নির্দেশ আছে কি? সত্যি বলতে কী, প্রকৃত মুসলমানের নির্দিষ্ট কোনও ধর্মীয় ড্রেসকোডের বাধ্যবাধকতাই নেই। যদি থাকত, তাহলে পৃথিবীর সব দেশের সব মুসলমান একই ড্রেস কোড তথা ডিজাইন মেনে চলত। আসলে কোরানে পোশাকবিধি নিয়ে শালীনতাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, বাকিটা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান তথা আবহাওয়া, কৃষ্টি ও রুচির ওপর নির্ভর করে। আর সেকারণেই আরব মরুভূমির মুসলমানের পোশাক আর আলাস্কা কিংবা সাইবেরিয়ার মুসলমানের পোশাক কখনও এক হতে পারে না। অথচ ভারতের মতো দেশের ভ্যাপসা গরমের মধ্যে যখন পুরুষের নির্দেশ মানতে মুসলিম নারীকে বহুক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুখসহ সর্বাঙ্গ-ঢাকা বোরখা পরতে বাধ্য করা হয়, তখন তা সেকিউলার রাষ্ট্রের সংবিধানের দেওয়া নারীর মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে না কি? নারী যদি স্বেচ্ছায় তা ব্যবহার করে তাহলে অবশ্য কিছু বলার নেই, কিন্তু সব সময় কি তা হয়? অর্থাৎ যে মুসলিম পুরুষ সেকিউলার রাষ্ট্রের সংবিধানের দেওয়া ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে সরব, তিনিই আবার যদি নিজের ঘরে নারীকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন তাহলে সে তো চূড়ান্ত দ্বিচারিতা !
তাছাড়া, বহিরঙ্গের ইসলামি চিহ্ন না রেখেও ইসলামের মূল স্পিরিটকে মান্যতা দিয়ে ইসলামি যাপনে অভ্যস্ত প্রকৃত মুসলমানের সংখ্যা তো কম নয়। অথচ অন্তরাত্মায় শুদ্ধ, আত্মিকভাবে ঋদ্ধ, ইসলামি নৈতিকতায় সিদ্ধ, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সেইসব উচ্চকোটির মুসলমানকে বহিরঙ্গ-সর্বস্ব গোঁড়া মুসলমানরা বহুক্ষেত্রে মুসলমান বলেই গণ্য করেন না। অথচ কোরান এইসব গুণাবলিকেই প্রকৃত মুসলমানের চিহ্ন হিসেবে মান্যতা দেয়। ধর্মের ব্যাপারে কোনও প্রকার জবরদস্তি না করা, এবং ভিন্ন ধর্মীয় যাপনের প্রতি বিরূপতা না দেখানো, অর্থাৎ পরমত-সহিষ্ণুতার মহার্ঘ পাঠ কোরানের অসংখ্য সুরা (পরিচ্ছেদ)-র অসংখ্য আয়াত (স্তোত্র)-এ (যেমন, সুরা তাওবা : আয়াত ৬, সুরা আল-আন’আম : আয়াত ১০৮, সুরা নাহাল : আয়াত ১২৫, সুরা আল-ইমরান : আয়াত ২০ এবং ১৫৯, সুরা বাকারাহ : আয়াত ২৫৬ এবং ২৭২) রয়েছে। রয়েছে মুক্তচিন্তা ও জ্ঞানদীপ্তির হাত ধরে চিন্তা ও যুক্তির দরজা খোলা রাখার স্পষ্ট ইঙ্গিত (সুরা আর-রা-আদ : আয়াত ৩, সুরা রূম : আয়াত ২১ এবং ২২)। রয়েছে বিজ্ঞান-চর্চার প্রতি প্রত্যক্ষ সওয়াল ( রা নিসা : আয়াত ৫৬, সুরা ইয়াসীন : আয়াত ৩৭-৪০, সুরা আর-রা-আদ : আয়াত ২)। আর সেই পথে হেঁটেই মধ্যপ্রাচ্যে এসেছিল ইসলামি রেনেসাঁ, যা একদা মধ্যযুগের অন্ধকারময় ইউরোপ তথা সারা বিশ্বকে আলো দেখিয়েছিল।
এই কোরানীয় বীক্ষণ ও আলোকপ্রাপ্তির সঙ্গে পরবর্তীকালে বহু শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট উলেমাদের হাতে সংশ্লিষ্ট শাসকের স্বার্থের অনুকূলে তৈরি হাদিস তথা শরিয়তের অনেক বিরোধ। অথচ সেই শরিয়তি যাপনকে অক্ষরে অক্ষরে না মানলে অর্থাৎ একটু উদারপন্থী মুসলমান হলেই তার বিরুদ্ধে ওঠে শরিয়তি ফতোয়া। বিশেষত ইরানি ও ভারতীয় যাপনরীতির সম্মিলিত প্রভাবে পরিপুষ্ট যে ভারতীয় সুফিবাদ ও পীরবাদ, তার বিরুদ্ধে এমন ফতোয়া জারি বিরল নয়। এখানেই ভারতীয়ত্বের উদারতার মৌলিক ভিত্তির সঙ্গে শরিয়তি রক্ষণশীলতার বিরোধ। এক কথায়, উদারপন্থী, প্রগতিশীল, মুক্তমনা মুসলমানের পরিচয়-সংকট আরও তীব্র। তার সংকট ঘরেও, বাইরেও। কারণ, গোঁড়া শরিয়তি মুসলমানের চোখে সে প্রকৃত মুসলমান নয়, আর অমুসলমানের চোখে সে ভারতীয় হলেও মুসলমান ভারতীয়।
তাছাড়া, ইসলাম তো শুধু শরিয়তের কথা বলে না। শরিয়ত তার বহিরঙ্গের শৃঙ্খলা মাত্র, অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক যাপনের জন্য ইসলামেই রয়েছে শরিয়তি শৃঙ্খলার পাশে মারাফত, তরিকত ও হাকিকতের দীক্ষা, যার প্রতিফলন দেখা যায় উচ্চকোটির ইসলামি অধ্যাত্ম-সাধক (যেমন, সুফিসাধক)-এর জীবনে। এই উচ্চস্তরের আধ্যাত্ম-সাধনার বলেই হিরা পর্বতে মহম্মদ (সঃ) পয়গম্বর হিসেবে দিব্যজ্ঞান তথা ঐশী কোরান লাভ করেন। লক্ষণীয়, কোরান অবতীর্ণ হয়েছে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে (৬০৯ থেকে ৬৩২ খ্রীঃ পর্যন্ত) মহম্মদ (সঃ)-এর জীবনের শেষ বছর পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমান্বয়ে কোরান অবতীর্ণ হওয়াই প্রমাণ করে ইসলামি যাপনবিধি সময়ের বিবর্তন অনুযায়ী পরিবর্তিত পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী নির্মিত। অর্থাৎ ইসলাম কোনও অচলায়তন নয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে ভারতীয় অধ্যাত্ম-পরম্পরার মতোই ইসলামি আধ্যাত্মিক যাপনকেও সম্পূর্ণরূপে অনুশীলনে আনা কঠিন হলেও সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান ও সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে অনুসরণ করা মোটেও কঠিন নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বহুক্ষেত্রেই তা দেখা যায় না। বরং বহু মুসলমানের তরফে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্টার অহং মাঝেমাঝেই এত উৎকটভাবে চোখে পড়ে যে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে কোরান তথা ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা যায়। বিশেষত গ্রাম্য ধর্মীয় সভাগুলিতে অর্ধশিক্ষিত উলেমা ও ধর্মগুরুরা ইসলামকে বিকৃত করার এই দায় এড়াতে পারেন না। যে বর্ধিত দায় থাকলে একটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের কাছ থেকে নিজেদের প্রতি সম্ভ্রম আদায় করা যায় তা বহুক্ষেত্রেই এই ধর্মগুরুদের মধ্যে অনুপস্থিত। বলা বাহুল্য, এ দেশে হিন্দু-মুসলমানের মানসিক দূরত্বের এটাও একটা বড়ো কারণ।
(৬)
যে যুক্তিতে ভারতীয় ভাষার মধ্যে ইংরেজি শব্দবন্ধ ঢুকে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা, সেই যুক্তিতেই যদি ধরে নেওয়া হয় আরবি, ফারসি, উর্দুর প্রবেশও স্বাভাবিক, তবু বলব এই অর্ধশিক্ষিত মোল্লাতন্ত্রের সৃষ্ট অনেক মাদ্রাসা আজও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মাতৃভাষার উৎকর্ষ ছুঁতে ব্যর্থ। উদাহরণ হিসেবে যদি বাংলার কথা ধরি, তাহলে বলব একদিকে বাংলাভাষার জন্য পাকিস্তানি উর্দু-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যেমন লক্ষ লক্ষ মুসলমানের আত্মত্যাগের ইতিহাস, অন্যদিকে সেই বাংলার মাটিতেই অসংখ্য মাদ্রাসাতে আরবি-ফারসি-উর্দু-ঘেঁষা বাংলা চর্চার অতীব করুণ ছবি। বাঙালি মুসলমানের বাংলাভাষা চর্চার এই দৈন্য অধুনা বাংলাদেশে অনেকটাই কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা দেখা গেলেও পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে গত একশো বছরে বিশেষ কিছু বদল হয়নি। প্রায় একশো বছর আগে তৎকালীন ‘সওগাত’ পত্রিকায় (১০ম সংখ্যা, ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ) আবুল ফজল তাঁর ‘ভাষাজ্ঞান ও চিন্তাশীলতা’ প্রবন্ধে এ নিয়ে সরাসরি বিঁধেছেন বাঙালি মুসলমানকে। ভাষার কোনও হিন্দু-মুসলমান হয় না জেনেও তিনি অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে বলছেন :
“মুসলিম বাংলা এখনো মাদ্রাসা ঘেষা; কিন্তু মাদ্রাসা ও মক্তবগুলিতে এখনো বাংলা শিক্ষার সুবন্দোবস্ত হয় নাই। যাহা হইয়াছে তাহাও অত্যন্ত ভুল-ভ্রান্তিজনক।… যাঁহারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে মোটেও পরিচিত নন, বর্তমানে তাঁহারাই মাদ্রাসা ও মক্তবে বাংলা শিক্ষক।… বইগুলিতে না আছে জ্ঞান ও বুদ্ধির প্রতি ইঙ্গিত, না আছে পুষ্ট ভাষা, না আছে সুন্দর বর্ণনা। অনেক বই-এর ভাব ভ্রমপূর্ণ — বানান পর্যন্ত বিশ্রী।”
বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা শিক্ষার এই হাল আজও প্রায় একই থাকায় বাংলাভাষী হিন্দুর চেয়ে বাংলাভাষী মুসলমান সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্বেও বাঙালি মুসলমান সমাজ থেকে নজরুলের পর রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলালের পাশে কোনও উল্লেখযোগ্য গীতিকারকে আজও পাওয়া গেল না। তার চেয়েও বড়ো কথা, আজও মুসলমানদের একটা বিরাট অংশ গান-বাজনাকে মনে করে ইসলামি রীতিবিরুদ্ধ। হায় রে মুসলমান! আজানের মতো মধুর সুর দিনে পাঁচ বার কানে ভাসে যার, সে মুসলমান আজও সুরের মাধুর্য বুঝবে না! কোরানের আয়াতের সুরেলা পাঠ যে সাংগীতিক সৌকর্যের মরমি আবহ তৈরি করে, তা রবীন্দ্রনাথের নিরাকার ব্রহ্ম-উপাসনার সাংগীতিক দ্যোতনার চেয়ে কম কিছু? শোনা যায় হজরত দাউদ (আঃ) অর্থাৎ বাইবেলের ডেভিড, শুধু অনন্য সুন্দর সুপুরুষই ছিলেন না, সেইসঙ্গে ছিলেন অসামান্য কন্ঠ-মাধুর্যেরও অধিকারী। আসল কথা হল, তৎকালীন অসভ্য, যাযাবর, ব্যভিচারে অভ্যস্ত আরব জাতিকে কঠোর বিধিনিষেধে বেঁধে নিয়য়ানুবর্তী, সুসভ্য জীবনে অভ্যস্ত করার মহতী লক্ষ্যে সেই ধরনের নাচ-গান নিষিদ্ধ করা হয়েছিল যা তৎকালীন আরবদেরকে উচ্ছৃঙ্খল ও ব্যভিচারী হতে প্রলুব্ধ করত। তাই পরবর্তীতে সুস্থ সংগীতের অন্তর্লীন সৌকর্য ও আধ্যাত্মিক পরাকাষ্ঠাকে নিয়ে সুফি কাব্যগীতির জন্ম হয়েছে। জন্ম হয়েছে এ দেশের উচ্চাঙ্গসংগীতে পারদর্শী অসংখ্য উস্তাদের সাধনায় সংগীতের নানান ঘরানা। তবু বলব, এ দেশের সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে সংগীত, নৃত্য, কলা, সাহিত্য — এক কথায় সার্বিকভাবে সংস্কৃতি চর্চায় আগ্রহ আজও যথেষ্ট কম। রবীন্দ্রনাথের উচ্চতাকে যদি ব্যতিক্রমও ধরে নিই, তবু বলব বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানের অবদান ও তার উৎকর্ষ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সৈয়দ আলাওল, দৌলত কাজী, মোশাররফ হোসেন, ওয়াজেদ আলী, মুজতবা আলী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, আবুল বাশার ইত্যাদি মুষ্টিমেয় কিছু নাম। অধুনা বাংলাদেশ অনেককে নিয়ে পথ হাঁটছে, কিন্তু মানিক-তারা-বিভূতি কিংবা উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমার-সত্যজিৎ কিংবা সুনীল-শক্তি-সন্দীপন-শীর্ষেন্দু-সমরেশদের শিখর ছুঁতে সময় লাগবে।
একই কথা খাটে সমগ্র ভারতের প্রেক্ষিতেও। ঔপনিবেশিক ভারতে কাজের ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে গ্রহণ করতে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের অনেক দেরি হওয়ার বিষময় ফল হল দিনের পর দিন কর্মক্ষেত্রে তাঁদের পিছিয়ে পড়া। অর্থনৈতিক জীবনে এভাবে পিছিয়ে পড়ার ফলে মুসলমান হিন্দুর কাছে ক্রমেই হয়ে পড়ল অনুগ্রহের পাত্র, যা আজও অব্যাহত। বীরবল-তানসেনের কদরকারী আকবর বাদশার উত্তরসূরি হরিপদ কেরানির চাকরি তো দূরের কথা, হয়ে পড়ল রিকশা বা টাঙ্গাচালক, স্থাপত্য-ভাস্কর্যের অন্যতম মুখ্য পৃষ্ঠপোষক ‘ভারত-ঈশ্বর’ শাহজাহানের উত্তরসূরি হয়ে গেল নেহাত রাজমিস্ত্রী, সংস্কৃতির চূড়ান্ত পৃষ্ঠপোষক কবিচিত্তের মূর্ত বিগ্রহ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের বংশধর হয়ে গেল পোশাক-প্রস্তুতকারী প্রান্তিক দর্জি, সংগীতরসিক নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের উত্তরসূরি হয়ে গেল মাংসের দোকানদার কিংবা নিদেনপক্ষে বিরিয়ানি-কাবাবের কারিগর। মির্জা গালিবের দেখানো পথে নৌসাদ, মজরুহ্ সুলতানপুরি কিংবা হাল আমলের জাভেদ আখতারের মতো কতিপয় মুখ ছাড়া বিপুল সংখ্যক মুসলমান মর্মস্পর্শী ট্র্যাজেডির শিকার। যেটা লক্ষণীয় তা হল, ট্র্যাজেডির চরিত্রগুলি গ্রিক ট্র্যাজেডির চরিত্রের মতো সম্পূর্ণরূপে নিয়তি-তাড়িত নয়।ষকারণ, শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ-হ্যামলেট-ওথেলো-লিয়াররের মতো তারা অনেকটাই তাঁদের পরিণতির দায় এড়াতে পারে না।আর এই দায় নিয়ে আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে তৎকালীন প্রগতিশীল পত্রিকা ‘শিখা’ (১ম বর্ষ,১৩৩৩ বঙ্গাব্দ)-তে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আবুল হুসেনের নিরপেক্ষ আত্মবিশ্লষণ :
“একশত বৎসর পূর্বে হিন্দু সমাজ সংস্কৃত শিক্ষাকে দূরে সরিয়ে পাশ্চাত্য জ্ঞানকে বরণ করেছিল — আর একশত বৎসর পরে আমরা সেই আরবী শিক্ষাকেই পুনঃপ্রবর্তিত করছি নবপ্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাসমূহে। প্রাচীন শাস্ত্র কন্ঠস্থ করে যে প্রকৃত শিক্ষা হয় না, সে বুদ্ধি আজ আমাদের হয় নাই।আজ তাই আমরা প্রাচীন শাস্ত্রের সঙ্গে একটুখানি ইংরেজি জুড়ে দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করে নিশ্চিন্তমনে নিদ্রা দিচ্ছি।”
“প্রাচীন শাস্ত্রের সঙ্গে একটুখানি ইংরেজি জুড়ে” দিতে প্রথমত অনেক দেরি হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, আগেভাগেই অনেকখানি এগিয়ে যাওয়া হিন্দুদের কাছে অনুগ্রহের পাত্র না হয়ে সমমর্যাদা ও সম্মান নিয়ে প্রকৃত ভারতীয় হয়ে ওঠার যাত্রায় সমান তালে এগোতে শুধু “একটুখানি ইংরেজি জুড়ে” দেওয়া যে যথেষ্ট নয় তা তাঁরা আজও অনেকে বুঝছেন না। যদি বুঝতেন তাহলে আজকের ভারতে খাগড়াগড়-কাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দায় এড়িয়ে গ্রামে গ্রামে তৈরি হওয়া অসংখ্য খারিজি মাদ্রাসার পক্ষে সওয়াল করে সেখানেও আধুনিক শিক্ষা হয় বলে আত্মপক্ষ সমর্থনের হিড়িক পড়ত না। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই এগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তবু বলব এইসব তথাকথিত নবমাদ্রাসা, যেখানে একটা বিরাট সংখ্যক মুসলমান শিক্ষার্থী পড়তে আসে সেখানকার “একটুখানি ইংরেজি জুড়ে” দেওয়া আধুনিক শিক্ষার হাল দেখলে বিস্মিত হতে হয়। এ বিষয়েও প্রাগুক্ত পত্রিকা ‘শিখা’-তে প্রায় একশো বছর আগেই আলোকপাত করা হয়েছে, যা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। সেখানে কাজী আনোয়াররুল কাদীর লিখছেন :
“অধুনা নতুন ধরনের মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছে। এখানে ইংরেজি শিখতে বাধা নাই। তবে বেশি ইংরেজি শিখলে গোনা হবে এরূপ ভাব মনের কোণা কানচি খুঁজলে বোধ হয় বেশ কিছু পাওয়া যাবে।… তবে মোটের ওপর বোঝা যাচ্ছে যে আমারা বুদ্ধির মুক্তি চাই না।”
কেন চাই না? কারণ অর্ধশিক্ষিত মোল্লাতন্ত্র জানেই না কিংবা জানলেও কায়েমি-স্বার্থে কোটি কোটি সাধারণ মুসলমানকে জানাতে চায় না যে খোদ কোরানেই জ্ঞানার্জন, চিন্তন, গবেষণা তথা বুদ্ধির মুক্তিকে চূড়ান্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চিন্তন ও বুদ্ধির মুক্তিকে মান্যতা না দিলে ‘মুতাজিলা’ নামক জ্ঞানান্বেষী চিন্তকদের হাতে ইসলামি রেনেসাঁ (যার উল্লেখ আগেই করেছি)-র জন্ম হত কি?
কে দেবে উত্তর? অন্তত অর্ধশিক্ষিত মোল্লাতন্ত্র সে উত্তর দেবে না তা নিশ্চিত। আর দেবে না বলেই মোল্লারা হয় অজ্ঞতাবশত, না হয় স্বার্থহানির ভয়ে কোরান তথা শরিয়তের বিধানের আধুনিক, যুক্তিনিষ্ঠ, সময়োপযোগী, বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা দিতে নারাজ অথবা অক্ষম। আর তার ফল হচ্ছে মারাত্মক। আবুল হুসেনের কথায় — “তাতে শিক্ষাপ্রীতি না বেড়ে বাড়ছে শিক্ষার প্রতি বিতৃষ্ণা, তাতে জ্ঞানের উদারতা ও শক্তি না বেড়ে বাড়ছে ধর্মান্ধতা ও আত্মপ্রবঞ্চনা, তাতে সত্য অনুসন্ধিৎসা না জেগে জাগছে সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা, পরধর্মের নিকৃষ্টতা প্রমাণের জন্য আকুল আগ্রহ, স্বধর্মের প্রতি অন্ধ অনুরাগ, অজ্ঞতার কুয়াশায় আচ্ছন্ন আত্মতৃপ্তি… বাহ্যিক পরিচ্ছদ দিয়ে অন্তরের দৈন্য লুকিয়ে লালন করবার প্রবৃত্তি এবং তাতে বাড়ছে নৈতিক ভীরুতা (moral depravity), স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি হৃদয়হীনতা, জ্ঞানার্জনে পরাঙ্মুখতা ও ব্যক্তিত্বহীনতা।”
(৭)
যে শিক্ষা মানসিক জড়তাকে সরিয়ে মুক্তচিন্তার জন্ম দেয়, সে তো শুধু পুরুষের জন্য হতে পারে না। ইসলাম তাই শিক্ষার কথা বলছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য। মনে রাখতে হবে মহম্মদ (সঃ)-এর কাছে প্রথম দীক্ষিত মুসলমান একজন নারী — তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রাঃ)। আর প্রথমবার আজানের ধ্বনি উচ্চারণের কৃতিত্ব তিনি দিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসকে, যার নাম হজরত বেলাল (রাঃ)। শুধু তাই নয়, সাম্যের পরাকাষ্ঠা হাতে ইসলাম নারীকে দিয়েছে মতপ্রকাশের ধর্মীয় তথা আইনি স্বাধীনতা, যার প্রথম প্রস্ফুটন নারীর জীবনসঙ্গী নির্বাচনে। ইসলামই প্রথম নারীর প্রত্যক্ষ সম্মতি ছাড়া বিবাহকে অবৈধ ঘোষণা করে।এমনকি, বিবাহে নারীর সম্মতি আছে কিনা তা যাচাই করার জন্য উপযুক্ত সাক্ষী থাকলে তবেই ইসলামি ‘নিকাহ হালালা’ (বৈধ বিবাহ) সম্ভব। যে তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিয়ে এত বিতর্ক, তার কোনও সমর্থন কোরানের কোথাও নেই। ইসলামে তালাক এক অতি-জটিল প্রক্রিয়া, যা যথাযথভাবে পালিত হলে বেশিরভাগ বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়তো হতোই না। এমনকি, ‘খোলা তালাক’ নামে একপ্রকার তালাকের অধিকার নারীকেও দেওয়া হয়েছে। আর নারীর সম্পত্তির অধিকারে ইসলাম তো মহম্মদ (সঃ)-এর জীবদ্দশাতেই ধর্মীয় ও আইনি শিলমোহর দিয়েছে, যখন পৃথিবীর কোথাও তা হয়নি। হজরত মহম্মদ (স:)-এর সহধর্মিণী খাদিজা (রাঃ) নিজেই ছিলেন একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী, যাঁর সহায়কের ভূমিকাতে ছিলেন স্বয়ং মহম্মদ(সঃ)। নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিয়ে ইসলামের অবস্থান নিয়ে এইসব দৃষ্টান্ত কি কিছুই ঈঙ্গিত দেয় না?
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে আজকের মুসলিম নারীর যে সামাজিক অবস্থান তা কী সত্যিই ইসলাম-অনুসারী, না কি কায়েমি-পুরুষতন্ত্রের স্বেচ্ছাচার? এ প্রশ্ন আজকের সেকিউলার ভারতে মুসলমান সমাজের অভ্যন্তর থেকেই করার সময় এসেছে। কারণ, বাইরে থেকে গেল গেল রব তুলে চাপিয়ে দেওয়া কোনও প্রগতি দিয়ে কোনও দিন কোনও সমাজের কল্যাণ হয়নি। অবশ্য এ প্রশ্ন আজকের সেকিউলার ভারত তৈরির বহু আগেই উঠেছিল, কিন্তু তা সীমাবদ্ধ ছিল কতিপয় মুসলমান লেখক ও চিন্তাবিদের নিজস্ব পরিসরে। ১৩২৮ বঙ্গাব্দে ‘সাধনা’ পত্রিকায় (৩য় বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা) ‘নারীর অধিকার’ প্রবন্ধে আবুল হুসেন লিখছেন :
“যে ইসলাম নারী জাতিকে সবলে দাসত্বের শৃঙ্খল হইতে বিমুক্ত করিয়া পুরুষ সমাজে সমান স্থান করিয়া দিয়াছিল — যে ইসলাম জড়নারীর অন্তরে প্রাণের সাড়া, প্রাণের অনুভূতি জাগ্রত করিয়াছিল — যে ইসলাম নারীর দায়িত্ব জ্ঞান, ধর্ম্ম পিপাসাকে বর্ধিত করিয়া দিয়াছিল — সেই ইসলাম আজ কোন্ নীতির বশবর্তী হইয়া নারীজাতিকে ইউরোপের মধ্যযুগের নারীর অবস্থায় উপনীত করিল?…. কোন্ শক্তি বলে সে নারীকে সকল অধিকার হইতে বঞ্চিত করিয়া পাশবিক পর্দার মধ্যে আবৃত করিল? না,ইসলাম করে নাই। ধর্ম্মের বিধান, মহাপুরুষ মোহাম্মদের(দঃ) আদর্শনীতি সমস্তই বর্তমান আছে; তবে মোসলেম নামধারী পুরুষরাই জঘন্য প্রথার দাস হইয়া আদর্শ ভুলিয়া গিয়াছে।”
এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্য এটাই যে শুধু প্রশ্ন তুলেই এখানে দায় এড়ানো হয়নি, রীতিমতো উত্তরটাও স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছে। সেকিউলার ভারত জন্ম নেওয়ার এত বছর পরেও প্রশ্নগুলি মুসলমান সমাজের অভ্যন্তরে সমান প্রাসঙ্গিক নয় কি?
এ কথা ঠিক, এই সঙ্কীর্ণতা থেকে মুসলিম সমাজকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সম্প্রতি সরকারি-বেসরকারি কিছু উদ্যোগ চোখে পড়ছে। ভারত সরকারের তরফে মাদ্রাসার আধুনিকীকরণের জন্য ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে, যার পোশাকি নাম ‘Scheme of Modernization of Madrasa’। এমনকি, ২০০৪-এ তৈরি হয়েছে ‘National Monitoring Committee for Minorities’ Education’। কিন্তু রক্ষণশীল দেওবন্দি ঘরানা থেকে মুক্ত হয়ে দক্ষিণ-ভারতে মাদ্রসা শিক্ষা যেভাবে আধুনিকতাকে সঙ্গে নিয়ে যুগের সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করছে, তেমন দৃষ্টান্ত অবশিষ্ট ভারতে সার্বিকভাবে তেমন চোখে পড়ছে কই? রক্ষণশীল দেওবন্দি ঘরানার মাদ্রাসার পাঠক্রম সম্পর্কে অমুসলিমদের মধ্যে স্পষ্ট কোনও ধারণা নেই। স্বভাবতই তৈরি হয়েছে একটা সন্দেহ তথা মানসিক দূরত্ব। খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেখানে মূলত ইসলামি দর্শন ও যাপনরীতির পাঠ যতটা গুরুত্ব পায় তার সাপেক্ষে অন্যান্য দর্শনের তুলনামূলক পাঠ (যা মানসিক তথা বৌদ্ধিক প্রসারতার জন্য আবশ্যক) নেই বললেই চলে। অথচ কোরানে মহম্মদ(সঃ)-এর আবির্ভাবের পূর্বে আবির্ভূত অসংখ্য প্রচারকদের ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শকে সম্মানের সঙ্গে মান্যতা দেওয়া হয়েছে, যা কোরানীয় উদারতা তথা ইসলামি সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের প্রথম পাঠ (সুরা বাকারাহ : আয়াত ১৩৬, সুরা মায়েদা : আয়াত ৫১, সুরা হুজুরাত : আয়াত ১৩, সুরা রূম : আয়াত ৩২, সুরা মুমিনুন : আয়াত ৫৩, সুরা হজ : আয়াত ৬৭, সুরা রা’আদ : আয়াত ৭, সুরা নাহল : আয়াত ৩৬)। এইসব মাদ্রাসার পাঠক্রমে মূলত যেগুলির ওপর জোর দেওয়া হয় তা হল: ভাষা (প্রধানত আরবি), বিশ্বাস (আক্বিদা), নৈতিক চরিত্র(আকলাখ), ইতিহাস(তারিক), ইসলামি অধ্যাত্ম-যাপন (ফিক), কোরানকে স্মৃতিতে ধরে রাখা(হাফিজ), কোরান পাঠ (তাজিদ), এবং কোরান ও হাদিসের ব্যাখ্যা (তাফসির)। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদির হাত ধরে মধ্যযুগে ইসলামি রেনেসাঁর জ্বলন্ত উদাহরণ সত্ত্বেও আজকের মাদ্রাসা এসবকে যেটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে তা যুগের তুলনায় যথেষ্ট নয়। অথচ ইসলামি দর্শন ও যাপনরীতির পাঠকে সঙ্গে নিয়েই এসব সম্ভব।
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে এসেও তাই অমুসলিমদের চোখে মুসলমানদের পরিচিতি মূলত অশিক্ষিত ও হতদরিদ্র একটি সম্প্রদায় রূপেই। ২০০৫-এ গঠিত সাচার কমিটির রিপোর্ট দেখলেই বোঝা যায় এই বিশেষ জনগোষ্ঠীর কী করুণ হাল। তার সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো রয়েছে ধর্মীয় বিদ্বেষ। আর এই দ্বিমুখী কারণেই এদেশের জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশের ওপরে মুসলমান হলেও কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যদের মাত্র ৬ শতাংশ মুসলমান। কিন্তু বিচারাধীন বন্দিদের ২১ শতাংশ মুসলমান, আর সাজাপ্রাপ্ত জেলবন্দি কয়েদিদের ১৬ শতাংশই মুসলমান। অথচ যাদের হাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা তথা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করার অধিকার, সেই পুলিশের মাত্র ৮ শতাংশ মুসলমান। আর আইএএস, আইপিএস, আইএফএস মিলিয়ে মাত্র ৩.২ শতাংশ মুসলমান অফিসার। এই পরিসংখ্যান দেখে Centre for Study of Developing Societies (CSDS) আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে আইনসভা ও পুলিশ-প্রশাসনে জনসংখ্যার তুলনায় কম প্রতিনিধি থাকার কারণে মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব হওয়া অসম্ভব নয়।
তাই মুসলমান পরিচিতি মুসলমানদের ভার না কি ভর, এই পরিচিতি তার বাহন হবে না কি তাকে সে বহন করবে, তা নির্ভর করছে তার সার্বিক উন্নতির ওপর। কেমন সে উন্নতি? সেখানে ধর্মীয় যাপনের ইসলামি স্পিরিটের মৌলিক দিককে অবিকৃত রেখে তাকে আধুনিক, প্রতিশীল ও যুগোপযোগী হতেই হবে। তবেই সে ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের কাছ থেকে অনুগ্রহের পরিবর্তে পাবে সমমর্যাদা। এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে হয় মালয়েশিয়ার ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী মহাতির মহম্মদের সেই মোক্ষম কথা — “… only when Islam is interpreted so as to be relevant in a world which is different from what it was 1,400 years ago can Islam be regarded as a religion for all ages”। মনে রাখতে হবে এ কথা বলার সময় তিনি ইসলামের মূল স্পিরিটকে মোটেই বিসর্জন দিতে বলেননি।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? মধ্যপ্রাচ্যে “মুতাজিলা”-দের হাতে ইসলামি রেনেসাঁ তো বটেই, পরবর্তী কালে বিক্ষিপ্তভাবে হলেও পৃথিবীর নানা প্রান্তে ইসলামের মূল স্পিরিটকে অবিকৃত রেখে স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী তাকে নিজেদের যাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার যৌক্তিক চেষ্টা (কোরানের বিভিন্ন সুরা ও আয়াত নং উল্লেখ করে যার প্রতি ইসলামি সমর্থনের কথা আগেই বলেছি) যে হয়নি তা নয়। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, মালয়েশিয়ার মহাতির মহম্মদ ছাড়াও ইরানের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও সমাজকর্মী জামাল-আল-দিন-আল-আফগানি, মিশরের মাহমুদ আবদুহ, পাকিস্তানে মহম্মদ ইকবাল প্রমুখ এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক। তুরস্কের খিলাফত, সৌদি আরবের ওয়াহাবি ইত্যাদির অনুসরণে ইসলামের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সময়ের দাবি ও স্থানিক প্রয়োজনীয়তার মেলবন্ধনে ঊনবিংশ শতকের ‘সালাফি’ কার্যকলাপ সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে অবশ্যই কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে মুসলমান-অধ্যুষিত ৪৯ টি দেশ সহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা এ গ্রহের তৃতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর সাপেক্ষে এই বিক্ষিপ্ত উদ্যোগ যে যথেষ্ট নয় তা বলাই বাহুল্য।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ও তার সেকিউলার কাঠামো নির্মাণের বহু আগেই তুরস্কের খিলাফত ও আরবের ওয়াহাবি আন্দোলনের ইতিবাচক প্রভাব এ দেশের মুসলমানদের প্রভাবিত করেছিল। তাছাড়া পারস্যের সুফি প্রভাব ভারতের মাটিতে তৈরি করেছে ইন্দো-ইরানীয় সুফি-উদারতা, যা এ দেশের ভক্তি-আন্দোলনকে (কবীর, নানক, দাদু, রামদেব, চৈতন্য প্রমুখের উদারতা ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে) যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। পূর্ব-ভারতে, বিশেষত বাংলায় বাউলিয়া ও ফকিরি যাপন ও পিরবাদী পরম্পরাতেও তার বিশেষ প্রভাব। এই অঞ্চলে বনবিবি, দক্ষিণরাই, ওলাবিবি, সত্যপির ইত্যাদির পরম্পরায় হিন্দু-মুসলমানের যৌথযাপনের অসামান্য ছবি। পশ্চিম ভারতের খোজা ও বোহরা এবং উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের আহমদিয়া মুসলিম সমাজ তাদের কৃষ্টি ও যাপনে রক্ষণশীল শরিয়তি মুসলমানদের চেয়ে হিন্দু ও জৈনদের অনেক কাছাকাছি। কিন্ত এতকিছু সত্ত্বেও এ দেশে অ-মুসলিমদের চোখে মুসলমান পরিচিতিটাই থেকে গেছে তাদের ভারতীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে। এ বড়ো দুর্ভাগ্যের কথা।
তাই মুসলমান সমাজকে হাঁটতে হবে আরও অনেক পথ। ইসলামের মূল স্পিরিটকে সঙ্গে নিয়েই সম্পৃক্ত হতে হবে এ দেশের কৃষ্টির সঙ্গে। পাশ্চাত্য ভাষার ঘেরাটোপে আবদ্ধ না থেকে খ্রিস্টান সমাজ যেমন এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মাতৃভাষাকে ধর্মচর্চার ভাষা করে তুলেছে, সেভাবে মুসলমান ধর্মগুরুদেরকেও বুঝতে হবে প্রায়-নিরক্ষর কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কাছে মাতৃভাষা ছাড়া শাস্ত্রের নির্যাস পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। আর শাস্ত্রের নির্যাস অর্থাৎ মূল স্পিরিটকে যেদিন তারা মাতৃভাষায় বুঝবে, সেদিন আর কেউ কায়েমি স্বার্থে ইচ্ছে মতো তাদের মগজধোলাই করতে পারবে না। সেইসঙ্গে ভারতীয় মহাকাব্য ও সাহিত্যে নিহিত শিক্ষণীয় বিষয়গুলিকে তথাকথিত ধর্মবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে উঠে তাদের তরফে বুঝতে হবে যে তা মানুষেরই জন্য। ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় মুসলমান সমাজের যে আগ্রহ চোখে পড়ে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
মুসলমান সমাজের অভ্যন্তরে অনেক সমস্যার কথা স্বীকার করেও বলব, মুসলমান জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে ভারতীয় করে তুলতে পারেনি, না কি হিন্দুদের পর্বতপ্রমাণ কুন্ঠা তাদেরকে ভারতীয় না ভেবে শুধুই মুসলমান করে রেখেছে — এ এক জটিল প্রশ্ন। আর এর উত্তর এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মানসিক দূরত্ব ঘোচানোর মধ্যেই নিহিত। আর তার জন্য দরকার উভয় সম্প্রদায়ের তরফেই পারস্পরিক অজ্ঞতা দূর করে দুই ধর্মের নির্যাসকে বাহ্যিক আচার-বিবর্জিত হয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে উপলব্ধি করা। আর সেটা সম্ভব সংস্কারমুক্ত, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও চেতনার প্রসারে। ভারতের মতো ধর্মাশ্রয়ী দেশের মানসভূমিতে বিজ্ঞানবৃক্ষ রোপনের কাজটা তাড়াহুড়ো করে সম্ভব নয়। মানসভূমির ধরন ও তার উর্বরতা অনুযায়ী ধাপে ধাপে মুক্তজ্ঞানের চর্চা আবশ্যক।কোনও সাংস্কৃতিক বিপ্লব কখনও রাতারাতি হয় না। এ এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এরজন্য কোনও কায়েমি স্বার্থ ছাড়াই উপযুক্ত সদিচ্ছা নিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মুক্তমনা মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু বিজ্ঞান-ঋদ্ধ হলেই হবে না, এ দেশের ধর্মাশ্রয়ী মানসভূমির স্পর্শকাতরতা উপলব্ধি করে উভয় সম্প্রদায়ের ইতিহাস, দর্শন ও পৌরাণিক উপাখ্যানের মধ্যে নিহিত শিক্ষণীয় ও কল্যাণমুখী দিকগুলি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও শ্রদ্ধা থাকা জরুরি। মনে রাখতে হবে বিদ্যাসাগরের মতো আজীবন নাস্তিকও কিন্তু সমাজ-সংস্কারের স্বার্থে শাস্ত্রকে আত্মীকরণ করেই সেই শাস্ত্রের অপব্যাখ্যাকে রুখে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন ভারতবর্ষের সমাজ-শরীর ও ধর্মীয় মানস রাশিয়া, চিন, কিংবা পশ্চিমি বিশ্বের মতো নয়। এ দেশে সমাজবিপ্লব সংঘটন তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে বহু নাস্তিক বিদ্যাসাগরের দেখানো পথে না হেঁটে এ দেশের মাটি, কৃষ্টি তথা সমাজ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে যে ভুলটি করেছেন তার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি। কুসংস্কারের পলিতে জমে যাওয়া নদীর সংস্কার করতে গিয়ে নদীর চরিত্র চেনা আবশ্যক। নদীর পলি সরাতে নেমে নদীটাকেই ভুলে গেলে তা হবে আত্মহত্যা।
অর্থাৎ ভারতীয় মুসলমানের পরিচয়-সংকট তথা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের জটিল রসায়নের নেপথ্য যে মনস্তত্ত্ব, তাকে অমোঘ না ভেবে তার মূলোচ্ছেদ করার হাতিয়ার হল ভারতীয় মানসের সঙ্গে সংগতি রেখে সংস্কারমুক্ত সার্বিক শিক্ষা ও চেতনার জাগরণ। শিক্ষাই সমস্যার সমাধান — এ কথা শুনতে শুনতে ক্লিশে হয়ে গেলেও প্রয়োজনে এই বহুশ্রুত, ক্লিশে কথাগুলোই বার বার বলা দরকার, কারণ যে কথা আমরা যত বেশি জানি, সে কথা তত কম মানি। আর তা যদি শিক্ষা-বিস্তার সংক্রান্ত হয় তাহলে তো কথাই নেই। কারণ, “দেশকে মুক্তি দিতে হলে দেশকে শিক্ষা দিতে হবে, এ কথাটা হঠাৎ এত অতিরিক্ত মস্ত বলে ঠেকে যে একে আমাদের সমস্যার সমাধান বলে মেনে নিতে মন রাজি হয় না”। রবীন্দ্রনাথের এই আক্ষেপকে আজ কাটিয়ে ওঠার সময় এসেছে। তাই মন রাজি হতে না চাইলেও তাকে রাজি করাতেই হবে সেই শিক্ষা তথা মুক্তজ্ঞানের অধিকারী হতে। বদ্ধমনকে রাজি করাতে হবে মুক্তমনে পরিবর্তিত হতে। কারণ মুক্তমনই পারে এ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমানের পরিচয়-সংকট কাটিয়ে এ দেশেরই সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী হিন্দুর সঙ্গে তার মানসিক দূরত্ব ঘোচাতে এবং দেশকে সত্যিকার প্রগতির পথিক করতে ।
আজকের ভারত সেই শিক্ষা, সেই মুক্তমন তথা সংস্কারমুক্ত আত্মবীক্ষণের অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে।