সম্পূর্ণা মণ্ডল
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুলাই সুদূর ইউরোপের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় ‘Indian Independence Act’। অতি দ্রুত ১৮ জুলাই এই প্রস্তাব আইনে পরিণত হয়। এই আইন অনুযায়ী স্থির হয় দীর্ঘ দুশো বছরের অধীনতা শেষে ভারতবর্ষে ‘ক্ষমতার হস্তান্তর’ হবে, অর্থাৎ ভারতবর্ষ তার রাজনৈতিক স্বাধীনতা ফিরে পাবে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা হবে দ্বি-খণ্ডিত। অর্থাৎ অবিভক্ত ভারতের মুসলিমপ্রধান প্রদেশ সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ববাংলা নিয়ে গঠিত হবে পৃথক একটি স্বাধীন দেশ যার নাম হবে ‘পাকিস্তান’, আর অবশিষ্ট অংশ নিয়ে গঠিত হবে স্বাধীন ভারতবর্ষ। এইভাবেই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিভাজনের নীতি অনুযায়ী ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামে দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের। ব্রিটিশ ভারতে ‘Divide & Rule’ নীতির হাত ধরে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল দেশভাগের কয়েক দশক পূর্ব থেকেই। এর সহজ সমাধান হিসেবে এবং নিজেদের রক্ষণশীল রাজনীতির স্বার্থে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় মুসলমানদের জন্য ভারত ভাগ করে পাকিস্তান নামক দ্বিতীয় রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করে, যাকে সমর্থন করে আমাদের দেশীয় নেতৃত্বের প্রথম সারির একাংশের রাজনীতিবিদরা। কিন্তু কাগজে-কলমে যে বিভাজন অত্যন্ত সহজ সমাধান, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েও তা কি ততটাই সহজ — এই সাধারণ সত্যটাই বুঝতে পারেননি অভিজ্ঞ ব্রিটিশ ভাইসরয়-গভর্নর জেনারেলরা এবং ক্ষমতাকামী ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিমলিগ নেতৃত্ববর্গ। হয়তো বুঝেছেন, কিন্তু ক্ষমতার দর কষাকষি ছিল চালিকা শক্তি। পরিণতি স্বরূপ দেশভাগের খবরে সীমান্তের দুই দিকেই শুরু হয় প্রবল দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক হানাহানি। দেশভাগ বাধ্য করল ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে রাতারাতি লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান মানুষকে নব্য নির্মিত সীমান্তের বিপরীত দিকে নিঃস্ব হয়ে চলে যেতে, নিজেদের বাড়ি-ঘর, পরিবার-প্রতিবেশী সবকিছু পিছনে ফেলে। সরকারি পরিসংখ্যান বলে দেশভাগের সময় প্রায় এক-দেড় কোটি মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হন, দাঙ্গায় নিহত হন প্রায় দশ লক্ষ মানুষ। বাস্তবে এই সংখ্যাটা যে আরও অনেক বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দেশভাগের এই বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশেই, কিন্তু তা সবচেয়ে করুণ হয়ে উঠেছিল বঙ্গপ্রদেশে। ইতিহাসের এক অদৃশ্য নিয়মেই বোধ হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল যে বঙ্গদেশে, সাম্রাজ্যবাদের শেষ কামড়ও এসে পড়েছিল সেই বঙ্গদেশেই। ১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় বঙ্গবিভাজন ও তার নতুন সীমান্ত নির্ণয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন প্রাক্তন ব্রিটিশ বিচারক স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ-কে। যিনি পূর্বে কখনও ভারতে আসেননি, বাংলা তথা ভারতবর্ষ সম্পর্কে, তার ভৌগোলিক সীমানা সম্পর্কে যার কোনও ধারণা ছিল না, এমনকি যিনি ম্যাপ পড়তেও নাকি জানতেন না। সর্বোপরি বঙ্গবিভাজনের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সময়ও তার হাতে ছিল না। তার এই যাবতীয় অজ্ঞতার ফলস্বরূপ র্যাডক্লিফ কমিশন রিপোর্ট অনুযায়ী বঙ্গপ্রদেশকে দু-ভাগে ভাগ করে মুসলমান প্রধান পূর্ববঙ্গকে জুড়ে দেওয়া হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে, আর পশ্চিমবঙ্গ থাকল ভারতে। পাকিস্তান (পশ্চিম) রাষ্ট্রের মূল ভূমিখণ্ডের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের দূরত্ব ছিল প্রায় ১২-শ মাইলেরও বেশি। ছিল না কোনও ভাষাগত বা সংস্কৃতিগত ঐক্য। তবুও শুধুমাত্র ধর্মের দাবিতে পূর্ববঙ্গকে রাতারাতি করে তোলা হয় পূর্ব-পাকিস্তান। পূর্ববাংলায় বসবাসকারী মুসলমান বাঙালির নতুন পরিচয় হয় ‘পূর্বপাকিস্তানি’, আর পূর্ববঙ্গের হিন্দু বাঙালি তার নিজের দেশ হারিয়ে, নিজের পরিচয় হারিয়ে হয় ভারতবর্ষে উদ্বাস্তু। এর মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ধর্মের শিকল ছিন্ন করে ভাষা ও সংস্কৃতির দাবি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে পূর্বপাকিস্তান এক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে — তার নাম আজ বাংলাদেশ। আজও পাশাপাশি অবস্থান করছে পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ববঙ্গ, কিন্তু তাদের পরিচয় বদলে গেছে — একজন ভারতবর্ষ, অপরজন বাংলাদেশ।
এই দেশভাগ বিশেষত বাংলা বিভাগের এই বেদনাদায়ক স্মৃতি বারবার উঠে এসেছে দুই বাংলার শিল্প ও সাহিত্য জগতে, কবি-সাহিত্যিকদের কলমে। শুধু শিল্প-সাহিত্য জগৎ নয়, দুই বাংলার চলচ্চিত্র জগৎও নিজেদের ক্যামেরায় বন্দি করতে চেয়েছে দেশভাগের সেই মর্মান্তিক অধ্যায়গুলিকে। তানভীর মোকাম্মেল (বর্তমানে ‘বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সস্টিটিউট’-এর পরিচালক ও বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক) পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্র ‘সীমান্তরেখা’ (২০১৭) সেই রকমই এক প্রচেষ্টা, যেখানে কোনও নির্দিষ্ট কাহিনি (script) অবলম্বন করে নয়, ৪৭-এর বিভাজন যাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছিল, রাতারাতি যাদের দেশ, পরিচয় কেড়ে নিয়ে করে তুলেছিল ‘উদ্বাস্তু’, দুই বাংলার সেইসব নিজের দেশ-হারানো মানুষেরা সামনে এসেছেন নিজমুখে তাঁদের দেশভাগের নিদারুণ কাহিনি নিয়ে, নিজেদের ব্যক্তিগত সব অভিজ্ঞতা নিয়ে। চলচ্চিত্রকারের কথায় — “কি এই সীমান্তরেখা? এ কি কেবলই এক কাঁটাতারের বেড়া? নাকি এ ভারত ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মাঝে এক বিভাজনরেখা? নাকি হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যেকার বিভাজনরেখা? নাকি পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের মাঝে আচরণগত যেসব পার্থক্য রয়েছে — তাই? নাকি আমাদের মনোজগৎ-এ বিরোধের এমন কোনও অদৃশ্য রেখা আছে যা আমাদেরকে মিলতে দেয় না….।” এই প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এসেছে দুই বাংলার (ভারতবর্ষের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র) বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন মানুষের বক্তব্য। সাধারণ মানুষ থেকে শিল্পী-সাহিত্যিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন ব্যক্তি থেকে উদ্বাস্তু ক্যাম্পে বসবাসকারী — প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে দেশভাগের অভিঘাত আজও কতটা নিদারুণভাবে জেগে রয়েছে, নিজের চিরপরিচিত বাড়ি-ঘর, নদী-মাঠ-গাছপালা সহ ফেলে আসা মাতৃভূমি সম্পর্কে স্মৃতির নস্ট্যালজিয়া আজও কতটা অমোঘ — ‘সীমান্তরেখা’-র প্রতিটি মুহূর্তে তা ধরা দিয়ে যায়। প্রায় ২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট ব্যাপ্ত এই প্রামাণ্যচিত্রের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি মানুষের অভিজ্ঞতার বিপুল স্রোতকে এই স্বল্পায়তনিক রচনায় তুলে ধরা হয়তো সম্ভব হবে না, কিন্তু যতখানি সম্ভব ‘সীমান্তরেখা’-র হাত ধরে মানুষের ‘উদ্বাস্তু’ পরিচয়ের কিছু কাহিনি, কিছু অধ্যায় থাকল।
ক্যাম্পের উদ্বাস্তু
বঙ্গবিভাজনের পর দুই বাংলা থেকেই সদ্য দেশ হারানো মানুষেরা নব্যনির্মিত সীমান্তের বিপরীত দিকে পাড়ি দেয়। পশ্চিমবাংলা থেকে কয়েক লক্ষ মুসলমান মানুষ চলে যায় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলাগুলিতে। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ থেকেও লক্ষ লক্ষ হিন্দু পরিবার (১৯৫৪-র আদমশুমারি অনুযায়ী প্রায় ২৬ লক্ষ হিন্দু মানুষ) চলে আসে ভারতে। ভারতে তাদের নতুন পরিচয় হয় ‘উদ্বাস্তু’। চলচ্চিত্রকারের কথায় — “বাঙালির সামাজিক ইতিহাসে, রাজনীতি ও শিল্প-সাহিত্যে একটা নতুন শব্দ যোগ হল — উদ্বাস্তু।” তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা উদ্বাস্তু ক্যাম্প বা উদ্বাস্তু কলোনিগুলিতে। এরকমই একটি ক্যাম্প ছিল রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প, যেখানে একসময় পূর্ববঙ্গ থেকে আসা লক্ষাধিক উদ্বাস্তু মানুষ থাকতে বাধ্য হয়েছিল। বলাবাহুল্য একজন মানুষের বসবাসের উপযোগী কোনও ব্যবস্থাই লক্ষাধিক উদ্বাস্তুদের জন্য নির্দিষ্ট এই ক্যাম্পে ছিল না। বাসিন্দাদের কথায় যেভাবে পশুরাও থাকতে পারে না, সেভাবে লক্ষাধিক মানুষকে থাকতে হয়েছিল এই ক্যাম্পে। সে সময়ের বাসিন্দা অশোক চক্রবর্তী-র গলায় উঠে আসে সেই করুণ অবস্থার ছবি — “….. পায়রার খোপের মতো করে করে অল্প অল্প জায়গার মধ্যে, না বাথরুমের অ্যারেঞ্জমেন্ট, না টয়লেটের অ্যারেঞ্জমেন্ট, কোনও অ্যারেঞ্জমেন্ট ছিল না। ওরই মধ্যে রান্না, ওর মধ্যেই ধোয়া, ওর মধ্যেই পড়াশোনা।” অস্বাস্থ্যকর পরিস্তিতিই ছিল কুপার্স ক্যাম্পের জীবনযাত্রা। পশ্চিমবঙ্গের আরও একটি বিখ্যাত উদ্বাস্তু ক্যাম্প ছিল ধুবুলিয়া ক্যাম্প। এই ক্যাম্পও একসময় ছিল লক্ষাধিক উদ্বাস্তু মানুষের আশ্রয়। এছাড়া ছিল সরকারি সৃষ্ট কিছু উদ্বাস্তু ক্যাম্প। যেমন অশোকনগর কলোনি। আর কিছু ছিল উদ্বাস্তুদের জবরদখল করা কলোনি। দক্ষিণ-কলকাতার যাদবপুরের বিজয়গড় কলোনি সেইরকম একটি। প্রথমে এর নাম ছিল ‘যাদবপুর বাস্তুহারা পল্লি’। এই কলোনিটি ছিল সারা ভারতবর্ষের মধ্যে উদ্বাস্তুদের প্রথম জবরদখল করা কলোনি। ধীরে ধীরে এর আশেপাশে তৈরি হয় আরও উদ্বাস্তু কলোনি। যেমন — অরবিন্দনগর, সমাজগড়, গান্ধি কলোনি, শ্রী কলোনি, বাঘা যতীন। বিজয়গড়ের বাসিন্দা তুষার সিংহ-এর স্মৃতিতে উঠে আসে — “এগুলো সব পতিত জমি ছিল, জলা-জমি ছিল, জঙ্গলে ভর্তি, সাপ-খোপ-খটাশ-জন্তু-জানোয়ারে ভর্তি ছিল।” পরিত্যক্ত এই সব অঞ্চলগুলিই ছিল উদ্বাস্তুদের নতুন বাসস্থান। বেশিরভাগ ক্যাম্পগুলি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ও আমেরিকার সেনাবাহিনীর জন্য নির্মিত সেনাছাউনি বা রসদাগার। দেশভাগের পর পরিত্যক্ত এই ক্যাম্পগুলিই হয়ে ওঠে উদ্বাস্তু মানুষদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। এই দেশভাগ যাদের ক্যাম্পের উদ্বাস্তু করে তুলেছিল, তাদের পূর্বে একটা স্বাভাবিক জীবন ছিল, আত্মীয়-পরিবার নিয়ে বাস ছিল নগরে বা গ্রামে, ছিল অস্তিত্ব, ছিল পরিচয়। তার বিপরীতে এই ক্যাম্পগুলিতে ছিল না একজন মানুষের সুস্থভাবে জীবনে বেঁচে থাকার ন্যূনতম দৈনন্দিন পরিষেবা, ছিল না কোনও স্বাস্থব্যবস্থা। টিবি, কলেরা, বসন্ত রোগ সহ মহামারির নানা রূপ ছিল ক্যাম্প জীবনের নিত্যসঙ্গী। বেঁচে থাকার সংকট ছিল প্রতিমুহূর্তে সেখানে। কিন্তু শুধুই কি টিকে থাকা, সেখানে ছিল অস্তিত্বের সংকট, পরিচয়ের সংকট। কবি সত্য গুহ, তিনি ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন, তাঁর কথায় — “দেশবিভাগ করে যারা এসেছিলেন নারীর সতীত্ব এবং ধর্ম রক্ষা করার জন্য…..রিফিউজি কলোনিগুলিতে তা নষ্ট হয়েছে। তারপর শেষে ধর্ম, শালগ্রাম শিলা সে ভিক্ষার উপকরণ হয়েছে। ট্রেনে ট্রেনে ঐ শালগ্রাম শিলা নিয়ে তারা ভিক্ষা করেছে। তাহলে ধর্ম কোথায়? ধর্মও নেই, সতীত্বও নেই। এককথায় বলা যেতে পারে দেশভাগের কু-ফলটা কি? কুফলটা হচ্ছে নীতি-নৈতিকতার বিসর্জন।” দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু জীবনের এক মর্মন্তুদ পরিচয়। ধর্মরক্ষার্থে, সম্মানরক্ষার্থে, সর্বোপরি জীবনরক্ষার্থে যে মানুষেরা একসময় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, উদ্বাস্তু জীবনে তার কোনও কিছুই তারা রক্ষা করতে পারেননি। দেশভাগের সময় ধর্ম ও রাজনীতির যৌথ আক্রমণ শুধুমাত্র যা পেরেছিল তা হল — মানুষের মনুষ্যত্বের অপচয় এবং পরিচিতির সংকট সৃষ্টি।
এছাড়া ছিল পিএল ক্যাম্প বা ‘permanent liability camp’। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ থেকে আসা সেইসব উদ্বাস্তু মানুষদের থাকার ক্যাম্প, যাদের আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। আমৃত্যু তাদের এইসব ক্যাম্পগুলিতেই থেকে যেতে হবে। বর্তমানে এরকম একটি ক্যাম্প হল উত্তরপাড়ার ভদ্রকালী ক্যাম্প। দাঙ্গার পর, চোখের সামনে প্রিয় মানুষগুলির হত্যাকাণ্ডের বীভৎস স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে এপার বাংলায় চলে আসা মানুষদের মধ্যেএকদল বৃদ্ধা নারী এখনও এই ক্যাম্পের বাসিন্দা। আজ প্রায় চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে তারা এই ক্যাম্পে বাস করছেন। কাজ করে খাবার মতন শারীরিক সামর্থ্য তাদের আর কারও নেই, সরকারি সাহায্যটুকুই বর্তমানে তাদের একমাত্র সম্বল। আর তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা? গঙ্গার পাড়ে শেষ আশ্রয়টুকু খুঁজে নেওয়া।
পুনর্বাসন প্রকল্প
এ তো গেল উদ্বাস্তু শিবিরগুলির কথা, এরপর আসা যাক পুনর্বাসন প্রকল্পগুলিতে। পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের আরও ১৮ টি অঙ্গরাজ্যে পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে ভারত সরকার। সরকারি হিসেবে প্রায় ২ কোটি ৬৫ লক্ষ মানুষকে এই ১৮টি রাজ্যে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। বর্তমান উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হিমালয়ের পাদদেশের পাহাড়-জঙ্গলে পূর্ণ নৈনিতাল ছিল সেইরকম একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র। বর্তমানে নৈনিতালে পুনর্বাসন পাওয়া উদ্বাস্তু মানুষরা বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন। পেশার পরিবর্তন ঘটেছে স্থান-কাল অনুযায়ী। পূর্ববঙ্গের জলের দেশের যেসব মানুষেরা মূলত জেলে হিসেবে জীবিকা পালন করত, নৈনিতালে পুনর্বাসন পাওয়া সেইসব উদ্বাস্তু মানুষেরা এখন চাষবাসে নিযুক্ত হয়েছে। থাকার জন্য বাড়ি, চাষের জন্য জমি, ব্যবসার জন্য দোকানঘর পেয়েছে তারা, পেয়েছে খানিকটা স্থিতি। দেশভাগের বেদনা তাদের মনে সময়ের অনেক স্রোত পেরিয়ে এসে আজ হয়তো অনেকটা স্থির, কিছুটা নিরুত্তাপ। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় পরবর্তী প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কথা — তারা কি নিজেদের ফেলে আসা দেশে আর ফিরে যেতে চায়? উত্তরে তারা বলেন — “ওরা সেসব উচ্চারণও করে না। ওদের জন্ম এখানে, ওরা জানে এটাই ওদের জন্মভূমি, এটাই ওদের মাতৃভূমি।” কিন্তু এই আপাত স্থিতিটুকু সব নয়, সংকট এখানেও রয়েছে, সমস্যা রয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে। শিক্ষাক্ষেত্রে এখানে বাংলা ভাষা নেই, রাষ্ট্রভাষা হিন্দি সেখানকার শিক্ষার মাধ্যম। স্কুলের পড়াশোনা হোক বা সরকারি, প্রশাসনিক কাজকর্ম — সবক্ষেত্রেই হিন্দি ভাষা। তাই নৈনিতালে পুনর্বাসন পাওয়া বাঙালিদের ভয় একটা কি দুটো প্রজন্মের পর তাদের এই বাংলা ভাষা, সংস্কৃতির আর কিছুই থাকবে না। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের মূল শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। তারা জানে মানুষের পরিচয় তার ভাষায়, তার সহজাত সংস্কৃতির প্রকাশে। কিন্তু এই সুদূর নৈনিতালে এসে এর কোনও কিছুকেই তারা ব্যক্ত করতে পারছে না। নৈনিতাল পুনর্বাসন প্রকল্প পূর্ববাংলার উদ্বাস্তু বাঙালিকে গৃহের আশ্রয় ফেরাতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু তার ভাষা-সংস্কৃতির, পরিচিতির সহজাত প্রকাশের পথ করে দিতে পারেনি।
নৈনিতাল ছাড়াও পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য মূলত মধ্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও ওড়িষ্যার এক বিশাল অংশ নিয়ে গড়ে তোলা হয় দণ্ডকারণ্য উদ্বাস্তু শিবির। বর্তমানে দণ্ডকারণ্যে বাস করে প্রায় তিন লক্ষের মতো পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষ। দণ্ডকারণ্য, রামায়ণ-এর সেই জঙ্গল যেখানে রাম-সীতাকে বনবাস দেওয়া হয়েছিল। আর পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে মূলত নিম্নবর্ণের মানুষদের দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হয়। নৈনিতাল পুনর্বাসন প্রকল্পের মতো দণ্ডকারণ্যেও উদ্বাস্তুদের সরকারি তরফে দেওয়া হয়েছে ঘর, চাষের জমি। কিন্তু দেশভাগ যা কেড়ে নিয়েছে তা কি আর ফিরে পাওয়া যাবে? দণ্ডকারণ্যের বাসিন্দাদের গলায় সেই বেদনার সুর — “পিতৃভিটা আমাদের ছেড়ে আসতে হল, এ কি শখে আসছি আমরা? বড়ো আঘাত নিয়ে আসছি, সে আঘাত মিটার মতো নাই।” পূর্ববঙ্গের নরম মাটির দেশের মানুষেরা দণ্ডকারণ্যের উত্তপ্ত আবহাওয়ায়, রুক্ষ, অনুর্বর প্রায় মরুভূমির মতো জমিতেও কঠোর পরিশ্রমে ফসল ফলাতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের হৃত পরিচয়ের শেকড় দণ্ডকারণ্যের মাটিতে আর কি ফিরে পাওয়া যাবে?
শুধু দণ্ডকারণ্য নয়, পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের পাঠানো হয় সাগর পেরিয়ে প্রায় কয়েক শত মাইল দূরে জনবসতিহীন আন্দামানে। যেখানে খাদ্য-পানীয়ের সেরকম কোনও ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না রাস্তা-ঘাট বা যাতায়াতের পরিষেবা, প্রায় জঙ্গলে পরিপূর্ণ আন্দামান। সেই আন্দামান যেখানে ব্রিটিশ আমলে রাজদ্রোহীদের পাঠানো হত, রাজবন্দিদের আমৃত্যু কয়েদ করে রাখা হত। বর্তমানে আন্দামানেও বাস করে প্রায় লক্ষাধিক উদ্বাস্তু মানুষ। তাদের জীবিকা চাষবাস থেকে পশুপালন, কাঠের আসবাব তৈরি থেকে মাছধরা — সবকিছুই। প্রায় কয়েক দশক এখানে বসবাস করে আন্দামানে নিজেদের একরকম করে মানিয়ে নিয়েছে এই উদ্বাস্তু মানুষেরা। না, আর কখনোই কলকাতার দিকে ফিরে যেতে চায় না তারা। তাদের কথায় — “যার যেখানে জন্মভূমি সেটাই তার স্বর্গ” — যখন সেই স্বর্গ ছেড়ে আসতেই হয়েছে, সেখানে ফিরে যাবার আর কোনও উপায় নেই, তখন কলকাতা বা আন্দামান-বিশেষ কোনও তফাত নেই। সুখের কথা হল দেশভাগের সেই কঠিন দিনগুলি পেরিয়ে, উদ্বাস্তু জীবনে আন্দামানে পুনর্বাসন পাওয়া মানুষেরা পায়ের তলায় আবার কিছুটা শক্ত মাটি পেয়েছেন। কিন্তু সংস্কৃতির সংকট, পরিচিতির সংকট এখানেও রয়েছে, রয়েছে রাষ্ট্রভাষার আধিপত্য। পূর্ববঙ্গ থেকে, নিজেদের বাস্তুভূমি থেকে কয়েক শতমাইল দূরে আন্দামানে এসে বাঙালি ছেলেমেয়েরা স্কুলে বাংলা পড়ার সুযোগ পায় না, তাদের শিখতে হয় হিন্দি ভাষা। এই ভাষিক, সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাও দেশভাগের যন্ত্রণার মতোই সমান তীব্র, জ্বালাময়।
আসাম ও ত্রিপুরায় দেশভাগের প্রভাব
দেশভাগের সময় পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে তৎকালীন ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত যাবতীয় প্রতিশ্রুতির প্রায় প্রতিটি পালন করা হয়েছিল। ফলে দেশভাগের পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যেই এইসব উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পুনর্বাসন সম্ভব হয়েছিল, যা হয়নি পূর্ববাংলা থেকে আসা বাঙালি উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে। তৎকালীন ভারত সরকারের আশা ছিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এই উদ্বাস্তুরা নিজেরাই পূর্ববঙ্গে তাদের ফেলে আসা বাড়ি-জমিতে ফিরে যাবে। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষ্য বলে বাস্তবে তা হয়নি। এই লক্ষ লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তুরা আর কোনও দিনই ফিরে যেতে পারেনি তাদের বাস্তুভূমিতে। ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি কখনোই আর তৈরি হয়নি সীমান্তরেখার ওপারে। ফলস্বরূপ শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পূর্ববঙ্গের আরও একটি সীমান্তবর্তী অঙ্গরাজ্য আসামেও বিপুল সংখ্যক পূর্ববঙ্গত্যাগী মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল দেশভাগের পর। বর্তমানে আসাম ও বাংলাদেশের মাঝে বিশাল ব্রহ্মপুত্র সীমান্ত নির্ণয় করেছে, তার এক তীরে আসামের ধুবরি, বিপরীত দিকে বাংলাদেশ। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পূর্ববঙ্গত্যাগী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি আসামে। বর্তমানে পূর্ববঙ্গের কঠোর পরিশ্রমী মানুষেরা আসামের কৃষিক্ষেত্রে রেখেছে ব্যাপক অবদান, তৈরি করেছে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয়। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র।দেশভাগের পূর্বে থেকেই আসামে একটি বড়ো অংশের মুসলমান সমাজ বাস করত, এরা মূলত ছিল বাংলাভাষী। দেশভাগের ফলে যখন দলে দলে হিন্দু উদ্বাস্তু পূর্ববঙ্গ থেকে আসামে আসতে শুরু করে, দেশভাগের খবরে আসামেও শুরু হয় সাম্প্রদায়িক হানাহানি, তখন এই আসামে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমানদের একটা বড়ো অংশ বাধ্য হয় নিজেদের ‘অসমিয়া’ হিসেবে পরিচয় দিতে। এই অসমিয়াকরণের ফলে একদিকে তারা যেমন তাদের ভাষিক পরিচয় হারায়, অন্যদিকে তাদের ধর্মীয় পরিচিতি নিয়েও শুরু হয় দ্বন্দ্ব। ফলে তারা উভয় দিক থেকে দুর্বল হতে শুরু করে। এই ভাষিক সংকট, পরিচিতির সংকট আজও বর্তমান। এই ভাষিক সংকট থেকে আসামে ঘটে ৬১-র ভাষা আন্দোলন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে আসামে বাংলা ভাষার আন্দোলন বরাক উপত্যকায় স্কুল-কলেজ সহ যে-কোনও সরকারি-প্রশাসনিক কার্যালয়ে বাংলা ভাষা ব্যবহারের অধিকার আদায় করে নেয়। বাকি আসামে কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। ফলস্বরূপ বর্তমানে আসামে বসবাসকারী বাঙালি ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই অসমিয়া শিখছে, শিখতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমে কমে আসছে।
শুধু আসাম নয়, প্রায় একই ছবি ধরা পড়ে নিকটবর্তী রাজ্য ত্রিপুরাতেও। দেশভাগ কেবল দুই বাংলার মধ্যেই বিভাজন রেখা টেনেছিল তাই নয়, ত্রিপুরা ও পূর্ববাংলার মধ্যেও তৈরি হয়েছিল তেমনি একটি সীমান্তরেখা। দেশভাগের সময় ত্রিপুরার অন্তর্গত বেশ কিছু অংশ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। এরফলে একদিকে যেমন ত্রিপুরার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ত্রিপুরার সংস্কৃতি। ত্রিপুরার সঙ্গে পূর্ববঙ্গের একটা ভাষিক বা সাংস্কৃতিক যোগ পূর্ব থেকেই ছিল। দেশভাগের সময় ত্রিপুরার নিকটবর্তী পূর্ববঙ্গের জেলাগুলি থেকে একটা বড়ো অংশের উদ্বাস্তু মানুষ তাই এসেছিল ত্রিপুরাতেও। বর্তমানে ত্রিপুরার আদি জনবাসী, বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মাঝে এই উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানুষেরা প্রায় মিলেমিশে গেছে। পূর্ববঙ্গের গান, কবিতা, লোকসংগীত ত্রিপুরার পথে-ঘাটে এখন অনায়াসে শুনতে পাওয়া যায়। পূর্ববঙ্গের জল-কাদা-কৃষির দেশ থেকে আসা মানুষেরা শুধু ত্রিপুরার কৃষিক্ষেত্রে উন্নতি ঘটিয়েছে তাই নয়, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে ত্রিপুরার শিক্ষাক্ষেত্রেও রেখেছে গুরুত্বপুর্ণ অবদান।
দেশভাগ ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ
দেশভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে, হিন্দুর জন্য আলাদা দেশ — ভারতবর্ষ, মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র দেশ — পাকিস্তান। এই ছিল দেশভাগের গোড়ার কথা। কিন্তু বঙ্গবিভাজনের ক্ষেত্রে দেখা যায় দেশভাগ এমন অনেক মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করেছিল যারা ছিলেন হিন্দু বা মুসলমান — এই দুই সম্প্রদায়েরই বাইরে। অবিভক্ত বাংলাদেশে গারো, হাজং, সাঁওতাল, খাসিয়া, মুন্ডা — প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ ছিলেন যারা দেশভাগের সময় পূর্ববাংলা ছাড়তে বাধ্য হন। মূলত ব্রিটিশ ভারতে নীলচাষকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গে এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসতি গড়ে তোলে। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, খুলনা, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলে এখনও কিছু কিছু এইসব আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ থেকে গেলেও, দেশভাগের সময় বিশেষত পাকিস্তান ঘোষণার পর এই আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির বৃহত্তর অংশ প্রবল অত্যাচারের সম্মুখীন হয় এবং পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয় বেঁচে থাকার অনিস্তার তাগিদে, নতুন জঙ্গলের খোঁজে। জনগণনা অনুসারে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৮ লক্ষের মতো মুন্ডা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাস করেন, যার বেশিরভাগই দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গ থেকে আগত।
নতুন পরিচিতির নির্মাণ
দেশভাগ কেবল বৃহত্তর অর্থে একদল মানুষের কাছে তার দেশের পরিচয়, তুমি কোন্ দেশের নাগরিক — এই পরিচয়কেই বদলে দেয়নি। এই দেশভাগ কিছু দেশ হারানো মানুষকে তার নিজের বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়েও বৃহত্তর সামাজিক বৃত্তে তার পরিচয় কী, তার অবস্থান কোথায় এই নতুন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিল। পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে আসা মানুষদের মধ্যে এরকম এক ঝাঁক মানুষ ছিলেন যাঁরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী — মানুষের কাছে অতি পরিচিত মুখ। এই মানুষদের মধ্যে একটা বড়ো অংশ যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে এসে নিজেদের চাকরিজীবন, কর্মজীবনের মধ্য দিয়ে এক নতুন পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দেশভাগ এক নতুন পরিচয় নির্মাণের পথে তাঁদের এগিয়ে দিয়েছিল। কবি মণীন্দ্র গুপ্ত-র কথায় — “আমাদের দেশ কোনও ভাবে ছাড়তেই হত। তার কারণ হচ্ছে আমাদের ওখানে ওটা তো গ্রামদেশ, বরিশাল এমন কোনও বড়ো শহর ছিল না। চাকরি-বাকরি কম ছিল। কিন্তু আমাদের চাকরি করে খাওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। সুতরাং আমাদের চাকরির সন্ধানে বাইরে বাইরে ঘুরতেই হত। বেশিরভাগই কলকাতায় হত, কলকাতার বাইরে যেত অনেকে।” অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণির চাকরির সুযোগ পূর্ববঙ্গে সেভাবে ছিল না, সেটা ছিল মূলত পশ্চিমবঙ্গেই। ফলে এই মানুষগুলিকে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে আসতেই হত। দেশভাগ পূর্ববঙ্গের এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণির ক্ষেত্রে এক নতুন পরিচয়ের নির্মাণকে যেন গতি দিয়েছিল। সেই কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় মৈত্রেয়ী সরকার-এর গলায় — “দেশভাগের পর আমাদের যেটা মনে হল যে আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। চাকরি — শুধু পড়াশোনা নয়, এরপর একটা চাকরিতে ঢুকতে হবে। বাবার বয়স হয়েছে, আমরা এতগুলো ভাই-বোন, ছোটোরাতো বেশ ছোটো। আমি দেশে থাকলে বা ঢাকায় থাকলে হয়তো এটা হতো না। কিন্তু এখানে এসে তো দরজাটা খুলে গেছে, অনেকখানি বড়ো, কোথায় যেতে পারি, কতদূর কী করতে পারি সেই সম্বন্ধেও একটা ধারণা হয়েছে এবং সেই কারণেই আমাদের সেইদিক থেকে সত্যিকারের উপকাররই হয়েছে, কোনও অসুবিধা হয়নি।”
বিপরীত দিকের ছবিটাও খানিক একই রকমের। অবিভক্ত বঙ্গদেশে শিক্ষা-দীক্ষা বা চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে মূলত আধিপত্য ছিল হিন্দু বাঙালির। মুসলমান বাঙালি সমাজ ছিল অনেক পিছনে। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-র মতে — “যারা চলে এলেন, তাদের ক্ষতি হল কোনও সন্দেহ নেই। যেমন ডাক্তার, যেমন উকিল, যেমন ইস্কুলের টিচার — এরকম কতকগুলো পেশা, যেগুলো মধ্যবিত্তদের পেশা। পূর্ববঙ্গে এই পেশাগুলো মূলত দখল করে ছিলেন হিন্দুরা। তারা চলে আসার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হল, ওই ভ্যাকুয়ামটা পূরণ করলেন কিন্তু মুসলিম সমাজের ওই বয়সের ছেলেমেয়েরা।” দেশভাগ মুসলমান বাঙালির জন্য পূর্ববঙ্গে শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে যেমন সহায়তা করেছিল, তেমনি পূর্ববাংলার মুসলমান বাঙালির সর্বাঙ্গীণ বিকাশকে অনেকটাই ত্বরান্বিত করেছিল। পূর্ববঙ্গের মুসলমান বাঙালি সমাজের বিকাশের, আত্মপরিচয়ের নবনির্মাণ হয়েছিল দেশভাগের হাত ধরে, তৈরি হয়েছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ।
আজকের সংখ্যালঘুরা
দেশভাগ তথা বঙ্গবিভাজন হয়েছে আজ প্রায় পঁচাত্তর বছর পূর্বে। তৈরি হয়েছে দুই পৃথক রাষ্ট্র — মুসলমান প্রধান বাংলাদেশ, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু উভয় রাষ্ট্রেই এমন কিছু মানুষ রয়েছেন, ধর্মীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে যাদের বর্তমান পরিচয় ‘সংখ্যালঘু’। কেমন আছেন তাঁরা? একসময় বাংলাদেশ ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা ধীরেশ নাগ-এর কথায় — “সেই ১৯৪৭ সাল, এই ধরুন আমার জন্মের আগে থেকে শুনে আসছি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়…..এই কারণে-অকারণে রেডিয়ো-টেলিভিশনে সবসময় একটা ‘সংখ্যালঘু’ তকমা এঁটে দেওয়া হচ্ছে। আর এই শুনতে শুনতে এই ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে যারা চিহ্নিত হয়ে যায়, তারা ক্রমশ মনের দিক থেকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্তরে, মানে সেই প্রশাসনিক স্তরে সবসময়ই যদি একদল মানুষকে, জনগণের একটা অংশকে নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে — এই পুজোর সময় পুলিশ থাকবে, রথের সময় অমুক দেখবে — এটা যে বাংলার যে স্বাভাবিক জীবন সেই স্বাভাবিক জীবনটাই ক্রমশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে….।” এই ‘সংখ্যালঘু’ চিহ্নিতকরণের অতিপরিচিতি আসলে আর এক অস্তিত্বের, পরিচিতির সংকট তৈরি করে। বর্তমান বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভুগছে তাই নিরাপত্তাহীনতায়, আর পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী সংখ্যালঘু মুসলমানেরা ভুগছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনুন্নতায়। বিশেষত শিক্ষাক্ষেত্রে তারা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। জনচেতনা ও সাক্ষরতার অভাব পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজে তুলনামূলকভাবে অনেকটাই বেশি। বিগত কয়েক দশকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষত মুসলমান মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার আরও প্রয়োজন আছে। শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে তাদের আরও এগিয়ে আসতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শান্তিপূর্ন সহাবস্থান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে বাস করে বিপুল সংখ্যক মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা আশরাফ আলি-র কথায় — “আমরা এক পরিবারের মতোই বাস করি এখন, ওদের পুজোতে আমাদের নেমন্তন্ন হয়, আমাদের ইদে ওদের নেমন্তন্ন হয়, এরকম আছে। আমরা এক টেবিলেই খাই……। এই পারস্পরিক আদান-প্রদান ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদের অনেকটাই আশাবাদী করে তোলে।”
দেশভাগ ও আজকের প্রজন্ম
দেশভাগের যন্ত্রণা শুধু ৪৭-এ যাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরাই বয়ে চলেন, এমন কিন্তু নয়। সাত দশক পরে আজকের দিনে দাঁড়িয়েও দুই বাংলার বর্তমান প্রজন্মের অনেক তরুণ-তরুণীরাও বয়ে চলে দেশভাগের সেই বিচ্ছেদবেদনা। না, তারা কেউ উদ্বাস্তু নয়, তারা আজ স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের নাগরিক। কিন্তু তারা পরস্পর জানে এই দুই বাংলা, যারা আজ শুধুমাত্র দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র, একদিন ইতিহাসে তারা এক ছিল, অপর বাংলা তাদেরও দেশ ছিল। তাদের অনেকেরই পূর্বপুরুষের একখানি ভিটে বা অনেকখানি ‘দেশ’ আজও রয়ে গেছে অপর বাংলার মাটিতে। কিন্তু আজ তারা একে অপরের কাছে শুধুমাত্র বিদেশি। তাই অতীত ইতিহাসের প্রতি তাদের অনেকেরই মনে আজ প্রশ্ন জাগে — দেশভাগ হলেও বাংলাভাগ কি সত্যিই জরুরি ছিল? বাংলাভাগের এই বিচ্ছেদবেদনা দুই বাংলার আগামী প্রজন্মের পর প্রজন্ম নীরবে বয়ে চলবে।
শেষের কথা
দেশভাগ হয়েছে। র্যাডক্লিফ লাইন বাংলার মানচিত্রকে বিভক্ত করেছিল, আজ কাঁটাতারের বেড়া পড়েছে বাংলার ভূমিখণ্ডে — এই ঘটে যাওয়া অতীত ইতিহাসকে মুছে ফেলা আর সম্ভব নয়, বা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে উভয় রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই সীমান্তরেখার রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়োজনকে অস্বীকার করাও সম্ভব নয়। যা সম্ভব তা হল এই বিভাজনরেখার ঊর্ধ্বে উঠে দুই বাংলার মানুষের মধ্যে যোগাযোগ, কাছাকাছি আসার একটা সহজ পথের নির্মাণ। পুরাতনকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না, তাই আগামীর প্রচেষ্টা নতুন হয়ে ওঠা — বন্ধুত্বে, প্রতিবেশিতায় নতুন হয়ে ওঠা। আজও দুই বাংলার মানুষের মধ্যে রয়েছে কাছে আসার, পরস্পরকে জানার আকাঙ্ক্ষা। সীমান্তবর্তী ইছামতীতে দুই পারের প্রতিমা বিসর্জন হয়, দুই বাংলার মানুষ কাছাকাছি আসে, যেমনটি আসে একুশে ফ্রেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবসে। রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় সবরকমের বিভেদ ভুলে তারা একে অপরের হাত ধরতে চায়। আজও দেশহারানো মানুষদের কাছে দেশভাগের অনুভবকে স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করার মতো শব্দ বোধ হয় কোনও ভাষার শব্দভান্ডারে নেই, দেশভাগের সেই হৃদয়বিদারক ঘটনাকে বোঝাতে যে-কোনও শব্দই যেন অনেক বেশি অগভীর, অর্থহীন। কিন্তু এই যোগাযোগ, যাতায়াতের মধ্যে দিয়েই হয়তো একটু একটু করে দুই বাংলার মানুষের দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে জমে থাকা বুকের বেদনাগুলো ভাষা পেতে পারে, এত বেদনা, হাহাকার, যন্ত্রণার শেষে সৌভ্রাতৃত্বের পথে শুরু হতে পারে আবার নতুন যাত্রা।
আসুন সবাই মিলে দেখে নিই ‘সীমান্তরেখা’। স্বদেশ স্বজন হারানো মানুষদের পরিচিতির সংকট, সংঘর্ষ ও নির্মাণের প্রামাণ্যচিত্র।
অভিবাদন তানভীর মোকাম্মেল!
[ সীমান্তরেখা প্রামাণ্যচিত্র দেখতে পারেন এই লিংক থেকে : https://youtu.be/d0BD_hpmppo ]