সঞ্জীব দাস
“From a very early age, perhaps the age of five or six, I knew that when I grew up I should be a writer. Between the ages of about seventeen and twenty-four I tried to abandon this idea, but I did so with the consciousness that I was outraging my true nature and that sooner or later I should have to settle down and write books.
I was the middle child of three, but there was a gap of five years on either side, and I barely saw my father before I was eight. For this and other reasons I was somewhat lonely, and I soon developed disagreeable mannerisms which made me unpopular throughout my schooldays. I had the lonely child’s habit of making up stories and holding conversations with imaginary persons, and I think from the very start my literary ambitions were mixed up with the feeling of being isolated and undervalued. I knew that I had a facility with words and a power of facing unpleasant facts, and I felt that this created a sort of private world in which I could get my own back for my failure in everyday life. Nevertheless the volume of serious – i.e. seriously intended – writing which I produced all through my childhood and boyhood would not amount to half a dozen pages. I wrote my first poem at the age of four or five, my mother taking it down to dictation.”
বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম নন্দিত ব্যক্তিত্ব জর্জ অরওয়েল রচিত ‘Why I write’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত এই অংশে চমৎকারভাবে জীবনীয় হয়ে উঠেছে একজন লেখক হতে চাওয়া ব্যক্তির সত্তার সংকট এবং সেই সংকট অতিক্রমের আন্তরিক উদ্যম।
কিন্তু এই সংকট কি অরওয়েলের একার? না, নিশ্চিতভাবেই তা যে নয় তার সমর্থনে আরও কিছু লেখকের মন্তব্য উদ্ধৃত করা যাক :
১) “I write to discover what I know.”
— Flannery O’Connor
২) “I can shake off everything as I write; my sorrows disappear, my courage is reborn.”
— Anne Franke
৩) “জীবনকে আমি যেভাবে ও যতভাবে উপলব্ধি করেছি অন্যকে তার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ ভাগ দেওয়ার তাগিদে আমি লিখি। আমি যা জেনেছি এ জগতে কেউ তা জানে না (জল পড়ে পাতা নড়ে জানা নয়)। কিন্তু সকলের সঙ্গে আমার জানার এক শব্দার্থক ব্যাপক সমভিত্তি আছে। তাকে আশ্রয় করে আমার খানিকটা উপলব্ধি অন্যকে দান করি।
দান করি বলা ঠিক নয়, পাইয়ে দিই। তাকে উপলব্ধি করাই। আমার লেখাকে আশ্রয় করে সে কতকগুলি মানসিক অভিজ্ঞতা লাভ করে — আমি লিখে পাইয়ে না দিলে বেচারি যা কোনোদিন পেত না। কিন্তু এই কারণে লেখকের অভিমান হওয়া আমার কাছে হাস্যকর ঠেকে। পাওয়ার জন্য অন্যে যত না ব্যাকুল, পাইয়ে দেওয়ার জন্য লেখকের ব্যাকুলতা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। পাইয়ে দিতে পারলে পাঠকের চেয়ে লেখকের সার্থকতাই বেশি। লেখক নিছক কলম-পেষা মজুর। কলম-পেষা যদি তার কাজে না লাগে তবে রাস্তার ধারে বসে যে মজুর খোয়া ভাঙে তার চেয়েও জীবন তার ব্যর্থ, বেঁচে থাকা নিরর্থক।”
— (‘কেন লিখি’ : লেখকেরকথা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)
৪) “আমাকে সবাই যখন ছেড়ে যায়, সবকিছু যখন ছেড়ে যায়, তখনই আমি লেখার কাছে ফিরে আসি, ফিরে আসতে হয়। এটা যেন আমার নিয়তি। বন্ধু-বান্ধব অনেকে আছেন, তাদের নিজের লেখা সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু আমার সেরকম কিছু ঘোষণা দেওয়ার সুযোগ কই? আমি তো বার বার পালিয়ে এসে লেখার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করি। সম্প্রতি আমি মুসা এবং ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ সম্পর্কে কিছু খোঁজ-খবর করছিলাম। ঈশ্বর মুসাকে যখন পয়গম্বরের দায়িত্ব গ্রহণ করতে বার বার আহ্বান করলেন, মুসা বার বার পালিয়ে গিয়ে দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিলেন। কারণ তিনি খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ঈশ্বর মুসাকে রেহাই দেননি। চেপে ধরে দায়িত্বটা তার ওপর আরোপ করেছিলেন। আমি নিতান্ত তুচ্ছ মানুষ। তবু আমার ক্রমেই মনে হচ্ছে, আমাকে লিখতে হবে, পালিয়ে বাঁচতে পারব না। যতদিন বাঁচি লিখতে হবে- পাঠক জুটুক আর না-ই জুটুক, ভালো কেউ বাসুক আর না-ই বাসুক।
এখন একটা বিশ্বাস মনের ভেতর হীরার মতো শক্ত হয়ে জমেছে — লেখকরা মানবসমাজের, মানব জাতির অস্তিত্বের সারবান অংশটুকু ধারণ করেন। রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, বৈজ্ঞানিক, সাংবাদিক এরা সবাই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কিন্তু লেখককে আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বিক্রমাদিত্যের আমলের কারিগর-বিজ্ঞানী এবং অন্যবিধ বিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের চিন্তা না করলেও চলে। কিন্তু কালিদাসকে নিয়ে না ভাবলে চৈতন্যের শুদ্ধতা আসবে না বলে মনে করি। আমি এমন আহামরি লেখক নই; তবু যখন কলম ধরি একটা ধারণা আমার আসে। মনে হয় আমি গোটা মানবসমাজের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আছি। আমার লেখার মধ্য দিয়ে মানুষের ব্যক্তিচৈতন্যের নতুন উদ্ভাস ঘটছে।
আবারো বলছি, আমি ছোট মানুষ। কোনও স্পর্ধিত উচ্চারণ আমাকে শোভা পায় না। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন ছন্দ দিয়ে তিনি যন্ত্র চালাবেন। গ্যেটে বিশ্বাস করতেন সমস্ত প্রাণশক্তি পুঞ্জিভূত করে একটামাত্র প্রবল ফুৎকারে নতুন দেববীর্যে বলীয়ান মানুষ সৃষ্টি করবেন। আমি কিছু নই তবু জানি, এসব অতিকায় মানুষ আমার মার মতো নারীর গর্ভে জম্ম নিয়েছিলেন।
একটুখানি অতিকথা বললাম, কারণ ক্ষুদ্র সাফল্যের চেয়ে মহৎ ব্যর্থতা অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত। কথাগুলো গুছিয়ে বলার সুযোগ হলো না। যখন একা থাকি, নির্জন পথে একাকী হাঁটি, আমার বাবার কথাগুলো HAUNT করে — ‘আমার ছেলেটি আগের যুগে জম্মালে পয়গম্বর হতো’। আমি ভাবতে থাকি, হয়তো কিছু দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবে। শেলি তো বলেছেন, ‘পোয়েটস আর দ্য আন-একনলেজড লেজিসলেটরস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’।
আমি কতটুকু লেখক, কতটুকু কবি বা অন্য কিছু, সেটাও জানি না। তবু আমাকে লিখতে হবে। লেখাটা আমার কাছে আনন্দের নয়, অত্যন্ত গুরুভার বেদনাময় কর্তব্য। এড়িয়ে যেতে চাই; পারি না।”
— আহমদ ছফা
(আহমদ ছফার ‘কেন লিখি?’ শীর্ষক এই স্মৃতিকথা প্রথম প্রকাশ হয়েছিল সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত ‘সচিত্র সময়’ সাপ্তাহিকে)।
উদ্ধৃতি আরও দেওয়া যেতেই পারে। তবে আর তা দেব না। তাতে করে পাঠককে গ্রাস করবে ক্লান্তি-চেতনা। তাই সেই সম্ভাবনার মূলোচ্ছেদ করে চলুন পাঠক আপনাদের নিজের উপলব্ধির কথা শোনাই।
আমার মনে হয় এক প্রকার অন্ত:শীল তাড়না থেকে একজন শিল্পী শিল্পসৃষ্টি করেন।সেই তাড়না থেকেই তো আদিকবি বাল্মীকির কণ্ঠে মন্দ্রিত হয়েছিল বিশ্বের প্রথম কবিতা :
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ। যৎ ক্ৰৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্॥”
এই ‘তাড়না’-কে আবার ‘প্রেরণা’ বলেও অভিহিত করা যায়। সেই প্রেরণার উদ্দীপন বিভাব অবশ্যই বাইরের জগতের কোনও ঘটনা। তার অভিঘাতে যখন শিল্পীর হৃদিমূল জেগে ওঠে আন্তরিকতায় তখনই হয় শিল্পের জন্ম। কিন্ত কীভাবে একজন কবি-লেখক নিজেকে চেনান? কীভাবে একজন কবি আরেকজনের থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র করে তোলেন? আমার মনে হয় এই স্বাতন্ত্র্য নিহিত থাকে দুটি ক্ষেত্রে — জীবনদর্শন এবং শৈলী। বিষয়টি শেলি এবং ওয়ার্ডসওয়ার্থের দুটি কবিতাকে সম্মুখে রেখে বুঝে নেওয়া যাক। প্রথমে শেলির ‘To a skylark’ কবিতাটি উদ্ধৃত করা যাক :
To a Skylark
Hail to thee, blithe Spirit! Bird thou never wert, That from Heaven, or near it, Pourest thy full heart In profuse strains of unpremeditated art.
Higher still and higher From the earth thou springest Like a cloud of fire; The blue deep thou wingest, And singing still dost soar, and soaring ever singest.
In the golden lightning Of the sunken sun, O’er which clouds are bright’ning, Thou dost float and run; Like an unbodied joy whose race is just begun.
The pale purple even Melts around thy flight; Like a star of Heaven, In the broad day-light Thou art unseen, but yet I hear thy shrill delight,
Keen as are the arrows Of that silver sphere, Whose intense lamp narrows In the white dawn clear Until we hardly see, we feel that it is there.
All the earth and air With thy voice is loud, As, when night is bare, From one lonely cloud The moon rains out her beams, and Heaven is overflow’d.
What thou art we know not; What is most like thee? From rainbow clouds there flow not Drops so bright to see As from thy presence showers a rain of melody.
Like a Poet hidden In the light of thought, Singing hymns unbidden, Till the world is wrought To sympathy with hopes and fears it heeded not:
Like a high-born maiden In a palace-tower, Soothing her love-laden Soul in secret hour With music sweet as love, which overflows her bower:
Like a glow-worm golden In a dell of dew, Scattering unbeholden Its aëreal hue Among the flowers and grass, which screen it from the view:
Like a rose embower’d In its own green leaves, By warm winds deflower’d, Till the scent it gives Makes faint with too much sweet those heavy-winged thieves:
Sound of vernal showers On the twinkling grass, Rain-awaken’d flowers, All that ever was Joyous, and clear, and fresh, thy music doth surpass.
Teach us, Sprite or Bird, What sweet thoughts are thine: I have never heard Praise of love or wine That panted forth a flood of rapture so divine.
Chorus Hymeneal, Or triumphal chant, Match’d with thine would be all But an empty vaunt, A thing wherein we feel there is some hidden want.
What objects are the fountains Of thy happy strain? What fields, or waves, or mountains? What shapes of sky or plain? What love of thine own kind? what ignorance of pain?
With thy clear keen joyance Languor cannot be: Shadow of annoyance Never came near thee: Thou lovest: but ne’er knew love’s sad satiety.
Waking or asleep, Thou of death must deem Things more true and deep Than we mortals dream, Or how could thy notes flow in such a crystal stream?
We look before and after, And pine for what is not: Our sincerest laughter With some pain is fraught; Our sweetest songs are those that tell of saddest thought.
Yet if we could scorn Hate, and pride, and fear; If we were things born Not to shed a tear, I know not how thy joy we ever should come near.
Better than all measures Of delightful sound, Better than all treasures That in books are found, Thy skill to poet were, thou scorner of the ground!
Teach me half the gladness That thy brain must know, Such harmonious madness From my lips would flow The world should listen then, as I am listening now.
এর বিপরীতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ রচিত ‘To The Skylark’ কবিতাটিকে রাখা যাক :
To the Skylark
Ethereal minstrel! pilgrim of the sky! Dost thou despise the earth where cares abound? Or, while the wings aspire, are heart and eye Both with thy nest upon the dewy ground? Thy nest which thou canst drop into at will, Those quivering wings composed, that music still!
Leave to the nightingale her shady wood; A privacy of glorious light is thine; Whence thou dost pour upon the world a flood Of harmony, with instinct more divine; Type of the wise who soar, but never roam; True to the kindred points of Heaven and Home!
এই দুটি কবিতারই আলম্বন বিভাব স্কাইলার্ক। তবু দুটি কবিতাই স্বতন্ত্র। এবং দুটি কবিতাতেই তাদের রচয়িতার আত্মপরিচয়ের চিহ্ন সুমুদ্রিত। কীভাবে? চলুন পাঠক বুঝে নেওয়া যাক।প্রথমটি কবি শেলি রচিত এক অসামান্য ‘Ode’ হিসেবে নন্দিত। একজন কথকের জবানিতে একটি স্কাইলার্ককে দেখে তাঁর প্রতিক্রিয়া এখানে সুনিয়ন্ত্রিত ছন্দস্পন্দে,সংবেদী চিত্রকল্পে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। যেকোনও অনুভবী পাঠক একে শেলির কবিতা বলে এক লহমায় চিনতে পারেন। কারণ কবির আত্মপরিচয় এখানে আন্তরিকতায় স্বপ্রকাশিত। এই স্বাতন্ত্র্য নিহিত আছে কবির অনন্যপরতন্ত্র জীবনদৃষ্টির প্রকাশে। এই সেই জীবনদৃষ্টি যার ছোঁয়ায় তুচ্ছ এক ভরত পক্ষী বা স্কাইলার্ক এবং তার সুর অসামান্য হিসেবে প্রতিভাত হয়, মর্ত্যলোকের এক পাখির গান স্বর্গীয়সুষমা লাভ করে। এটি আসলে একজন রোমান্টিক কবি মনের বস্তুজগতের সঙ্গে নিভৃত মনোলগ। কবিতার প্রথম স্তবকেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায় :
Bird thou never wert, That from Heaven, or near it,
এইভাবে আসলে এই পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের দিকটিকে কবি কুশলতায় উন্মোচিত করেছেন স্কাইলার্ককে আশ্রয় করে। কবিতার সমাপ্তি ঘটেছে এই স্কাইলার্কের কাছে কবির আনন্দ অনুভবের শিক্ষাদানের ব্যাকুল আবেদনে :
Teach me half the gladness That thy brain must know, Such harmonious madness From my lips would flow The world should listen then, as I am listening
স্বর্গীয় আনন্দ অনুভবের আকুল তৃষ্ণার এই তুঙ্গ উদ্বোধনে, রোমান্টিক পার্থিবচেতনার প্রকাশেই যে খোদিত হয়ে আছে তাঁর আত্মপরিচয় তা সচেতন পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন।
এছাড়া শৈলীগত দিক তো আছেই। আলোকিত শব্দবন্ধের ব্যবহার শেলির কবিতাকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। এই প্রবণতা এখানেও লক্ষগোচর। কবিতার সূচনা কথকের স্কাইলার্ককে সম্বোধনে :
Hail to thee, blithe spirit ! Bird thou never wert.
কবি স্কাইলার্ককে ‘blithe spirit’ হিসেবে সম্বোধন না করে merry sprit, কিংবা jocund, jovid, jolly spirit-ও বলতে পারতেন। কিন্তু করলেন না। কেন? এর উত্তর নিহিত আছে প্রতিটি শব্দের অর্থগত সূক্ষ্ম পার্থক্যে। সেই পার্থক্য নিম্নরূপ :
Merry implies a gay, cheerful temper or mood and uninhibited enjoyment of frolic, festivity, or fun of any sort.
Blithe carries a stronger implication of freshness, buoyancy, and lightheartedness than merry; it usually suggests carefree, innocent, or even heedless gaiety.
Jocund heightens the implication of gladness and usually also connotes liveliness, exhilaration of spirits, or elation.
Jovial connotes especially good-fellowship or conviviality.
Jolly often suggests higher spirits than jovial and an even more manifest attempt to keep others laughing (as by jesting, bantering, and playing tricks).
(Source : https://www.wrightingtips.cc)
সোজা কথায় বললে স্কাইলার্কের গানে কবি যে high spirit, যে innocent মহনীয়তাকে অনুভব করেছেন তা অন্য শব্দগুলোর ব্যবহারে সম্ভব হত না। তাই spirit এর বিশেষণ হিসেবে ‘blithe’ শব্দের ব্যবহার অমোঘ হয়ে উঠেছে। কোনও পাখিকে এইভাবে অলোকসামান্য স্নিগ্ধতায় ভরে দেওয়ার ফলে সাধারণ বাক্যটিও অসামান্য হয়ে উঠেছে। তাই পাঠক পঙক্তিটি একবার উচ্চারণ করেই থেমে যান, পিছন ফিরে বাক্যটিকে আবার দেখেন, মোহাবিষ্ট হন, তারপর আবার পড়েন। একেই তো সমালোচক : ‘foregrounding’ বা ‘প্রমুখন’ রূপে অভিহিত করেছেন।
এছাড়া চিত্রকল্প এবং উপমা অলঙ্কারের ব্যবহারের কথাও আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়। শেলির অধিকাংশ কবিতার মতো এখানেও চিত্রকল্পের সৌজন্যে মর্ত্যলোক এবং অমর্ত্যলোকের সেতুবন্ধন ঘটেছে। এসবই যে কবিকে ভিড়ের মধ্য আলাদা করেছে তা বুঝতে সংবেদী পাঠকের অসুবিধা হওয়ার কথা নয় বলেই মনে করি।
শেলির মতোই রোমান্টিক যুগের কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ। তাঁর ‘To The Skylark’ কবিতাতেও আমরা পাই রোমান্টিকতার সৌরভ। তবে তা স্বাদে-গন্ধে শেলির কবিতার থেকে আলাদা। ফরাসি তাত্ত্বিক Buffon-এর সেই অমোঘ উক্তি এই সূত্রে আমাদের মনে এসে যায়: le style c’est l’homme lui-même (‘The style is the man himself’)। কথাটিতে জোর পড়েছিল কবিব্যক্তিত্ব-এর ওপর। একজন কবির ব্যক্তিত্ব যে কীভাবে একই বিষয় নিয়ে রচিত দুটি কবিতাকে পৃথকভাবে চিনিয়ে দেয় তা উপরোক্ত দুটি কবিতাকে পাশাপাশি রেখে আমরা উপলব্ধি করতে পারি। কবিতাটির সূচনা আকাশবিহারী স্কাইলার্কের উদ্দেশে কথকের আকুল জিজ্ঞাসায় :
Ethereal minstrel! pilgrim of the sky! Dost thou despise the earth where cares abound? Or, while the wings aspire, are heart and eye Both with thy nest upon the dewy ground? Thy nest which thou canst drop into at will, Those quivering wings composed, that music still!
কবিতার সূচনাতে ওয়ার্ডসওয়ার্থ স্কাইলার্কের বিশেষণ হিসেবে বেছে নিলেন ‘Ethereal minstrel’ এই শব্দবন্ধ। এর থেকে মনে হতে পারে তাঁর চলা শেলির পথ ধরে। অর্থাৎ তাঁর স্কাইলার্কও পার্থিবজীবন বিবিক্ত অমর্ত্যলোকের সৌরভ-স্নিগ্ধ কবিতা। কিন্তু তা যে নয় তা বোঝাতেই যেন এর পাশাপাশি ‘pilgrim of the sky’-এর বিরোধাভাসের অন্তর্ঘাতী আয়োজন। বিরোধাভাসের এই শৈলীই তো ওয়ার্ডসওয়ার্থের অভিজ্ঞান! এরপরই প্রচ্ছন্নতার স্নিগ্ধমেঘের আস্তরণটুকুও কবি সরিয়ে নিলেন আচম্বিতে তীক্ষ্ণ বাক্য-শরে :
Dost thou despise the earth where cares abound? Or, while the wings aspire, are heart and eye Both with thy nest upon the dewy ground?
এমন কাকু বক্রোক্তির অলৌকিক নান্দনিক প্রয়োগ শেলির কবিতায় দুর্লভ। একইভাবে ওয়ার্ডসওয়ার্থের অন্ত:শীল মর্ত্যপ্রীতি কবিতায় ধীর লয়ে ডানা মেলতে থাকে। পরিশেষে কূলে পৌঁছে এটি হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিকতার নির্মোকে একটি সুগভীর জীবনরসের কবিতা।
এই বিশ্লেষণ থেকে পাঠক, একথা কী স্পষ্ট নয় নিজস্ব সৃষ্টি কীভাবে হয়ে ওঠে স্রষ্টার আত্মপরিচয় নির্মাণের যুদ্ধক্ষেত্র! এই লড়াই সর্বদাই প্রাণবন্ত। নতুবা স্রষ্টার অস্তিত্বই যে বিপন্ন হয়ে ওঠে! এরকম দেশজ উদাহরণও কম নেই। আমার হাতের কাছেই আছে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং শঙ্খ ঘোষের কাব্যগ্রন্থ । এঁদের কবিতা দিয়েও স্রষ্টার আত্মপরিচয়ের সংকট এবং সৃষ্টিকে আশ্রয় করে তার থেকে পরিত্রাণের বিষয়টি বোঝানো যায়। আমরা জানি দুজনের কবিতা উল্লেখ্যযোগ্যভাবে বাঁক নিয়েছিল সত্তরের নকশাল আন্দোলন এবং অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কালো দিনগুলোতে। সমকালীন অনেকেই যখন নিরাপদ দূরত্ব থেকে ‘প্রেম-প্রকৃতি’র বয়ান-ব্যূহে নিজেদের লুকোতে ব্যস্ত তখন এই দুই কবি সময়ের কাছে দায়বদ্ধ থেকেছেন। তাঁদের ছাত্ররা তখন অগ্নিপথের যাত্রী। অনেকেই তিমিরবরণ সিংহ — নামটার সঙ্গে পরিচিত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ছিল অলোকরঞ্জন-শঙ্খের প্রিয় ছাত্র। সে ১৯৭১-এ বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে পুলিশের নির্মমতার বলি হয়।
গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার সংকল্প নিয়ে আরও অনেক স্বপ্নদর্শী ছাত্রের মতো সে-ও গ্রামের পথে পা বাড়িয়েছিল। যাওয়ার আগে, গভীর রাত্রে, সে অলোকরঞ্জনকে বলে গিয়েছিল, ‘দেখবেন, বিপ্লব ঠিক আসছে’। শঙ্খ ঘোষকে বলেছিল : ‘কোথায় যাব, কবে ফিরব, কিছু ঠিক নেই।’ তাঁর এই পরিণতি দুজনের-ই সত্তার মূল ধরে নাড়া দেয়। দুজনের মনেই প্রশ্ন জাগে এমন কালবেলায় কি একজন কবি চুপ করে থাকবেন? আর পাঁচজনের মতো আত্মরতির স্বর্গ রচনায় থাকবেন মগ্ন? না তা তো হতে পারে না। প্রতিষ্ঠানবিরোধী শঙ্খ ঘোষের লেখনীতে উৎকীর্ণ হল শোকার্ত প্রতিবাদ ‘তিমির বিষয়ে দু-টকরো’ কবিতায়। অন্যদিকে তাকে মনে রেখেই অলোকরঞ্জন লেখেন ‘অমৃতধামযাত্রী’ কবিতা। ভারতীয় রসবাদ অনুযায়ী বিচার করলে দেখা যায় দুটি কবিতারই আলম্বন বিভাব একটি মৃত্যু — এক ছাত্রের শোকাবহ পরিণতি। শেলি একদা কিটসের মৃত্যুশোকে মুহ্যমান হয়ে ‘Adonais’ রচনা করেন। আর শঙ্খ-অলোকরঞ্জন প্রিয় এক ছাত্রের শোকে গ্রস্ত হয়ে রচনা করলেন আধুনিক বাংলা কবিতার দুই বিশুদ্ধ লিরিক। এখানেও দেখা যায় বিষয়বস্তু এক হলেও কবিব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্যের জন্যই দুটি কবিতাই স্ব-চিহ্নিত কবিতার মাত্রা পেল। শঙ্খের কবিতা মর্মান্তিক শোকের এক ব্যাকুল-সংহত উচ্চারণ। কবিতার সূচনা সমাসক্তিসিক্ত আসামান্য বাক্যে :
“ময়দান ভারী হয়ে নামে কুয়াশায় দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ”
বস্তুর ওপর এখানে প্রাণধর্ম আরোপিত হয়েছে। তারফলে সত্তর দশকের সন্ত্রাসকবলিত সময় তার শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ নিয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। এই পরিবেশকে আরও গাঢ় করে তুলতেই নিক্ষিপ্ত হয় বক্রোক্তির তীক্ষ্ণ শর :
“তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?”
দুই অলংকারের আন্তরিক ব্যবহারে নাটকীয় হয়ে উঠেছে এখানে কথকের ব্যক্তিশোক:
“নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই তোমার ছিন্ন শির, তিমির।”
পাঠক এখানে প্রত্যাশা করে বিস্ময়বোধক চিহ্নের। এই চিহ্নের ব্যবহারে শোকের ব্যাকুলতা দুকুলপ্লাবী হয়ে উঠত। কিন্তু ‘নি:শব্দের কবিতার’ উদ্গাতা শঙ্খ তা হতে দেবেন কেন! তাই তিনি ব্যক্তিশোকের অশ্রুকে প্রস্তরকঠিন করে তুলতে পাঠকের প্রত্যাশাকে অন্তর্ঘাতে চুরমার করে পঙক্তিটিকে বেঁধে দেন পূর্ণচ্ছেদের কঠিন প্রাচীরে।
কবিতাটি দুটি স্পষ্ট পর্যায়ে বিভক্ত। প্রথম পর্যায়টির নাম ‘আন্দোলন’। পরবর্তী পর্যায় ‘নিহত ছেলের মা’ :
“আকাশ ভরে যায় ভস্মে দেবতাদের অভিমান এইরকম আর আমাদের বুক থেকে চরাচরব্যাপী কালো হাওয়ার উত্থান এছাড়া আর কোনও শান্তি নেই, কোনও অশান্তিও না।”
দ্বিতীয় তথা শেষ স্তবকে এসে কবিতা অন্য পথে বাঁক নিয়েছে। প্রথমে এসেছে পরস্পরলগ্ন দুটি চিত্রকল্প। কথক দেখেন ভস্মাতুর আকাশ। তিনি একে দেবতাদের অভিমানের দ্যোতক হিসেবে দেখেন। এর পাশাপাশি কথক নিজেদের বুকে জমাটবাঁধা শোকের কথাও বলেন। তবে সরাসরি নয়, সংবেদী চিত্রকল্পের আশ্রয়ে :
“আর আমাদের বুক থেকে চরাচরব্যাপী কালো হাওয়ার উত্থান”
এক কথায় প্রকৃতি থেকে ব্যক্তিমন সবই শোকে রাঙানো। এরপর চূড়ান্ত নিরুপায়তার অনুভবের নম্র উচ্চারণে ঘটেছে কবিতার সমাপ্তি :
“এছাড়া আর কোনও শান্তি নেই, কোনও অশান্তিও না।”
এমন বিশুদ্ধ লিরিক, এমন সংবেদী চিত্রকল্প, এমন সংযমী স্বরের উচ্চারণ শঙ্খ ছাড়া আর কার হতে পারে?
এর পাশাপাশি অলোকরঞ্জনের কবিতাটি পড়া যাক। ‘লঘুসংগীত ভোরের হাওয়ার মুখে’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের ‘অমৃতধামযাত্রী’ কবিতায় ব্যক্তি-কবির সত্তার নিজস্বতা ক্ষমতা পরিসরকে হেলায় প্রত্যখ্যান করে স্বাতন্ত্র্যদীপ্ত হয়ে উঠেছে। কবিতার সূচনা বাক্যটি আমাদের সংস্কারকে কী অনায়াসেই না টলিয়ে দেয়!
“আমি কার মৃত্যুরস আস্বাদন করি মনে-মনে!”
কথক যদি যেকোনও ব্যক্তিমাত্র হন তবুও এরকম উচ্চারণ করাটাই কী অস্বাভাবিক নয়! আর সেই ব্যক্তি যদি কবি স্বয়ং হন তবে? এক প্রিয়জন অকাল প্রয়াত। তাঁর জন্য শোক কথক-কবির কাছে ‘মৃত্যরস আস্বাদন’ বলে মনে হওয়ার চিন্তাও কী ভয়ংকর! এখানে ‘মনে মনে’ — এই শব্দদ্বৈতের ব্যবহার কী কম তাৎপর্যপূর্ণ! বি-পরিচিতি করণ এবং সেই সূত্রে এমন শিহর উদ্দীপক প্রমুখনের উদাহরণ বাংলা কবিতার ইতিহাসে খুব বেশি আছে কী! এখানে বুদ্ধিজীবী নামক এক শ্রেণির ক্ষমতাবানদের কবি একেবারে নগ্ন করে দিয়েছেন। ওপরে স্বপ্নালু শহিদের জন্য আহা-উহু করা, অশ্রুপাত করা, আড়ালে নারকীয় আনন্দ অনুভব করাতেই অভ্যস্ত বঙ্গীয় সুশীলদের একটা বড়ো অংশ। অলোকরঞ্জন এঁদের অনেককেই ব্যক্তিগতভাবে জানতেন। সেই অভিজ্ঞতাই এখানে স্তম্ভিত হয়েছে।
এই প্রত্যখ্যানের ভাষা দ্বিতীয় স্তবককে প্রদান করেছে তীক্ষ্ণ মিসাইলের তীব্রতা :
“লোহিতচন্দনে সেইজন শুয়ে থাকে তীব্রসুখী — শহিদ আমার — তাকে ঘিরে বিদ্যাধর যক্ষ আর কুক্কুর-কিন্নরী করে বড়ো বেশি হাহাকার”
এইভাবে ‘বিদ্যাধর যক্ষ’ আর ‘কুক্কুর কিন্নরী’ — এই তীব্র তির্যক বক্রবাচনে কাদের বিঁধেছেন তা বুঝতে কী আর বাকি থাকে!
তৃতীয় স্তবকে কবিতার বাঁক বদল ঘটেছে — বক্তব্যে এবং শৈলীতেও। বর্তমান থেকে কথক এখানে অতীতমুখী:
“যেদিন পরানো হল হাতকড়ি গানের খাতাটি তার দিয়ে গেছে আমাকে, গোপনে, ঠিক রাত দুটোর সময়”
রাষ্ট্রশক্তির গেস্টাপো বাহিনী হাতকড়ি পরিয়ে তুলে নিয়ে গেছে কথকের স্নেহভাজন বিপ্লবীকে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাতন্ত্রের কাছে সন্ত্রাসবাদী হলেও সে তো আসলে স্বপ্নালু বিপ্লবী। আর তা-ই সে গান করে, গান লেখেও। সে তাঁর গানের খাতাটা গ্রেপ্তার হওয়ার আগের দিন রাতে দিয়ে গেছে গোপনে। এরপর কবিতা শমে পৌঁছেছে :
“সব-কিছু দিলে যেন ভয়ানক চুরি করা হয়!”
একটি মাত্র বাক্য! ক্ষোভ, বিস্ময়, ক্ষোভজনিত আর্তি সবই মিলেমিশে এখানে স্ফটিক-কাঠিন্য লাভ করেছে। এই অবরোহ এবং আরোহী প্যাটার্নের মিশ্ররীতি, এমন তির্যক বাচনভঙ্গি, এমন দূরান্বয়ী শব্দ এবং স্তবক-বিন্যাস অলোকরঞ্জনের একান্ত নিজস্ব। তাই শঙ্খ ঘোষের কবিতার পাশে ‘অমৃতধামযাত্রী’-কেও তাঁর রচিত কবিতা বলে চিনে নিতে আমাদের অসুবিধা হয় না।
পরিশেষে সত্তা ও তাঁর প্রকাশ এবং সেই প্রকাশের অনন্যপরতন্ত্রতার জটিল রসায়নের কথায় আসি। এই কথার সূচনা একটি আপাতনিরীহ প্রশ্ন থেকে : স্রষ্টা সৃষ্টি করেন, কিন্ত কেন করেন? একথার উত্তরে Dejan Stojanovic তাঁর ‘The Sun Watches’-এ বলেছেন : “Even if you are alone you wage war with yourself”। এই দ্বন্দ্ব, এই সংঘাতে রক্তাক্ত সত্তা নিজেকে প্রকাশ করতে, নিজ সত্তার একান্ত অনুভবকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চায়। একে ভাববাদী কবি বলবেন ‘ব্যক্তি আমির বিশ্বগত’ হয়ে ওঠার আবেগ-এষণা। স্রষ্টার ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য সত্তার এই প্রকাশকে অনন্যপরতন্ত্র অবয়ব দেয়। শেলির কবিতা থেকে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা, অলোকরঞ্জনের কবিতা থেকে শঙ্খের কবিতা এইভাবেই স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত হয়ে ওঠে। সৃষ্টিশীল ব্যক্তিসত্তার এই আততি, তার প্রকাশের এই আখ্যানের কোনও বিরাম নেই। সত্তার অনির্বাণ নির্মাণের এই আনন্দেই তো ফরাসি চারণের দল গেয়ে ওঠেন :
“পাপিলন দে সোয়া এস পোয়া।”
(আনন্দোচ্ছল একঝাঁক প্রজাপতি….)
এই নির্মাণের আনন্দেই কবির বেঁচে থাকা। জীবনের প্রান্তবেলায় উপনীত অশীতিপর কবি এই সৃষ্টির উল্লাসেই মৃত্যুকে খারিজ করার প্রেরণা পান :
“ভাবতে বসি আমিও আজ নতরে দামের মতো ধ্বংসাবশেষ,বয়েসটাও ক্ষতবিক্ষত —
তবুও যদি শেষ কবিতা প্রলয়কালের মেঘে লিখে উঠতে না পারি তবে কী হবে বেঁচে থেকে?
আমার ডান কনুই ঘেঁষে মৃত্যু পরোয়ানা খারিজ করে কাঁপতে থাকে প্রজাপতির ডানা —”
আমরাও সেই আনন্দের স্বাদ নিই। সেই আনন্দ সাগরে আমাদের মনও বলে ওঠে:
“এখনো নভোনীলে দেখছি বাকপ্রতিমা শতশত সেই অরণ্যে চলছি হেঁটে হাইডেগারের মতো।”