পরিচিতি কেন্দ্রিক রাজনীতির চ্যালেঞ্জ 

প্রকাশ কারাত

(ভাষান্তর : সায়ন চক্রবর্তী)

বর্তমানকালে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে পরিচিতি সত্তার রাজনীতি সাধারণভাবে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্যতম প্রধান উপাদান রূপে উঠে এসেছে। ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত পরিচিতি কেন্দ্রিক রাজনীতির ধারণারই কোনও অস্তিত্ব ছিল না। সময়টা হল ১৯৮০-র দশক, যখন থেকে পরিচিতির রাজনীতি গুরুত্ব লাভ করতে থাকে। 

পটভূমি

১৯৮০-র দশকে বিশ্বায়িত ফিনান্স পুঁজির ইন্ধনে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের আবির্ভাব। নয়া উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রম এই সময় থেকে জোরদার হতে শুরু করল। তথ্য-প্রযুক্তির মতো নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি বিশ্বায়ন এবং ফিনান্স পুঁজির গতিশীলতাকে ত্বরান্বিত করল। 

বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের এই পর্যায় এবং সমাজতন্ত্রের পতন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভাজন সমসাময়িক। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হল শোষণ। সমাজতন্ত্র থেকে পশ্চাদপসরণের কারণে শোষণ থেকে মুক্তির সর্বজনীন লক্ষ্যে পৌঁছানো দুর্বল হয়ে পড়ল। 

সমাজতন্ত্রের পতনের সঙ্গে সঙ্গে জাতিগত পরিচিতি এবং ভ্রাতৃঘাতী বিবাদের পুনরুত্থান হয়। বলকান অঞ্চলে, পূর্ব-ইউরোপ এবং পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে এই পুনরুত্থান নাটকীয়ভাবে বিস্ফোরণের রূপ নেয়।

ফিনান্স পুঁজি পরিচালিত পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের আক্রমণাত্মক আবির্ভাব এবং সমাজতন্ত্রের দুর্বল হয়ে পড়া একত্রে পরিচিতির রাজনীতির উত্থানের পটভূমি রচনা করেছে।

জাতিগত পরিচিতির রাজনীতি এবং জাতিগত জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক দ্বন্দ্ব এবং ভ্রাতৃঘাতী বিবাদের জেরে যুগোস্লাভিয়া টুকরো টুকরো হয়ে যায়। স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের গড়ে ওঠা, বসনিয়ার যুদ্ধ এবং যুগোস্লাভিয়ার মতো রাষ্ট্রের একাধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়া বিশ্বব্যাপী পরিচিতির রাজনীতি ছড়িয়ে পড়ার পূর্বশর্ত হিসাবে কাজ করেছে। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নেও বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলির নিজেদের মধ্যে বিবাদ ছিল। আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজি এবং ইউরোপীয় পুঁজি এই দেশগুলির বাজারে প্রবেশ করার সুযোগ খুঁজছিল। এহেন পরিস্থিতির ফলে জাতীয়তাবাদী বিবাদ আরও বেড়ে উঠল। নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বাজার অর্থনীতির এবং নয়া-উদারনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হল।

বিশ্বায়িত ফিনান্স পুঁজি অসংখ্য পরিচিতির ভিত্তিতে বিভক্ত জনগণের মধ্যে কাজ করা সুবিধাজনক মনে করে। তাতে বাজার ব্যবস্থায় প্রবেশ করা এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। ভোগবাদ এবং বাজার ব্যবস্থা প্রত্যেক গোষ্ঠীকে পরিষেবা প্রদান করে। কিন্তু অসংখ্য পরিচিতিতে বিভক্ত করে তাদের পুঁজির শোষণ এবং বাজারে পুঁজির কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে  মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেয় না।

সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের অন্তর্গত ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিযোগী গোষ্ঠীগুলিকে একত্রে নিয়ে চলে। এই গোষ্ঠীগুলি পরস্পর  সামাজিক উদ্বৃত্ত এবং পণ্যের ওপর অধিকার দাবি করতে থাকে। শাসক শ্রেণির কাছে একটি সুসংহত গোষ্ঠী যে মৌলিক রাজনীতির ভিত্তিতে অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত এবং পণ্যের সুষম বণ্টনের দাবি করে তার পরিবর্তে বহু গোষ্ঠীর উপস্থিতি অবশ্যই সুবিধাজনক। 

বিশ্বায়িত পুঁজি পরিচালিত ধনতন্ত্রের বর্তমান পর্যায় এবং তথ্য-প্রযুক্তি আনীত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মিলিত প্রভাব আছে সমাজের ওপর। ধনতন্ত্রের শেষ পর্যায়ে উত্তর-আধুনিকতার আবির্ভাব। মার্কসবাদ পরবর্তী তত্ত্ব উত্তর-আধুনিকতা পরিচিতি সত্তার রাজনীতির ভিত্তিভূমি হাজির করেছে। 

উত্তর-আধুনিকতা কী? 

উত্তর-আধুনিকতা একটি বুর্জোয়া দার্শনিক মতাদর্শ যা বিংশ শতাব্দীর ধনতন্ত্রের সাফল্যের কারণে এবং সমাজতন্ত্রের পিছু হটার কারণে উঠে এসেছে। এই মতাদর্শ মার্কসবাদের বিরোধী।

আলোকপ্রাপ্তি (enlightenment) প্রকল্প মৃত এবং নিঃশেষিত — এই গভীর বোধ থেকে উত্তর-আধুনিকতার জন্ম। আঠারো শতকে ইউরোপে যে আলোকপ্রাপ্তি শুরু উনিশ শতকে তা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই আলোকপ্রাপ্তি ব্যক্তিস্বাধীনতার সর্বজনীন মূল্যবোধ, প্রগতি এবং যুক্তিবোধের পথ উন্মুক্ত করে।

উত্তর-আধুনিকতা আলোকপ্রাপ্তির সমস্ত মূল্যবোধকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে এবং সর্বজনীনতা ও সামগ্রিকতা সম্পর্কিত সমস্ত দর্শন বা রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সমস্ত সামগ্রিকতার তত্ত্বকে নস্যাৎ করে তার নাম দেওয়া হয়েছে মেটা ন্যারেটিভ। সমস্ত গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ তথা মেটা ন্যারেটিভ — উদারনীতি, সমাজতন্ত্র বা অপরাঅপর সর্বজনীনতার তত্ত্ব — সব বাতিল। উত্তর-আধুনিকতা অনুযায়ী মুক্তির লক্ষ্যে সমস্ত সর্বজনীন আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে নতুন দমন ও নিপীড়নের দিকে নিয়ে যায়। এই মতবাদ ধনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রকে কোনও কাঠামো বা ব্যবস্থা হিসাবে স্বীকৃতিই দেয় না। উত্তর-আধুনিকতা ভাষার সাহায্যে জ্ঞান এবং ক্ষমতাকে মধ্যস্থতা করে, যার প্রকাশ বিভিন্ন ভাবে হতে পারে। উত্তর-আধুনিক দার্শনিকদের মতে, ইতিহাসকে দেখতে হবে প্রসঙ্গ এবং আপেক্ষিকতার নিরিখে।

উত্তর-আধুনিকতা কেবলমাত্র পরিচিতি, পার্থক্য এবং সংঘর্ষের বিভিন্ন টুকরোগুলোকে মান্যতা দেয়। তাই এই তত্ত্বের দ্বারা যা সম্ভব, তা হল একটি নির্দিষ্ট পরিচিতির নির্দিষ্ট অংশকে মান্যতা দেওয়া; কোনও নির্দিষ্ট সংগ্রাম অথবা পার্থক্য এবং পরিচিতির ওপর ভিত্তি করে স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক আন্দোলনের খণ্ডিত রাজনীতির সম্ভাবনা। 

উত্তর-আধুনিকতাকে মনে হয় মৌলিক সামাজিক তত্ত্ব। কিন্তু বাস্তবে তা পুঁজিবাদের বিরোধী নয়। বুর্জোয়া তত্ত্বের বিকল্প নয়। এই তত্ত্বকে মার্কসবাদের বিরোধিতার শস্ত্র রূপে ব্যবহার করা হয়। 

পরিচিতির রাজনীতির উদ্ভব মার্কসবাদ পরবর্তী এই উত্তর-আধুনিকতা থেকে।

পরিচিতির রাজনীতি কী? 

পরিচিতির রাজনীতি হল কোনও ব্যক্তি তার জাত, জাতি, ভাষা বা ধর্ম অথবা অন্য কোনও কিছু, যা তিনি তার পরিচিতি মনে করেন তার ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী জনৈক ব্যক্তির অনেক পরিচিতি থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি যে পরিচিতি দ্বারা নিজেকে সংজ্ঞায়িত করেন সেটাই তার পরিচিতি। এইভাবে একজন পুরুষ একজন শ্রমিক এবং একজন কালো মানুষ হতে পারেন। তিনি যদি মনে করেন তার গায়ের রং তার প্রধান পরিচিতি তাহলে সেটাই হবে তার পরিচিতি। তখন তাকে একজন কালো মানুষ হিসাবেই ধরা হবে, একজন শ্রমিক হিসাবে নয়। পরিচিতির রাজনীতি অনুযায়ী তিনি যে শ্রেণিতে অবস্থান করেন সেটা তার পরিচিতি হবে না। কোনও একজনের পরিচিতি খুঁজতে পরিচিতির রাজনীতি পার্থক্য এবং বিভেদের খোঁজ করে। কিছু মানুষ, যারা কিছু নির্দিষ্ট পরিচিতি, যেমন জাত, জাতি, বা ধর্মের ভিত্তিতে একত্র ও সংহত হয়ে রাষ্ট্রের কাছে বা সমাজের কাছে তাদের চাহিদা পেশ করলে সেটাই হবে পরিচিতির রাজনীতি।

ধনতন্ত্রের উত্থানের সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও শ্রেণি যুক্ত ছিল। উনিশ শতক থেকে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক দল এবং আন্দোলন ছিল রাজনীতির ভিত্তি। এই রাজনীতি এবং আন্দোলনে যে মানুষেরা সংহত হয়েছিল তাদের ভিত্তি ছিল ভাষাগত জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় পরিচিতি। তবে যাই হোক, জাতীয়তার লড়াইতে বা জাতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইতে, লড়াইটা বিভিন্ন শ্রেণি এবং গোষ্ঠী সম্পর্কিত হলেও, একই ভাষা-ভাষীর মানুষজন সেখানে একত্রিত হয়েছিল। এমনকি পাকিস্তানে যখন ধর্ম রাষ্ট্রের ভিত্তি হল, তখন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিভিন্ন পরিচিতি সমবেত হল। বর্তমানকালের পরিচিতির রাজনীতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, এই মতাদর্শ শ্রেণির ধারণার বিরুদ্ধে। বিভাজিত পরিচিতির তত্ত্ব নির্মাণের মাধ্যমে এই রাজনীতিশ্রেণি সচেতনতা গড়ে ওঠাকে প্রতিহত করতে চায়।

পরিচিতির রাজনীতির তাত্ত্বিকরা বলেন যে, কোনও নির্দিষ্ট নিপীড়ন কেবলমাত্র সেই পরিচিতির মানুষেরাই বুঝতে এবং অনুভব করতে পারে। অতএব অন্যরা সেই লড়াই থেকে বাদ। এই তত্ত্ব সবরকম নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে সংঘবদ্ধ লড়াই, তাকে বিভাজন করতে সাহায্য করে। এমন যদি হয় যে, কেবলমাত্র যারা জাতি বৈষম্যের শিকার তারাই জাতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে, সেক্ষেত্রে যেমন প্রগতিশীল শ্বেতাঙ্গ মানুষ ও অন্যান্যদের ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল রাইটস আন্দোলন, এই সমস্ত সাধারণ আন্দোলনের গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকেই অস্বীকার করা হয়। 

উত্তর-আধুনিক তত্ত্বানুযায়ী শ্রেণি একটি পরিচিতি। এঁরা ধনতন্ত্রের শ্রেণি-শোষণ এবং শাসক শ্রেণির ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। এই তত্ত্ব ধনতন্ত্রে শ্রেণিশোষণের ভিত্তি এবং শাসক শ্রেণি ও শাসিত শ্রেণি বিভক্ত সমাজের ধারণাকে মান্যতা দেয় না। মার্কসবাদ অনুযায়ী শোষণ একটি বস্তুনিষ্ঠ ঘটনা এবং শোষণের বিষয়ে সচেতনতা হল মনোগত। কারণ তা ব্যক্তির সচেতনতার ওপর নির্ভরশীল। বিপরীতে পরিচিতির রাজনীতি বলে যে নিপীড়ন একটি মনোগত বিষয়, কারণ যে এটা অনুভব করছে তার ওপর নির্ভরশীল। 

পরিচিতির রাজনীতি অনুযায়ী শ্রমিক শ্রেণিকে পুরুষ ও নারী, দলিত ও অন্যান্য জাতের পরিচিতি, ভাষাগত জাতীয়তাবাদ এবং জাতিগত পরিচিতিতে বি-নির্মাণ করা হয়েছে। এই ভাবনা শ্রমিক শ্রেণির এবং অন্যান্য শ্রেণি, যেমন কৃষক ও কৃষি-শ্রমিক ধারণার অস্বীকৃতি। পরিচিতির রাজনীতি তাই এমনভাবে রাজনীতি পরিচালন করা উপযুক্ত মনে করে, যেখানে অল্প কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদের অংশ নিয়ে বা নিজ নিজ অবস্থার পরিবর্তনের লড়াইতে, রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানানোর ক্ষেত্রে সামান্য সহযোগিতা অথবা অল্প-স্বল্প প্রতিযোগিতা থাকবে। এই রাজনীতি প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধতায় কোনও চ্যালেঞ্জ জানায় না।

পরিচিতির রাজনীতি বুর্জোয়া শাসক শ্রেণি এবং বিশ্বায়িত ফিনান্স পুঁজির কাছে আদর্শ। বিভাজিত পরিচিতিকে কাজে লাগায় বাজার ব্যবস্থা। আসলে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে বিভিন্ন জীবনধারা উদযাপন করা হয়। তাদের ভোগবাদী চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন পণ্যের নকশা তৈরি করা হয়। 

উন্নয়নশীল ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে পরিচিতির রাজনীতি বিশ্বায়িত ফিনান্স পুঁজির প্রবেশ ও তাদের বাজার দখল বা নিয়ন্ত্রণকে সহজতর করে। বাজার এবং তার উৎপাদিত পণ্যের সমসত্ত্বতাকে বিভিন্ন পরিচিতি গোষ্ঠীগুলির পারস্পরিক পার্থক্য প্রভাবিত করতে পারে না।

পরিচিতির রাজনীতি চরিত্রগতভাবে এক পরিচিতির সঙ্গে অন্য পরিচিতির বিভাজন করে এবং বর্জন করে। বাস্তবে পরিচিতি অপরের থেকে পৃথক হওয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। জাত, জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গের ভিত্তিতে ‘অপর’-কে বর্জন করা হয় এবং প্রায়ই নিজেদের মধ্যে লড়িয়ে দেওয়া হয়।

নির্দিষ্ট পরিচিতির রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হয় ব্যক্তির অন্যান্য পরিচিতিকে অস্বীকার করে। একজন কালো চামড়ার শ্রমিককে কালো দেখা হয় তার শ্রমিক চরিত্রকে উপেক্ষা করে। একজন মহিলা শ্রমিককে তার লিঙ্গের মাধ্যমে পরিচিত করা হয়, তার শ্রমিক মর্যাদা দ্বারা নয়। 

পরিচিতির রাজনীতি কেবলমাত্র সমাজের সংখ্যালঘুদের সংহত করে। জাত, জাতি, ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু। এমনকি মহিলাদেরও বিভিন্ন উপ-শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয় এবং তার ভিত্তিতে তাদের সংহত করা হয়। পরিচিতির বিভাজনের এই প্রক্রিয়ার নেপথ্যে তত্ত্ব খাড়া করা হয়।

পরিচিতির রাজনীতি খুব বেশি হলে বিভিন্ন সংখ্যালঘু পরিচিতির গোষ্ঠীর মধ্যে জোট তৈরি করতে পারে। প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনের সংগ্রামে সংখ্যাগরিষ্ঠের সংগঠন এবং আন্দোলনের কথা বিবেচনা করে না।

পরিচিতির রাজনীতির রাজনৈতিক পরিণাম 

পরিচিতির রাজনীতির আপন দর্শন তাকে বুর্জোয়া রাজনীতির অনুষঙ্গ করে তুলেছে। পরিচিতির রাজনীতি কার্যকর থাকলে তা মানুষকে পৃথক পৃথক গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে। এই গোষ্ঠীগুলি নিজেদের মধ্যে প্রায়ই হয় প্রতিযোগিতা, নয় দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে। 

বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিভিন্ন অংশের জনগণ বিভিন্ন নিপীড়নের শিকার। এই নিপীড়নের সুযোগ নিয়ে পরিচিতির রাজনীতি তাদের সংহত করার চেষ্টা করে। এমনভাবে তাদের সংহত করা হয় যেন জনগণের মধ্যে সাধারণ কোনও নিপীড়ন বা বঞ্চনা নেই। তাদের নিজেদের পরিচিতি এবং অনুভূত বঞ্চনাই একমাত্র বাস্তব, অন্য কারো তা নেই। 

বুর্জোয়া ব্যবস্থা যতদিন চালু আছে ততদিন যদিও বা জাত ও লিঙ্গের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নিপীড়নের আংশিক বা পূর্ণ সমাধান হয়, তাহলেও শোষণের সমাধান হয় না। পরিচিতির রাজনীতি এই সত্যকে আড়াল করে রাখে। পরিচিতির রাজনীতি রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্রকে স্বীকার করে না। তাদের মতে রাষ্ট্র নিরপেক্ষ এবং স্বশাসিত। 

পরিচিতির রাজনীতি সাধারণত NGO, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং কেতাদুরস্তভাবে যাকে বলা হয় সিভিল সোসাইটি — তাদের দ্বারাই পরিচালিত হয়। তারপর তথাকথিত নিরপেক্ষ সামাজিক আন্দোলনকে উৎসাহিত করা হয়। এই সংগঠনগুলি অনেকটাই বুর্জোয়া, রাষ্ট্র এবং পশ্চিমের অর্থ সাহায্য প্রাপ্ত সংগঠন দ্বারা সমর্থিত। এইসব NGO এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো যারা নিজেরাই বিচ্ছিন্নভাবে এবং খণ্ডিতভাবে কাজ করে, তারাই পৃথক পরিচিতির প্রকৃত বাহক।

কীভাবে পরিচিতির রাজনীতি মানুষের মধ্যে বিভাজন করে তা বুঝতে পারা দরকার। পরিচিতির রাজনীতি শ্রেণি ঐক্যের বিরোধী এবং তা জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার বিরুদ্ধে কাজ করে। এই রাজনীতি শ্রেণি ভিত্তিক আন্দোলন এবং রাজনীতিকে প্রতিহত করার জন্য  ব্যবহৃত বুর্জোয়াদের অস্ত্র।

ভারতীয় প্রেক্ষিত 

ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থায়ও পরিচিতির রাজনীতি প্রবেশ করেছে। ভারতবর্ষের মতো দেশে জাত, ধর্ম, ভাষা, জাতি, সম্প্রদায় এবং বহু নিপীড়িত গোষ্ঠী থাকায়, ভারতবর্ষ পরিচিতি ভিত্তিক রাজনীতির উর্বর ভূমি। জাত একটি পরিচিতি যার ভিত্তিতে পরিচিতির রাজনীতি মাথা চাড়া দেয়। সমাজে জাতিগত নিপীড়ন এবং বৈষম্য থাকায়, যে মানুষেরা জাতিগত নিপীড়নের শিকার, তাদের জাতিগত পরিচিতির রাজনীতিতে সংহত করা হয়। ভারতবর্ষে সম্পদের অসম বণ্টন এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে দলিত এবং OBC-দের সংরক্ষণের প্রশ্ন উঠে এসেছিল। কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলি মৌলিক সামাজিক কাঠামো এবং শ্রেণি শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে না। তারা বিভিন্ন নিপীড়িত গোষ্ঠীগুলিকে একত্র করে লড়াইকে জোটবদ্ধ করতে আগ্রহী নয়।

ভারতবর্ষে দলিত, আদিবাসী, মহিলা এবং সংখ্যালঘুদের মধ্যে কাজ করছে এমন NGO  এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সংখ্যা অনেক। 

পরিচিতি সত্তার রাজনীতি এবং তার প্রভাব বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে। বহুজন সমাজ পার্টি এর একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। অপরাপর অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কিছু রাজনৈতিক দলও এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 

এই ধরনের পরিচিতির রাজনীতি শুধু যে দলিত বা পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা নয়। অন্যান্য উচ্চজাত এবং প্রভাবশালী জাতও এই রাজনীতির শরণাপন্ন। বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনি লড়াইতে শক্তি সংগ্রহের জন্য তাদের সমর্থন আদায় করতে পরিচিতি কেন্দ্রিক রাজনীতি ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি, সমাজবাদী পার্টি এবং কংগ্রেস — এইসব বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি দলিত এবং তার অন্তর্গত অংশগুলিকে নিয়ে বিভিন্ন সভা করে থাকে তাদের সমর্থন আদায়ের জন্য। এইভাবে পরিচিতির রাজনীতি এক জাতের সঙ্গে অন্য জাতের সম্পর্কে ভাঙন ধরায়।

তপশিলি জাতির বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং বৈরিতা এই রকম ভাঙনের উদাহরণ। যেমন অন্ধ্রপ্রদেশে মাল-মাদিগা দ্বন্দ্ব। আবার দলিত খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের মধ্যে নতুন পরিচিতির উত্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ধর্ম

ধর্মীয় পরিচিতি হল পরিচিতি সত্তার রাজনীতির আর-এক ভিত্তি। এই পরিচিতি-রাজনীতির প্রধান কাজ হল সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে সংগঠিত করা।

সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের রাজনীতি জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরতে চায়। কিন্তু এটাও এক ধরনের পরিচিতির রাজনীতি। প্রকৃতপক্ষে বিজেপির ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ ধর্মীয় পরিচিতি-রাজনীতির ছদ্ম-আবরণ। বিজেপি ভারতবর্ষে হিন্দুত্বের ভিত্তিভূমিকে দৃঢ় করতে দলিত এবং অন্যান্য পরিচিতির দলকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় তাদের রাজনীতিতে।

জাতিগত পরিচিতি এবং জাতিসত্তা কেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ 

এর ভালো উদাহরণ হল কীভাবে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বে জাতিগত পরিচিতির রাজনীতি ১৯৮০-র দশক থেকে উত্থান লাভ করেছে। স্ব-স্ব জাতিতে অন্তর্ভুক্ত থাকার সচেতন মানসিকতা এবং তৎপ্রসূত আবেগ অধিকারবোধ ভিন্ন ভিন্ন পরিচিতি সত্তার মধ্যে জেহাদের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। বৃহত্তর রাজনীতির প্লাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত না-থাকার কারণে সংকীর্ণ জাতিগত পরিচিতি অন্যদের সঙ্গে বিরোধ বাধিয়েছে। দিমাসা বা নাগা, বোরো কিংবা কার্বি — এরা একে অপরের সঙ্গে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। 

পরিচিতিগত রাজনীতি বিচ্ছিন্নতার ভিত্তিভূমিও। এই প্রক্রিয়ায় উত্তর-পূর্বে পৃথক রাজ্যের দাবি উঠে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে গোর্খাল্যান্ডের দাবি নেপালি পরিচিতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং তার কোনও বৃহত্তর গণতান্ত্রিক প্লাটফর্ম নেই। পরিচিতির রাজনীতি সহজে সেইসব জাত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু দলের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে, যারা নিজেদের অভিন্ন পরিচিতির অংশ হিসাবে স্বচ্ছন্দ ও নিরাপদ বোধ করে এবং এটাকেই শ্রেণিশোষণ এবং সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা রূপে মনে করে। 

পরিচিতি সত্তার রাজনীতি এবং তার রাজনৈতিক সংহতির মাধ্যমে এইসব সম্প্রদায়ের অন্তর্গত পেটি-বুর্জোয়া অংশ লাভবান হয়। তারা এই ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু ব্যবস্থার মধ্যে থাকা নিপীড়নের শেষ হয় না। 

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরিচিতির রাজনীতির ফলে শ্রেণিশোষণ এবং সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই-এর জন্য প্রয়োজনীয় সাধারণ আন্দোলন দুর্বল ও বাধাপ্রাপ্ত হয়। 

পার্টির অবস্থান এবং হস্তক্ষেপ 

সিপিআই(এম)-এর অবস্থান এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে, সমাজে শ্রেণিশোষণ ও সামাজিক নিপীড়ন আছে। ভারতবর্ষে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী এবং আধা-সামন্ততান্ত্রিক শোষণের সঙ্গে জাত, জাতি এবং লিঙ্গের ভিত্তিতে বিভিন্ন সামাজিক নিপীড়ন বজায় আছে। শাসক শ্রেণি শ্রেণি-শোষণের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত মূল্য নিষ্কাশন করে এবং তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন সামাজিক নিপীড়নকে সুকৌশলে ব্যবহার করে। অতএব শোষণ এবং নিপীড়নের সমস্ত ধরনের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে লড়াই করা জরুরি। 

এই কারণেই পার্টি জাত এবং অন্যান্য বিভেদাত্মক অনুশীলনের বিরুদ্ধে লড়াই-এর সঙ্গে সঙ্গেই শ্রেণি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। 

আমাদের বুঝতে হবে যে, বিশ্বব্যাপী ফিনান্স পুঁজির উঠে আসা এবং বিশ্বায়নের সূচনায় শাসক শ্রেণি পরিচিতি কেন্দ্রিক রাজনীতি এবং আন্দোলনকে ভীষণভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এই আন্দোলন নিপীড়িত অংশের জনগণের মধ্যে পেটি বুর্জোয়া অংশকে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে সাহায্য করেছে।

ভারতবর্ষের শাসকরা পরিচিতির রাজনীতির বৈচিত্র এবং আন্দোলন নিয়ে বিচলিত নন। তাঁরা পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকেন এবং মানুষকে এই রাজনীতিতে যুক্ত করতে চাইছেন। পরিচিতির রাজনীতির বিপরীত দিকটি হল এই যে, এই রাজনীতি বর্তমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির বৃহত্তর লড়াই সংগঠিত করতে বাধা দেয়। পরিচিতি কেন্দ্রিক রাজনীতি নিও-লিবারাল জামানার প্রচণ্ড বৈষম্য ও শোষণ থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয়। এইভাবে মানুষকে বিশ্বায়িত ফিনান্স পুঁজি এবং বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির কর্মপদ্ধতি বুঝতে দেওয়া হয় না। ফলত, বৃহৎ পুঁজির হাতিয়ার ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, ডব্লুটিও-র কার্যকলাপ এবং বৃহৎ-পুঁজির শাসন কীভাবে দেশ চালাচ্ছে তাও চোখে পড়ে না।

পার্টির উনিশতম কংগ্রেসের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পরিচিতি সত্তার রাজনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে :

“বর্তমানে জাত পরিচিতির ভিত্তিতে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সচলতা কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আরও  বিভিন্ন বুর্জোয়া দল জাত পরিচিতিকে পুঁজি করে জাতের বিয়য়ে সম্মিলন তৈরি করার চেষ্টা করছে। এইভাবে জাতের ভিত্তিতে মানুষকে সংহত করা পার্টি তথা বাম আন্দোলনের সামনে কঠিন সমস্যা তৈরি করছে। পার্টি  জনগণের সমস্ত নিপীড়িত অংশকে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে চায় এবং বাম-গণতান্ত্রিক প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে চায়। পার্টিকে নির্দিষ্ট করে দলিত ও জনগণের পিছিয়ে পড়া অংশের জীবিকা এবং সামাজিক নিপীড়নের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এইভাবে শ্রেণি এবং সামাজিক বিষয়কে নিয়ে একত্রে কাজ করে জাত নিয়ে ভাগাভাগি গড়ে ওঠার ক্ষতিকর প্রভাবকে প্রতিহত করতে হবে।”

জাতের ভিত্তিতে সামাজিক নিপীড়নের প্রশ্নে এটাই পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত এবং এইভাবে বিষয়টাকে শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।

পার্টিকে সামাজিক বিষয়গুলি নিয়ে সরাসরি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পার্টির আঠারোতম কংগ্রেস ডাক দিয়েছে যে, পার্টিকে সামাজিকভাবে নিপীড়িত অংশের চাহিদা ও বঞ্চনাকে চিহ্নিত করতে হবে। এর মধ্যে গণতন্ত্র সম্পর্কিত বিষয় জড়িয়ে আছে। মহিলাদের ওপর নিপীড়ন এবং লিঙ্গ বৈষম্য, দলিত এবং পিছিয়ে পড়া মানুষের বৈষম্যের শিকার হওয়া, আদিবাসীদের প্রতি নিপীড়ন, সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য — পার্টিকে সমস্ত বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে এবং এই সামাজিক পীড়ন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত করতে হবে। 

আমাদের বুঝতে হবে যে, পরিচিতির রাজনীতি সেইসব অংশ থেকে সাড়া পায়, যারা সামাজিক নিপীড়নের শিকার এবং সমাজে প্রান্তিক হয়ে আছে। যে আদিবাসীদের বাসস্থান, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা সবই ধ্বংসের মুখে, তাদের কাছে পরিচিতি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই কারণেই পার্টির ১৮তম কংগ্রেস এই সামাজিক বিষয়গুলিকে গুরুত্ব সহকারে অন্তর্ভুক্তির ওপর জোর দিয়েছে। 

যখন পরিচিতি কেন্দ্রিক এইসব  বিষয় এবং তৎসম্পর্কিত সংগ্রাম শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে এবং বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্লাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত করা হবে, তখনই তা সাম্প্রদায়িক পরিচিতির রাজনীতিকে প্রতিহত করতে পারবে।

NGO প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, পরিচিতির রাজনীতি এদের প্রধান হাতিয়ার। স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক আন্দোলন এবং অরাজনৈতিক আন্দোলনের কথা বলে এরা সাধারণ আন্দোলনকে বাধা দেয়। এইভাবে জনগণকে বাম রাজনীতি এবং সাধারণভাবে রাজনীতি সম্পর্কে বিমুখ করে তোলে। আদিবাসী, দলিত এবং নিপীড়িত জনগণের মধ্যে যে NGO-রা কাজ করে, তাদের জন্য বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ আসে। এই NGO-রা পরিচিতির রাজনীতি ব্যবহার করে সাধারণ আন্দোলন থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে। পৃথক পৃথক পরিচিতি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ব্যাপক ঐক্য গড়ে ওঠার পথে বাধা সৃষ্টি করে। 

পার্টির ১৮তম কংগ্রেসে ‘কিছু নীতিগত বিষয়’ শীর্ষক-এ নির্দেশ করা হয়েছে :

“যে-সব NGO জাত, জাতি এবং ধর্মীয় রাজনীতিকে পালন করে এবং জনগণের কিছু অংশকে সাধারণ আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় তাদের অপচেষ্টাকে প্রতিহত করতে হবে।”

এমন সময় আসতে পারে যখন বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পরিচিতির রাজনীতিতে যুক্ত গোষ্ঠীগুলি যে সমস্যাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে, তা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। যেমন বলা যায়, দলিতদের বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে যদি জাতিগত নিপীড়নের বিষয়ে লড়াই করতে হয়, তাহলে এই বিষয়ে যারা মানুষকে সংহত করতে পেরেছে সেই রকম গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। অন্য কিছু গোষ্ঠীর সঙ্গেও হাত মেলানো যেতে পারে। কিন্তু সাধারণ প্লাটফর্মে তাদের সাম্প্রদায়িক এবং বিভাজক দৃষ্টিভঙ্গি যাতে না আসে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। সাধারণের ঐক্যবদ্ধ সমবেত মঞ্চে আমরা যখন যুক্ত হচ্ছি, তখন মূল দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আপস করা হবে অনুচিত। এই গোষ্ঠীগুলি সম্পর্কে আমাদের মনোভাব, তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য বিষয়ে পার্টির সদস্য এবং অনুগামীদের শিক্ষিত করা প্রয়োজন। 

এই বিষয়ে দুটি ভ্রান্ত প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে হবে।

প্রথমটা হল যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা শ্রেণি এবং শ্রেণিভিত্তিক  আন্দোলনের কথা বলে, কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বাস্তবে কতটা নিপীড়ন এবং বিভেদের শিকার, তা বিচার করে না। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের একটা প্রবণতা আছে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সমস্যার ওপর জোর দেওয়া, যা শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে গঠিত। এক্ষেত্রে দলিত বা তপশিলি উপজাতি থেকে আসা শ্রমজীবীদের প্রতি অভ্যন্তরীণ বিভেদের সমস্যা উপেক্ষা করা হয়। যেমন একই কাজ করার জন্য দলিত শ্রমজীবী কম মজুরি পায়। শ্রমজীবীদের বিভিন্ন অংশের প্রতি সংঘটিত সামাজিক নিপীড়ন এবং বিভেদের বাস্তবতা উপেক্ষা করে বৃহত্তর শ্রমিক শ্রেণি-ঐক্য গঠন এবং শ্রেণি-আন্দোলন শক্তিশালী করা যায় না। 

অন্য প্রবণতাটি হল, পরিচিতি সত্তার রাজনীতির কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে তার পশ্চাদ্গমন করা। কতিপয় গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক রাজনীতি এই ধারাকে প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। তাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার নামে এবং তাদের জয় করার নামে কখনও কখনও তাদের ভ্রান্ত রাজনীতিকে থামানো বা বাধা দান করা হয় না। এই গোষ্ঠীগুলি সম্পর্কে জনগণের মধ্যে প্রচার চালানোর কোনও চেষ্টা করা হয় না। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন জাত এবং সমস্ত সামাজিক বাধার ঊর্ধ্বে উঠে নিপীড়িত জনগণকে নিয়ে শ্রমজীবী ঐক্য গড়ে তোলা।

আমরা যদি এইসব মানুষদের চেতনার স্তরের ভিন্নতার কথা মাথায় রেখে, তাদের জন্য পৃথক পরিসর তথা মঞ্চ তৈরি করতে চাই, তাহলে তাদের কাছে পৌঁছোতে হবে, তাদের সমস্যাগুলির ভিত্তিতে তাদের সংগঠিত ও সংহত করতে হবে। সর্বোপরি এই সংহতকরণের মাধ্যমে তাদের সমগ্র জনতার সাধারণ আন্দোলনে যুক্ত করতে হবে। এই প্রয়াসে যদি আমরা নিরলস ভাবে সক্রিয় থাকি তবে তারা সংকীর্ণ পরিচিতির ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক এবং শ্রেণি আন্দোলনে যুক্ত হতে পারবে। 

[ মূল প্রবন্ধ ‘The Challenge of Identity Politics’ প্রকাশ হয় The Marxist পত্রিকায় (XXVII 1-2, January-June 2011)।]  

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান