জয়া মিত্র
মানুষ রোজই কিছু শেখে। কোনও দিন বেশি, আবার কোনও দিন অল্প একটু। গত এক বছর ধরে ভারতবর্ষে আমরা শিখলাম, সে এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। নিশ্চিত, পরবর্তীতে এই ঘটনাপ্রবাহ একটা উপকথায় পরিণত হবে। ভারতবর্ষের কৃষকদের হাতে এক সমকালীন ইতিহাসকে তৈরি দেখলাম। এক-দুদিন নয়, গত এক বছর ধরে কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ কৃষক দেশের রাজধানী অবরোধ করে রাখলেন। ভারতবর্ষ, যাকে একসময় আমরা জেনেছিলাম সমৃদ্ধ এক কৃষি-সভ্যতার দেশ বলে, পরবর্তী সময়ে, বড় হয়ে উঠতে উঠতে দেখলাম দুনিয়ার কাছে তার নতুন পরিচয় ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো দরিদ্র ক্ষুধার্তদের দেশ। আগে যাদের বলা হত দরিদ্র, ভদ্রতা করে এখন তাদের বলা হয় ‘উন্নয়নশীল’। ভারত সেই অবস্থার মধ্যে থেকেও আন্তর্জাতিক বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে গণ্য হবার দিকে এগোচ্ছে। এর কেন্দ্রবিন্দু তথা আধুনিক শক্তিকেন্দ্র যে রাজধানী, তাকে এক বছর ধরে ঘিরে রেখেছিলেন কৃষকরা। তাঁদের হাতে কোনও অস্ত্র দেখা যায়নি। অথচ তাঁদের ঘিরে রাখার মধ্যে এমন জোর ছিল যা ওই শক্তিকেন্দ্রকে একেবারে নড়াচড়া করতে দেয়নি। তাঁদের কাছ থেকে যে শিক্ষা পাওয়া গেল গত এক বছর ধরে কিংবা তারও আগে যে সলতে পাকানোর পর্যায়, যা আমাদের অলক্ষ্যে ছিল তার কিছু কিছু আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল, বিস্ফারিত হয়ে উঠল — সেই সমস্ত পর্যায় ধরে আমরা দেখলাম যে, মানুষের আত্মিক শক্তি যখন সামনে এসে দাঁড়ায় অর্থাৎ যখন মানুষ ঠিক করে যে সে কিছু একটা করবে, খুব বড়ো শক্তির বিরোধিতা করে একটা বড়ো পদক্ষেপ নেবে, তখন এমন বলে সে বলীয়ান হয় যা তাকে একটা দূরক্ষেত্র পর্যন্ত জয়লাভ করার শক্তি জোগায়।
বিগত দশ বছরের পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গণআন্দোলনের গতিপ্রকৃতি আমরা লক্ষ করছি। আমেরিকায় ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট, মূলত যুব ছাত্রদের নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, ইউরোপ, এশিয়ার দেশে দেশে স্থানীয় শাসকের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে তা ছড়িয়ে পড়ে। খোদ ব্রিটেন সহ নানাদেশ, বিশেষত যুবছাত্ররা সেই নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করল, আমাদের পার্কসার্কাস বা শাহীনবাগের মত নানা জায়গাতেও। এই প্রত্যেক ক্ষেত্রে শক্তিমানরা বারবার চেয়েছিল প্রতিবাদ অস্ত্রের রাস্তায় নেমে আসুক। কেননা সব দেশে অস্ত্রই শাসকের ভাষা, অস্ত্রের রাস্তায় একবার নামিয়ে আনতে পারলে প্রতিরোধকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ধ্বংস করে দেওয়া সহজ হয়। কিন্তু নানা উস্কানি সত্ত্বেও এই আন্দোলনগুলো অস্ত্রের পথে যায় নি। বরং তার চেয়ে অনেকবেশি কার্যকর রাস্তাই নিলেন আন্দোলনকারীরা — দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে শাসকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। যেমন আমরা শুনেছি বিখ্যাত লবণ আন্দোলনের সময়ে আমাদের এই বাংলার মেদিনীপুরের গ্রামের মানুষরা, দলে দলে মেয়েরা, পুলিশের লাঠিবৃষ্টির সামনেও অটল থেকে ঘোষণা করেছিলেন — ‘যতো মারো, তবু আমরা পিছাবনি’। অখ্যাত সেই গ্রাম দেশের ইতিহাসে জায়গা করে নিল ‘পিছাবনি’ নামে। দেখা গেল শাসকের ভাষার শরণ নেওয়ার বদলে মানুষ সামাজিক ন্যায়ের পথকে অনেক বেশি জোরের জায়গা বলে মনে করলেন। প্রায় একদশকে নানা দেশে, এমনকি আমাদের দেশেরও নানা ক্ষেত্রে পার্কসার্কাস থেকে শাহীনবাগ, জেএনইউ থেকে যাদবপুর, নাগরিকত্ব প্রমাণ বিরোধী আন্দোলন, বিভিন্ন জায়গায় ‘উন্নয়ন’এর নামে জমিদখল বিরোধী আন্দোলন বারে বারে নতুন পথে অভিঘাত তৈরি করছিল। জলের মধ্যে একটি ছোটো তরঙ্গ থেকে যেমন ক্রমশ বৃহত্তর বৃত্ত তৈরি হয়, ঠিক সেইরকম ভাবেই যেন ভারতবর্ষের কৃষক আন্দোলন একটা ঐতিহাসিক চেহারা পেল স্থায়িত্বের দিক থেকে, বিশালতার দিক থেকে।
এক বছর ধরে আমরা এই কৃষক আন্দোলনের সাক্ষী থাকলাম। সেক্ষেত্রে বারেবারে যাঁরা আন্দোলনকারীদের কাছে গিয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করছিলাম — ওঁদের মধ্যে কী কী পরিবর্তন দেখলেন? কেননা যাঁরা এসে রাস্তায় বসে ছিলেন, তাঁরা সকলে কৃষক নন, অথচ দাবি দাওয়া ছিল কৃষকের। আমরা এখন সেইসব কৃষকদের বলছি ‘অন্নদাতা’। ভারী সুন্দর এই শব্দটা তৈরি হয়ে উঠেছে এই এক বছরের মধ্যে। আসলে আন্দোলন নিজেই নিজের সৌন্দর্যে এই শব্দটা তৈরি করেছে। একজন তরুণ বন্ধু বললেন — ‘অন্নই ব্রহ্ম’। বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের মতো কবি তা লিখছেন। ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ‘অন্নকে ব্রহ্ম’ বারবার বলা হয়েছে। অন্ন মানুষের চেতনার জন্মদাতা। তাই যাঁরা সেই অন্নদানের শাস্ত্র জানেন তারাই ব্রহ্মজ্ঞানী — প্রকৃত জ্ঞানী। যাঁরা সৃষ্টি করতে পারেন, মাটি থেকে জল থেকে বীজ থেকে রৌদ্রের তাপ থেকে; কীভাবে মিশলে কোন্ অবস্থা তৈরি করতে পারলে ল্যাবরেটরির বাইরে প্রকাণ্ড খোলা মাঠের মধ্যে নিশ্চিত ভাবে প্রাণ সৃষ্টি হয়, সেই জ্ঞান যাঁদের আছে, তাঁদের থেকে বড় শিক্ষক আর কেউ নেই। স্বভাবত এই একবছরে তাঁদের যে অবস্থান, সেক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে কী কী পরিবর্তন ঘটেছে, জানতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, আন্দোলনকারীদের মধ্যে আছে অসম্ভব একটা নৈতিক জোর — ‘আমি যা করছি এটা আমি ঠিক কাজ করছি’ এই জেদের জোর। আমরা জানি, কবিরা সত্য কথা বলেন বা সত্য কথা যিনি বলেন তাঁকেই কবি বলা হত। কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা কবি এলিস ওয়াকার বলছেন — ‘everything you love can be saved’, যা কিছু তুমি ভালোবাসো তাকে রক্ষা করতে পারবে। সে ভালোবাসা হতে হবে আপ্রাণ ভালোবাসা। এই যে শক্ত করে ভালোবাসা, আপ্রাণ ভালোবাসা, ভালোবাসার জন্য সত্য সত্যই নিজের জান কুরবান দিতে তৈরি থাকা, তাই তো আমরা দেখলাম যখন চোখের সামনে একে একে সাতশ’ প্রিয়জনের মৃত্যু দেখার পরও, ঠান্ডায় জমে অসহ্য গরমে ছটফট করে মরে যেতে দেখার পরও, কেউ উঠে যাননি। কথায় যেমন বলে ‘বুকে পাষাণ বেঁধে’ স্থির রইলেন লড়াইয়ের মাঠে, তাঁদের নৈতিক শক্তি তো সত্যিই অকল্পনীয়। অথচ সেই শক্তি দিনের-পর-দিন মাসের-পর-মাস কী নরম ভাবে আত্মপ্রকাশ করল! যাদের হাত থেকে লাঠির আঘাত পেয়েছিলেন, কাঁদানে গ্যাস কিংবা কনকনে ঠান্ডার দিনে জলকামানের ঠান্ডা জলবর্ষণের মতো অমানুষী পীড়ন — সেই পুলিশ বাহিনীকেও কিন্তু ডেকে খাইয়েছেন এই অন্নদাতারা দিনের পর দিন। এবং সরকারের আমন্ত্রণে কথা বলার জন্য যেদিন শক্তিকেন্দ্রে পৌঁছোলেন তখন কিন্তু তাঁরা সরকারের দেওয়া অন্ন শান্তভাবে প্রত্যাখান করে নিজেদের খাবার সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন, ওখানে নিজেরাই বসে খেলেন। এই আচরণগুলিই এই আন্দোলনের মানুষদের ভিন্নতাটা সকলের চোখে স্পষ্ট করে তুলল।
রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক নেতাদের দেখে দেখে চোখ পচে গিয়েছে আমাদের, মন কালো হয়ে গিয়েছে। এত লোভ, এত দুর্নীতি। যেন এর কোনও তলকূল নেই, কোনো আত্মসম্মানবোধও নেই অবশিষ্ট। সেই সময়ে এই মানুষদের এই আমূল ভিন্নতা। এখানে যেমন ছোটো কৃষক বড়ো কৃষকরা ছিলেন তেমনি অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, লেখক, কবি — বিভিন্ন পেশার মানুষেরা সবাই এসে এক জায়গায় জড়ো হয়েছিলেন। একটিমাত্র দাবি — ভারতবর্ষের সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রাণ স্বাধীনতার মূল আমার কৃষির অধিকার আমার জীবিকা ও সংস্কৃতির অধিকার। কৃষিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য পাস করা তিন আইন ফেরত নিতে হবে। এছাড়া আর কোনোকিছুই বিবেচনাযোগ্য নয়। এই জোরটা কোথা থেকে আসে?
এ কি শুধু কৃষকদের নিজেদের জন্য দাবি? তা নয়, কেননা তাঁরা কেবলমাত্র নিজেদের ভাতের হাঁড়ি বসাবার জন্য চাষ করেন না। একজন তরুণ লেখক সম্পাদক বলেছেন, ‘কৃষকরা সংবর্ধনা পাওয়ার জন্য চাষ করেন না। তাঁরা চাষ করলে আমরা খেতে পাই।’ কৃষকরা যে কঠিন পরিশ্রমের জীবন কাটান, বংশানুক্রমে চাষের কাজে যে জ্ঞানকে তাঁরা আয়ত্ত করেছেন এবং তাকে প্রয়োগ করে দশকের পর দশক ধরে সমস্ত সমাজের খাদ্য উৎপাদন করেন — তাতে তাঁদের কোনও ফাঁকি থাকে না। তবে কেন আমাদের দেশের কৃষকরা দরিদ্র থাকেন? কেন আমার দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ কম খেয়ে বাঁচতে বাধ্য হন? আমরা সকলে জানি, ছোটোবেলা থেকে আমাদের বছরের-পর-বছর শেখানো হত আমাদের জনসংখ্যা বেশি তাই আমাদের খাবারে কুলায় না। কিন্তু এ সত্য কথা নয়। সত্য কথা হল, যাঁদের হাতে ক্ষমতা আছে তাঁরা সেই সব ফসল নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করে রাখেন এবং নিজেদের সুবিধামতো খরচ করেন। তাঁদের মধ্যে সেই নৈতিকতার জায়গা কোথাও নেই যে, যাঁরা উৎপাদন করছেন তাঁরাই ঠিক করবেন কাকে কী দেবে। সমাজের জন্য যেহেতু এই উৎপাদন সেক্ষেত্রে প্রথমেই সমাজের ক্ষুন্নিবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
অর্থাৎ, যাঁরা চাষ করেননি, কেবলমাত্র রাজনৈতিক ফন্দিফিকির দিয়ে ক্ষমতা দখল করে রেখেছেন তাঁরাই মূলত দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্ভাবনা — কৃষিকে নষ্ট করেছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস সংসদ বলছে ভারতবর্ষ দশ হাজার বছরের পুরানো কৃষি ইতিহাসের অধিকারী। এই দশ হাজার বছর ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিয়মাবলি মেনে কত বিচিত্র রকমের কৃষিকাজ হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কতোদূর পথ এসেছে কৃষিকাজের পদ্ধতি, বিষয়। আজ যেন আমরা কোথাও তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। আমরা আর তাকিয়ে দেখি না। আমরা নিজেদের সংস্কৃতি থেকে সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। কিছু কিছু বাইরে থেকে নিয়ে আসা জ্ঞানের বেড়াজাল আমাদের মধ্যে একটা অভেদ্য প্রাচীর সৃষ্টি করেছে। আমরা কৃষকের জীবনের দিকে কখনও তাকিয়ে দেখিনি। যদি দেখি তাহলেও অন্য কারোদের বুনে দেওয়া একটা চিত্রিত পর্দার ভেতর দিয়ে দেখছি। কৃষকের জীবনে যে কঠিন শ্রম, যে নিয়মানুবর্তিতা, যেভাবে তাঁরা প্রকৃতিকে পাঠ করতে পারেন, সেই পাঠের অর্থবোধ করতে পারেন এবং যেভাবে প্রকৃতির কাছ থেকে প্রতিটা সমস্যার সমাধানের রাস্তা খুঁজে বার করে নিজে উৎপাদন করেন, সেই উৎপাদন অন্যের কাজে লাগে, সেই কৃষিসম্ভব দেশে, কৃষি সংস্কৃতির দেশে কী করে সমস্তটা এমন বিশৃঙ্খল হয়ে গেল! আমার সমস্ত মাটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমার এই সাতশো নদীর দেশ, যে দেশের অন্যতম জাতীয় সংগীতে দেশকে ‘সুফলা’ বলার আগে ‘সুজলা’ বলা হয়েছে সেই অজস্র বৃষ্টিপাত আর অকৃপণ নদীর দেশের সমস্ত জল দূষিত হয়ে গিয়েছে, নয় শেষ হয়ে গিয়েছে। যাঁরা অকৃষক, অর্থাৎ যে যে কর্পোরেট কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ করছিল গত ৫০-৬০ বছর ধরে, হিসেবে দেখা যাবে তারা প্রত্যেকে কোটি কোটি টাকা জমা করেছে। সারের ব্যবসা হোক কিংবা কীটনাশক বিষ, ট্রাক্টর থেকে হারভেস্টর, মাটির নিচের আরো আরো নিচের জল টেনে তোলার পাম্প অর্থাৎ কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন জিনিসের বড়ো ব্যবসা করেছ যারা — মোটা পুঁজি লাগিয়েছে কৃষি ক্ষেত্রে, তারা প্রত্যেকেই কোটিপতি হয়ে গিয়েছে। ফাঁকির ভাগটা, ক্ষয়ের দিকটা পড়েছে কৃষকদের দিকে আর প্রকৃতির ওপর। আমার জঙ্গল ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, মাটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, নদী নষ্ট হয়ে গিয়েছে আর দেশে কমপক্ষে আড়াই লক্ষ কৃষকের মৃতদেহ আমাদের সভ্যতা বহন করে চলেছে।
এই সংকটকালে দাঁড়িয়ে আমরা যদি না বোঝার চেষ্টা করি যে, কৃষি একটি সমগ্র সংস্কৃতি, এর সঙ্গে জীবন-যাপনের গভীর সম্পর্ক আছে, তাহলে এই সভ্যতার ধ্বংস আটকানো আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। কৃষিজীবী অন্নদাতাদের আন্দোলন আমাদের এই শিক্ষাই দিল, এই নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের সততা বজায় রাখার শিক্ষা। নিজের ভালোমন্দ খোলাভাবে বিচার করে দেখার এবং তা এক সম্মেলক কাজে ব্যবহারের শিক্ষা। আমরা বর্তমান সভ্যতার এমন অংশ হয়ে গিয়েছি যে বুঝে না বুঝে কারও নির্দেশ অনুযায়ী চলছি। স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমশ এক প্রভুর প্রত্যক্ষ অধীনতা থেকে অন্য বিশ্বপ্রভুর অধীনতায় এসে আমরা পৌঁছেছি। চিন্তাশীল মানুষরা বারেবারে বলছিলেন, যে ঔপনিবেশিক শক্তিকে তুমি শত্রু বলে চিহ্নিত করছ, তার হাত থেকে ছাড়া পেলেই কি তুমি স্বাধীন হবে? জানার মধ্যে একথা সবচেয়ে বেশি করে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর গান্ধিজি। আজ আমরা তাঁদের কথার সত্যতা বুঝতে পারছি। আজ যে আমি অনেকের অধীন তা শুধু নয়, বরং সবচেয়ে বড়ো বিপদ হল এই অধীনতার পরিসরে দৃশ্যত আমাকে জোর করে কেউ ধরে আনেনি। একবার থমকে দাঁড়িয়ে আমাদের পায়ের সামনে খাদটার দিকে যদি তাকিয়ে দেখি তাহলে বুঝতে পারব সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের জায়গা থেকেই কিন্তু আমাদের দখল করে নেওয়া হয়েছে।
সাধারণ এক উদাহরণ দেওয়া যাক। ছোটো ক্লাসের ছেলেদের একসময় উঁচু ক্লাসের ছেলেরা সিগারেটের বা অন্য কোনও রকমের নেশা ধরিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাইত কত মজা নেশায়! কিন্তু একটা সময় যে নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল সে কিন্তু সরে দাঁড়ায় তাই শুধু নয়, বরং যাকে নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল তার ঘাড়ে ভর করে নিজের ইচ্ছে পূরণ করে। আমাদের এই যে ঝকমকে সভ্যতা, বহুজাতিক সভ্যতা (বিশ্বময় দিয়েছে তারে ছড়ায়ে) এই যে ভোগের সংস্কৃতি, যেখানে স্পর্ধাভরে লিখে দেওয়া যায় তুমি জিনিস কিনতে কিনতে মরে যাও Shop Till You Drop। কেননা তাকে জিনিস উৎপাদন ও বিক্রি করতে হবে। এই জিনিস বিক্রির উদ্দেশ্য কাদের, কোথা থেকে কীভাবে এই জিনিস বিক্রি পৃথিবীর কালচারকে দখল করল এ নিয়ে অনেকে লিখেছেন, অনেক বড়ো মানুষ বলেছেন। তবু তার থামার লক্ষণ বিশেষ চোখে পড়ে না।
কোথা থেকে এই আগ্রাসী উৎপাদন ও ব্যয়ভার ব্যবস্থার শুরু? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রথম মার্কিন কংগ্রেস হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট হ্যারল্ড ট্রুম্যান বলছেন এই যুদ্ধের পরে প্রায় সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এখন আমাদের দায়িত্ব — it is our responsibility to develop the world. তারপরের কথাটা খুব প্রণিধানযোগ্য — to develop means to produce more. আগে আমরা জানতাম প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন হয় অর্থাৎ যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই উৎপাদন হয়। পুরানো সভ্যতায় ওই একই ভাষায় বলা হত cut your coat according to your cloth. আমাদের ঘরে সংসারে গৃহস্থালীতে সমাজে এই সংযতভাবে ব্যবহার করার একটা প্রচলন ছিল। তাকে বলা হত সাশ্রয়। খুব অল্পদিনের মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন নয়, প্রয়োজন উৎপাদন করাই ডেভেলপমেন্ট-এর প্রথম ও প্রধান সর্ত হয়ে দাঁড়াল। producing need। এই Producing need -ই নতুন সংস্কৃতির নানারকম কৌশল। প্রতিদিন যেখানে যত বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ আছে সেই সব দেশের পর দেশে গিয়ে সুকৌশলে সেখানকার কিছু মানুষকে সাংস্কৃতিকভাবে জয় করে নিয়ে তাদেরকে প্রথমে (ফ্রিতে নেশা করার সুযোগ দিয়ে) বোঝানো হল যে, এই রকম জীবন যাপন, এই যে প্রাচুর্য আর বেহিসাবি জীবনযাপন (তোমার যত খুশি তত ব্যবহার করো) — এই জীবন যাপনই মানুষের উদ্দিষ্ট। একেই সভ্যতা বলে। যত ঝকমক করবে তত বেশি সভ্যতা। আমাদের মত অনেকলোক সেই সাংস্কৃতিক প্রচারে নিজেদের অভ্যস্ত ভাবনাচিন্তা বিসর্জন দিলাম। নিজেরা এসে ওই ‘প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন’-এর বদলে ‘উৎপাদন অনুযায়ী প্রয়োজন’-এর জায়গাটায় যোগ দিলাম। লোভই সংস্কৃতি হয়ে উঠল আর ‘আরো যা যা পাওয়া যায়’ তা আয়ত্ত করাই ধীরেধীরে সমাজের কিছুজনের মনোযোগের প্রধান বিষয় হয়ে গেল। তার জন্য চলল নিরন্তর, এমনকি অর্থহীন প্রতিযোগিতা ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর। যাদের সেই ক্ষমতা নেই, ক্রমাগত সুচতুর বিজ্ঞাপনের সাহায্যে তাদেরও টেনে আনা যে কোনোভাবে অর্থ উপার্জনের দিকে। অর্থের প্রয়োজন সৃষ্টি করা হল বেশি জিনিস কেনানোর জন্য। একদিন যাঁরা ‘চিপকো’ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন আজ তাঁদের নাতিরা বলে, জঙ্গল আবার গজিয়ে যাবে, এখন গাছ বাঁচানোর বদলে টাকা নিয়ে শহরে চলে যাওয়াই ভালো। ‘ভালো’র সর্বগ্রাসী বিজ্ঞাপন অসংখ্য মানুষকে সেদিকেই টেনে নেয়। সর্বত্র। কৃষিকেও সমাজের ক্ষুধানিবারণের বদলে ক্রমশই করে তোলা হয়েছে অর্থ উপার্জনের উপায় যদিও তার মালিকানা চাষির হাতে নেই, আছে অন্যত্র। ধীরসঞ্চারী বিষের মতন তৈরি হয়ে উঠেছে নতুন সংস্কৃতি। আমাদের জ্ঞান থাকে না যে কোনো বস্তুর উৎপাদনই শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিকে ক্ষয় করে। এই need আর greed একসঙ্গে হলে মনে পড়ে গান্ধীজির কথাটি ‘Nature has enough by everybody’s need but nothing for everybody’s greed.’ শ্রী নীহাররঞ্জন রায় প্রাকৃতিক সম্পদকে বলেছিলেন ‘প্রাকৃতিক ধনসম্বল’। সম্বল তো তাই, যাকে মানুষ খুব যত্নে রেখে রেখে খরচ করে। সেখান থেকে আমরা ধীরে ধীরে একটা শব্দে অভ্যস্ত হলাম ‘প্রাকৃতিক সম্পদ’। আর আজকে দেখি কখন যেন সেই শব্দ মুছে গিয়ে নতুন শব্দ এসেছে ‘প্রাকৃতিক উপাদান’। উপাদান তো কাঁচামাল, যাকে প্রসেসিং করা হবে। ব্যবহৃত হওয়াই যার গুরুত্ব। গত ত্রিশ চল্লিশ বছর ধরে হাজার হাজার সচেতন মানুশের সতর্কবাণী বিফলে যাচ্ছে রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের কাছে কারণ তারা অনেকখনাই সফলভাবে দখল করতে পেরেছে এক বড়ো অংশের মানুষের ভাবনা।
এদিকে ক্ষয় হতে হতে প্রকৃতি যেখানে এসে পৌঁছেছে তা বুঝতে গবেষণা বা সতর্কবার্তার দরকার পড়ে না। প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন আবহাওয়ার বিপদ আছড়ে পড়ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ধনী এবং দরিদ্র এইরকম ভাবে বিপন্ন হচ্ছে। কোনোভাবে সেখান থেকে বাঁচবার কিংবা পালাবার উপায় নেই। এই যাঁরা to develop is to producing more — এই কথাটা মেনে চলছিলেন তাঁদের সংকটও কমছে না। সেই যে একটা ছবি ছিল একটা সাপ লেজের দিক থেকে নিজেকে খেতে শুরু করেছে।
কোটি কোটি বছরে পৃথিবী যা জমা করেছিল, প্রকৃতিতে ধনসম্বল বলে যা কিছু সমস্ত প্রাণীজগতের রক্ষার উপায় হিসাবে ছিল তার সবকিছু অল্প কিছু মানুষ উন্মত্তের মতো, চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো ধ্বংস করছে। এই সংকটই আজ পৃথিবীর প্রধান সংকট। আসলে মানুষ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভাবে বাঁচার কথা। খড়কুটোটিকেও মানুষ আঁকড়ে ধরে বাঁচবার জন্য। নিজের জন্য, নিজের সন্তানের জন্য, প্রিয়জনদের জন্য। তাই এখন অনেকজন আমরা বারবার ভাবছি আমরা বাঁচব কেমন করে। গত একশো থেকে দেড়শো বছরের যে অতি উপভোগের সংকট কালে আমরা নিজেদের আপ্রাণ জড়িয়ে ফেলেছি যদি সেইখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারি, এখনও তাহলে পৃথিবী আমাদের কাছে মুক্ত আছে। কিন্তু কেমন করে বেরিয়ে আসব এত বড়ো বিপদ, সমস্ত পৃথিবীজোড়া যে সংকট তার ভেতর থেকে?
প্রথমেই তো মনে হয়, আমি যে একলা একটা সামান্য মানুষ আমি কী বা করতে পারি? আবার একই সঙ্গে ভাবি এই বিশাল মানবধারার মধ্যে অণুপরিমান হলেও আমি তো এরই একটা গ্রন্থি। আমারই মতো আরও সহস্র সহস্র কোটি মানুষের ভেতর দিয়ে এই সর্বনাশ ধাবিত হচ্ছে। আমি যদি ভাবি এই লোভ, অসংযম এই অনর্থক নষ্টবুদ্ধিকে আমি আমার অস্তিত্ব দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করব, তাহলে কিছুটা সুফল কি পাব না? আমাদের খুব পুরানো গল্প ‘আরুণি উদ্দালক’-এর কথা মনে পড়ে। গুরু তাঁকে বলেছিলেন বন্যার জলে ধানখেতের বীজ ভেসে যাচ্ছে, যাও বীজ রক্ষা করো। অন্যেরা কাদা দিয়ে মাটি দিয়ে চেষ্টা করেছে, কিন্তু জলধারা আটকাতে পারেনি। আরুণি অন্য উপায় না পেয়ে নিজে শুয়ে পড়ল সেই ভাঙা আলের ওপর। নিজের অস্তিত্ব দিয়েই সে ভাঙন ঠেকানোর চেশটা করল। নিজেকেই আল করে তুলল সে। একমাত্র তখন বীজ ভেসে যাওয়া আটকাল। এই গল্পের এক নতুন ব্যাখ্যা মনের মধ্যে ঘুরেঘুরে আসে। সময়ের সংকটই গুরু গৌতম, যিনি বলেছিলেন বীজ রক্ষা করো।
বীজ তো রক্ষা করতেই হয়। আমরা এখনও এমন জায়গায় চলে যাইনি যে, আমাদের সভ্যতা বীজ হারিয়ে ফেলেছে। আমরা খুব ছোট্ট জায়গা থেকে ভাবতে পারি। যে মানুষদের শ্রদ্ধা করি, দেখে শেখার চেষ্টা করি তাঁরা কিন্তু যা বলেন সেটাই করেন। যেমন, চাষিরা, যাঁরা গত এক বছর ধরে আমাদের শিখিয়েছেন। আমাদের জনপদগুলোর আশেপাশে যাঁরা থাকেন কিংবা এখনও আমাদের বহু পরিবার যাঁদের শিকড় এখনও গ্রামে প্রোথিত তাঁদের থেকে আমরা সরে সরে আসছি। কিন্তু আমাদের সেই সরে আসার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই যে ক্রমশ সমাজ থেকে সরে আসা, গোষ্ঠী থেকে সরে আসা, মানুষ যে সমাজবদ্ধ জীব তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া, ক্রেতাসংস্কৃতি অর্থহীন কতগুলি প্রতিযোগিতার মধ্যে আমাদের ঠেলে দিয়েছে। সবচেয়ে ছোট শিশুকেও শেখানো হয় ‘জিততে হবে’। এটাই সংস্কৃতি। সেই যে পুরানো পঞ্জিকায় লেখা থাকত এই সুগন্ধি রুমালটি যার কাছে থাকবে সে সব কাজে চূড়ান্ত সফল হবে। তখন অবাক হয়ে ভাবতাম, পঞ্জিকায় যা লেখা আছে সে তো সবাই দেখবে, সবাই যদি রুমালটা কেনে! এখন সেই কথা আবার মনে হয়। এখন প্রত্যেককেই বলা হয় তোমাকে শ্রেষ্ঠ হতে হবে, তোমাকে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে। এই ‘ক্ষমতাসম্পন্ন’ ‘শ্রেষ্ঠ’ ‘সফল’ শব্দাবলিকে যদি প্রশ্ন করে করে বিশ্লেষণ করতে থাকি, ছোটোদের অভিভাবকরা যাঁরা পাগলের মতো বাচ্চাদের একটা প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেন তাঁদের যদি খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করি, তাঁদের নিজেদের মুখোমুখি করতে পারি তাহলে দেখা যাবে সব সফলতা শ্রেষ্ঠতা সবচেয়ে উঁচু শব্দগুলোর অর্থ একটাই — অনেক বেশি ক্রয়ক্ষমতা লাভ করতে হবে। ‘অসফল হওয়া’র, ‘হেরে যাওয়া’র বোধে সমাজ বাস্তবে গ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। নতুন সংস্কৃতির মালিকরা বলছে ‘কেনো আরও কেনো তাতে তোমার প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক। কেননা আমাকে produce করে যেতে হবে তাতে যদি পৃথিবীর সব প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়, যাবে। রাস্তা বানাতে যদি চাষের জমি নষ্ট করতে হয়, হবে। খনি করতে গিয়ে যদি আদিম অরণ্য ধ্বংস হয়, হবে। খাদান খুঁড়লে দেউচা-পাচামি ধ্বংস হয়ে যাবে তো যাবে আমি আরেক জায়গায় চলে যাব। এর আগে কি ধ্বংস হয়ে যায়নি, ঝাঁঝরা হয়ে যায়নি আফ্রিকার, দক্ষিণ আমেরিকার প্রাকৃতিক সম্পদে সম্পন্ন দেশ! এই নতুন অর্থনীতিই আজকের রাজনীতি। এর প্রবক্তারা আসলে তান্ত্রিকের মতো, ভূতগ্রস্তের মতো। কত মুনাফা এঁরা চান? মুনাফাও তো একটা ধারণা। এই যে ভূতগ্রস্ত তন্ত্রগ্রস্ত মানুষেরা যাঁদের কখনও কর্পোরেট, কখনও ক্ষমতা বলা হয়, এঁদের তো কিছু যায় আসে না মনুষ্যজন্ম নিয়ে। একটা দেশ ধ্বংস হয়ে গেলে পরের দেশটায় যাবে। আমাজনের জঙ্গল পুড়ে ছাই হয়ে গেল তো কিছুই গেল এল না। তারপরে এক মাসের মধ্যে আবার অন্য আরেক জায়গায় এদের মৃগয়া ছড়িয়ে পড়ল। এতদিন যে আমরা ভরসা পেতাম ভারতবর্ষ অনেক বড়ো দেশ আর অনেক মানুষ, আমাদেরকে একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হবে না, কিন্তু আজকে আর সেই ভরসা থাকছে না। কেননা, আমাদের মতো মানুষেরা এখন নানারূপে নিত্য প্রচারিত লোভগুলির মুখোমুখি হচ্ছি, ওদের বিশ্বাস করছি, ওগুলো আয়ত্ত করার চেষ্টা করছি, ওখানে প্রবিষ্ট হবার লোভে একজন একজন করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি। অর্থ আর বস্তু আয়ত্ত করার পরে কিন্তু আমাদের আর কোনও ছাড় নেই।
এক লক্ষ টাকা দিয়ে এক ব্যক্তি মিউজিক সিস্টেম কিনেছেন, কিন্তু তিনি সেই মিউজিক সিস্টেমে একটা শব্দ কোনও দিন শোনার সময় পাননি। কেননা সমস্ত দিন ও রাত্রি তাঁকে লিখে দিতে হয়েছে ওই উৎপাদনের মেশিনটাকে চালু রাখার জন্য। যদি মানুষকে নিজের স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি সমস্ত কিছু বিসর্জন দিতে হয় তাহলে তার এই জীবনে সফলতা কোথায়? আমি একবারের একটা টিকিট কেটে এই জীবনের ভ্রমণপথে ঢুকেছি। বেরিয়ে যাব ক্লান্ত বীতস্পৃহ অশান্তিতে জর্জর; কোনও বন্ধু নেই কোনও স্বজন নেই সবাই কেবল প্রতিযোগী এরকম অবস্থায়! কী লাভ হল আমার সফল হয়ে সার্থক হয়ে? এই প্রশ্নগুলো আমার নিজের কাছে খুব বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যদি পরস্পরের হাত ধরতে না পারি, আমরা যদি একটা দিন একটা মাস একটা পক্ষকাল নিজের পরিবারের সঙ্গে থাকতে না পারি, নিজের বন্ধুদের সঙ্গে নির্মল মনে না মিশতে পারি, যদি অন্যের আনন্দ দেখে খুশি হতে না পারি, আমি ছাড়া আমার আশেপাশের সব লোককে প্রতিমুহূর্তে competitor ভাবতে হয় আর অবিশ্বাস করতে হয় তাহলে সে জীবনতো এক ভয়ঙ্কর বোঝা। ঠিক যে মুখ আজ দেখতে পাই খুব ছোটো ছেলেমেয়েদের, রঙ করা মুখ চোখ, অদ্ভুত একরকমের স্বাস্থ্য, একরকমের পোশাক। একেবারে তরুণদেরও মুখে নিষ্প্রাণ অশান্তি আঁকা, কেউ আনন্দিত নয়। এক মুহূর্ত একটা জিনিস আয়ত্ত করে সুখী পরমুহূর্তে আরেকটির জন্য ছুটছে। এই জীবন থেকে বেরিয়ে আসার কথা আমি ভাবতে থাকি। সহজ জীবনের দিকে যাব। এত জটিল এত স্তূপীকৃত ঐশ্বর্যের জীবন দরকার নেই। আমার তো একটা জীবন। এই একটা জীবনকে আনন্দিত করে না তুলে আমি কেন এত কষ্ট করব!
আমার কাছাকাছি যে বন্ধুরা, আমার যে শিশুরা, আমার আপনজনেরা, আমার যে গোষ্ঠীর মানুষেরা, যারা আমাদের আশেপাশে আছেন আমরা নিজেরা নিজেদের রোজ এই প্রশ্ন করতে শুরু করি যে, তোমার আনন্দ কীসে? দিনের শেষে কোনও শান্ত মুহূর্ত কি পাও তুমি নাকি ঘুমোতে যাও দুশ্চিন্তা নিয়ে? ঘুম ভাঙে প্রচণ্ড টেনশন এবং অ-সুখের মধ্যে? এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে যেখানে কোনও প্রতিযোগিতা নেই, ছোটো-বড়ো কোনও প্রতিযোগিতাই থাকবে না। কেননা কম্পিটিশনে যা অর্জন করব তা আমার সত্যিই দরকার নেই বরং পৃথিবীর যে ভয়ংকর অসুখ করেছে, আমার আশেপাশের মানুষেরা যে যে অসুখের কারণে কষ্ট পাচ্ছেন আমি এক এক সেন্টিমিটার করে সেটা কমানোর দিকে এগিয়ে যেতে পারি। এই যে এত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য খনি বাঁধ, ধ্বংস জঙ্গল আর জঙ্গলনিবাসী প্রাণ, নদীদের মৃতদেহে সভ্যতা পচে উঠছে, এতো বিদ্যুৎ কেন দরকার? এখন গ্রামেও ব্যবহৃত হয়। কেননা গ্রামেও পাম্পে জল তোলা হয়। বিরাট বড় সব ব্যাটারি রিচার্জ করা হয়। কোনও গ্রাম নেই যেখানে মানুষ তাঁর শ্রমের মর্যাদা পান। টাকা দিয়ে শ্রমের মর্যাদা হয় না, জীবনযাপন দিয়ে হয়। কত আর টাকা লাগে একটা মানুষের সহজ জীবন কাটাতে। যে বিপুল সম্পদ আমরা খরচ করি এবং তাকে আবর্জনা তৈরি করে ফেলি আমি সেই পথটাকে আমার নিজের মধ্যে যেতে দেব না, আমরা এতটুকু করার কথা ভাবতে পারি। যে কথা সত্য বলে মনে হবে সে কথা ক্রমাগত বলার চেষ্টা করব কেউ যদি না শোনে তাও বলব। বিশ্বাস মানুষ ঠিকই শুনবে, কেননা এ তো কোনও মানুষের একার চিন্তা নয়! পৃথিবী জুড়ে এত মানুষ ভাবছেন। দূষণের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার জন্য সেই মানুষদের পাশে দাঁড়াবার জন্য যারা সহজ জীবন জানেন। আমরা যখন বিকল্পের কথা ভাবব তখন বিকল্প আমাকে অসংযত প্রাচুর্য দেবে এই কথা ভাবব না।
ছোটো করে বাঁচা, সহজ করে বাঁচা, সুন্দর করে বাঁচা যেমনভাবে আমার সমাজ বহুদিন বাস করেছে ওটাই দরকার। সমাজের কি দোষ ত্রুটি ছিল না? ছিল, কিন্তু সেই দোষ ত্রুটিগুলোকে একটু একটু করে সংশোধন করা যায়। এ বাড়িতে মশা কামড়াচ্ছে বলে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পাশে অন্য বাড়ি তৈরি করে থাকব এমনটা তো করি না। কিংবা সাপ বেরিয়েছিল বলে এটা ফেলে অন্য বাড়িতে চলে গেলাম। বাড়িতেই থাকি ওটাকে আর একটু যত্ন করি আর একটু বুদ্ধি খরচ করি, আর একটু ভাবি। মানুষের প্রধান প্রাকৃতিক বিশেষত্ব তার ভাবনা করার ক্ষমতা আর ভালোবাসার ক্ষমতা। এই প্রাকৃতিক গুণ অন্য প্রাণীর নেই, মানুষের আছে। কিন্তু এই চকচকে সভ্যতায় এখন এই ভাবনার ক্ষমতাকে কাজে লাগানো ক্রমশ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই বাচ্চারা আর যেন না ভাবে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা বড়োরাও আর ভাবছি না। কেবলমাত্র কতগুলো মাধ্যমের উন্মাদ ডিকটেশনের পিছন পিছন চলছি। কিন্তু কেন? জীবন তো আমার, জীবনযাত্রা তো আমার ব্যক্তিগত জীবন যাত্রা। তবে সেই ব্যক্তিগতের মুক্তি কোথায়? অনেক অসংখ্য ব্যক্তিগত, গোষ্ঠিগত সমষ্টিগত নিয়েই সামাজিক জীব মানুষের সামগ্রিক যাপন। না হলে সে বাঁচে না। সেই সচেতন জীবিত ব্যক্তিগতের পথ কীভাবে সমষ্টিতে মিশবে, সামগ্রিকের দায়িত্ব নিতে শেখাবে যেমন কৃষকেরা নিলেন, তার আর্থিক হিসাব নয় প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেখলাম। আমি সকলের পাশে দাঁড়িয়ে সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
(‘আমরা-এক সচেতন প্রয়াস’-এর আয়োজিত আলোচনাসভায় প্রদত্ত বক্তৃতার উত্তর-লিখন করেছেন প্রীতি দে।)