পরিচিতির সাতকাহন 

মোহিত রণদীপ

আমি কে? কী-ই বা আমার পরিচয়? 

না, এই প্রশ্নের কোনও দার্শনিক উত্তর খোঁজার উদ্দেশ্য এই লেখার নেই। এই প্রশ্নের মুখোমুখি যখন দাঁড়াই, তার উত্তরে নিজের অনেক রকম পরিচয় আমার সামনে উঠে আসে। আমি কারোর সন্তান, কারোর পিতা, কারোর ভাই, কারোর বন্ধু! কোথায় আমার পঠনপাঠন! কিংবা কী আমার ধর্ম, কী আমার বর্ণ, কী আমার জাত, কী আমার ভাষা! কী আমার পেশা, কী আমার কাজকর্ম, আমার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিচয়ই বা কী! কার আমি সমর্থক! কোথায় আমার বাড়ি, কোথা থেকে এসেছি, কোথায় আমার দেশ, কী আমার জাতীয়তা! 

কোনটা আমার পরিচয়? কোন্ পরিচয় মুখ্য? কোনটাই বা গৌণ? 

সম্ভবত এইসব প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন, সময় এবং পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে! কিন্তু, এটা ঠিক যে কোনও একটা পরিচয়ের নিগড়ে আমাদের কারোর পরিচিতি সীমাবদ্ধ নয়! পরিচয়ের এই নানান রকমফের নিয়েই ‘পরিচিতির সাতকাহন’। 

. 

একথা আমরা সবাই জানি, এই পৃথিবী বহু রকমের বৈচিত্রে ভরা! আমাদের জীবনেও সেই বৈচিত্রের ছাপ প্রতি পরতে!  সেই বৈচিত্রের সৃষ্টি আমাদেরই নিজস্ব গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনের ঘেরাটোপে, প্রতিনিয়ত অজস্র সৃজনের মাধ্যমে। কিন্তু, সেই বৈচিত্রকে অস্বীকার করে এই পৃথিবীরই কোথাও কোথাও, কোনও কোনও বিশেষ সময়ে ও পরিস্থিতিতে আমাদের বহুমাত্রিক পরিচয়কে একটা নির্দিষ্ট পরিচয়ের মধ্যে বেঁধে রাখার চেষ্টা চলে। ইতিহাসে আমরা দেখেছি, গায়ের রঙের ভিত্তিতে সাদা আর কালোতে বিভাজিত দুনিয়া। দাস আর তার প্রভুর বিভাজন, মজুর আর পুঁজির মালিকে বিভক্ত পৃথিবী। জার্মানিতে আর্য গরিমায় গর্বিত জার্মান নাৎসি আর ‘বহিরাগত’ ইহুদির বিভাজন! সারা পৃথিবী জুড়ে সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর বিভাজন। সেই বিভাজন কখনও ধর্মের নামে, কখনও গাত্রবর্ণের নিরিখে, কখনও জাতপাতের নামে, কখনও ভাষার নামে, কখনও প্রাদেশিকতার নামে! গাত্রবর্ণের তফাতটুকু বাদ দিলে প্রায় সমস্ত বিভাজনই মানুষের তৈরি। ক্ষমতা আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই এই সমস্ত বিভাজন। ক্ষমতার স্বার্থেই দেশের একদল মানুষের অন্য সমস্ত পরিচয় সরিয়ে রেখে কোনও নির্দিষ্ট পরিচয়ে চিহ্নিত করে নির্মিত হয় সংখ্যাগুরুর বয়ান। আমাদের দেশে ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, জাতের নামে, ভাষার নামে মানুষকে ভাগ করার ‘ঐতিহ্য’ বহু প্রাচীন। ক্ষমতার প্রয়োজনেই এদেশের মানুষের বহুমাত্রিক পরিচয়কে একেবারে নস্যাৎ করে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার চেষ্টা সাম্প্রতিক কালে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দেশের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী দেশের মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘু এই দুই ভাগে ভাগ করার চেষ্টা করে চলেছে অবিরাম! প্রচার করে চলেছে, সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায় খুব শীঘ্রই জনসংখ্যায় সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে! এই প্রচার সংখ্যাগুরু বহু মানুষ বিশ্বাসও করেছেন। তাঁরা কোনও যুক্তিবোধ দিয়ে, তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে যাচাই করে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। সযত্নে নির্মিত ‘পোস্ট ট্রুথ’-এর ওপর আস্থা রেখেছেন তাঁরা। 

এই প্রসঙ্গে একবার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল বিশিষ্ট সমাজ-চিন্তক, প্রাবন্ধিক সৌরীন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ওঁর কথাই হুবহু তুলে দিলাম এখানে। 

“বেশ কয়েক বছর ধরে একটা ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার খুব বেশি, শীঘ্রই ওরা সংখ্যায় হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে, হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। 

ধরা যাক্, সত্যিই মুসলমানরা সংখ্যায় অনেকটা ছাড়িয়ে গিয়ে সংখ্যাগুরু হয়ে গেল! আর, হিন্দুরা হয়ে পড়ল সংখ্যালঘু! 

এতে কী কী অসুবিধা হতে পারে? আসুন না, একটু ভেবে দেখি, কী হতে পারে যদি সত্যিই আমরা হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ি! কেমন হবে সেই অনুভূতি? খুব কি বিপন্ন বোধ করবেন? মনের মধ্যে কি একটা চাপা ভয় বা অনিশ্চয়তার অনুভূতি দেখা দেবে? নিরাপত্তাবোধের অভাব বোধ করবেন? রাস্তাঘাটে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান, অসম্মানের আশঙ্কা নিয়ে চলতে হবে? নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে, জোট বেঁধে থাকতে ইচ্ছে করবে? সত্যিই কেমন হবে, আপনার মনের পরিস্থিতি, আপনার জীবনযাপন? 

এই পরিস্থিতিটা অনেকে দূরতম কল্পনাতেও আনতে চান না! সেটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ‘সংখ্যালঘু’ হয়ে বাঁচা বড়ো সহজ নয়! এদেশে আমরা মানে সংখ্যাগুরু হিন্দুরা যদি এটা একটু মনে রাখি, তাহলে সংখ্যালঘু-মানসিকতা বুঝতে সুবিধা হয়! সুবিধা হয়, সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিপন্নতা, অসহায়তা, হীনম্মন্যতা, আগ্রাসনের রূপকে বুঝতে! 

আমরা বরং আর একটু সংবেদনশীল মন দিয়ে তাঁদের জায়গা থেকে একটু বুঝতে চেষ্টা করি, সংখ্যালঘু মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, নাস্তিকদের মনের অবস্থা ! আমরা যদি সংখ্যালঘু হয়ে যাবার ভয় পাই, তাহলে এখন যাঁরা সংখ্যালঘু, তাঁরাও যে ভয় পাচ্ছেন, সেটা আমাদের বুঝতে হবে।” 

সৌরীন ভট্টাচার্যের এই কথার মধ্যে যে দর্শন রয়েছে, তা সমানুভূতির বোধ থেকে উৎসারিত। সেই দর্শনই হয়তো ঘৃণা, বিদ্বেষ আর হানাহানিতে ভরপুর এই বিশ্বে প্রকৃত শান্তির সন্ধান দিতে পারে!  

সংখ্যালঘু মনকে তাঁদের জায়গা থেকে উপলব্ধি করার শিক্ষা আধুনিক সভ্যতার অন্যতম মাপকাঠি। আমাদের মতো বহুত্বে পরিপূর্ণ দেশে তা আরও বেশি করে জরুরি! অথচ ঘটে চলে ঠিক তার উলটো প্রবাহ! ধর্মীয়, ভাষাগত, লিঙ্গ/যৌনতার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক মানুষকে প্রতিনিয়ত কী নির্মম অবজ্ঞা, অবহেলা, অপমান, অসম্মানের মুখোমুখি হতে হয়! একঘর বর্ণহিন্দুর মধ্যে কোনও একজন কত অনায়াসে হয়তো তাঁদেরই কোনও সহকর্মীর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেন, ‘সোনার চাঁদ/সোনার টুকরো’ জাতীয় অশ্লীল সম্ভাষণ! তখন আমাদের নীরবতাই যেন প্রশ্রয়ের সূচক হয়ে ওঠে। সংখ্যালঘু মানুষটির জায়গায় নিজেকে রাখলে, তাঁর অসম্মানিত মনের অনুভূতিকে তাঁর জায়গা থেকে বোঝার চেষ্টা থাকলে এমন উচ্চারণের আগে অন্তত দশবার ভাবতাম আমরা!  

. 

এক সরকারি অফিসের কাহিনি। বড় মেজো সেজো অফিসারসহ অন্য কর্মীরাও সকাল সাড়ে দশটার মধ্যেই প্রায় সবাই পৌঁছে যান। ঠিক ওই সময় চা নিয়ে আসে পাড়ার চায়ের দোকানের কর্মচারী বছর পনেরোর শিবু। সেদিন শিবুর হাত থেকে চা চলকে গিয়ে পড়ল অফিসের সেজোবাবু রাজদীপ ভট্টাচার্যের হাতে। অমনি উঠে দাঁড়িয়ে কষে দুটো থাপ্পড় লাগালেন শিবুর গালে! অফিসেরই ক্লার্ক তুহিনবাবু এই ঘটনায় প্রবল রেগে গেলেন, ‘ওইটুকু ছেলেটাকে এভাবে আপনি মারলেন! কোত্থেকে এত সাহস হয় আপনার?’ গলা চড়িয়ে পালটা চিৎকার করতে থাকেন সেজোবাবু। মেজোবাবু এসে সেজোবাবুকে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলেন, ‘কী এক লুন্যাটিক, পাগলের কথায় এত গুরুত্ব দিচ্ছেন আপনি!’ সেজোবাবুও মেনে নেন, ‘ঠিকই বলেছেন, স্যার!’

তুহিনবাবুর ওই সঠিক প্রতিবাদ হয়ে গেল, ‘লুন্যাটিক, পাগলের কথা…!’ বছর দশেক আগে তুহিনবাবু অ্যাকিউট সাইকোসিস-এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই সময় অল্প কিছুদিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছিল। এরপর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। তা সত্ত্বেও তাঁর ওপরে ওই স্বল্পকালীন মানসিক অসুস্থতার জন্য স্থায়ীভাবে ‘লুন্যাটিক’, ‘পাগল’ ছাপ লেগে যায়! তার নামে নয়, অসুস্থতার নাম দিয়ে তাকে ডাকা হয়! সেটাই হয়ে ওঠে তাঁর পরিচয়! অথচ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কারোর ক্ষেত্রে এভাবে আমরা, ‘ওই লোকটি ডায়াবেটিক’ বলি না! খুব সঙ্গত বোধ থেকেই বলি না! কিন্তু, মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে আমাদের এই সঙ্গত বোধ কাজ করে না সেভাবে! 

. 

ছোটো থেকেই আমাদের মধ্যে অনেকে বড়ো হই ‘গাধা’, ‘ছাগল’, ‘মাথামোটা’, ‘আকাট মূর্খ’… এমনই অনেক রকম বিশেষণ শুনতে শুনতে! ‘কিছুই পারিস না’,  ‘তোর দ্বারা কিছু হবে না’, ‘পাশের বাড়ির ছেলেটাকে দেখে শেখ’…এই জাতীয় বাক্যবাণের সঙ্গেও কমবেশি পরিচিত আমরা বেশিরভাগ জনই! স্কুলে বা বাড়িতে প্রদত্ত এইসব বিশেষণ অনেক সময় যেন অনেক ছেলেমেয়ের পরিচিতিই হয়ে ওঠে! বন্ধুরাও কেউ কেউ এইসব ‘ডাকনাম’-এ ডাকতে শুরু করে! এগুলো শুনতে শুনতে এক সময় আমাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করে, সত্যিই সে ‘আকাট মূর্খ’ কিংবা ‘মাথামোটা’, সত্যিই তার দ্বারা আর কিছু হবে না! আর যখন চেষ্টা করেও কিছু হবে না, তখন আর চেষ্টা করেই বা কী হবে! সেই কিছু হয়ে ওঠার যতটুকু চেষ্টা ছিল একসময়, তাও থেমে যায়! নিজের ওপর আস্থা সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়। তখন চেষ্টা শুরু হয় অন্য পরিচিতি গড়ে তোলার। পাড়ার যে ভালো ছাত্র বা ছাত্রীটি তার আদর্শ হয়ে উঠেছিল লেখাপড়ার কোনও এক পর্বে, এখন তার রোল মডেল হয়ে ওঠে সলমন খান বা অক্ষয় কুমারের মতো কোনও ম্যাচো হিরো কিংবা নিদেন পক্ষে পাড়ার মাস্তান কোনও দাদা! ও জানে এতে মাস্টারমশাই-দিদিমণিদের স্নেহ-ভালোবাসা না জুটলেও অবজ্ঞা আর তিরস্কারের মাত্রা কিছু কমবে, জুটবে একটু সমীহও। নেতারাও দলে টানার চেষ্টায় থাকবেন। ভোট করতে হলে মাসলপাওয়ারের মূল্য কতটা তা তাঁদের চাইতে ভালো আর কে-ই বা জানে! এভাবেই নিরীহ ছেলেটা তার আগের পরিচিতি বদলে ফেলে হয়ে ওঠে দোর্দণ্ডপ্রতাপ পাড়া বা শহরের দাদা! তবে সবাই যে ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ হয়ে উঠতে পারে এমন নয়, তারা হয়তো হীনম্মন্যতার ভার বয়ে নিয়ে চলে বহু কাল ধরে! 

. 

ছিলেন দাদা সিপিএম, হলেন দাদা তৃণমূল, তার পরে বিজেপি এখন আবার তৃণমূল! এভাবেই কত দাদা আর দিদিদের পরিচিতি যে রাতারাতি বদলে যায়, বদলে যায় তাঁদের আরাধ্য ‘দেবদেবী’, বদলে যায় তাঁদের ‘আদর্শ’, ভোলভাল সব! 

গত বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের রাজ্যে এই প্রবণতা প্রবল হয়েছে! এই প্রবণতা সেভাবে আমাদের রাজ্যে এতটা ব্যাপক আকারে ছিল না আগে। গত বিধানসভা নির্বাচনের কয়েকমাস আগে থেকে আমরা দেখলাম, বেশ কয়েকজন প্রতাপশালী নেতানেত্রীর হঠাৎই ‘শ্বাসজনিত অসুবিধা’ দেখা দিল! কিছুদিন আগেও যে আইপিএস অফিসার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে যত্রতত্র, এমনকি সরকারি অনুষ্ঠানেও সমস্ত সরকারি প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করে মাতৃজ্ঞানে বিভোর হয়ে উঠছিলেন তিনিই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হঠাৎই খড়্গহস্ত হয়ে উঠলেন সেই মাতৃসমার প্রতি! যে যুবনেতা মঞ্চের ওপরেই চরণস্পর্শ করতেন কথায় কথায় তিনিই দলবদলের পর একেবারে অন্য রূপে অবতীর্ণ হলেন! কুকথার বাণ ডাকল তাঁর কন্ঠে! ‘অনুপ্রেরণা’ শব্দ উচ্চারণ না করে যাঁরা কোনও কাজ করতেন না এবং অন্য কেউ উচ্চারণ করতে ভুলে গেলে রোষান্বিত হতেন, তাঁদের মধ্যেও অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা গেল দলবদলের পর! এঁদের অনেকেই আবার তাঁদের ‘আরাধ্য’ নির্বাচনে ত্রুটির কথা স্বীকার করে ফিরে এসেছেন পুরোনো ঠিকানায়! একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ যেতে একমাস না ঘুরতেই প্রতিদ্বন্দ্বী দলে নাম লেখালেন। আর, এই দল বদলের সঙ্গে সঙ্গেই বদলে যায় তাঁদের রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ, মতাদর্শ, আরাধ্য নেতানেত্রী…সব কিছুই! 

আশ্চর্যের কথা, কত অনায়াসে এইসব জনপ্রতিনিধিদের মতাদর্শ, রাজনৈতিক পরিচয় ঘনঘন বদলে যায় ক্ষমতার আরও বেশি স্বাদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়! শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ই বদলে যায় তা নয়, যে রাজনৈতিক দল, প্রতীক, নেতৃত্ব, সাধারণ সমর্থকের শ্রম, জনসমর্থনের ওপর নির্ভর করে এরা নির্বাচনে দাঁড়ান, নির্বাচনী যুদ্ধে জয়ী হন — সেই সবের প্রতি বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা এঁদের মধ্যে দেখা যায় না! আরও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষায় অনায়াসে বদলে ফেলতে পারেন সব পরিচয় মুহূর্তের মধ্যেই! এর জন্য কোনও আদর্শের প্রয়োজন হয় না তাঁদের! 

এক্কেবারে আমাদের শৈশবে দেখা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের দলবদলের সেই রুদ্ধশ্বাস পর্ব নতুন করে ফিরে এল রাজনৈতিক জার্সি বদলের মধ্য দিয়ে! এতো হতেই পারে! রাজনীতিতে ‘নৈতিকতা’ সব থেকে বিরল শব্দ! শুধু এইসব রাজনীতির খেলোয়াড়দের মুখে ‘আদর্শ’, ‘গণতন্ত্র’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘সংবিধানের পবিত্রতা’ এই সব শব্দের ব্যবহার বড় বিভ্রান্ত করে আমাদের! 

. 

আমাদের এই দেশে আমাদের নামের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে পদবি, আবার সেই পদবির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে আমাদের বর্ণ তথা জাতপাত ভিত্তিক, পেশা ভিত্তিক, সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থান ভিত্তিক পরিচয়। এইভাবেই মানুষেরই দ্বারা তৈরি পদবি-নির্ভর পরিচিতির মাধ্যমে আমাদের মনের মধ্যে টিকে থাকে বর্ণ ব্যবস্থা, জাতপাত, উচ্চনীচ সামাজিক অবস্থান। 

আপাত ভাবে শিক্ষা-সংস্কৃতির গর্বে আমরা বঙ্গজনেরা অনেক সময়ই বলে থাকি, জাতপাতের মতো পিছিয়ে পড়া ব্যাপার-স্যাপার বিহার-উত্তরপ্রদেশের মতো উত্তরের রাজ্যগুলোতে টিকে আছে। আমাদের এখানে ওসব নেই! সত্যিই কি বাংলায় বর্ণভিত্তিক জাতপাত নেই! খবরের কাগজের পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনের পৃষ্ঠা কোন্ বাস্তব তুলে ধরে? কেমন ভাবে জাতপাত টিকে আছে ওইসব বিজ্ঞাপনের মধ্যে তা একবার  বিজ্ঞাপনের পাতায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়! আমাদের দেশে পদবি দিয়েই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চেনা যায় বর্ণভিত্তিক ব্যবস্থায় কারোর অবস্থান। এই পদবি প্রথাকে টিকিয়ে রাখার মাধ্যমেই সযত্নে টিকিয়ে রেখেছি আমরা বর্ণ ভিত্তিক জাতপাত ব্যবস্থাটাই। উপনয়নের মতো আপাদমস্তক ব্রাহ্মণ্যবাদী অনুষ্ঠান আধুনিক, প্রগতিপন্থীর বাড়িতেও অনায়াসে আয়োজিত হয়। মনে কোনও প্রশ্ন উঁকি দেয় না! 

বিয়ের পরে বদলে যায় হিন্দু নারীর পদবি। পূর্বতন পৈতৃক পদবি ত্যাগ করে স্বামীর পদবি নেওয়াই রেওয়াজ। তৈরি হয় নতুন পরিচয়! এ সম্পর্কে কোথাও লিখিত কোনও নিয়ম আছে কিনা তাও সন্দেহের! 

. 

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানিতে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ত জাতীয়তাবাদী নাৎসি পার্টি একটি আইন প্রণয়ন করে, যার নাম, ন্যুরেমবার্গ আইন। এই আইনের বলে জার্মানিতে বসবাসরত ইহুদিদের নাগরিকত্বের অধিকার অনেকাংশেই খর্ব করা হয়! এরপর তাঁদের এই আইনের মাধ্যমে চিহ্নিত করে পাঠানো হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্প-এ। আমাদের দেশেও বলা ভালো নাৎসি পার্টির সিলেবাসের হুবহু অনুসরণ করে তৈরি হল সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট বা সিএএ আইন। যা আসাম রাজ্যের নাগরিকত্বের সমস্যা নিয়ে পূর্বে তৈরি ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনশিপ বা এনআরসি-এর পরিবর্ধিত ও পরিপূরক সাম্প্রদায়িক সংস্করণ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটা বড়ো অংশকে ‘অনাগরিক’ হিসাবে চিহ্নিত করে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’-এ পাঠানোর পরিকল্পনা করা হল! এই এনআরসি-র মাধ্যমে চিহ্নিত করা হবে কে ‘নাগরিক’ আর কে ‘অ-নাগরিক’!  তারপর সেই ‘অ-নাগরিক’ চিহ্নিত মানুষকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদনের ভিত্তিতে তাঁর ধর্মীয় পরিচয় যাচাই করে নতুন করে দেওয়া হবে নাগরিকত্ব। আমার ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার আমাকেই ‘অ-নাগরিক’ ঘোষণা করতে পারে এই এনআরসি-র মাধ্যমে। মুহূর্তে নাকচ হয়ে যেতে পারে আমার এই দেশের নাগরিকত্ব! আমার এতদিনের ‘ভারতীয়’ পরিচয়টাই প্রশ্নের মুখে আজ! নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আমাকেই ছুটতে হবে একের পর এক সরকারি দপ্তরে পুরোনো নথিপত্র সংগ্রহের জন্য! সরকারি কর্তাব্যক্তিরা সেই সব নথিপত্র দেখে সন্তুষ্ট না-হলে আমি হারাতে পারি এই দেশে বসবাসের অধিকার! আসামের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখলাম, সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের থেকে বহুগুণ বেশি সংখ্যাগুরু হিন্দুদের স্থান হয়েছে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’-এ। আমার ‘নাগরিকত্ব’-র পরিচয় যখন বিপন্ন, তখন পথ দেখিয়েছেন ভারত রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী নিজেই! ‘আপনার ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ কী?’ তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে জানতে চাওয়া একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক’। 

মনে পড়ে গেল এই সিএএ-র আন্দোলনের পর্বেই প্রয়াত সেই কবির কবিতা যিনি মৃত্যুর আগে ঘোষণা করে গেলেন অমোঘ উচ্চারণ! 

যদি বিরুদ্ধে থাকে…

রাহত ইন্দৌরি 

যদি বিরুদ্ধে থাকে, থাকতে দাও, জীবন তো নয়

এ-সবই ধোঁয়ামাত্র, আকাশ তো নয় 

আগুন ধরলে পুড়ে ছাই হবে সব ঘরই

এখানে শুধু আমারই ঘর, এমন তো নয় 

আমি জানি শত্রুর ক্ষমতা এতটুকু কম নয়

কিন্তু আমার মতো হাতের মুঠোয় প্রাণ তো নয় 

আমার মুখ থেকে যা বেরোয় তা সত্য

আমার মুখে তোমার লব্জ তো নয় 

আজ যে মসনদে গদিয়ান, থাকবে না কাল

ভাড়াটে মাত্র, পৈতৃক বাড়ি তো নয় 

সবারই রক্ত মিশে আছে এই মাটিতে 

হিন্দুস্তান কারোর বাপের তো নয়! 

(অনুবাদ : মোহিত রণদীপ) 

এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা বিভিন্ন ভাবে পরিচয়ের প্রচলিত খোপখাপের বাইরে! তাঁরা না হিন্দু, না মুসলমান, না খ্রিস্টান, না বৌদ্ধ…কোনও প্রচলিত ধর্মমতের অনুসারী নন!  আবার নাস্তিক বলতে প্রচলিতভাবে যা বোঝায় তেমনও নন! ঈশ্বর বিশ্বাসীর প্রতি অশ্রদ্ধা নেই এতটুকু! অন্যদিকে আবার পুজো-পরবের হট্টমেলায় নিঃসঙ্গ, শ্রাদ্ধ বা উপনয়ন এড়িয়ে চলেন প্রবলভাবে! এদিক থেকে একেবারে অসামাজিক! এমনকি জাঁকজমকের বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী বা জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকে পারতপক্ষে দূরে থাকাই পছন্দ! সামাজিক ভাবে অনেকটাই বেমানান। বিশ্বাসের দিক থেকেও কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা  মতবাদেরও অনুগামী বা সমর্থক নন। কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি, সমাজবাদী, বিএসপি, সিপিআই(এম), কিংবা কোনও নকশালপন্থী দলের খোপেও পড়েন না! ফুটবল বা ক্রিকেটেও নির্দিষ্ট কোনও দলের সমর্থক নন। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কোনও দলের খোপেই আবদ্ধ নন!  

‘দেশপ্রেম’ বলতে যা বোঝায় তা নেই বললেই চলে! বরং, সরকারের ঘোষিত ‘দেশদ্রোহীদের’ অধিকার নিয়ে কথা বলা পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করেন! কাশ্মীরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে চিৎকার করেন। এমনকি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধ হলে সেই দেশের মানুষের কী হাল হবে তাই ভেবে অস্থির হন! দেশের সীমান্ত আর সেনাবাহিনী রাখার কোনও প্রয়োজন নেই বলেই যাঁর বিশ্বাস! 

সেই মানুষটির পরিচিতি  কী হবে?

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান