দেবাশিস মল্লিক
জ্ঞানের জগতে কি অস্তিত্বের ক্ষেত্রে ‘আমি’ বা ‘অহম্’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চেতনার প্রথম উন্মেষ যে ‘আমি’ থেকে, সেই ‘আমি’ থেকেই সব ভাবনার শুরু, আবার ‘আমি’-তে এসেই সব কিছুর সম্পূর্ণতা। যুগে যুগে ভাবুক-চিত্তে জীবন ও জগতের নানা রহস্য ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে, যার সমাধান-কল্পে আবিশ্বের বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক, ধর্ম প্রবক্তারা চরম সত্য উদ্ঘাটনে ব্রতী হয়েছেন। উপনিষদ ও ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন প্রস্থানে ‘অহম্’ সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনা এসেছে পরম সত্যের উপলব্ধিতে। আবার সুফি দর্শনে বা মরমিয়া দর্শনে আত্মোপলব্ধিকে কেন্দ্র করে ‘আশেক’(আমি) ও ‘মাশুক’(পরম আমি)-এর ধারণা গড়ে উঠেছে। আমি কে? আমি কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাব? এ মহাবিশ্বে আমার যথার্থ স্থান কোথায় — এসব প্রশ্ন অন্যান্য চিন্তাবিদদের মতো রবীন্দ্রনাথকেও আলোড়িত করেছিল জীবনভর, তিনি তার সমাধান খুঁজেছেন নিজের মতো করে। বাউল সাধকেরা নিজেকে জানার কথা বলেছেন, বলেছেন আত্মতত্ত্ব জ্ঞান না-হলে সাধন হবে না। রবীন্দ্রনাথ বলছেন :
‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমার চেনা।’[১]
বাস্তব জীবনে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা মানুষকে প্রশ্নাতুর করেছে, কিছুক্ষণ পূর্বে জীবিত ও সচল যে, তাকে কয়েক মুহূর্ত পরে মৃত ও নিথর হয়ে যেতে দেখে, অথচ তার শরীরটিকে অবিকল আগের মতো থাকতে দেখে ধারণা হয়েছে জীবদ্দশায় যে শক্তি মানুষের যাবতীয় সক্রিয়তার মূলে, তারই অনুপস্থিতিতে মানুষের মধ্যে আর প্রাণের অস্তিত্ব নেই, তাহলে সেই শক্তি বোধহয় দেহাতীত, বিমূর্ত কিছু — একেই ভাবা হয়েছে আত্মা, ধরে নেওয়া হয়েছে শরীর ও আত্মা স্বতন্ত্র সত্তা। প্রাচীন গ্রিক কবি হোমার যে বিদেহী আত্মার বর্ণনা দিয়েছিলেন সেখানে আত্মা বায়বীয়, স্পর্শাতীত হয়েও দৃশ্যমান, দেহেরই ছায়ামূর্তি যেন। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথ পারিবারিক ঔপনিষদিক ঐতিহ্যের কারণে হোক বা স্বভাবসুলভ আধ্যাত্মিক প্রবণতায় মূল সত্তার আধ্যাত্মিক স্বরূপে বিশ্বাস রেখেছেন। তাঁর বিবেচনায় আত্মার মধ্যে সসীম ও অসীমের মিলন, এর মাঝেই দুয়ের লীলা। আত্মার মধ্যে আছে অসীমের উপলব্ধির আকাঙ্ক্ষা, আত্মা যখন নিজের মধ্যে অসীমকে উপলব্ধি করে তখন সে সকল বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করে। তবে রবীন্দ্র উপলব্ধিতে — ‘আমি যা-কিছু পেয়েছি সমস্তই তিনি দিয়েছেন এইটেই যেন উপলব্ধি করতে পারি… তা হলেই সীমার মধ্যে অসীমকে পাব। নইলে সীমাকেই ক্রমাগত জুড়ে জুড়ে বড়ো করে কখনোই অসীমকে পাওয়া যায় না এবং কোটির পরে কোটিকে উপাসনা করেও সেই একের উপাসনায় গিয়ে পৌঁছনো যেতে পারে না।’[২]
মানুষ যখন শুধু অহৈতুকী আনন্দের তাগিদে সৃষ্টি করে চলে তখন সে নিজের অন্তরে অনন্তকে অনুভব করে, এভাবেই মানুষ সংযুক্ত হয় অসীমের সঙ্গে। তখন সে অবিনাশী। অন্যদিকে মানুষের যে সত্তা সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তায় তাকে আবদ্ধ রাখে, সে তার অহং। সে কিন্তু জন্ম-মৃত্যুর অধীন। ‘শুরু হতেই ও আমার সঙ্গ ধরেছে, / ওই একটা অনেক কালের বুড়ো, / আমাতে মিশিয়ে আছে এক হয়ে।’ আবার বলছেন ‘ওর জরা দিয়ে আচ্ছন্ন করে আমাকে / যে আমি জরাহীন। / … তাই ওকে যখন মরণে ধরে / ভয় লাগে আমার / যে আমি মৃত্যুহীন।’[৩]
মানুষের মধ্যে দুটো দিক আছে, এক আমাতে বদ্ধ আর এক সর্বত্রব্যাপ্ত। এই উভয়কে মিলিয়েই মানুষের পরিপূর্ণ সত্তা। রবীন্দ্রনাথের কথায় — ‘কে সেই আমার অন্তরঙ্গ সঙ্গী যিনি আমার সমস্ত ক্ষণিককে গ্রহণ করছেন তাঁর নিত্যে। তখনই মনে হল, আমার এক দিক থেকে বেরিয়ে এসে আর-এক দিকের পরিচয় পাওয়া গেল; এষোহস্য পরম আনন্দঃ। আমার মধ্যে এ এবং সে — এই এ যখন সেই সে-র দিকে এসে দাঁড়ায় তখন তার আনন্দ। … একলা আপনাকে বিরাট থেকে বিচ্ছিন্ন করে সুখে দুঃখে আন্দোলিত হই। তার মাত্রা থাকে না, তার বৃহৎ সামঞ্জস্য দেখি নে। কোনও-এক সময়ে সহসা দৃষ্টি ফেরে তার দিকে, মুক্তির স্বাদ পাই তখন। যখন অহং আপন ঐকান্তিকতা ভোলে তখন দেখে সত্যকে।’[৪]
আর যদি রবীন্দ্রকবিতায় এই বক্তব্যের অনুরণন খুঁজতে যাই, মনে পড়ে ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যের ‘দুই আমি’র শেষ পংক্তিগুলি — ‘আমার ভিতর লুকিয়ে আছে / দুই রকমের দুই খেলা, / একটা সে ওই আকাশ-ওড়া, / আরেকটা এই ভুঁই-খেলা।’
চেতনার উন্মেষের একটি নির্দিষ্টকাল অবধি শিশুর মধ্যে আমি-তুমির কোনও ভেদ নেই। ফরাসি মনোবিজ্ঞানী জাক লাঁকা বলছেন, শিশু আয়নায় প্রতিবিম্ব দেখে সেটাকেই নিজে বলে ভাবে। এই ‘স্ব’-বিভ্রম শিশুর নিজের কাছে সত্য। ‘শিশু’ ও ‘শিশু ভোলানাথ’ দুটি কাব্যের কবিতাগুলিতে স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ নিজের পরিণত মননটিকে গোপন রাখতে পারেননি। ফলে তাঁর কবিতায় শিশুচরিত্রগুলি অনায়াসে সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ভাবিত হতে পারে। তাঁর খোকা মাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে — ‘এলেম আমি কোথা থেকে, / কোন্ খেনে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে?’[৫] আবার কোথাও সে বলে, ‘কোথায় যেতে ইচ্ছে করে / শুধাস কি মা, তাই? / যেখান থেকে এসেছিলেম / সেথায় যেতে চাই।’[৬] মূল সুরে নিশ্চয়ই এক নয়, তবু পড়তে পড়তে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে মনে পড়ে যাওয়া হয়তো খুব অপ্রাসঙ্গিক নয় : ‘ আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।’ [৭]
রোমান্টিক কবিচিত্তের বিষাদগ্রস্ততা ও অতৃপ্ত কামনা বাসনার জন্য অস্থিরতা রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের কবিতাগুলোর ছত্রে ছত্রে পাওয়া যায়। একদিকে প্রবল জীবনাকাঙ্ক্ষা অন্যদিকে উন্মুখ আত্মরতি তরুণ কবিচিত্তে জাগিয়েছে নৈরাশ্য ও নিঃসীম বেদনা। নিজেকে হারানো দিশেহারা অবস্থার মাঝেই কবির দ্বৈতসত্তার সন্ধান পাই — ‘হারায়েছি আমার আমারে, / আজি আমি ভ্রমি অন্ধকারে।’[৮]
‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতিমাল্য’, ‘গীতালি’ পর্বে ঈশ্বরকে কবি পেয়েছেন নাথ ও সখা রূপে। এ পাওয়া কখনোই শ্রীরাধার শ্রীকৃষ্ণকে লাভের সঙ্গে তুলনীয় নয়। শুধু আত্মনিবেদন নয়, কবির সংলাপে আত্মদহনের সুর স্পষ্ট হয়ে ওঠে বেশ কিছু গানে ‘এই করেছ ভালো, নিঠুর, / এই করেছ ভালো।’ [৯]
অচেতন মনের সম্বিৎ ফেরাতে আঘাতের প্রয়োজন হয় বুঝে সেই আঘাতকে ‘তাঁর’ আশীর্বাদ হিসেবেই দেখতে চান তিনি। কিন্তু বারংবার আঘাত যদি নেমে আসে, তখন জীবন দেবতার এই নিষ্ঠুরতায় ক্ষতবিক্ষত কবি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাই বলে ওঠেন — ‘না বাঁচাবে আমায় যদি/ মারবে কেন তবে?’ [১০]
আবার জীবনদেবতার সঙ্গে কবির একাত্মতা অনুরণিত হয় বিশ্বপ্রকৃতিতে ‘তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে / আলোয় আকাশ ভরা। / তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে / ফুল্ল শ্যামল ধরা।’ [১১]
এটুকুই তো সব নয়, পরমপুরুষ যিনি, তিনিও এই ‘আমি’-কে বাদ দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ নন, আমির যোগেই তাঁর পূর্ণতাপ্রাপ্তি ‘তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর / তুমি তাই এসেছো নিচে / আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, / তোমার প্রেম হত যে মিছে।’ [১২]
‘অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে’ — ‘রাজা’ নাটকের এই গানে এই একাত্মতার উপলব্ধি আরও স্পষ্টতর হয়েছে। চলার পথে মাঝে মাঝে জীবনস্বামীকে হারিয়ে ফেলার সংশয়ও জাগে, কিন্তু দুঃখ ভোগের অমারাতে এই প্রতীতি জেগেছে সেই পরম তিনি কিছুতেই হারাতে দেবেন না। তাঁর সঙ্গে যে দূরত্ব সাময়িক তৈরি হোক না কেন, তিনি থাকবেন পাশে — ‘তোমার পথে চলা যখন / ঘুচে গেল, দেখি তখন — / আপনি তুমি আমার পথে লুকিয়ে চল সাথে।’ [১৩]
আত্মসমাহিত সেই নিখিল একা একক, নিঃসঙ্গ, ঘুমে অচেতন, তারই মধ্যে সুপ্ত ছিল ব্যক্তি ‘আমি’, সেই আমি এসে বিধাতাপুরুষের ঘুম ভাঙিয়ে তাঁকে জাগরণের আনন্দে পূর্ণ করে দিচ্ছে, তাই বিশ্বজগতে দেখা দিচ্ছে আনন্দের হিল্লোল। ‘আমি’-র ব্যক্তিসত্তার জাগ্রত চৈতন্যে আবিশ্ব পরিচিতি লাভ করছে — ‘আমারি চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, / চুনী উঠলো রাঙা হয়ে। / আমি চোখ মেললুম আকাশে, / জ্বলে উঠল আলো / পূবে পশ্চিমে। / গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, সুন্দর, / সুন্দর হল সে।’ [১৪]
তথ্যসূত্র :
১) ‘পূজা পর্যায় স্বরবিতান ৪১’, গীতবিতান, কলকাতা, সাহিত্যম, ২য় সংস্করণ শ্রাবণ, ১৪১৫ বঙ্গাব্দ
২) ‘শান্তি-নিকেতন’, রবীন্দ্র রচনাবলী চতুর্দশ খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯২, পৃ.৭৮০
৩) ‘শেষ সপ্তক’, বাইশ নং কবিতা, রবীন্দ্র রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, নভেম্বর ১৯৮৩, পৃ.১৮৫
৪) ‘মানুষের ধ’র্ম, রবীন্দ্র রচনাবলী চতুর্দশ খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃ.১০৪৮
৫) ‘জন্মকথা’, শিশু কাব্য, রবীন্দ্র রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড,পশ্চিমবঙ্গ সরকার, মে ১৯৮২,পৃ.৫
৬) ‘সংশয়ী’, শিশু ভোলানাথ কাব্য, তদেব, পৃ.৫৫৮
৭) ‘জরাসন্ধ’, হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য কাব্যগ্রন্থ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়
৮) ‘আমি-হারা’, সন্ধ্যাসংগীত কাব্য, রবীন্দ্র রচনাবলী প্রথম খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, জুলাই ১৯৮০, পৃ.৩৩
৯) ‘গীতাঞ্জলি’, ৯১ সংখ্যক, তদেব, পৃ.২৪৭
১০) ‘গীতালি’, ৩২ সংখ্যক, তদেব, পৃ.৩৮১
১১) ‘গীতিমাল্য’, ৫২ সংখ্যক, তদেব, পৃ.৩২৯
১২) ‘গীতাঞ্জলি’, স্বরবিতান ২৯৪ সংখ্যক, তদেব, পৃ.২৪৭
১৩) ‘পূজা পর্যায়’, গীতবিতান, তদেব, পৃ.৮৮
১৪) ‘আমি’, শ্যামলী কাব্য, রবীন্দ্র রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড, পৃ.৩৯২
সহায়ক গ্রন্থ :
১) ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, বিভিন্ন খণ্ড।
২) ‘গীতবিতান’, সাহিত্যম, কলকাতা, ২য় সাহিত্যম সংস্করণ, শ্রাবণ ১৪১৫।
৩) ‘রবীন্দ্রকাব্যে আমির ক্রমবিকাশ’, রশীদুল আলম, বাংলা একাডেমী ঢাকা, মে, ১৯৮৮।
৪) ‘কবির নাম ও সর্বনাম’, রণজিৎ গুহ, কলকাতা, তালপাতা, ২য় সংস্করণ এপ্রিল, ২০০৯।