বাংলা ও বাঙালির জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন এবং মেডিসিন ও বিজ্ঞানের সাধনা

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

আজ থেকে প্রায় ১৮০ বছর আগে সেসময়ের মেডিক্যাল কলেজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান যিনি একাধারে ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের এমডি, বহু ভাষাবিদ, গবেষক এবং ভারতের IMS (Indian Medical Service)-এ স্থান পাওয়া প্রথম ভারতীয় সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয় চিকিৎসকদের ভারতে বসবাস ও চিকিৎসা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন — “granting all the praise and honour due to hard-working and intelligent professors, the European medical officers were at best birds of passage, and could not, therefore, permanently improve the position and prospects of the profession out of the service.” (‘Address in Medicine : The Present State of the Medical Profession in Bengal (delivered on February 3rd, 1864)’, British Medical Journal 2 July-December 1864 : 88) ফলে এসমস্ত “পরিযায়ী পাখিদের” বিকল্প হচ্ছে ইউরোপীয় জ্ঞানকে নিজেদের মতো করে আত্মীকরণ করে নেওয়া। একে আমরা যদি জাতীয়তাবাদী চিন্তার ভ্রূণরূপ ধরি তাহলে মনে হয় গুরুতর কোন প্রমাদ হবে না।

পরাধীন ভারতে স্বাধীনভাবে গবেষণার চিন্তায় উজ্জীবিত বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী আবিষ্কার করেছিলেন সেসময়ের লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ-নেওয়া মারণান্তক অসুখ কালাজ্বরের সবচেয়ে ফলদায়ী চিকিৎসা – ইউরিয়া স্টিবামিন ওষুধ।

ব্রহ্মচারী ১৯৩৬ সালে ভারতের বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন — “As a matter of the most vital concern in nation-building, the problem of nutrition demands very careful consideration by statesmen and scientists alike, more so due to the fact, as has been recently observed, that a great part of the world’s population is not consuming the necessary food stuff. An eminent Swiss authority predicts the decay of civilization unless there is a fundamental revision of the people’s diet.”

আমরা “নেশন-বিল্ডিং” শব্দটিকে খেয়াল করব। দেশ এবং জাতির গঠনে, ব্রহ্মচারীর ধারণানুযায়ী, রাষ্ট্রনেতা, বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের জনকল্যাণী শক্তিকে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যবৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা — এসবের একটি যোগসূত্রে বিশ্বাস করেছিলেন ব্রহ্মচারী। 

১৯৩৬ সালে যখন এ কথা ব্রহ্মচারী বলছেন সেসময় জাতীয়তাবাদী ভাবনার জোয়ারের কাল। এসময়ে, খুব অল্পকথায় বললে, ভারত স্বাধীনতা আসবে কোন পথে এনিয়ে যেমন বিতর্ক চলছে, তেমনি চলছে স্বাধীন বা প্রাক-স্বাধীন ভারতে শিক্ষা এবং বিজ্ঞানচর্চার ধরন কেমন হবে এ নিয়েও বিভিন্ন মত ও পথের দ্বন্দ্ব। বিজ্ঞানচর্চার সাথে ভারতীয় উদ্যোগে স্বাধীন প্রযুক্তি এবং প্রযুক্তি-নির্ভর ব্যবসায়িক উদ্যোগ কোন পথে বিকশিত হবে — বিবিধমুখী এরকম বিভিন্ন দ্বন্দ্বের প্রত্যক্ষ চেহারা দেখার আগে আমরা একবার দেখে নেব ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকেই “জাতীয় শিক্ষা” নিয়ে কত পরীক্ষানিরীক্ষা চলেছে। এবং তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব কিভাবে পড়েছে পরবর্তী সময়ের চিন্তাজগতের ওপরে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করব, যে বছর আইনস্টাইনের ‘স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি’ প্রকাশিত হয় সেবছরটি (১৯০৫) ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসেও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব আনলেন। শুরু হল বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য তুমুল আন্দোলন। একথা আমাদের সবার জানা। এসময়ে আরেক যুগন্ধর বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোসের বয়স ১১। পরবর্তীকালে তাঁর কৈশোর বয়সের বন্ধু নীরেন্দ্রনাথ রায় জানাচ্ছেন — “তরুণ সত্যেনের জীবন যখন গঠিত হচ্ছে সেই সময় তাঁর উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল স্বদেশী আন্দোলন।” (শান্তিময় চ্যাটার্জি, এণাক্ষী চ্যাটার্জি — ‘সত্যেন্দ্রনাথ বোস’, ১৯৫৮, পৃঃ ২২)

আমরা অল্প সময়ের জন্য পুরনো ইতিহাসে ফিরে যাই।

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের পূর্ণ বিকাশের আগে এক সলতে পাকানোর বেশ লম্বা ইতিহাস আছে। স্মরণ করুন, ১৮৫৭-র সিপাহিদের মহাবিদ্রোহের স্মৃতি তখনো শিক্ষিত সমাজের একাংশের মাঝে ফিকে হয়ে যায়নি। সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে যদিও এভাবে বলা সঠিক নয়। এই বিদ্রোহকালে বাঙালি সমাজের নিরন্ন, খেটে খাওয়া বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন বিষয়টি সম্পর্কে উদাসীন। “কিন্তু ইংরেজের অনুগ্রহপুষ্ট বাংলার জমিদার, ধনী ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী এবং শিক্ষিত সমাজের একটা অংশ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে। এইকালের বাঙালি পত্রিকা-সম্পাদকরা হয় ছিলেন ধনী জমিদার অথবা কোনও-না-কোনওভাবে ইংরেজের ওপর নির্ভরশীল।” ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদক ইংরেজরা দিল্লি পুনরুদ্ধার করলে সহর্ষে তিনি লেখেন — “ভারতের প্রিয় পুত্র হিন্দু সমুদয় মুক্ত মুখে বল সবে ব্রিটিশের জয়।” (স্বপন বসু, ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী – ‘১৮৫৭-র বিদ্রোহঃ সমকালীন বাংলা ও বাঙালি’, ২০০৭, পৃঃ ৫১)

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং অর্থদাতা উত্তরপাড়ার বিখ্যাত বিদ্যোৎসাহী বিজয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ‘উত্তরপাড়া’ পাক্ষিক পত্রিকা-য় লিখলেন — “আমাদিগের বঙ্গদেশস্থ সমস্ত বাঙ্গালিগণ নিতান্ত প্রভুভক্ত, ইহারা সর্বদা কেবল পরমেশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতেছে, যে, শ্রীশ্রীমতী রাজ্যেশ্বরীর মঙ্গল হউক।” তিনি একটি কবিতাও লিখেছিলেন — 

“গোঁয়ার শূয়ার সব নাহি কিছু দয়া।                                                                                               বিনা দোষে প্রাণ নাশে নাহি হয় মায়া।।                                                                                        বিনা দোষে নারী বধে বড়ই অজ্ঞান।                                                                                                 রোষ বশে মেরে ফেলে দুধের সন্তান।।                                                                                                   ধর্ম্ম ধর্ম্ম কর‍্যে মিছে ধর্ম্ম করে নাশ।                                                                                                     ধর্ম্ম মর্ম না বুঝিতে হল সর্বনাশ।...                                                                                               ‘যথাধর্ম্মস্তথা জয়’ সর্ব্বলোকে কয়।                                                                                                  ব্রিটিশের জয় বল ব্রিটিশের জয়।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৫২)

কিন্তু এর বিপরীত চিত্র এবং ব্যাখ্যাও শিক্ষিত সমাজের মধ্য থেকে তৈরি হচ্ছিল। বিদ্রোহ শুরু হবার অল্পদিনের মধ্যে হরিশচন্দ্র মুখার্জির হিন্দু পেট্রিয়ট ‘দি কান্ট্রি অ্যান্ড দ্য গবর্ণমেন্ট’ নামে একটি লেখায় বলা হয় — “এটি আর সৈন্যবাহিনীর বিদ্রোহমাত্র নয়, পরিণত হয়েছে এক গণ অভ্যুত্থানে। বাংলার সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক এই অভ্যুত্থানের একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো। শুরু থেকেই বিদ্রোহীরা দেশবাসীর সহানুভূতিপুষ্ট। দেশবাসী তাঁদের একটি মহৎ জাতীয় উদ্দ্যেশ্যে নিবেদিতপ্রাণ শহিদ বলে মনে করেন।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৫৬)

যাহোক, এরকম ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও, মোটের ওপরে আলোচনা সহজ করার জন্য বলা যায় যে তখন সামাজিক স্মৃতিতে রয়েছে ১৮৬০-এর নীল বিদ্রোহের রেশ, রয়েছে হিন্দুমেলার (১৮৬৭-১৮৮৮০) কাজকর্মের খতিয়ান। পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান লীগ (১৮৭৫) এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের (১৮৭৬) কর্মধারা এবং ১৮৮৩ সালে ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কনফারেন্সের কর্মকাণ্ড (১৮৮৩), এবং, সর্বোপরি, ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম নেওয়া ১৯০৫-এর সর্বব্যাপী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তথা আত্মসচেতন জাতীয় চৈতন্যের জন্ম দিয়েছে।

১৯০৫-এর আগে রঙ্গলাল, মধুসূদন, দীনবন্ধু, বঙ্কিম, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র এবং সমসাময়িক কালে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, কবিতা, নাটক সৃষ্টি হচ্ছে। জাতীয়তাবাদী নাটক লিখছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপেন্দ্রনাথ দাস, এবং গিরীশচন্দ্রের মতো মানুষেরা। জাতীয়তাবাদ ঘেঁষা গান লিখছেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মনোমোহন বসু, গোবিন্দচন্দ্র রায় এবং, সর্বোপরি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। অবশ্য এখানে উল্লেখ করা দরকার যে যিনি সঙ্গীত লিখেছেন তিনি নাটকও লিখেছেন, আবার বিপরীত প্রক্রিয়াও চলেছে।

এসময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা জাতীয়তাবাদী চেতনাপুষ্ট সংবাদপত্রের উন্মেষ। ১৮৫৩ সাল থেকে হরিশচন্দ্র মুখার্জির হিন্দু পেট্রিয়ট এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছিল, ১৮৬৮ সাল থেকে মতিলাল ঘোষের সম্পাদিত অমৃতবাজার পত্রিকা এই ধারায় যুক্ত হয়। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি সম্পাদিত বেঙ্গলি সংবাদপত্র ১৮৭৯ সাল থেকে এই ধারাকে পুষ্ট করছিল। এরসাথে আরও অন্তত দুটি বিশেষ পত্রিকার কথা এখানে উল্লেখ করতে হবে যেগুলো জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের স্বপক্ষে শিক্ষিত সমাজের মাঝে জোরদার জনমত তৈরির কাজ চালিয়ে গেছে। প্রথমটি হল সতীশচন্দ্র মুখার্জির ডন (১৮৯৭) পত্রিকা এবং দ্বিতীয়টি রামানন্দ চ্যাটার্জির প্রবাসী (১৯০১) পত্রিকা। 

এ সময়কালের সামাজিক ঘটনাগুলো স্মরণ করি। বাংলার “আত্মিক” শক্তির উদ্বোধন হল — কেশবচন্দ্র, রামকৃষ্ণ, বিজয়কৃষ্ণ প্রমুখের কর্মকাণ্ডে। ১৮৯৩ সালে বিবেকানন্দের শিকাগো সম্মেলনের বক্তৃতা এক ভিন্নধর্মী আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিল। এনিয়ে অনেক বিতর্কের অবকাশ থাকলেও এটা একটি ঐতিহাসিক সত্য। এ প্রসঙ্গে সুমিত সরকারের রামকৃষ্ণ নিয়ে পর্যবেক্ষণ আমাদের ভাবতে সাহায্য করবে — “Ramkrishna’s conversation often has surprisingly deep ‘textual’ foundations, even where it seems to be most context-determined, or a product of homespun wisdom alone. Thus bhakti to him, as in much Kaliyuga literature, was the counterpoint to the new nineteenth-century world of chakri which reduced the quantum of free time and left little room for contemplation or ritual.” (‘Writing Social History’, 1997, পৃঃ ৩১৫-৩১৬)

আরেকটি পুস্তকের প্রকাশ এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল — দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ (ইংরেজপ্রভাবের পূর্ব্ব পর্যন্ত) (১৮৯৬ সালে প্রথম সংস্করণ) প্রকাশ হওয়া। তিনি বাঙ্গালির নিজস্ব ভাষার অন্দরমহলের রত্নরাজির সম্ভার বাংলাভাষী পাঠকের সামনে খুলে দিলেন। ভাষাগতভাবে বাংলা যে এত সমৃদ্ধ এই বোধ হয়তো কিছু পরিমাণে নতুন আত্মপরিচিতির জন্ম দিতে সাহায্য করে থাকবে। এই পুস্তকের একটি নজর দেবার মতো বিষয় হল সাম্প্রদায়িকতা বোধহীন বক্তব্যের স্পষ্ট প্রকাশ। দীনেশচন্দ্র লিখছেন — “হিন্দুগণ যেরূপ পীরের সিন্নি দিতেন, মুসলমানগণও সেইরূপ দেবমন্দিরে ভোগ দিতেন উত্তর পশ্চিমে হিন্দুগণ এখনও মহরম উৎসব করিয়া থাকেন। অর্দ্ধ শতাব্দী হইল, ত্রিপুরার মির্জা হুসেন আলি নামক জনৈক মুসলমান জমিদার নিজ বাড়ীতে কালীপুজা করিতেন এবং ঢাকার গরিব হুসেন চৌধুরী সাহেব বিস্তর টাকা ব্যয় করিয়া শীতলা দেবীর অনুষ্ঠান করিতেন, আমরা এরূপ শুনিয়াছি।” (দ্বিতীয় সংস্করণ, “কাব্যশাখা”, পৃঃ ৫৪০)

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিলনা। এর অভিঘাত ছিল অনেক সুদূরপ্রসারী — “It marked the beginning of open and organized revolt of a self-conscious subject nation against an alien ruling power.” (Haridas Mukherjee and Uma Mukherjee, ‘The Origins of National Education Movement (1905-1910)’, 1957, পৃঃ ৩) আরও বলছেন — “The movement for National Education as manifest in 1905 was essentially an expression of Bengal’s militant nationalism which had been slowly but surely growing in our land since the middle of the nineteenth century.” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩) 

শুধু এটুকুই নয়। যারা সেসময় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরচ্ছে তাদের ব্যবহারিক জীবনে অর্থ ও অন্ন সংস্থান করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে এসেছিল — “The fundamental weakness of our Indian educational system is that the average Indian student cannot bring his education into any direct relation with the world in which, outside the class or lecture room, he continues to live. For that world is still the old Indian world of his forefathers, and it is as far removed as the poles asunder from the Western world which claims his education.” (Valentine Chirol, ‘Indian Unrest’, 1910, পৃঃ ২১৬) পরে বিশদে ব্যাখ্যা করে বললেন — “The rapid rise m the cost of living has affected no class more injuriously than the old clerkly castes from which the teaching staff and the scholars of our schools and colleges are mainly recruited. Their material position now often compares unfavourably with that of the skilled workman and even of the daily labourer, whose higher wages have generally kept pace with the appreciation of the necessaries of life. This is a cause of great bitterness even amongst those who at the end of their protracted course of studies get some small billet for their pains … Whilst the skilled artisan, and even the unskilled labourer, can often command from 12 annas to 1 rupee (Is. to Is. 4d.) a day, the youth who has sweated himself and his family through the whole course of higher education frequently looks in vain for employment at Rs.30 (£2) and even at Rs.20 a month. In Calcutta not a few have been taken on by philanthropic Hindus to do mechanical labour in jute mills at Rs.15 a month simply to keep them from starvation.” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ২২৪-২২৫) এখানে উল্লেখ করা দরকার যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ সিলেবাসে ১৯০৬ সালের আগে বাংলার কোন “compulsory paper” ছিল না। (সুমিত সরকার, ‘The Swadeshi Movement in Bengal 1903-1908’, পৃঃ ১৫১)  

ইংরেজ দার্শনিক স্পেন্সার পর্যন্ত ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা নিয়ে মতামত দিয়েছিলেন — “the amazing of an Examiner who proposes to test the fitness of youths for commencing their higher education, by seeing how much they know of the technical terms, cant phrases, slang, and even extinct slang, talked by the people of another nation. Instead of unfitness of the boys, which is pointed to us, we may see rather the unfitness of those concerned in educating them.” (‘Origins of the National Education Movement’, পৃঃ ৮)

১৯০২ সালে ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটিজ কমিশন তৈরি হল। এই কমিশনের একমাত্র হিন্দু সদস্য ছিলেন ডঃ গুরুদাস ব্যানার্জি। কমিশনের মিটিংয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে (বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে) অতিরিক্ত রাষ্ট্রিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে তাঁর “Note of Dissent” জানান। তিনি আপত্তি তোলেন যে সরকারি হস্তক্ষেপ এত অতিরিক্ত হচ্ছে যে সমাজের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মতামতকে আদৌ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছেনা। মজার কথা, বর্তমানে প্রায় সমধর্মী ছবি (হয়তো বা বিপরীতও) দেখছি আমরা ভারতবর্ষে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের জগত থেকে রাষ্ট্র ক্রমাগত হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। রাষ্ট্র বেশি বেশি করে বেসরকারিকরণের দিকে ঝুঁকছে। বিপরীতে সামাজিক দাবি হচ্ছে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। এবং গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মুক্ত পরিসর করে তুলতে হবে।

যাহোক, ১৯০৪ সালে “ইউনিভার্সিটিজ অ্যাক্ট” চালু হল “which tightened official control over senate and transferred to the government the power of granting affiliations, was considered by all sections of nationalist opinion to be a major threat to the ‘independence of universities’ and ultimately to the whole future of higher education.” (‘The Swadeshi Movement in Bengal’, পৃঃ ১৫৮)

অবশ্য এর আগে ১৯০১ সালে স্বাধীনভাবে শিক্ষার চেতনা প্রবাহিত করার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু তাই নয়, অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও, স্বাধীনভাবে জাতীয় শিক্ষার আদর্শে স্কুল তৈরি হচ্ছে। একটা সময়ে ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমায় যতসংখ্যক হাই স্কুল ছিল তার সংখ্যা সমগ্র যুক্ত প্রদেশের (পরবর্তীতে উত্তরপ্রদেশ) গ্রামাঞ্চলের স্কুলের চেয়ে বেশি। (পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৪৯) মনে রাখা দরকার, সুমিত সরকারের গবেষণা দেখিয়েছে যে এসমস্ত স্কুলগুলোতে ‘Aryan knowledge’-কে প্রাধান্য দিতে হবে এরকম একটি বোধ অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করেছে।

এরপরে, ১৯০৬ সালের ১৪ আগস্ট, টাউন হলের ঐতিহাসিক মিটিংয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ “জাতীয় শিক্ষানীতি” নিয়ে সুদীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠ করলেন। সবার মাঝে রোমাঞ্চের সৃষ্টি হয়েছিল। এই মিটিংয়ের সভাপতি ডঃ রাসবিহারী ঘোষ ঘোষণা করলেন — ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ৫ লক্ষ টাকা, সুবোধচন্দ্র মল্লিক ১ লক্ষ টাকা এবং ময়মেনসিংয়ের মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য বাহাদুর ন্যাশনাল কাউন্সিলের জন্য আড়াই লক্ষ টাকা মূল্যের জমি দান করছেন। (‘Origins of the National Education Movement’, পৃঃ ৮২) 

রবীন্দ্রনাথের সুদীর্ঘ প্রবন্ধটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি — 

“জাতীয় বিদ্যালয় তো বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হইয়া গেল, এখন এই বিদ্যালয়ের উপযোগিতা যে কী সে কি যুক্তি দিয়া বুঝাইবার আর কোনো প্রয়োজন আছে। …

আমাদের দেশের একটা মুশকিল এই হইয়াছে, শিক্ষা বল, স্বাস্থ্য বল, সম্পদ বল, আমাদের উপরে যে কিছু নির্ভর করিতেছে, এ কথা আমরা একরকম ভুলিয়াছিলাম। অতএব এ-সকল বিষয়ে আমাদের বোঝা না বোঝা দুই-ই প্রায় সমান ছিল। আমরা জানি, দেশের সমস্ত মঙ্গলসাধনের দায়িত্ব গবর্মেণ্টের; অতএব আমাদের অভাব কী আছে না আছে তাহা বোঝার দরুন কোনো কাজ অগ্রসর হইবার কোনো সম্ভাবনা নাই। এমনতরো দায়িত্ববিহীন আলোচনায় পৌরুষের ক্ষতি করে। ইহাতে পরের উপর নির্ভর আরো বাড়াইয়া তোলে। 

স্বদেশ যে আমাদেরই কর্মক্ষেত্র এবং আমরাই যে তাহার সর্বপ্রধান কর্মী, এমনকি, অন্যে অনুগ্রহপূর্বক যতই আমাদের কর্মভার লাঘব করিবে, আমাদের স্বচেষ্টার কঠোরতাকে যতই খর্ব করিবে, ততই আমাদিগকে বঞ্চিত করিয়া কাপুরুষ করিয়া তুলিবে—এ কথা যখন নিঃসংশয়ে বুঝিব তখনই আর-আর কথা বুঝিবার সময় হইবে। …

বিধাতার প্রসাদে আজ কেমন করিয়া সেই পরিচয় পাইয়াছি.। আজ আমরা স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম, ইচ্ছাই ঈশ্বরের ঐশ্বর্য, সমস্ত সৃষ্টির গোড়াকার কথাটা ইচ্ছা। যুক্তি নহে, তর্ক নহে, সুবিধা-অসুবিধার হিসাব নহে, আজ বাঙালির মনে কোথা হইতে একটা ইচ্ছার বেগ উপস্থিত হইল এবং পরক্ষণেই সমস্ত বাধা বিপত্তি, সমস্ত দ্বিধাসংশয় বিদীর্ণ করিয়া অখণ্ড পুণ্য ফলের ন্যায় আমাদের জাতীয়বিদ্যাব্যবস্থা আকার গ্রহণ করিয়া দেখা দিল। বাঙালির হৃদয়ের মধ্যে ইচ্ছার যজ্ঞহুতাশন জ্বলিয়া উঠিয়াছিল এবং সেই অগ্নিশিখা হইতে চরু হাতে করিয়া আজ দিব্যপুরুষ উঠিয়াছেন—আমাদের বহুদিনের শূন্য আলোচনার বন্ধ্যত্ব এইবার বুঝি ঘুচিবে।…

অনেকদিন পরে আজ বাঙালি যথার্থভাবে একটা-কিছু পাইল। এই পাওয়ার মধ্যে কেবল যে একটা উপস্থিত লাভ আছে, তাহা নহে, ইহা আমাদের একটা শক্তি। আমাদের যে পাইবার ক্ষমতা আছে, সে ক্ষমতাটা যে কী এবং কোথায়, আমরা তাহাই বুঝিলাম। এই পাওয়ার আরম্ভ হইতে আমাদের পাইবার পথ প্রশস্ত হইল। আমরা বিদ্যালয়কে পাইলাম যে তাহা নহে, আমরা নিজের সত্যকে পাইলাম, নিজের শক্তিকে পাইলাম। 

আমি আপনাদের কাছে আজ সেই আনন্দের জয়ধ্বনি তুলিতে চাই। আজ বাংলা দেশে যাহার আবির্ভাব হইল তাহাকে কিভাবে গ্রহণ করিতে হইবে তাহা যেন আমরা না ভুলি। আমরা পাঁচজনে যুক্তি করিয়া কাঠখড় দিয়া কোনোমতে কোনো একটা সুবিধার খেলনা গড়িয়া তুলি নাই। আমাদের বঙ্গমাতার সূতিকাগৃহে আজ সজীব মঙ্গল জন্মগ্রহণ করিয়াছে; সমস্ত দেশের প্রাঙ্গণে আজ যেন আনন্দশঙ্খ বাজিয়া উঠে, আজ যেন উপঢৌকন প্রস্তুত থাকে, আজ আমরা যেন কৃপণতা না করি। 

তাই আজ আমি ছাত্রদিগকে অনুরোধ করিতেছি, এই বিদ্যালয়ের প্রাণকে অনুভব করো—সমস্ত বাঙালিজাতির প্রাণের সঙ্গে এই বিদ্যালয়ের যে প্রাণের যোগ হইয়াছে তাহা নিজের অন্তঃকরণের মধ্যে উপলব্ধি করো—ইহাকে কোনোদিন একটা ইস্কুলমাত্র বলিয়া ভ্রম করিয়ো না। তোমাদের উপরে এই একটি মহৎ দায়িত্ব রহিল। স্বদেশের একটি পরমধনের রক্ষণভার আজ তোমাদের উপরে যতটা পরিমাণে ন্যস্ত হইল, তোমাদিগকে একান্ত ভক্তির সহিত, নম্রতার সহিত তাহা বুঝিয়া লইতে হইবে। ইহাতে তপস্যার প্রয়োজন হইবে। ইতিপূর্বে অন্য কোনো বিদ্যালয় তোমাদের কাছে এত কঠোরতা দাবি করিতে পারে নাই। এই বিদ্যালয় হইতে কোনো সহজ সুবিধা আশা করিয়া ইহাকে ছোটো হইতে দিয়ো না। বিপুল চেষ্টার দ্বারা ইহাকে তোমাদের মস্তকের ঊর্ধ্বে তুলিয়াধরো; ইহার ক্লেশসাধ্য আদর্শকে মহত্তম করিয়া রাখো; ইহাকে কেহ যেন লজ্জা না দেয়, উপহাস করিতে না পারে, সকলেই যেন স্বীকার করে যে, আমরা শৈথিল্যকে প্রশ্রয় দিবার জন্য, জড়ত্বকে সম্মানিত করিবার জন্য বড়ো নাম দিয়া একটা কৌশল অবলম্বন করি নাই। তোমাদিগকে পূর্বাপেক্ষা যে দুরূহতর প্রয়াস, যে কঠিনতর সংযম আশ্রয় করিতে হইবে, তাহা ব্রতস্বরূপ ধর্মস্বরূপ গ্রহণ করিয়ো। কারণ, এ বিদ্যালয় তোমাদিগকে বাহিরের কোনো শাসনের দ্বারা,কোনো প্রলোভনের দ্বারা আবদ্ধ করিতে পারিবে না—ইহার বিধানকে অগ্রাহ্য করিলে তোমরা কোনো পদ বা পদবীর ভরসা হইতে ভ্রষ্ট হইবে না—কেবল তোমাদের স্বদেশকে তোমাদের ধর্মকে শিরোধার্য করিয়া, স্বজাতির গৌরব এবং নিজের চরিত্রের সম্মানকে নিয়ত স্মরণ রাখিয়া, তোমাদিগকে এই বিদ্যালয়ের সমস্ত কঠিন ব্যবস্থা স্বেচ্ছাপূর্বক অনুদ্ধত আত্মোৎসর্গের সহিত নতশিরে বহন করিতে হইবে।”

জাতীয় শিক্ষার জন্য এই আন্দোলনের সাথে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হয়েছেন সিস্টার নিবেদিতা, অরবিন্দ ঘোষ, নীলরতন সরকার, তারকনাথ পালিতের মতো মানুষেরা। এমনকি আশুতোষ মুখার্জিও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। যদিও “Asutosh Mukherjee had no sympathy at all with the National Council as a potential rival to his university – he even privately urged Minto to take action against the politically-unreliable national schools – but in his own way he was realising a part of the constructive programme of the national education movement.” (‘The Swadeshi Movement in Bengal’, পৃঃ ১৭০)

বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে অরবিন্দ ১৯০৭ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এবং ইতিহাস ও পলিটিক্যাল সায়ান্সের শিক্ষক হিসেবে ডিসেম্বর, ১৯০৭ থেকে মে, ১৯০৮ পর্যন্ত শিক্ষাদান করেছেন। কিন্তু এরপরে ধীরে ধীরে নামী ব্যক্তিরা সরে যেতে শুরু করেন। ডিসেম্বর ১৯০৮-এ সতীশচন্দ্র মুখার্জির মতো অত্যুৎসাহী সংগঠকেরা সরে যান। ১৯০৭-এর আগস্ট মাসেই সন্ধ্যা পত্রিকা তিক্তস্বরে লেখে — “The truth is that Satish Babu and secretly many others of the National College as well are quite stiff with fear.” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৭১) এরকম লেখার পেছনের ঘটনাটি হচ্ছে, ন্যাশনাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র সুশীলকুমার সেনকে যখন কিংসফোর্ডের আদেশে চরম বেত্রাঘাত করা হয় তারপরে সুশীলকুমারকে কলেজের তরফ থেকে সম্মান জানানোর কোন সাহস দেখানো হয়নি। সম্পাদক হিসেবে আশুতোষ চৌধুরী এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জি ১৭ ডিসেম্বর, ১৯০৮-এ সার্কুলার জারি করে জানান যে মফস্সলের স্কুল সহ কোন স্কুলের ছাত্ররাই আর ইংরেজ বিরোধী পিকেটিং বা বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করতে পারবেনা। ১৯০৯-এর আগস্ট নাগাদ ন্যাশনাল কাউন্সিলের ক্রিয়াকলাপে মিন্টো নিতান্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন — “It is very satisfactory that the National Council of Education has been doing much to keep the students of national schools under control…” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৭২)

১ জুন, ১৯০৬-এ যেদিন ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশন’-কে সরকারিভাবে রেজিস্টার করা হয় সেদিনই আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন তৈরি হয় তারকনাথ পালিত এবং অন্যান্যদের নেতৃত্বে — সোসাইটি ফর দ্য প্রোমোশন অফ টেকনিক্যাল এডুকেশন (S.P.T.E)। S.P.T.E-র তত্ত্বাবধানে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট ২৫ জুলাই, ১৯০৬ থেকে কাজকর্ম শুরু করে — ৯২, আপার সার্কুলার রোডে মাসিক ৩০০ টাকায় ভাড়া করা একটি ঘরে। এটিই এখন ইউনিভার্সিটি সায়ান্স কলেজ (চালু কথায় রাজাবাজার সায়ান্স কলেজ)।

বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রথমে প্রমথনাথ বোস (১৯০৬-১৯০৮) এবং পরে শরৎকুমার দত্ত (১৯০৯-১৯১০)। প্রমথনাথ বোস (পি এন বোস) ভারতের একজন অগ্রগণ্য ভূতাত্ত্বিক এবং জীবাশ্মবিদ ছিলেন। শরৎকুমার দত্ত হলেন প্রথম ভারতীয় যিনি বার্লিনের Technological University of Charlottenburg থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় সর্বোচ্চ অনার্স নিয়ে পাস করেছিলেন। ১৯০৯ সালে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর ছাত্রসংখ্যা ছিল ১২৪। (‘Origins of the National Education Movement’, পৃঃ ৪৯-৫০)

এদিকে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ এবং স্কুল বৌবাজার স্ট্রিটে ১৫ আগস্ট, ১৯০৬ থেকে এর যাত্রা শুরু করেছিল। প্রথম প্রিন্সিপাল ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, সতীশচন্দ্র মুখার্জি প্রথম সুপারিন্টেনডেন্ট। ভারতীয় ইতিহাস এবং সংস্কৃতির নামী গবেষক হিসেবে যারা সেসময়েই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাঁর মধ্যে কয়েকজন (যেমন রবীন্দ্রনারায়ণ ঘোষ, বিনয়কুমার সরকার, রাধাকুমুদ মুখার্জি) এখানে শিক্ষকতা করেছিলেন। অন্যান্য শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন মোক্ষদাচরণ সমাধ্যায়, সখারাম গণেশ দেউস্কর এবং পালি ভাষার শিক্ষক ধর্মানন্দ কোশাম্বি (প্রখ্যাত অঙ্কবিদ, ঐতিহাসিক এবং মার্ক্সবাদী পণ্ডিত ডি ডি কোশাম্বির পিতা)। সুমিত সরকার মন্তব্য করছেন — “The all-India outlook of the leaders of national education is noteworthy; the study of Hindi and Marathi was encouraged (as well as of Pali, Persian and Sanskrit and also French and German)…” (‘The Swadeshi Movement in Bengal’, পৃঃ ১৬৮)

এরপরে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে ভাঁটা পড়ে। সংগঠকদের মতদ্বৈধ, বিভিন্ন বিরোধী মতকে সমাধান করার অজানা রাস্তা এবং, সর্বোপরি, ছাত্রসংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পেতে শুরু করে। এর প্রধান কারণ ছিল এই প্রচেষ্টা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে পাস করে বেরনোর পরে কর্মসংস্থানের কি হবে এ উত্তর অজানা ছিল।

কিন্তু “all that survived of the wreck of national education movement in Calcutta was the College of Engineering and Technology, the real institutional nucleus perhaps of the modern Jadavpur University.” (‘The Swadeshi Movement in Bengal’, পৃঃ ১৬৭) 

এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। সায়েন্টিফিক এবং টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের প্রসঙ্গ খুব জোরদারভাবে এলেও মেডিক্যাল শিক্ষার অঞ্চলটি, কিছু ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ছাড়া, প্রধানত ইংরেজ সরকার তথা রাষ্ট্রের হাতেই তোলা থাকল। যদিও সেসময়ে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জায়গায় প্রাইভেট মেডিক্যাল স্কুলের আদলে কিছুকিছু ক্ষেত্রে ডিসেকশন এবং রোগ নির্ণয় ও ওষুধ প্রয়োগের শিক্ষা দেওয়া হত। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘আরোগ্য-নিকেতন’-এ এ চিত্র খানিকটা ধরা আছে।

তাহলে কি জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন বা সামগ্রিকভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঢেউ মেডিক্যাল কলেজগুলোর ছাত্রদের স্পর্শ করেনি। প্রসঙ্গত বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ৩টি মেডিক্যাল কলেজ কলকাতা শহরে ছিল — (১) মেডিক্যাল কলেজ, ক্যালকাটা বা শুধুই মেডিক্যাল কলেজ, (৩) ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল (বর্তমান নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ), এবং (৩) কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ (বর্তমানে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ)। ঢাকাতে সেসময়ে তৈরি হয়েছিল মিটফোর্ড হাসপাতাল, যেখানে মেডিক্যাল ক্লাস নেওয়া হত।

শ্রীলতা চ্যাটার্জির গবেষণা জানাচ্ছে ১৯২১ সাল নাগাদ — “Gandhi himself, at a meeting at Mirzapore Park, appealed to the students to leave their studies. The Calcutta Medical College students who had been immune to propaganda by the leaders were overwhelmed by his appeal.” (‘Congress Politics in Bengal (1919-1939)’, 2002, পৃঃ ৭১-৭২)

এর আগে ঘটে যাওয়া জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন এবং, বিশেষ করে, গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল মেডিক্যাল শিক্ষার ওপরেও। ১৯০৭ সালে (জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের কাল) ডঃ শরৎকুমার মল্লিক ১৯১, বৌবাজার স্ট্রিটে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ অফ ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর কাজকর্ম শুরু হয়। ১৯১০ সালে এর সাথে একটি “ফ্রি হাসপাতাল” যুক্ত হয়। মহারাজা মণীন্দ্র নন্দীর দান করা একখণ্ড জমিতে (৩০১/৩, আপার সার্কুলার রোড) এই হাসপাতাল সরে যায়। ১৯১৯ সালে ডঃ শরৎকুমার মল্লিকের উদ্যোগে নতুন করে আবার এ কলেজ ও হাসপাতাল চালু হয়। এসময়ে এর দায়িত্বভার গ্রহণ করে “ক্যালকাটা মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশন” নামে এক ট্রাস্টি বোর্ড। নতুন ইন্সটিটিউশন State Medical Faculty of Bengal for LMF Course-এর সাথে “affiliated” ছিল। ১৯২৪-২৫ সালে ছাত্রদের প্রথম ব্যাচ Licentiate Examination of the Faculty-র জন্য পরীক্ষায় বসে।

শ্রীলতা জানাচ্ছেন – “Someswar Prasad Chaudhuri recalled how as a young medical student he was greatly moved by Deshabandhu’s speech in a meeting at Hedua and, disregarding all the attractions of further studies in Europe, responded to his call. He joined the newly opened National Medical College.” (পৃঃ ৭২)

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের আগে এবং অভিঘাতে বিজ্ঞানচর্চায় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ

যেসমস্ত স্বাধীন চিন্তকদের ওপরে জাতীয়তাবাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে তাঁদের মধ্যে মহেন্দ্রলাল সরকার (২ নভেম্বর, ১৮৩৩ – ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৪) অগ্রগণ্য। আমরা প্রায় সবাই জানি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এমডি হচ্ছেন মহেন্দ্রলাল। প্রথম এমডি ছিলেন চন্দ্রকুমার দে। মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৮৬০ সালে মেডিসিন, সার্জারি এবং মিডওয়াইফারি সর্বোচ্চ অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হন। ১৮৬৩ সালে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে এমডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপরে Bengal Branch of British Medical Association-এ যোগ দেন। 

১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিন। এই জার্নালে মহেন্দ্রলাল হোমিওপ্যাথির তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দিক নিয়ে প্রধানত আলোচনা করেছেন। কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয় সেটা নয়। শুধু এটুকু বলা যায় যে বেঙ্গল ব্র্যাঞ্চ অফ ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক হয়েছিলেন ১৮৬৩ সালে। সেসময়ে তিনি ঘোরতর হোমিওপ্যাথি বিরোধী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি হোমিওপ্যাথি চর্চায় বিশ্বাস করতে শুরু করেন। সহ-সভাপতি হিসেবে ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৭ সালে তিনি বার্ষিক মিটিংয়ে “On the supposed uncertainty in medical science, and on the relationship between diseases and their remedial agents” শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন (পরে এই শিরোনামেই পুস্তক হিসেবে এটি প্রকাশিত হয়) — আধুনিক মেডিসিনের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং হোমিওপ্যাথির প্রসঙ্গ নিয়ে। এর পরিণতিতে তাঁকে ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে বিতাড়িত করা হয়। অথচ সূর্য গুডিভ চক্রবর্তীর বাসগৃহে বেঙ্গল ব্র্যাঞ্চ অফ ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠার দিনে গুডিভ চক্রবর্তী বলেছিলেন — “The great and altogether novel characteristic of the Bengal Medical Association is, that in the room, for the first time, an united body of European and Physicians and Surgeons have now met, upon a perfect equality, with the common purpose of cultivating and advancing the Science of Medicine.” আরও বলেছিলেন যে এই অ্যাসোসিয়েশনের কাজ হবে “the pursuit of truth”। (‘Indian Annals of Medical Science’, No. 17, পৃঃ ১৫৪)

মহেন্দ্রলালের ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিন সম্বন্ধে সেসময়ের বিখ্যাত জার্নাল ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এ (জুলাই ১, ১৮৬৮) বিজ্ঞপ্তি হিসেবে বলা হল — “We have received the fifth number of this journal, and are very sorry to learn that the Editor is still single-handed. We beg to assure Dr. Sircar that when we made use of the term Sub-Assistant Surgeon, we did not allude to him, as we were well aware of his being an independent practitioner. We regret very much to think that the title of Sub-Assistant Surgeon should convey “an everlasting reproach,” as Dr. Sircar says it does. We do not despair of living to see it associated with all that is dignified, honorable, and lucrative.”

১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ভারতের প্রথম স্বাধীন বিজ্ঞান সাধনা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়ান্স (IACS)। অতি ঘটনাবহুল এর জন্ম, বৃদ্ধি ও বিকাশের ইতিহাস। আমি এ নিয়ে বিশদ আলোচনা থেকে বিরত থাকছি বর্তমান আলোচনার জন্য যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক নয় বলে। কিন্তু প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু বিষয় আলোচনায় আসবে।

মহেন্দ্রলালের একটি বিশেষ অবস্থান — বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যৌগপদ্যে গড়ে ওঠা সভ্যতা এবং এরকম সভ্যতার মাঝে বাস করা চিন্তাহীন নিষ্কর্মা মানুষকে নিয়ে তাঁর ধারণা — উদ্ধৃত করছি তাঁর নিজের লেখা থেকে — “There is an immense difference between civilized man and the man happening to live in civilized times; between the man of science and the man whom accident has placed in the era of science … The very fact of being born at this stage of the world’s history is indeed in itself a privilege, but with such privilege, to remain as ignorant as the man of the stone period, is not a matter of unspeakable shame, but an awful irresponsibility. To whom much has been given, of him much shall be required.” (J. Lourdusamy, ‘Science and National Consciousness in Bengal : 1870-1930’, 2004, পৃঃ ৬২)

এখানে আমরা মহেন্দ্রলালের করা বিভাজনটি খেয়াল করি। তিনি “সিভিলাইজড ম্যান” এবং “সিভিলাইজড টাইম”-এ জন্মানো মানুষের মাঝে প্রভেদ করছেন। প্রকৃত অর্থে তিনি বোঝাতে চাইছেন বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির সাথে যুক্ত মানুষ এবং ঘটনাচক্রে এরকম সময়ে জন্মেছে বলে “সিভিলাইজড” মানুষ — এ দুটিকে এক নিঃশ্বাসে বলা যাবেনা। তাঁর কথায় বলা যায়, যদি এরকম সময়ে জন্মেও কেউ স্বাধীনভাবে মৌলিক চিন্তাভাবনা না করে তাহলে তাকে প্রস্তর যুগের মানুষ বলা যায়। শুধু তাই নয়, এ কাজ না করা একধরনের অকথিত ঘৃণার জন্ম দেয়, এ কাজ একটি ভয়াবহ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা — “The very fact of being born at this stage of the world’s history is indeed in itself a privilege, but with such privilege, to remain as ignorant as the man of the stone period, is not a matter of unspeakable shame, but an awful irresponsibility”। হয়তো কথাগুলো কঠোর। কিন্তু রূঢ় সত্যি, আজ একুশ শতকের ভারতবর্ষে এবং পৃথিবীতে।

১৯০৩ সালে প্রকাশিত ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় এবং অমৃতলাল সরকার সংকলিত ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা — ইহার সংখেপবৃত্তান্ত ও অভাব পুস্তকের ভূমিকায় সংকলকরা জানান — “আমাদের দেশে যাহাতে বিজ্ঞান শাস্ত্রের আলোচনা হয়, সেই সম্বন্ধে ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ তেত্রিশ বৎসর পূর্বে, চিকিৎসা বিষয়ে একখানি মাসিক পত্রে (ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিন), ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকার একখানি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভার ইহাই প্রথম সূচনা।”

উত্তরপাড়া হিতকরী সভার “লিটারারি ব্র্যাঞ্চের” মিটিং-এ (১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭২) মহেন্দ্রলাল “On the desirability of a national institution for the cultivation of the sciences” শীর্ষক একটি দীর্ঘ বক্তব্য পাঠ করেন। এটি পরে আলাদা প্রবন্ধ হিসেবে (সাথে আরও অনেকের বক্তব্য ও মিনিটস সমেত) ৪৮ পাতার প্রবন্ধ হিসেবে ছাপা হয় (‘Indian Journal of History of Science’, vol. 29, Supplement, 1994, pp. 1-48)।

এই অভিভাষণের প্রায় সূচনাতেই তিনি বলেন — “How is it that we can scarcely name a single individual who may be said to be pursuing with steadiness any branch of science? How is it that the Medical College of Calcutta, which has been in existence for nearly half a century, and within whose walls some of the noblest of the physical sciences are practically and experimentally taught, has not yet turned out a single student who has even thought of cultivating any of these sciences for which such ample foundation has been laid during his term in the College?” (পূর্বোক্ত, পৃঃ S-2)

একটি গভীর প্রশ্ন তুললেন তিনি বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে। মেডিক্যাল কলেজের মতো সেসময়ের সর্বোন্নত প্রতিষ্ঠানে যেখানে মেডিসিনের বাইরেও ল্যাবরেটরিতে ফিজিক্যাল সায়ান্সের চর্চা এবং হাতেকলমে পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য সমস্ত সুযোগসুবিধে রয়েছে সেখান থেকে একজনও মৌলিক পথে গবেষণা করার সদিচ্ছা নিয়ে গবেষক বেরোবেনা কেন? তাঁর তীব্র যন্ত্রণার উৎস হচ্ছে স্বাধীন পথে বিজ্ঞানচর্চার আগ্রহ ভারতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছেনা। তাহলে পরাধীন ভারত কিভাবে ইংরেজ আধিপত্যের সঙ্গে পাল্লা দেবে? তিনি স্বাধীন বিজ্ঞানচর্চাকে এই অসম যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে গবেষণা করে ঔৎকর্ষ প্রমাণ করা নয়। তিনি চেয়েছিলেন সামগ্রিকভাবে একটি গবেষণার আবহাওয়া, একটি নতুন পথে চিন্তার পরিমণ্ডল তৈরি করতে।

এই অভিভাষণেই মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা ছাত্রদের নিয়ে তাঁর আক্ষেপ স্পষ্টভাষায় প্রকাশ করেন — “the class of graduates of the Medical College of Calcutta and other places … how they remain eternally degraded and disgraced as Sub-Assistant Surgeons, excluded from all independent positions, and with no hope” (পূর্বোক্ত, পৃঃ S-3। যদিও ১৮৭৫ সালে এদের অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন র‍্যাংক দেওয়া হয়)।

তাঁর এ আক্ষেপ পরবর্তী সময়ে মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষাক্রম ‘ল্যাবরেটরি মেডিসিন’-এর যুগে প্রবেশ করার পরে খানিকটা প্রশমিত হয়েছিল। যদিও তিনি চাক্ষুষ করে যেতে পারেননি। 

‘ল্যাবরেটরি মেডিসিন’ নিয়ে বলার কথা হল, খুব সংক্ষেপে বললে, আমরা সাধারণভাবে মেডিসিনের ধরন ও চর্চার সাথে (একটি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভর্তি হওয়া রোগী, রোগীর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে কেস হিস্টরি নেওয়া, মৃত্যুর পরে রোগের প্রকৃত চরিত্র উদ্ঘাটনের জন্য পোস্টোমর্টেম এবং রোগ ও রোগীর পরিসংখ্যান তৈরি করা) পরিচিত এর প্রধান জন্মস্থান ফরাসি বিপ্লব-পরবর্তী (১৭৮৯) সময়ে প্যারিসের হাসপাতালগুলো। এর পূর্ণ বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত। হসপিটাল মেডিসিনের পরের ধাপটিকে বলা হয় ‘ল্যাবরেটরি মেডিসিন’ — “In 1848, a new medicine, “laboratory medicine,” made its appearance in Paris under the leadership of Louis Pasteur, Claude Bernard, and the Societe de Biologie.”। (Erwin Ackernecht, ‘Medicine at the Paris Hospital 1794-1848’, p. xiii)

মেডিক্যাল কলেজে ‘ল্যাবরেটরি মেডিসিন’-এর যুগের সর্বোত্তম সন্তানদের মধ্যে পড়েন সূর্য গুডিভ চক্রবর্তী, মহেন্দ্রলাল সরকার, কানাইলাল দে, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কিংবা শম্ভুনাথ দের মতো বিজ্ঞানসাধক এবং আবিষ্কারকেরা।

কানাইলাল দে (২৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৩১ – ১৬ আগস্ট, ১৮৯৯)

ইংরেজিতে তাঁর নাম লেখা হয়েছে একাধিক বানানে – Kanny Lall Dey, Kanny Loll Dey। কিন্তু কানাইলাল দে নামটি বাংলা বানানে বা উচ্চারণে কখনও আসেনি। 

কানাইলাল ১৮৫৩ সালে মেডিক্যাল থেকে পাস করে সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন হিসেবে কলেজেই শিক্ষতায় যোগদান করেন। কেমিস্ট্রিতে তাঁর অন্তর্নিহিত অস্বাভাবিক ব্যুৎপত্তি এবং আগ্রহ ছিল। তিনি কেমস্ট্রির প্রফেসরের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮৬২ সালে তাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক পদ দেওয়া হয়। ১৮৬৯ সালে মেডিক্যাল কলেজের ‘ভার্নাকুলার ক্লাস’-এর কেমিস্ট্রির এবং মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সের (এখন যাকে ফরেনসিক মেডিসিন বলা হয়) শিক্ষক নিযুক্ত হন। লন্ডন, প্যারিস, আমেরিকা, আমস্টার্ডাম, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে ১৮৫৮ থেকে ১৮৮৩ সালের মধ্যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক এগজিবিশনে ভারতীয় ‘মেডিসিনাল প্ল্যান্ট’ এবং ‘ইনডিজেনাস ড্রাগস’ সম্পর্কে পেপার পড়ে বা সশরীরে ডেমন্সট্রেশন দিয়ে স্বর্ণপদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের পুরষ্কার, অকুণ্ঠ প্রশংসা এবং আন্তর্জাতিক স্তরের সোসাইটিগুলোর সাম্মানিক সদস্যপদ পেয়েছেন। সেসময়ের লন্ডন থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী Chemist and Drugist পত্রিকায় ২৭ জানুয়ারি, ১৮৯৪-এ “world’s fifty most eminent men of science related to pharmacy” প্রকাশিত হয়। এতে তিনি স্থান পান। উপনিবেশিক সরকারের কেমিস্ট এবং কেমিক্যাল এগজামিনারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদও তিনি উপযুক্ত যোগ্যতাসহ সামলেছেন। মহেন্দ্রলাল সরকারও উদাহরণস্থানীয় কেমিস্ট হিসেবে তাঁকে গণ্য করতেন। তাঁর লেখা দীর্ঘ প্রবন্ধ “Modified land scurvy with pingaemia” প্রকাশিত হয়েছিল Indian Annals of Medical Science-এ ১৮৬৮ সালে (No. XXIV)। পরে একই বছরে পেপারটি পুস্তককারে প্রকাশিত হয়। এই পেপারে রোগের বর্ণনা দিয়ে তিনি জানাচ্ছেন — “The epidemic spread from this spot all round and visited almost every one of the sixteen huts already described. It spared neither age nor sex; men, women, and children alike suffered from its effects.”

কানাইলাল দে সম্পর্কে অল্পকথায় ডেভিড আর্নল্ড প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলেছেন — “(ব্রিটিশের জ্ঞান জগতের সাথে) একটি সংলাপ রক্ষিত হচ্ছিল, এবং যেসব ভারতীয়রা পশ্চিমী মেডিক্যাল শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিল তারা এ জ্ঞানের বিনিময়ের ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি সবচেয়ে ত্রুটিসন্ধানী নর্ম্যান শেভার্সের মতো ব্রিটিশ চিকিৎসকও (Norman Chevers) তাঁদের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহে ভারতীয়দের কাজকর্মের, যারা তাঁদেরকে ভারতীয় ওষুধ এবং ভারতীয়দের বিষের ব্যবহার সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেছেন, প্রশংসাসূচকভাবে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে, কানাইলাল দে এবং উদয়চাঁদ — যথাক্রমে ১৮৬০ ও ১৮৭০-এর দশকে — এবং ১৮৯০ ও ১৯০০-এর দশকে চুণীলাল বোস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন পাশ্চাত্যের মনোযোগের ক্ষেত্রে ভারতের বিষ-সংক্রান্ত ওষুধ এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে। এই জ্ঞান এই বিষ এবং ওষুধের চরিত্র ও প্রয়োগ বোঝার ক্ষেত্রে পশ্চিমী জ্ঞান জগতকে বিশেষ সাহায্য করেছে। এর মাঝে কৈফিয়তমূলক কিছু ছিলনা। ১৮৬২ সালে কানালিলাল দে ভারতীয় ওষুধের ব্যাপারে লন্ডনে এক একজিবিশনের জন্য একটি তালিকা প্রস্তুত করেন — এর মাঝে ছিল বিষ এবং গর্ভপাতকারী ওষুধের নাম। ১৮৬৭ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Indigenous Drugs of India প্রকাশ করেন (এর সম্পূর্ণ সংশোধিত, নতুন করে লেখা এবং অনেক বৃহদাকার ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে)। এ গ্রন্থে তিনি বাজারে যেসব ওষুধ এবং বিষ পাওয়া যায় অথবা যেগুলো বাঙ্গালি বৈদ্য এবং হাকিমেরা ব্যবহার করে তার তালিকা অন্তর্ভুক্ত করেন। নিজের গবেষণার ক্ষেত্রে ফরেন্সিক নমুনায় আফিম আবিষ্কার করা করার নিজস্ব পদ্ধতিকে ব্যবহার করেছিলেন।” (পৃঃ ৭৪) কেমস্ট্রির আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক তথা গবেষক চুনীলাল বসু — বঙ্গ প্রদেশের কেমিক্যাল এগজানিনারও ছিলেন — তাঁর বিভিন্ন লেখায় এবং অভিভাষণে কানাইলাল দের ১৮৬০ পরবর্তী সময়ে মূল্যবান অবদানের কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন।

জগদীশচন্দ্র বসু (৩০ নভেম্বর, ১৯৫৮ – ২৩ নভেম্বর, ১৯৩৭)

১৯১৮ সালে প্রকাশিত ‘Sir J. C. Bose : A Sketch of His Life and Career’ পুস্তকে মন্তব্য করা হয়েছে — “Patriotism in a country like this comes often to be identical with politics. But it is our singular good fortune that it has found its expression not only in politics but also in the sciences and the arts. The discoveries of Dr. Bose· have shed lustre on his, country.” এ উক্তি এক অর্থে জগদীশচন্দ্রের দেশাত্মবোধের নির্যাসকে ধরেছে — দেশাত্মবোধ ভারতের মতো দেশে রাজনীতির সমার্থক হয়ে ওঠে। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে রাজনীতি ছাড়িয়ে বিজ্ঞান এবং শিল্পকলায় প্রতিফলিত হয়েছে।

তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে ইংল্যান্ডে যান উচ্চতর শিক্ষার জন্য (যদিও তাঁর বাবার ইচ্ছে ছিল তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করুন)। এসময়ে জগদীশচন্দ্রের নিজের উপলব্ধি ছিল — “আমি আমার শাসক, অন্য কারও নয়। আমি একজন স্কলার হব, প্রশাসক নয়।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৬) সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময় তাঁর ফিজিক্সের শিক্ষক ছিলেন ফাদার লাফোঁ। বেলজিয়ান এই শিক্ষক সেসময়ের একজন অগ্রগণ্য পদার্থবিদ ছিলেন। লাফোঁ মহেন্দ্রলাল সরকারের সাথে IACS প্রতিষ্ঠা করার একজন উদ্যোগী ব্যক্তিত্বও বটে।

গ্র্যাজুয়েশনের পরে কোন শিক্ষায় প্রবেশ করবেন এ নিয়ে তাঁর মধ্যে কিছুটা দোলাচলচিত্ততা ছিল — “Young Bose then turned his attention towards medicine, apparently the only avenue and means of support for the career of natural scince.” এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর মাতৃদেবের তরফে তাঁকে ছেড়ে থাকার ভীতি এবং সমুদ্র পেরিয়ে বিদেশযাত্রার অজানা আশঙ্কা। (প্যাট্রিক গেডেস, ‘Life and Works of Sir Jagadis C. Bose’, ১৯২০, পৃঃ ২৪)

লন্ডনে তাঁর ভারত থেকে অর্জিত বিএ ডিপ্লোমা ম্যাট্রিকুলেশনের তুল্য বলে বিবেচিত হল। তিনি মেডিক্যাল স্টুডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম বছরের পড়া শুরু করলেন। রে ল্যাঙ্কাস্টার ছিলেন তাঁর জুলজির শিক্ষক। প্রথম বছরের ছাত্রদের অ্যানাটমি শেখা বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু ডিসেকশন রুমের ভয়ঙ্কর গন্ধ তাঁকে অসুস্থ করে তুলল। দীর্ঘদিন জ্বরে ভুগেছিলেন। অ্যানাটমির শিক্ষক তাঁর এই “hopeless” ছাত্রকে অ্যানাটমি পড়া পরিত্যাগ করার উপদেশ দিলেন। জগদীশচন্দ্র পাড়ি দিলেন কেম্ব্রিজে। ১৮৮১ সালে ক্রাইস্ট’স কলেজে ন্যাচারাল সায়ান্সের স্কলারশিপ অর্জন করলেন। (‘Life and Works of Sir Jagadis C. Bose’, পৃঃ ২৮) কেম্ব্রিজে পড়া শুরু করেও তিনি হতবুদ্ধি হয়েছিলেন, তাঁর নিজের যোগ্যতা সম্বন্ধে অনিশ্চিতবোধও ছিল — “he adpted the plan of going as fully as possible to the course science lectures — ‘a perfect orgie of lectures’ — and with thes to as many laboratories as possible.” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩০) কেম্ব্রিজে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন প্রোফেসর লিভেনিং (কেমিক্যাল কোর্সেস) এবং লর্ড র‍্যালের মতো পদার্থবিদকে। 

কেম্ব্রিজের ল্যাবরেটরিতে তাঁর চোখের সামনে স্পেক্ট্রোস্কোপির জগত উন্মোচিত হল। তাঁর জীবনীকার গেডেস মন্তব্য করছেন — “his work satisfied his teachers: as was evidenced first by his Cambridge degree in Natural Sciences Tripos, and that of B.Sc. taken at London (University of London) about the same time and without further work.” (পূর্বোক্তঃ পৃঃ ৩১)

আশিস নন্দী জগদীশচন্দ্রকে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সাইকোঅ্যানালিটিক্যাল বিশ্লেষণধর্মী পুস্তকে (পড়াশুনো নিয়ে মন্তব্য করেছেন — “Throughout his undergraduate days, he took a variety of courses without specializing in any … In particular, his professor of physics, Lord Raleigh, served as another Father Lafont.” (‘Alternative Sciences : Creativity and Authenticity in Two Indian Scientists, ১৯৮০’, পৃঃ ৩৭) সামগ্রিক বিচারে তাঁর এই মন্তব্য খানিকটা লঘু বলে মনে হয়।

নেচার-এ (অক্টোবর ২৮, ১৯২০) প্যাট্রিক গেডেসের বইটি নিয়ে একটি আলোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। সে আলোচনায় বলা হয়েছিল — “The story of his life shows that Sir J. C. Bose had to contend, at all stages, with difficulties of every kind. The first and most fateful was of securing was that of securing a university education in England … Having successfully completed his university career, Bose returned to India to face the the next serous difficulty – that of obtaining a suitable educational post … The last, and the most formidable, of the difficulties to be overcome was that of securing of his work.” (Nature, ‘Experimental Science in India’, vol. 106, no. 2661, পৃঃ ২৭২-২৭৩) আশিস নন্দীর মূল্যবান পুস্তকে এই বিষয়গুলো যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিত এবং দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে বিষয়গুলোকে। 

যাহোক, ইংল্যান্ডের পড়াশুনো শেষ করে ভারতে ফিরে এলেন জগদীশচন্দ্র। যোগ দিলেন ইম্পেরিয়াল সার্ভিসের একজন ক্যাডার হিসেবে সেসময়ের ভারতে সবচেয়ে খ্যাতনামা কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিক্সের অধ্যাপক হিসেবে। এখানেও এক ঊল্লেখগযোগ্য কাহিনি আছে। স্বয়ং লর্ড রিপন তাঁকে অধ্যাপক পদ দেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পাবলিক ইন্সট্রাকশনের ডিরেক্টর তাঁর ওপরে খাপ্পা হয়ে যান। রীতিমত উষ্মা নিয়ে তাঁকে বলেন — “I am usually approached from below, not from above. There is no higher-class appointment at present available in the Imperial Education Service. I can only offer you a place in the Provincial Service, from which you may be promoted.” (‘Life and Works of Sir Jagadis C. Bose’, পৃঃ ৩৩) কলেজে যোগ দিয়ে দেখলেন কলেজে প্রেসিডেন্সির খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোন ল্যাবরেটরি নেই। ১০ বছর পরে একটি ছোট ল্যাবরেটরি গড়ে উঠল।

এখানে উল্লেখ করা দরকার, তাঁর সুশিক্ষিতা স্ত্রী অবলা বসু (ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সময়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন, পরে মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজে ২ বছর পড়ে শারীরিক অসুস্থতার কারণে পড়া বাদ দেন) যিনি সারাজীবন তাঁকে গবেষণা ও স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্রে প্রেরণা জুগিয়েছেন, তাঁর স্নেহময়ী মা এবং পিতৃদেব এঁদের সবাইকে সম্মান জানাতে তাঁর ৩৫তম জন্মদিনে (৩০ নভেম্বর, ১৮৯৪) তিনি শপথ নিলেন “his life henceforth was to be above all dedicated to the pursuit of new knowledge.” (‘Life and Works of Sir Jagadis C. Bose’, পৃঃ ৩৯)  

পরবর্তী প্রসঙ্গে যাবার আগে এটা উল্লেখ করে নেওয়া ভালো যে “he was also the victim of race discrimination in the Department. When Bose joined service, an Indian Professor’s income, even if he be in the. Imperial service, was two-thirds that of a European. A further insult was offered him too by cutting down half of even this two-thirds since his appointment was only officiating. But Bose was determined and strong.” (‘Indian Scientists’, পৃঃ ৬৪-৬৫) 

গান্ধীজির সত্যাগ্রহের অনেক আগে এভাবে চরম আর্থিক ক্ষতি সহ্য করে একজন মেধাবী শিক্ষকের টানা তিনবছর মাইনে না নিয়ে অধ্যাপনা করা এক ভিন্ন ধরনের সত্যাগ্রহ বৈকি। এরপরে উপনিবেশিক সরকার নতি স্বীকার করে। তিনি পুরো মাইনে পেতে শুরু করেন। জগদীশচন্দ্রের ঘটনার পরবর্তীতে আর কোন ভারতীয় শিক্ষক এরকম জাতিগত বৈষম্যের স্বীকার হননি।

১৮৯৫ সাল থেকে জগদীশচন্দ্র একের পর এক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখতে শুরু করেন। তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র “The Polarisation Electrical Ray by a Crystal” প্রকাশিত হয় জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল-এর মে, ১৮৯৫, সংখ্যায়। এর অব্যবহিত পরে আরও দুটো গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ইলেক্ট্রিশিয়ান (সেসময়ের বিখ্যাত ইলেক্ট্রিক্যাল জার্নাল)-এ। এর মধ্যে একটি হল “On a new electro-polariscope”। তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল বলা যায় পরের গবেষণাপত্র “Determinants of the Indices of Electric Refraction”। ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি এর প্রকাশ হওয়া মাত্র তাদের জার্নালের জন্য মনোনীত করে, যা ছিল বৈজ্ঞানিকমহলে এক বিরাট সম্মানের ব্যাপার। (‘Indian Scientists’, পৃঃ ৬৬-৬৭)

এখানে আরও কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে — মাইক্রোওয়েভ ইঞ্জিনিয়ারিং, সলিড-স্টেট device-এর ক্ষেত্রে প্রথম পেটেন্টের কৃতিত্ব, নেচার তুল্য জার্নালে ২৭টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হওয়া এবং উদ্ভিদের ফিজিওলজি নিয়ে ইংরেজিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয়োক্ত বিষয়ে বইদুটি হল — (১) ‘Plant-Autoographs and Their Revelations’ (From the Smithsonian Report for 1914, Pages 421-443), এবং (২) ১৯০২ সালে প্রকাশিত ‘Response in Living and Non-Living’। প্রথম বইটির পরিচয় হিসেবে বলা হয়েছিল — “Reprinted by permission from pamphlet copy published by the Royal Institution of Great Britain. Lecture at the Weekly Evening Meeting, Friday, May 29, 1914”।

খুব সম্প্রতি প্ল্যান্ট সিগন্যালিং অ্যান্ড বিহেভিয়ার পত্রিকায় (২০২১, ভল্যুম ১৬, নম্বর ১) প্রকাশিত “American racism and the lost legacy of Sir Jagadis Chandra Bose, the father of plant neurobiology” প্রবন্ধে প্রবন্ধকার বলছেন — “Sir Jagadis Chandra Bose, India’s first modern biologist departed boldly from mainstream botany by claiming that plants possess “nerves” and “pulsating cells” that function respectively much like the nerve and heart cells of animals … In the 21st century, Bose’s contributions to biology have begun to be appreciated anew, particularly within the plant neurobiology community.” সবই হল একে একে, কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় বঞ্চিত থেকে গেলেন!

যা বলছিলাম, সেসময়ের পদার্থবিদ্যার দুনিয়ায় “Hertzian wave” আলোড়ন ফেলেছিল। এ বিষয়ে জটিলতায় এবং বিশদ ব্যাখ্যায় প্রবেশ না করে শুধু এটুকু বলা যায় যে উপনিবেশিক ভারতের একটি দুর্বল ল্যাবরেটরিতে তিনি নিজের উদ্ভাবিত নতুন ধরনের “coherer” (রেডিও তরঙ্গ ধরার যন্ত্র) ব্যবহার করলেন। কিন্তু কখনও এর পেটেন্ট নিলেননা। ফলে বৈজ্ঞানিক মহলে তাঁর আবিষ্কারের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। 

ইংলিশম্যান পত্রিকায় ১৮ জানুয়ারি, ১৮৯৬-এ লেখা হল — “The Electrician thinks that it would be a useful and remunerative work for some practically minded man “to devise a practicable system of electromagnetic light-houses, the receivers on board ship being some electrical equivalent to the human eye. The evolution of a suitable generating apparatus would, we think present little difficulty; that of a suitable receiver, on the other hand seems likely to give considerable trouble. In this connection we would draw attention to the substantial and workmanlike form of ‘Coherer’ devised by Professor Bose. The sensibility and range of this type of ‘Coherer’ would appear to leave little to be desired, and it is certainly more likely to withstand the thousand-and-one shocks at sea than any of the forms hitherto brought out … Should Professor Bose succeed in perfecting and patenting his ‘Coherer’, we may in time see the whole system of coast lighting throughout the navigable world revolutionised by a Bengali scientist working single handed in our Presidency College Laboratory.” (বিশ্বপ্রিয় মুখার্জি, ‘Jagadish Chandra Bose’, Publication Division, 2010, পৃঃ ১৭)

প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরির বাইরে তাঁর কাজের প্রথম ডেমন্সট্রেশন দিয়েছিলেন কলকাতার টাউন হলে ১৮৯৫ সালে। বাংলার লেফটন্যান্ট গভর্নর উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জি এবং হলভর্তি অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে তাঁর (মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘের) পরীক্ষা দেখালেন — “Electric waves penetrated his colossal body and two closed rooms, and played different kinds of ‘havoc’ in the third room. The waves fired a cannon, fired a pistol and exploded a gunpowder heap.” (‘Jagadish Chandra Bose’, Publication Division, 2010, পৃঃ ১৮)

১৮৯৬ সালে লর্ড কেলভিন তাঁকে লিখেছিলেন যে তিনি তাঁর কাজে “literally filled with wonder and admiration: allow me to ask you to accept my congratulations so much success in the difficult and novel experimental problems you have attracted”। ফ্রান্সের আরেক দিকপাল পদার্থবিদ মঁসিয়ে করনু, ফ্রেঞ্চ অ্যাকাডেমি অফ সায়ান্সেস-এর প্রক্তন সভাপতি, জগদীশচন্দ্রকে ১৮৯৭ সালে লেখেন — “the very first results of your researches testify to your power of furthering the progress of science … I hope to take full advantage of the perfection to which you have brought your apparatus, for the benefit of of Ecole Polytechnique and for the sake of further researches I wish to complete.” (‘Life and Works of Sir Jagadis C. Bose’, পৃঃ ৪০)

আর-একজন বিশ্রুত বিজ্ঞানী পল ল্যাঞ্জেভিন (যাঁর পিএইচডি ছাত্রদের মধ্যে আইরিন ক্যুরি এবং লুই ডি ব্রগলির মতো বিজ্ঞানীরা ছিলেন) জগদীশচন্দ্র প্যারিসে তাঁর ল্যাবরেটরিতে কাজ করে আসার পরে একটি চিঠি তথা শংসাপত্র লিখেছিলেন জগদীশচন্দ্রকে।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। জানুয়ারি ১১, ১৯৩০-এ নেচার-এ (No. 3141, Vol. 125) ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল হেনরি জ্যাকসনকে (যিনি নিজে F.R.S ছিলেন) নিয়ে ২ পাতার একটি ‘obituary’ প্রকাশিত হয়। এই ‘obituary’-তে উল্লেখ করা হয় — “১৮৯১ সালে ব্রিটিশ নৌবাহিনী এমন একটি পদ্ধতির অনুসন্ধান করছিল যার সাহায্যে কোন টর্পেডো কোন বন্ধু জাহাজের কাছাকাছি এলে এর উপস্থিতি জানান দিতে পারে ‘Hertzian waves’ ব্যবহার করে। ১৮৯৫ সালে he read some experiments by Dr. (now Sir Jagadis) Bose on coherers. Having obtained a satisfactory coherer, he managed in this year to effect communication by electromagnetic radiation from one end of his ship to the other.” (‘Nature’, No. 3141, Vol. 125, পৃঃ ৫৯)   

আশিস নন্দী কোন তথ্যসূত্রের উল্লেখ না করে তাঁর পুস্তকে জানিয়েছেন যে ১৮৯৯ সালের পরে জগদীশচন্দ্র যে উদ্ভিদ ফিজিওলজির দিকে ঝুঁকেছিলেন তার কারণ হল “his researches were now leading him towards more complex mathematical work for which he had no aptitude. His students say that he dreaded mathematical details” (‘Alternative Sciences’, পৃঃ ৪৫) এরকম নেতিবাচক মন্তব্য প্রকৃতপক্ষে জগদীশচন্দ্রের সমগ্র কর্মকাণ্ডকে একজন ‘failed’ তথা পরাজিত নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে। আমি একে গ্রহণ করতে পারছিনা। বাকিটা বিচারের ভার পাঠকদের ওপরে।

বরঞ্চ ১৭ মে, ১৯০১ সালে তাঁর সুহৃদ রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিটি এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি লিখছেন — “A short time before my lecture, a multi-millionaire proprietor of a very famous telegraph company telegraphed me with an urgent request to meet me. I replied that I had no time. In response he said that he is coming to meet me in person and within a short time he himself arrived with patent forms in hand. He made an earnest request to me not to divulge all valuable research results in today’s lecture: “There is money in it — let me take out patent for you. You do not know what money you are throwing away” etc. Of course, “I will only take half share in the profit — I will finance it” etc.

This multi-millionaire has come to me like a beggar for making some more profits. Friend, you would have seen the greed and hankering after money in this country, – money, money – what a terrible all pervasive greed! If I once get sucked into this terrible trap, there wont’ be any escape! See, the research that I have been dedicated to doing, is above commercial profits. I am getting older – I am not getting enough time to do what I had set out to do — I refused him.” (‘ব্যক্তিগত চিঠিপত্র’, রবীন্দ্রভবন আর্কাইভস, শান্তিনিকেতন) 

এই কোটিপতি ব্যক্তির নাম মেজর স্টিফেন ফ্লাড পেজ, মার্কনির Wireless and Telegraph Company-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। এবং চিঠিটি জগদীশচন্দ্রের জীবনদর্শনকে পরিস্ফুট করে। এখানে প্রাচীন ভারতের নিষ্কাম সাধনার কথা যেন বলছেন জগদীশচন্দ্র। বাণিজ্যিক লাভ এবং কেবলমাত্র অর্থের জন্য নিজের আবিষ্কারকে বিক্রি করতে রাজী হলেননা। এমনকি তাঁর মৌলিক উদ্ভাবনার পেটেন্টও নিলেননা। ফলে বিজ্ঞানের আগ্রাসী প্রতিযোগিতার জগতে তিনি ‘পিছিয়ে’ পড়লেন। একজন বিজ্ঞানীর পরম আকাঙ্ক্ষা নোবেল প্রাইজ থেকে দূরে রইলেন। অনেক পরে IETE (Institution of Electronics and Telecommunication Engineers) Technical Review জার্নালে “Sir J C Bose’s Diode Detector Received Marconi’s First Transatlantic Wireless Signal of December 1901 (The “Italian Navy Coherer” Scandal Revisited)” শিরোনামের প্রবন্ধে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৯৮, পৃঃ ৩৭৭-৪০৬) প্রবীর বন্দ্যোপাধ্যায় মার্কনি সংক্রান্ত ভুল তথ্য এবং অতিকথার ইতিহাস উদ্ঘাটন করেন।

ভারতের জাতীয় ক্ষেত্রে IACS-এর দশম বার্ষিক অ্যানুয়্যাল মিটিংয়ের রিপোর্ট থেকে জানা যায় জগদীশচন্দ্র এই বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের গুরত্ব সম্যক অনুধাবন করে “offered his services to the IACS by providing many lecture-demonstrations, often encouraging students themselves to perform experiments.” (‘Science and National Consciousness in Bengal’, পৃঃ ১২৫) তাঁর দেশপ্রেম তথা জাতীয়তাবাদী চেতনার উৎসে ছিল বিজ্ঞান একটি বৈশ্বিক ক্ষেত্র যেখানে ভারত তার জাতপাত-নির্ভর জ্ঞানচর্চার ঊর্ধে উঠে সমানভাবে অংশগ্রহণ করবে। একইরকম অবদান রাখবে। স্বাধীন পথে চিন্তা করবে। স্বাধীন পথে উদ্ভাবন করবে।

প্রসিডিংস অফ দ্য রয়্যাল সোসাইটি অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত তাঁর “প্ল্যান্ট অ্যান্ড অ্যানিম্যাল রেসপন্স” প্রবন্ধে (১৯২০) তিনি বলেছিলেন — “প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য, উভয় ভৌগোলিক স্থানের আমরা, জ্ঞানের প্রবাহ উন্মুক্ত করার জন্য এবং অজ্ঞানতা দূর করার কাজে ব্যাপৃত। আমরা একদিন পৃথিবী থেকে চলে যাব, রাষ্ট্রগুলো বিলীন হয়ে যাবে। কেবলমাত্র সত্য বেঁচে থাকবে, কারণ সত্যের অবস্থান সময়কে অতিক্রম করে এবং চিরকালীন।”

কৃষিতে তাঁর উদ্ভিদবিদ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে আমেরিকাকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাঁকে সরকারিভাবে তাঁর গবেষণার বিষয় বিশদে জানানোর জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আমেরিকায় কৃষিবিদ্যা বিষয়ক সমস্ত ডিপার্টমেন্ট এই বক্তৃতায় উপস্থিত ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যুরো অফ প্ল্যান্ট ইন্ডাস্ট্রি “which was keen to adopt his new methods in the study of actions of fertilizers on plants.” (‘Science and National Consciousness in Bengal’, পৃঃ ১২২)।

কিন্তু বিপরীত একটি স্রোতও ছিল — “The anti-Bose camp in the United States, as has been discussed, had an extremely high density of racist eugenicists … Of course, Bose’s opponents maintained, in their own minds, genuinely held scientific objections to Bose’s paradigm (from a historiographic viewpoint, it matters not whether these genuinely held beliefs were correct or not). Scientists who express maverick views always face strong opposition from the scientific orthodoxy: so, was the opposition that Bose faced out of the ordinary?” (Peter V. Minorsky, “American racism and the lost legacy of Sir Jagadis Chandra Bose, the father of plant neurobiology”, Plant Signaling & Behavior, 2021, VOL. 16, NO. 1, e1818030, 17 pages) সারাজীবন বিরুদ্ধতার স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেলেন এই অতিলৌকিক প্রতিভাধর মানুষটি।

“বোস ইন্সটিটিউট” বা বসুবিজ্ঞান মন্দির উদ্বোধনের দিন তিনি যে অভিভাষণ দিয়েছিলেন তার শুরুতেই বলেছিলেন — “আমি এই প্রতিষ্ঠানকে উৎসর্গ করছি কেবলমাত্র একটি ল্যাবরেটরি হিসেবে নয়, একটি মন্দির হিসেবে।” বিজ্ঞানের কঠোরতম গবেষণার সাথে একজন সর্বাগ্রগণ্য ভারতীয় তথা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী এবং ভারতীয় জ্ঞানতাপসের দুটি ধারা এসে মিশে গেল। আবার ল্যাবরেটরি তথা মন্দিরের কর্মপথ নিয়ে তিনি নির্দ্বিধায় জানালেন — “কিন্তু উচ্চপর্যায়ের সাফল্য কঠোর নির্ভুলতা ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয় … এখানে যেসমস্ত লেকচার দেওয়া হবে সেগুলো কেবলমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীর জ্ঞানের পুনরাবৃত্তি হবেনা। এই ল্যাবরেটরির দেয়াল-ঘেরা চৌহদ্দির মধ্যে এরা নতুন আবিষ্কারের ঘোষণা করবে যেগুলো এই ল্যাবরেটরিতেই প্রথমবারের জন্য ডেমন্সট্রেট করা হবে।” (পরমহংস যোগানন্দ, ‘Autobiography of a Yogi’, 1946, পৃঃ ৬৬-৬৭)

প্রফুল্লচন্দ্র রায় (২ আগস্ট, ১৮৬১ – ১৬ জুন, ১৯৪৪)

ধ্রুব রায়না তাঁর “The Young P.C. Ray and the Inauguration of the Social History of Science in India(1885-1907)” (‘Science, Technology and Society’, মার্চ ১, ১৯৯৭, পৃঃ ১-৩৯) প্রবন্ধে একটি মনোযোগ দেবার মতো পর্যবেক্ষণ রেখেছেন — “First, Ray’s own predisposition to pharmacological chemistry, and a specific programme initiated by his thesis supervisor at Edinburgh, Crum Brown who along with Thomas Fraser founded the branch of pharmacology dealing with the constitution of drugs and their therapeutical properties (Ray 1932: 60). Second, his investigations revealed thaw the place of mercury and mercury based compounds in Indian alchemy was unique, and he intended to decipher the nature of its use, its preparation and efficacy. Third, in 1895,  Ray commenced his research afresh on the problem of assigning a place to mercury and some of the heavy metals in the periodic table.” (পৃঃ ২৭)

রায়না বলতে চেয়েছেন যে প্রফুল্লচন্দ্রের মৌলিক গবেষণা এবং ঐতিহাসিক আগ্রহের মধ্যে একটি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। প্রফুল্লচন্দ্রের মান্য গবেষণা গ্রন্থ ‘A History Of Hindu Chemistry’ (২ খণ্ডে)-তে এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশের ১১শ শতকের টীকাকার চক্রপাণি দত্তের চরক সংহিতার ওপরে টীকায় ‘চিকিৎসাস্থান’-এ পারদের ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায় বলে আমরা জানি।

প্রফুল্লচন্দ্রকে নিয়ে লেখাপত্র প্রচুর। নতুন গবেষকরা নতুন ভাবে তাঁর কাজের বিশিষ্টতা এবং সম্ভাবনার দিগন্ত খুঁজছেন। তাঁকে নিয়ে লেখার প্রাচুর্য এতই বেশি যে এ লেখায় খুব নতুন সন্ধান দেওয়া মুশকিল।

জ্ঞান প্রকাশের লেখা ‘Another Reason : Science and the Imagination of Modern India’ (১৯৯৯)-তে লেখক প্রফুল্লচন্দ্রকে (তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘A History Of Hindu Chemistry’, যার প্রথম খণ্ড প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে এবং ২য় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে ১৯২৫-এ) নিয়ে আলোচনায় খানিকটা ভিন্ন চোখে দেখেছেন তাঁর কাজকে — “This was not a work of nationalist cheerleading but a work of immense sophistication and erudition that assessed the achievements of Hindu alchemy from the point of view of modern experiments and observations.” প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর অতিবিখ্যাত গবেষণাকর্মে কখনওই দাবি করেননি যে হিন্দু অ্যালকেমি কোন “experimental science” ছিল। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ভারতে এর বিকাশ দেশীয় উৎস থেকেই হয়েছিল। ইউরোপীয়দের এবং ওরিয়েন্টালিস্টদের দাবি ছিল গ্রিক প্রভাবে এখানে অ্যালকেমির চর্চা শুরু হয়। তিনি সে দাবিকে নস্যাৎ করেছেন উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে।

তিনি ‘হিন্দু কেমিস্ট্রি’র ইতিহাস লিখেছেন বটে তবে তাঁর এই হিন্দুত্ব, হিন্দুশাস্ত্র কিংবা হিন্দু রাষ্ট্রের জয়গাথা রচনার জন্য নয়। বরঞ্চ হিন্দুত্ব বা হিন্দুরাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এমন কতকগুলো বিষয় তাঁর নিজের লেখা থেকে দেখে নেওয়া যাক।

পরপর বললে এরকমভাবে সাজানো যায় — 

(১) “প্রায় ১০০০ বছর ধরে হিন্দু জাতি মৃতপ্রায় (as good as dead) হয়ে আছে আছে বলা যায়।” (“Bengali Brain and Its Misuse”, Essays and Discourses by Prafulla Chandra Ray, 198, পৃঃ ১৮১) 

(২) “Rationalism is the very fountain of nation’s life … The cultured Hindu proud of his intellectual attainments began to look down upon the lower classes, he surrendered his own judgement in favour of the injunctions of the Shastras.” (পৃঃ ১৮৩-১৮৪)। এরপরে তীক্ষ্ণভাষায় আক্রমণ করছেন তাঁর সময়ের বাঙ্গালি তথা হিন্দুদের — “এরা শিশুশয্যায় শুতে ভালোবাসে, ছোট ঘরে এবং নিজের বন্ধুবর্গের ছোট গণ্ডির মধ্যে থাকতে ভালোবাসে … যখন কোন স্থানে ‘spirit of enquiry’ মরে যায় তখন আমরা বৃথা আশা করব যে ‘capacity for original investigation among people’ বেঁচে থাকবে।” (পৃঃ ১৮৪) এখানে আমাদের মহেন্দ্রলাল এবং জগদীশচন্দ্রের কথা স্মরণে আসবে। একইভাবে ‘spirit of enquiry’ সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন এঁরা।

(৩) ইউরোপও যে এরকম সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে তিনি সে কাহিনী ঐতিহাসিক তথ্যসহ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বলছেন – “When Martin Luther shook off the thraldom of the Pope and boldly placarded his protest in the Church-gate of Wurtemberg, the glad tidings reached from one corner of Europe to the other and stirred the imost depth of society.” (পৃঃ ১৯২) একথার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সবার কাছেই সহজবোধ্য। ভাগ্যিস সময়টা ছিল ১৯১০-এর উপনিবেশিক ভারত, ২০২২-এর প্রায়-হিন্দু ভারতরাষ্ট্র নয়। তাহলে তাঁর ভাগ্যলিপিতে যে কি লেখা ছিল!

(৪) তিনি সাংখ্য দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কপিল ঋষি এবং নিরীশ্বরবাদী চার্বাক দর্শনের উল্লেখ করেছেন শ্রদ্ধা নিয়ে। তাঁর বয়ানে — “Kapila even goes the length of calling in question the very existence of God for it cannot be proved to demonstration.” বলছেন চার্বাক আরও একধাপ এগিয়েছিলেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বেদের ‘divine origin’-কে অস্বীকার করেছিলেন। (পৃঃ ১৮৬)

(৫) উল্লেখ করেছেন নাগার্জুনের কথা যিনি প্রথম মেডিসিনে লোহার ব্যবহারের কথা বলেছেন এবং রসেন্দ্রচিন্তামণি অনুযায়ী পাতন প্রক্রিয়ার উদ্ভাবক। মুসলমানদের আগমণের ফলে যে হিন্দু ঔৎকর্ষের পতন হয় (যেমনটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মনে করতেন) এনিয়ে তিনি জানান “but history belies this theory.” (পৃঃ ১৮৮) তিনি প্রশ্ন রেখেছেন যদি মুসলমান আক্রমণই হিন্দুদের পতনের কারণ হয় তাহলে দক্ষিণ ভারতে (যেখানে মুসলমান আধিপত্য কখনওই স্থায়ী হয়নি) “Hindu learning and science would seek asylum in Southern India.” বরঞ্চ মুসলমান আমলে নবদ্বীপ এবং বিক্রমপুরের জ্ঞানচর্চা বিকশিত হয়েছে বলে তিনি দেখিয়েছেন। তাঁর অভিমত, বৌদ্ধধর্মের পতন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থান হিন্দুদের জ্ঞানচর্চার পতনের মূলে — “The very essence of the rejuvenated Brahminism was exclusive.” (পৃঃ ১৮৯) এ চিত্র তো আজ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। শুধু তাই নয়, এসময়ে জ্যোতির্বিদ্যা জ্যোতিষচর্চায় পরিণত হয় বলে তিনি মনে করেছেন।

(৬) তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল — “যখন একটি রাষ্ট্র বা জাতি অতীব হীন অবস্থায় পতিত হয় তখন এক হাজার একটি সর্বনাশা আচারবিচার ফনফনিয়ে ওঠে এবং “eat into the vitals of of the social fabric.” (পৃঃ ১৯৪) কুল্লুকভট্ট বা রঘুনন্দন কাউকেই তিনি এ ব্যাপারে রেয়াত করেননি।

(৭) তীব্র শ্লেষ নিয়ে তিনি লিখলেন — হিন্দু সমাজ পূর্ণত মেটেরিয়ালিজমে সিঞ্চিত। “Those who go up for University education are taught to look upon it purely as a means to an end. A diploma is judged by monetary equivalent – as something which can be turned into cash.” (পৃঃ ২০৩)

এরকম এক মানসিক জগত নিয়ে জাতির মাঝে তিনি নতুন অন্বেষণ বীক্ষার সন্ধান করেননা। একে মূলগতভাবে পুনঃনির্মিত করার চেষ্টা করেছেন। সে কাহিনীর বিস্তৃত বিবরণ ধরা আছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস সংক্রান্ত অসংখ্য লেখাপত্রে, তাঁর আত্মচরিত-এ এবং অন্যান্য পুস্তকে। আমরা সে আলোচনা এখানে করছি না।

শুধু এটুকু বলা যায় — “কতকগুলি “টেকনোলজিক্যাল বিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠিত করাই সর্বাপেক্ষা বেশি প্রয়োজনীয় নহে; সফল ব্যবসায়ী বা শিল্পপ্রবর্তক হইতে হইএল যে সাহস, প্রত্যুৎমন্নমতিও, কর্মকৌশলের প্রয়োজন, বাংলার যুবকদের পক্ষে তাহাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছে।” (‘আত্মচরিত’, ১৯৩৭, পৃঃ ৬৩) এ বিষয়ে ডেভিড আর্নল্ডের পূর্বোক্ত পুস্তকে (‘Toxic Histories’) আর্নল্ড বলছেন — “Ray helped transform chemistry into a prominent field of scientific enquiry for Indians, a form of patriotic as well as public service, and something of this idealistic ethos impressed itself on Ray’s contemporary Chunilal Bose.” (পৃঃ ১১৪-১১৫)

উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী (১৯ ডিসেম্বর, ১৮৭৩ – ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৬) 

ইতিহাসে কুখ্যাত ‘বর্ধমান ফিভার’ বস্তুত দুটি রোগের যুগপৎ আক্রমণে হয়েছিল। ব্রহ্মচারী ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এ প্রকাশিত (সেপ্টেম্বর, ১৯১১) তাঁর গবেষণাপত্র “On the Nature of the Epidemic Fever in Lower Bengal Commonly Known as Burdwan Fever. (1854-75)”-এ দেখিয়েছিলেন — “It is thus evident that there was an epidemic of two diseases during the outbreak of Burdwan fever. The severe cases described by French were mostly cases of malaria (probably malignant tertian fever), while those that constituted the large majority of cases observed by Jackson were cases of Kala-azar.”

১৯২৮ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘A Treatise on Kala-azar’ গ্রন্থে ব্রহ্মচারী জানাচ্ছেন — “কালা-আজার নামটি যদিও বহুল ব্যবহৃত হয়, কিন্তু যথোপযুক্ত নয়। এ নাম দিয়ে বোঝানো হয় যে এক বিশেষ ধরনের জ্বরে ত্বকের রঙ কালো হয়ে যায়। এজন্য অনেকেই মনে করেন একে ‘কালা-জ্বর’ বলা উচিত।” অঞ্চলভেদে কতভাবে এর নামের ভিন্নতা ঘটেছে তার ব্যাখ্যা করেন তিনি। ১৮২৪-২৫-এ যশোরে যখন এ রোগের প্রকোপ দেখা যায় তখন একে ‘জ্বর-বিকার’ বলা হত। এরই অন্যান্য নামগুলো হল — ‘দমদম জ্ব’”, ‘সাহেবদের রোগ’, ‘সরকারি অসুখ’, ‘কালা-দুঃখ’, ‘কালা-হাজার’, ‘আসাম ফিভার’, ‘ponos’ (Greece), ‘semieh’ (Sudan), ‘malattia de menssa’ (Sicily) ইত্যাদি। এসব থেকে কালাজ্বরের পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। জলপাইগুড়িতে একে বলা হত ‘পুষ্করা’ আর আসামের মানুষ একে বলতো ‘সাহেবদের রোগ’। 

যাহোক, আসামের সুবিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চা বাগান তৈরি হল, ‘সাহেবদের রোগ’ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো স্থানীয় অধিবাসী এবং চা বাগানের কুলি তথা শ্রমিকদের মাঝে। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেতে লাগলো এই ব্ল্যাক ডেথ বা কৃষ্ণ মৃত্যুর থাবায়। তখন আড়কাঠিদের দিয়ে ছোটনাগপুর অঞ্চলে থেকে দরিদ্র, ভুখা মানুষদের নিয়ে আসা হল চা বাগানের কুলি হিসেবে। চা বাগান তৈরির মধ্য দিয়ে আগেই আসাম এবং গারো পার্বত্য অঞ্চলের টোপোগ্রাফি পরিবর্তিত হয়েছিল। এবার নতুন করে ডেমোগ্রাফির পরিবর্তন শুরু হল। আরেকটা পরিবর্তন হল — আসামের মানুষের মাঝে চা পানের অভ্যেস তৈরি করে দেওয়া হল। পরিবর্তন হল পানাভ্যাসেরও। ৩,৫০,০০০-এর বেশি মানুষ এ রোগে মারা গিয়েছিল। আবার কোন কোন হিসেবে এ সংখ্যা ২৫ লক্ষও হতে পারে। এ রোগে সেসময়ে মৃত্যুহার ছিল ৯০%।

উপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি এক গভীর সংকটের মুখে পড়লো — মানুষ তথা চা বাগানের কুলিদের মৃত্যু আটকানো না গেলে চা উৎপাদন হবেনা, মুনাফায় ঘাটতি পড়বে। আবার বিজ্ঞানীদের কাছে দুটি প্রশ্ন এলো — (১) এ রোগ কিভাবে হয়? রোগের বাহক কে? (২) মৃত্যুকে প্রতিরোধ করা যাবে কিভাবে। মেরি গিবসন তাঁর “The Identification of Kala-azar and the Discovery of Leishmania Donovani” গবেষণাপত্রে জানাচ্ছেন – “In the years following 1858, when the British government formally assumed power over the whole of British India, the government of Bengal became concerned by reports of an epidemic of quinine-resistant fever occurring in the district of Burdwan in Lower Bengal. The mortality was so great that the population, the productivity of the land, and consequently the government revenue were greatly diminished.”

এক অদ্ভুত সমাপতন ঘটলো — সাম্রাজ্যবাদ চায় মুনাফার জন্য কুলিদের বাঁচিয়ে রাখতে, এবং বিজ্ঞান চায় একটি মানুষেরও যেন মৃত্যু না ঘটে। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী সে লক্ষ্যে তাদের সমস্ত শ্রম ঢেলে দেন। উপনিবেশিক শাসকেরা তার সুফলটুকুর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে। এটা বিজ্ঞানের ট্র্যাজেডি। শুধু তাই নয় একটি ‘মেডিক্যাল-স্টেট-পলিটিক্স কমপ্লেক্স’ গড়ে ওঠে। রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির যূপকাষ্ঠে চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা বলি প্রদত্ত হন।

এর ভালো উদাহরণ দেখা যাবে ১৮৬৭-পরবর্তী উপনিবেশিক ভারতের কলেরা পলিসির ক্ষেত্রে। সুয়েজ খাল চালু হবার পরে কলেরা রোগী থাকলে জাহাজ শুদ্ধ কোয়ারান্টাইনে থাকা আন্তর্জাতিকভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কিন্তু এতে ইংরেজের মুনাফায় ঘাটতি পড়ছিল। এজন্য কলেরার সংজ্ঞা বদলে দেওয়া হল, কলেরা ছড়ানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রাহ্য ধারণাকেও আক্রমণ করা হল, অস্বীকার করা হল। এ ব্যাপারে অনবদ্য সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন শেল্ডন ওয়াটস তাঁর “From Rapid Change to Stasis: Official Responses to Cholera in British-Ruled India and Egypt : 1860-1921”। তাঁর পর্যবেক্ষণে — “To maintain general amnesia, they silenced critics at the Royal Army Medical College at Netley who knew what the score was. They kept inconvenient documentary evidence, written before the policy change, under wraps and in some cases may have destroyed it.” আরেকজন উচ্চপদস্থ ইংরেজ চিকিৎসক অ্যান্ড্রু ডানকান তাঁর “A Phase in the History of Cholera in India” (১৯০২ সালে এডিনবার মেডিক্যাল জার্নাল-এ প্রকাশিত) প্রবন্ধে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে এই বিপজ্জনক প্রবণতার বর্ণনা দিয়েছেন। “মেডিক্যাল-স্টেট-পলিটিক্স কমপ্লেক্স”-এর এর চাইতে ভালো উদাহরণ আর কি আছে?

১৮৬৭-৬৮ পরবর্তী সময়ে ভারতে কলেরা গবেষণার ক্ষেত্রে ‘পলিসি রিভার্সাল’ বা নীতির আপাদমস্তক পরিবরর্তনের ফলে শুধু কলেরা সংক্রান্ত গবেষণা নয়, সব শাখার স্বাধীন গবেষণা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনিতেই পুঁজি এবং বাণিজ্যের প্রয়োজন ছাড়া অন্য বিষয়ে গবেষণায় উপনিবেশিক ভারতে উৎসাহ দেওয়া হত এমন নয়। এই সময়ের পরে তা আরও কমে যায়। এমনকি খোদ সাদা চামড়ার সাহেব রোনাল্ড রস তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রে বিস্তর বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। বিজ্ঞানের আমলাতন্ত্র বিভিন্ন পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। ফলে ব্রহ্মচারী “রাজভক্ত” ছিলেন কিনা এ প্রশ্ন এরকম এক প্রেক্ষিতে খুব জরুরী নয় একেবারেই। অধিকতর জরুরী ছিল একজন কালা মানুষ শিক্ষাক্ষেত্রে যত যোগ্যতাই অর্জন করুন না কেন তিনি উপনিবেশিক বিজ্ঞানের আমলাতন্ত্রের সাথে কতটা লড়াই করে উঠতে পারছেন এবং আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের জগতের ঘাঁৎঘোঁৎ ভালো বুঝতেন কিনা। 

দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি আমরা তার মাঝে খুঁজে দেখতে পারি অন্যভাবে। তাঁর নাম দুবার — ১৯২৯ এবং ১৯৪৬ — নোবেলের তালিকায় নমিনেশন পাওয়া সত্ত্বেও কেন নোবেল পুরষ্কার পেলেননা । আর প্রথম ক্ষেত্রে এটা জেনে রাখা ভালো ইন্ডিয়া রিসার্চ ফান্ড থেকে অনুদান পাওয়ার দরুণ তার আবিষ্কৃত ইউরিয়া স্টিবামিনের বাজারে আসা সহজ হয়েছিল। কিন্তু ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলের (বর্তমানের নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ) যে ঘরে এই অসম্ভব গবেষণাকর্মটি করেছেন সেটা আয়তনে জেলের একটা সেলের সাইজের বেশি কিছু ছিলনা। তাঁর নিজের কথায় — “I recall with joy that memorable night in the Calcutta Campbell Hospital at Sealdah, where after a very hard day’s work I found at about 10 o’clock that the results of my experiments were up to my expectations … I shall never forget that room where Urea Stibamine was discovered. The room where I had to labour for months without a gas point or a water tap and where I had to remain contented with an old kerosene lamp for my work at night. To me it will ever remain a place of pilgrimage where the first light of Urea Stibamine dawned upon my mind.” তাঁর গবেষণাকক্ষে কোন গ্যাসের সংযোগ ছিলনা, ছিলনা বিদ্যুৎ সংযোগ, এমনকি ট্যাপ ওয়াটারের সরবরাহও নয়। একটি পুরনো কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাত্রিবেলা কাজ করতেন আবিষ্কারের অদম্য আকাঙ্ক্ষায়।

ব্রহ্মচারী এলএমএস ডিগ্রি পান ১৮৯৯ সালে। ১৯০০ সালে এমবি ডিগ্রি — মেডিসিন এবং সার্জারি দুটিতেই প্রথম হয়ে গুডিভ এবং ম্যাকলিওডস মেডেল পান। ১৯০২ সালে এমডি পাশ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপরে ১৯০৪ সালে পিএইচডি অর্জন। বিষয় ছিল ‘Studies on Haemolysis’। তাঁর পিএইচডির থিসিসের সংক্ষিপ্ত এবং উন্নত চেহারার নতুন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় বায়োকেমিক্যাল জার্নাল-এ ১৯০৯ সালে “Some Observations on the Haemolysis of Blood by Hyposmotic and Hyperosmotic Solutions of Sodium Chloride” শিরোনামে। এছাড়াও ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিকাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন থেকে Mente মেডেল এবং এশিয়াটিক সোসাইটির উইলিয়াম জোন্স মেডেল লাভ করেন।

পরবর্তীকালে তাঁর প্রায় সম্পূর্ণ জীবন ব্যয়িত হয়েছে গবেষণার নির্ভুল লক্ষ্যে। প্রায় ১৫০টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে নেচার, ল্যান্সেট, ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল, বায়োকেমিক্যাল জার্নাল, ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ বা ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এর মতো জার্নালগুলোতে।

যখন কালাজ্বরের বিভিন্ন ওষুধ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে সেসময় ব্রহ্মচারীর মাথায় আসে আর্সেনিক এবং অ্যান্টিমনি পর্যায় সারণীতে একই গ্রুপে রয়েছে। এবং দুটি মৌলের ক্ষেত্রে রাসায়নিক ও বায়োলজিক্যাল চরিত্রে অনেক মিল আছে। তিনি এবার অ্যান্টিমনি দিয়ে পরীক্ষা শুরু করলেন। প্রথমে পাউডার তৈরি করে, পরবর্তীতে অ্যান্টিমনির কোলয়ডিয় (colloidal) দ্রবণ তৈরি করে। সফল হলেন। তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল ল্যান্সেট পত্রিকায় (অক্টোবর ২১, ১৯১৬) “The Preparation of Stable Colloidal Antimony” শিরোনামে। তিনি জানালেন — “The remarkable trypanocidal properties possessed by antimony, its specific action against the Leishmania, and the fact that in the colloids generally the ratio dosis curativa : dosis tolerata is very low, make it desirable to prepare a stable solution of colloidal antimony.” তাঁর শেষ কথা ছিল — “The colloid obtained in this way seems to be a very stable substance, and in this respect differs from the Svedberg’s colloid. The therapeutic use of the colloidal metallic antimony has already been described n the Indian Medical Gazette (May, 1916) Further observations on the use of this drug in the same disease have shown similar beneficial results.” শেষ বাক্যটি খেয়াল করলে বুঝবো যে আজকের যুগের ফেজ ১ ট্রায়ালের ছায়া তাঁর পরীক্ষায় ধরা আছে। এই গবেষণার কাজে সাহায্যের জন্য ১৯১৯ সালে ইন্ডিয়ান রিসার্চ ফান্ড আর্থিক অনুদান পেয়েছিলেন।

এরপরে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এ ১৯২২ সালে “Chemotherapy of Antominal Compounds in Kala-azar Infection” শিরোনামে। এখানে প্রতিটি যৌগের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করলেন। দেখালেন ইউরিয়া স্টিবামিন (carbostibamide) সবচেয়ে কার্যকরী, ফলদায়ক এবং কম সময় লাগে চিকিৎসার ক্ষেত্রে। ১৯৮৬ সালে Revista da Sociedade Brasileira de Medicina Tropical জার্নালে ফিলিপ মার্সডেন “The Discovery of Urea Stibamine” (এপ্রিল-জুন, ১৯৮৬) শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।

এবার এই ওষুধের ব্যাপক প্রয়োগ শুরু হল আসামে — চা বাগানে, গ্রামে-গঞ্জে, লোকালয়ে এবং অন্যত্র। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ (৪ মে, ১৯২৯) “Preventive Medicine in Assam” শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হল — “In June, 1927, universal or mass treatment of all kalaazar patients with urea stibamine was inistituted consequient on a marked reduction having been effected in the cost of this preparation; previouisly only 10 per cent. of the patients had been so treated, the remainder having received the less effective sodiumin antimony tartrate. The change of treatment resulted at once in a most gratifying increase of cures and a more regular attendance of patients at treatinent centres.” 

১৯৩২ সালে সরকারি কালা-জ্বর কমিশনের ডিরেক্টর এইচ ই শর্ট বললেন — “We found Urea Stibamine an eminently safe and reliable drug and in seven years we treated some thousands of cases of Kala-azar and saw thousands more treated in treatment centers. The acute fulminating type characteristic of the peak period of an epidemic responds to treatment extraordinarily promptly and with an almost dramatic cessation of fever, diminution in the size of spleen and return to normal condition of health.” এরসাথে মাথায় রাখতে হবে ইউরিয়া স্টিবামিন ব্যবহারের আগে যেখানে মৃত্যুহার প্রায় ৯০% ছিল, এ ওষুধ ব্যবহারের পরে তা বদলে গিয়ে সুস্থতার হার ৯০% হয়।

যাহোক, নেচার-এ (ডিসেম্বর ১৬, ১৯৩৯) লিওনার্ড রজার্সের (যিনি ফেলো অফ রয়্যাল সোসাইটি ছিলেন) একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হল “The Antimony Treatment of Kala-azar” শিরোনামে। এ প্রতিবেদনে অনেক তথ্যের মাঝে একবার ছুঁয়ে যাওয়া হল যে “The first of these was introduced (and patented) by Dr. U. N. Brahmanchari in Calcutta in 1921, under the name of urea stibamine. This proved less toxic and more effective, and it enabled more than 90 per cent of cases to be cured by intravenous injections within a few days”। আজকের অ্যাকডেমিক পরিভাষায় একে বলা হয় relativization — অর্থাৎ, কোন উপায়ে মূল বিষয়কে লঘু করে দেওয়া। এ প্রতিবেদনেই পরে লিখলেন — “according to Napier, who in 1925 found a course of stibosan to cost £2 5s. and one of urea stibamine £3 – a prohibitive sum for poor villagers in India.” মনে হয় দুরভিসন্ধি থেকে দুটি ভুল বা মিথ্যে তথ্য আন্তর্জাতিক গবেষক মহলে তুলে ধরলেন রজার্স — (১) ইউরিয়া স্টিবামিনকে ‘পেটেন্টেড’ বললেন, যা কখনই ছিলনা, এবং (২) ইউরিয়া স্টিবামিনের প্রতিটি ডোজের খরচ সেসময়ের হিসেবে ৩ পাউন্ড বলে দেখালেন। 

এরপরে নেচার-এ (এপ্রিল ৬, ১৯৪০) পত্রিকার তরফে প্রকাশ করা হল একটি ছোট রিপোর্ট “Antomny Treatment of Kala-azar” শিরোনামে। সেখানে পরিষ্কার করে বলা হল হল “He (Brahmachari) states that, contrary to Sir Leonard Rogers’ statement, urea stibamine was not patented.” আরও বলা হল — “Sir Leonard Rogers stated in his article that a course of treatment with urea stibamine cost £3 in 1925.” কিন্তু বাস্তবে “Sir Upendranath states that urea stibamine is now supplied by the Government at Rs. 1 per gram, and since 1·5 gm. is sufficient for complete cure, the total cost of the drug to-day is now Rs. 1.8 (about 2s. 3d.).” নেচার-এর রিপোর্টের উপসংহারে বলা হল — “Yet this cost is still relatively high for a country in· which the great majority of the population live dangerously near the starvation line, and there is still room for a rapidly effective and really cheap remedy for kalaazar.”

আমরা শেষ বাক্যটি খেয়াল করলে বুঝবো সরকারের লক্ষ লক্ষ পাউন্ড মুনাফার জোগানদার শ্রমিকেরা এই রোগে উজাড় হয়ে গেলেও রাষ্ট্রের তরফে পাব্লিক হেলথের কোন প্রোগ্রাম উপনিবেশিক সরকারের তরফে ছিলনা। এরকম প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসার দায় রোগীর নিজের। আজকের ভারতবর্ষে রাষ্ট্রের তরফে চিকিৎসার দায় যে ক্রমাগত রোগীদের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এর মধ্যে কি সেদিনের কোন ছায়া আমরা দেখতে পাচ্ছি?

১৯২৯ সালে নোবেলের জন্য ভারত থেকে নমিনেশন পেয়েছিলেন ব্রহ্মচারী। কিন্তু কে ছিলেন তাঁর প্রস্তাবক? প্রস্তাবক ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক সুধাময় ঘোষ। আন্তর্জাতিক মহলে কে চেনে তাঁকে? ফলে ব্রহ্মচারী নোবেলের জন্য নির্বাচিত হলেননা। কিন্তু নোবেলজয়ী সি ভি রমন আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং যোগাযোগের এই পরিসরটি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন। এজন্য ১৯৩০ সালে তিনি যখন নোবেল প্রাইজ পান তাঁর প্রস্তাবক ছিলেন ৬ জন আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী। এঁদের মধ্যে নিলস বোর, রিচার্ড ফেইফার, ডি ব্রগলির মতো নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীরা ছিলেন। একই বছরে মেঘনাদ সাহা নমিনেশন পেয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাবক ছিলেন ডি এন বোস এবং শিশির মিত্র, যাদের আন্তর্জাতিক মান্যতা প্রায় কিছুই ছিলনা। সত্যেন্দ্রনাথ বসু বা মেঘনাদ সাহাও নোবেল প্রাইজ পাননি। কিন্তু বোস-আইন্সটাইন সমীকরণ পদার্থবিদ্যার জগতকে নতুন পথে ভাবতে শিখিয়েছে। তাঁর নামে ‘বোসন পার্টিকল’ নামাঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু উপনিবেশের প্রতিভাধর বিজ্ঞানী নোবেলের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হননি।

ব্রহ্মচারীর গবেষণা ১৯২৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত কয়েক লক্ষ মানুষের জীবন রক্ষা করেছিল। বিজ্ঞানের জগতে এ এক পরম প্রাপ্তি। আমরা যদি এর পাশে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য ১৯৯০ সালে নোবেলজয়ী জোসেফ মারের কথা স্মরণ করি তাহলে আরেকটু বোধগম্য হবে বিষয়টি। জোসেফ মারে কোন তাত্ত্বিক কাজ করেননি। ১৯৫৪ সালে পৃথিবীতে প্রথম সফল কিডনি প্রতিস্থাপন করেছিলেন। কয়েক কোটি মানুষের জীবন বেঁচেছে। সমধর্মী কাজ করেও ব্রহ্মচারী নোবেল থেকে বঞ্চিত। ১৯৪৬ সালেও ব্রহ্মচারী নমিনেশন পেয়েছিলেন। কিন্তু নোবেল জয় হয়নি। অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো ১৯৩৭ সালে তাঁকে নাইটহুড দেওয়া হয়।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১ জানুয়ারি, ১৮৯৪ – ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪)

সত্যেন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখার সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল কি লেখা যায় এবং কতটুকু লেখা যায়। একদিকে, সত্যেন্দ্রনাথের নামে পদার্থবিদ্যার জগতে ‘বোসন’ পার্টিকল-এর নাম চিরকালীন হয়ে যাওয়া; আরেকদিকে মাত্র ৩০ বছর বয়সে খোদ আইন্সটাইনের সাথে পত্রালাপের মধ্য দিয়ে বোস-আইন্সটাইন সমীকরণ বা স্ট্যাটিস্টিক্স তথা ডিস্ট্রিবিউশন সমগ্র পৃথিবীর শিক্ষিত মানুষের কমবেশি চেনা শব্দ হয়ে ওঠা — এসব মিলে এমন একটি জ্যোতির্বলয় (halo) তাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছে যে আসল মানুষটিকে চেনা মুশকিল হয়ে পড়ে।

এরসঙ্গে যুক্ত করুন CERN-এর গবেষণাগারে হিগস-বোসন পার্টিকল নিয়ে অনুধ্যায়ী গবেষণা। ৪ জুলাই, ২০১২-তে CERN-এর ডিরেক্টর জেনারেল Rolf Heuer-এর বিখ্যাত উক্তি — “It was the Higgs Boson, the almost-mythical entity that had put particle physics in the global spotlight”। এর ফলে জ্যোতির্বলয়টি আরও শক্তিশালী হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অভিঘাতে প্রধানত দুটি বিষয় শিক্ষার অঙ্গনে এলো — (১) বাংলা ভাষাকে বহুক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ, এবং (২) উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণামুখী দৃষ্টিভঙ্গীকে উৎসাহ দেওয়া। একসময়ে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সাথে স্বল্পসময়ের জন্য যুক্ত স্যার আশুতোষ মুখার্জি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫টি টার্মে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব সামলেছেন। ১৯১৩ সালে তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্নাতকোত্তর পাঠক্রম চালু হল। জমি তৈরি হয়েই ছিল। ফসল ফলতে দেরী হলনা। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ২৫-৩০ বছরের মধ্যে বোস পরিসংখ্যান, মেঘনাদ সাহার তাপ আয়নন তত্ত্ব এবং সি ভি রমনের রামন-এফেক্ট আবিষ্কৃত হল।

শান্তিময় চট্টোপাধ্যায় ও এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘সত্যেন্দ্রনাথ বোস’ (১৯৭৮) গ্রন্থে তাঁরা একটি নজর করার মতো পর্যবেক্ষণ করেছেন। আমার উল্লিখিত তিন বিজ্ঞানী — বসু, সাহা এবং রামন — যখন তাঁদের গবেষণাকর্ম করছেন সেসময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেছে। বিশ্বযুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চাকে প্রভাবিত করল, বিজ্ঞানচর্চার অভিমুখের পরিবর্তন ঘটালো। লেখকেরা বলছেন — “প্রতিরক্ষার কাজে বিজ্ঞানকে প্রয়োগের বিপুল সম্ভাবনার কথা যুদ্ধরত দেশগুলির সরকার বুঝতে পারলেন ফলে সাধারণভাবে বিজ্ঞান গবেষণার উপর এর গভীর প্রভাব দেখা গেল। সরকারি ও আনুকূল্যে বিজ্ঞানের দিক পরিবর্তিত হল। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ছেড়ে সহস আরম্ভ হল বিশাল বিশাল সরকারী অর্থপুষ্ট উদ্যোগ। প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা ছাড়াও বিজ্ঞানের অন্যান্য বিভাগে বর্ষিত হতে লাগল সরকারী ও দাক্ষিণ্য, কারণ তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের বুনিয়াদ পাকা না হলে ফলিত বিজ্ঞান অথবা প্রয়োগধর্মী গবেষণা বেশি এগোতে পারেনা।” (পৃঃ ১০) আজকের ভারতবর্ষে তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রেই গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। 

সত্যেন্দ্রনাথ যখন যুবক ও পরিণত হচ্ছেন তখন তাঁর বৈশিষ্ট্য বোঝাতে বলা যায় — “The family background explains much in S N Bose’s character – his urbanity and innate sophistication, his love of art and literature, his love for perfection, his liberal and open mind, his originality, a sense of family loyalty and national pride. Unlike many of his eminent predecessors and contemporaries, Satyendranath was city bred.” (S N Bose : ‘The Man and His Work’, ২য় খণ্ড, ১৯৯৪, পৃঃ ৯)

চিরকালের অত্যন্ত কৃতবিদ্য ছাত্র, যাঁর চোখের পাওয়ার মাইনাস ১৪, সত্যেন্দ্রনাথ ১৯০৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পঞ্চম হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনী-তে লিখছেন — “সেই স্মরণীয় বছরে এমন একদল মেধাবী ছাত্র প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয় যারা ভবিষ্যতে গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল।” এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, সত্যেন্দ্রনাথের পিতৃদেবের পড়ার বিস্তৃত পরিধির মধ্যে মার্ক্সবাদের পুস্তকও ছিল। (চট্টোপাধ্যায় ও চট্টোপাধায়, ‘সত্যেন্দ্রনাথ বোস’)

আমরা লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব কিরকম গভীরভাবেভাবে বাংলার মানসিক, বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক এবং বোধের জগতকে প্রভাবিত করেছিল। উল্লেখ করেছি যে এর প্রভাব তখন কিশোর সত্যেন্দ্রর মনে কি গভীর ছাপ ফেলেছিল। বাংলায় এসময় তরুণদের মধ্যে স্বাধীনতার আগুন আগুন জ্বলে ওঠে। বহুসংখ্যক সশস্ত্র গুপ্ত সমিতি তৈরি হয়। এরকম একটি সমিতি হল অনুশীলন সমিতি। “সত্যেন্দ্রনাথ ও তাঁর বন্ধু জীবনতারা হালদার এইসব গুপ্ত সমিতির ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ এইরকম একটি সমিতি পরিচালিত নৈশ স্কুলে পড়াতেন। স্কুলটির নাম ছিল ওয়ার্কিং মেনস ইন্সটিটিউট — এখানে শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাদান করা হত।” (‘সত্যেন্দ্রনাথ’, পৃঃ ২৩) “Some of the others to join Presidency College in 1909 were Maniklal De, Jnanchandra Ghosh (who came from Giridih), Jnanendranath Mukherjee (who came from Bardhaman), Nikhilranjan Sen, Pulinbehari Sarkar and Amaresh Chakrabarty. 1909 was a remarkable year – it was the year ofthe Alipore Bomb Case. The political atmospbexe was highly charged. A year ago the first bomb had been thrown at Muzaffarpur at a British official. Khudiram was caught and hanged. Overnight he became a martyr and a darling of the people.”

প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকর্ড মার্কস পেয়ে পাস করা যুবক ১৯১৬ সালে সেসময় সদ্যগঠিত বিজ্ঞান কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সঙ্গী অধ্যাপক ছিলেন সারাজীবনের বন্ধু দ্বিতীয় স্থানাধিকারী মেঘনাদ সাহা। (S N Bose : ‘The Man and His Work’, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩)।

প্রসঙ্গত বলা ভালো, সত্যেন্দ্রনাথ একাধারে ফিজিক্স, অংক, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, দর্শন, খনিবিদ্যা, সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলায় আগ্রহী ও ব্যুপত্তিসম্পন্ন মানুষ। আবার নিজে ভালো বেহালাবাদক ছিলেন। সেসময় কলকাতায় যেসব সাহিত্য আড্ডা বসতো তার অনেকগুলোরই তিনি নিয়মিত সদস্য ছিলেন। নিজের চেষ্টায়  সহজাত দক্ষতায় ফরাসী এবং জার্মান ভাষা শিখেছিলেন।

শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এসময়ে (১৯১০-এর দশকে) এক জার্মান অধ্যাপক ছিলেন – পি জে ব্রুল। তিনি সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদকে জার্মান ভাষায় লেখা ফিজিক্সের অনেকগুলো বই দেন। এর মধ্যে কয়েকটি স্বয়ং ম্যাক্স প্ল্যাংকের (পদার্থবিদ্যায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের স্রষ্টা) লেখা বই ছিল। দুজনেই জার্মান ভাষা ভালভাবে জানতেন বলে সাবজেক্ট অনুযায়ী বইগুলো ভাগ করে নিলেন। মেঘনাদের ভাগে পড়লো থার্মোডায়ানামিক্স এবং স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিক্স। আর সত্যেনের ভাগে ইল্কট্রোম্যাগ্নেটিজম এবং থিওরি অফ রেলাটিভিটি। (‘সত্যেন্দ্রনাথ’, পৃঃ ৩২)

১৯১৮ সালে সত্যেন্দ্রনাথের প্রথম গবেষণাপত্র (মেঘনাদ সাহার সাথে যৌথভাবে লেখা) “On the Influence of the Finite Volume of Molecules on the Equation of State”, প্রকাশিত হয়েছিল Phil. Mag. (Ser. 6, 36, 199-203)-এ। “The equation of state proposed in the paper is generally known as the ‘Saha-Bose equation of state’. (’S N Bose : The Man and His Work’, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩১১)। সত্যেনের নিজস্ব ৩য় আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র — “On the Deduction of Rydberg’s Law from the Quantum Theory of Spectral Emission” — আবার প্রকাশিত হল Philosophical Magazine-এ (40, 619-27)। ১৯২১-এ জাপান যাবার পথে আইন্সটাইন খবর পান তিনি সেবছরের নোবেল প্রাইজ পাচ্ছেন। ১৯২৪ সালে Pauli দেখিয়েছিলেন যে মুক্ত ইলেক্ট্রন এবং বিকীরণ (রেডিয়েশন) উভয়য়েই থার্মাল ইক্যুইলিব্রিয়ামে থাকতে পারে (প্ল্যাঙ্কের ল অনুযায়ী)। Zeitschrift fur Physik-এ (সেসময়ের তাত্ত্বিক ফিজিক্সের সবচেয়ে বিখ্যাত জার্নাল) প্রকাশিত হল (১৯২৩-এ) পলি, আইন্সটাইন এবং Ehrenfest-এর পেপার। ১৯২৩-এই মেঘনাদ সাহা ঢাকায় আসেন। সত্যেন্দ্র সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। সাহা এই পেপারগুলো প্রতি সত্যেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সালটি ১৯২৪। 

এই পেপারগুলোর নতুনতর গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি লিখলেন যুগান্তকারী সেই পেপার “Planck’s Law and the Light-Quantum Hypothesis” এবং Philosophical Magazine-এ প্রকাশের জন্য। প্রকাশিত হলনা। ১৯২৪-এর ৪ জুন একটি চিঠি সহ এই পেপারটি পাঠালেন স্বয়ং আইনস্টাইনের কাছে, যাতে পেপারটি Zeitschrift fur Physik-এ প্রকাশিত হয়। ১৫ জুন, ১৯২৪-এ আরেকটি পেপার “Thermal Equilibrium in the Radiation Field in the Presence of Matter” পাঠালেন আইন্সটাইনকে। প্রথম পেপারটি নিজে জার্মানে অনুবাদ করে আইন্সটাইন পূর্বোক্ত জার্নালে পাঠালেন প্রকাশের জন্য। এবং সত্যেন্দ্রকে আইনস্টাইন ব্যক্তিগত চিঠিতে লিখলেন — “signifies an important step forward and I liked it very much . . . You are the first to derive the factor quantum theoretically, even though because of the polarization factor 2 not wholly rigorously. It is a beautiful step forward.” 

Zeitschrift fur Physik-এ “Plancks Gestez und Lichtquantenhypothese” শিরোনামে পেপারটি প্রকাশিত হল আগস্ট, ১৯২৪-এ। সাথে আইন্সটাইনের নোটও প্রকাশ করে জার্নাল — “Bose’s derivation of Planck’s law signifies, in my opinion, an important step forward. The method used here gives also the quantum theory of an ideal gas, as I shall show elsewhere.”  বোসের ২য় পেপারও আইন্সটাইনের জার্মান অনুবাদে Zeitschrift fur Physik-এর সেপ্টেম্বর, ১৯২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। আইনস্টাইন ভিয়েনায় প্রুশিয়ান অ্যাকাডেমির কনফারেন্সে প্রথম “Bose’s counting method” নিয়ে নিজের পেপার পাঠ করেন। (আমি এসমস্ত তথ্যের জন্য ঋণী ’S N Bose : The Man and His Work’, ২য় খণ্ড, গ্রন্থের কাছে)

এরপরে অক্টোবর, ১৯২৪-এ বোসের বিদেশ তথা প্যারিস যাত্রা। সিলভাঁ লেভির সূত্রে পরিচয় হল বিশ্বখ্যাত ফরাসী পদার্থবিদ পল ল্যাঞ্জেভিনের সাথে। ল্যাঞ্জেভিন প্যারিসের বিখ্যাত ল্যাবরেটরি Maurice de Broglie-তে এক্স-রে স্পেক্ট্রোস্কোপি শেখার সুযোগ করে দেন।

এরপরে বোসের আইন্সটাইন সহ অন্য বিজ্ঞানীদের সাথে পরিচয় এবং আলাপচারিতা হয়। পরবর্তীতে তিনি লিখছেন — “was very friendly with Franck, Einstein, Born, Ewald, Szilard and Mark”। এখানে উল্লেখিত বিজ্ঞানীদের নামগুলো শুধু খেয়াল করুন — সেসময় পদার্থবিদ্যার দুনিয়া যাঁরা তাত্ত্বিকভাবে ওলটপালট করে দিচ্ছিলেন সেসব বিজ্ঞানীরা। বার্লিনের ল্যাবরেটরিতে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফির পাঠ নিলেন। ১৯২৬-এ পল ডিরাকের মতো বিজ্ঞানী সংযুক্ত করলেন “Bose and Fermi statistics of particles to the symmetry properties of their wave functions and names them ‘bosons’ and ‘fermions’.” (’S N Bose : The Man and His Work’, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩১৩)

“Bose applies for a Professor’s post at Dhaka University, with recommendations from Einstein, Langevin, and Mark. Later in the year, he returns to Dhaka, and is appointed Professor and Head of the Department of Physics, when D M Bose, the original appointee, declines the offer. In his Dhaka years, he reorganizes the Physics Department, developing special facilities for research work in X-ray spectroscopy, X-ray diffraction, magnetic properties of matter, optical spectroscopy including Raman spectra, wireless etc.” (পূর্বোক্ত)

১৯৩১ সালে পরিচয় পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর বাংলায় লেখা প্রবন্ধ “বিজ্ঞানের সংকট”। ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিজ্ঞানের ওপরে প্রথম পুস্তক বিশ্ব পরিচয় উৎসর্গ করলেন বোসকে। কি বিচিত্র এবং দুর্ভাগ্যজনক গতিতে জীবন এগোয়। বোসের সংখ্যায়ন এবং আরও অন্যান্য বিষয়ে নতুন পথে গবেষণা করে যখন ডিরাক, পাউলি সহ একের পর এক বিজ্ঞানী যখন নোবেল প্রাইজ পাচ্ছেন সেসময়ে বোস ভারতে Agricultural Research Sub-committee of the Indian Central Jute Committee-র মনোনীত সদস্য হচ্ছেন কিংবা Weights and Measures Committee, Government of Bengal-এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হচ্ছেন।

১৯৪৮ সালে, হয়তোবা হত-মনোরথ, সত্যেন্দ্রনাথ বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ-এর জন্ম দিলেন। ১৯৫১ সালে “As a Special Representative from India, Bose attends a meeting, sponsored by the UNESCO, at Paris, to consider the establishment of an international statistical centre. He visits Germany and meets Walther Bothe, Otto Haxel, J H D Jenson and H Meier Leibnitz in Heidelberg, and Otto Hahn, Werner Heisenberg and Houtermans in Gottingen.” (’S N Bose : The Man and His Work’, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩১৭)

রাশিয়া সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গেলেও তাঁর কখনো আমেরিকা যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এই নিয়ে এক মার্কিন লেখক তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি  পরিহাসছলে বলেন — “আপনাদের সেনেটর ম্যাকার্থি হয়ত আপত্তি করতেন। আমি আগেই সোভিয়েত রাশিয়া ঘুরে এসেছি যে।” (চট্টোপাধ্যায় ও চট্টোপাধায়, ‘সত্যেন্দ্রনাথ বোস’, ১৯৫৮, পৃঃ ৭৪-৭৫) রসিকতার ছলে বললেও বোসের মানসিকতা এই উক্তিতে ধরা পড়ে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার যে অপচয় ঘটছে সত্যেন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে অবহিত। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার ধারাকে প্রতিষ্ঠা করা তাঁর শেষ জীবনের আরব্ধ কর্মের একটি ছিল — “শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে সরাসরি ভাবের আদান-প্রদান দরকার। এই আদান-প্রদানের পথে ভাষার অন্তরায় না থাকাই বাঞ্ছনীয় … স্নাতকোত্তর পর্যায়েও শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা করে দেওয়া উচিত।” (পূর্বোক্ত, পৃঃ ৯৪)

শম্ভুনাথ দে (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫ – ১৫ এপ্রিল, ১৯৮৫)

একজন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতনামা ইনফর্মেশন সায়েন্টিস্ট ইউজিন গারফিল্ড তাঁর “Mapping Cholera Research and the Impact of Sambhu Nath De of Calcutta” গবেষণাপত্রে (‘Current Comments’, Number 14, April 1986) জানিয়েছিলেন — “De and colleagues also published highly cited pioneering studies on V. cholerae action on the intestinal membrane. The 1953 paper “An experimental study of the mechanism of action of Vibrio cholerae on the intestinal mucous membrane” is De’s most-cited paper, cited 340 times since its publication. De passed away just before we wrote to ask him for a Citation Classic@ commentary.” 

রবার্ট কখ যেখানে থেমেছিলেন (কলেরার জীবাণুর আবিষ্কার) সেখান থেকে শম্ভুনাথ দে-র যাত্রা শুরু — তার পরবর্তী ধাপে এগিয়েছেন তিনি। ১৯৫৩ সালের অক্টোবর সংখ্যায় Journal of Pathology and Bacteriology-তে প্রকাশিত তাঁর পেপার “An experimental study of the mechanism of action of V. cholerae on the intestinal mucous membrane”-এ দেখালেন যে জীবাণুর শরীর থেকে নিঃসৃত এক্সোটক্সিন কলেরা রোগীর ডায়ারিয়ার কারণ। তাঁর এই গবেষণাপত্রে তিনি বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কিভাবে খরগোশের ওপরে পরীক্ষা করেছিলেন — “Rabbits weighing 1200-1500 g. were not allowed food or water for twenty-four hours. With aseptic precautions and local procaine awsthesia, a midline incision about two inches long was then made just below the middle of the abdomen, which was opened by cutting through the muscles and peritoneum. A segment of small intestine taken midway between its upper and lower ends was isolated with two silk ligatures; blood vessels were carefully avoided.” তাঁর এই পদ্ধতি পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক গবেষণার জগতে একটি গৃহীত পদ্ধতি হয়েছে। তিনি সম্ভবত এক্ষেত্রে পথিকৃৎ। এই পেপারে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল — “These results suggest that Vibrio cholerae alters the permeability of intestinal capillaries to proteins.”

অনেক পরে ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এ (ফেব্রুয়ারি, ২০১১) রবার্ট হলের পেপার (“A De in the life of cholera”) দেখিয়েছে — “fundamental misconception in cholera pathogenesis was swept away when S.N. De used ligated loops of rabbit ileum to demonstrate lumenal fluid accumulation in the presence of Vibrio cholerae culture filtrates … The discovery was not so much ahead of its time as desperately awaited, but still De’s new model of pathogenesis had surprisingly little immediate impact. After a lag period of several years it was accepted, and a fresh generation of investigators boosted cholera from scientific obscurity to paradigm status.”

৩০ মে, ১৯৫৯-এ নেচার-এ তাঁর “Enterotoxicity of Bacteria-free Culture-filtrate of Vibrio cholerae” প্রকাশিত হয়। WHO-র বুলেটিনে (‘Bull World Health Organ’ 2010; 88: 237–240) ক্ল্যাসিক পেপার (“From endotoxin to exotoxin: De’s rich legacy to cholera”) হিসেবে তাঁর কাজ গৃহীত হয়। এই পেপারের পরিচিতি হিসেবে বলা হয় — “Between 1951 and 1959, Sambhu Nath De made crucial discoveries on the pathogenesis of cholera that changed the course of our understanding of the disease”। যদিও নোবেল প্রাইজ তাঁর কাছে অধরাই থাকে। 

রেজোনেন্স জার্নাল-এ প্রকাশিত অন্য একটি প্রবন্ধে (“Life and Work of Sambhu Nath De”, অক্টোবর, ২০১২) দু’জন গবেষক দেখিয়েছেন — “De began his studies on the remarkable pathological changes in the kidneys in cholera cases which showed renal shunt mechanism in operation — a feature of many other toxic conditions. He published a number of papers on this topic between 1950 and 1955.”

ক্যালকাটা মেডিক্যাল ক্লাবে Dr. B. C. Roy Memorial Oration-এ (“Cholera Exotoxin – a delayed discovery”, মুদ্রিতাকারে অপ্রকাশিত) তিনি বলেছিলেন — “Vibrio cholera has now been promoted to the rank of few exotoxin producing bacteria. However, diphtheria exotoxin was discovered within four years of the discovery of the bacillus, tetanus exotoxin within six years and botulism toxin at the same time as the organism. It has taken seventy five years for cholera exotoxin to be discovered in 1959 after the organism was discovered by Robert Koch in 1884…”

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জোশুয়া লেডারবার্গ শম্ভুনাথের নাম নোবেল কমিটিতে সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়। লেডারবার্গ শম্ভুনাথের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে দেখেছিলেন “iconoclastic creativity, experimental skill, and observational mastery” হিসেবে। 

১৯৮৩ সালে প্রকাশিত (২০১৮ সালে পুনঃপ্রকাশিত) W. E. van Heyningen এবং John R. Seal-এর লেখা সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘CHOLERA : The American Scientific Experience’, 1947-1980–তে শম্ভুনাথ সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে — “in 1959, S. N. De of Calcutta very clearly demonstrated the existence in cholera culture filtrates of an exotoxin that mimicked the symptom of cholera that was responsible for all the ill effects of the disease, namely, the outpouring of fluid into the gut. In other words, cholera, like diphtheria and tetanus, was an exotoxinosis. But the significance of De’s discovery was not immediately grasped, and his historical paper went unnoticed for some years, even, apparently, in the PSCRL (Patient Security Category Review List).” (পৃঃ ১৬৯)

৩১ মে, ১৯৭৭ সালে W. E. van Heyningen (তিনি তখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার উইল্যাম ডান স্কুল অফ প্যাথোলজির রিডার) শম্ভুনাথকে একটি চিঠি লেখেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন — (১) “I think your work of tremendous significance and most serious researchers on cholera throughout the world acknowledge this.”, (২) “It is a great honour for me to be in correspondence with you.”  

কিন্তু ততদিনে শম্ভুনাথের জীবনতিয়াষার ফল্গুধারা শুকিয়ে গেছে। তিনি এই চিঠির উত্তরে লিখলেন — “আমি আপনার নামের সাথে বিলক্ষণ পরিচিত এবং আপনার টক্সিনের ওপরে পেপারগুলো অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। কিন্তু আমি এখন একটি মুদির দোকান চালাচ্ছি (grocery shop) — অর্থাৎ আমার বাড়িতে একটি ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোস্টিক ল্যাবরেটরি চালাচ্ছি। অন্তত এটুকু আমার সান্ত্বনা যে ১৯৭৩ সালে চাকরি থেকে অবসর নেবার পরে আমার বিস্তৃত গবেষণার বিষয় থেকে ফলিত চেহারায় মানুষের জন্য কোন কাজে লাগতে পারছি।” হৃদয়াভ্যন্তরের সমস্ত যন্ত্রণা এ কথাগুলোর মাঝে ঝরে পড়ছে। ২০১৮ সালে এমএসএস মুর্তি তাঁকে নিয়ে বই লিখেছেন — ‘Sambhu Nath De : the Discovery of Cholera Toxin”। ১৯৯০ সালে কারেন্ট সায়ান্স পত্রিকার একটি পুরো সংখ্যা (৫ জুলাই, ১৯৯০) উৎসর্গ করা হল তাঁর স্মরণে এবং স্মৃতিকথায়, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দিকগুলোকে নিয়ে আলোচনা করে।

২০১১ সালে ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এর সম্পাদকয়ীতে (“Dr Sambhu Nath De: unsung hero”, Indian J Med Res 133, February 2011, pp 127) বলা হয় — “De’s discovery of cholera toxin introduced a new paradigm in research on cholera. A recent search done on November 19, 2009 in the PubMed database using the keyword “cholera toxin” yielded a phenomenal 11, 168 publications that the work of De spawned. De’s work on cholera toxin has impinged into diverse areas such as cellular physiology, biochemistry and immunology.”

১৯৫৯ সালে তাঁর নোবেল প্রাইজ পাওয়ার যোগ্য আবিষ্কারের বহুদিন পরে আন্তর্জাতিক জগতে তিনি অবশেষে স্বীকৃতি পান। ১৯৭৮ সালে নোবেল সিম্পোসিয়ামে বিশেষ লেকচার দেবার জন্য আমন্ত্রিত হন তিনি। পরম যন্ত্রণা নিয়ে সে লেকচারে তিনি বলেছিলেন — “১৯৬০-এর দশকের গোড়া থেকে আমি মৃত অবস্থায় ছিলাম। Nobel Symposium Committee আমাকে আবার কবর থেকে খুঁড়ে তুলেছে এবং আপনাদের সান্নিধ্যে এই দু’দিন কাটানোর ফলে আমি অনুভব করছি যে আমি আবার জীবনে ফিরে আসছি।” 

শেষ কথা

আমরা এতক্ষণের আলোচনায় যা দেখলাম তার নির্যাস হল মূলত ১৯০৫ পরবর্তী সময়ে (এবং মহেন্দ্রলালের মতো ব্যতিক্রমী মানুষের ক্ষেত্রে) বাঙালি জীবনে উপনিবেশিক রাষ্ট্রের মাঝে এবং একে অতিক্রম করে এক নতুন আত্মপরিচিতি গড়ে তোলার সন্ধান। এই সন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন প্রফুল্ল চন্দ্র থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বোস। মেডিসিন ও বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নতুন নতুন মাইলফলক ছুঁয়েছে বাঙালি মনীষা। আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ থেকেছে মেডিসিন ও বিজ্ঞানচর্চার আংশিক ক্ষেত্রে। এর বাইরে আরও অনেকের কথা আলোচনা করা যেত, যেমন বিশেষ করে মেঘনাদ সাহার কথা। স্থান সংকুলানের জন্য অনেক প্রতিভার আলোচনা অপূর্ণ থেকে গেল। কিন্তু বাংলাভাষায় জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এরকম আলোচনা একেবারেই নগণ্য। এ কারণে এই প্রবন্ধ পাঠকের চিন্তার ভুবনে নতুন তরঙ্গের সৃষ্টি করতে এ ভরসা রইল।

কিন্তু ২০২২-এর মধ্যভাগের ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ, জাতি, বিজ্ঞান এবং জিজীবিষার নতুন করে রাষ্ট্র-নির্ধারিত সংজ্ঞা তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে খুব সামান্য কথা বলা প্রয়োজন।

২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে বানু সুব্রমনিয়ামের লেখা মোটের ওপরে বৃহৎ পুস্তক ‘Holy Science : The Biopolitics of Hindu Nationalism’। ভূমিকা এবং উপসংহার সহ মোট ৮টি অধ্যায়ে বিধৃত এই বইটির আলাদা করে চ্যাপ্টারগুলোর উল্লেখ করা। পাঠকেরা অনুমান করতে পারবেন কিভাবে পুস্তকে প্রতিপাদ্যের বিস্তার ঘটেছে — 

(১) “INTRODUCTION. Avatars for Bionationalism : Tales from (An) Other Enlightenment”, 

(২) “Home and the World : The Modern Lives of the Vedic Sciences”, 

(৩) “Colonial Legacies, Postcolonial Biologies : The Queer Politics of (Un) Natural Sex”, 

(৪) “Return of the Native: Nation, Nature, and Postcolonial Environmentalism”, 

(৫) “Biocitizenship in Neoliberal Times : On the Making of the “Indian” Genome”, 

(৬) “Conceiving a Hindu Nation : (Re) Making the Indian Womb”, 

(৭) “CONCLUSION. Avatars for Dreamers : Narrative’s Seductive Embrace”, এবং 

(৮) “Epilogue. Finding India : The Afterlives of Colonialism”।

বইটির গুরুত্ব বিবেচনা করে নেচার-এর মতো জার্নালে এর একটি রিভিউ প্রকাশিত হয়েছিল (২৫ জুলাই, ২০১৯) “সায়ান্স অ্যান্ড রাইজিং ন্যাশনালিজম ইন ইন্ডিয়া” শিরোনামে। এ রিভিউয়ে একটি গুরুত্ববাহী সতর্কবার্তা ছিল — কিভাবে প্রকৃত বিজ্ঞানীদের দাবি মিশে যেতে পারে হিন্দুত্ববাদীদের দাবির সাথে — 

“Another of Subramaniam’s examples reveals that scientific and religious aims can merge, arguably more positively. The government-driven Sethusamudram Shipping Canal Project, which launched in 2005, aimed to dredge a passage through limestone shoals between islands off the coasts of India and Sri Lanka. Environmental scientists who protested against the destruction of this fragile ecosystem found themselves on the same side as Hindu leaders who see the site as sacred (the shoals feature in the epic poem the Ramayana, as a bridge built by the deity Rama and his army of monkeys). Ultimately, the Archaeological Survey of India, the supreme court and the parliament were drawn into the debate. Work on the project halted in 2009.”

আমার লেখা শেষ করছি আলোচ্য পুস্তকে লেখকের একটি পর্যবেক্ষণ রেখে — 

“It is disconcerting to track how easily Hindu nationalists appropriate South Asian history as Hindu history and how uncritically they embrace Western science as Vedic science in order to forge the idea of India as a Hindu nation and a global superpower. But I do not want to cede Hinduism to Hindu nationalism. Hinduism is a heterogeneous, diverse, polyvocal, and polytheistic religion that proves to be infinitely flexible and adaptable. There is no singular fundamental text, no singular religious authority, no singular code of conduct, no singular religious ritual, no singular religious practice, no singular god. Hinduism can also be seen as an assemblage of vibrant traditions, including ones that embrace nonviolent, pluralistic thinking and an idea of India as a multireligious, secular, democratic republic.” (পৃঃ ২১৬-২১৭)

বাকিটা বিচারের ভার পাঠকের হাতে তোলা রইল।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান