শশাঙ্ক মণ্ডল
উনিশ শতকে মধ্যবিত্ত বাঙালির চিন্তা-চেতনায় পাশ্চাত্যের অনুসরণে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ লক্ষ করা যায়। আমরা জানি কোনও ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসমষ্টি ভাষা, সাংস্কৃতিক চেতনা বা ধর্মীয় সূত্রে নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ ভাবলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়। উনিশ শতকের রেনেসাঁসদীপ্ত মধ্যবিত্ত বাঙালির নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধের মূল ভিত্তিভূমি ছিল ধর্ম। হিন্দুত্বই হয়ে উঠেছিল তাঁদের জাতীয়তাবোধের মূল অবলম্বন। এই ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং অবশ্যই চন্দ্রনাথ বসু (১৮৪৪-১৯১০)। আমার এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধের মূল বিষয় চন্দ্রনাথ বসুর ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের পর্যালোচনা।
একথা সকলেরই জানা কোনও মানুষের ব্যক্তি-জীবন, সমাজ-জীবন, কর্ম-জীবন ভাব-জীবন ইত্যাদি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না গড়ে উঠলে ব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই উপলক্ষ্যে তাই প্রথমেই চন্দ্রনাথ বসুর ব্যক্তি জীবনের নানা পরতগুলি দেখে নেওয়া যেতে পারে। তার থেকেই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে তাঁর জাতীয়তাবাদের পশ্চাদভূমি। হুগলি জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার অধীন হরিপাল থানার অন্তর্গত সেকালের এক সমৃদ্ধ কৈকালা গ্রামে চন্দ্রনাথ বসু (৩১ আগস্ট, ১৮৪৪) [১] জন্মগ্রহণ করেন। কৈকালা গ্রামের বসু পরিবার ওই অঞ্চলে ‘ধর্মনিষ্ঠ ক্রিয়াবান হিন্দু’[২] বলে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল। কাশীনাথ বসুর কনিষ্ঠপুত্র সীতানাথ বসু চন্দ্রনাথের পিতা। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। প্রখ্যাত ওরিয়েন্টাল সেমিনারি শাখা স্কুলে তাঁকে ভর্তি করা হয়। স্কুলে ইংরেজি সাহিত্যের আদর থাকলেও অঙ্ক ও বাংলার সমাদর তেমন ছিল না। বাল্যকালে পারিবারিক আবহাওয়াতেই হিন্দু ধর্মের লোকাচারকে শ্রদ্ধা করতে শিখলেও ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়াশোনার সময় প্রাচ্য ধর্ম ও আচার তাঁর ব্যক্তিত্ব গঠনে ভীষণভাবে ক্রিয়াশীল হয়েছিল। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদের প্রতি তাঁর মন ধাবিত হয়েছিল এই সময় থেকেই। ১৮৬০ সালে এন্ট্রান্স পাস করে ১০ টাকা মাসিক বেতন দিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সামর্থ্য না থাকায় ওরিয়েন্টাল সেমিনারির হরেকৃষ্ণ আঢ্যের সহযোগিতায় তিনি আট টাকার সরকারি বৃত্তি পেয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রবেশ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় চন্দ্রনাথ হিন্দুর চিরাচরিত বিশ্বাস ও মজ্জাগত ধর্মবোধ থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিলেন। এই সময়ে তাঁর ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত শুরু হয়। কেশবচন্দ্রের উদ্দীপনাময় বক্তৃতার মাধ্যমে রিড, হ্যামিল্টন, কান্ট, প্রমুখ প্রজ্ঞাবাদী দার্শনিকের মতবাদের সঙ্গে পরিচিত হন। তবে এই সমস্ত দার্শনিকদের মননশীলতা তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি। অগস্ত্ কোমতের প্রণালীর সঙ্গে আমাদের সমাজ প্রণালীর অনেক সাদৃশ্য দেখে আনন্দিত হলেও এই মতবাদে ঈশ্বরের স্থান না থাকায় তাঁর মানসলোক থাকে অতৃপ্ত। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ওই কলেজ থেকেই তিনি ইতিহাসে স্নাতকে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে বিশেষ অনুমতির সাহায্যে তিনি এমএ পরীক্ষায় (ইতিহাসে অনার্স) প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনিই প্রথম এই বিরল সম্মান লাভ করেন।[৩] পরের বছর (১৮৬৭) বিএল পরীক্ষায় তিনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হন। বিএল পাশের পর সকলের মতো তিনিও আদালতে ছুটেছিলেন, এমনই একটি মন্তব্য পাওয়া গেলেও এটি তথ্যনিষ্ঠ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ করে তিনি কিছুকাল ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে শিক্ষকতা করেছিলেন। অমৃতলাল বসুর স্মৃতিকথায় আমরা জানতে পারি স্কুলে ইতিহাস পড়াতেন চন্দ্রনাথ বসু। সুতরাং পাশ করার পর তিনি আদালতে ছোটেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লিটারেরি শিক্ষা প্রাক্টিক্যাল প্রবৃত্তির উন্মেষ ঘটাতে না পারায় দলে দলে আদালতে ছুটতে হয়েছিল একথা সত্য। সেখানে তিনি দেখলেন উকিলরা শিক্ষিত কিন্তু তাঁদের মধ্যে সদ্ভাব অপেক্ষা অসদ্ভাব বেশি, পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঈর্ষা ও প্রলোভন ভয়াবহ। তাছাড়া মোক্তারদের খোশামোদ করতেও তাঁর দ্বিধাবোধ হত। সুতরাং ওকালতিতে তাঁর সাফল্য আসেনি।এইসময় চন্দ্রনাথ বসু কলেজের অধ্যাপনার ইচ্ছে শিক্ষা বিভাগের অধ্যক্ষ উড্রোব সাহেবের কাছে প্রকাশ করার কিছু দিনের মধ্যে কৃষ্ণদাস পালের সহায়তায় ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি নিয়ে ঢাকায় যান। চন্দ্রনাথের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় বঙ্কিমচন্দ্রই তাঁকে পরোক্ষে নিষেধ করেছিলেন ঢাকায় যেতে। পুলিশের অপ্রতিহত প্রভাব যা বিচারকের রায়কে প্রভাবিত করে চলে, স্বাধীনচেতা চন্দ্রনাথকে প্রতিমুহূর্তে পীড়িত করতে থাকে। ফলে ৬ মাসের অধিক তাঁর এই চাকরিটিও স্থায়ী হয় না। ঢাকা থেকে প্রত্যাবর্তন করে শ্রীযুক্ত মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্নের অনুরোধে তিনি জয়পুর কলেজের অধ্যক্ষের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন (১৮৭৮-৭৯)।
সুজলা-শীতলা বাংলার মানুষ চন্দ্রনাথের কাছে জয়পুরের কেবল পাহাড় ও বালি সহ্য হল না। সুতরাং এখানেই জয়পুর কলেজের অধ্যাপনার সমাপ্তি। ইতিমধ্যে বেঙ্গল গভর্নমেন্ট লাইব্রেরির অধ্যক্ষের মৃত্যু হয়। শিক্ষা বিভাগের অধ্যক্ষ স্যার আলফ্রেড ক্রফটের কাছে ঐ শূন্যপদটির জন্য প্রার্থনা জানিয়ে দরখাস্ত করেন তিনি। তাঁর শিক্ষাগুরু সি এইচ টনি সাহেবের সহায়তায় বেঙ্গল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান পদে নিযুক্ত হন (৭ই অক্টোবর, ১৮৭৯)। এই কাজে তিনি সাত বছর কাল কাটিয়েছিলেন। কাজের চাপ কম থাকায় বাংলা সাহিত্যপাঠের বহু সময় পান। কিন্তু ইতিমধ্যে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের অনুবাদকের পদটি শূন্য হয়। এই কাজ মোটেই সহজ সাধ্য ছিল না বরং তা ছিল ভীতিজনক। এই কাজ করে অসুরসদৃশ রবিনসন সাহেব বহুমূত্র রোগে মারা গিয়েছেন এবং মনীষী রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় অনুবাদকের কর্মে রত থাকাকালীন পরলোকগমন করেছেন। শিক্ষা বিভাগের অধ্যক্ষ ক্রফট সাহেব চন্দ্রনাথকে ওই পদের জন্য মনোনীত করেন। স্বাস্থ্যহানির ভয়ে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য তিনি ওই কাজ গ্রহণ করেন। অল্পদিনের পরিশ্রমে চন্দ্রনাথ পীড়িত হয়ে ক্রফট সাহেবকে তাঁর অক্ষমতার কথা জানান। সাহেবের অনুরোধে আর একমাস তিনি ওই কাজে বহাল থাকেন। স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় তাঁর মানস পরিবর্তনের কথা। প্রথম জীবনে অপরের চাকরি করে অধীনতা স্বীকার করতে তাঁর অনিচ্ছা ছিল। পরে সব কাজই ঈশ্বরের — এই বোধ থেকে তিনি গ্লানিমুক্ত হন। তিনি সরকারি কাজকে গ্রহণ করলেন ধর্মচর্চার অঙ্গ হিসাবে। ফলে দিনরাত, রবিবার,পুজোর ছুটিতে অফিস বন্ধ করে বাড়িতে কাজ করতে থাকেন। অসুখ-বিসুখেও না খেয়ে কাজ তাঁর জপমালা হয়ে ওঠে।[৪] সুদীর্ঘ ১৭ বছর বাংলা সরকারের অনুবাদকের কর্মে তিনি নিযুক্ত ছিলেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি তিনি সরকারি কাজ থেকে অবসর নেন। এছাড়াও তিনি টেক্সট বুক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের অস্থায়ী সহ-সভাপতি (১৮৯৬) এবং সভাপতি (১৮৯৭) হিসেবে কাজ করেন।
ইংরেজি ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কারণেই বঙ্কিমচন্দ্রের মতো চন্দ্রনাথও ইংল্যান্ডের গৌরবময় বিপ্লব সম্পর্কে ইংরেজিতে লেখা শুরু করেন। এমনকি তাঁর একটি লেখা সম্পর্কে (১৮৬৪) দি ইংলিশম্যান পত্রিকায় এক পর্যালোচনায় সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল আদৌ এই লেখাটি কোনও ভারতীয়ের লেখনী প্রসূত কিনা! ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশের পূর্বে বাংলা ভাষায় তিনি একচ্ছত্র লেখেননি। তিনি এক জায়গায় বলেছেন — “আমি কখনও বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য ঘৃণা করি নাই। তখন চারিদিকে মাতৃভাষার নিন্দা শুনিতাম, স্কুলে উহা ভালো করিয়া শেখানো হইত না। কিন্তু আমি লুকাইয়া বাঙ্গালায় প্রবন্ধ লিখিতাম। লিখিয়া লুকাইয়া রাখিতাম — কাহাকেও দেখাইতাম না।[৫] তাঁর ‘শকুন্তলা তত্ত্ব’ এবং ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর সমালোচনা পড়ে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র মুগ্ধ হন। বঙ্কিমচন্দ্রের অনুরোধে তিনি বাংলায় লেখা শুরু করেন।
চন্দ্রনাথ বসু উনিশ শতকের রেনেসাঁসের আলোয় স্নাত হয়েও পাশ্চাত্যের অনুকরণের স্রোতে গা না ভাসিয়ে তিনি বিপরীত স্রোতের যাত্রী হলেন। নিজের ধর্ম এবং ঐতিহ্যের দিকে ফিরে তাকালেন শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে। এক তীব্র জাতীয়তাবোধ তাঁকে পরিচালিত করল। তাঁর সৃষ্টিবিশ্বে সেই জীবনদৃষ্টি অনুস্যূত হয়ে আছে। তাঁর মধ্যে এই জাতীয়তাবোধ জেগে ওঠার মূলে আছে এক অসামান্য ব্যক্তির প্রভাব। তিনি হলেন শশধর তর্কচূড়ামণি। উনিশ শতকের হিন্দু-পুনরুত্থানবাদী আন্দোলনের অন্যতম এই নেতার সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের সানকিডাঙ্গার বাসায় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ছাত্রজীবন থেকেই চন্দ্রনাথের মানস সংকট চলছিল। একসময় দার্শনিক কোমতের পজিটিভিজম তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কোমতের মতবাদে ঈশ্বরের স্থান নেই দেখে তাঁর অন্তরে অতৃপ্তি থেকে যায়। তারও পূর্বে ব্রাহ্মসমাজে তাঁর যাতায়াতের ফলে হিন্দু ধর্মের প্রতি বিশ্বাস কিছুটা শিথিল হয়েছিল। ইংরেজদের মুখে তিনি শুনেছেন রিলিজিয়ান কেবল ঈশ্বর নিয়েই আর কিছু নয়। মনের কোণে দ্বিধার জন্ম হয় — ঈশ্বর ছাড়া এই বস্তুজগতের কোনও কিছুর সঙ্গে মানুষের কোনও ধর্মমূলক সম্বন্ধ কি নেই? দীর্ঘদিনের সেই অতৃপ্তির অন্বেষণ এক মুহূর্তে চূড়ামণি মহাশয়ের সাক্ষাৎকারে দূরীভূত হল। ‘ধৃ’ ধাতু থেকে ধর্ম, অর্থাৎ যা ধারণ করে তাই ধর্ম। বিশ্বে যা কিছু আছে তা বিশ্বনাথ থেকে স্বতন্ত্র রাখলে বিশ্বনাথকে পাওয়া যায় না। কারণ বিশ্ব তাহলে আমাদেরকে রক্ষা না করে বিনাশই করে। এই তত্ত্বের আলো চন্দ্রনাথ বসুর জীবনকে এক অন্য খাতে প্রবাহিত করে। তাঁর কাছে ধর্ম এবং দেশ এক এবং অভিন্ন হিসেবে প্রতিভাত হয়।
এই সময় থেকেই চন্দ্রনাথ বসু হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনায় তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে ব্রতী হন। চন্দ্রনাথ সম্পর্কে সমালোচক খগেন্দ্রনাথ মিত্রের বক্তব্যে জানা যায়, ‘যারা শিক্ষা অর্জন করে হিন্দু ও হিন্দুত্বকে কেবল ঘৃণা করতে শিখেছে, তাদের মনে ঘৃণার পরিবর্তে অনুরাগ সঞ্চার করে দেওয়া এবং যারা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেছে তাদের মনে শ্রদ্ধার উদয় ঘটানো ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। এমনকি শিথিল সমাজ বন্ধনকে তিনি দৃঢ় করতেও উদ্যোগী হয়েছিলেন।’ সমাজ বন্ধন সুদৃঢ় করা তথা হিন্দুজাতির ঐক্য সাধনের প্রয়াসে চন্দ্রনাথ বসুর জাতীয়তাবাদের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তাঁর এই ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের স্বরূপ লক্ষ করি মূলত ‘শকুন্তলাতত্ত্ব’ (১৮৮১), ‘হিন্দুত্ব’ (১৮৯২) ও ‘সাবিত্রী তত্ত্ব’ (১৯০০) নামক গ্রন্থে। ‘শকুন্তলাতত্ত্ব’ ‘বঙ্গদর্শনে’ ধারাবাহিকভাবে সাতটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কালিদাসের নাট্যকাব্য ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ বিশ্লেষণ করে চন্দ্রনাথ কয়েকটি সামাজিক ও নৈতিক তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছেন। প্রথমত, নারী-পুরুষের পরিণয় শুধু সেই ব্যক্তি বিশেষের মঙ্গল-অমঙ্গলের কারণ নয়, তা সমস্ত সমাজের কল্যাণ-অকল্যাণের কারণও। দ্বিতীয়ত, শকুন্তলার ভাবাবেগ। প্রণয় আবিষ্ট হয়ে তিনি সামাজিক কর্তব্যে (অতিথি সেবা যার অন্যতম) অবহেলা করেছেন। এই আত্মভাব শিক্ষা দ্বারা সমাজমুখী করতে না পারলে দুর্বাসার অভিশাপ নিয়তির মতো নির্মম হয়ে ওঠে। তৃতীয়ত, হিন্দু সমাজে দুটি হৃদয়ের মিলনকে বিবাহ বলে না। সামাজিক সুখ-দুঃখের নিয়ন্ত্রণ শক্তি থাকে বিবাহ নামক বিষয়ে। সমাজকে সাক্ষী রেখে তার সম্মতির সঙ্গে সেবায় নিযুক্ত না হলে অমঙ্গল নিশ্চিত। চতুর্থত, দুষ্মন্ত পৌরুষের জীবন্ত মূর্তি হয়েও তিনি রিপুর শাসনে নীতিভ্রষ্ট। মানবজাতির এই প্রবৃত্তির দাসত্বের ঐতিহাসিক তত্ত্ব অভিজ্ঞানমশকুন্তলা। পঞ্চমত, দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার মিলন আসলেই পুরুষ ও প্রকৃতির জাগতিক মিলন। আধ্যাত্মিক জগতে পুরুষের দ্বারা প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়; কিন্তু জগৎ-সংসারে প্রকৃতি দ্বারা পুরুষ শাসিত হয়। এই প্রভেদের জন্যই শকুন্তলাকে দিয়ে দুষ্মন্তের পদস্খলন দেখানো হয়েছে এবং বার্তা দেওয়া হয়েছে জগতে পুরুষ মাত্রই দুষ্মন্তের মত বিপদগ্রস্ত। ষষ্ঠত, প্রবৃত্তি সংযমে শুধুমাত্র মানসিক শক্তির প্রয়োগ নয়, বরং সমাজকে সুসংহত ও নীতিপ্রবণ করে সমাজরূপ মহাশক্তির প্রয়োগ করতে হবে। অভিজ্ঞানশকুন্তলম এই মানসিক ও সামাজিক শক্তির মহাকাব্য। চন্দ্রনাথ বসুর এই তত্ত্ব অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য হল সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা এবং এক সামগ্রিক চেতনায় সংঘবদ্ধ হওয়া, যা জাতীয়তাবাদেরই নামান্তর।
চন্দ্রনাথ বসু সমালোচনামূলক সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন যদি ‘শকুন্তলাতত্ত্ব’ হয় তাহলে সমাজতত্ত্বমূলক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ‘হিন্দুত্ব’ নামক গ্রন্থ। ‘বাঙালির ইতিহাস না থাকলে বাঙালি মানুষ হবে না’, বঙ্কিমচন্দ্রের এমনই আক্ষেপের জবাব পাওয়া যায় ‘হিন্দুত্ব’ (১৮৯২) নামক গ্রন্থের ভূমিকায় : “ইউরোপ যাহাকে ইতিহাস বলে আমাদের তাহা নাই সত্য, কিন্তু প্রকৃত ইতিহাসের উপকরণ আমাদের পূর্ণমাত্রায় আছে।” জাতির প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধানে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও আলোচনায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতো বরেণ্য মানুষদের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছিলেন চন্দ্রনাথ বসু। তিনি মনে করতেন, ‘প্রত্নতত্ত্বে প্রাচীনদের প্রাণ পাওয়া যায় না, দুই একখানা ভাঙ্গা হাত পাওয়া যায় মাত্র।’ ইউরোপীয় প্রণালীতে পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কার নয় বরং জাতির মানসিক প্রকৃতির মধ্যেই জাতির ইতিহাস সন্ধানই প্রকৃত পথ। জাতির প্রকৃত ইতিহাস সন্ধানের লক্ষ্যেই চন্দ্রনাথ ‘হিন্দুত্ব’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি হিন্দু ধর্মশাস্ত্র, দেবতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজপ্রণালী ইত্যাদি বহু বিষয়েকে একত্রিত করে ‘হিন্দুত্ব’-কে আকার দিতে চেয়েছেন। এই সমস্ত কিছুর জন্য হিন্দু কারো কাছে বিন্দুমাত্র ঋণী নয় বরং হিন্দুর যা আছে সবই তার নিজের। প্রাচীন বৈভবের গর্ব করা মনুষ্যত্ব নয়, প্রাচীন বৈভব পুনর্লাভ করাই মনুষ্যত্ব — এই ধারণার পূর্ণ প্রতিফলন ‘হিন্দুত্ব’-তে লক্ষ করা যায়। ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থে চন্দ্রনাথ মূলত অদ্বৈতবেদান্ততত্ত্ব এবং কতগুলি মৌলিক বিষয়ের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। বিষয় গুলি হল — সোহহং, লয়, নিষ্কাম ধর্ম, তুষানল, কড়াক্রান্তি, পুত্র, আহার, ব্রহ্মচর্য, বিবাহ, তেত্রিশ কোটি দেবতা, মূর্তিপূজা, মৈত্রী। এই গ্রন্থের দু-একটি প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করে আমরা মূল বিষয়টি উপলব্ধি করার চেষ্টা করব।
এই গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ‘সোহহং’-সেই আমি, দার্শনিক তত্ত্ব সমৃদ্ধ রচনা। ব্রহ্মা ব্রহ্মাণ্ড, সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তা একই। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীগণ বিরুদ্ধ মত পোষণ করে থাকেন। তাঁরা মনে করেন সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তা, ব্রহ্ম ও ব্রহ্মাণ্ড পৃথক। নৈয়ায়িক পদ্ধতি অবলম্বন করে তিনি দ্বৈতবাদকে খণ্ডন করে অদ্বৈতবাদে সিদ্ধান্ত স্থাপন করেছেন। ‘হ্যামলেট’ শেক্সপিয়রের অন্যতম সৃষ্টি কিন্তু ‘হ্যামলেট’ ও শেক্সপিয়র পৃথক একথা বলা যায় না। কারণ শেক্সপিয়রের শেকসপিয়রত্ব ‘হ্যামলেটে’ প্রকাশিত হয়েছে, তা অন্য কারোর গুণ নয়। প্রাবন্ধিক এই সাহিত্যিক সিদ্ধান্ত থেকেই মূল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। মানবস্রষ্টা ও মানব একই — সোহহং বা সেই-ই আমি। প্রশ্ন জাগতে পারে যে ব্রহ্মাণ্ড যদি ব্রহ্মই হয় তাহলে কি ব্রহ্মাণ্ডের যত পদার্থ আছে সবই ব্রহ্ম? উত্তর না। কারণ, ব্রহ্ম কোনও পদার্থ নয়, ব্রহ্ম ইন্দ্রিয়াতীত, তাঁকে জ্ঞানের আলোকেই অনুভব করা যায়। জ্ঞানের আলোকে জগৎ দেখলে একাধিক পদার্থ যেমন দেখা যায় না তেমনি একাধিক ব্রহ্মও মিলবে না। সোহহং-বাদের বিরোধীরা মনে করেন মানুষ যদি নিজেকে ব্রহ্মা বলে মনে করে তাহলে তার অহংকার সীমাহীন হয়ে পড়বে। চন্দ্রনাথের বক্তব্য, ‘মানুষ নিজেকে ব্রহ্ম মনে করলে তার অহংকার বিনষ্ট হবে।’ কারণ জগতের সমস্ত পদার্থের সঙ্গে মানুষ যখন একাত্ম অনুভব করবে তখন তার অহংকার বা আত্মাভিমান প্রকাশের অবকাশ থাকবে না। ভারতীয় পুরাণে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ ও বিষ্ণুরদ্বেষী হিরণ্যকশিপুর দ্বন্দ্বে ইউরোপীয় ধর্মযুদ্ধের অনুরূপ যুদ্ধের উদাহরণ তিনি দেখতে পেয়েছেন। প্রহ্লাদ ইউরোপীয় মহাপুরুষদের মতো আত্মস্বাধীনতার নামে নয়, বিষ্ণুর নামে সব যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন। তাঁর কথায় ও ব্যবহারে অহংবোধের লেশমাত্র ছিল না। ভারতীয় চিন্তার শ্রেষ্ঠত্ব এইখানে যে অহংবিনাশী সোহহংবাদ তাঁদেরই আবিষ্কার এবং তাঁদের আশ্রয়। সূক্ষ্মদর্শী বিরাটমতি হিন্দুর সূক্ষ্মতম অতি-বিরাট সোহহং-এর প্রকৃত অর্থ — প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞান, প্রকৃত আত্মজ্ঞান, অপরিসীম মন, অপরিমিত সাহস — এই সমস্ত মহত্ত্বের এক অত্যুচ্চ ভাবসম্পদ। মানুষ সেই পরব্রহ্ম — এক হিন্দু ছাড়া আর কেউ তা ভাবার সাহস বা মানসিকতা দেখায়নি। ‘সোহহং’ প্রবন্ধটির অত্যুচ্চ দার্শনিক ভাবসম্পদ অন্যমাত্রা দান করলেও পাশাপাশি উগ্র শ্রেষ্ঠত্বের ধ্বজা গগনচুম্বী হতে দেখা যায়। জাতিসত্তার উগ্রত্ব কখনোই কাম্য নয়। রবীন্দ্রনাথ নেশনকে একটি মানস পদার্থ বলে প্রথমদিকে ধারণা করলেও পরবর্তীতে নেশনকে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে তিনি দেখেছেন। তিনি মনে করেন জনগণকে যা যান্ত্রিক প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ করে। সুতরাং সোহহং মতবাদটি যতক্ষণ নিরহংকার হতে শেখায় ততক্ষণ পর্যন্ত তার মূল্য অপরিসীম। কিন্তু হিন্দু ভিন্ন পৃথিবীর অন্য কোনও জাতি এই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে না অর্থাৎ হিন্দুর দৃষ্টিতে সকলেই নিকৃষ্ট। এই জাতীয়তাবোধে বিপদের ঝুঁকি আছে।
তাঁর পরবর্তী প্রবন্ধ ‘লয়’। গুরুবাদকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে অলৌকিক পৌরুষেয়তায় পরব্রহ্মে লয় প্রাপ্ত হওয়া মানব জীবনের চরম উদ্দেশ্য। সগুণ অবস্থা থেকে নির্গুণ অবস্থা প্রাপ্ত হওয়াই লয়তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য। পৃথিবী বা প্রকৃতির রূপ রস সৌন্দর্যের প্রতি মোহ মুক্ত হওয়া, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করা লয়তত্ত্বের বিষয়। ‘নিষ্কাম ধর্ম’ প্রবন্ধটি হিন্দু ধর্মের লয়বাদের অপরিহার্য ও ন্যায়ানুগত সিদ্ধান্ত। গীতার নিষ্কাম কর্ম তত্ত্বকে এই ভাবেই তিনি নিজস্ব লয়তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন। ভারতবাসী শ্রমবিমুখ ও আরামপ্রিয়, পাশ্চাত্যবাদীর এই অভিযোগের উত্তর চন্দ্রনাথ ‘তুষানল’ প্রবন্ধে দিয়েছেন। কষ্টসহিষ্ণুতায় একদিন আমাদের পূর্বপুরুষেরা জগতে বরণীয় ছিলেন, সুতরাং কষ্টসহিষ্ণুতার উত্তরাধিকার আমাদের আছে। এক স্থানে স্থির থেকে বিদ্যাচর্চার দারাও কষ্ট স্বীকার করা যায়, আবার ইতস্তত ছোটাছুটি করলেও কষ্ট স্বীকার করা হয়। প্রথম পথটি আমাদের; যুগের প্রয়োজনে আমাদের দ্বিতীয় প্রণালীর কষ্টভোগ ও শিক্ষা করতে হবে কিন্তু তার জন্য আমাদের নিজস্ব প্রণালী ত্যাগ করলে চলবে না। কারণ ভারতীয় প্রণালী শ্রেষ্ঠতর।
‘কড়াক্রান্তি’ তাঁর সমাজতত্ত্বমূলক প্রবন্ধ। হিন্দুশাস্ত্র মতে দেহের ব্যভিচারের মতো মনের ব্যভিচারও পাপ। তাই সতীধর্মের কড়াক্রান্তির সুদূরগামিতা হিন্দুধর্মের ও হিন্দুত্বের লক্ষণ বলে তিনি এই প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। তাঁর পরবর্তী প্রবন্ধ ‘পুত্র’। হিন্দুর পুত্র লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে কয়েকটি সুগভীর অর্থ তিনি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। পিতৃঋণ পরিশোধ, বংশের গৌরববৃদ্ধি, বংশরক্ষা, এবং নিত্যত্বপ্রিয়তা থেকে হিন্দুর পুত্র লাভের ইচ্ছা প্রবল হয়ে ওঠে। সুতরাং হিন্দুর পুত্রাকাঙ্ক্ষা জৈব প্রয়োজনজাত নয়, বরং তা সুগভীর উদ্দেশ্যমূলক বা ধর্মমূলক। ‘আহার’ প্রবন্ধটি ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থের প্রতিনিধি স্থানীয় মননশীল রচনা। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার শিক্ষিত সমাজ দুটি সামাজিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে আন্দোলিত হয়েছিল যার একটি আহার ও অপরটি কন্যাবিবাহ। হিন্দু কলেজের শিক্ষিত ইয়ংবেঙ্গল সম্প্রদায় আহার বিষয়ে হিন্দুর চিরাচরিত ধারণার মূল সদর্পে আঘাত হেনেছিল। এই আঘাতের উত্তর সন্ধানে চন্দ্রনাথ ‘আহার’ প্রবন্ধটি লেখেন। আহারের প্রথম উদ্দেশ্য দেহের পুষ্টি সাধন, দ্বিতীয় উদ্দেশ্য আত্মার শক্তিবর্ধন। কর্মভেদে আহারের পার্থক্য শাস্ত্রসম্মত। দেহকে নির্দিষ্ট প্রণালীর কর্মে পটু রাখার জন্য যদি মাংস ভক্ষণ প্রয়োজন হয় তবে তা গ্রহণ শাস্ত্রসম্মত। বরং এক্ষেত্রে নিরামিষ আহার শাস্ত্রবিরুদ্ধ। বিশুদ্ধ চিত্তে লোভের বশবর্তী না-হয়ে আহার করাই শ্রেয়। আহার সম্পর্কে চন্দ্রনাথের মধ্যপন্থা প্রশংসার দাবি রাখে। ‘ব্রহ্মচর্য’ প্রবন্ধটিতে লেখক দেখিয়েছেন যে, বাল্যে বা কৈশোরে নয়, সমগ্র জীবন ধরেই ব্রহ্মচর্য পালনের আবশ্যিকতা আছে। আমাদের দেশের প্রাচীন বিদ্যাশ্রমের চতুর্বিধ শিক্ষা দেওয়া হত। দেহের শিক্ষা, মনের শিক্ষা, হৃদয়ের শিক্ষা ও আত্মার শিক্ষা। ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থায় মনের শিক্ষা ভিন্ন অন্যপ্রকার শিক্ষা হওয়া কঠিন। প্রাচীন ভারতের শিক্ষার নিয়ম ছিল চারটি — কষ্টসহিষ্ণুতা, বিলাসবিদ্বেষ, চিত্তসংযম ও নিষ্ঠা। কঠোর নিয়মে জীবনব্যাপী ব্রহ্মচর্যের আদর্শ পালনকে হিন্দুত্বের লক্ষণ বলে প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন। ব্রহ্মচর্য শুধু কঠোরতার সাধনা নয়, কোমলতার ধ্যানও। সুতরাং ব্রহ্মচর্য পালন সর্বকালেই প্রয়োজনীয় বলে তিনি অভিমত পোষণ করেছেন। ‘বিবাহ’ তাঁর ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থের অপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। বিবাহ সমাজজীবনের একটি মৌলগ্রন্থি। সুতরাং সেই প্রথায় আঘাত লাগলে সমস্ত সমাজ বন্ধনই শিথিল হয়ে পড়ে।এই প্রসঙ্গে ভূদেব মুখোপাধ্যায়, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, চন্দ্রনাথ বসু রক্ষণশীলতার পক্ষপাতী। হিন্দুরবিবাহ শাস্ত্রীয় অনুশাসনের দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের পক্ষে চন্দ্রনাথ আস্থা জ্ঞাপন করেছেন। হিন্দুবিবাহের উদ্দেশ্য আধ্যাত্মিকতা, সাংসারিক বাস্তব নয়। যদিও এই প্রবন্ধটি সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন করেছেন চন্দ্রনাথ বসুকে। যদিও চন্দ্রনাথ বসু কোথাও শাস্ত্র, কোথাও বা বিজ্ঞান কোথাও লোকাচারের যুক্তিতে নিজ মতকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। হিন্দুদের বহু দেবদেবীর কল্পনার সমর্থনে তিনি লিখেছেন ‘তেত্রিশ কোটি দেবতা’। ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দুধর্ম তার বহু দেববাদের জন্য নিন্দিত হয়েছিল। খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম ধর্ম মতে ঈশ্বর এক ও অবিভাজ্য। হিন্দুরা এক ব্রহ্মকে জগৎব্যাপী প্রত্যক্ষ করেন, ব্রহ্মা জগৎময় । চন্দ্রনাথের মতে হিন্দুর অবলম্বিত পথই শ্রেষ্ঠ। রামমোহন রায়ের একেশ্বরবাদে বিশ্বাস চন্দ্রনাথ সমর্থন করেন না। পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্ম হিন্দু রাজনারায়ণ বসু হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন করেও বহুদেববাদের সমর্থন করতে পারেননি। ‘প্রতিমা বা মূর্তিপূজা’-য় চন্দ্রনাথ ঐশী শক্তিকে জড়মূর্তিতে মানসিক শক্তির দ্বারা উপলব্ধি করেন। প্রতিমার এইরূপ উপলব্ধিকে artistic idealism বলা যেতে পারে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রথমে খ্রিস্টধর্মীয়রা, পরে ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীরা হিন্দুর সাকার উপাসনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ পৌত্তলিকতার বিরোধী ছিলেন। রাজনারায়ণ বসু ব্রাহ্ম হিন্দু বলে অভিহিত হলেও হিন্দুর মূর্তিপূজা সমর্থন করেননি। দয়ানন্দ সরস্বতী যিনি বৈদিক ধর্মের পুনরুজ্জীবন চেয়েছিলেন তিনিও মূর্তিপূজার বিরোধিতা করেছিলেন। চন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধটিতে গতানুগতিক শাস্ত্র প্রমাণ উদ্ধার করেননি। বরং সাহিত্যতত্ত্ব শিল্পতত্ত্ব প্রভৃতি বহু বিষয়ের অবতারণা করে হিন্দুর মূর্তিপূজার দার্শনিকতা আবিষ্কারে অগ্রসর হয়েছেন। পরিশেষে তাঁর ‘মৈত্রী’ প্রবন্ধে বিশ্বব্যাপী সমদর্শিতা দেখানো হয়েছে। সর্বভূতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব জ্ঞানে সর্বভূতে প্রেম বিস্তৃত হোক। এই সমদর্শিতা বা সমত্ববাদ হিন্দুধর্ম ছাড়া অন্যত্র দুর্লভ।
চন্দ্রনাথ বসু তাঁর ‘হিন্দুত্ব’ প্রবন্ধে হিন্দুর সাধারণ বৈশিষ্ট্য গুলি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীর অন্যান্য জাতির তুলনায় হিন্দু কোনও অংশে নিকৃষ্ট নয় — এই অভিমত তিনি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। সাধারণভাবে ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির স্রষ্টা হিসেবে সাভারকারকেই কৃতিত্ব দেওয়া হয়। যদিও এই কৃতিত্বের সম্পূর্ণ দাবিদার বাঙালি চন্দ্রনাথ বসু। উত্তর ভারতের সুচতুর হিন্দি বলয়ের একদল মানুষ বাংলাকে ধর্মনিরপেক্ষতার আবাসভূমি ও মহারাষ্ট্রকে হিন্দুত্বের বিচরণভূমি হিসেবে চিত্রিত করে থাকেন। অথচ হিন্দুত্বের সৃষ্টি ও আবাসভূমি এই বাংলা, তা আমরা সহজেই বুঝে নিতে পারি। সাভারকার ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থটি লেখেন ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে, অথচ চন্দ্রনাথ বসু প্রায় ৩১ বছর পূর্বে (১৮৯২) তাঁর ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থটি রচনা করেন। যদিও সাভারকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় এবং ইংরেজি ভাষায় তাঁর গ্রন্থটি লিখিত হওয়ায় সর্বভারতীয় স্তরে বেশি করে প্রচারের আলোয় এসে পড়ে। চন্দ্রনাথের ‘হিন্দুত্ব’ গ্রন্থের প্রকাশ একটি বিষয় স্পষ্ট করে, যে হিন্দু জাতীয়তাবাদ এদেশে মাথা তুলেছে তার গর্ভগৃহ আসলে এই বাংলা। উনিশ শতকীয় বাংলায় বঙ্কিমচন্দ্র, ভূদেব এবং চন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ ছিলেন এর উদ্গাতা। অবশ্য সাভারকরের মতো চন্দ্রনাথ বসু হিন্দু সমাজের সবকিছু সুন্দর বলে মনে করেননি। এই ধর্মে যে কিছু কিছু আবর্জনাও যে আছে তা তিনি স্বীকার করতেন অকুণ্ঠে। হিন্দুজাতীয়তাবাদী হলেও তিনি হিন্দুধর্মকে সংস্কারের ঊর্ধ্বে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের মতো তিনি উদার দৃষ্টি নিয়ে ধর্মকে দেখেছেন। দেশের সকল মানুষকে উদার হিন্দুত্বের পতাকা তলে সমবেত করতে চেয়েছেন। এখানেই তাঁর জীবনদৃষ্টির স্বাতন্ত্র্য নিহিত।
তথ্যসূত্র :
১. চন্দ্রনাথের ‘সার্ভিস রেকর্ডস’-এ রয়েছে সেপ্টেম্বর ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দের; সম্ভবত এন্ট্রান্স সার্টিফিকেটে বয়স এক বছর কম দেখানো হয়েছিল।
২. হরিমোহন মুখোপাধ্যায়, ‘বঙ্গভাষার লেখক’ (১ম), কলিকাতা, ১৩১১ বঙ্গাব্দ, পৃ.৬৮১
৩. B. B. Majumdar, ‘History of political thought from Rammohan to Dayananda’, Vol-I, Calcutta, 1934, p.276
৪. চন্দ্রনাথ বসু, ‘পৃথিবীর সুখদুঃখ’, কলিকাতা, ১৩১৩ বঙ্গাব্দ, পৃ.৮৪-৮৫
৫. চন্দ্রনাথ বসু, ‘বন্ধুবৎসল বঙ্কিমচন্দ্র’, কাছের মানুষ বঙ্কিমচন্দ্র, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ, পৃ.১১৬