ফরাসি বিপ্লব ও জাতীয়তাবাদ

গোপাল চন্দ্র সিনহা 

এক 

ইতিহাস চলমান, গতিশীল — তা থেমে থাকে না। এই গতিময়তা জীবন্ত হয়ে ওঠে ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে। কালের নিয়মে এবং সমকালীন বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট ঘটনা ঘটে যায়। সেই ঘটনা সম্পর্কে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন চলতে থাকে সেই সময় এবং তারপরেও যুগ যুগ ধরে। এরই সূত্র ধরে সেই ঘটনার নানা দিক ক্রমে ক্রমে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এখনও পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ইতিহাসের বহু অজস্র ঘটনার মধ্যে এখানে আলোচনার বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের মহান ফরাসি বিপ্লবকে। ফরাসি বিপ্লবকে দু-চার কথায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অমলেশ ত্রিপাঠী যা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, “কোনও কোনও জাতির ইতিহাসে এমন এক অভ্যন্তরীণ বিপর্যয় উপস্থিত হয় যখন কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে তার ঐতিহ্য লব্ধ রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের মন্দীভূত স্রোতে প্রবল আলোড়ন জাগে, আবর্ত সৃষ্টি হয়, বন্যায় দুকুল ভেসে পুরাতন দিক দিশা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তারপর ঘোলাজল সরে গেলে জাগে নতুন রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বৃহত্তর ও মহৎ সৃষ্টির ভূমি। ক্বচিৎ কখনও সে আলোড়ন সেই জাতির প্রাক্তনকে প্লাবিত করেই ক্ষান্ত হয় না। সীমান্ত অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়ে দূর দূর দেশে। কোথাও দর্শনে, কোথাও কাব্যে কোথাও জাতীয়, কোথাও বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, তীব্র বা মৃদু ছন্দে তার আঘাত লাগে। হয়তো কখনোই তার প্রেরণা অবসিত হয়না। তেমনি এক বন্যা নেমেছিল ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালে, যাকে আমরা ফরাসি বিপ্লব নাম দিয়েছি।”[১] 

ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯)-এর সূত্র ধরে ফ্রান্স তথা ইউরোপে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ও প্রসারের বিষয়টি এই প্রবন্ধের মুখ্য বিষয়। বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার আগে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা ও এর উন্মেষ সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। ‘জাতীয়তাবাদ’ একটি ভাবগত আদর্শ। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জাতির যোগ অত্যন্ত নিবিড়। বস্তুত, ‘জাতীয়’ অর্থাৎ ইংরেজিতে ‘নেশন’ থেকেই ‘ন্যাশনালিজম’ বা ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটি এসেছে। উল্লেখ্য, কোনও একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী একই ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পন্ন জনসমষ্টিকে জাতি বলা হয়ে থাকে। অবশ্য ‘জাতীয়তাবাদের’ সংজ্ঞা সম্পর্কে পণ্ডিতরা একমত নন। সেই বিতর্কের মধ্যে না গিয়ে ভৌগোলিক নৈকট্য, ভাষাগত ও ধর্মীয় ঐক্য, ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের অভিন্নতা ও জাতিকুলগত ঐক্যকে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ও লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে থাকে। তবে ওই সমস্ত লক্ষণগুলির প্রত্যেকটি বা সবগুলোই জাতীয়তাবাদের জন্য অপরিহার্য নাও হতে পারে।[২] এমন মনে করা বোধ হয় অসঙ্গত হবেনা যে ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, অর্থনীতি প্রভৃতি যে কোনও এক বা একাধিক কারণে যখন কোনও দেশ বা জাতির মধ্যে গভীর একাত্মবোধ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই একাত্মবোধের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ বা জাতি বা সমাজের প্রত্যেকে সুখ-দুঃখ, ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের সমান অংশীদার বলে নিজেদের মনে করে এবং এ সবকিছুর সঙ্গে জাগ্রত হয় গভীর দেশপ্রেম তখন তা জাতীয়তাবাদ বলে স্বীকৃত হতে পারে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি রাজনৈতিক আদর্শ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। বস্তুত, রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে মূর্ত হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদ। এর সঙ্গে নিশ্চিতভাবে সমাজ তথা জাতির অনুপূরক সম্পর্ক বিরাজমান থাকে। এরকম বলাও বোধহয় অসংগত হবে না যে যখন কোনও দেশের সমগ্র জনসমাজ উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কোনও বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সামাজিক বৈষম্য বিনষ্ট করে ধীরে ধীরে একটি জাতিতে পরিণত হয় তখন তা জাতীয়তাবাদের রূপ ধারণ করে। বলা বাহুল্য, এটি হল জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা সংক্রান্ত একটি সাদামাটা ধারণা। এ বিষয়ে পণ্ডিত মহলে বিতর্ক চলতে পারে। জাতীয়তাবাদের উন্মেষ কখন ঘটেছিল সেই বিষয়ে পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে। সেই সুগভীর ও  চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্যে নাকি শুধু একটি কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যেতে পারে যে ‘জাতীয়তাবাদ’ ভাবধারার সম্প্রসারণ ঘটেছিল ইউরোপ মহাদেশে ঊনবিংশ শতকে এবং পশ্চাতে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে সংঘটিত মহান ফরাসি বিপ্লব। 

দুই 

ফ্রান্সের সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ‘পুরাতনতন্ত্রের’ (Ancient Regime) আমূল পরিবর্তন ঘটানোই ছিল ফরাসি বিপ্লব তথা বিপ্লবীদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এই ‘পুরাতনতন্ত্র’ তথা পুরানো ব্যবস্থা প্রাক্-বৈপ্লবিক ফ্রান্সের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। ফরাসি বিপ্লবের ফলে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক ভাবধারা সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে খুব সংক্ষেপে ওই পুরানো ব্যবস্থা ও প্রাক্-বৈপ্লবিক ফ্রান্সের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য, চতুর্দশ লুইয়ের সময় (১৬৪৩-১৭১৫ খ্রিস্টাব্দ) থেকে ‘Divine Right’ বা ঈশ্বরপ্রদত্ত অবিসংবাদী রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করে আসছিলেন বুরবোঁ রাজতন্ত্রের শাসকরা। এই ধারা বজায় ছিল পরবর্তী শাসকগণ, যথা — পঞ্চদশ লুই (১৭১৫-১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দ) ও ষোড়শ লুই-এর রাজত্বকালে (১৭৭৪-১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ)। এই সূত্র ধরে এঁরা ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে চরম স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। শাসকরা যে সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে দেশ শাসন করতেন তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ হল ফ্রান্সের প্রতিনিধি সভা স্টেটস জেনারেলের সাংবিধানিক মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে সুকৌশলে এই সভার অধিবেশন আহ্বান না করার বিষয়টি। বলাবাহুল্য, প্রতিনিধি সভার আহ্বান একশো পঁচাত্তর বছর ধরে বন্ধ থাকার ফলে জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবি দাওয়া পূর্ণ হওয়ার কোনও প্রশ্ন ছিল না। 

সমকালীন ফ্রান্সে আইনের শাসন বলে কিছু ছিল না। বিচারব্যবস্থা ছিল জটিল ও বিশৃঙ্খলা পূর্ণ। বিচার ব্যবস্থার উৎস রাজা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। উল্লেখ্য, পার্লামেন্ট (Parliament)-গুলি ছিল সর্বোচ্চ রাজকীয় বিচারালয়, যেগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিল প্যারিসের পার্লামেন্ট। সবচেয়ে বড়ো কথা হল পার্লামেন্টের সদস্যপদ রাজার কাছ থেকে কেনার রীতি প্রচলিত ছিল এবং পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিল অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধিশালী অভিজাত তথা সামন্তশ্রেণি। এর পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ। অষ্টাদশ শতকের শেষে অর্থাৎ বিপ্লবের প্রাক্কালে অভিজাতদের ক্ষমতা ও উচ্চাশা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর পাশাপাশি রাজকীয় ক্ষমতা ও রাজশক্তির নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল হচ্ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তৎকালীন শাসক ষোড়শ লুই-এর প্রশাসনিক অদক্ষতা ও বাস্তববুদ্ধির অভাব। প্রসঙ্গত বলা যায় ফ্রান্সে রাজকীয় আইন নথিভুক্ত করত পার্লামেন্ট, যার মধ্যে সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ ছিল অভিজাত শ্রেণির প্রভাবসম্পন্ন প্যারিসের পার্লামেন্ট। পার্লামেন্ট বিরোধিতা করলে রাজকীয় নির্দেশকে আইনে পরিণত করা ছিল প্রায় অসম্ভব। তাই দেখা যায় অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে রাজকীয় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল অভিজাত আধিপত্য সম্পন্ন প্যারিসের পার্লামেন্ট। এখানে যেটা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হল, মহান ফরাসি বিপ্লবের সূচনার নেপথ্য কারিগর ছিল কিন্তু এই পার্লামেন্ট তথা এর পরিচালক অভিজাত শ্রেণী এবং তা সংঘটিত হয়েছিল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত সম্পদশালী ও বুদ্ধিজীবী বুর্জোয়া শ্রেণির দ্বারা সংঘটিত মূল বিপ্লবের প্রায় এক বছর আগেই। এই ঘটনা ইতিহাসে ‘অভিজাত বিদ্রোহ’, আবার কোনও কোনও পণ্ডিত ‘অভিজাত বিপ্লব’ বলে চিহ্নিত করেছেন। 

সুযোগসুবিধা ভোগী শ্রেণি অভিজাতরা বিভিন্ন উচ্চপদের অধিকারী ছিল এবং প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ও রাজার কাছের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কেন ও কীভাবে পক্ষান্তরে বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল সে বিষয়ে কৌতূহল জাগা খুবই স্বাভাবিক। এর প্রকৃত কারণ নিহিত ছিল প্রাক্-বৈপ্লবিক ফ্রান্সের আর্থিক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে। আর্থিক ব্যবস্থায় প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল। বুরবোঁ শাসকদের আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন এবং অষ্টাদশ শতকের বিভিন্ন যুদ্ধের ফলে কোষাগারের অবস্থা প্রায় শূন্যের কোঠায়।[৩] একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যুদ্ধের জন্য ব্যয় হয়েছিল প্রায় কুড়ি কোটি স্টার্লিং পাউন্ড এবং রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যাবার পর্যায়ে পৌঁছেছিল।[৪] এই চরম সংকট থেকে অব্যাহতির জন্য লক্ষণীয় কোনও অর্থনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা নেওয়া হয়নি সরকারের তরফে। একদিকে যুদ্ধের বিপুল পরিমাণ ব্যয়ভার এবং অপরদিকে রাজপরিবারের অমিতব্যয়িতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণি যাজক (প্রথম সম্প্রদায়) ও বিশেষভাবে দ্বিতীয় সম্প্রদায় অভিজাত শ্রেণির করভার থেকে অব্যাহতির বিষয়টি। বস্তুত, ফ্রান্সের আর্থিক সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল করভারের অসম বণ্টন। অর্থনৈতিক দিক থেকে যাদের বেশিরভাগ মানুষই ছিল দুর্বল, সেই তৃতীয় সম্প্রদায়ের উপরই প্রায় সমস্ত করের বোঝা চাপানো হত। অপরদিকে যাদের কর প্রদানের ক্ষমতা ছিল, সেই সুবিধাভোগী শ্রেণি (যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল অভিজাত তথা সামন্ত শ্রেণি)-কে কর দিতে হত না। 

বলা বাহুল্য, সরকারের তীব্র আর্থিক সংকট থেকে  মুক্তির একমাত্র পথ ছিল সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণির ওপর শুল্ক আরোপ করা। এই কাজটা করতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। আর ঐ বিপত্তির মধ্যেই লুক্কায়িত ছিল মহান ফরাসি বিপ্লবের অঙ্কুর। উল্লেখ্য রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে গেলে অর্থনৈতিক সংস্কার ঘটানো অপরিহার্য, এই উপলব্ধি থেকে বুরবোঁ শাসক ষোড়শ লুই অর্থমন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত তাঁর দুই মন্ত্রী, যথা ক্যালোন (১৭৮৩-১৭৮৭) এবং ব্রিয়েন (Brienne) বা ব্রিয়াঁ (১৭৮৭-৮৮)-র মাধ্যমে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত কর ব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধনে ব্রতী হন। স্বাভাবিকভাবেই সুযোগসুবিধা ভোগী প্রথম দুটি শ্রেণি, যথা — যাজক ও অভিজাতরা, যারা সুদীর্ঘকাল ধরে কর প্রদানের ক্ষেত্রে অব্যাহতি পেয়ে আসছিল দেশের অন্যান্য জনসাধারণের ন্যায় তাদের উপরেও শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে শুধু একথা বলাই যথেষ্ট হবে যে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকেই রাজার তরফে প্রস্তাবিত কর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অভিজাতরা সোচ্চার হয়। নানা ধরনের আলোচনা বিফল হওয়ায় রাজতন্ত্রের সঙ্গে অভিজাতদের সম্পর্ক সংঘাতের রূপ নেয়। অভিজাতদের প্রাধান্য সম্পন্ন প্যারিসের পার্লামেন্টের মাধ্যমে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আইনি সংঘাতে নামে অভিজাত শ্রেণি। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে প্যারিসের পার্লামেন্টে একটি ঘোষণাপত্রে কিছু মৌলিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয় যে রাজতন্ত্র বংশানুক্রমিক। কিন্তু কর ধার্য করার অধিকার আছে একমাত্র স্টেটস্ জেনারেল (ফ্রান্সের প্রতিনিধি সভা)-এর। রাজা এককভাবে তা করতে পারেন না। আরও বলা হয় যে, কোনও ফরাসি নাগরিককে রাজার ইচ্ছানুযায়ী গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করা যাবে না।[৫] এর প্রত্যুত্তরে ষোড়শ লুই ৮ মে তারিখে জোরপূর্বক ৬টি অনুশাসন নথিভুক্ত করেন এবং পার্লামেন্টের হাত থেকে আইন নথিভুক্ত করার ক্ষমতা কেড়ে নেন। এমনকি দুজন সদস্যকে জোরপূর্বক গ্রেফতার করেন। এভাবে উভয় শক্তির মধ্যে সংঘাত চরম পর্যায়ে পৌঁছোয়। 

এই ঘটনার স্বল্পকাল পরে ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই, অভিজাত সম্প্রদায়ের উদ্যোগে প্রথম সম্প্রদায়ভুক্ত উচ্চযাজক, দ্বিতীয় সম্প্রদায় তথা অভিজাতরা এবং তৃতীয় এস্টেট বা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বুর্জোয়া শ্রেণি ভিজিলে (Vizille) নামক স্থানে একটি সভায় মিলিত হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজা ষোড়শ লুই নিয়মতান্ত্রিক পথে কর ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করুন। এই সভায় স্টেটস জেনারেলের আহ্বান ও পার্লামেন্টের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দাবি জানানো হয়। সমগ্র ফ্রান্সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধের ঝড় ওঠে। এই বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে ভিজিলের সভায় তিনটি সম্প্রদায় মিলিত হয়ে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বানের ব্যাপারে রাজার কাছে যে জোরালো প্রস্তাব রেখেছিল তা ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বৈরতন্ত্র ও অপশাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের স্বরূপ। বস্তুত, ভিজিলে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত এবং এতে জনসমর্থনের ব্যাপকতায় ষোড়শ লুই-এর মনোবল ভেঙে যায়। তিনি অভিজাত শ্রেণির কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসেই তিনি মন্ত্রী ব্রিয়াঁ-র মাধ্যমে স্টেটস জেনারেল আহ্বানের প্রতিশ্রুতি দেন। শুধু তাই নয়, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহ্বান করা হবে, এই মর্মেও তিনি ঘোষণা জারি করেন। এইভাবে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিজাতদের বিদ্রোহ সাফল্য লাভ করে। বলা বাহুল্য, দীর্ঘ ১৭৫ বছর পর স্টেটস জেনারেল তথা প্রতিনিধি সভার অধিবেশন আহ্বানের বিষয়টি ফ্রান্সে বৃহত্তর বিপ্লবের সুস্পষ্ট ক্ষেত্র প্রশস্ত করে দিয়েছিল। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিজাতদের সংগ্রাম পরিণত হয়েছিল জাতীয় সংগ্রামে। 

তিন

অভিজাত বিদ্রোহের সফলতার পর ধীরে ধীরে অথচ সুস্পষ্টভাবে জাতি (Nation), জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি ধারণাগুলি বলিষ্ঠ রূপ নিতে থাকে। সেই আলোচনায় প্রবেশের আগে কীভাবে বিপ্লবের নেতৃত্ব ‘প্যাট্রিসিয়ান’ বা অভিজাতদের হাত থেকে ‘প্লিবিয়ান’ বা তৃতীয় সম্প্রদায়ের প্রাগ্রসর শ্রেণি বুর্জোয়াদের হাতে আসে সে বিষয়ে খুব সংক্ষেপে আলোকপাত করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলা যায় ১৭৮৮-র অভিজাত বিদ্রোহ (বিপ্লব?) নিশ্চিতভাবে ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজতন্ত্রের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে দেয়। রাজকীয় স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। কিন্তু মনে রাখা দরকার অভিজাতরা নিজ শ্রেণির স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে সচেতনতার অভাবে নিজেদের অজান্তে রাজতন্ত্রের ওপর আঘাত হেনে পুরাতনতন্ত্রের ভিত্তিকেই দুর্বল করে ফেলেছিল। উল্লেখ্য, অভিজাত বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পুরানো সমাজের সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা। এই ব্যবস্থা যে পুরাতনতন্ত্রের একটি অন্যতম প্রধান অঙ্গ তা তারা তখন উপলব্ধি করেনি। আসলে এই বিদ্রোহের নেতৃস্হানীয় ব্যক্তিরা তখন অনুভব করেননি যে রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব ক্ষুণ্ণ হলে ‘পুরাতনতন্ত্র’ বিনষ্ট হবে। আর ‘পুরাতনতন্ত্র’ বিনষ্ট হলে অভিজাতদের বিশেষ সামন্ততান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধাগুলো আর থাকবে না। কারণ রাজতন্ত্রের অস্তিত্বের ওপরেই পুরাতনতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের অস্তিত্ব নির্ভর করত। তাই রাজকীয় স্বৈরতন্ত্রর ওপর চরম আঘাত হেনে অভিজাতরা পুরানো ব্যবস্হা তথা নিজেদের দীর্ঘদিনের বিশেষ সুযোগ-সুবিধায় আঘাত করেছিল। 

বলা বাহুল্য, বুর্জোয়ারা ঐ সুযোগকে ঠিকমত কাজে লাগিয়েছিল। তাদের অভিযোগ কেবল রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিল না। ‘পুরাতনতন্ত্র’, যার মধ্যে বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল অভিজাতদের বিভিন্ন সামন্ততান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা, সেগুলিকে বিনষ্ট করাও ছিল তাদের একটি প্রধান উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, রাজশক্তির বিরুদ্ধে অভিজাত বিদ্রোহের সময় শিক্ষিত, সচেতন এবং মন্তেস্কু, ভলতেয়ার, রূশো, প্রমুখ দার্শনিকদের লেখনী ও ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ বুর্জোয়ারা  ছিল অভিজাতদের সমর্থক। নেতৃত্বের কোনও প্রশ্ন ছিল না। তবে ঐ বিদ্রোহ থেকে ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য তারা রসদ সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। তখন কেবল বুরবোঁ শাসক কর্তৃক স্টেটস জেনারেলের আহ্বানের জন্য তাঁরা ছিলেন উন্মুখ। কিন্তু যখন স্টেট জেনারেল (প্রতিনিধি সভা) আহ্বানের বিষয়টি চূড়ান্ত রূপ নিল তারপর থেকেই অর্থাৎ অধিবেশন বসার আগে থেকেই নানা ঘটনাক্রমে অভিজাততন্ত্র তথা পুরানো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বুর্জোয়াদের ক্ষোভ প্রকাশ্য রূপ নিতে শুরু করে। মহান ফরাসি বিপ্লবের অশনি সংকেত ধ্বনি শোনা যেতে থাকে। বুর্জোয়াদের দ্বারা সংঘটিত এই বিপ্লবে বুর্জোয়া ছাড়াও তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত অপর দুই শ্রেণি, যথা কৃষক ও সাঁকুলেৎ (শহরের শ্রমজীবী, চাল-চুলোহীন ভবঘুরের মানুষ)-রাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।[৬] পরবর্তী আলোচনা থেকে দেখা যাবে যে অভিজাত শ্রেণির বিদ্রোহ একটি প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যুত্থান হিসেবে শুরু হলেও প্রকৃতপক্ষে ধীরে ধীরে এটি একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রূপ নেয়। তাই সংগত কারণেই বলা হয়ে থাকে, “প্যাট্রিসিয়ান (অভিজাত)-রা বিপ্লবের সূচনা করে, প্লিবিয়ান (জনতা বা সাধারণ নাগরিক)-দের দ্বারা সম্পূর্ণ হয়”।[৭] বস্তুত, নেতৃস্থানীয় বুর্জোয়ারা তথা বুর্জোয়া শ্রেণি জনতার হিংসাত্মক আন্দোলনকে নিজস্ব বিপ্লবের স্বার্থে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই প্রবল গণসমর্থনই বিপ্লবকে সাফল্যমণ্ডিত করে। 

দীর্ঘ ১৭৫ বছর যাজক ও অভিজাত এবং তৃতীয় এস্টেট (বুর্জোয়া, কৃষক ও সাঁকুল্যেৎ শ্রেণি)-এর  প্রতিনিধিদের কোনও পরামর্শ নেননি ফ্রান্সের শাসকেরা দেশপরিচালনার ক্ষেত্রে। স্বাভাবিকভাবে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে  ভার্সাই শহরে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসার সঙ্গে সঙ্গে এমনকি তার আগে থেকেই ফ্রান্সে বৈপ্লবিক পরিবেশ সৃষ্টি হয় — ‘ফরাসি জাতি’-র পরিচিতি নিয়ে বাস্তবসম্মত প্রশ্ন তোলা হয় দার্শনিকদের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃবৃন্দের দ্বারা। তৃতীয় এস্টেটের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় বুক বাঁধে। উল্লেখ্য, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসার মাধ্যমে যে বিপ্লবের সূচনা, নানা চড়াই-উতরাই-এর মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ডাইরেক্টরি শাসনের অবসানে। 

স্টেটস জেনারেলের অধিবেশনে ফ্রান্সের চিরাচরিত তিনটি এস্টেট বা সম্প্রদায় যথা- যাজক (প্রথম) অভিজাত (দ্বিতীয়) এবং তৃতীয় অর্থাৎ বুর্জোয়া, কৃষক ও সাঁকুলেৎ শ্রেণির অবস্থান ও সদস্য সংখ্যার বিষয়কে কেন্দ্র করে তৃতীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে অপর দুটি শ্রেণির সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত বলা যায়, অভিজাতদের প্রাধান্য সম্পন্ন ‘পার্লামেন্ট অফ প্যারিস’ ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে ২৪ সেপ্টেম্বরে গৃহীত একটি প্রস্তাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ১৭৫ বছর আগে ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রচলিত ব্যবস্থা অনুযায়ী স্টেটস জেনারেলের সদস্যরা তিনটি পৃথক শ্রেণি পৃথকভাবে নির্বাচিত হবে এবং নির্বাচিত সদস্যরা তিনটি পৃথক কক্ষে বসবে ও আলাদা ভাবে ভোট দেবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হল আগের মতোই সম্প্রদায় ভিত্তিক ভোট চালু থাকবে মাথাপিছু নয়। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের গোড়া থেকেই বুর্জোয়া শ্রেণি বুদ্ধিজীবী নেতারা প্রতিবাদে সোচ্চার হয় এবং অভিজাতদের সিদ্ধান্ত যে বিধিসম্মত নয় তা যুক্তি ও তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত প্রখ্যাত বিপ্লবী অ্যাবে সিয়েস-এর ‘What is Third State?’ পুস্তিকাটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এতে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন তৃতীয় সম্প্রদায়ই হল ‘সব’। কারণ দেশের প্রায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ লোক এর অন্তর্ভুক্ত। এরপর তিনি বলেন তৃতীয় সম্প্রদায়ের মধ্য দিয়েই ফরাসি জাতির ইচ্ছা প্রকাশিত। দ্বিতীয় সম্প্রদায় অর্থাৎ অভিজাত শ্রেণি সম্পর্কে তিনি বলেন দীর্ঘকাল বিশেষ অধিকার ভোগ করে ও মূল সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ‘জাতি’ হিসেবে তারা তাদের অধিকার হারিয়েছে। এই পুস্তিকায় তিনি আরও লেখেন যে যাজকরা বৃত্তিজীবী। তারা কোনও শ্রেণি হিসেবে গণ্য হতে পারে না। এক কথায় ফ্রান্সের আসল জাতি হল তৃতীয় সম্প্রদায় — এটাই ছিল পুস্তিকার মর্মবস্তু। আর এই আসল সত্যটিকে বাস্তবায়িত করতে গিয়েই তৃতীয় সম্প্রদায় তথা এর প্রতিনিধি বুর্জোয়ারা নানা অকল্পনীয় বৈপ্লবিক ঘটনার সূত্রপাত করেছিলেন, যার অন্যতম ফলশ্রুতি হল জাতীয়তাবাদের উন্মেষ। 

চার

এখন তৃতীয় সম্প্রদায় কর্তৃক বিপ্লবী পদক্ষেপগুলি ক্রমানুসারে সংক্ষেপে উল্লেখের সূত্র ধরে জাতীয়তাবাদের উন্মেষের বিষয়টির উপর আলোকপাত করা যাক। ১৭৮৯-এর ৫ই মে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসার সঙ্গে সঙ্গেই তৃতীয় সম্প্রদায় তৃতীয় কক্ষের পরিবর্তে একটি কক্ষে যৌথ অধিবেশন ও প্রত্যেক সদস্যর মাথাপিছু ভোটের দাবিতে সোচ্চার হয়। রাজা ও অভিজাত সম্প্রদায় এর তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃবর্গ যথা লাফায়েৎ, মিরাবো, এ্যাবে সিয়েস প্রমুখের নেতৃত্বে তৃতীয় সম্প্রদায় তাদের দাবিতে অটল থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৭ জুনে তৃতীয় সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যরা নিজেদের জাতীয় সভা (National Assembly) বলে ঘোষণা করল। বলা বাহুল্য, তাদের পশ্চাতে প্রবল জনসমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতেই তৃতীয় সম্প্রদায়ের এই ধরনের দুঃসাহসিক ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়। এর পরবর্তী ঘটনা হল ২০ জুন টেনিস কোর্টের শপথ। উল্লেখ্য, ঐ তারিখে সভাকক্ষের দ্বার রূদ্ধ দেখে তৃতীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা পার্শ্ববর্তী একটি টেনিস খেলার মাঠে সমবেত হয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন যে যতদিন না ফ্রান্সের জন্য একটি নতুন সংবিধান রচিত হচ্ছে ততদিন তাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবেন। বিপ্লবীদের পক্ষে এর ফল হয়েছিল ইতিবাচক। ২৭ জুন তৃতীয় সম্প্রদায়ের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন এবং তিনটি সম্প্রদায়ের একত্রে অধিবেশন ও মাথা পিছু ভোটের দাবিকে স্বীকৃতি দেন। এর কয়েকদিন পরে ৯ জুলাই তারিখে জাতীয় সভা (National Assembly) সংবিধান সভা (Constituent Assembly)-য় রূপান্তরিত হয়। এইভাবে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তৃতীয় সম্প্রদায় বিশেষ করে বুর্জোয়া শ্রেণি জয়লাভ করল। সাধারণভাবে এই পর্বের বিপ্লবকে ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ বলে চিহ্নিত করা হয়। 

বুর্জোয়া বিপ্লবের পরবর্তী ঘটনা হল জনতার বিপ্লব। বস্তুত, খাদ্য উৎপাদন হ্রাস, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, সরকারের বৈষম্যমূলক করনীতি নিম্নবর্গের মানুষকে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট করে তুলেছিল। বুর্জোয়া বিপ্লবের সাফল্য তাদের মনে আশার সঞ্চার করে। জনতা বিপ্লবী হয়ে ওঠে এবং নানান হিংসাত্মক ঘটনার সৃষ্টি হয়। গণবিদ্রোহ প্রকট রূপ নেয়। এই গণবিদ্রোহের তিনটি পর্যায় হল যথাক্রমে — বাস্তিল দুর্গের পতন, পৌরবিপ্লব এবং কৃষক বিপ্লব। উল্লেখ্য, ১৪  জুলাই মূলত অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে উত্তেজিত হিংসাশ্রয়ী জনতা বুরবোঁ শাসকদের স্বৈরাচার ও অত্যাচারের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ (কারাগার) আক্রমণ করে এবং এর পতন ঘটায়। বাস্তিল দুর্গের পতন প্যারিসের বিপ্লব শুধু স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদই নয়, এটি জনতার সশস্ত্র অভ্যুত্থানের একটি সফল নজির। এছাড়া বিপ্লবী লাফায়েতের নেতৃত্ব শান্তি ও সম্পত্তি রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত হল জাতীয় রক্ষীবাহিনী (National Guard)। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্যারিসের প্রশাসনিক ক্ষমতা চলে এল বুর্জোয়াদের হাতে। প্যারিসের বিদ্রোহের  দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ফ্রান্সের সমস্ত শহরে কমিউন বা পুরসভা গঠিত হয়। এইসব কমিউনগুলিতে প্যারিসের অনুকরণে গঠিত হয় জাতীয় রক্ষীবাহিনী। এই পৌরবিপ্লব শহরাঞ্চলে রাজকর্তৃত্ব শিথিল করে দেয়। ইতিমধ্যে জুলাই মাসের শেষ দিকে আর্থিক সংকটে জর্জরিত কৃষকরা ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলে অভ্যুত্থান ঘটায়। প্যারিসের অনুকরণে বিদ্রোহী কৃষকের অস্ত্রসজ্জিত হয়ে  সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সামন্তপ্রভুদের প্রাসাদ আক্রমণ করে ও তাদের অধিকারের নথিপত্র কেড়ে নেয় এবং পুড়িয়ে দেয়। বহু যাজক ও সামন্তপ্রভু দেশ ছেড়ে চলে যায়। গ্রামাঞ্চলে “পুরাতনতন্ত্র” প্রায় ভেঙে পড়ে। 

দেশের সর্বত্র বৈপ্লবিক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ৪ আগস্ট সর্বসম্মতভাবে জাতীয় সভায় সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি সংক্রান্ত কয়েকটি প্রস্তাব পাশ হয় এবং সেগুলি ১১ আগস্টের মধ্যে বিধিবদ্ধ করা হয়। ওই তারিখেই জাতীয় সভা সামগ্রিকভাবে সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি ঘোষণা করে। এরপর থেকে বিপ্লব এগিয়ে যেতে থাকে বাধা বন্ধনহীন গতিতে। জাতীয় সভা (পরবর্তীকালে সাংবিধানিক সভা)-র চালিকাশক্তি হিসেবে তৃতীয় সম্প্রদায় তথা বুর্জোয়া শ্রেণি পুরাতন তন্ত্রের অবলুপ্তি এবং সাংবিধানিক পথে রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাস করতে তৎপর হয়ে ওঠে। ২৬ আগস্ট জাতীয় সভা বিখ্যাত মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র জারি করে, যাতে বলা হয় আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং স্বাধীনতা হল মানুষের জন্মগত অধিকার। আরও বলা হয় জনগণই রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জনগণের কল্যাণের এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্র গঠিত। এই ঘোষণায় স্পষ্টতই বলা হয় যে বংশপরিচয় নয় — যোগ্যতাই হবে দেশের যেকোনও মানুষের রাজপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার একমাত্র মাপকাঠি। এইভাবে প্রচলিত ‘পুরাতনতন্ত্র’-কে একেবারে ধূলিস্যাৎ করে দেওয়া হয়। এরপর নতুন সংবিধানে শাসনক্ষেত্রে রাজার দৈব-অধিকারের দাবি নস্যাৎ করা হয়। এছাড়া রাজার পূর্বতন উপাধি ‘ফ্রান্সের রাজা’-র পরিবর্তে নতুন উপাধি হয় ‘ফরাসি জাতির রাজা’। অর্থাৎ রাজা এখন থেকে আইনের অনুশাসনে আবদ্ধ। রাষ্ট্র এখন এক ঐক্যবদ্ধ জাতির প্রতিভূ। সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকৃত উৎস হল এই জাতি। রাজার ইচ্ছামতো গ্রেফতার করার স্বৈরতন্ত্রী ক্ষমতা নিষিদ্ধ হল। সাংবিধানিক পথে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল। রাজকীয় সার্বভৌমত্ব আর থাকল না। ‘সক্রিয়’ নাগরিকদের ভোটের দ্বারা নির্বাচিত ৭৪৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা ছিল প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। ত্রিশ লক্ষ ‘নিষ্ক্রিয়’ নাগরিক ভোট প্রদানের অধিকার অর্থাৎ জাতির সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত থাকল। নিঃসন্দেহে এটি সাংবিধানিক সভার কার্যাবলির একটি নেতিবাচক দিক। সুতরাং একদিক থেকে বুর্জোয়া স্বার্থ সুরক্ষিত থাকল। এই বিপ্লবকে ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ আখ্যা দেওয়া অযৌক্তিক নয়। তথাপি সাংবিধানিক সভার আমলে (১৭৮৯-৯১) উপরে উল্লেখিত বৈপ্লবিক কাজগুলির মাধ্যমে পুরাতন সমাজ কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে নতুন সমাজের জন্ম সূচিত হয়েছিল। রাজকীয় স্বৈরাচার নির্মূল হয়েছিল। নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বুর্জোয়া স্বার্থের অনুকূল হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় ঐক্যের সহায়ক হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের অবাধ গতি জাতীয়বাজারের ঐক্য সাধন করেছিল। সবচেয়ে বড়ো কথা হল ফরাসি জাতীয় চেতনা এরপর থেকে সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করতে থাকে। 

ইতিমধ্যে রাজশক্তির তরফে গৃহীত বিপ্লব বিরোধী কিছু পদক্ষেপ এবং ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ বৈপ্লবিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ইউরোপের প্রধান প্রধান রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধ মনোভাব ফরাসি জাতির মনে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে। বিক্ষুব্ধ জনতা রাজতন্ত্রের অবসানের দাবিতে ১৭৯২-এর ১০ আগস্ট রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে এবং রাজার রক্ষীবাহিনীর বেশ কয়েকশো মানুষকে হত্যা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ইতিপূর্বে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে গঠিত আইনসভা রাজতন্ত্রের অবসান ঘোষণা করে। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল বুর্জোয়া শ্রেণির সম্পত্তিভিত্তিক ভোটাধিকারের নীতি পরিত্যক্ত হয় এবং সর্বজনীন ভোটাধিকারের নীতি চালু হয় ও ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে বিপ্লব আর বুর্জোয়াদের হাতের মুঠোয় রইল না, ‘গণবিপ্লবে’র রুপ ধারণ করল। ইতিহাসবিদ জর্জ লেফেভার এই ঘটনাকে — ‘দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন। 

এরপর থেকে বিপ্লবের গতি নতুন দিকে মোড় নেয়, যার মূল দিকগুলি খুব সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে। রাজতন্ত্রের অবসান ও গণভোটের ভিত্তিতে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সূত্র ধরে ফ্রান্সে দুটি প্রধান দল যথা জ্যাকোবিন ও জিরন্ডিনদের মধ্যে সংঘাতে শেষ পর্যন্ত জ্যাকোবিনদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও ভোটাভুটির পর শেষ পর্যন্ত জ্যাকোবিন প্রস্তাব কার্যকরী হয় এবং ১৭৯৩-এর ২১ জানুয়ারি রাজা ষোড়শ লুইয়ের গিলোটিনে শিরশ্ছেদ ঘটে। এর তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় দেশের অভ্যন্তরে ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে। অর্থনৈতিক সংকট মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ইংল্যান্ডের নেতৃত্বে অস্ট্রিয়া, স্পেন, পোর্তুগাল, সার্ডিনিয়া, নেপলস ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রথম রাষ্ট্রজোট গঠন করে ফ্রান্সে আক্রমণে উদ্যত হয়েছিল। ঘরে-বাইরের এই সংকট থেকে বিপ্লব, বিপ্লবের আদর্শগুলি যথা — স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী-কে রক্ষা করতে জ্যাকোবিন প্রজাতন্ত্রের মূল পরিচালক ম্যাক্সিমিলিয়ন রোবসপায়র ও তার অনুগামীরা দেশে এক জরুরিকালীন শাসন শুরু করেন, যা ‘সন্ত্রাসের শাসন’ ( Region of Terror) নামে সুপরিচিত। এটি চলেছিল ১৭৯৩-এর জুন থেকে ১৭৯৪-এর ২৭শে জুলাই রোবসপায়র ও তাঁর কয়েকজন অনুগামীর গিলোটিনে প্রাণদণ্ড পর্যন্ত। এই সময়কালে গণ-নিরাপত্তা সমিতির প্রধান রোবসপায়রের একক নেতৃত্বে মহা সন্ত্রাসের দরুন যেমন বেশ কিছু মানুষ গিলোটিনে প্রাণ হারিয়েছিলেন, [৯] তেমনি ঘরে-বাইরের সংকট কেটে গিয়েছিল এবং বিপ্লব তথা বিপ্লবের আদর্শগুলি সুরক্ষিত হয়েছিল। পুরাতনতন্ত্রের মূল শিকড়গুলি সন্ত্রাসের ফলে বিনষ্ট হয়েছিল। সন্ত্রাসের সময় আইন-শৃঙ্খলা বজায় ছিল। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল মানুষের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে। দেশত্যাগী অভিজাতদের ভূ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছিল। সামন্তপ্রভুদের নিপীড়ন থেকে কৃষকরা সার্বিক মুক্তি লাভ করেছিল। সবচেয়ে বড়ো কথা হল, বংশ কৌলীন্য নয়, যোগ্যতাকেই রাজপদে অধিষ্ঠিত হবার একমাত্র মাপকাঠি (‘career open to talent’) হিসাবে গণ্য করা হল। বলাবাহুল্য, এর সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মতো বংশ কৌলিন্যহীন ব্যক্তিও সামরিক প্রতিভার ভিত্তিতে ফ্রান্সের সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। 

ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসকে আর দীর্ঘায়িত না করে শুধু এ কথাই বলা যায় যে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই (বিপ্লবী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৯ই থার্মিডোর) রোবসপিয়ারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে এবং এরপর থেকে ১৭৯৫-র অক্টোবর পর্যন্ত জাতীয় কনভেনশনের শাসন বজায় থাকে। এই পর্বের শাসনকাল ‘থার্মিডোরিও প্রতিক্রিয়া’ নামে সুবিদিত এবং এই সময়ে উগ্র জ্যাকোবিনদের পরিবর্তে দক্ষিণপন্থী জিরোন্ডিন ও প্লেন বা নিরপেক্ষ নরমপন্থীরা ক্ষমতাসীন হয়ে প্রতিবিপ্লবী মনোভাবে বলীয়ান হয়ে ওঠে। শুরু হয় পাল্টা সন্ত্রাস, যা ‘শ্বেত সন্ত্রাস’ নামে পরিচিত। এইসময় রোবসপিয়েরের নেতৃত্বে পরিচালিত সন্ত্রাস (লাল সন্ত্রাস)-এর সমর্থকদের প্রতি প্রতিশোধস্পৃহা পরিলক্ষিত হয়। মৃত্যুদণ্ড ও কারাদণ্ডের মাধ্যমে জ্যাকোবিন ও বিপ্লবীদের নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। বিপ্লবী সরকার কর্তৃক গৃহীত নীতিগুলি ক্রমশ তুলে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যেমন সর্বোচ্চ মূল্যের আইন বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্যারিসের রাজনীতিতে জনতার ভূমিকাকে এরপর থেকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত করা হয়। উল্লেখ্য, ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ মে এক দল জঙ্গি জনতা কনভেনশনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শেষ চেষ্টা করে। কিন্তু সেনাবাহিনী নিরস্ত্র জনতাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে — গণবিপ্লবের অধ্যায় আপাতত সমাপ্ত হয়। বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্য পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কনভেনশন একটি নতুন সংবিধান রচনা করে, যার মাধ্যমে উচ্চবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণির পাঁচজন ডাইরেক্টরের হাতে ফ্রান্সের শাসনভার অর্পণ করা হয়। এটি ডাইরেক্টরি শাসন (১৭৯৫-৯৯) নামে পরিচিত। প্রসঙ্গত বলা যায় ডাইরেক্টরি আমলে ফ্রান্সের সকল বিদেশনীতি পরিচালনার সূত্র ধরে কেবল সামরিক প্রতিভার জোরে সমকালীন ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ফ্রান্সের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন (নভেম্বর, ১৭৯৯)। এইভাবে ১৭৮৯-এর মে মাসে যে বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটেছিল ১৭৯৯-এর ১০ নভেম্বর (বিপ্লবী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৮ ব্রুমেয়ার) তার আপাতত সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু বিপ্লবের ফলে যে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তার সমাপন ঘটেনি। 

পাঁচ

বিপ্লবের উত্থান, গতিধারা প্রভৃতি সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করা হল। এখন হিসাব-নিকাশের পালা। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ — দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর ধরে ফ্রান্সের ইতিহাস যে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হল তার নিট ফল কী — এ বিষয়ে কৌতূহল জাগা খুব স্বাভাবিক। ‘পুরাতনতন্ত্র’ কি আমুল পরিবর্তিত হল? বিপ্লবের সীমাবদ্ধতাগুলিই বা কি? নতুন কোনও ভাবধারা বা আদর্শবোধের কি জন্ম হল এই সূত্র ধরে — এসব নানা প্রশ্ন জাগা খুবই বাস্তব। 

পুরাতনতন্ত্রের একটি অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র এবং ‘Divine Right Theory’ বা দেবানুগ্রহে শাসন পরিচালনার তত্ত্ব, যা এই বিপ্লবের আঘাতে ধ্বংস হয়েছিল। দুর্নীতিগ্রস্ত চার্চ ব্যবস্থার স্বতন্ত্র স্বাধীন অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছিল। সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটল। প্রাক্-বৈপ্লবিক যুগের ফ্রান্সের সমাজে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত অধিকারের ভিত্তিতে যে সুযোগ সুবিধাভোগী ও সুযোগ-সুবিধাহীন (তৃতীয় সম্প্রদায়) শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। দার্শনিক রুশোর ‘আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান’ — এই তত্ত্বের পূর্ণ  প্রয়োগ ঘটানো হল ১৭৮৯-এর ৪ আগস্ট রাত্রে। এরপর থেকে ফ্রান্সে তিনটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত সমাজব্যবস্থা বিলুপ্ত হল। প্রথম (যাজক) ও দ্বিতীয় (অভিজাত /সামন্ত) সম্প্রদায়ের ‘বিশেষ অধিকার’-এর বিলুপ্তি ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল সামাজিক সাম্য। এর ফলে প্রাক্-বৈপ্লবিক আমলে তৃতীয় সম্প্রদায় অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অত্যাচার ও শোষণ চলত তা বন্ধ হল। নানা ধরনের শুল্কের বোঝা আর কেবল ওই সম্প্রদায়কেই বহন করতে হল না। তার দায়বদ্ধতা সকল শ্রেণির উপরে চাপানো হল। শ্রেণিবৈষম্য দূর হওয়ায় জাতি হিসেবে ‘ফরাসি জাতি’র মর্যাদা সুদৃঢ় হল। ফরাসি বিপ্লবের সূত্র ধরেই রাজতন্ত্রের পরিবর্তে প্রজাতান্ত্রিক সরকারের ধারণা সাময়িকভাবে হলেও প্রতিষ্ঠিত হল। নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্পত্তির ভোটাধিকারের নীতি প্রারম্ভিক পর্বে চালু হলেও সর্বজনীন ভোটাধিকারের নীতি চালু হয়েছিল প্রথম প্রজাতান্ত্রিক সরকারের আমলে। বংশকৌলীন্য নয়, যোগ্যতার মাপকাঠিকে কোনও পদে অধিষ্ঠিত হবার প্রধান সোপান বলে গণ্য করা হল, যার উপর ভিত্তি করে ১৭৯৯-এর নভেম্বরে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সিংহাসনে আসীন হতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয়, কোড নেপোলিয়ন (১৮০৪-১৮০৭) বা নেপোলিয়নের আইনবিধি প্রণয়নের মাধ্যমে বিপ্লবের অন্যতম আদর্শ ‘সাম্য’-কে ফ্রান্স ও তার বাইরে জার্মানি, ইটালি প্রভৃতি দেশে সম্প্রসারিত করা হয়েছিল। গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে নেপোলিয়ান (১৭৯৯-১৮১৪) একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটালেও দেশে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেনি। পরে ১৮৩০-এর জুলাই মাসে এবং ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বিপ্লবের তীর্থভূমি ফ্রান্সে আবার বৈপ্লবিক জাগরণ ঘটে। প্রথমটির মাধ্যমে বুর্জোয়া রাজতন্ত্রের চিরতরে অবসান ঘটে এবং দ্বিতীয়টির মাধ্যমে ফ্রান্সের পুনরায় (দ্বিতীয়) প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, যার আয়ুষ্কাল ছিল চার বছর।                                                             

ছয়

ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান অবদান হল জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার উদ্ভব ও তার ক্রমসম্প্রসারণ। এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে শ্রেণিবৈষম্য দূরীভূত হওয়ায় জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিপ্লবের সূত্র ধরে। প্রসঙ্গত বলা যায়, বিপ্লব চলাকালীন অভিজাত ষড়যন্ত্র ও ইউরোপীয় রাষ্ট্র জোটের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের সংগ্রামের সময় থেকেই ‘জাতীয় ঐক্যের’ চেতনা সুদৃঢ় হয়। এছাড়া প্রাক্-বৈপ্লবিক ফ্রান্সের বিভিন্ন প্রাদেশিক চিহ্ন ধ্বংস করে সমগ্র ফ্রান্সে একই ধরনের আইন কানুন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্ভব ঘটে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রের। উল্লেখ্য, সংবিধান সভার আমলে (১৭৮৯-৯১) বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন, বিপ্লবী সরকার (১৭৯২-৯৫) কর্তৃক আবার অতিকেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন এবং ডাইরেক্টরির আমলে (১৭৯৫-৯৯)-র প্রশাসনিক সংস্কার — সবকিছুর ফলস্বরূপ একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল জ্যাকোবিন ক্লাব এবং সমগ্র ফ্রান্সে ওই ক্লাবের সম্প্রসারণের জন্য তৎপরতা। এর ফলে এক ও অখণ্ড জাতীয়চেতনার জাগরণ সম্ভব হয়। [১০] উল্লেখ্য, ফরাসি বিপ্লব ও নবজাগ্রত ফরাসি জাতি যখন প্রায় চতুর্দিক থেকে আক্রান্ত তখন জ্যাকোবিনদের আদর্শ ফরাসিদের জাতীয়তাবোধ ও সামনের আকাঙ্ক্ষাকে নতুন করে উদ্দীপ্ত করে। এখানে আরও উল্লেখ করা যায় যে, মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল সামন্ততন্ত্র। এই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সেই প্রথম প্রকৃতপক্ষে সামন্তপ্রথার সমাধি রচিত হয়। যেসব সামন্তপ্রভু ও বিশপ সামন্ততান্ত্রিক সুযোগ সুবিধা উপভোগ করত তা থেকে তারা বঞ্চিত হওয়ায় পক্ষান্তরে জাতীয়তাবোধের আদর্শের জয় হয়। ফরাসি বিপ্লব সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে এক শ্রেণির পণ্ডিতের ধারণা। যদিও এই মত সর্বজনগ্রাহ্য নয়। 

রাজা বা রাজতন্ত্র নয়, ‘জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’ — দার্শনিক রুশোর এই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ঘটে ফরাসি বিপ্লবের সূত্র ধরে, ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট জাতীয় পরিষদ কর্তৃক প্রচারিত ব্যক্তি ও নাগরিকের অধিকারসমূহের ঘোষণার মাধ্যমে। সামন্ততন্ত্র ও স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফরাসি জাতির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফলস্বরূপ জাগ্রত হয় জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম। পূর্বতন গির্জার নিয়ন্ত্রণাধীন শিক্ষাব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে এনে শিক্ষার আধুনিকীকরণ ঘটানো, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল সুনাগরিক গড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় ঐক্যবোধকে সুদৃঢ় করে তোলা। সন্ত্রাসের আমলে (১৭৯৩-৯৪) ১৭৯৩-এর ১৯ নভেম্বরে প্রণীত আইনে যে প্রাথমিক পাঠক্রমের ব্যবস্থা করা হয়েছিল তাতে মানবিক অধিকারের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশের জন্য আত্মত্যাগের বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়, যা দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের জ্বলন্ত উদাহরণ। শিক্ষাবিস্তারের প্রয়োজনে প্রাক্-বৈপ্লবিক আমলের ফ্রান্সে প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষাগুলির পরিবর্তে ফরাসি ভাষাকে ‘জাতীয় ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিভিন্ন ক্লাব ও সোসাইটিতে ফরাসি ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার রীতি চালু হয়, যা জাতীয় ঐক্য ও দেশপ্রেমের লক্ষণ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।

সমগ্র ফ্রান্সে একই ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিপ্লবের ফলে প্রতিষ্ঠিত নতুন অর্থনৈতিক সম্পর্ক ‘জাতীয় ঐক্যের’ চেতনাকে শক্তিশালী করে তোলে। দেশের অভ্যন্তরে যে শুল্ক ব্যবস্থার প্রচলন ছিল তার বিলোপ ঘটিয়ে একটি জাতীয় বাজারের প্রতিষ্ঠা ঘটে। এর ফলে ফ্রান্সের অভ্যন্তরে পণ্য চলাচল অবাধ হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ঐক্যের চেতনা জাগ্রত হয়। ১৭৯০-এর ১৯ মে অর্থনৈতিক ঐক্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে দেশের সর্বত্র একই রকম ওজন ও পরিমাপ প্রণালীর ব্যাপারে একটি কমিশন গঠিত হয়। এই ব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল দশমিক পদ্ধতি। এই অর্থনৈতিক ঐক্যবোধও জাতীয় চেতনার উন্মেষে সাহায্য করেছিল। 

জাতীয়তাবাদের উদ্ভবে বিপ্লবের সময় যুদ্ধের প্রয়োজনে শ্রেষ্ঠ জাতি ও সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য। প্রসঙ্গত বলা যায় চরিত্রগতভাবে এই নতুন সেনাবাহিনী পূর্বতন পূর্ব-রাজতন্ত্রের সেনাবাহিনীর থেকে ছিল অনেকাংশে স্বতন্ত্র। উল্লেখ্য, রাজকীয় সেনাবাহিনীর ভাঙনের সুযোগ নিয়ে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুন সংবিধান সভা জাতীয় রক্ষীবাহিনী (National Guard) থেকে এক লক্ষ স্বেচ্ছাব্রতী সৈনিক নিয়ে একটি সেনাদল সংগঠিত করে। সমকালীন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ও ফ্রান্সের বিপক্ষে গঠিত প্রথম রাষ্ট্রজোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আশঙ্কায় এই বাহিনী গঠন করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। বলা বাহুল্য, এই নবগঠিত সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ জাতীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। সুতরাং, বিপ্লবের অন্যতম স্থায়ী অবদান হিসাবে জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের বিষয়টি অনস্বীকার্য।

ফরাসি বিপ্লবের যুগে পালিত জাতীয় উৎসব সমূহ পালনের মাধ্যমেও জাতীয়তাবোধের অখণ্ড চেতনার প্রকাশ ঘটে বলে কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করে থাকেন। [১১] উৎসবগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল স্বাধীনতার উৎসব (১৭৯২-এর ১৫ এপ্রিল), প্রজাতন্ত্রের ঐক্য ও অখণ্ডতার উৎসব (১৭৯৩-এর ১০ আগস্ট), বিপ্লবী ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় বর্ষের উৎসব। এছাড়াও ডাইরেক্টরির শাসনকালে (১৭৯৫-৯৯) ক্যাম্পোফর্মিও চুক্তি (১৭৯৭)-র স্মরণে এবং জ্যাঁ জ্যাক রুশোর সম্মানে আয়োজিত উৎসবের সমারোহের কথাও উল্লেখের দাবি রাখে। উৎসব পালনের মূল লক্ষ্য ছিল বিপ্লবের বিখ্যাত ঘটনাসমূহ এবং খ্যাতিমান মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সদ্বৃত্তির সমূহকে সমগ্র শ্রেণির মানুষের কাছে বিশেষভাবে তুলে ধরা। উল্লেখ্য, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং দেশ, সংবিধান ও আইনের প্রতি নাগরিকদের অনুরাগ বৃদ্ধি করা ছিল উৎসবগুলির অন্যতম লক্ষ্য। সর্বোপরি, জাতীয় উৎসবগুলিতে জনতার উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে ফরাসি জাতির মধ্যে এক অখণ্ড জাতীয় ঐক্যের চেতনা জাগ্রত হত। এ কথা অবশ্য ঠিক যে বিপ্লব থেমে যাবার পর জনতার ভূমিকা গৌণ হয়ে যায় এবং উৎসব প্রায় নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। 

সাত

১৭৮৯-খ্রিস্টাব্দের মহান ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর প্রভাব পড়েছিল। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, পরবর্তীকালে ১৮৩০-এর জুলাই মাসে এবং ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ফ্রান্সে যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল এবং সেগুলির প্রভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যথা জার্মানি, ইটালি, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, সুইজারল্যান্ড-এ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যতটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিল, ১৭৮৯-এর বিপ্লবের পরে পরেই ততটা প্রভাব পড়েনি। পরবর্তীকালে বিশেষ করে নেপোলিয়ানের অভ্যুত্থান (১৭৯৯)-এর পর কিছুটা তার অজ্ঞাতসারেই বিপ্লবের আদর্শগুলি বিশেষ করে ‘সাম্য ও মৈত্রী’র আদর্শ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে বিপ্লব চলাকালীন অর্থাৎ ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৫ পর্যন্ত সময়কালে ফ্রান্সের বাইরে ইউরোপের অন্যত্র এই বিপ্লব সম্পর্কে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? উল্লেখ্য প্রারম্ভিক পর্বে ইউরোপের শাসকশ্রেণি এই বিপ্লবের বিরোধিতা করেছিল। তখন বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিল ফ্রান্সের বিপ্লব তথা বিপ্লবের আদর্শগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা — ইউরোপে বিপ্লবকে প্রসারিত করার চিন্তা তখন বিপ্লবীদের ছিল না। অপরদিকে বিপ্লবের বিরোধিতায় মেতে উঠেছিলেন অনেক প্রখ্যাত পণ্ডিত। ইংল্যান্ডের দার্শনিক এডমন্ড বার্ক ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে Reflection of the French Revolution নামে ফরাসি বিপ্লবের ওপর একটি রক্ষণশীল গ্রন্থ লেখেন, যাতে ওই বিপ্লবকে ‘ঐতিহ্য বিরোধী’, ‘সর্বনাশের ইঙ্গিত’ প্রভৃতি বিরূপ বিশেষণে অভিহিত করা হয়। কিন্তু ১৭৮৯-এর পর থেকে যতই দিন অতিবাহিত হয়েছে ততই বিপ্লবীরা পুরাতনতন্ত্রের নানা চমকপ্রদ ও আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। এর ফলে ইউরোপে সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ও অত্যাচারের অবসানের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, স্বৈরতন্ত্রের ভিত কেঁপে উঠেছিল এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ও গণতান্ত্রিক চিন্তার সূত্রপাত ইউরোপকে ভীত ও আশঙ্কিত করেছিল। এক কথায় ফরাসি বিপ্লব থেকে ইউরোপ লাভ করেছিল মানুষের অধিকার ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের শিক্ষা এবং প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ-এর আদর্শ। 

বস্তুত, ফরাসি বিপ্লব ধীরে ধীরে ইউরোপের ইতিহাসের অঙ্গীভূত হয়ে যায় এবং জাতীয়তাবাদের ধারণা পরবর্তীকালে ইউরোপের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও অনুভূত হয়। এমনকি বিপ্লবের সমকালীন যুগেই ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইটালি, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশ ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা কম বেশি প্রভাবিত হয়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা এই বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, ব্লেক, টমপেন, জার্মানির ফিকটে, হেগেল, কান্ট, রাশিয়ার কারমুজিন প্রমুখর উল্লেখ করা যেতে পারে। বিপ্লবের সময় ইংল্যান্ড ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেও পরে বিপ্লবের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ম্যানচেস্টার, লন্ডন, নটিংহাম প্রভৃতি শহরে সংস্কারকামী কিছু সমিতি স্থাপিত হয়। সেখানের শ্রমজীবী সম্প্রদায় ফ্রান্সের বৈপ্লবিক আদর্শগুলির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়। আয়ারল্যান্ডের দুই প্রখ্যাত দেশপ্রেমিক, যথা লর্ড এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড ও উলফ টোন জাতীয় কনভেনশনের সঙ্গে আলোচনার জন্য ফ্রান্সে এসেছিলেন এবং আয়ারল্যান্ডে জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন ফরাসি বিপ্লবের আগে থেকেই চলছিল তা আরও উদ্দীপ্ত হয়। ইটালির স্যাভয় ও পিডমন্ট প্রদেশের কৃষকরা বিদ্রোহে উত্তাল হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। ১৭৮৯-এর ১৪ জুলাই ফ্রান্সের স্বৈরাচারী শাসনের প্রতীক বাস্তিল দুর্গের পতনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন জার্মানির কবি সাহিত্যিক, দার্শনিক তথা বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। রুশোর ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ তত্ত্ব বহু জার্মানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। আবার ফরাসি বিপ্লবের শুরু হবার দুই বছর আগেই বেলজিয়ামে অস্ট্রিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় জোসেফের বিরুদ্ধে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৭৮৯-এর ফরাসি বিপ্লব তাকে আরও উদ্বুদ্ধ করে। এছাড়াও সুইজারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশগুলিতেও ফরাসি বিপ্লবের তাৎক্ষণিক প্রভাব কম বেশি পড়েছিল। 

ইউরোপ মহাদেশের বাইরে আমাদের দেশ ভারতবর্ষেও ফরাসি বিপ্লবের ফলে উদ্ভূত গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের প্রভাব পড়েছিল, যার প্রতিধ্বনি শোনা যায় এ দেশের বিভিন্ন মনীষীর বক্তব্য ও লেখনীর মধ্যে। ১৮১৫ থেকে ১৮৩০-এর মধ্যে ইউরোপ ও ইউরোপের বাইরে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় সর্বদাই গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করেছিলেন। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও কিশোর বয়সেই প্রকাশ্যে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ প্রচার করতে গিয়ে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের সপক্ষে মত প্রকাশ করেন। [১২] এছাড়াও, ১৮৩০-এর ২৫ ডিসেম্বর রাতে একদল দুঃসাহসী বাঙালি তরুণ কলকাতার নবনির্মিত অক্টরলনি স্তম্ভে (এখন যা শহীদ মিনার) চড়ে ইংরেজদের পতাকা ছিঁড়ে দিয়ে তার জায়গায় উড়িয়ে দেন ফরাসি বিপ্লবের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা। [১৩] এটা কি ফরাসি বিপ্লবের ফলে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদী আদর্শের স্ফুরণ নয়! ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘সাম্য’ প্রবন্ধে ফরাসি বিপ্লবের যে সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্য মূল্যায়ন করেছেন তা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে — “রুশোর মূল কথা সাম্য প্রাকৃতিক নিয়ম। ….. ফরাসি বিপ্লবে যাহা-কিছু ঘটিয়াছিল তাহার মূল নিহিত রুশোর গ্রন্থে।…. সেই ফরাসি বিপ্লবে রাজা গেল, রাজকুল গেল, রাজপদ গেল, রাজ নাম লুপ্ত হইল। সম্ভ্রান্ত লোকের সম্প্রদায় লুপ্ত হইল। পুরাতন খ্রিস্টধর্ম গেল, ধর্মযাজক সম্প্রদায় গেল, মাস, বার প্রভৃতির নাম পর্যন্ত লুপ্ত হইল।…. ফ্রান্স নতুন কলেবর প্রাপ্ত হইল। ইউরোপে নতুন সভ্যতার সৃষ্টি হইল। মানবজাতির স্থায়ী মঙ্গলসিদ্ধ হইল।” 

বিস্তারিত আলোচনার পর এ বিষয়ে কৌতূহল জাগা খুবই স্বাভাবিক যে ফরাসি বিপ্লব কি সার্বিক সাফল্য লাভ করেছিল! অর্থাৎ তৃতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত বুর্জোয়া, কৃষক ও সাঁকুলেৎ (শ্রমজীবী) মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কি পূর্ণ হয়েছিল? এর সুস্পষ্ট উত্তর হল বুর্জোয়াদের স্বার্থ চরিতার্থ হয়েছিল এই বিপ্লবের দ্বারা। কিন্তু নিম্নবর্গের মানুষের কিছু সুবিধা নিশ্চয়ই হয়েছিল। কিন্তু যে স্বপ্নের পেছনে তারা ছুটেছিল তার অনেকটাই অধরা থেকে গিয়েছিল।

এতৎসত্ত্বেও ‘জাতীয়তাবাদ’-এর আদর্শ যে ফরাসি বিপ্লবের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিল সেই বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই। শুধু ফ্রান্স নয়, ইউরোপকেও তা গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের সূত্র ধরে আবির্ভূত নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের আদর্শগুলিকে প্রসারিত করেছিলেন। পোল ও ইটালিয়দের সঙ্গে সুসম্পর্কের সূত্র ধরে তিনি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করেছিলেন। এছাড়া নেপোলিয়ান শাসনের বিরুদ্ধে স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানি, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে যে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছিল তা জাতীয়তাবাদকে দৃঢ়তর করে। এইভাবে ঊনবিংশ শতকে জাতীয়তাবাদ ইউরোপে একটি জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার সৃষ্টি করে। সর্বোপরি, ফরাসি বিপ্লব থেকেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। উল্লেখ্য, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ সাধন ও উৎপাদনের উপায়ের জাতীয়করণ ছাড়া সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে অন্য কোনও পথ নেই, এই সত্য প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ রাবেউফ (১৭৯৫-৯৬)। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ফ্রান্সে শাশ্বত ডাইরেক্টররা তাকে প্রাণদণ্ড দিলেও ওই আদর্শের অপমৃত্যু ঘটেনি।

টীকা ও সূত্র নির্দেশ : 

১) অমলেশ ত্রিপাঠী, ‘ফরাসিবিপ্লবেরঐতিহাসিকব্যাখ্যা, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ: ৫০ 

২) সুভাষ ভট্টাচার্য, ‘সংসদইতিহাসঅভিধান, প্রথম খণ্ড, কলকাতা, ২০০৯, পৃ: ১১১

৩) এ প্রসঙ্গে দুটি যুদ্ধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে, যেগুলির সঙ্গে বুরবোঁ রাজতন্ত্র তথা ফ্রান্স বিশেষ ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। ফরাসি রাজকোষের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল অপরিসীম। এই দুটি যুদ্ধ হল — যথাক্রমে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৭৫৬-১৭৬৩) এবং আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৬-৮৩)।

৪) সুভাষ রঞ্জন চক্রবর্তী, ‘ইউরোপেরইতিহাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ১৯৯২, পৃষ্ঠা: ১০৬

৫) এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বুরবোঁ শাসকদের আমলে ফ্রান্সের ‘লেতর দ্য ক্যাশে’ (Letters de cachet) নামে এক ধরনের অসাংবিধানিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রচলিত ছিল। এর মাধ্যমে রাজারা যে কোনও নাগরিককে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করে রাখার অধিকার ভোগ করে আসছিলেন। এইসব নিরপরাধ ব্যক্তিদের বাস্তিল দুর্গে বন্দি করে রাখা হত।

৬) বুর্জোয়ারা বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে গিয়েছিলেন প্রধানত প্রচলিত সামাজিক বৈষম্যের বিনাশ ঘটাতে এবং অভিজাত শ্রেণির সমান মর্যাদা ভোগের দাবিতে। নিম্নশ্রেণির কৃষক ও সাঁকুলেতরা এতে যোগদান করেছিলেন মূলত দারিদ্র ক্ষুধার তাড়নায়।

৭) জর্জ রুডে, ‘দ্যরিভলিউশনারিইউরোপ, ফনটেনা বুকস, ১৯৬৪, পৃষ্ঠা: ৮২

৮) যে সমস্ত নাগরিক তিনদিনের শ্রমের সমান অথবা দেড় থেকে তিন লিভর পর্যন্ত কর প্রদান করত তারা ‘সক্রিয়’ নাগরিক বলে গণ্য হত। তারাই ভোট দেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হন। আর যারা গৃহভৃত্য এবং যারা ওই কর প্রদান করত না তারা ‘নিষ্ক্রিয়’ নাগরিক বলে গণ্য হন এবং ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

৯) সন্ত্রাসের ফলে মোট কত লোক নিহত হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা শক্ত। ডোনাল্ড গ্রিয়র বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে যে হিসাব দিয়েছেন তা হল বিনা বিচারে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজারের মধ্যে। বিভিন্ন বিচারালয় বা জরুরি কমিশনের দ্বারা প্রদত্ত মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞার সংখ্যা ১৬,৫৯৪। সুভাষ রঞ্জন চক্রবর্তী, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ১৭১ দ্রষ্টব্য।

১০) প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্তী, ‘ফরাসিবিপ্লব, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ১৯৯০, পৃষ্ঠা: ৪৪৬

১১) ঐ, পৃষ্ঠা ৪৪৯-৫০ 

১২) গৌতম চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত), ‘ফরাসিবিপ্লবদুশোবছরেরআলোতে, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, কলকাতা, ১৯৯০, পৃষ্ঠা: ৮১

১৩) ঐ, পৃষ্ঠা : ৮৩

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান