শোভনলাল দত্তগুপ্ত
এক
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে রুশ বিপ্লবের প্রত্যক্ষ প্রভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল (কমিনটার্ন)। এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশে দেশে শ্রমজীবী মানুষের পুঁজিবাদ-বিরোধী উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনকে সংগঠিত করা এবং সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকে সর্বতোভাবে সমর্থন জানানো। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের (১৮৮৯–১৯১৪) সংস্কারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় কমিনটার্নের (১৯১৯-১৯৪৩) কর্মসূচি ছিল প্রকৃত অর্থেই বিপ্লবাত্মক এবং সামগ্রিকভাবে মার্কসবাদের ভাবধারায় পুষ্ট। তাই স্বাভাবিক কারণেই এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাকে ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকেরা ভালো চোখে দেখেননি এবং গোড়া থেকেই কমিনটার্নের সঙ্গে পুঁজিবাদী দুনিয়ার বিরোধ ও সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই বিরোধের আরও একটি কারণ ছিল; তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সদস্য বলতে বোঝাত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে। কমিনটার্নের কর্মসূচির প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যই ছিল তাদের সদস্যপদ প্রাপ্তির অন্যতম মাপকাঠি এবং এভাবেই কমিনটার্নের কালপর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত আন্দোলন বহুলাংশেই ছিল কমিনটার্নের দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রভাবিত। কমিনটার্নের কর্মসূচি, রণকৌশল ইত্যাদির ক্ষেত্রে পরিবর্তন ছিল কমিউনিস্ট পার্টিগুলির দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনেরও ইঙ্গিতবাহী। কমিউনিস্ট আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য প্রতিষ্ঠিত এরকম আন্তর্জাতিক সংগঠনকে মেনে নেওয়া তাই পশ্চিমি দুনিয়ার পক্ষে গোড়া থেকেই এক অসম্ভব ব্যাপার ছিল।
ভারতবর্ষের পক্ষে, বিশেষত কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বে, কমিনটার্নের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে (অর্থাৎ ১৯১৯-১৯৪৩) কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকার যথার্থ মূল্যায়ন করতে হলে কমিনটার্নের দৃষ্টিভঙ্গি নিরপেক্ষভাবে করা সম্ভব নয, কারণ এই সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সি.পি.আই.) কমিনটার্নের প্রতি আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। এই নিঃশর্ত আনুগত্যের ফল কি দাঁড়িয়েছিল তার একটি বিশ্লেষণ আজকের দিনে প্রয়োজন।
এই প্রশ্নটি গত এক দশকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশেষ একটি কারণে। কমিনটার্নের জীবদ্দশায় এবং ১৯৪৩ সালে কমিনটার্নের অবলুপ্তির পর থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কমিনটার্ন মহাফেজখানার দ্বার ছিল গবেষকদের কাছে রুদ্ধ; এমন কি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের গবেষকদের কাছেও এই মহাফেজখানা ব্যবহার করার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। গরবাচভের সময়ে অর্থাৎ, তার পেরেস্ত্রোইকা-পর্বে এই মহাফেজখানার দরজা ক্রমে ক্রমে খুলে দেওয়া শুরু হয় এবং তার পরিণতিতে গত এক দশকে কমিনটার্নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও নথিপত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, যার যথার্থ অনুধাবন অনেক স্বীকৃত ভাবনাচিন্তাকেই টলিয়ে দিচ্ছে। তার অর্থ এই নয় যে এর আগে কমিনটার্নের কোনও দলিলই প্রকাশিত হয়নি। গবেষক মহলে কমিনটার্নের দুটি প্রধান প্রকাশিত পত্রিকার [International Press Correspondence (Inprecor) এবং Communist International] মাধ্যমে লভ্য অনেক দলিলই অজানা ছিল না। কিন্তু এ সবই ছিল সরকারিভাবে গৃহীত বিভিন্ন দলিল ও নথিপত্র। এই সব দলিলের নেপথ্য কাহিনি কিংবা কমিনটার্নের অভ্যন্তরে ঘাত-প্রতিঘাত, অন্তর্বিরোধ, প্রতিবাদ সংক্রান্ত অসংখ্য দলিল, নথি, চিঠিপত্র ছিল সম্পূর্ণভাবেই অজানা। আশির দশকের শেষ পর্বে প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং পরবর্তীকালে ইউরোপের আরও অন্যান্য দেশে (যেমন ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড) এই দিকটি ক্রমে ক্রমে উন্মোচিত হতে শুরু করে এবং কমিনটার্ন গবেষণার ক্ষেত্রে সূচিত হয় এক নতুন মাত্রা। এই প্রেক্ষাপটেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে কমিনটার্নের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল, সেই প্রশ্নটি এখন বিশেষভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। [১]
দুই
কমিনটার্নের সঙ্গে ভারতবর্ষের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সম্পর্ককে ভালোভাবে বুঝতে হলে তিনটি পর্যায়ে এই বিষয়টির অনুসন্ধান প্রয়োজন। প্রথম পর্ব: ১৯১৯-১৯২৪; দ্বিতীয় পর্ব: ১৯২৪-১৯৩৫; তৃতীয় পর্ব: ১৯৩৫-১৯৪৩। বলাবাহুল্য যে কমিনটার্ন-ভারতবর্ষ সম্পর্কের প্রশ্নটিকে রুশ বিপ্লবের প্রভাব নিরপেক্ষভাবে বিচার করা যাবে না, কারণ কমিনটার্নের প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রধান প্রেরণা ছিল ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব এবং তার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন লেনিন। পরবর্তীকালেও তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, বিশেষত বিশের দশকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্বিরোধ, কমিনটার্নের রাজনীতিকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে এবং ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনও এই প্রভাবের বাইরে ছিল না।
রুশ বিপ্লবের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠী সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা শুরু করেন অক্টোবর বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই। গঙ্গাধর অধিকারীর প্রামাণ্য গবেষণার সূত্র ধরে বলা চলে যে ভারতবর্ষে এরকম চারটি গোষ্ঠী বিপ্লবী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেয়। [২] প্রথম গোষ্ঠী : বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মহম্মদ বরকতুল্লা, তরুমল আচার্য, মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জি প্রমুখ বিভিন্ন পথে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রবেশ করেন। দ্বিতীয় গোষ্ঠী : খিলাফত আন্দোলনের শরিক মহম্মদ আলী সেপাসি, আবদুল মজিদ, শওকত উসমানি প্রমুখ ছিলেন মূলত হিজরত গোষ্ঠীভুক্ত। তৃতীয় গোষ্ঠী : পাঞ্জাবের গদর পার্টির আদর্শে উদ্বুদ্ধ রতন সিং, সন্তোখ্ সিং প্রমুখ; চতুর্থ গোষ্ঠী : কলকাতার মুজফ্ফর আহমেদ, মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেল্লু, বোম্বাইতে এস এ ডাঙ্গে প্রমুখ পরোক্ষভাবে, মূলত মস্কোতে অবস্থিত মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যোগাযোগে সচেষ্ট হন। এই সময় ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তৃতীয় আন্তর্জাতিক এবং ভারতবর্ষের এই চারটি গোষ্ঠীই কমিনটার্নের সঙ্গে যোগাযোগে উদ্যোগী হয়, কারণ কমিনটার্নই হয়ে দাঁড়ায় সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিপ্লবী কর্ণধার। যেটুকু বলা হল তা থেকে একথা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে শেষোক্ত গোষ্ঠীটি বাদ দিলে প্রথম তিনটি গোষ্ঠীই সরাসরি সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রবেশ করতে ও কমিনটার্নের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিল। তার ফলে এই তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে একেবারে গোড়া থেকেই নানা ধরনের বিরোধ ও সংঘাত, এমনকি একই গোষ্ঠীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব অব্যাহত ছিল। এই দ্বন্দ্ব ও বিরোধের অন্যতম কারণ ছিল একটাই : প্রতিটি গোষ্ঠী দাবি করে যে এককভাবে তাঁরাই ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের যথার্থ প্রতিনিধি এবং কমিনটার্নের উচিত একক ভাবে সেই গোষ্ঠীকেই স্বীকৃতি দেওয়া। এই পরিস্থিতি বিশের দশকে এক দীর্ঘ সময় জুড়ে বিদ্যমান ছিল, যদিও কার্যত শেষ পর্যন্ত কমিনটার্নে ভারতবর্ষ এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে নীতি নির্ধারণের প্রধান দায়িত্ব এসে বর্তায় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ওপরে।
প্রথম পর্ব : ১৯১৯-১৯২৪ : বলা যেতে পারে এই সময় ছিল কমিনটার্নে লেনিনের যুগ। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পরে, পঞ্চম কমিনটার্ন কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবার সময় পর্যন্ত ব্যাপ্ত এই কালপর্বটি ভারতবর্ষের পক্ষে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৯ সালে, যখন কমিনটার্নের সঙ্গে ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিপ্লবী গোষ্ঠীর সম্পর্ক সেভাবে গড়ে ওঠেনি, ‘বিশ্বের সর্বহারাদের প্রতি’ শীর্ষক একটি দলিলে উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের গুরুত্বকে তুলে ধরা হয় এবং একথা খুব স্পষ্টভাবে বলা হয় যে উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রাম সমাজতান্ত্রিক ইউরোপের সব রকম সমর্থন পাবে। তার এক বছর পরে অনুষ্ঠিত হয় কমিনটার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেস (১৯২০) এবং এখানেই প্রথম ঔপনিবেশিক প্রশ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। লেনিন-রায় বিতর্ক, যেটি সবার কাছেই মোটামুটি পরিচিত, এই দ্বিতীয় কংগ্রেসেরই ফলশ্রুতি। সাধারণভাবে এরকম একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে রায়ের প্রস্তাবিত ঔপনিবেশিক দলিলের খসড়া, যেটি ছিল প্রবল ভাবে বামপন্থী ঝোঁক ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, লেনিনের খসড়া দলিলের সঙ্গে কিছু কিছু পরিবর্তন সহ, একযোগে গৃহীত হয় এবং এটি প্রমাণ করে যে রায়ের দলিলের এই স্বীকৃতি কার্যত ছিল রায়ের সঙ্গে লেনিনের এক ধরনের বোঝাপড়া বা সন্ধির নামান্তর; অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত এককভাবে লেনিন নয়, রায়ও স্বীকৃতি পান ঔপনিবেশিক প্রশ্নের তাত্ত্বিক হিসেবে।
এ সরল ধারণাটি কিন্তু পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। গঙ্গাধর অধিকারী রুশ গবেষক এ. রেজনিকভের গবেষণার ফলাফল অনুসরণ করে দেখান [৩] যে রায়ের ঔপনিবেশিক প্রশ্ন সংক্রান্ত মূল দলিলটি ছিল খুবই একপেশে ও প্রবলভাবে বামপন্থী ঝোঁক সম্পন্ন, যার মূল কথাটি ছিল এই যে ভারতবর্ষে শিল্পায়নের ফলে শ্রমিকশ্রেণি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম এবং ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলি যেহেতু সাম্রাজ্যবাদের দালাল মাত্র, সেই কারণে একযোগে সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে ভারতবর্ষের শ্রমিকশ্রেণিকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কায়েম করতে হবে। রেজনিকভ কমিনটার্ন মহাফেজখানার দলিল ঘেঁটে দেখিয়েছেন যে রায়ের দলিলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশকে লেনিন স্বহস্তে সংশোধন করেন এবং এর ফলে লেনিনের সংশোধিত এই দলিলটি যখন লেনিনের নিজস্ব দলিলের সঙ্গে গৃহীত হয়, তখন উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকলেও ব্যবধান অনেক হ্রাস পায়।
কমিনটার্নের লেনিন পর্বে ঔপনিবেশিক প্রশ্নে জাতীয়তাবাদকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা বা সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা রায়ের মতো আরও অনেক চিন্তকের মধ্যে প্রকট ছিল। লেনিন কিন্তু একেবারে গোড়া থেকেই যে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন তার সারবস্তু ছিল এই যে, একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের বিরোধের তাৎপর্য এবং দেশের অভ্যন্তরে জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলির দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা এবং শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের বিরোধিতার বিষয়টি খেয়াল রেখে ভারতবর্ষের মতো দেশে প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার কৌশল অবলম্বন করা। সেই ফ্রন্টে জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং কমিউনিস্টদের সহাবস্থানের সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্টদের স্বাতন্ত্র্যকেও টিকিয়ে রাখতে হবে; কিন্তু তা করতে হবে বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের শামিল হয়ে, সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদকে একই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করে নয়।
লেনিনের এই দ্বান্দ্বিক চিন্তা রায়ের মতো আরও অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। কিন্তু যে কথাটা উল্লেখযোগ্য তা হল এই যে, কমিনটার্নের লেনিন যুগে ভিন্নমতকেও স্বীকৃতি দেয়া হত; কমিন্টার্নের গৃহীত ঔপনিবেশিক দলিলের সঙ্গে একযোগে রায়ের বিকল্প দলিলও স্থান পেয়েছিল; রায়ের কণ্ঠরোধ করা হয়নি। লেনিনোত্তর পর্বে কমিনটার্নে এই ধারাটি ক্রমে ক্রমে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
দ্বিতীয় কংগ্রেসের অব্যবহিত পরেই প্রধানত মানবেন্দ্রনাথের উদ্যোগে তাসখন্দে ১৭ অক্টোবর ১৯২০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। রায় দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে লেনিনের সঙ্গে একমত না হলেও সাধারণভাবে দ্বিতীয় কংগ্রেসে গৃহীত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রশ্নে বিরোধিতা করেননি। ১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসে আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রিশতম অধিবেশনে নলিনী গুপ্তের মাধ্যমে রায় ও অবনী মুখার্জি স্বাক্ষরিত একটি ইস্তাহার এসে পৌঁছোয় এবং বলা যেতে পারে এই দলিলটিই ছিল কমিনটার্নের সঙ্গে ভারতবর্ষের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ। এই দলিলে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি আবেদন করা হয় যে তাঁরা যেন শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে যুক্ত করেন।
১৯২২ সালে কমিন্টার্নের তৃতীয় কংগ্রেসে ঔপনিবেশিক প্রশ্ন বা ভারতবর্ষ সম্পর্কে কোনও বড় সিদ্ধান্ত গৃহীত না হলেও ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের অপ্রকাশিত রাজনৈতিক ইতিহাস এবং পরবর্তীকালে কিছু কিছু রুশ গবেষকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে এই সময়ে ভারতবর্ষে বিপ্লবী আন্দোলনের রণকৌশল সম্পর্কিত তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দলিল পেশ করা হয়, যদিও শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। একটি দলিলের রচয়িতা ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগীরা; দ্বিতীয় দলিলটি পেশ করেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর সঙ্গীরা; তৃতীয় দলিলটি পেশ করেন এম এন রায়। এতদিন পর্যন্ত এই দলিলগুলির সত্যতা নিয়ে বেশ কিছুটা সংশয় ছিল, কারণ এগুলি কোনো দিনই প্রকাশিত হয়নি। কমিনটার্ন মহাফেজখানার দ্বার উন্মুক্ত হবার পর বর্তমানে এই দলিলগুলি গবেষকদের হস্তগত হয়েছে।[৪] বিস্তৃত আলোচনার মধ্যে না গিয়েও এ কথা বলা যেতে পারে এঁদের প্রত্যেকেরই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, এক কথায়, বামপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন করার প্রশ্নে অনেকটাই নেতিবাচক, যদিও রায়ের ক্ষেত্রে বলা চলে যে দ্বিতীয় কংগ্রেসের চরম সংকীর্ণতাবাদী অবস্থান থেকে সরে এসে তিনি এখন ছিলেন কিছুটা মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণের পক্ষে।
এই সময় থেকেই রায়ের সম্পাদিত Vanguard, Advance Guard প্রমুখ পত্রিকা ভারতবর্ষে গোপনে পৌঁছোতে শুরু করে এবং সেইসঙ্গে ছিল Inprecor যার মাধ্যমে দেশে কর্মরত বিভিন্ন কমিউনিস্ট গোষ্ঠী ভারতবর্ষ সম্পর্কে কমিনটার্নের অবস্থান, নীতি ইত্যাদি সম্পর্কে ক্রমে ক্রমে অবহিত হতে শুরু করেন। কমিনটার্নের সঙ্গে এই গোষ্ঠীগুলির গোপন যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে মানবেন্দ্রনাথ রায়, অবনী মুখার্জি, নলিনী গুপ্ত প্রমুখের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইভাবে কলকাতায় মুজাফ্ফর আহমেদ, আব্দুল হালিম, মুম্বাইতে এস এ ডাঙ্গের সঙ্গে কমিনটার্নের যোগাযোগ ক্রমে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
১৯২২ সালে অনুষ্ঠিত হয় কমিনটার্নের চতুর্থ কংগ্রেস। ‘প্রাচ্য দেশ সংক্রান্ত প্রশ্ন’ শীর্ষক গৃহীত দলিলে মূলত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় ফ্রন্ট গঠনের ধারণাটিকে সমর্থন জানানো হয় এবং তার পরিণতিতে ১৯২৩ সালে ১৪ জুন তারিখে কমিনটার্নের কার্যকরী সমিতির পক্ষ থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায় Workers’ and Peasants’ Party–র আসন্ন সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে যে চিঠি দেয় তার মূল কথাই ছিল এই সংগঠনের মাধ্যমে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে চাপ সৃষ্টি করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বামপন্থী মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত করা। যদিও এই সম্মেলন শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হতে পারেনি, কারণ ১৯২৫ সালের মে-জুন মাসে WPP-এর অধিকাংশ নেতাকেই কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করে, পরবর্তীকালে এই আধা বে-আইনি সংগঠনটি অল্প সময়ের জন্য হলেও বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করে।
তিন
দ্বিতীয় পর্ব : ১৯২৪-৩৪ : ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পরে অনুষ্ঠিত হয় কমিনটার্নের পঞ্চম কংগ্রেস। এই সময় থেকেই কমিনটার্নের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্রুত পরিবর্তিত হতে শুরু করে, যা সরাসরি প্রভাবিত করে ভারতবর্ষ সম্পর্কে কমিনটার্নের রাজনৈতিক অবস্থানকেও। লেনিনোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে এই সময় থেকেই সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্ব ক্রমেই প্রকট হতে শুরু করে। প্রথমে স্তালিন-ত্রৎস্কি ও পরে স্তালিন-বুখারিন বিরোধ শেষ পর্যন্ত পরিণতি লাভ করে ১৯২৭ সালে ত্রৎস্কির ও ১৯২৯ সালে বুখারিনের অপসারণে ও স্তালিনের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায়। এই ঘটনার প্রত্যক্ষভাবে এসে পরে কমিনটার্নেও। সিপিএসইউ-এর স্বার্থ বা সিপিএসইউ-এর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ স্তালিনীয় রাজনৈতিক লাইন ক্রমে ক্রমে কমিনটার্নের রাজনৈতিক স্বার্থ বা রাজনৈতিক লাইনের সমার্থক হয়ে দাঁড়াল এবং তার ফলে কমিনটার্নের অভ্যন্তরে ভিন্ন মতাবলম্বীদের কখনও ত্রৎস্কিপন্থী বা অতি বামপন্থী কিংবা কখনও বুখারিনপন্থী বা দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের দ্রুত অপসারণও হয়ে দাঁড়াল অনিবার্য। কমিনটার্নের কর্মসূচি, পরিচালন ব্যবস্থা, বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে সিপিএসইউ-এর স্বীকৃত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এই ভাবেই ক্রমে ক্রমে প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে শুরু করে। এককথায়, লেনিনপর্বে ভিন্নমত বা বক্তব্যকে গ্রহণ করার যে সহনশীল মানসিকতার প্রকাশ আমরা দেখি, লেনিনোত্তর কমিনটার্নে তা দ্রুত অপসৃত হতে শুরু করে। এর আরও একটি কারণ ছিল : ১৯২৪ সালের আগে কমিনটার্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নও ভূমিকা ছিল লেনিন, ত্রৎস্কি, জিনোভিয়েভ প্রমুখের। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অভ্যন্তরে স্তালিনের কার্যকরীভাবে প্রবেশ ও দ্রুত উত্থান কিন্তু শুরু হয়েছিল লেনিনের মৃত্যুর পরে, তার আগে নয়। তার এই প্রবেশ ও উত্থানই কমিনটার্নের ওপরে সিপিএসইউ-এর নিয়ন্ত্রণকে দ্রুত শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করে।
স্তালিনীয় দৃষ্টিভঙ্গি যে লেনিনোত্তর কমিনটার্নের ঔপনিবেশিক প্রশ্ন সংক্রান্ত অবস্থানকে কেমন ভাবে প্রভাবিত করেছিল, তার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় ১৯২৪ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিকের পঞ্চম কংগ্রেসে। এই প্রথম সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ব্যাপক মোর্চা গঠনের প্রয়োজনীয়তা, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে রণকৌশল রচনার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলির প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের উপযোগিতা ইত্যাদি বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করা শুরু হয় এবং যার পরিণতিতে এই কংগ্রেসে প্রাচ্য দেশগুলির বিষয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বা কর্মসূচি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কমিনটার্ন মহাফেজখানার নথিপত্র অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে ঔপনিবেশিক প্রশ্ন সংক্রান্ত একটি দীর্ঘ খসড়া দলিল রচিত হয়েছিল ঠিকই এবং সেখানে মূল শক্তি ছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার বিষয়টিকে চিহ্নিত করা; কিন্তু এ দলিলটি যখন স্তালিনের কাছে প্রেরণ করা হয় তাঁর মতামতের জন্য তখন তিনি স্বহস্তে এটির যে সংশোধন করেন, তার মূল কথাটি দাঁড়িয়ে যায় অন্যরকম। [৫] প্রায় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের দ্বিতীয় কংগ্রেসে পেশ করা ঔপনিবেশিক দলিলের তাত্ত্বিক অবস্থানের কাছাকাছি ছিল এই বক্তব্য; সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার বিষয়টি সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করে মন্তব্য করা হল যে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির অভ্যন্তরে একটি বিভাজন রেখা টানা প্রয়োজন, কারণ এর একটি অংশ প্রগতিশীল ও অপর অংশ প্রতিক্রিয়াশীল। প্রায় একই ধরনের বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটে প্রাচ্যের শ্রমজীবীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২৫ সালে প্রদত্ত স্তালিনের বক্তৃতায় ভারত সম্পর্কিত মন্তব্যে।
১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত কমিনটার্নের ষষ্ঠ কংগ্রেসের এই বক্তব্যেরই ব্যাপক ও বৃহত্তর অর্থে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই মহাসম্মেলনে গৃহীত কর্মসূচিতে ও ঔপনিবেশিক প্রশ্ন সংক্রান্ত গৃহীত দলিলে কার্যত যে অবস্থান করা হল তার ফলশ্রুতি ছিল এই যে, ভারতবর্ষের মতো দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার সংগ্রামে জাতীয়তাবাদী শক্তির ভূমিকা মূলত প্রতিক্রিয়াশীল, কারণ জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিরোধিতার প্রশ্নে জঙ্গি অবস্থান গ্রহণ করতে অক্ষম; সেইসঙ্গে একথাও বলা হল যে এইসব দেশে প্রলেতারিয়েত ও দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থের এতটাই মেরুকরণ হয়েছে যে অচিরেই প্রলেতারীয় বিপ্লব বা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছিল আসন্ন এবং সেটি ঘটবে সোভিয়েত বিপ্লবের ধাঁচে।
এই জাতীয় অতি-বামপন্থী অবস্থান গ্রহণের পিছনে কয়েকটি নির্দিষ্ট কারণ ছিল। এক, ধনতান্ত্রিক দুনিয়ায় ঘনায়মান অর্থনৈতিক সংকট এরকম একটি মানসিকতার সৃষ্টি করেছিল যে প্রলেতারীয় বিপ্লব দেশে দেশে আসন্ন প্রায়। দুই, অনেক দেশেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জঙ্গি সাম্রাজ্য বিরোধিতার পথকে অনুসরণ না করে এক ধরনের নিষ্ক্রিয়, অহিংস, বোঝাপড়ার পথকে অনুসরণে আগ্রহী হয়। যেমন, ভারতবর্ষে গান্ধিবাদী আন্দোলন জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন, ধর্মঘট প্রভৃতির প্রতি যে নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছিল, তার পরিণতিতে এই জাতীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াটা খুব বিচিত্র ছিল না। উপরন্তু ১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবির পরিবর্তে যখন ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস (Dominion Status)-কেই মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল তখন আন্দোলন সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ কাজটাও হয়ে গেল আরও সহজ। একই সময় চিনে কুয়োমিন্টাং-কমিউনিস্ট পার্টির জোট ভেঙে যায় এবং জাতীয়তাবাদী কুয়োমিন্টাং দল কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে যে দমন-নিপীড়নের নীতি গ্রহণ করে তা থেকেও প্রাচ্যের দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী দল ও শক্তিগুলির সম্পর্কে নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণের সূত্র অনুসন্ধান করা সম্ভব। তিন, এই সময় এই সিপিএসইউ-এর অভ্যন্তরে বুখারিন-স্তালিন বিরোধ চরমে ওঠে। স্তালিনের প্রবল বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে, যার ফলশ্রুতি ছিল ষষ্ঠ কংগ্রেসে গৃহীত কমিনটার্নের রাজনৈতিক লাইন, বুখারিনের মত ছিল অনেকটাই ভিন্নধর্মী। বুখারিন ‘দক্ষিণপন্থী’ বা ‘সংশোধনবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত হলেন, কারণ তিনি ষষ্ঠ কংগ্রেসের প্রস্তাবিত অতি বামপন্থী, সংকীর্ণতাবাদী রাজনৈতিক অবস্থানের বিরোধী ছিলেন। কমিনটার্ন মহাফেজখানা থেকে সংগৃহীত বুখারিনের স্বাক্ষরিত খসড়া কর্মসূচিটি পাঠ করলে দেখা যায় [৬] যে সব দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে একই পথ, অর্থাৎ সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লবের মডেলকে অনুসরণ করতে হবে, কিংবা গণতন্ত্রের পতন ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিশ্বব্যাপী সাফল্য অনিবার্য, অথবা জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ ও সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ছিল সমগোত্রের, এই জাতীয় অতি সরল অবস্থান সেখানে ছিল অনুপস্থিত। এই খসড়াটি স্তালিনের অনুমোদনের জন্য তাঁর কাছে প্রেরিত হলে তিনি যে সংশোধনগুলি করেন তার পরিণতিতে কমিনটার্নের গৃহীত কর্মসূচি সংকীর্ণ বামপন্থী চেহারা নেয়। এর ফলে স্তালিন-বুখারিন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সৃষ্ট হয় প্রবল তিক্ততা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বুখারিন স্তালিন সংশোধিত খসড়াটিই মেনে নেন এবং সেটির ভিত্তিতেই কর্মসূচিটি কমিনটার্নে গৃহীত হয়। বুখারিনের মূল বক্তব্য ছিল এই যে, পুঁজিবাদ তার গভীর সংকট সত্ত্বেও নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে; সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির সঙ্গে ফ্যাসিবাদের কিছু কিছু প্রশ্নে আপাত নৈকট্য থাকলেও উভয়কে সমগোত্রীয় মনে করলে ভুল করা হবে; পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে তার নিজস্ব পরিস্থিতি অনুযায়ী রণকৌশল ঠিক করতে হবে; একটি সাধারণ ছকের মধ্যে সব দেশের পার্টিকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। বলাবাহুল্য যে এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্তালিনীয় চিন্তার প্রায় সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। কিন্তু বুখারিনের মূল খসড়া দলিলটি যেহেতু ষষ্ঠ কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের কাছেও অজানা ছিল, সেই কারণে কোনও বিকল্প ভাবনা চিন্তার অবকাশও কমিনটার্নের ষষ্ঠ কংগ্রেসে ছিল না।
এই সংকীর্ণ অতি বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে ষষ্ঠ কংগ্রেসের গৃহীত ঔপনিবেশিক প্রশ্ন সংক্রান্ত দলিলে। মানবেন্দ্রনাথ রায় কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁর তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছিলেন এবং ক্রমে ক্রমে স্তালিনীয় সংকীর্ণতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেন। ষষ্ঠ কংগ্রেসে তিনি উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু ঔপনিবেশিক প্রশ্নের আলোচনায় এই সময়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরা। তাঁদের অবস্থান ছিল উগ্রপন্থার কাছাকাছি এবং কিছুটা তাঁদের বক্তব্যের প্রভাবেই ঔপনিবেশিক প্রশ্ন সংক্রান্ত দলিলটি যখন গৃহীত হয়, তখন সেটির তাত্ত্বিক অবস্থান দাঁড়ায় চরম বামপন্থার খুব কাছাকাছি।
এর পরিণতি ভারতবর্ষের পক্ষে সুখকর হয়নি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সীমিত ইতিবাচক ভূমিকাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে তাকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিয়ে গান্ধিজি, নেহেরু, সুভাষচন্দ্র প্রমুখকে কার্যত সাম্রাজ্যবাদের অনুচর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়; স্বপ্ন দেখা শুরু হয় ভারতবর্ষে অচিরেই সোভিয়েত ধাঁচে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কায়েম করার। এর ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল স্রোত থেকে কমিউনিস্টরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন; Workers’ and Peasants’ Party -র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে কমিউনিস্টরা যখন ষষ্ঠ কংগ্রেসের কর্মসূচিকে বাস্তবায়িত করার কথা ভাবছেন তখনই আবার নেমে আসে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার আঘাত, যার পরিণতিতে বিশের দশকের শেষে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। কমিনটার্নের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ষষ্ঠ কংগ্রেসের অব্যবহিত পরেই বুখারিন কমিনটার্ন থেকে অপসারিত হন এবং তারপরে বহিষ্কৃত হন সিপিএসইউ থেকেও। যদিও পরে সিপিএসইউ-এর সদস্যপদ তিনি ফিরে পান, কমিনটার্নে বুখারিনের প্রত্যাবর্তন আর ঘটেনি। এর ফলে গোটা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের পরিচালন পদ্ধতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন দেখা যায়। ভিন্ন মতাবলম্বী ব্যক্তিদের মূলত ‘দক্ষিণপন্থী’ বা ‘সংশোধনবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে কমিন্টার্ন থেকে বিতাড়ন শুরু হয়। এর মধ্যে ছিলেন জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির ব্র্যান্ডলার, থালহাইমার, ভারতবর্ষের এম এন রায় প্রমুখ অনেকে এবং এর পরিণতিতে একদিকে যেমন কমিন্টার্নের অভ্যন্তরে বিকল্প ভাবনা চিন্তা প্রকাশের সম্ভাবনা নিঃশেষিত হতে শুরু করে, অপরদিকে তেমনি প্রবলভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে স্তালিন প্রদর্শিত বামপন্থা; যাকে প্রকৃত লেনিনবাদ আখ্যা দেওয়া হয়।
মানবেন্দ্রনাথের অপসারণের পরে কমিনটার্নে ভারতবর্ষ সংক্রান্ত সমস্যাগুলি দেখাশোনার দায়িত্ব এসে বর্তায় বেন ব্র্যাডলির ওপরে। বস্তুতপক্ষে বিশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সিপিজিবি-র ভূমিকা কমিনটার্নে ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে এবং রায়ের অবর্তমানে তিরিশের দশকের গোড়া থেকেই সিপিজিবি হয়ে দাঁড়ায় কমিনটার্নে কার্যত ভারতবর্ষ ও সিপিআই-এর প্রতিনিধি। এর ফলে একদিকে যেমন ভারতবর্ষের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে কমিনটার্ন নেতৃত্বের ভাবনাচিন্তা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক বড়ো ধরনের প্রতিবন্ধক সৃষ্টি হয়, অপরদিকে অনেক বিষয়েই সিপিআই-সিপিজিবি সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করে। কমিনটার্ন-এর অপ্রকাশিত দলিলগুলি পাঠ করলে এখন দেখা যায় যে, সিপিজিবি-র ভারতবর্ষে কমিউনিস্টদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা সাধারণভাবে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের প্রশ্নে সিপিজিবি-র নেতৃত্বের একাংশের এক ধরনের রাজনৈতিক ঔদাসীন্য সিপিআই-এর মধ্যেও যথেষ্ট ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। [৭]
কমিনটার্ন প্রদর্শিত যে বামপন্থী সংকীর্ণতা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে গ্রাস করেছিল, তার জের চলে ১৯৩৫ সালে অনুষ্ঠিত কমিনটার্নের সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবার সময় পর্যন্ত। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের এক বড়ো অংশ গ্রেপ্তার হবার পরে এবং কমিনটার্নের প্রবল মাত্রায় সংকীর্ণ বামপন্থী রাজনীতির শিকার হয়ে সিপিআই এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়। যদিও সিপিআই নেতৃত্বের একাংশ ক্রমেই কমিনটার্নের এই হঠকারী রাজনৈতিক লাইন সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করতে শুরু করেন, কার্যত কমিনটার্নের ভাবনা চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ১৯৩৫ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম কংগ্রেসের সময় থেকে।
চার
তৃতীয় পর্ব : ১৯৩৫-১৯৪৩ : সাধারণভাবে এই পর্বটি দিমিত্রভ প্রদর্শিত যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির কালপর্ব হিসেবে আখ্যাত হয়। গোটা ইউরোপ জুড়ে আসন্ন বিশ্বযুদ্ধের বিপদ, জার্মানি, ইটালি ইত্যাদি দেশগুলিতে ফ্যাসিবাদের প্রবল উত্থান, বামপন্থী ও কমিউনিস্টদের নিধন অভিযান প্রভৃতি ঘটনা কমিনটার্নকেও প্রবলভাবে আলোড়িত করে এবং এই প্রেক্ষাপটেই জর্জি দিমিত্রভ ১৯৩৫ সালের সপ্তম কংগ্রেসে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুক্তফ্রন্ট, গণফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রশ্নটির গুরুত্বকে চিহ্নিত করেন। স্বাভাবিকভাবেই এই ফ্রন্টে সোশ্যাল ডেমোক্রেসি, সাম্রাজ্যবাদ ও দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার বিরোধী সমস্ত ধরনের গণতান্ত্রিক, জাতীয়তাবাদী দল ও গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হবার যে সুযোগ উপস্থিত হল, সেটিকে বাস্তবায়িত করার অর্থ হল ষষ্ঠ কংগ্রেসে গৃহীত বামপন্থী সংকীর্ণতার রাজনীতিকে পরিহার করা। এই প্রশ্নটি কিন্তু কমিনটার্নে অমীমাংসিত থেকে যায়। যদিও যুক্তফ্রন্টের নীতিকে গ্রহণ করা হল সপ্তম কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের পরিণতি হিসেবে, একথা কোথাও বলা হল না যে ষষ্ঠ কংগ্রেসের রাজনৈতিক লাইনকে পরিত্যাগ না করে যুক্তফ্রন্টের রাজনীতিকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে কমিনটার্নের এই স্ববিরোধিতা গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করে। যদিও রজনী পাম দত্ত, বেন ব্র্যাডলি প্রমুখ অনেকেই নানাভাবে ১৯৩৫ সালের পরে যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে বাম সংকীর্ণতার পথ পরিহার করে জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলির সহযোগিতায় কমিউনিস্টদের উদ্যোগে জাতীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রশ্নটি তুলে ধরেন এবং এই কথাও যদিও ঠিক যে সিপিআই-এর জাতীয় নেতৃত্ব অতীতের পথ পরিহার করে কমিনটার্ন প্রদত্ত নতুন পথ গ্রহণ করতে সচেষ্ট হয়, কমিনটার্ন মহাফেজখানার নথিপত্র থেকে এটাও এখন বোঝা যায় যে ওই সময়ে অর্থাৎ তিরিশের দশকের শেষভাগে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী এমন কি নেতৃত্বেরও কোনও কোনও স্তরে এই নতুন নীতি গ্রহণ করার প্রশ্নে যথেষ্ট সংশয় ও দ্বিধা ছিল। [৮] সাধারণভাবে কমিউনিস্ট পার্টির কাছে ষষ্ঠ কংগ্রেস প্রদত্ত লাইনটির প্রয়োজনীয়তা তখনও পর্যন্ত নিঃশেষিত হয়নি। এই পরিস্থিতিতে পুরোনো ভাবনাচিন্তাকে পরিহার করে নতুন করে জাতীয় ফ্রন্ট গড়ে তোলা, কংগ্রেস ও কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টির সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা ছিল খুবই কঠিন কাজ।
এই সময়ে আরও একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার সময় এখন এসেছে। ১৯৩৪ সালে সিপিএসইউ-এর অভ্যন্তরে সমস্ত বিরোধী গোষ্ঠী ইতিমধ্যে পর্যুদস্ত হয়ে যায় এবং তার প্রভাব অনুভূত হয় সপ্তম কংগ্রেসের পরবর্তী কমিনটার্নেও। একদিকে যেমন দিমিত্রভ যুক্তফ্রন্টের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন অপরদিকে কিন্তু কমিনটার্নের কার্যকরী সমিতি এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর অনেকাংশেই সিপিএসইউ-এর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং এই ভাবেই মধ্য-তিরিশের দশক থেকে কমিনটার্নে শুরু হয় এক অতি কঠিন জটিল ও বেদনাদায়ক পর্ব। একটি কথা এখানে ভুলে যাওয়া চলবে না যে দিমিত্রভ ও তাঁর মতো আরও প্রভাবশালী নেতারা (যেমন, তোগলিয়াত্তি) কমিনটার্নে যুক্তফ্রন্টের নীতি চালু করার ব্যাপারে নীতিনিষ্ঠ ভাবে উদ্যোগী হলেও সিপিএসইউ-এর অভ্যন্তরে বা সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজ ও রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের দ্রুত অবলুপ্তির প্রশ্নে একরকম বাধ্য হয়েছিলেন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে। তোগলিয়াত্তি, দিমিত্রভ প্রমুখ চিন্তাভাবনার দিক থেকে ছিলেন স্তালিনীয় ভাবাদর্শের বিরোধী এবং এক সুস্থ গণতান্ত্রিক বিকল্পের পক্ষে। কিন্তু তাঁদের পক্ষে ১৯৩৫ সালের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত স্তালিনীয় মডেলটিকে সমর্থন ও স্তালিন অনুসৃত নীতিতে সায় দেওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প ছিলনা। এর ফলে কমিনটার্নের সাংগঠনিক স্তরে স্তালিনের প্রভাব অতি দ্রুত ব্যাপ্তি লাভ করে এবং সেটি কিন্তু ঘটে দিমিত্রভ প্রদর্শিত যুক্তফ্রন্ট নীতিকে মেনে নিয়েই, অর্থাৎ কমিনটার্নের অভ্যন্তরে সাংগঠনিক স্তরে অনুভূত হয় রুশি ধাঁচে প্রবল কেন্দ্রীকরণ ও আমলাতন্ত্রীকরণের ঝোঁক ও একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্তরে অনুসৃত হয় দিমিত্রভীয় যুক্তফ্রন্ট নীতি। এই ধরনের জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে দিমিত্রভ সহ গণতান্ত্রিক মানসিকতা সম্পন্ন অনেক নেতাই ছিলেন কার্যত অসহায়, নীরব দর্শক মাত্র।
এর সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে। এক, গোটা ইউরোপ জুড়ে কমিউনিস্টরা যখন প্রায় ঘরছাড়া তখন তাঁদের আত্মগোপনকালে আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিতে হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে। কমিনটার্নের কেন্দ্রীয় দপ্তর ছিল মস্কোতে। ফলে স্তালিন নেতৃত্বের বিরোধিতা করে অন্যান্য কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। দুই, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সিপিএসইউ-এর প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন ও সোভিয়েত রাষ্ট্র ও পার্টির ওপরে পরিস্থিতিগত কারণে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবল নির্ভরতা কমিনটার্নকে ক্রমেই সিপিএসইউ-এর ক্রীড়নকে পরিণত করে তোলে। তার প্রমাণস্বরূপ বলা চলে যে, ১৯৩৫ সালে কমিনটার্নের সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবার পরে কার্যকরী সমিতি যখন পুনর্গঠিত হল তখন সেখানে স্থান পেলেন সোভিয়েত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত একাধিক অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি, যেমন ত্রিলিসার (মসকভিন), এঝভ, স্তালিনের অতি ঘনিষ্ঠ কট্টরপন্থী ঝদানভ ও মলোতভ। এর ফলে কমিনটার্নের গোটা সাংগঠনিক স্তরেই বড়ো রকমের গুণগত পরিবর্তন ঘটে যায়, যার মাশুল গুণতে হয়েছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে।
কমিনটার্নের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির এই গুণগত পরিবর্তন সম্পর্কে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির কোনও ধারণাই ছিল না। কমিনটার্নে ভারতের নিজস্ব কোনও বড়ো মাপের প্রতিনিধির অনুপস্থিতি, সিপিজিবি-এর ওপরে নির্ভরতা এবং সিপিএসইউ-এর অন্তর্বিরোধের রাজনীতি সম্পর্কে কার্যত এক ধরনের একপেশে ভাবনাচিন্তা কমিনটার্নের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হবার পক্ষে সিপিআই-এর সামনে বড়ো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সিপিএসইউ এবং কমিনটার্ন সম্পর্কে স্তালিনীয় ভাষ্যই ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির কাছে একমাত্র স্বীকৃত ভাবনা হওয়ায় কোনও বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়া সিপিআইয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
তাই পরবর্তীকালে ১৯৪১ সালের ২২ জুন সোভিয়েত ইউনিয়ন নাৎসি জার্মানি দ্বারা আক্রান্ত হবার পর যখন কমিনটার্ন ‘জনযুদ্ধের’ নীতি ঘোষণা করে, যার অর্থ ছিল জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করেও নিঃশর্তভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মিত্র শক্তিকে সমর্থন জ্ঞাপন করা, কিছুটা সংশয় সত্ত্বেও সিপিআই-এর পক্ষে এই নীতিকে গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। এর ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে জাতীয় ফ্রন্টের রাজনীতির অবসান ঘটে, যুদ্ধের প্রশ্নে মিত্র শক্তি হিসেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়, ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সিপিআই-এর পক্ষে অংশগ্রহণ করা স্বাভাবিক নিয়মেই তাই সম্ভবপর হয় না এবং এসবের পরিণতিতে সিপিআই নতুন করে আবারও স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে ১৯৪৩ সালে কমিনটার্নের অবলুপ্তি ঘোষিত হওয়ার সময়ও সিপিআই-এর কোনও ভূমিকা ছিল না, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সামান্য কয়েকটি দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে পরামর্শ করেই তৃতীয় আন্তর্জাতিকের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়।
পরিশেষে যে কথাটি বলা প্রয়োজন তা হল এই যে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিনটার্নের ভূমিকার যথার্থ মূল্যায়ন করতে হলে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করার সময় এসেছে। গোড়া থেকে এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি অবশ্যই ভারতবর্ষের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে ব্যাপক নৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি অন্য সমস্ত ধরনের সমর্থন জুগিয়েছিল। ভারতবর্ষের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে যে বামপন্থী ঝোঁক বা ধারা লক্ষ করা যায়, কমিনটার্নের রাজনীতি ও মতাদর্শের প্রভাব সে ক্ষেত্রে একেবারেই উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু সেই সঙ্গে এই কথাটিও খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে লেনিন পর্বের কমিনটার্ন ও লেনিন পরবর্তী অধ্যায়ের কমিনটার্ন সমগোত্রীয় নয়। লেনিনোত্তর কমিনটার্নে বহুলাংশেই কমিনটার্নের মূল আদর্শ ও রাজনীতি থেকে যে বিচ্যুতি ঘটেছিল, যেভাবে এই পর্বে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রীতিনীতির অবমূল্যায়ন হয়েছিল এবং যেভাবে কমিনটার্নকে আঁকড়ে ধরেছিল আমলাতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা, তার ফলে বড়ো রকমের ক্ষতির স্বীকার করতে হয়েছিল পৃথিবীর সব দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকেই। ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম ছিল না এবং তার পরিণতিতে প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভবিষ্যত।
সূত্র নির্দেশ :
১. কমিনটার্ন মহাফেজখানার গুরুত্ব প্রসঙ্গে শোভনলাল দত্তগুপ্ত, ‘কমিনটার্ন মহাফেজখানা ও ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম’ (১-২) কালান্তর, ৭ ও ৮ ডিসেম্বর, ১৯৯৫ দ্রষ্টব্য।
২. G. Adhikari (ed.), ‘Documents of the History of the Communist Party of India’ (1917-1922), vol. I (New Delhi, 1971) ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
৩. ঐ, পৃ. ১৭৩-১৭৭; আরও দেখুন A. Reznikov, ‘The Commintern and the East : Strategy and Tactics in the National Liberation Movement’ (Moscow, 1984), পৃ. ৬১-৭২।
৪. এই দলিলগুলি বর্তমানে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। মস্কোর কমিনটার্ন মহাফেজখানার সূচি অনুযায়ী প্রথম দলিলটির নম্বর 495/68/37/54-67; দ্বিতীয় দলিলটির নম্বর 495/68/64/67-73; তৃতীয় দলিলটির নম্বর 490/1/6/49-52।
৫. স্তালিনের স্বহস্তে সংশোধিত মূল রুশ ভাষায় রচিত এই দলিলটি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। মস্কো মহাফেজখানার সূচি অনুযায়ী এই দলিলের নম্বর 492/1/219/1-21।
৬. বুখারিনের এই খসড়ার অংশবিশেষ, যেটা মূলত ঔপনিবেশিক প্রশ্ন সংক্রান্ত বক্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। মস্কো মহাফেজখানার দলিলের নম্বর 493/1/36।
৭. এরকম একাধিক চিঠিপত্র মস্কোর কমিনটার্ন মহাফেজখানা থেকে সংগ্রহ করে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। উদাহরণস্বরূপ ‘Memorandum dated London, 4.9.34 to ECCI by Communist Group of Indians in London’ মস্কোর নথি নং 495/68/487/33-36; ‘Letter from the Indian Communist Group (London) dated 9.4.34 to the CPGB Secretariat’ মস্কোর নথি নং 495/68/464/23।
৮. উদাহরণস্বরূপ A Note entitled ‘India’ dated 20.8.38 মস্কোর কমিনটার্ন মহাফেজখানা থেকে সংগৃহীত এই দলিলটি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে; মস্কোর নথি নং 495/16/46/111-114।
[ আলোচ্য প্রবন্ধ নরহরি কবিরাজ সম্পাদিত ‘অসমাপ্ত বিপ্লব অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা’ (কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা, ১৯৯৭) গ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল।লেখকের অনুমতিতে পুনর্মুদ্রিত হল। ]