জাতীয়তাবাদ : আধুনিকতাবাদী সান্দর্ভিক নির্মাণ না কি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার

অর্পিতা ব্যানার্জী 

স্বদেশপ্রীতি তথা অর্চনার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বিকল্প হিসেবে জাতীয়তাবাদের একটি তর্কাতীত প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। যদিও সচেতন পাঠকমাত্রই এই বিষয়টি নিয়ে বেশ বিচলিত বোধ করেন যে, বিংশ শতকের ষাট বা সত্তরের দশকের আগে পর্যন্ত জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ভাবগম্ভীর কোনও সান্দর্ভিক আলোচনা সেভাবে গতি পায়নি। এই অনাগ্রহের বাতাবরণে সম্ভাব্য ব্যতিক্রম হিসেবে অবশ্য কার্লটন হেইস, হ্যানস কোন এবং ই এইচ কারের মতো কিছু ব্যক্তিত্বের অবদানকে স্বীকার করে নিতেই হয়। মোটামুটিভাবে বিংশ শতকের আশির দশকে অবশ্য আকস্মিকভাবেই যেন এই স্থবিরত্বের আবহে প্রাণসঞ্চার করে একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ — যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৮২ সালে প্রকাশিত জন আর্মস্ট্রং এর ‘নেশনস বিফোর ন্যাশনালিজম’ এবং জন ব্রুলির  ‘ন্যাশনালিজম এন্ড দ্য স্টেট’। এর ঠিক এক বছর পর প্রকাশিত হয় জাতীয়তাবাদ বিষয়ক যুগান্তকারী গ্রন্থ বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ‘ইমাজিনড কমিউনিটিস’ এবং এরিক জে হবসবম এবং টেরেন্স রেঞ্জারের যুগ্ম প্রচেষ্টায় ‘দ্য ইনভেনশন অফ ট্র্যাডিশন’। এই গুরুত্বপূর্ন গবেষণা গ্রন্থগুলি প্রকাশের তিন বছর পর জাতীয়তাবাদ বিষয়ে একাধিক বিতর্কিত দিক নিয়ে প্রকাশিত হয় আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ — আর্নেস্ট গেলনারের ‘নেশনস এন্ড ন্যাশনালিজম’ এবং অ্যান্টনি ডি স্মিথের ‘দ্য এথনিক অরিজিন অফ নেশনস’। তবে এক্ষেত্রে একটি বিষয় বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে, জাতীয়তাবাদ বিষয়ে অনুশীলনগত বা রণনীতিগত ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে একেবারেই যে কোনও আলোচনা হয়নি এমনটা বলা হয়তো বাঞ্ছনীয় হবে না। সরাসরি জাতীয়তাবাদ বিষয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা না হলেও বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে আন্তরিক সংযোগ বিষয়ে রুশো, হার্ডার, ফিকটে, মিল, লর্ড অ্যাক্টন, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, লুক্সেমবার্গ, বাওয়ার, স্ট্যালিন, ভন ট্রিস্কে, রেঁনার, অবদানকে কখনোই তাই পুরোপুরি নাকচ করা যায় না। 

তবে ১৯৪৫ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে ক্রমশই জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে বিতর্কগুলি যেমন আন্তর্বিষয়ক তেমনই অজস্র বৌদ্ধিক সম্ভাবনায় সমৃদ্ধতর হতে থাকে। এই প্রবন্ধ পরিসরে জাতীয়তাবাদ বিষয়ে আধুনিকতাবাদী তত্ত্বগুলির একটি রূপরেখা পরিবেশনের প্রয়াস করবেন প্রাবন্ধিক, যেগুলি বিংশ শতকের আশি ও নব্বই দশকে যেমন প্রাসঙ্গিক ছিল তেমনই আজও যে কোনও জাতীয়তাবাদ বিষয়ক আলোচনার ক্ষেত্রে অনিবার্য উল্লেখর দাবি রেখে যায়। 

জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত আধুনিকতাবাদী তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছিল প্রধানত সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ‘আদ্যবাদী’ অবস্থানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। এই আদ্যবাদের মূল বক্তব্য ছিল এই যে, ‘জাতীয়তা’ বা ‘nationality’ প্রকৃত প্রস্তাবে মানবিক অস্তিত্বের ‘প্রাকৃতিক অংশবিশেষ’।  ‘আদ্যবাদী’ (primordialist) তাত্ত্বিকদের মধ্যে বিশিষ্ট তাত্ত্বিক গির্টজ যেমন বলেন, “By a primordial attachment is meant one that stems from the ‘givens’ or more precisely, as culture is inevitably involved in such matters, the assumed “givens” of social existence, immediate contiguity and kin connection mainly but beyond them, the givenness that stems from being born into a particular religious community speaking a particular language, or even a dialect of a language and following particular social practices. The congruities of blood, speech, custom and so on, are seen to have an ineffable and at times overpowering coerciveness in and of ourselves.” ( Geertz, 259 )[১] অন্যদিকে জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে এমন প্রাকৃতিকতা ও বিশ্বজনীনতার আবহকেই সমস্যায়িত করে তোলেন জাতীয়তাবাদ বিষয়ক আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিকেরা। আধুনিকতাবাদীদের এমত অবস্থানটিকে ব্যক্ত করতে গিয়ে স্মিথ বলেন যে, ধ্রুপদী আধুনিকতাবাদ বিশ্বাস করে ‘নেশন’ এবং ‘জাতীয়তাবাদ’ আসলে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় তৈরি হওয়া কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতি। ওই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বিবিধ দিক নিয়ে ১৯৬০-এর দশক থেকে তাত্ত্বিক ও অনুশীলনগত স্তরে এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জাতীয়তাবাদী মুক্তকামী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ক্রমশই সন্দর্ভটির তাৎপর্য সংক্রান্ত তত্ত্বচর্চা জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। 

‘জাতীয়তাবাদ’ বিষয়ক আলোচনা সংশ্লিষ্ট হতে থাকে পুঁজিবাদ, শিল্পায়ন ও নগরায়ণ ধর্মনিরপেক্ষতা, আমলাতন্ত্রের বিকাশের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলির সাথে। এক্ষেত্রে মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আধুনিকতাবাদী তাত্ত্বিকদের মধ্যে বিষয়টির উদ্ভব এবং বিকাশ সংক্রান্ত বিষয়ে অবস্থানগুলি অভিন্ন নয়। যদিও এঁরা প্রায় সকলেই বিশ্বাস করেন ‘নেশন’ এবং ‘জাতীয়তাবাদ’ উভয়েরই বিকাশ ঘটেছে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সমাজতাত্ত্বিক চাহিদা হিসেবে। বলাই বাহুল্য যে, এই জাতীয় চাহিদা গড়ে ওঠার ভিত্তিতে ‘প্রাক্-আধুনিক’ বিশ্ব-ইতিহাসের সে অর্থে কোনও ভূমিকা নেই বলেই তাঁরা মনে করেন। 

আধুনিকতাবাদী অবস্থান থেকে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব বিষয়ে প্রাথমিকভাবে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। এরিক জে হবসবম এবং টেরেন্স রেঞ্জারের যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত এই গ্রন্থটি অবশ্যই ‘দ্য ইনভেনশন অফ ট্র্যাডিশন’। গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার প্রায় সাত বছর পর তাদের একই ধরনের বিষয় নিয়ে প্রকাশিত হয় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, ‘নেশনস অ্যান্ড ন্যাশনালিজম সিনস সেভেনটিন এইটি : প্রোগ্রাম, মিথ, রিয়্যালিটি’। আর এই দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার মধ্যবর্তী পর্যায়ে ১৯৮৩ সালে বেলফাস্টের কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে হবসবম জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে একাধিক বক্তৃতামালার মধ্যে দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর অবস্থানটিকে সুষ্টভাবে তুলে ধরেন। 

পূর্বোক্ত প্রবন্ধসংকলন গ্রন্থ এবং বক্তৃতামালার মধ্যে দিয়ে হবসবম প্রাথমিকভাবে যা তুলে ধরতে চাইলেন তা হল “নেশন” এবং “জাতীয়তাবাদ” উভয়েই কিছু সামাজিক প্রকৌশলের (social engineering) ফলশ্রুতি। এই সামাজিক প্রকৌশলগুলির মৌলিক লক্ষ্য হল এক ধরনের ‘ঐতিহ্যের আবিষ্কার’। এই নির্মিত ঐতিহ্যের জন্ম হয় কতগুলি ‘মূল্যমান’ (values) এবং ‘সাধারণ আচরণগতধারা’-কে কেন্দ্র করে — যার ভিত্তি প্রকাশ্যে বা গোপনে, সচেতন বা অবচেতনের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকা কিছু ভাবনাস্রোত এবং তৎসংশ্লিষ্ট অনুশীলন। ক্রমশই পূর্বোক্ত ‘মূল্যমান’ এবং সাধারণ আচরণগতধারা-গুলি সমাজের/কৌমের ধারণা বিশ্বে সযত্নে লালিত হতে থাকে। আর এই লালনের মৌলিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় অতীতের সাথে বর্তমানের ‘আবিষ্কৃত’ ঐতিহ্যের এক ধরনের সাম্পর্কিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা(হবসবম, ১-১৪)।[২]  হবসবম পাঠককে বারবার স্মরণ করিয়ে দেন যে, আধুনিক ‘নেশন প্রীতির’ অন্যতম রূপ ‘জাতীয়তাবাদ’ আসলে ‘আবিষ্কৃত ঐতিহ্যের’-ই একটি অনস্বীকার্য অঙ্গ। এই ‘আবিষ্কার’- প্রক্রিয়ায় এমনকি ইতিহাসকেও ব্যবহার করা হয় ‘বৈধতাবিধানকারী’ একটি অস্ত্র হিসেবে — কারণ গোষ্ঠীবদ্ধতার প্রশ্নে ‘সাধারণ’ অতীত বিষয়ে ঐতিহাসিকজ্ঞান সন্দেহাতীতভাবেই অত্যন্ত মূল্যবান। যদিও হবসবম একথাটি উল্লেখ করতে ভোলেন না যে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পরম্পরাগত যে ধারাবাহিকতার ধারণা  তুলে ধরা হয় তা মূলত ‘কল্পনা’- ভিন্ন কিছুই নয়। এক্ষেত্রে হবসবম ‘আবিষ্কার’ (invention)-এর দুটি ধারার কথা উল্লেখ করেন —

ক) পুরাতন ঐতিহ্য বা প্রতিষ্ঠানের সাথে অভিযোজন সংক্রান্ত ‘আবিষ্কার’।

খ) ঐচ্ছিকভাবে নতুন ‘ঐতিহ্যের’ জন্মদান। 

হবসবমের মতে প্রথম প্রবণতাটি প্রায় সব সমাজেই লক্ষ্য করা যায়, এমনকি তথাকথিতভাবে ঐতিহ্যবাহী সমাজেও। অন্যদিকে দ্বিতীয় প্রবণতাটি তখনই সমাজে প্রকট হয়ে উঠতে থাকে যখন দ্রুত সামাজিক পরিবর্তনের মুখে সামাজিক ঐক্য এবং নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা একান্তভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। 

আসলে ‘প্রথম’ এবং ‘দ্বিতীয়’ উভয়ক্ষেত্রেই ‘জাতীয় কৌম’ বা ‘national community’- র প্রয়োজন থাকলেও শিল্পায়নের মতো অর্থনৈতিক তথা সামাজিক রূপান্তরণ যখন দ্রুত ‘গণ সঞ্চালন’ বা mass mobilization ঘটায় তখন ‘আবিষ্কৃত’ ঐতিহ্যের সূত্রে সমগ্র সমাজকে বেঁধে এক ধরনের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। হবসবম মনে করেন এমনই একটি সময়পর্ব ছিল ১৮৭০-১৯১৭-র মধ্যবর্তী পর্ব। ‘mass politics’-এর উত্থানকে কেন্দ্র করে এই কালপর্বটি ‘আবিষ্কৃত ঐতিহ্যের’ সর্বোচ্চ পর্যায় বলে উল্লেখ করেন হবসবম। হবসবমের মতে এই কালপর্বের পূর্বে নাগরিক/শাসিত জনগণের (অর্থাৎ নাগরিক প্রজাদের) মূলস্রোত রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ সেভাবে লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু ১৮৭০-১৯১৭-র মধ্যে মূলস্রোত রাজনীতিতে নাগরিক/প্রজাদের দ্রুত অনুপ্রবেশ লক্ষণীয় হয়ে ওঠে প্রধানত ভোটাধিকারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে। আর ঠিক এই সময়েপর্বেই শাসনকারী এলিটদের ‘গণ রাজনীতি’-র অতর্কিত আঘাত থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে ‘আবিষ্কৃত ঐতিহ্য’-র। প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার, গণ/জাতীয় অনুষ্ঠানের পালন (যেমন বাস্তিল দিবস) এবং গণ-স্মৃতিসৌধের নির্মাণ ছিল এই প্রচেষ্টার অংশবিশেষ। আর এই পদ্ধতিগুলি প্রয়োগের ফলে সমাজে কিছু অভিনব প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে হবসবম লিখেছেন, “nationalism became a substitute for social cohesion through a national church, a royal family or other cohesive traditions, or collective group self-presentations, a new secular religion.”(হবসবম ৩০৩)[৩] 

হবসবমের মতে, জাতীয়তাবাদ কে আসলে খুঁজে নিতে হবে সেই ছেদবিন্দুতে যেখানে রাজনীতি, প্রযুক্তি এবং সামাজিক রূপান্তরণ পরস্পরকে ছুঁয়ে রয়েছে। তিনি বলেন যে ‘নেশন’ আসলে কোনও ভূখণ্ডগত রাষ্ট্রের অনুসন্ধান মাত্র নয় — এটি প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বিশিষ্ট স্তরে সংঘটিত বিষয়। যেমন ছাপাখানা নির্মাণ, প্রাথমিক শিক্ষাবিস্তার, গণরাজনীতির বিকাশ, জাতীয় ভাষার উদ্ভব ও সম্প্রসারণ ব্যতিরেকে ‘ঐতিহ্যের নির্মাণ’ এবং ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে চিহ্নিত করা যায় না, তেমনই জাতীয়তাবাদের প্রকল্পটিও কোনও সান্দর্ভিক বা ব্যাবহারিক আকৃতি পায় না। হবসবম মনে করেন এক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদকে ‘উপর থেকে’ এবং ‘নীচ থেকে’ এই দ্বৈত প্রকরণের একটি যুগ্ম সম্মিলন হিসেবে দেখতে হবে। কারণ রাষ্ট্রীয়/ কৌমগত/ সমষ্টিগত ঐতিহ্যের আরোপণ যেমন জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের একটি অঙ্গ, ঠিক তেমনই জনগণের সমষ্টিজাত অভিজ্ঞতাভিত্তিক অবধারণা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা-ও প্রকল্পটির অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ। হবসবমের ভাষায়, “nationalism is constructed essentially from above, but which cannot be understood unless also analysed from below, this is in terms of the assumptions, hopes, needs, longings and interests of ordinary people, which are not necessarily national and still less nationalist.” (হবসবম ৩০৩) [৪]

জাতীয়তাবাদ বিষয়ক সবচেয়ে বিতর্কিত আধুনিকতাবাদী অবস্থানটি অবশ্য গ্রহণ করেন আর্নেস্ট গেলনার। গেলনারের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ সমালোচক টম নায়রন-ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ে তাঁর অনবদ্য অবদানকে অস্বীকার করতে পারেননি। তিনি লিখছেন গেলনারের চর্চা সম্ভবত  “is the most important and influential recent study in English.”  (নায়রন ৯৬) [৫] একদা গেলনারের তত্ত্বাবধানে গবেষণাপত্র লিখেছিলেন যে বিশিষ্ট তাত্ত্বিক এন্টনি ডি স্মিথ, তিনিও জাতীয়তাবাদ বিষয়ে গেলনারের আধুনিকতাবাদী তত্ত্বকে সংশয়াতীতভাবেই মৌলিক হিসেবে গণ্য করেন। জাতীয়তাবাদী তত্ত্ব সম্পর্কিত গেলনারের অবদানকে বিবৃত করতে গিয়ে তিনি লিখছেন, “it is one of the most complex and original attempts to come to grips with the ubiquitous phenomenon of nationalism.” (স্মিথ ১০৯) [৬] 

গেলনারের তাত্ত্বিক অবস্থানের সবচাইতে নজরকাড়া দিক ছিল বিষয়টি সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞান এবং বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক ডুর্খেইম ও ওয়েবারের সূত্রে প্রাপ্ত বৌদ্ধিক উত্তরাধিকার। প্রধানত তাদের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেই মানবিক ইতিহাসের তিনটি পর্বের কথা উল্লেখ করেন গেলনার। এগুলি হল — ক) শিকারী-সংগ্রাহক পর্যায় (hunter gatherer phase), খ) কৃষি-ভিত্তিক পর্যায় (agro-literate phase) এবং গ) শিল্প সমাজ পর্যায় (industrial phase)। এই পর্যায়গুলির মধ্যে গেলনার, জাতীয়তাবাদকে নিতান্তই আধুনিক শিল্প সমাজের অঙ্গ বলে মনে করেন। কারণ প্রাচীন যুগের নগররাষ্ট্র, মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক প্রশাসনিক ও সামাজিক ব্যবস্থা কোনও কিছুই শেষ পর্যন্ত জাতিকেন্দ্রিক সত্তাবোধের সাথে নিবিষ্ট সম্পর্কে মিলিত ছিল না। ফলত ‘নেশন’-সম্পর্কিত চৈতন্যবোধের উপরে ভূখণ্ড কেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাবলীল ও নিখুঁত উপরিপতন সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে এই উপরিপতনের প্রায় অনিবার্য একটি চিত্র লক্ষ্য করা যায় আধুনিক শিল্পসমাজগুলিতে।

গেলনারের ভাষায়, “nationalism is primarily a political principle which holds that the political and national unit should be congruent.” (গেলনার ১)[৭] আর ‘রাজনীতি’ এবং ‘জাতীয়তা’-র এই উপরিপতন সম্ভব হয়েছে ‘ক্ষমতা’ ও ‘সংস্কৃতির’ মধ্যে গভীর সম্পর্কের ভিত্তিতেই। যা প্রাক্-আধুনিক ঐতিহাসিক পর্যায়গুলিতে লক্ষ্য করা যায়নি। যেমন গেলনার দেখান যে শিকারী-সংগ্রাহক পর্বে জাতীয়তাবাদের মতো একটি মতাদর্শের সে অর্থে কোনও গুরুত্ব দেখা যায় না — কারণ জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য শেষ বিচারে একটি কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ছাঁচ নির্মাণ। কিন্তু শিকারী-সংগ্রাহক পর্বে রাষ্ট্রব্যবস্থারই সে অর্থে উদ্ভব না হওয়ায় মতাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদেরও তেমন প্রয়োজনিয়তা দেখা যায়নি। শুধু তাই নয় ‘জন্মসূত্রে অর্জিত মর্যাদা ভিত্তিক’-ভাবে পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলি গড়ে ওঠার ফলে ‘সাধারণ শ্রেণি’ (যেমন কৃষক বা অন্যান্য উৎপাদক) থেকে ‘প্রশাসক শ্রেণি’-র (যেমন যোদ্ধা, পুরোহিত, অভিভাবক) সংস্কৃতির মধ্যে গড়ে ওঠে এক বিপুল ব্যবধান। এই বিভাজিত সমাজে সামাজিক বর্গগুলির মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা ছিল ‘প্রেক্ষিত-নির্ভর’ (contextual), যা আধুনিক এবং উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থার ‘প্রেক্ষিত-নিরপেক্ষ’(context-free) সামাজিক-সাংস্কৃতিক যোগাযোগের তুলনায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল। গেলনারের মতে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতা এবং রাজনীতির মধ্যে এক নতুন ধরনের সম্পর্ক সৃজিত হয়। তার ভাষায়, “Now a high culture pervades the whole of society, defines it, and needs to be sustained by the polity.” (গেলনার ১৮) [৮] গেলনার দেখান যে, ‘অ্যাগ্রো লিটারেট’ সমাজে ‘সাংস্কৃতিক অংশীদারিত্ব’ সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল না — কারণ এই সমাজে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সামাজিক সাম্মানিক ভূমিকাই অনঢ়ভাবে ব্যক্তি অবস্থানের নির্ধারক ছিল। এমতাবস্থায় সংস্কৃতি কেবলমাত্র সামাজিক কাঠামোকে শক্তপোক্ত এবং প্রাধান্যশীল আনুগত্যগুলির রূপভেদগুলিকে সংরক্ষণ করবার জন্য ব্যবহৃত হত। অন্যদিকে শিল্প সমাজগুলিতে সংস্কৃতি অনেক বেশি ভূমিকা পালন করে থাকে এবং এটি চিহ্নিত হয় উচ্চমানের সামাজিক গতিশীলতা (social mobility) দ্বারা। আধুনিক সমাজে এই অর্জিত মর্যাদার ভিত্তি জন্মসূত্রে প্রাপ্ত মর্যাদা ভিত্তিক নয়। শুধু তাই নয়, এই নতুন প্রেক্ষিতে সংস্কৃতির তাৎপর্য সম্পূর্ণ মৌলিক। এটি নির্ভর করে না, “on local dialectical idiosyncracy”-র উপর। আধুনিক সমাজে যা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা যায় তা হল, “context-free communication and a high level of cultural standardization. For the first time in history, culture becomes important in its own right.” (গেলনার ১৫৫) [৯] 

তবে সংস্কৃতির ‘প্রমিতকরণের’ (cultural standardization) এই উচ্চস্তর আরোহণের বিশিষ্ট কারণও ছিল। গেলনার দেখান যে, শিল্পভিত্তিক সমাজ এক ‘চিরন্তন বৃদ্ধি’ বা ‘perpetual growth’-এর ধারণার উপর ভিত্তিশীল, যেখানে বৃত্তিগুলির চারিত্রিক পরিবর্তনশীলতা না থাকলে সেগুলির টিকে থাকার সম্ভাবনাও ছিল না। ফলে এক ‘চিরন্তন-পরিবর্তনশীলতা’ এই সমাজের বৈশিষ্ট্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যেমনভাবে আত্মপ্রকাশ করে বিশেষ এক ধরনের সংস্কৃতি যা শিল্প সমাজের চিরন্তন অসাম্যগুলিকেও উপরিতলগতভাবে সাম্যময় হিসেবে উপস্থাপন করে। এমন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি ক্রমশই কাছাকাছি চলে আসতে থাকে এবং তৈরি হয় এক ধরনের ‘বহির্সামাজিকতা’ (exo-socialism)-এর ধারণা। গেলনারের ভাষায়, “The imperative of exo-socialization is the main clue to why state and culture must now be linked, whereas in the past their connection was thin, varied, loose and often minimal.” (গেলনার ৩৮) [১০] 

এককথায় জাতীয়তাবাদ দেখা দেয় শিল্প সমাজের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির এক অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে। যদিও এই অনিবার্য ফলশ্রুতির মধ্যে দুর্বলতা ও দৃঢ়তার সহাবস্থান লক্ষণীয়। প্রাথমিকভাবে এই প্রবণতাকে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় সাপেক্ষে ‘দুর্বল’ বোধ হয় কারণ সম্ভাবনাময় ‘নেশান’ নির্মাণের পূর্বশর্তগুলি উপস্থিত থাকলেও অনেক সময় সেগুলি ‘দানা’ বেঁধে আদর্শ ‘নেশন’ হয়ে উঠতে পারে না। ফলত জাতীয়তাবাদের থেকে প্রত্যাশিত সদর্থক বিষয়গুলি অর্জন করার দুর্বলতম প্রচেষ্টা ব্যতিরেকেই এই রাষ্ট্রগুলি এক চারিত্রিকভাবে ‘অব্যবস্থিত’ জাতীয়তাবাদী পর্বে ঢুকে পড়ে। এই ধরনের দুর্বল জাতীয়তাবাদ যে সংস্কৃতির প্রতিফলন তাকে গেলনার ‘wild culture’ বা ‘জংলি সংস্কৃতি’ বলে চিহ্নিত করেন। এর সাথে আধুনিক যুগে প্রত্যাশিত ও নির্মিত ‘garden culture’ (বা উদ্যান-সংস্কৃতির)-এর বিস্তর দূরত্ব। কারণ ‘উদ্যান সংস্কৃতির’ মধ্যে দিয়েই ক্ষমতা ও সংস্কৃতির এক প্রত্যাশিত সামঞ্জস্যপূর্ণ উপরিপতন সংঘটিত হয়। আর এই উপরিপতনের সম্ভাবনাকে সুনির্দিষ্ট করে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষক বাহিনী। গেলনারের ভাষায় আধুনিক শিল্প সমাজের মধ্যে রয়েছে এক অভূতপূর্ব ‘সবলতা’র দিকও। কারণ এটি জাতীয়তাবাদের মতো একটি বৈধতা বিধানকারী মতাদর্শের জন্মদান করে ও উপরিতলগত ভাবে বিচিত্র সংস্কৃতিগুলিকে একটি ‘সাধারণ’ প্রেক্ষিতের মধ্যে ধারণ করে রাখতে সক্ষম হয়। 

১৯৮৩ সালে জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত আরও একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রভাবশালী কাজ প্রকাশিত হয় — তাৎপর্যের দিক থেকে যেটি হবসবম এবং রেঞ্জারের সমগোত্রীয়-ই ছিল বলা চলে। কাজটি অবশ্যই বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ‘ইম্যাজিনড কমিউনিটিস : রিফ্লেকশন অন দ্য অরিজিন এন্ড স্প্রেড অফ ন্যাশনালিজম’। অ্যান্ডারসন ‘জাতীয়তা’ এবং ‘জাতীয়তাবাদ’ সংক্রান্ত আলোচনাটিকে প্রলম্বিত করেন সাংস্কৃতিক স্তরে। তাঁর মতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে যখন একাধিক জটিল ও বহুস্তরীয় সামাজিক ঐতিহাসিক শক্তিগুলি পরস্পরের সাথে স্বতঃস্ফূর্ত অথচ এক বিশেষ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তখনই উদ্ভব হয় জাতীয়তাবাদের। অ্যান্ডারসনের ভাষায়, “spontaneous distillation of a complex crossing of discrete historical forces and once created, they became models which could be emulated in a great variety of social terrain by a corresponding wide variety of ideology.” (অ্যান্ডারসন ৪) [১১] 

অ্যান্ডারসনের জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত তত্ত্ব দেখাতে চায় যে কেন এবং কীভাবে কিছু সাংস্কৃতিক বিষয় সন্দর্ভটির অন্তর্নিহিত গভীর সম্বন্ধগুলিকে সৃজন করে। এক্ষেত্রে ‘জাতীয়তাবাদ’ নামক বিষয়টিকে তিনি কোনোভাবেই কেবল একটি ভাবাদর্শগত নির্মাণ হিসেবে দেখতে চাননি। এমনকি পারিবারিক, রক্ত সম্বন্ধীয়, ধর্মীয় বা কৌমগত কোনও কাল্পনিক ‘রাজনৈতিক মতাদর্শগত’ গোষ্ঠীসত্তার মতো বিষয় হিসেবেও তিনি জাতীয়তাবাদকে গণ্য করতে চাননি। কারণ অ্যান্ডারসন প্রায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে, ‘জাতি’ ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যদি কেবল কাল্পনিক রাজনৈতিক কৌমের উপর নির্ভরশীল একটি বিষয় হিসেবে দেখা হয় তবে ভ্রান্তির সম্ভাবনা থেকেই যায়। একইসাথে কৃত্রিমভাবে সৃজিত এই জাতীয় ‘কৌমবোধ’ অন্তর্জাতভাবে ‘সীমায়িত’ এবং ‘কাল্পনিক’ বলেও তিনি মনে করেন। এটি ‘কাল্পনিক’ কারণ ক্ষুদ্রতম ‘নেশনে’-ও সকল সদস্যদের পক্ষে সকলকে চেনা সম্ভব নয় বা তাদের সাথে কোনও সামাজিক আদানপ্রদান সম্ভব নয়। এটি ‘সীমায়িত’ কারণ রাষ্ট্রের রয়েছে সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা যার বাইরেই রয়েছে অপর একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। আর ‘নেশন’-ও শেষ বিচারে ‘কল্পিত’-ই, কারণ এটি সমাজে প্রাধান্যশীল অসাম্য সত্ত্বেও একধরনের ‘কল্পিত সাম্যের’ বা  ‘আনুভূমিক কমরেডশিপ’-এর কথা বলে। অ্যান্ডারসনের ভাষায়, “regardless of the actual inequality and exploitation that may prevail in each, the nation is always conceived as a deep, horizontal comradeship.” (অ্যান্ডারসন ৬-৭) [১২]

অ্যান্ডারসনের মতে প্রকৃতপ্রস্তাবে এক জাতীয় সৌভ্রাতৃত্বের বোধ-ই লক্ষাধিক মানুষকে একটি ‘নেশন’-এর সদস্য হিসেবে সহ-সম্মতি জানাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে অ্যান্ডারসনের কাছে ‘কল্পিত’-র অর্থ ‘কৃত্রিম’ বা ‘মিথ্যাশ্রয়ী’ নয়। এই বিষয়টির উল্লেখ গুরুত্বপূর্ণ কারণ পূর্বোক্ত আলোচনায় উত্থাপিত আর্নেস্ট গেলনারের আলোচনায় যেখানে ‘আবিষ্কার’ বা ‘invention’-কে অনেকক্ষেত্রেই ‘fabrication’ বা ‘falsity’-র সমার্থক হিসেবে দেখা হয়েছে সেখানেই অ্যান্ডারসন ‘কল্পিত’ বা ‘imagined’-কে কোনও ভাবেই ‘মিথ্যাশ্রয়ী’ একটি বিষয় হিসেবে দেখতে চাননি। আসলে  অ্যান্ডারসনের কাছে জাতীয়তাবাদী অস্তিত্বগুলির ‘কৃত্রিমতা’ বা ‘অকৃত্রিমতা’ গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তাঁর কাছে যা বিচার্য তা হল কীভাবে ‘জাতীয়তাবাদী অস্মিতাবোধ’ কল্পিত? এক্ষত্রে বিষয়টিকে বিবেচনা করতে গিয়ে অ্যান্ডারসন তাঁর আলোচনার সূত্রপাত ঘটান সেইসব পূর্বশর্তের আলোচনার মধ্য দিয়ে যা ‘কল্পিত কৌম’ সৃজনে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর ব্যাখ্যাকে প্রলম্বিত করেন মূলত সপ্তদশ শতকের সেই বিখ্যাত প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরে, যেখানে ‘নেশন’ নামক একটি নব্য প্রতিষ্ঠান ‘ধর্মীয় কৌম’ (religious communities) এবং ‘রাজতান্ত্রিক কৌম’ (dynastic realm)-কে প্রতিস্থাপন করেছিল। ক্ষয়ীভূত হচ্ছিল পবিত্র ভাষা বা sacred language-গুলির আধিপত্য। যেমন একদা ‘ল্যাটিন’ ছিল সমগ্র ইউরোপের বুদ্ধিজীবীদের ভাষা — বিশ্বাস করা হত এই ভাষাটি ভিন্ন কোনও মহৎ বৌদ্ধিক ‘সৃষ্টিকর্মে’-র জন্ম হবে না। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দী থেকে এই পরিস্থিতির মধ্যে এক দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই সময় থেকে মাতৃভাষায় প্রকাশিত হতে থাকে বহু পত্র পত্রিকা — এমনকি ভাবগম্ভীর গ্রন্থ সমূহও। (অ্যান্ডারসন ১২-১৯) [১৩] 

কিন্তু প্রশ্ন হল ‘নেশন’ তথা তার ভাবাদর্শগত ভিত্তি জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের ক্ষেত্রে এগুলির প্রাসঙ্গিকতা কী? বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অ্যান্ডারসন বলেন যে প্রাচীন বা মধ্যযুগে ধর্ম যে ঐতিহ্যগত ভূমিকা পালন করেছিল — তা এক কথায় ছিল অনবদ্য। কারণ ধর্মই জীবনের আকস্মিকতার অভিঘাতগুলিকে ‘ভবিতব্য’ হিসেবে চিহ্নিত করে জটিল জীবন আবর্তকে অনেকখানি সহনীয় করে তুলেছিলl  

কিন্তু ক্রমশই ধর্মভিত্তিক ‘পবিত্র’ কৌমগুলি প্রতিস্থাপিত হয় এবং সেটিই সমগ্র বিশ্বকে নিয়ে চলে এক অনস্বীকার্য পরিবর্তন অভিমুখে। এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘সময়’ সম্পর্কে খ্রীস্টীয় ‘simultaneity’-র ধারণার প্রতিস্থাপন। ‘divine providence’-এর উপর ভিত্তিশীল সময় সম্পর্কে এমত ধারণায় ‘ঐশ্বরিক ইচ্ছার’ এমন সর্বগ্রাসী প্রাধান্য ছিল যে আমাদের জ্ঞাত সংসারের কোনও স্বতন্ত্র অন্তর্জাত নিহিতার্থ এক্ষেত্রে অস্বীকৃত হয়। (অ্যান্ডারসন ২৪)[১৪] অ্যান্ডারসন মনে করেন সময় সম্পর্কে এমন ধারণার অবসান ঘটতে থাকে আধুনিক সমাজে — আধুনিক সমাজ আসলে পরিচালিত হয় ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ‘homogeneous empty time’-এর ধারণার দ্বারা। যেখানে সময় সম্পর্কে নবচেতনা ‘নেশন’-কে নতুনভাবে কল্পনা করে। ‘নেশনকে’ এক্ষেত্রে দেখা হয় একটি ‘সমাজতাত্ত্বিক জীববস্তু’ বা ‘social organism’ হিসেবে — যা ইতিহাসের নির্দিষ্ট ধারা বেয়ে এগিয়ে চলে। সময় সম্পর্কে এই নব্য ধারণার শরিক হয় উপন্যাস, নাটক, নভেল এমনকি খবরের কাগজ-ও। বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে অ্যান্ডারসন বলেন, “This has profound implication for the idea of nation. An American would probably meet or even know the names of more than a handful of his fellow Americans. He would have no idea of what they are doing at any one time. Yet he has complete confidence in their steady, anonymous, simultaneous activity.” (অ্যান্ডারসন ২৬) [১৫] 

তবে এই ‘সাধারণ বাস্তব’ নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল অবশ্যই সংবাদপত্র। বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অ্যান্ডারসন দেখান যে, যে কোনও সংবাদপত্র আপাতভাবে কিছু বিচ্ছিন্ন কাহিনি শোনায়, কিন্তু পত্রিকার শিরোভাগে যে তারিখটি থাকে তাই কাহিনিগুলিকে একটি অভিন্ন যোগসূত্রে বেঁধে ফেলে। আর সেটিই একই সাথে পঠিত হয় অজস্র পাঠকের দ্বারা — আর এই পাঠপ্রকরণ সবচাইতে বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে একধরনের যোগসূত্র নির্মাণ করে। তাই অ্যান্ডারসন সংবাদপত্রগুলিকে ‘extreme form of the book’ অথবা ‘one day best seller’ বলে অভিহিত করেন। 

প্রায় একই ধরনের প্রভাব লক্ষ করা যায় ‘গণ উৎসব’ (public ceremony)-গুলির ক্ষেত্রেও। অ্যান্ডারসন প্রসঙ্গত বলেন “yet each individual is well aware that the ceremony he performs is being replicated simultaneously by thousands (or millions) of others of whose existence he is confident yet of whose identity he has not the slightest notion.” (অ্যান্ডারসন ৩৩) [১৬] 

সংক্ষেপে বলা চলে যে, অ্যান্ডারসনের মতে, আধুনিক ‘নেশন’-এর সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের তিনটি ছেদ বিন্দুতে চিনে নেওয়া সম্ভব। এগুলি হল পূর্বে আলোচিত— ‘সময়ের ধারণা বিষয়ে পরিবর্তন’, ‘ধর্মীয় এবং রাজকীয় কৌমগুলি’-র অবক্ষয় এবং ‘বৃহদাকৃতি মুদ্রণ প্রযুক্তির আবির্ভাব’। আর এই অভিনব কালপর্বটিকেই অ্যান্ডারসন অভিহিত করেন ‘মুদ্রণ পুঁজিবাদ’ বা ‘print capitalism’ হিসেবে। ‘print capitalism’-এর মধ্যে ঘটতে থাকা পরিবর্তনগুলিই জনগণকে নতুন করে নিজেদের স্বরূপ অনুধাবনে সক্ষম করে তুলেছিল। যেমন ল্যাটিন ভাষায় পারদর্শী অভিজাত জনগণের সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য— তাই গ্রন্থ বিপণনের বাজার ক্রমশ সম্পৃক্ত হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু পুঁজিবাদের প্রয়োজন ছিল নতুন বাজার এবং মুনাফার। তাই ক্রমশই মাতৃভাষায় অনূদিত প্রকাশিত হতে থাকল জনপ্রিয় থেকে শুরু করে ভাবগম্ভীর গ্রন্থগুলিও। তাই মানবতাবাদীদের একাংশের দ্বারা প্রাক্-খ্রীস্টীয় অতীতের পুঁথিগুলিকে মাতৃভাষায় অনুবাদ করা হলে ল্যাটিনের একচ্ছত্র প্রবরতান্ত্রিক আধিপত্যে ভাটা পড়ল। আর মুদ্রণভাষাগুলি এভাবেই পবিত্রভাষাগুলিকে প্রতিস্থাপিত করায় সেগুলি জনগণের ভিতরে অনেক সহজে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পায় — যা শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদের পূর্বশর্তরূপে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

তবে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে পূর্বোক্ত আধুনিকতাবাদী অবস্থানের বিরুদ্ধে কোনও বৌদ্ধিক অবস্থান তৈরি হয়নি এমনটা নয়। সচেতন পাঠক মাত্রেই এই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত যে, জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত আধুনিকতাবাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধাচারী একটি প্রতিক্রিয়া হিসেবেই জন্ম নিয়েছিল ‘এথ্নোসিম্বোলিজম’ বা নৃকুলচিহ্নায়নবাদ। এই তত্ত্বের তাত্ত্বিক জনক  অ্যান্টনি ডি স্মিথ এর মতে, নৃকৌলিক পরিচিতি, জাতীয়তাবাদের গঠন, টিকে থাকা বা প্রকরণগত পরিবর্তনের পিছনে যেভাবে পুরাণতত্ত্ব, চিহ্ন বা প্রতীক, স্মৃতি, মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্য কাজ করে তাকে আলোচনা থেকে বাদ দিলে জাতীয়তাবাদ বিষয়ক যেকোনও তাত্ত্বিক অবস্থানই অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে। আসলে উপরোক্ত বিষয়গুলির আন্তঃসম্পর্ক একটি বহমান কালের প্রেক্ষিতে ‘সমষ্টিগত অস্মিতা’-র (collective identity) জন্ম দেয়, যেটি জাতীয় ‘অতীত’, ‘বর্তমান’ এবং ‘ভবিষ্যতে’-র ‘সাংগঠনিক’ পূর্বশর্ত হিসেবে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। আর এই বক্তব্যের ভিত্তিতেই ‘এথ্নোসিম্বোলিজম’ বা নৃকুলচিহ্নায়নবাদ দেখাতে চেষ্টা করে যে, পূর্বে অস্তিত্বশীল ‘নৃকৌলিক গোষ্ঠী’ বা ‘এথনিগুলি’ (ethnies)-ই অতীতের স্বর্ণযুগের সেই স্মৃতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম যা আধুনিক নেশন গঠনকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুধু তাই নয় এই তত্ত্বটি আরও দেখাতে চেষ্টা করে যে, কীভাবে নৃকুলগুলি অতি ধীর গতিতে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলিকে বদলায় এবং একবার ‘সংগঠিত’ হয়ে গেলে এটি এতটাই পোক্ত একটি শিকড় তৈরি করে যা অভিবাসন, অনুপ্রবেশ বা আন্তর্বৈবাহিক সম্পর্ক প্রভৃতির মধ্যে দিয়ে উন্মূল হয়ে যায়না (স্মিথ ১৬)। আর এই জাতীয় দাবির মধ্যে দিয়ে স্মিথ যা প্রমাণ করতে চাইলেন তা হল, ‘আধুনিক’-সময়পর্ব বা জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্মের প্রেক্ষিতটি একটি ‘ফাঁকা প্লেট’ বা ‘tabula rasa’ নয় বরং এটি “resembles a palimpsest on which are recorded experiences and identities of different epochs and a variety of ethnic formations, the earlier influencing and being modified by the later.” (স্মিথ ৫৯-৬০) [১৭] 

স্মিথ অবশ্য একথা স্বীকার করে নেন যে, মূলত তাঁর পূর্বেই জন এ আর্মস্ট্রং-ই হলেন প্রথম সেই তাত্ত্বিক যিনি ১৯৮২ সালে ‘নেশনস বিফোর ন্যাশনালিজম’-এ নৃকৌলিক অস্মিতাগুলির প্রাক্-আধুনিক শিকড় সন্ধানে প্রবৃত্ত হন। এক্ষেত্রে আর্মস্ট্রং-এর মৌলিক অনুসন্ধানটি ছিল যে, কীভাবে ‘নেশন’-এর মতো ‘গোষ্ঠীগত’ পরিচিতি ভিত্তিক একটি বিষয়ের উদ্ভব ঘটে যা ধারণ করে থাকে এক ‘বিস্তৃত সময়প্রেক্ষিত’ বা ‘extended temporal perspective’ (যেই প্রেক্ষিতের অবশ্যই একটি অতীত পিছুটান আছে)। আর্মস্ট্রং মনে করেন যে, নৃকৌলিক সচেতনতার রয়েছে একটি দীর্ঘ ইতিহাস এবং সমসাময়িক জাতীয়তাবাদ আসলে সেই সচেতনতারই চরম প্রকাশ। 

এই চেতনার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বৈশিষ্ট্য হল এর ‘টিকে’ যাওয়ার ক্ষমতা এবং নৃকৌলিক সীমারেখা সম্পর্কে সচেতনতা। এক্ষেত্রে অবশ্যই নরওয়ের বিশিষ্ট নৃতাত্ত্বিক ফ্রেডরিক বার্থ-এর গোষ্ঠীচেতনা বিষয়ক দৃষ্টিকোণটির উপর খানিক আলোকপাত করা প্রয়োজন। বার্থ দেখান যে, কোনও গোষ্ঠী-ই তাঁদের নিজস্বতাকে স্থির ‘সারসত্তা’-র (essence) দ্বারা চিহ্নিত করে না বরং এটি চিহ্নিত হয় ‘বিদেশি’ জনগোষ্ঠীর থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য করার মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ গোষ্ঠী কেন্দ্রিক সীমায়নকে চিহ্নিত করার সময় অপর গোষ্ঠী থেকে তাদের স্বাতন্ত্র্যই অগ্রাধিকার পায়, কোনও বিশেষ গোষ্ঠীর বিষয়গত (objective) বৈশিষ্ট্যসমূহ নয়। আর্মস্ট্রং মনে করেন যে, বার্থ-এর এমন দৃষ্টিভঙ্গির বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে — যেমন এর ফলে গোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক বা অন্যান্য পরিবর্তনকে সহজে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটি নৃকৌলিক ‘সীমারেখা’ বিষয়ক স্বাতন্ত্র্যকে অতিক্রম করছে। শুধু তাই নয়, এটি ভূখণ্ডকেন্দ্রিক ‘জাতি’ ভাবনার সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করে যায় সহজেই। আর্মস্ট্রং, বার্থের অবস্থানটিকে আর-একটু  প্রলম্বিত করে দেখান যে, নৃকৌলিক সীমায়নকে তখন বোঝা যায় যখন ‘অপরের’ সাথে সংযোগ স্থাপনের যে মাধ্যমগুলি, যেমন ‘কথ্য ভাষা’ বা ‘অন্যান্য প্রতীকী’ ভঙ্গি গুলির যোগাযোগ নির্মাণের সক্ষমতা হ্রাস পায় অথবা অকার্যকর হয়ে আসে। 

আর্মস্ট্রং-এর মতে প্রকৃত প্রস্তাবে, পুরাণ তত্ত্ব (myth), প্রতীক বা  চিহ্ন (symbol), সাধারণ কথ্য সংযোগ এবং তৎসংশ্লিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি গুচ্ছর মতো বিষয়গুলি, যেকোনও বিশুদ্ধ বিষয়গত শর্তগুলির (material factions) তুলনায় অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী।

আসলে ‘প্রতীক’-গুলির স্থায়িত্ব লাভের কারণ প্রধানত সেগুলির ‘বাচনিক’ এবং ‘অ-বাচনিক’ পুরাতাত্ত্বিক কাঠামোগুলির (mythic structure) মধ্যে লীন হয়ে যেতে থাকার ক্ষমতা। আর এই পুরাতাত্ত্বিক কাঠামোগুলি তাদের বৈধতা বিধানকারী ক্ষমতাকে অর্জন করে মূলত অন্যান্য পুরাতত্ত্বগুলির সাথে সম্মিলিত হয়েই। আর্মস্ট্রং বিষয়গুলিকে একত্রিত ভাবে ‘mythomoteur’ বলে অভিহিত করেছেন। আর্মস্ট্রং এর মতে ‘mythomoteur’ শেষ পর্যন্ত একটি ‘পলিটি’-র প্রধান সাংগঠনিক পুরাণকথা বা ‘constitutive myth’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। 

তবে ‘নেশন’-এর নৃকৌলিক ভিত্তিকে খনন করে আনার প্রশ্নে সবচাইতে দীর্ঘ এবং মৌলিক কাজটি সম্ভবত করেন এম ডি স্মিথ। স্মিথ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, আধুনিক ‘নেশন’-এর স্বরূপকে অনুধাবনই করা যায় না, যদি প্রাক্অস্তিত্বশীল নৃকৌলিক উপাদানগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া না হয়। স্মিথ অবশ্য একথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন না যে, কিছু আধুনিক ‘নেশন’ ব্যবস্থায় সমৃদ্ধ নৃকৌলিক উত্তরাধিকারকে চিহ্নিত করা যায় না — তবে সেই জাতীয় দৃষ্টান্ত অত্যন্ত দুর্লভ। স্মিথের মতে, “usually there has been some ethnic basis for the construction of modern nation, be it only some dim memories and elements of culture and alleged ancestry which it is hoped to revive.”  (স্মিথ ১৭) [১৮] 

স্মিথ আসলে জাতীয়তাবাদ বিষয়ক ‘আদ্যবাদী’ (primordialist) এবং ‘আধুনিকতাবাদী’ (modernist) উভয় অবস্থানের সাধারণীকরণ প্রবণতার ঊর্ধ্বে জাতীয়তাবাদ এবং ‘নেশন’ সংক্রান্ত একটি চলনসই সংজ্ঞা দানের প্রয়াসে প্রবৃত্ত হন। কারণ তাঁর মতে, সমকালীন ‘নেশন’ সংক্রান্ত চর্চা (যেগুলি আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি আধুনিকতাবাদী প্রবনতার প্রতি ঝুঁকেছিল) ‘জাতীয়তা’ বা ‘নেশন’-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে ততখানি মাথা ঘামায়নি যতখানি মাথা ঘামিয়েছে ‘আধুনিক’ নেশন নিয়ে। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতকের পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকার জাতীয়তাবাদ এবং ‘নেশন’ ভাবনা নিয়ে। এমতাবস্থায় এই জাতীয় সান্দর্ভিক আলোচনা থেকে বাদ পড়ে গিয়েছে পৃথিবীর পূর্ব দিকের ইতিহাস। ইউরোপ কেন্দ্রিক বৌদ্ধিক চর্চার সীমায়নকে অতিক্রম করতে চেয়ে স্মিথ তাই ‘নেশন’ তথা তার ভিত্তিমূলে থাকা জাতীয়তাবাদী প্রবণতা বিষয়ে লিখেছেন, “nation is a named human population sharing an historic territory, common myths and historical memories, a mass, public culture, a common economy and common legal rights and duties for all members.” (স্মিথ ১৪) [১৯] 

‘নেশন’ সম্পর্কে স্মিথ এর এমন সংজ্ঞায়ন বিষয়টির অর্থাৎ নেশন-ভিত্তিক পরিচিতির জটিলতা তথা বিমূর্ততা বিষয়ে আমাদের সচেতন করে। একই সাথে সচেতন করে বিষয়টির বহুস্তরীয় চারিত্রিক গঠন বিষয়েও। স্মিথ নৃকৌলিক ‘অস্মিতা ভিত্তিক কৌম’ বা ‘ethnic’-এর (অর্থাৎ যেগুলিকে তিনি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন) কতগুলি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন যেমন — ‘গোষ্ঠীগত একটি বিশেষ নাম’ (collective proper name), ‘সাধারণ উত্তরাধিকার বিষয়ে পুরাকথণ’ (myth of common ancestry), ‘ঐতিহাসিক স্মৃতির সাধারণ উত্তরাধিকার’ (shared historical memories), ‘বিশিষ্ট স্বদেশভূমির সাথে শিকড় সম্বন্ধে স্থাপন’(shared historical memories) প্রভৃতি। আর এই বিষয়গুলিই আধুনিক ‘নেশন’-এর ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কিছু ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে বলেও তিনি মনে করেন। তাই জাতীয়তাবাদ তথা ‘নেশন’ ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে একটি আধুনিক বিষয় হিসেবে দেখার ক্ষেত্রে যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে সে বিষয়ে সরব হন স্মিথ। 

এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ পরিসরে ‘জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কিত আধুনিকতাবাদী অবস্থানগুলি আলোচনার প্রেক্ষিতে নৃকুলচিহ্নায়নবাদীদের এমত যুক্তিগুলিকে সংক্ষেপে আলোচনা করতেই হয়, কারণ এরা জাতীয়তাবাদীকে কেবল এক আধুনিকতাবাদী ‘উপসর্গ’ বলে চিহ্নিত করে না, একইসাথে ধারণাটির ‘অতীত যোগ’-কে তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে একটি স্পষ্টতর প্রেক্ষাপট নির্মাণে সহায়তা করেন। বিংশ শতাব্দীর সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে ‘জাতীয়তাবাদী’ চেতনার উৎস সন্ধানে যদিও আধুনিকতাবাদী তত্ত্বগুলি এক যুগান্তকারী তাত্ত্বিক ভূমিকা গ্রহণ করে, তথাপি সান্দর্ভিক স্তরে এর সীমাবদ্ধতাগুলিকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। স্মিথ এবং গেলনারের তত্ত্বে জাতীয়তাবাদের উৎস সন্ধানের প্রশ্নে যে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে — সেটি আজও তাই সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং চর্চিত। 

সূত্র নির্দেশ : 

১. C. Geertz (1993). ‘The Interpretation of Cultures : Selected Essays’, Basic Books, London : Fontana.

২. E.J Hobsbawm and T. Ranger (eds) (1983). ‘The Invention of Tradition’, Cambridge University Press, Cambridge.

৩. প্রাগুক্ত 

৪. প্রাগুক্ত 

৫. T. Nairn (1981). ‘The Break-up of Britain : Crisis and Neo-Nationalism’, Common Ground, London.

৬. A. D. Smith (1983). ‘Theories of Nationalism’, Holmes and Meier Publishers, London. 

৭. E.Gellner (1983). ‘Nations and Nationalism’, Blackwell Publishing Ltd, London.

৮. প্রাগুক্ত  

৯. প্রাগুক্ত 

১০. প্রাগুক্ত 

১১. B. Anderson (1983). ‘Imagined Communities : Reflection of the Origin and Spread of Nationalism’, Verso, London.

১২. প্রাগুক্ত

১৩. প্রাগুক্ত

১৪. প্রাগুক্ত

১৫. প্রাগুক্ত

১৬. প্রাগুক্ত

১৭. A. D. Smith (1995). ‘Nations and Nationalism in a Global Era’, Wiley, Cambridge.

১৮. প্রাগুক্ত

১৯. প্রাগুক্ত

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান