রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ বক্তৃতামালা ও আজকের ভারতবর্ষ

দেবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায় 

আজকের ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে চেষ্টার ত্রুটি নেই। সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে শিশু পাঠ্যপুস্তক, বলিউডের দুনিয়া থেকে ক্রিকেট মাঠের যুদ্ধ — জনপরিসরের সবক্ষেত্রেই নাগরিকদের জাতীয়তাবাদী হয়ে ওঠার ও অন্যদেরকে জাতীয়তাবাদী করে তোলবার প্রচেষ্টা অব্যাহত। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আবার সাম্প্রতিককালে যুক্ত হয়েছে বিশেষ এক শিবিরের রাজনৈতিক সক্রিয়তা। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি কখনও বা ক্রিকেট মাঠের পিচ খুঁড়ে দেওয়া হয়েছে, কখনও বা পাকিস্তানি গজল শিল্পীর অনুষ্ঠান বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, আবার কখনও বা গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রদের দিল্লির আদালত চত্বরের মধ্যেই শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছে। এখন তো সেই আক্রমণ তীব্রতর। ঘৃণা-বিদ্বেষে জারিত উগ্র অমানবিক বর্বরতাকে জাতীয়তাবাদের নামে প্রতিষ্ঠার এক প্রকাশ্য এক পরিকল্পিত চেষ্টা আজ দৃশ্যমান। রুচি খাদ্য সংস্কৃতি চিন্তা-চেতনায় নেমে আসছে সরকারি ফতোয়া। বলা হচ্ছে বশ্যতা মানো নতুবা দেশদ্রোহীর তকমা সহ পাকিস্তান চলে যাও। আর এইসব যাবতীয় কাজকর্মই করা হচ্ছে ‘জাতীয়তাবাদ’-এর নাম করে। এক্ষেত্রে ‘দেশের প্রতি ভালোবাসা’ আর ‘জাতীয়তাবাদ’-কে সমার্থক হিসেবে দেখিয়ে জাতীয়তাবাদকে যাবতীয় বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে এক পবিত্র, অলঙ্ঘ্য, সর্বজনীন ধারণা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে, মানবিকতা নয়,  জাতীয়তাবাদই হল একমাত্র আদর্শ যা সবাই মেনে নিতে বাধ্য। আমরা যারা এর বিরোধিতা করছি তারাও খানিক দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলছি, জাতীয়তাবাদ তত খারাপ নয়, খারাপ হল উগ্র জাতীয়তাবাদ। আসলে এক অজানা আতঙ্কে ভাবাদর্শ হিসাবে ‘জাতীয়তাবাদ’-কে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করবার সাহস আমরা পাচ্ছি না। এইরকম এক ভয়ের আবহে আমরা শরণাপন্ন হব রবীন্দ্রনাথের, ফিরে দেখব একশ বছরেরও বেশি সময় আগে দেওয়া তাঁর চারটি বক্তৃতাকে। দেখব দু-দুটো দেশের ‘জাতীয় সংগীত’ রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ কীভাবে জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছেন। কীভাবে তিনি বলছেন, জাতীয়তাবাদ হল ইউরোপীয় ধারণা এবং আমাদের মতো সমাজ-নির্ভর সভ্যতার কাছে জাতিরাষ্ট্র-নির্ভর জাতীয়তাবাদ মোটেই গ্রহণযোগ্য ভাবাদর্শ হতে পারে না। 

এক্ষেত্রে অবশ্য আলোচনা শুরুর আগেই একটা কথা বলে রাখা দরকার। রবীন্দ্রনাথ সর্বতোভাবে জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছিলেন — তার মানে কিন্তু এই নয় যে দেশকে, দেশের মানুষকে তিনি কারোর চেয়ে কম ভালোবাসতেন। জাতীয়তাবাদকে যখন তিনি ভাবাদর্শ হিসেবে অগ্রহণযোগ্য মনে করছেন, মনে করছেন জাতীয়তাবাদ হল দেশবন্দনার এক বিকৃত রূপ — তখনও কিন্তু তাঁর লেখায় দেশকে ভালোবাসার এক বিকল্প পথের আভাস তিনি দিয়ে চলেছেন। দেশকে ভালোবাসার সেই মানবিক ও বিকল্প পথ নিয়ে আলোচনা [১] এই প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা করব না। বরং এই প্রবন্ধে আমরা তাঁর ওই বক্তৃতাগুলোকে সামনে রেখে বুঝতে চেষ্টা করব জাতীয়তাবাদের প্রতি তাঁর সমালোচনাকে। 

দুই

আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি আগে, ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে চতুর্থবারের জন্য বিদেশ যাত্রা করলেন। এবারে তাঁর গন্তব্য জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই সফর চলাকালীন জাপানে দেওয়া তাঁর দুটি ভাষণ ‘দি মেসেজ অব ইন্ডিয়া টু জাপান’ ও ‘দি স্পিরিট অফ জাপান’ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া দুটি ভাষণ ‘দি কাল্ট অব ন্যাশনালিজম’ ও ‘ন্যাশনালিজম ইন ইন্ডিয়া’ – এই চারটি ভাষণকে একত্র করে পরের বছর প্রকাশিত হল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ন্যাশনালিজম’।[২] গ্রন্থে প্রথম দুটি বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত আকারে ‘ন্যাশনালিজম ইন জাপান’ নামে অন্তর্ভুক্ত হল। তৃতীয় বক্তৃতাটি অনেক অংশ বর্জিত ও নতুন অংশ সহ ‘ন্যশনালিজম ইন দি ওয়েস্ট’ শিরোনামে গ্রন্থভুক্ত হল। শেষ বক্তৃতাটি খানিক পরিবর্তন করতে চাইলেও সে সুযোগ আর রবীন্দ্রনাথ পেলেন না। ফলে সেটি অপরিবর্তিত অবস্থায় ওই নামেই গ্রন্থভুক্ত হল। এভাবেই গড়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থটি। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ নিছক শিল্প-সংস্কৃতি নয়, রাজনৈতিক দিক থেকে তুললেন জাতীয়তাবাদ নামক ভাবাদর্শের বৈধতার প্রশ্ন, ছুঁয়ে গেলেন ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার পারস্পরিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ। 

রবীন্দ্রচিন্তায় ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থটির তাৎপর্য কোথায় তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রামচন্দ্র গুহ যথার্থভাবেই বলেন, ওই সময়ে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ “…হয়ে উঠলেন এক পথপ্রদর্শক এবং সেই সূত্রে এক বি-তার্কিকও। বিভিন্ন দেশ ও সভ্যতা কীভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হবে এই প্রশ্ন নিরসনের সুবিস্তৃত পরিসর উন্মোচন করল ন্যাশনালিজম নামে ক্ষীণতনু পুস্তিকাটি।”[৩] প্রাচ্য-প্রতীচ্য — এই দুই সভ্যতার মধ্যেকার তুলনামূলক আলোচনা ও সম্ভাব্য কথোপকথন বিষয়ক রবীন্দ্রনাথের চিন্তা, যা ‘ন্যাশনালিজম’-এ ব্যক্ত হল তা আরও বিকশিত ও স্পষ্ট উচ্চারণে ধ্বনিত হল তাঁর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘ক্রিয়েটিভ ইউনিটি’ [৪] গ্রন্থের বেশ কিছু লেখায়। ‘ক্রিয়েটিভ ইউনিটি’-র ‘ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট’ [৫] প্রবন্ধটির উল্লেখ করে রামচন্দ্র গুহ আমাদের পরামর্শ দেন “এই বইটি পড়তে হবে ন্যাশনালিজমের উত্তরপাঠ হিসেবে, ঠিক যেভাবে একই নামে ১৯০৮ সালে লেখা প্রবন্ধটি পড়া যেতে পারে বইটির প্রাক্-কথন রূপে।”[৬] কিন্তু শুধু এখানেই থেমে না থেকে আমরা যদি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘জাপান-যাত্রী’ [৭] বা ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘টকস্ ইন চায়না’ [৮] — রচনাগুলিকে অখণ্ড বক্তব্য ধরে নিয়ে পড়তে থাকি, তবে আমরা দেখব পরিণত পর্বে রবীন্দ্রনাথের চোখে জাতীয়তাবাদ ইউরোপীয় আধুনিকতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ধারণামৌল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে এবং এই সমস্ত রচনাগুলিতে আধুনিকতার ওই ইউরোপীয় রূপটিকে বর্জন করে রবীন্দ্রনাথ এক বিকল্প আধুনিকতার আভাসও রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় ওই বিকল্প আধুনিকতার ধারণাটি কীভাবে বিকশিত হচ্ছিল এবং তাঁর জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত প্রথম জীবনের লেখাপত্র কীভাবে বিবর্তিত হতে হতে ‘ন্যাশনালিজম’-এ এসে উপনীত হল — এইসব আলোচনা অবশ্য এখানে আমরা করব না। আগেই বলেছি, আমরা আমাদের আলোচনার অভিমুখ সীমাবদ্ধ রাখব মূলত ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থটির ওপর। 

একথা ঠিক যে,  রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ বিষয়ক বক্তব্য কেবল তাঁর ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থ পাঠ করলে বোঝা সম্ভব হবে না। কারণ তিনি তাঁর বহু বাংলা প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, এমনকী কবিতা-উপন্যাসেও জাতীয়তাবাদ নিয়ে নিজের মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইংরাজিতে লিখিত বলে এই গ্রন্থটিই আন্তর্জাতিক মহলে জাতীয়তাবাদ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সবচাইতে জনপ্রিয় ও চর্চিত ভাষ্য হয়ে উঠেছে। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ মূলত দুটি স্তরে জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করবার কথা ঘোষণা করেছেন। প্রথমত, তিনি দেখিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মানবিকতার দিক দিয়ে বিচার করেও জাতীয়তাবাদকে গ্রহণযোগ্য ভাবাদর্শ হিসেবে স্বীকার করা যায় না। দ্বিতীয়ত, ভারতের নিজস্ব ইতিহাস, তার সহনশীল ঐতিহ্য, তার বহুত্ববাদী সংস্কৃতির কথা মাথায় রাখলে ভারতীয় সভ্যতার পরিপ্রেক্ষিতেও এই ইউরোপীয় ধারণাকে অনুকরণযোগ্য ভাবাদর্শ হিসেবে স্বীকার করা যায় না। 

এই কথাগুলি মাথায় রেখে এখন এই ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থটি পাঠ করতে গেলে আমরা দেখব এখানে রবীন্দ্রনাথ ‘নেশন’-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “যান্ত্রিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সংগঠিত করা হলে জনসমষ্টি যে সত্তা পরিগ্রহণ করে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমবায় অর্থে সেই সত্তাটিই নেশন”।[৯] তাঁর এ বক্তব্যে জোর পড়ে নেশনের ‘সংগঠিত’ ও ‘যান্ত্রিক’ — দিক দুটির উপর। লোভ ও স্বার্থের তীব্র দ্বন্দ্বসংঘাতই নেশনের যান্ত্রিক উদ্দেশ্য সাধনের মর্মকথা। পশ্চিমি নেশন ও নেশন-স্টেট একই সীমানাবেষ্টিত, ফলত বস্তুগত লোভ চরিতার্থ করার ও ক্ষমতা-দম্ভ প্রকাশ করার যান্ত্রিক উদ্দেশ্যে নির্মিত এই নেশন অনিবার্যভাবে আত্মদম্ভী রণ-উন্মত্ত হয়ে উঠতে বাধ্য। নেশনের পরম শত্রু হয়ে ওঠে আর-এক নেশন। আমার থেকে অন্য নেশন বড়ো হবে — তা ইউরোপের কোনও নেশন চায় না। ফলে ইউরোপীয় সভ্যতার মুখোশের আড়াল থেকে তার রক্তপিপাসু স্বরূপ আত্মপ্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “ইউরোপের মাটি থেকে অঙ্কুরিত হয়ে যে রাজনৈতিক সভ্যতা সারা পৃথিবী ছেয়ে ফেলছে, প্রবণতায় তা মাংসাশী এবং স্বগোত্রভোজী। অন্য জনগোষ্ঠীর সম্পদে তা পুষ্ট এবং সে তাদের গোটা ভবিষ্যৎটাকেই গিলে খেতে চায়।”[১০] শুধু তাই নয়, তিনি আরও বলেন, “নেশন না-হয়ে-ওঠা দেশগুলিতে পাশ্চাত্য সভ্যতার বাধাহীন প্রবাহ আটকানোর ক্ষেত্রে বাঁধের কাজ করে পশ্চিমী নেশন। কারণ সে-সভ্যতা ক্ষমতার সভ্যতা, সে কেবল তার নিজেরই জন্য; যাকে শোষণ করার জন্য বেছে নিয়েছে তার কাছে ক্ষমতার উৎসটিকে উন্মুক্ত করতে সে স্বভাবতই অনাগ্রহী।”[১১]

মানুষের লোভ-স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা, যান্ত্রিক উদ্দেশ্যে নির্মিত, ক্ষমতাদর্পী এই ভাবাদর্শকে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু মানব সভ্যতার চরম সত্য বলে মানতে রাজি নন। তিনি বলেন, “বহুজাতিকতার বর্ণহীন অস্পষ্টতা কিংবা জাতি-পূজার প্রবল আত্মরতি কোনোটিই মানব-ইতিহাসের লক্ষ্য নয়।”[১২] তিনি জানেন, বহুকাল ধরেই বিকলাঙ্গ মনুষ্যত্বের উপরই ‘নেশন’ গড়ে উঠেছে। কিন্তু স্বার্থপরতার উপর দেবত্ব আরোপ করলেও তার থেকে উদ্ভূত ঘৃণা ও লোভ, ভয় ও দ্বিচারিতা, সন্দেহ ও অত্যাচার — এগুলি কখনোই লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই রবীন্দ্রনাথ সুনিশ্চিত যে, “মানুষের উপর যাঁদের বিশ্বাস আছে, এই প্রবল প্রত্যাশায় ভর না করে তাঁদের উপায় নেই যে, নেশনের দানবিকতা আগেকার হিংস্র দাঁত ও নখ নিয়ে, দীর্ঘ প্রসারিত লৌহকঠিন হাত নিয়ে, উদরসর্বস্ব হৃদয়হীন বিপুল গহ্বর নিয়ে আর ফিরে আসবে না; বিমূর্ত অস্পষ্টতার কবল থেকে, ব্যক্তিচৈতন্যের স্বাধীনতায় মানুষের নবজন্ম হবে।”[১৩] 

পশ্চিমি জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “সত্য হল, পশ্চিমী ন্যাশনালিজমের উৎসমূল ও কেন্দ্রে আছে সংঘাত ও বিজয়ের মানসিকতা; সামাজিক সহযোগিতা তার ভিত্তি নয়। আধ্যাত্মিক আদর্শবাদ নয়, তা গড়ে তুলেছে ক্ষমতার নিখুঁত সংগঠন।”[১৪] ওই গ্রন্থেরই ‘ন্যাশনালিজম ইন ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু দাবি করলেন, “প্রকৃত ন্যাশনালিজমের ধারণা কখনো ভারতবর্ষে ছিল না। যদিও শৈশব থেকে আমাকে শেখানো হয়েছে মানবতা ও ঈশ্বরভক্তির থেকে নেশন নামের প্রতিমাটির পূজা মহত্তর। আমি বিশ্বাস করি সে-শিক্ষা আমি অতিক্রম করে এসেছি, এবং আমার দৃঢ় প্রত্যয়, মানবতার আদর্শ থেকেও দেশকে বড়ো করে দেখার পাঠ দেয় যে শিক্ষা, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে আমার স্বদেশবাসী প্রকৃত ভারতবর্ষকে ফিরে পাবে।”[১৫] আশিস নন্দী এ প্রসঙ্গে যথার্থভাবেই বলেন,[১৬] কোনও আধুনিক ভারতীয় যদি — জাতীয়তাবাদ ও নেশন-স্টেটের নীতিগুলিকে সর্বজনীন ও সার্বত্রিক বলে দাবি করেন — তবে তিনি অজান্তেই এ প্রশ্নে নিজেকে স্থাপন করেন গান্ধি ও রবীন্দ্রনাথের অবস্থানের বিপক্ষে। রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে এরূপ অবস্থান নেওয়া আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক কারণ, আশিস নন্দীর ভাষায় “আধুনিক ভারতে গান্ধি ছিলেন বহিরাগত, রবীন্দ্রনাথ অন্দরের বাসিন্দা। রবীন্দ্রনাথ ভারতের আধুনিক চৈতন্য গঠনে সহভাগী; তাঁর কন্ঠস্বর মূল্যবান। … তাঁকে অস্বীকার করলে ভারতের আধুনিক চৈতন্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে অস্বীকার করা হয়।”[১৭] 

আলোচনার এই সন্ধিক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠতে পারে। তা হল, রবীন্দ্রনাথ কি ‘ন্যাশনালিজম’ সম্পর্কে তাঁর এই ধারণাকে কেবলমাত্র ভারতবর্ষ, বা বৃত্তটাকে আর একটু প্রসারিত করলে, বিদেশি জাতিরাষ্ট্র দ্বারা শাসিত কোনও দেশীয় জনসমাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে দাবি করলেন? না কি তিনি যেকোনও জনসমাজের ক্ষেত্রেই বিষয়টি প্রযোজ্য বলে মনে করলেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শক্তির রাজনৈতিক কবলমুক্ত জাপানের শ্রোতৃমণ্ডলীর উদ্দেশে বললেন, “কেবলমাত্র পরাধীন জাতিগুলি নয়, আপনারা যাঁরা নিজেদের স্বাধীন ভাবার বিভ্রমের মধ্যে বাস করেন তাঁরাও, ন্যাশনালিজমের অন্ধ আসক্তির বশে প্রতিদিন মানবতা ও স্বাধীনতা বিসর্জন দিচ্ছেন।… একথা জেনে আমরাও সান্ত্বনা পাবো না যে, বর্তমান যুগে মানবতা শক্তিহীনতার যে অসুখে ভুগছে তা কেবল পরাধীন জাতিসমূহের মধ্যেই সীমিত নয়, তার ধ্বংসক্রিয়া সংগোপনে বাধাহীনভাবে আমূল ক্ষতি করছে সেই মানুষদেরও, যাঁরা নিজেদের স্বাধীন বলে বিশ্বাস করার সম্মোহনে আচ্ছন্ন।”[১৮] 

জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ ভাবাদর্শ শুধুমাত্র স্বাধীনতা এবং চিরন্তন মানবিক মূল্যবোধগুলিকেই বিনষ্ট করে না, আসলে নেশন-স্টেটের ধারণা এবং তার ভাবাদর্শগত ভিত্তি ‘জাতীয়তাবাদ’ এক ধরনের যান্ত্রিক স্বার্থসংকীর্ণ রাজনীতিরও সূত্রপাত ঘটায়, যেখানে পারস্পরিক ভীতি প্রদর্শনের দ্বারা নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন যে, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এই চরিত্রের সঙ্গে ভারতীয় ঐতিহ্যের এক গভীর বিরোধ আছে। কারণ অভিন্ন ভাবাদর্শের মধ্যে যাবতীয় বৈচিত্র্যের বিলোপ ঘটিয়ে সমসাত্ত্বিক ‘নেশন’ গঠনের জাতীয়তাবাদী প্রকল্পটি আসলে বহুত্ববাদী এবং বৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীল ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। নেশনের স্টিম্-রোলার চালিয়ে ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধূলিসাৎ করে সমসাত্ত্বিক ‘ভারতীয় নেশন’ গঠনের আজন্ম বিরোধী রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে রামচন্দ্র গুহ যথার্থভাবেই বলেন, “অন্য দেশপ্রেমিকদের মতো রবীন্দ্রনাথ ভারতের হিন্দু, উত্তর-ভারতীয়, উচ্চবর্ণ, ইত্যাদি কোনও বিশেষ সত্তাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে, সে-সত্তাটিকে জাতীয়তার মর্মমূলে স্থান দিতে, এবং অন্য সত্তাগুলি ওই বিশিষ্ট সত্তাটিকে মেনে চলুক, নিজেদের তার অধীনস্থ মনে করুক — এমন দাবি করতে অস্বীকার করেছিলেন। অধ্যাপক তনিকা সরকার যেমনটি উল্লেখ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয় ছিল ভারত ‘একটি কেন্দ্র-হীন দেশ ছিল এবং তাই-ই থাকবে’।”[১৯] আর সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করতে ভোলেন না, কীভাবে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে সেখানকার আদিম জনজাতিকে ইউরোপ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল। ইউরোপ ও ভারতবর্ষ – এই দুই সভ্যতার প্রতিতুলনা করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের আত্মসর্বস্বতা ও সম্পদ বৃদ্ধির ঝোঁকে অধীন জাতি অচিরেই লোপ পেয়েছে, এমনকী বর্তমান যুগেও সেই ধ্বংসের মনোভাব কাজ করছে। আর অন্যদিকে ভারতবর্ষ “প্রথমাবধি জাতিগত পার্থক্যগুলিকে মান্য করেছে এবং তার সমগ্র ইতিহাস জুড়ে এই সহিষ্ণুতার বোধ ক্রিয়াশীল।”[২০] ভারতের ইতিহাস স্বতন্ত্র,  তাই রবীন্দ্রনাথ সাবধান করে দেন, “আমরা অন্য দেশের ইতিহাস ধার করতে পারি না, এবং নিজের শ্বাসরোধ যদি করি তা হবে আত্মহত্যার সামিল, ভারতে এই মানসিকতায় আমাদের ঋদ্ধ হতে হবে। যাপনের অংশ নয় এমন কিছু যখন ধার করা হয়, তা তোমার জীবনকে বিধ্বস্ত করার কাজেই লাগে।”[২১] 

তিন 

একথা ঠিক যে, ভুলে যাওয়ার পক্ষে একশো বছর যথেষ্ট দীর্ঘ সময়। আর রবীন্দ্রনাথ তো আজ আমাদের কাছে নিছক একজন কবি, সাহিত্য প্রতিভা মাত্র। “বছরে তিরিশবার/ চিত্রাঙ্গদা আর/ শ্যামা-শাপমোচনের অশ্রুমোচন/ সব আমাদের জন্য।” রবীন্দ্রনাথের দর্শন, তাঁর শিক্ষাভাবনা, তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তা — সবই আমরা বিস্মৃত হয়েছি অনেকদিন। জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাঁর সাবধান বাণী যে আমাদের মনে থাকবে না — তা আর আলাদা করে বলবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আজকের এই গভীর অন্ধকারে হয়তো তিনি পারেন আমাদের পথ দেখাতে। তাই আমাদের নিজেদের গরজেই আজ শতবর্ষ পরে ‘ন্যাশনালিজম’ গ্রন্থটি নতুন করে পড়া দরকার। পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষ মানবিকতার খাতিরে নিজের দেশে জাতীয়তাবাদের ও জাতি–রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছেন। নিজের রাষ্ট্র যা কিছু করে তাই সমর্থনযোগ্য — এ পথের পথিক হতে তাঁরা নারাজ। তাই তো, পরাধীন ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার দাবিতে কোনও কোনও ব্রিটিশও গলা মেলান। তাই তো, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় বেশকিছু মার্কিন তরুণ-তরুণী এ প্রশ্নে সরাসরি নিজেদের রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন। এরকম বহু নজির ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর দেশে দেশে। জাতীয়-রাষ্ট্রের চোখে হয়তো এঁরা রাষ্ট্রবিরোধী, দেশদ্রোহী, জাতীয়তাবাদী নন। কিন্তু মানবিকতার প্রেক্ষিতে এঁরা কী আমাদের চোখে যথেষ্ট শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন না? তাই জাতীয়তাবাদ নয়, মানবিকতাই অনেক উচ্চ আদর্শ — এ সত্য আজ দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করার সময় এসেছে। অবশ্য তা ঘোষণা করবার সময়ও আমাদের মনে পড়ে রম্যাঁ রলাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথেরই আর-একটি মূল্যবান কথা, “আমাদের রক্ষা করে যে সত্য, তা স্বল্পজনের কণ্ঠেই ধ্বনিত হয় এবং অধিকাংশ তাকে প্রত্যাখ্যান করে আর তাদের ব্যর্থতার মূল্যেই সত্য জয়ী হয়।”[২২] 

———————————— 

(উদ্ধৃতিগুলি অনূদিত।)

তথ্যসূত্র : 

১) আশিস নন্দীর মতো চিন্তাবিদরা রবীন্দ্রনাথের দেশ ভাবনার পথটিকে জাতীয়তাবাদের (ন্যাশনালিজম) থেকে পৃথক করে স্বদেশপ্রেম (প্যাট্রিয়াটিজম) নামে চিহ্নিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত ধ্যান-ধারণার বিবর্তন, এ প্রসঙ্গে গান্ধির সঙ্গে তাঁর বিতর্ক, জাতীয়তাবাদের সঙ্গে স্বদেশপ্রেমের পার্থক্য, ইত্যাদি নানা আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে অন্যত্র বিশদে আলোচনা করবার চেষ্টা করেছি। উৎসাহী পাঠক দেখতে পারেন – দেবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ বিরোধী স্বদেশপ্রেম’, সেতু প্রকাশনী, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০১৯।

২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ন্যাশনালিজম’, দি ইংলিশ রাইটিংস অব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভলিউম টু, এডিটেড বাই শিশিরকুমার দাস, সাহিত্য একাডেমি, নিউ দিল্লি (২০০৪), পৃ. ৪১৭-৪৬৬। এই গ্রন্থটি সম্প্রতি বাংলাতে অনূদিত হয়েছে। উৎসাহী পাঠক দেখতে পারেন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘জাতীয়তাবাদ’, অনুবাদ ও সম্পাদনা — অশোককুমার মুখোপাধ্যায় ও কৃত্যপ্রিয় ঘোষ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ২০১২।

৩) রামচন্দ্র গুহ, ‘ইন্ট্রোডাকশন’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ন্যাশনালিজম, নিউ দিল্লি, পেঙ্গুইন বুকস,২০০৯, p. xxxiii-xxxiv.

৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ক্রিয়েটিভ ইউনিটি’,  দি ইংলিশ রাইটিংস অব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভলিউম টু, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৯৩-৫৬৯।

৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট’, ক্রিয়েটিভ ইউনিটি, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৩০-৫৩৭।

৬) রামচন্দ্র গুহ, ‘ইনট্রোডাকশন’, পূর্বোক্ত,  পৃ. xxxiv.

৭) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘জাপান যাত্রী’ রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বাদশ খন্ড, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৮৯, পৃ. ১৪৫-২০৬।

৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘টকস্ ইন চায়না’,  দি ইংলিশ রাইটিংস অব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভলিউম টু, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৭১-৬৮৬।

৯) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ন্যাশনালিজম’, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪২১। 

১০) উপরোক্ত, পৃ. ৪৪০।

১১) উপরোক্ত, পৃ. ৪২৬।

১২) উপরোক্ত, পৃ. ৪১৯।

১৩) উপরোক্ত, পৃ. ৪৩৫।

১৪) উপরোক্ত, পৃ. ৪২৬।

১৫) উপরোক্ত, পৃ. ৪৫৬।

১৬) আশিস নন্দী, ‘দি ইললেজিটিমেসি অব ন্যাশনালিজম : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অ্যান্ড দি পলিটিক্স অব সেল্ফ’, রিটার্ন ফ্রম একজাইল, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, নিউ দিল্লি, ১৯৯৮, (প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৪)। পৃ. ১-৮। প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, আশিস নন্দীর এই চমৎকার গ্রন্থটি সম্প্রতি বাংলাতে অনূদিত হয়েছে। উৎসাহী পাঠক দেখতে পারেন : আশিস নন্দী, ‘জাতীয়তাবাদ ও ভারত চিন্তা’, সজল বসু সম্পাদিত, কলকাতা বুক পোস্ট পাবলিকেশন, ২০১৪।

১৭) উপরোক্ত, পৃ. ৪।

১৮) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ন্যাশনালিজম’, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪২৭-৪২৮।

১৯) রামচন্দ্র গুহ, ‘ইন্ট্রোডাকশন’, পূর্বোক্ত, পৃ. ১।

২০) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ন্যাশনালিজম’, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৫৯।

২১) উপরোক্ত, পৃ. ৪৫৬-৪৫৭।

২২) প্রশান্তকুমার পাল, ‘রবিজীবনী’, সপ্তম খণ্ড, কলকাতা, আনন্দ, ২০০২, পৃ. ৪২৭।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান