রেনেসাঁস : আন্তর্জাতীয়তা ও জাতীয়তা

শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায় 

যে দেশ উপনিবেশবাদ কবলিত সে দেশে রেনেসাঁস হবে কি করে? [১] এই উত্তরগর্ভ প্রশ্নে জর্জরিত ছিল আমাদের উনিশ শতক বিচার। বক্তব্য ছিল, ইতালিতে রেনেসাঁস হতে পেরেছিল তার কারণ অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক দিক থেকে সে দেশ ছিল স্বয়ম্ভর, স্বাধীন। কোনও বহিরাগত দমন-পীড়ন বা আভ্যন্তর ক্ষয় তাদের কুড়ে কুড়ে খায়নি। চাঁদ বণিকের পালায় উচ্চারিত বল্লভের সংলাপ ধার করে এর উত্তর দেওয়া যায় — “ইতিহাস খুল্যে দেখো, … ভুল, ভুল, মহাভুল কর‍্যাছি তখন।”[২] 

প্রথমে আসি ইতালীয় রেনেসাঁসের প্রসঙ্গে। চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর ইতালি সেই অর্থে কোনও দেশই ছিল না। দুর্গ প্রাকার বেষ্টিত একগুচ্ছ নগররাষ্ট্রের সমাহার মাত্র। বিভিন্ন প্রতাপশালী বংশের পরস্পর বিবদমানতার অস্থির আবর্ত। জে. এ. সাইমন্ডসের ভাষায় ‘এজ অফ ডিসপট’।[৩] উইল ডুরান্ট তখনকার ইতালিকে চিত্রিত করেছেন এই ভাষায়, “a loose bundle of a petty states”।[৪] “ইতালি শতধা বিচ্ছিন্ন হয়ে ঐক্যের জন্য একজন বিজেতার অপেক্ষায় ছিল”।[৪] মেকিয়া ভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) ইতালির রাজনৈতিক অবস্থা চিত্রিত করতে গিয়ে বলেছেন, “ইতালীয়দের অবস্থা হিব্রুভাষীদের চেয়ে দাসত্বপূর্ণ, পারসিকদের চেয়ে অত্যাচারিত ও এথেনীয়দের তুলনায় ছন্নছাড়া ও বিশৃঙ্খল”।[৫] ইতালি ছিল বিদেশিদের কাছে আধা পদানত। দক্ষিণ ইতালি হয়েছিল স্পেনের অধীন ও উত্তর ইতালি ফ্রান্সের। ঐতিহাসিক গুইচারদিনি (১৪৮৩-১৫৪০) মৃত্যুর আগে তিনটি জিনিস দেখে যেতে চেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি “বর্বর আক্রমণকারীদের হাত থেকে ইতালির মুক্তি”।[৬] বলা বাহুল্য তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ হয়নি। রেনেসাঁসের ইতালি ক্রমশ বহিরাক্রমণকারীদের কাছে পদানতির দিকেই এগিয়ে গিয়েছিল। 

তার আভ্যন্তর অবস্থা কেমন ছিল তা অনুধাবন করার জন্য ফ্রাঙ্ক স্পটনিজ ও নিকোলাস মেয়ের নির্মিত তিনটি পর্বে বিন্যস্ত ‘মেদিচি : মাস্টার্স অব ফ্লোরেন্স’ ও ‘মেদিচি : দি ম্যাগনিফিসিয়েন্ট’ ফিল্মটি দেখা যেতে পারে।[৭] চার্চ, মার্চেন্ট ও প্রিন্স — এই ত্রয়ীর বিরামহীন সংঘাতে দুলছিল ফ্লোরেন্স, রোম এবং অন্যান্য নগর রাষ্ট্রগুলি। সুস্থিতি ও নিশ্চয়তা বলে কিছু ছিল না। 

অর্থনৈতিক অবস্থা? বিখ্যাত ‘লোপেজ থিয়োরি’ পড়লে দেখতে পাবেন ১৩৪৮ সালের ব্ল্যাক ডেথের পর ইতালির অর্থনৈতিক অবস্থা নিদারুণ সংকটের মধ্যে পড়ে।[৮] ‘হার্ড টাইম অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট’ ও ‘ইকোনমিক ডিপ্রেশন অব দ্য রেনেসাঁস’ নামক গবেষণাভিত্তিক নিবন্ধে লোপেজ ও মিসকিমিন দেখিয়েছেন — “After 1348 the Italian economy entered upon an unchecked downward spiral for several centuries”।[৯] অ্যান্টনি মালহো তাঁর ‘সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক ফাউন্ডেশন অব দি ইতালিয়ান রেনেসাঁস’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, “During the Renaissance many merchants were less busy, or at least thought they could spare more time for culture.”[১০] অর্থনৈতিক মন্দায় পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল ইতালির বণিকরা। রাষ্ট্রনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাষ্ট্রীয় অনৈক্য, অর্থনৈতিক অলসতা ও নিম্নমুখিতা সত্ত্বেও সেখানে রেনেসাঁস হতে অসুবিধা হয়নি। ইতালির কথা আরও সবিস্তারে আনা যেত। কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। মূলকথা এই যে রেনেসাঁসের জন্য আদর্শ স্থিতিশীল বলিষ্ঠ ও স্বয়ম্ভর দেশ-পরিবেশ প্রয়োজন বলে আমাদের চিন্তকরা যে রায় দিয়েছিলেন ও সেই দেশ-পরিবেশ এখানে নেই সুতরাং রেনেসাঁস এখানে হতে পারে না বলে আফসোস করেছিলেন তা ছিল ‘মহাভুল’। 

বস্তুতপক্ষে প্রতিকূলতা পূর্ণ পরিবেশ অনেক সময় আত্ম পরাক্রম প্রকাশের সহায়ক হয়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া আক্রান্ত একটা বিড়ালও সর্বেন্দ্রিয় সজাগ বাঘিনি হয়ে উঠতে পারে। ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির প্রতিকূলতা আমাদের আত্মপ্রকাশকে সুতীক্ষ্ণ ও প্রোজ্জ্বল করে তোলেনি একথা কে বলবে? সেই প্রসঙ্গে আসার আগে রেনেসাঁসের মূল প্রাণবায়ু কী ছিল তা একটু জেনে নেব।  

অনেকের ধারণা আছে জাতীয়তার আবেগ বা স্বাজাত্যভিমানের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষা রেনেসাঁসের মূল মন্ত্র। ইতালির রেনেসাঁসের দিকে তাকালে তার কোনও হদিস মেলে না। বরং দেখা যায় সর্ব পরিচয় ও সর্ব সংস্কারমুক্ত মানবিক পরিচয়কেই তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। আত্মমুখী জাতীয়তা নয়, বিশ্বমুখী মানবতায় তারা উত্তীর্ণ হতে চেয়েছিলেন। তাদের বিদ্যাচর্চা ও শিল্পচর্চায় সেই আদরাই ধরা পড়েছে। ‘প্রিন্স অব রেনেসাঁস হিউম্যানিজম’ আখ্যাত এরাজমুস বলেছিলেন, যে দেশে ভালো লাইব্রেরি আছে সেই দেশই তাঁর স্বদেশ। শিক্ষিত মানুষের স্বদেশ বা স্বভূমি বলে কিছু নেই। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বা রাফায়েলের তুলিতে যে রূপ-সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে তা রাষ্ট্রিক ভূগোল নিরপেক্ষ। ‘মোনালিসা’ বা ‘স্কুল অব এথেন্স’ শুধু ইতালির নয় গোটা বিশ্বের। বস্তুতপক্ষে জাতীয়তাবাদ নয়, বৈশ্বিকতাই ছিল তাঁদের অভিমন্ত্র। “Instead of patriotism the Italians were inflamed with the zeals of cosmopolitan.”[১১] সকলেই জানেন ইউরোপে রেনেসাঁসের পর হয়েছিল রিফর্মেশন। ইতালিতে হয়েছিল রেনেসাঁস, মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে জার্মানিতে হয় রিফর্মেশন। বিশুদ্ধ মানবতাবাদের অভিমুখ ছিল রেনেসাঁসে। সেই অভিমুখকে ধর্মীয় শুদ্ধতার দিকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল রিফর্মেশন। রেনেসাঁসে ছিল বৈশ্বিকতার চর্চা, রিফর্মেশন আঁকড়ে ধরেছিল জাতীয়তাবাদের ও জাতিত্ববাদের ধ্বজা। রেনেসাঁসে যার বিন্দুবিসর্গ ছিল না। মার্টিন লুথার তাঁর ‘এড্রেস টু দি জার্মান নোবলিটি’ (১৫১৭) রচনায় জার্মান জাতীয়তাবাদের স্বর উচ্চগ্রাম করে দেন।[১২] রাফায়েল যখন ‘স্কুল অব এথেন্স’ এঁকেছিলেন তখন গ্রিক দার্শনিকদের সাদরে বরণ করেছিলেন। ভিনদেশি বলে তাঁদের ব্রাত্য করে রাখেননি আর লুথার এর চ্যালা হুটেন তাঁর ‘দি রোমান ট্রিনিটি’-তে যে বিদ্বেষবিষ ছড়িয়েছেন তার স্বরূপ এই রকম — “Three ills I pray for Rome : Pestilence, Famine and War. This be my Trinity.” [১৩] জাতিবাদের সংকীর্ণতা প্রকট হয়ে ওঠে রিফর্মেশনের সংস্কৃতিতে। 

ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও রিফর্মেশনের এই প্রেক্ষিতটি উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁসের গতিপ্রকৃতি বুঝতে সহায়ক হবে ভেবে প্রেক্ষিতটি স্পষ্ট করা হল। 

বঙ্গীয় রেনেসাঁস রামমোহন থেকেই মানবতাবাদের চর্চায় মনোনিবেশ করে। মানুষের সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা সাধ্য-সাধনা নিয়ে তার মাথা ঘামানো। শাস্ত্র ও দেশাচারের জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষকে মুক্ত করার দিশায় তার পথ চলা। জ্ঞানের চর্চায়, বোধের চর্চায়, অনুভবের চর্চায় যা কিছু বাধা তাকে দূরীভূত করার সংকল্পে সে টানটান করে বাঁধে তার কর্মসূচি। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও আমাদের জীবনকে সামাজিক অচলতা থেকে মুক্ত করার প্রকল্পে সক্রিয় হয়ে ওঠেন প্রথম থেকেই। 

এই সঙ্গে এটাও জানানো দরকার সকলপ্রকার সংকীর্ণ জাতিবাদ থেকে মুক্ত ছিল তাঁদের মন। রামমোহন ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক হয়েও সেই ধর্মের যে ন্যাসপত্র রচনা করেছিলেন তাতে কোনও প্রত্যাখ্যান ছিল না। অপরকে অগ্রাহ্য বা হেয় করে নিজেকে মহতোমহীয়ান রূপে প্রতিষ্ঠিত করার একপেশেমি ছিল না ধর্মীয় সংবিধানে। তাঁর জীবনীকার লিখেছেন, “Brother, our religion is universal”[১৪] — এই কথাটি বলতে বলতে তাঁর চোখ অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠত। ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক পটভূমিকায় তিনি কেবলমাত্র বৈদান্তিক হিন্দু ছিলেন না, ইসলাম ধর্ম ও একাত্মবাদী খ্রিস্টান ধর্মের চর্চাতেও তিনি পারঙ্গম ব্যক্তি ছিলেন। ফরাসি বিদেশমন্ত্রকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “All mankind are one great family of which numerous nations and tribes existing are only various branches.” [১৫] 

তিনি শুধু প্রাচীন ভারতীয় বিদ্যার পুনরুদ্ধারের কাজ করেননি, আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাকেও স্বাগত জানিয়েছিলেন মুক্তমনে।[১৬] কোনও সন্দেহ নেই বঙ্গীয় রেনেসাঁসের সূচনাকালেই রামমোহন আন্তর্জাতিকতাবাদের ছিলাটিকে টানটান করে বেঁধেছিলেন। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত পণ্ডিত হলেও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য বিদ্যার পাঠ্যক্রমকে প্রয়োজন মতো সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যক্রম রচনায় সংযোজিত করতে দ্বিধা করেননি।[১৭] ব্যালেন্টাইনের সঙ্গে এ নিয়ে যে বাদানুবাদ হয়েছিল তা অনুধাবন করলে দেখা যায় তিনি সেই রক্ষণশীল দেশাভিমানি পণ্ডিতদের মধ্যে পড়েন না যাঁরা মনে করতেন সর্বোচ্চ সত্য দেশীয় প্রাচীন শাস্ত্রে নিঃশেষে বলা হয়ে গেছে আর নতুন কিছু পাশ্চাত্য বিজ্ঞান-দর্শন থেকে নেবার নেই।[১৮] জ্ঞানের কোনও দেশ কাল নেই। যা সত্য তা মুক্তমনে গ্রহণ করতে হবে। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও স্বল্পায়ু হলেও তাঁর বছর পাঁচেকের শিক্ষক জীবনে ভারতীয় ছাত্রদের মনে ও মননে জিজ্ঞাসার ঝড় তুলেছিলেন। দেশীয় সামাজিক রীতিনীতির অবশ্যপাল্য আচারনিষ্ঠতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলেন অবাধ পাশ্চাত্য দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাস-সাহিত্য চর্চার আগ্রহ উসকে দিয়ে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর টপকে গিয়েছিলেন দেশীয় সংস্কৃতির বর্ডার লাইন। বাণিজ্যে, জীবনচর্যায়, শিল্প স্থাপনে তিনি আক্ষরিক অর্থেই মেলবন্ধন ঘটাতে তৎপর ছিলেন দেশীয় উদ্যোগের সঙ্গে বিলিতি কৃৎকৌশল। অক্ষয় কুমার দত্ত ‘বিশ্বরূপ মূল গ্রন্থে’র নিবিষ্ট পাঠক। তাঁর ধাত ছিল বিজ্ঞানের। প্রকৃতি ও মানব সমাজকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন জ্ঞানচক্ষু দিয়ে। জ্ঞান চরিত্রগতভাবে জাতি ও দেশ পরিচয় নিরপেক্ষ। দর্শন চর্চাতেও তিনি কোনও দেশীয়তাকে মানেননি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর খাড়া নজর ছিল। মাইকেল ছিলেন সাত সমুদ্রের সিন্দবাদকল্প নাবিক। গ্রিক, লাতিন, ইতালীয়, ফরাসি, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। বাংলা নাটক, মহাকাব্য, পত্রকাব্য, অমিত্রাক্ষর ছন্দ, চতুর্দশপদী কবিতা তিনি রচনা করেছেন দেশি-বিদেশি সাহিত্যাদর্শ মিলিয়ে। লিখেছেন — 

“যদি ভাষা শুদ্ধ, ভাবাবেগ হৃদয়গ্রাহী, বৃত্তান্ত আকর্ষণীয় এবং চরিত্রগুলি খাঁটি হয় তবে বিজাতীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অর্থ হয় না। তুমি কি মূরের কাব্য অপছন্দ কর তার প্রাচ্যত্বের জন্য; বায়রনের কাব্য তার এশীয় আবহের জন্য; অথবা কার্লাইলের গদ্য তার জার্মানত্বের জন্য?” [১৯] 

প্রসঙ্গটি আর বিস্তারিত না করলেও চলে। আমাদের মূল কথা বলা হয়ে গেছে। রেনেসাঁসের সংস্কৃতি প্রকৃতিগতভাবে জাতীয়তাবাদী নয়, কসমোপলিটান — বঙ্গীয় রেনেসাঁসে তা শুরু থেকেই ছিল। বৈশ্বিকতা বা আন্তর্জাতিকতাবাদের এই ঐতিহ্য রবীন্দ্রনাথে পৌঁছে সামুদ্রিক ব্যাপ্তি লাভ করেছিল। 

“আমি পৃথিবীর কবি                                                                                                                যেথা তার যত ওঠে ধ্বনি                                                                                                         আমার বাঁশির সুরে                                                                                                                  সাড়া তার জাগিবে তখনি।” [২০] 

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে রামমোহনের সৌজন্যে সূচিত বঙ্গীয় রেনেসাঁসের মূল চালিকা সূত্র ছিল বৈশ্বিকতা বা আন্তর্জাতিকতাবাদ। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রেনেসাঁসের মধ্যে অঙ্কুরিত হয় রিফর্মেশনের চারিত্র‍্য। নব্য হিন্দুত্ববাদের সেই উত্থান-সময়ে ঝোঁক পড়ে ধর্মের দিকে। স্বদেশ ও স্বধর্ম একাকার হয়ে যায়। ঠিক জার্মানিতে যেমন হয়েছিল এখানেও স্বাজাত্যভিমান প্রবলভাবে মাথা তুলতে শুরু করে। বঙ্কিমেই প্রথম ফুঁসে ওঠে অভিমানিনী প্রাচ্য।[২১] গ্রাম থেকে এসে গদাধর চাটুজ্যে ভবতারিণীর মন্দিরে ঢুকে হয়ে যান রামকৃষ্ণ দেব।[২২] মাথায় পাগড়ি পরা ডেপুটি বা ঊর্ধ্বাঙ্গে উত্তরীয় জড়ানো বিদ্যাসাগর সবার কাছেই গিয়েছিলেন তিনি, নাইটিঙ্গেলের গান শুনে একজনকেই পেড়ে ফেলতে পেরেছিলেন তিনি বিবেকানন্দ।[২৩] হেস্টির প্ররোচনায় নরেন্দ্রনাথ দত্ত হয়ে তিনি ঢুকলেন বের হলেন বিবেকানন্দ হয়ে। রেনেসাঁসের ফুল রাখা হল রিফর্মেশনের ফুলদানিতে।[২৪] 

মেলায়, মহোৎসবে, রাজনীতিতে, ধর্মে, সাহিত্যে ফুটে বেরোতে লাগল উদ্দীপিত দেশাভিমান। রেনেসাঁসের বিশ্ববোধ ও রিফর্মেশনের জাতীয়তাবোধ— এই দুয়ের সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে টেনে বাঁধা সহজ কাজ ছিল না। অলোকসামান্য প্রতিভার অধিকার বলে রবীন্দ্রনাথ সেটি সম্পন্ন করেছিলেন। স্বাজাত্যবোধের উগ্র অভিমান একটি জাতিকে যেমন গৌরবস্ফীত করে তেমনি সংকীর্ণ করে। অপরাপর জাতি-ধর্ম এমনকি বিদ্যা সম্পর্কেও একটা প্রত্যাখ্যান ধর্মী আবেগ উৎকট হয়ে ওঠে। বাইরের আলোককে বহিষ্কৃত করে নিজের ঘরের অন্ধকারকে পূজা করার ধুম লেগে যায়। রবীন্দ্রনাথ রেনেসাঁসের অক্ষয় উত্তরাধিকার বলে স্পষ্ট করে ঘোষণা করেন — “Nationalism হচ্ছে একটা ভৌগোলিক অপদেবতা, পৃথিবী সেই ভূতের উপদ্রবে কম্পান্বিত; সেই ভূত ঝাড়বার দিন এসেছে।”[২৫] বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার এমন একটি কেন্দ্র স্থাপন করা যেখানে ভারতবর্ষের হয়ে সমস্ত পৃথিবীকে আমন্ত্রণের দ্বার উন্মুক্ত থাকবে। 

এই গেল বঙ্গীয় রেনেসাঁস কীভাবে তালফেরতা নদীর মতো রামমোহন থেকে উৎসারিত হয়ে রবীন্দ্রসঙ্গমে এসে মিশেছিল তার মানচিত্র বা খতিয়ান। 

এখন আসা যাক বঙ্গীয় রেনেসাঁসের সারকথায়। তার প্রধান অ্যাজেন্ডা কী ছিল? কোন লক্ষ্যে ঘটেছিল তার ঐতিহাসিক উত্থান? আমি মনে করি উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁস একটা মোকাবিলার নাটক। প্রবল পরাক্রমশালী একটা সভ্যতা যখন উপনিবেশবাদের হাত ধরে আমাদের ঘাড়ের উপর এসে পড়ল তখন যথাযথভাবে তার মোকাবিলা করা দরকার হয়ে পড়েছিল। একদল মনে করেছিলেন, খারাপ ভালো নির্বিশেষে আমাদের যা কিছু আছে তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হবে। এঁরা ছিলেন সংরক্ষণবাদী। আর একদল ভেবেছিলেন খারাপ ভালো নির্বিচারে পশ্চিমি সভ্যতার যা কিছু আছে তার পায়ে নিঃশেষে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এই সংকট থেকে মুক্তির দিশা রচনা করে রেনেসাঁস। রেনেসাঁসের দিশারিরা এক্ষেত্রে অবলম্বন করেন দুটি সূত্র — পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আলোকিত দিকগুলির পরিগ্রহণ ও প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিবাচক জ্ঞানরাজির পুনরুদ্ধার। সুনির্বাচিত পরিগ্রহণ ও পুনরুদ্ধার দিয়ে সংগ্রথিত পথ দিয়েই জাতি পৌঁছেছে আত্মগঠন ও আত্মপ্রকাশের বিশ্বমান্য লক্ষ্যে। 

রেনেসাঁস আমাদের দিয়েছে অভ্রংলিহ সেইসব মননশীল ও সিসৃক্ষু প্রতিভাধরদের যাঁরা নির্মাণ করেছেন আমাদের মানসিক স্থাপত্য, সৃজনসুন্দর অক্ষরপ্রতিমা। প্রতিভার এই পর্বতমালা গোটা উনিশ শতকের মানচিত্রে যেভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে তা একটি জাতির জীবনে কদাচ দেখা যায়। ভারতপথিক রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, নব্যবঙ্গের দীক্ষাগুরু হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, বৈজ্ঞানিক মনুষ্যত্বের পরাকাষ্ঠা অক্ষয় কুমার দত্ত, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ভোরের পাখি বিহারীলাল চক্রবর্তী, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, রামকৃষ্ণ পরমহংস, বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। রেনেসাঁসের স্বধর্মই হচ্ছে একই দেশে সংক্ষিপ্ত সময়কালের মধ্যে অসাধারণ মননশীল ও সৃজনশীল প্রতিভার উত্থান। এই জিনিস ইতালিতে দেখা গিয়েছিল উনিশ শতকের বাংলাতেও দেখা গেল। ভূবিজ্ঞানে আছে ভাসমান মহাদেশের টেকটনিক প্লেট অন্য একটি মহাদেশের টেকটনিক প্লেটে এসে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করলে ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি হয়।[২৬] সমতল ছেড়ে অনেক উঁচুতে উঠে যায় পর্বত শৃঙ্গগুলি। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এটা ঘটে। পাশ্চাত্য সভ্যতার টেকটনিক প্লেট যখন এদেশীয় টেকটনিক প্লেটে এসে আঘাত করে সেই সাংঘাতিক (সংঘাত + ষ্ণিক) সময়পর্বে এদেশে উত্থান ঘটে ভঙ্গিল পর্বতের মতো অভ্রংলিহ প্রতিভার শৃঙ্গ মালার। এ ধরনের প্রতিভার মিছিল কোনও জাতির জীবনে যখন তখন আসে না। এঁরা রেনেসাঁসের সৃষ্টি, এঁরা রেনেসাঁসের স্রষ্টাও। প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সংগ্রাম ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা যুক্ত নেতৃত্বদানকারী যোদ্ধৃ প্রতিভার দরকার পড়ে। আমাদের রেনেসাঁস-ম্যানরা এসেছিলেন সেই কর্তব্য পালনের কাজে। এঁরা সময়ের সৃষ্টি ও স্রষ্টা। দ্বান্দ্বিক সময়ের হৃদয় মন্থন করে এঁদের উত্থান। রেনেসাঁস যদি মোকাবিলার নাটক হয় এঁরা তার প্রধান কুশীলব। 

ইতিহাসের সেই মহা সন্ধিক্ষণে কী কাজ এঁদের? এটা বোঝানোর জন্য আমরা ফুটবল খেলার চিত্রকল্প আনব। প্রবল পরাক্রান্ত একটি ফুটবল দলের সঙ্গে খেলা ছিল আমাদের। নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ ও সুদক্ষ ঔপনিবেশিক শক্তির মুখোমুখি হলে দুটি পরিণাম ঘটতে পারে। হয় আত্মবিলয় নয় আত্মপ্রতিষ্ঠা। পৃথিবীতে অনেক দেশ বা জাতি ঔপনিবেশিক শক্তির মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে হারিয়ে গেছে সে দৃষ্টান্ত বিরল নয়। আমরা কিন্তু হারিয়ে যাইনি। কীভাবে আমরা শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম সে আলোচনা আগে করেছি। দুই সভ্যতার গুণাগুণ দিয়ে আমরা রচনা করেছিলাম আমাদের চলন পথ, ক্রীড়াশৈলী। রামমোহন থেকে সেই খেলার সূচনা। তিনি উপনিষদের অনুবাদ করলেন আর আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাকে আহ্বান জানালেন। সেখান থেকে খেলা শুরু। তাঁর সামনে ছিলেন বিদ্যাসাগর ও ডিরোজিও। একজন কর্ষণ করলেন প্রাচীন ভারতীয় বিদ্যার অন্যজন আকর্ষণ করলেন পাশ্চাত্য বিদ্যাকে। এই পুনরুদ্ধার ও পরিগ্রহণের প্রকল্প থেকেই বিদ্যাসাগর ও মাইকেলের অগ্রগতি। বাঙালির আত্মপ্রকাশের প্রধান ক্ষেত্র সাহিত্য।[২৭] একজন হলেন বাংলাগদ্যের জনক,  অন্যজন নবযুগের কবি। মনন ও সৃজনের এই নির্মাণ ও দেওয়া-নেওয়া নিয়ে তাঁরা এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। খেলা মাঝমাঠ অতিক্রম করে প্রবেশ করল প্রতিপক্ষের সীমানায়। দু-দিক থেকে গড়ে তোলা আত্মনির্মাণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার খেলা প্রতিপক্ষের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে বঙ্কিমচন্দ্রে এসে। দোলাচলতা ও ভ্রান্তিও খেলারই অংশ। এক সময় দেখা গেল যে দেশের দুর্বলতা ছিল উপহাস ও করুণার বিষয় — অশিক্ষার অন্ধকার, অর্থনৈতিক দারিদ্র‍্য ও ইহবিমুখতার কারণে যে দেশ ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের চোখে ঝাড়ফুঁক, ভিক্ষুক ও সন্ন্যাসীদের দেশ হিসাবে পরিগণিত হত; হিদেনদের মানুষ করার মহান দায়িত্ব নিয়েই তাদের আগমন বলে তারা মনে করত সেই অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেল শতাব্দীকালের মধ্যে। প্রবল প্রতাপান্বিত বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে অন্তত তিনজন ঢুকে পড়েছিলেন – একজনের নাম বিবেকানন্দ, দ্বিতীয়জন রবীন্দ্রনাথ, তৃতীয় ব্যক্তির নাম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। মিশনারিরা মনে করতেন কুসংস্কারক্লিষ্ট আচার অনুষ্ঠান জর্জরিত  হিদেনদের উদ্ধার করতে হবে, তাদের জীবনে আনতে হবে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের আলোক সত্য। তাদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের চাবিকাঠি আমাদের হাতে। ১৮৯৩ সালে চিকাগো ধর্ম সম্মেলনের আয়োজক ছিলেন খ্রিস্টান ফান্ডামেন্টালিস্টরা। তারা চেয়েছিলেন বিশ্বের নানা ধর্মের মানুষদের ডেকে নিয়ে এসে তাদের সামনে খ্রিস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে। বিবেকানন্দ সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের সাজানো পরিকল্পনা চূর্ণ করে দিয়ে এলেন। সবাই কান খাড়া করে, ঘাড় শক্ত করে শুনল ভারতেরও বলার কথা আছে। যাদের চিরকাল ছাত্র বলে ভাবা হয়েছিল তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করার মতো শিক্ষার হদিস মিলল বিবেকানন্দের বক্তৃতামালায়। ১৯১৩ সাল নাগাদ নোবেল প্রাইজ কমিটি রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে আবিষ্কার করলেন এমন উচ্চারণ যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ও উৎকণ্ঠিত পৃথিবীর জন্য জিয়নমন্ত্র স্বরূপ। রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি ও সমরনীতির শিখরে বসে কম্পমান পাশ্চাত্য সভ্যতা তখন অভয়বাণীর খোঁজে গীতাঞ্জলিকেই বরণীয় বলে মান্যতা দান করল। ১৮৩৫-এ মেকলের মিনিটে ঘোষিত হয়েছিল এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলনের লক্ষ্যটা কী হবে। জন্মে ভারতীয, চিন্তায় পুরোদস্তুর ইউরোপীয় সেইভাবে তৈরি হয়েছিল প্রথম প্রজন্মের ডেপুটি। দ্বিতীয় প্রজন্মের ডেপুটি ছিলেন বঙ্কিম — তীরেও নহে পারেও নহে অবস্থা। তৃতীয় প্রজন্মের এক উচ্চ-শিক্ষিতের নাম সুভাষচন্দ্র। আই সি এস পরীক্ষার প্রগতিপত্র তাঁর কাছে এক টুকরো কাগজ মাত্র। আই এন এ-র সর্বাধিনায়ক হিসাবে তিনি যখন পুরোদস্তুর মিলিটারি ইউনিফর্ম পরে ‘দিল্লি চলো’-র ডাক দিচ্ছেন তখন উপনিবেশবাদের ছুটির ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে।  

ভারতীয় হিসাবে বাঙালির এই প্রত্যয়, এই মর্যাদা, এই প্রতিষ্ঠা এই চ্যালেঞ্জের শক্তি ভিতর থেকে যে তৈরি করে দিয়েছিল তার নামই রেনেসাঁস। প্রস্তুতি ও প্রকাশের এই মহাপ্রকল্পটি চলেছিল গোটা উনিশ শতক জুড়ে। সূচনা থেকেই এই চ্যালেঞ্জ দীপ্যমান ছিল। রামমোহন থেকেই। রামমোহন বা দ্বারকানাথ চ্যালেঞ্জের হিডেন অ্যাজেন্ডা নিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছিলেন কিন্তু প্রস্তুতি অপরিণত ছিল বলে তাঁরা কেউ আর জয়ী হয়ে ফিরে আসতে পারেননি। বিলেতের মাটিতেই তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন শেষ শয্যা। মাইকেল মধুসূদন যখন মিলটনের পাশের আসনে বসবেন বলে ইউরোপে যান তখনও বাঙালির প্রস্তুতি অসম্পূর্ণ। ইউরোপ তাঁকে ফেরত পাঠিয়ে দেয় ভিখিরি করে। বিবেকানন্দ গিয়েছিলেন কপর্দকশূন্য অবস্থায় ফিরে আসেন রাজার মতো বিজয়ীর বেশে। প্রস্তুতিপর্ব ততদিনে সুপরিণত। তখন প্রকাশের উদ্ভাস। রবীন্দ্রনাথকে নোবেল প্রাইজ আনতে যেতে হয়নি। নোবেল প্রাইজই এসেছিল তাঁর নিজস্ব মোকামে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ততদিনে কারাগৃহ ভাঙার গান ধরেছেন, “কারার ওই লৌহ কপাট/ ভেঙে ফেল কররে লোপাট”।[২৮] নিজ গৃহে পরবাসী সেই পৌরুষ যখন আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রূপে দেখা দিলেন পূর্ব-সীমান্তে তখন বোঝা গেল উপনিবেশবাদ আমাদের নিকেশ করতে পারেনি। যাঁরা মনে করেন উনিশ শতকের রেনেসাঁস ছিল  উপনিবেশবাদের সহায়ক শক্তি ও তার হুকুম তামিল করা একটি দাসত্ব সংস্কৃতি — বিকৃত ও পঙ্গু, তাঁদের বিচারের সঙ্গে একমত হওয়া যায় না। রেনেসাঁস আসলে উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আত্মসংগঠন, আত্মপ্রকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সংস্কৃতি। বিশ্বসভ্যতার মানচিত্রে বাঙালিকে এভারেস্টের সমুচ্চ মর্যাদা দিয়েছে রেনেসাঁস। রেনেসাঁস ছাড়া সে যে কোনও জাতি। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে একজনই রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। তিনি বঙ্গীয় রেনেসাঁসের স্বর্ণশতদল। সারা পৃথিবীকে তিনি সুরভিত করে গেছেন। ইতালীয় রেনেসাঁসের সর্বোচ্চ প্রতিভূ যদি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি হন, বঙ্গীয় রেনেসাঁসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভূ রবীন্দ্রনাথ। তিনি শুধু বাংলা বা ভারতের কবি নন, বিশ্বকবি। ‘দি স্টোরি অব সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থমালার লেখক উইল ডুরান্ট, যাকে বলা হয় একালের হেরোদোতাস তিনি রবীন্দ্রনাথকে উপহার দেওয়া একটি বইতে লিখেছিলেন ভারতকে কেন স্বাধীনতা দেওয়া হবে তার উত্তর হচ্ছ তুমি। যে দেশ রবীন্দ্রনাথকে জন্ম দিয়েছে সে দেশ স্বাধীন হবে না তো কোন দেশ হবে? [২৯]

উল্লেখপঞ্জি : 

১. “বাঙলার ‘রিনাইসেন্স’ ছিল ‘কলোনিয়াল রিনাইসেন্স’ — পরাধীন জাতির রিনাইসেন্স এবং যে স্বাধীন নয় তার সত্যকার রিনাইসেন্স হবে কি করে?” — গোপাল হালদার — ‘বাঙলা সাহিত্য ও মানব স্বীকৃতি’, ১৩৬৩, পৃ. ৩২

২. শম্ভু মিত্র, ‘চাঁদ বণিকের পালা’, (প্রথম প্রকাশ, মাঘ ১৩৮৪) নবম সংস্করণ, দ্বিতীয় পর্ব, পৃ. ২৪

৩. J. A. Symonds, ‘Renaissance in Italy’, vol.1, ‘The Age of Despots’, Gloucester, Mass, 1965

৪. W. Durant, ‘The Story of Civilization’, vol. V, ‘The Renaissance’, p.440, 613

৫. Quoted W. Durant, Ibid, p. 563

৬. Quoted L. W. Spitz, ‘The Renaissance and Reformation Movement’, Chicago, 1971, p. 233, Guicciardini, Riccordi, Series I, No.14

৭. ‘Medici : Masters of Florence’ (TV Series), A historical drama, produced by Italian Companies Lux Vide and Rai Ficlion in collaboration with Frank Spotzitz’s Big Light Production, created by Frank Spotnitz & Nicholas Meyer, started 18 Oct, 2016

৮. R. S. Lopez, Hard Times and Investment in Culture, ‘The Renaissance : A Symposium’, New York, 1953

৯. R. S. Lopez & H. S. Miskimin, ‘The Economic Depression of the Renaissance’, The Economic History, XIV, 1962

১০. A. Malho (ed), ‘Social and Economic Foundation of the Italian  Renaissance’, USA, 1969, p. 115

১১. J. A. Symonds, Ibid, vol.2, p. 11

১২. Martin Luther, ‘An Open Letter to the Christian Nobility of the German Nation concerning the Reform of the Christian Estate’, 1520

১৩. R. H. Bainton, ‘Here I stand — A Life of Martin Luther’, USA, 1950, p.101

১৪. রামমোহন ইংল্যান্ড যাওয়ার প্রাক্কালে নন্দকিশোর বসুকে বলেছিলেন, “মুসলমানরা তাঁকে মুসলমান, হিন্দুরা তাঁকে বৈদান্তিক হিন্দু এবং খ্রিস্টানরা তাঁকে খ্রিস্টান বলবে।” S. D. Collet, ‘The Life and Letters of Raja Rammohun Roy’ (1900) ed. by D. K. Biswas and P. C. Ganguly, 1962, p. 201

১৫. M. Carpenter, ‘The Last Days in England of Raja Rammohun Roy’, 1976 edition ed. by S. Majumdar, p. 75

১৬. বেদান্ত ও উপনিষদের অনুবাদ করেছিলেন একদিকে অন্যদিকে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ টাকা যে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে মদত দেওয়ার জন্য খরচ করা উচিত সেই মর্মে লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি লেখেন (১৮২৩ সালে)। তার ভিত্তিতেই সংস্কৃত কলেজের জন্য নির্মিত গোলদিঘির বাড়িতে হিন্দু কলেজকেও স্থান দেওয়ার ব্যবস্থা হয়।  

১৭. Notes on the Sanscrit College, 12 April, 1852, দ্রষ্টব্য, ইন্দ্রমিত্র, ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশ 

১৮. Notes on the Ballentyne’s Report, 7 Sept, 1853, “They believe that their Sastras have all emanated from omniscient Rishis and therefore they cannot be infallible”; দ্রষ্টব্য, ইন্দ্রমিত্র, তদেব

১৯. ক্ষেত্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘মধুসূদন রচনাবলী’, ১৯৭৭, পত্রসংখ্যা ৪৯ (ইং)

২০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’, ত্রয়োদশ খণ্ড (বিশ্বভারতী), জন্মদিন, ১০ সংখ্যক কবিতা, (২১ জানুয়ারি, ১৯৪১), উদয়ন, পৃ. ৬৫

২১. ‘নায়কের সন্ধান — ইতিহাসের প্রেক্ষিতে’ (রিভিউ আর্টিকেল) শ. মু. চতুরঙ্গ, ভাদ্র, ১৪০৩; রেনেসাঁসের আলোয় বঙ্গদর্শন, শ.মু. পনশ্চ, ২০১৯, পৃ. ৩৮২-৩৯০

২২. ‘রেনেসাঁসের কলকাতা ও রামকৃষ্ণ’, শ. মু. কোরক সাহিত্য পত্রিকা, শারদ, ১৪১৮; রেনেসাঁসের  আলোয় বঙ্গদর্শন, তদেব

২৩. Hyper History. Net, praise of Folly; লুথার বলেছিলেন, তিনি হচ্ছেন এরাজমুসের মুগ্ধ পাঠক। তাঁর কণ্ঠস্বর হচ্ছে নাইটিঙ্গেলের গানের মতো মধুর। কিন্তু তাঁর মুগ্ধতা হচ্ছে সেই ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো। নাইটিঙ্গেলের গান শুনে তৃপ্ত হয় না যতক্ষণ না তাকে ধরতে পারছে। 

২৪. ‘রেনেসাঁস থেকে রিফরমেশনে : বিবেকানন্দ’, শ. মু. নানা বিবেকানন্দ, সম্পাদনা তাপস ভৌমিক, ২০১২; ‘রেনেসাঁসের আলোয় বঙ্গদর্শন’, তদেব, পৃ. ২৩৮-৫৭

২৫. উদ্ধৃত অমিতাভ ঘোষ, ‘বিদ্যাসাগর আনন্দ প্রাঙ্গণে’, ১৩৯৩, পৃ. ২৮৭

২৬. W. E. Le Grand, ‘Drifting Continents and Shifting Theories’, Cambridge University Press, Cambridge, 1988; দীপঙ্কর লাহিড়ী,  ‘সংসদ ভূবিজ্ঞান কোষ’, ১৯৯৯, পৃ. ১৮২

২৭. ‘রেনেসাঁস ও বাংলা সাহিত্য’, শ. মু., রেনেসাঁসের আলোয় বঙ্গদর্শন, ২০১৯, পৃ. ২৮৭

২৮. কাজী নজরুল ইসলাম, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’… (গান), কাব্যগ্রন্থ : ‘ভাঙার গান’, ১৯২৪, আগস্ট। ১৯২৪, ১১ নভেম্বর তৎকালীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। দ্বিতীয় মুদ্রণ, ১৯৪৯

২৯. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘ভারত-সংস্কৃতি’, ১৯৪৪ 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান