দেবদত্ত গুপ্ত
ভারতীয় তথা বাংলার শিল্পীদের ছবিতে নানা ভাবে স্বদেশ চেতনার প্রতিফলন, ঘাত প্রতিঘাতের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। সেই চিহ্ন যে কেবল স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেখা গিয়েছে এমনটা নয়, এর শুরু আরও অনেক আগে থেকেই। আমরা যদি রাজা রবি বর্মার ছবির দিকে তাকাই তাহলেই আমাদের সেকথা অনুভব করতে সহজ হবে। রবি বর্মার ছবির বিষয় নির্বাচন আমাদের সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। যেমন ধরা যাক রাবণের সীতা হরণের ছবিটির কথা। খুব ভালো করে দেখলে অনুভব করা যায় যে এ কেবল মাত্র রামায়ণের নিছক বর্ণনা নয়। তা যদি হত তবে তিনি রাবণের চেহারার বর্ণনায় দশটি মস্তকই আঁকতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি রাবণকে আঁকলেন একটি মস্তকের বর্ণনায়। অর্থাৎ রাবণকে চেনার যে প্রচলিত উপায় তা থেকে তিনি বেরিয়ে এলেন। এর কারণ কিন্তু সুপ্ত স্বদেশ বোধ। আসলে এই রাবণ কেবল রামায়ণের রাবণ নয়, এই রাবণ হল বিদেশি শত্রু যে কিনা আমাদের দেশের সম্পদ (সীতা সেই সম্পদের প্রতীক) হরণ করে নিজের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে ইংরেজ শক্তি আমাদের কাছে বিদেশি শত্রুই। তারা আমাদের দেশের সম্পদ লুঠ করছে অবাধে। এই ঘটনার ছায়াই কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম রবি বর্মার সীতা হরণ চিত্রে। এই প্রত্যয়টাই হল আসলে স্বদেশ চেতনার প্রত্যয়। যেখানে শিল্পী ধরিয়ে দিতে চান দেশের সম্পদ লুঠের বিষয়টিকে।
আমাদের বাংলায় স্বদেশি চেতনার ছবি ধরা পড়ল কালীঘাটের পটে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে হাতে অসি নিয়ে চলেছেন ঝাঁসির রানি। মাথার মুকুটে দেখা গেল ঠিক যেন রানি ভিক্টোরিয়ার মাথার ক্রাউন চেহারার। আসলে সে যুগে পটুয়ার কাছে রানি ভিক্টোরিয়া ছিলেন শক্তির পরাকাষ্ঠা। তাই ঝাঁসির রানির মুকুটে এল ইংরেজ রানির ক্রাউন। কিন্তু এমন পট যখন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে গেল তখন স্বদেশ চেতনাও যেন ছড়িয়ে গেল বাংলার ঘরে ঘরে। সেই সঙ্গে কালীঘাটের পটে আরও দেখা গেল মল্ল বীর শ্যামাকান্ত লড়াই করছেন খালি হাতে বাঘের সঙ্গে। এসব ছবিতে মেলে স্বদেশি অনুপ্রেরণার উপাদান। বিশেষ করে শ্যামাকান্তের সঙ্গে বাঘের লড়াইয়ের যে পট তাঁরা এঁকেছিলেন তা ছিল আসলে ইংরেজের সঙ্গে বাঙালির লড়াইয়ের প্রতীক। এই ভাবেই দেশের ছবিতে ছায়া ফেলতে থাকে স্বদেশি চেতনা। একসময় বিজ্ঞাপনেও দেখা গেল স্বদেশি চেতনার প্রতিফলন। সেখানে বিশেষ করে ছাপা হত কালী প্রতিমার ছবি। এসব বিজ্ঞাপনে দেখা যায় যে তিনি যুদ্ধে রত। এবং অসুর বধে ব্যস্ত।
যুগের সাথে সাথে শিল্পীদের ছবিতে স্বদেশের নানা অনুপ্রেরণা দেখতে পাওয়া যায়। যেমন ১৯০৫ সালে অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন ভারত মাতা। এই ভারত মাতার চার হাতে অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন ধানের ছড়া, পুঁথি, বস্ত্রখণ্ড, আর সঙ্গে রুদ্রাক্ষের মালা। আসলে সন্তানের চাহিদার কথাই যেন ভাবছেন ভারত মাতা। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ ধরিয়ে দিলেন ভারত মাতার সন্তানের শিক্ষার প্রয়োজনের কথা থেকে শুরু করে ধ্যানের প্রয়োজনের বার্তা পর্যন্ত এক জীবনবোধের কথাকে। এই যে স্বদেশের সন্তান কেমন হবে, বা সে কি চাইবে তাঁর মায়ের কাছে সেই কথাই ধরিয়ে দিলেন অবনীন্দ্রনাথ ভারত মাতার ছবির মধ্যে দিয়ে। তাই বঙ্গমাতা নাম দিয়ে তাঁর এই চরিত্রের যাত্রা শুরু হলেও লোকে তাকে আজীবন ভারত মাতাই বলে এসেছে। যে সময় জাতীয়তাবাদের কথা ভাবছে ভারতবাসী এটা সেই সময়ের ছবি। ছবির রচনা পদ্ধতিতেই ধরা যায় যে ভারত মাতা সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছেন। যাকে আমরা বলি লার্জার দ্যান লাইফ। পদ্মের প্রতীকেও কিন্তু সেই আলোর দিকে মাথা তোলার ইঙ্গিত। এই ছবির ভাষা আমাদের আজ বুঝে নিতে হয় আরও নানা ইঙ্গিত দিয়ে।
এই জাতীয়তাবাদের নানা দিকে তৈরি হল নানা ধরনের ছবি। যেমন নন্দলাল বসুর ছাপাই ছবির বাপুজি। এখানে তিনি গান্ধিজিকে দেখালেন একজন নির্ভীক একলা চলার অফুরন্ত শক্তিধর একজন মানুষ হিসেবে। ডান্ডি অভিযানের সঙ্গে যুক্ত এই ছবি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণাতেই এঁকেছিলেন নন্দলাল বসু। সব থেকে বড়ো কথা হল এই স্বদেশ বোধ নন্দলালের মধ্যে আজীবন লক্ষ করা গিয়েছে। যে কারণে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর যখন তিনি ভারতের সংবিধানের চিত্রকরণের দায়িত্ব পেলেন সেখানেও আমরা দেখলাম জাতীয়তাবাদের মনন কাজ করেছে সেই অলঙ্করণের অন্তরালে। ফলত সংবিধানের পাতায় আমরা অনেক কিছুর সাথে সাথেই দেখলাম নেতাজি আজাদ হিন্দ ফৌজ-কে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই ভাবেই জাতীয়তাবাদের নতুন চিত্রিত সংজ্ঞা তৈরি করেছিলেন নন্দলাল সংবিধানের পাতায়। হরিপুরা কংগ্রেসের পোস্টারের অভ্যন্তরেও দেখা গেল জাতীয়তাবাদের নতুন সংজ্ঞা।
আবার রামকিঙ্কর বেইজ যখন গান্ধিজি-র ছবি আঁকলেন তখন তাঁর প্রেরণা হিসেবে কাজ করল ‘Do or Die’ শব্দ ক-টি। আর-একটি ছবিতে আমরা দেখি রামকিঙ্কর সরাসরি ‘বন্দে মাতরম’ শব্দ ক-টি সরাসরি লিখেছেন। আসলে সবের অন্তরালেই রইল জাতীয়তাবাদের প্রেরণা। এই একই প্রেরণা থেকে শিল্পী ললিত মোহন সেনও এঁকেছিলেন গান্ধিজির ছবি। আসলে এই কথা অস্বীকার করা যায় না যে দীর্ঘদিন জাতীয়তাবাদের ছবি বলতেই শিল্পীরা গান্ধিজির অবয়ব রচনা করেছিলেন। আসলে গান্ধিজির অবয়বের আড়ালেই শিল্পীরা খুঁজে নিয়েছিলেন জাতীয়তাবাদের ও স্বদেশির অনুপ্রেরণা।
এই ধারাতেই আবার আমরা দেখেছি হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার এঁকেছেন চরকায় সুতো কাটছেন বঙ্গললনা। এই ছবি কিন্তু একেবারে সরাসরি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণাতেই নির্মিত। অর্থাৎ বারেবারেই দেখা যাচ্ছে স্বদেশি চেতনাতেই বাংলার শিল্পীরা ছবি আঁকছেন ঠিকই কিন্তু বিষয় ভাবনায় রয়েছে নানাবিধ অদলবদল। অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতা থেকে হেমেন্দ্রনাথের চরকায় সুতো কাটার ছবি পর্যন্ত সেই অদলবদল আমাদের চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে নজরে আসে শৈলী নিয়েও নিজস্ব ভাবনার নানা পরিচয় রেখেছেন শিল্পীরা। তাই এক কথায় বলা যেতে পারে যে ভারতমাতায় কাজ করেছে শিল্পীর কল্পনার বিস্তার, গান্ধির মধ্যে শিল্পীরা দেখতে চেয়েছিলেন জাতীয়তাবাদের একজন পথ প্রদর্শককে, চরকা কাটার ছবির আড়ালেও কাজ করেছে গান্ধির অনুপ্রেরণা। অন্যদিকে হরিপুরা পোস্টারে কর্মজীবী মানুষের আড়ালেই নন্দলাল বসু খুঁজে নিলেন জাতির আত্মপরিচয়ের নতুন সংজ্ঞা।