স্বাগতা রায়
জাতীয় সত্তা, জাতীয় রাষ্ট্র অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আমাদের মননে-চেতনায় যে সব ধারণা ক্রিয়াশীল, সেগুলির উৎস আসলে ইউরোপ। উনিশ শতকে বাঙালির ইউরোপীয় (মূলত কেতাবি) জ্ঞানচর্চাই এবিষয়ক আলোচনা বা চর্চার সূত্রপাত ঘটায় — একথা অত্যুক্তি নয়। তবে ঔপনিবেশিক শাসনের বিশোধিত রূপ এবং পারস্পরিক প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে কীভাবে ভারতবাসীর আঞ্চলিক ঐক্যচেতনা ভারতের সংস্কৃতিগত ঐক্যের ধারণায় পরিণত হয়েছিল, তা নিয়ে মতভেদ আছে। কেননা ভারতে রাজনৈতিক চিন্তার বিবর্তন ঘটেছে অনেক জটিল পথ ভেঙে। সেকারণে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের একমুখী সরল ব্যাখ্যাকরণ সম্ভব নয়।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উৎস-প্রকৃতি-স্বরূপ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্কের অন্ত নেই। সি এ বেইলি প্রমুখদের মতে ভূখণ্ড ও ঐতিহ্যগত দেশপ্রেমের পূর্ব চেতনার ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল। আবার আদি জাতীয়তাবাদী মনোভাব গড়ে ওঠার ব্যাপারে জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও জাতীয় চেতনাকে বেশি গুরুত্ব দিতে আগ্রহী যাঁরা, তাঁদের মতে জাতি সম্পর্কে চেতনার ভিত্তি ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতি বিদ্বেষ এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের জন্য গর্ববোধ। ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা জাতীয়তাবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিরোধের অস্তিত্বকে তাঁরা স্বীকার করেন না। কে এন পানিক্করের মতে, ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আসলে ঔপনিবেশিকবাদ অপসারণ প্রক্রিয়ার অংশ। উনিশ শতকের পশ্চিমি শিক্ষা ও মতাদর্শে প্রভাবিত একাংশের প্রচেষ্টা বা প্রচারের ফল জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ। ব্যক্তিগত স্তর থেকে গণচেতনার স্তরে উত্তরণ ছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফসল। আবার ভ্যালেন্টাইন শিরল মনে করেন, ব্রিটিশ শাসনের আগে রাজনৈতিক জাতিত্ব নয়, ভারতের মানুষজন কেবল ভৌগোলিক সত্তায় বিশ্বাসী ছিল। অনিল শীল প্রমুখরা পাশ্চাত্য শিক্ষাকেই রাজনৈতিক সচেতনতার মূল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কারণ তাঁর মতে ব্রিটিশ অধিকৃত তিন প্রেসিডেন্সি, বাংলা-মাদ্রাজ-বোম্বাইতেই বেশি মাত্রায় মানুষ পাশ্চাত্য শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, শিক্ষিত হয়েছিল, যদিও তার অনেকখানি উচ্চবিত্ত শ্রেণির কুক্ষিগত ছিল। তবু তার প্রভাব ব্যাপ্তি পেয়েছিল। আবার গর্ডন জনসন, জ্যাক গালাঘ্যর, বেকার প্রমুখরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষের প্রাথমিক পর্যায়কে ঐতিহাসিক গুরুত্ব দিতে অনাগ্রহী। তাঁদের মতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলে ইংরেজের পৃষ্ঠপোষকতা ও ভারতীয়দের আবেগময়তার এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ফসল। এই ক্ষেত্রে নানা স্বার্থের উপস্থিতিও অনেকে লক্ষ করেছেন। ওয়াশব্রুক যেখানে শিক্ষিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে বিত্তশালীদের যোগাযোগ লক্ষ করেছেন, সেখানে অনিল শীল প্রমুখদের মতে পৃষ্ঠপোষকরা তাঁদের আশ্রিতদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য, ভিতকে আরও মজবুত করার উদেশ্যে। গালাঘ্যরের বক্তব্যও এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক — সরকারি অনুপ্রেরণাই প্রদেশভিত্তিক রাজনীতিকে কাছে নিয়ে এসেছিল। আবার জনসনের মতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তখনই সংগঠিত হয়েছে যখন ব্রিটিশ সরকার শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের আভাস দিয়েছে এবং লাভের সম্ভাবনা নেই দেখে তা স্তিমিতও হয়ে গেছে, কেননা ভারতীয় রাজনীতিবিদরা সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন বা দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবার পুরোনো অভ্যাসের রাজনীতিতে ফিরে গেছেন। আবার সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদের সংঘর্ষের ধারণার ওপর আলোকপাত করেছেন কিছু ঐতিহাসিক যাঁদের গবেষণায় আন্দোলনের আঞ্চলিক পরিবর্তনশীলতা ও অন্তর্বিরোধধের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্বরূপ নিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে নানা প্রমাণ থাকলেও এই রাজনীতির কোনও মৌলিক লক্ষ্য বা পটভূমি ছিল না বলেই এঁদের দাবি। এই আন্দোলনে অনুগামীদের অস্তিত্ব বা ভূমিকা বিষয়ে তাঁরা সন্দিহান, প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা-সহযোগিতাকেই অপরিহার্য বলে মনে করেন তাঁরা। ম্যাকলান সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, শিক্ষামূলক সমিতিগুলির মধ্যে জাতীয়তাবাদের উপাদান খুঁজেছেন। কেননা স্থানীয় রাজনীতিতে জাতি-ভাষা-ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর প্রভাব পড়ত।
এই দৃষ্টিভঙ্গির বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে নিম্নবর্গ বা সাব-অলটার্নদের অবস্থানকে রণজিৎ গুহর মতো যাঁরা গুরুত্ব দেন, তাঁরা জাতীয় আন্দোলনে এলিটদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেওয়াকে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি বলতে চান। সেক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ব্রিটিশদের থেকে পাওয়া সুযোগ-সুবিধায় পুষ্ট উৎসাহিত অর্থ-খ্যাতি-ক্ষমতালোভী ভারতীয়দের একইসঙ্গে স্বভূমিতে ও ইংরেজদের সঙ্গে দু-তরফা সংগ্রামের কাহিনিতে পর্যবসিত হয়। শুধু তাই নয়, অভিজাতবর্গকে এ আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে ধরে নিলে কেবল মাহাত্ম্য ও আদর্শের গল্পটিই সামনে থাকবে, শোষণ আর উৎপীড়নের অংশ হয়ে পড়বে গৌণ। উচ্চবর্গের রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিল নির্দিষ্ট, সীমাবদ্ধ, নিয়ন্ত্রিত, সাবধানী। সে তুলনায় নিম্নবর্গের ক্ষেত্রে সোচ্চার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশ দেখা যায়।
মার্কসপন্থী চিন্তাবিদরা আবার ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নতুন অর্থনৈতিক শক্তির ভূমিকাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতে, জাতীয়তাবোধ তখনই জেগে ওঠে যখন এক ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাসকারী ভিন্ন ভিন্ন বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী একই রকম অর্থনৈতিক চাপের শিকার হয়। সামন্ততন্ত্র বা রাজতন্ত্রের প্রতি অধিকাংশ মানুষের এক ধরনের প্রথাগত আনুগত্য থাকে, কিন্তু যখন ধনতন্ত্র অর্থনৈতিক সংকটের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্বের সংকট তৈরি করে, তখন তার মধ্যে এক ধরনের প্রতিরোধমূলক প্রবৃত্তি লক্ষ করা যায়, যা সম্মিলিত ভাবে জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়। তবে এলিট বা বুর্জোয়া শ্রেণির এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে। কিন্তু তাঁদের মতে মূলত বাণিজ্যসূত্রে ধনী হয়ে ওঠা রাজনৈতিক আদর্শহীন ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির ‘ক্ষীণ রাজনৈতিক দৃষ্টি’ জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে অনেকেই এব্যাপারে সহমত পোষণ করেন যে, আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ উনিশ শতকের শেষদিকের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নব্যবুর্জোয়াদের রাজনৈতিক চিন্তা ও উচ্চাভিলাষের ফসল, যার কেন্দ্রে ছিল গণতান্ত্রিক দৃষ্টিসম্পন্ন দেশীয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। আবার লেভকোভ্স্কির মতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনে বদলে যাওয়া অর্থনৈতিক কাঠামো ঔপনিবেশিক ভারতে নতুন সমাজভিত্তিক সম্পর্ক তৈরি করছিল। যার ফলে সমাজে ব্যাপক গতিশীলতা লক্ষিত হয় এবং সামাজিক পরিবর্তনের এই পালাই চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে স্বাধীনতার জন্য মরিয়া অসম রাজনৈতিক যুদ্ধে। তাঁর মতে ভারতের বাণিজ্যে ব্রিটিশের অনুপ্রবেশ এবং তাদের ভূমিব্যবস্থার ফলে ভূমি বিক্রয়যোগ্য হওয়ায় ভারতে বাজারভিত্তিক অর্থনীতি সৃষ্টির অনুকুল পরিবেশ গড়ে ওঠায় বণিক-দালাল-ব্রিটিশ বণিক-মহাজন এসব নানা জীবিকার মানুষের কারণে সমাজে নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়। আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক প্রগতি এই নতুন সামাজিক শ্রেণির প্রতিষ্ঠা লাভের সংগ্রাম রূপে বিবেচিত হতে পারে।
এই মতের প্রায় সমর্থনে গোল্ডবার্গ বলতে চেয়েছেন, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রভাবিত গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীদের দ্রুত গতিতে পরিণত হয়ে ওঠায় এই শ্রেণির পক্ষে উপনিবেশের শাসনতন্ত্রের অধীন হয়ে থাকা সম্ভবপর হচ্ছিল না। আবার বিপান চন্দ্রের মতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল বিভিন্ন শ্রেণির, কেবল বুর্জোয়াদের নয়। ভারত-ব্রিটিশ স্বার্থজনিত সংঘাত আর গৌণ সামাজিক দ্বন্দ্ব যা শ্রেণি-বর্ণ-ধর্মভিত্তিক। বিপান চন্দ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পুঁজিবাদী শ্রেণির উত্থানকে গুরুত্ব দিলেও তিনি ভারতীয় বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সৃষ্ট ও লালিত মতাদর্শকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ জাতীয়তাবাদ আসলে এক আদর্শ। সামাজ্যবাদের প্রকৃতি ও ভারতীয়দের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত — সমস্যার এই মূলগত রূপ অনুধাবন করে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রচারের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের উদ্ভব প্রসঙ্গে তাঁর মত — গ্রামীণ বা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার ধ্বংসসাধন এবং অন্তর্দেশীয় বাণিজ্যের প্রসারের ফলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, তার ফলে অর্থনীতির কাঠামোর ক্ষেত্রে আপাতভাবে এক সর্বভারতীয় বহির্গঠন লক্ষ করা গিয়েছিল। একই রকম শিক্ষাব্যবস্থার সূত্রে জীবনদর্শনের ক্ষেত্রে এক আধুনিক বাতাবরণ তথা ভাবধারা লক্ষ করা যায় যার ফলে ভাবনাচিন্তার ধরনে ভিত্তিতে এক সর্বভারতীয় বুদ্ধিজীবী-শ্রমজীবী-পুঁজিপতির সৃষ্টি হয়, যাঁদের শ্রেণিগত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজবাস্তব বিশ্লেষণের প্যাটার্ন ছিল একই রকম; ভারতীয়ত্ব— এই চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যই সেখানে প্রধান, সেখানে জাতিগত বা আঞ্চলিক বিভেদের থেকেও এই আবেগের দিকটিই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়। আধুনিক মানববিদ্যা ও সমাজবিদ্যার বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতেও স্থানীয় দল ও গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের মধ্যেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ধারার শিকড় প্রোথিত আছে।
দুই
ভারতে জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনার অঙ্কুর হিসেবে হিন্দুত্ববাদী ভাবনাচিন্তা প্রথমে মূল কার্যকর ফ্যাক্টর ছিল। পরাধীন ভারতে ধর্মীয় সংস্কার-এর হাত ধরেই সমাজ সংস্কারের ভাবনা চিন্তার সূত্রপাত ঘটেছিল। পর্তুগিজদের দ্বারা রোমান ক্যাথলিক মিশনারিদের খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও প্রসারের উদ্যোগ, ধর্মান্তকরণ এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই ধর্ম ও সমাজ উভয়েরই সংস্কারের প্রয়োজন, তা সমাজের পুরোধা ব্যক্তিরা অনুভব করেন।
উনিশ শতকে ভারতে জাতীয়তাবাদের উৎস হিসেবে আমরা একাধিক ঘটনাকে চিহ্নিত করতে পারি। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের প্রভাব (ফরাসি বিপ্লব, ইতালি ও জার্মানির ঐক্য আন্দোলন) ছাড়াও ইংরেজ জাতির সঙ্গে অন্যান্য ভারতীয় জাতির সম্পর্ক-যুদ্ধ-সমঝোতা বা অধীনতামূলক মিত্রতার নীতি, ইংরেজদের ক্রমবর্ধমান সাফল্য, দেওয়ানি লাভ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ, ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে কর্নওয়ালিস, বিচার ও পুলিশ ব্যবস্থা, রাজস্বনীতি ও ফলাফল, কোম্পানির শিল্পনীতি ও বাণিজ্যনীতি, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের কারণে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার অবনতি, রামমোহন-ডিরোজিও-বিদ্যাসাগর প্রমুখদের নেতৃত্বে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, মহারাষ্ট্রের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, কৃষক-ওয়াহাবি-নানা উপজাতি আন্দোলন, কোম্পানির শাসনের অবসান ও ব্রিটিশ শাসন-ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস, দেশীয় রাজন্যবর্গের নির্ভরশীলতা, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিয়ন্ত্রণ, সীমান্তনীতি। ভারতে রেলপথের প্রবর্তন, পাঞ্জাব, বাংলা, মহারাষ্ট্রে শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলন। জাতিগত বৈষম্যের কারণে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব ক্রমে বেড়েই চলে যার অন্যতম ফলশ্রুতি ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের অসন্তোষ। এছাড়া দেশাত্মবোধক সাহিত্য-সাময়িকপত্র-সংবাদপত্রের ভূমিকা, নাট্যানুষ্ঠান আইন, দেশীয় সংবাদপত্র আইন সূত্রে সরকারের বিরূপ প্রতিক্রিয়া; এসবের ফলস্বরূপ স্বরাজ অর্জনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সমিতির উদ্ভব, জাতীয় সম্মেলন, এবং শেষপর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা।
মূলত বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তনের পর্ব থেকেই এর শুরু। কেননা এই কালপর্বের প্রতিটি ওঠানামার সাক্ষী ছিল বাংলার আপামর মানুষ, সেই শুরুর সময় থেকেই যে বৈষম্যের চারা রোপিত হয়েছিল, সেই বৈষম্যই একদিন মহিরুহে পরিণত হয়েছিল এবং বাঙালি তথা ভারতবাসীকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। যার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘দস্তক’ দিয়ে সে বৈষম্যের আখ্যানের শুরু, আর ‘রাষ্ট্রগুরু’ সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা সংক্রান্ত আন্দোলনের কালপর্বে সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক সর্বভারতীয় প্রতিবাদ মূর্ত হয়ে ওঠে। দেশীয় নবাব-বাদশা-রাজাদের অন্যায়ভাবে যুদ্ধে পরাস্ত বা অপসারণ করা, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নামে লুঠতরাজ, বারবার পরীক্ষামূলকভাবে রাজস্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন, আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর পরিবর্তন, জমিদার-মহাজন প্রভৃতি শ্রেণির মাধ্যমে সমাজে ত্রাস-লুঠের সমর্থন, কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির চরম দুরবস্থা, দেশীয় শিল্প ও তার সঙ্গে জড়িত শিল্পীদের অবিরাম শোষণ, নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক আচরণ যা প্রায় অত্যাচারের নামান্তর; সব মিলে মূলত বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই আধুনিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়।
ভারতবাসীর ব্রিটিশ শাসনবিরোধী মনোভাবের মূলে ছিল ব্রিটিশ স্বার্থের সঙ্গে ভারতবাসীর স্বার্থের সংঘাত; রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই সংঘাত পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। ভারতের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা তথা ভারতীয় অর্থনীতির বিপর্যয়ের কারণ হল ব্রিটিশ শাসন— মূলত এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। করের বোঝা, জমিদার-মহাজনদের শোষণ, আইন-শৃঙ্খলার নামে দমন-পীড়ন, ব্যবসায় ব্রিটিশদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতা প্রভৃতি কারণে কৃষক-শিল্পী-কারিগর-শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে বুদ্ধিজীবী তথা মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঘনীভূত সমবেত অসন্তোষই ক্রমে জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি স্বরাজের চেতনার উন্মেষ ঘটায়।
ভারতীয় শিল্পের ক্ষেত্রে প্রথম দিকে ইউরোপীয় ও পরবর্তীতে ভারতীয়দের তৎপরতায় এবং ব্রিটিশ পুঁজির আধিপত্যের দরুন উনিশ শতকের শেষদিক থেকে ভারতে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছিল। তবে নিজেদের লাভের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে ভারতীয় শিল্পের উন্নয়ন এবং দেশীয় শিল্পপতিদের শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার চেষ্টা চলত। এসব সত্ত্বেও উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই সুতিশিল্প, ইস্পাত ও লোহা শিল্প, জাহাজ শিল্পের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ ঘটে; স্বদেশি ভাবধারার প্রভাবেও সুতিকল, ব্যাঙ্ক, গেঞ্জি, ওষুধ, সাবান, চর্ম শিল্পেরও প্রসার ঘটে। বিশ শতকের প্রথমার্ধেই ভারতীয় শিল্পপতিদের প্রচেষ্টায় ক্রমে ক্রমে চা, চিনি, কাগজ, সিমেন্ট, কাগজ, রাসায়নিক শিল্পেরও বিকাশ ও প্রসার ঘটে। ভারতীয়দের ব্যবসায়িক স্বার্থপূরণে ব্রিটিশদের ক্রমাগত হস্তক্ষেপ ও অবিরাম বাধা সৃষ্টির কারণে ‘স্বরাজ’ বা স্বাধীন ভারতের বাসনা জেগে ওঠে।
ব্রিটিশ সংস্কৃতি ও শাসনব্যবস্থার প্রতি প্রথম দিকে আস্থাশীল (অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকার শিল্পোন্নয়নের প্রসার ঘটিয়ে ভারতকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন) হলেও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সামনে দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুরবস্থা ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছিল। দেশীয় অর্থনীতির উপর সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভারতকে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত করার প্রবণতা এবং ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বেকারের সংখ্যা পুঞ্জীভূত ক্ষোভের ভিত্তিকেই পোক্ত করে তুলছিল। রানি ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্রে গুণ-যোগ্যতা অনুযায়ী ভারতীয়দের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি; ভারতীয়দের শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি থাকলেও উচ্চ ও দায়িত্বশীল পদগুলি ইউরোপীয়দের জন্যই সংরক্ষিত থাকত। ইংরেজদের ঔদ্ধত্য, ভারতীয়দের প্রতি হীন দৃষ্টিভঙ্গি-ঘৃণা-অপমানজনক ব্যবহার এসব দিকগুলি ভারতবাসীদের ক্ষুব্ধ করে তুলছিল। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের এই অন্তর্নিহিত প্রকৃতি এবং ভারতীয়দের উপর তার ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে সাম্রাজ্যবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রূপ গ্রহণ করে, কেননা ভারতের প্রায় সব শ্রেণির মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে হয়ে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। যেহেতু বাংলায় প্রথমে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রসার ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল। এই কারণে বাংলায় সর্বপ্রথম জাতীয়তাবাদী সাহিত্য ও সংবাদপত্র বাংলা ভাষার মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ করে যা মানুষকে স্বদেশি চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ করে। উনিশ শতকে রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিবেকানন্দ, দীনবন্ধু মিত্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখরা তাঁদের প্রবন্ধ, সংস্কারমূলক প্রস্তাব, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটোগল্প — সাহিত্যের নানা সংরূপের মধ্য দিয়ে বাঙালি জনসাধারণের মনে জাতীয়তাবাদ ও দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলেন। উনিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে বাংলায় রাজনৈতিক চেতনা ক্রমেই পরিস্ফুট হয়ে ওঠে এবং শাসনতান্ত্রিক সংস্কার প্রভৃতি বিষয়ে সভা-সমিতি ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনমত সংগঠিত হতে থাকে। দেশীয় ভাষায় প্রচারিত সংবাদপত্র-পত্রিকাগুলি জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা ও জাতীয়তাবাদ প্রচারের প্রধান বাহক হয়ে ওঠে। প্রয়োজনে তারা সরকারের শাসননীতির সমালোচনা থেকেও দ্বিধান্বিত হত না। অস্ত্র আইন, পত্র-পত্রিকা আইন, নাটক আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল নিষেধাজ্ঞা বা নতুন আইনের বিরুদ্ধে ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় অর্থাৎ জনমত তৈরি হয়, সভা ও সমিতিগুলিরও এব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। ভারতবাসীর অভাব-অভিযোগ না পূরণ করায় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সনদ পাওয়ার সময় এলে ভারতে রাজনৈতিক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। (জমিদার সমিতি ও বঙ্গ-ইঙ্গ ভারত সংযুক্ত হয়ে) ‘ব্রিটিশ-ভারত সভা’-র নেতৃত্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নেতারা সমবেত ভাবে নানা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দাবি (সিভিল সার্ভিস সহ সব সরকারি চাকরি দরজা ভারতীয়দের কাছে খুলে দেওয়ার, সুষ্ঠু অর্থনীতির প্রবর্তনের, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার দাবি করেন) পার্লামেন্টের কাছে পেশ করে। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে শিশিরকুমার ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলার কয়েকজন বিশিষ্ট নেতা ‘ইন্ডিয়ান লিগ’ নামে এক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন যা ইংরাজি সংবাদপত্র ‘ইংলিশম্যান’ ভারতীয়দের রাজনৈতিক প্রথম জাগরণ বলে অভিহিত করে।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ভারতসভা’ (Indian Association) প্রতিষ্ঠা করেন যা জাতীয় কংগ্রেসের আগে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য জাতীয়তাবাদী সংস্থা ছিল। বাংলার নবীন নেতারা ‘ব্রিটিশ-ভারত সভা’-র গোঁড়াপন্থী নীতির অনুসরণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। কেননা তা বৃহত্তর জনস্বার্থবিরোধী ছিল। ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে যখন জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভ দানা বাঁধছিল, সেই সময়ই ‘রাষ্ট্রগুরু’ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতিতে পূর্ণোদ্যমে যোগদান করেন। ‘ভারত সভা’-র লক্ষ্য ছিল দেশে এক শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলা, রাজনৈতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে ভারতবাসীদের সংঘবদ্ধ করা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি জোরদার করে তোলা এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে জনগণকে শামিল করা। সুরেন্দ্রনাথের মতে ‘ভারত সভা’ মধ্যবিত্ত শ্রেণির গণ-চেতনা প্রতিফলিত করে এবং বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বিভিন্ন প্রদেশের রাজনৈতিক সংস্থাগুলির সঙ্গে যোগ দিয়ে সুরেন্দ্রনাথের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শুরু হয় সর্বভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা সংক্রান্ত আন্দোলন। পরীক্ষার নিয়ম-কানুন ও পরীক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ বয়ঃসীমা এমনই ছিল যে ভারতীয়ের পক্ষে ইংল্যান্ডের ইউরোপীয় পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে এই পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা খুবই অসুবিধাজনক ছিল। তা সত্ত্বেও কয়েকজন ভারতীয় এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তা ইংরেজ আমলাদের মনঃপুত হয়নি। তাই ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে পরীক্ষার্থীদের বয়ঃসীমা একুশ থেকে কমিয়ে উনিশ করা হয়, যার ফলে এই পরীক্ষায় যোগ দেওয়া ভারতীয় ছাত্রদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথসহ ভারতীয় নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নতুন বিধির পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। এর পর বিচারব্যবস্থায় জাতিভেদমূলক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ‘ভারত সভা’-র নেতৃত্বে শুরু হয় ‘ইলবার্ট বিল আন্দোলন’। বাংলার মতোই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন আন্দোলনের উদ্ভব ঘটলে জাতীয়তাবাদীরা এক সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংস্থার প্রয়োজন অনুভব করেন। এই উদ্দেশ্যেই ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। রামতনু লাহিড়ীর সভাপতিত্বে বোম্বাই, মাদ্রাজ, লাহোর, আহমেদাবাদ, কটক, নাগপুর, দ্বারভাঙা, মিরাট থেকে আগত শতাধিক প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বৃহত্তর কর্মসংস্থান, বিচারব্যবস্থার পৃথকীকরণ, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন প্রভৃতি নানা বিষয়ের আলোচনার মধ্য দিয়ে এই সম্মেলনের লক্ষ্য ও আদর্শ দেশবাসীর মনে গভীর উৎসাহের সঞ্চার করে। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে পূর্বের নেতাদের সঙ্গে রাজা নরেন্দ্র কৃষ্ণ দেব, রায় বদরী দাস বাহাদুর, দ্বারভাঙার মহারাজা, নেপালের রাজদূত প্রমুখের উপস্থিতিতে অস্ত্র আইন, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন এবং সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সংস্কার সাধন, বিচার ও শাসন বিভাগের পৃথকীকরণ প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়। প্রায় এই সময়েই বোম্বাইয়ে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
ফলে একদিকে ভারতীয় জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও বিপ্লবী মনোভাব এবং অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী শাসকের সামনে তাতে করে যে সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল আর সম্ভাব্য হিংসাত্মক অভ্যুত্থানকে প্রতিহত করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের তরফ থেকে কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় সংস্থা গঠনের প্রয়োজন ছিল— এই দ্বন্দ্বকে সামনে রাখলে অ্যাল্যান হিউমের উদ্যোগকে কংগ্রেসের উৎপত্তির একমাত্র কারণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। তবে ব্রিটিশদের শাসননীতির স্বার্থ জড়িত থাকলেও একথা বলা যায় যে, জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা কোনও আকস্মিক ঘটনা ছিল না, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক তৎপরতাই জাতীয় কংগ্রেসের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। বাঙালি তথা সমস্ত ভারতীয়ই হৃত আত্মসম্মান উদ্ধারের স্বপ্ন দেখছিলেন নতুন করে।
বাঙালির একাংশ পাশ্চাত্য শিক্ষার মোহে ভেসে গেলেন, গুরুত্ব বুঝলেও এক অংশ সামঞ্জস্যের পথ ধরেছিলেন। আত্মমর্যাদাবোধের সঙ্গে সঙ্গে স্বাজাত্যবোধ ও স্বজাতিপ্রীতি এঁদের চরিত্রের এক বড়ো দিক। এই স্বাজাত্যবোধই পরবর্তীকালের বাঙালির জাতীয়তাবোধে দেশীয় সত্তার পাশাপাশি বাঙালিত্বকেও অবিচ্ছেদ্য করে তুলেছে।
তিন
উনিশ শতকে পশ্চিমী শিক্ষা ও মতাদর্শে প্রভাবিত একাংশের প্রচেষ্টা বা প্রচারের ফলেই ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল বা বাঙালির প্রাদেশিক স্বতন্ত্র সত্তার বিকাশ ঘটেছিল। স্বরাজের বাসনাই ব্যক্তিমনে স্বাতন্ত্র্যের সূত্রে জাত্যভিমানের ভাবনাকে সূচিত করে। খাদ্য-পোশাক এগুলি যেহেতু মানুষের নিত্যজীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত, তাই এর সঙ্গে আরাম-স্বাচ্ছন্দ্যবোধ-আর্থসামাজিক অবস্থান-স্বাস্থ্য এসবই জড়িয়ে থাকে। খাদ্য-সংস্কৃতি আমাদের সত্তা বা পরিচিতির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেননা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, আমাদের রোজকার বেঁচে থাকা এসব কিছুর সঙ্গে খাওয়া-পরা অর্থাৎ অন্ন-বস্ত্রের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কেননা শরীরের পরিপোষণ নয়, বিষয়টি বৌদ্ধিক সত্তার উপরও প্রভাববিস্তারী। সাহিত্য বা শিল্প যে কোনও নির্মাণের সঙ্গে এর যোগ অস্বীকার করা অসম্ভব। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত তৎকালীন বাংলার মানুষজনের কাছে বাঙালির খাদ্যাভ্যাস বিষয়টি কেন আলোচনা-চিন্তাভাবনার চর্চা হয়ে উঠেছিল, তা সহজেই হৃদয়ঙ্গম করা যায়। সেখানে খাদ্য কেবল ব্যক্তিগত পরিসরে আটকে থাকে না, তা তখন অনেক মানুষের, তা তখন আর স্বাদ-গন্ধ-বর্ণ-বৈচিত্র্যের পরিচায়ক নয়, তার সঙ্গে স্বদেশ, তার চেতনা, তার স্বপ্ন, তার বাসনা, তার যাপন সবকিছুই যুক্ত হয়ে পড়তে থাকে। তার অস্তিত্বের সবটুকুই যখন ‘স্বরাজ’ শব্দটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, সেখানে খাদ্য যা থেকে শরীর তার প্রয়োজনীয় সম্ভাব্য শক্তি আহরণ করে, তা যে বিশেষভাবে আলোচিত বা চর্চিত হবে, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকে না। পরাধীন দেশের মানুষ তার ব্যক্তিগত অবমাননাকে স্বভূমি ও স্বজাতির অবমাননার সঙ্গে এক করে দেখে।
উনিশ শতকে এসব ভাবনার হাত ধরেই খাদ্যসংস্কৃতিতে কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। রান্নার বইয়ের মুদ্রিত ধারার পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত চর্চার এক জোয়ার লক্ষ করা যায়। সেই আলোচনায় চিকিৎসক, বিজ্ঞানী তো বটেই রাজনীতিবিদদেরও এ বিষয়ে রীতিমতো মাথা ঘামাতে দেখা গিয়েছে। এবং খাদ্য সংক্রান্ত জীবিকার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনও এই আলোচনার আওতাভুক্ত হচ্ছে। সমাজের যেসব শ্রেণির মানুষজনের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন ছাড়া সেভাবে আর কোনও রকমের মানবিক সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে অনীহা দেখা যেত, সেই মানুষগুলির প্রয়োজন বা চাহিদা বা গুরুত্ব যাই বলি কেন তা কিন্তু উচ্চবিত্ত এই শিক্ষিত সমাজ অনুভব করছে। যেমন গোয়ালা, বাবুর্চি, রাঁধুনি, গৃহভৃত্য, ময়রা, সবজি বিক্রেতা, যাদের অস্তিত্ব বা উপস্থিতি কোনোটাই শিক্ষিত মানুষের কাছে চিন্তাভাবনার বিষয় হিসেবে গ্রহণযোগ্য ছিল না, এবার তারা তাদের জীবিকার সূত্রে শিক্ষিত মানুষের আলোচনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কেননা তাদের বিক্রীত পণ্যের মানের ওপর সাধারণ মানুষ তথা ‘জাতির স্বাস্থ্য’ নির্ভর করছে। তাই গোয়ালার দুধ কতখানি খাঁটি বা তাতে জল মেশানো এই ধরনের সমস্যার মোকাবিলায় তাঁরা গোয়ালাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও তার পারিপার্শ্বিককে একেবারে অস্বীকার করছেন না। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শেষ দিকে তাই কলকাতায় গোয়ালাদের বাসস্থান, তাদের বসতির যাবতীয় অসুবিধাগুলি পত্র-পত্রিকার আলোচনায় স্থান করে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বসতি এলাকাগুলি যে কতখানি অস্বাস্থ্যকর তার খুঁটিনাটি বর্ণনা তুলে ধরা হচ্ছে। এবং চারিদিকে মানুষ এবং গবাদি পশুর মলমূত্র, তরিতরকারির খোসা, অন্যান্য আবর্জনা — এসব কিছুর মধ্যে বসবাসকারী মানুষ ও মনুষ্যেতর প্রাণী দুইয়েরই ক্ষতি হচ্ছে, কেননা দূষিত পরিবেশে কারোরই শারীরিক-মানসিক কোনোপ্রকার স্বাস্থ্য যে ভালো থাকার কথা নয় — আলোচনায় আসছে। তাই গরুর দুধ সুষম খাদ্য এবং শিশু-বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে তা অত্যাবশ্যকীয় হলেও এই গরুর দুধ সেই চাহিদা মেটাতে কতখানি সক্ষম হবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছিল। পাশাপাশি গোখাদ্যের মান বা গোয়ালাদের শারীরিক রোগব্যাধি (চর্মরোগ বা ছোঁয়াচে রোগ ইত্যাদি) বা তাদের পরিচ্ছন্নতাবোধ এসবও জাতির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার ভাবনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছিল। তাই এসবের সুষ্ঠু সমাধান নিয়ে আলোচনার পরিসরও ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
একই কথা প্রযোজ্য খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে জড়িত বাকি জীবিকার মানুষের ক্ষেত্রেও। রাঁধুনি বা গৃহভৃত্য রাখার মতো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক পরিসরেও এই আলোচকরা হস্তক্ষেপ করছেন। কারণ বিষয়টি আর পরিবার বা ব্যক্তিগত এইসব শব্দের পরিধির মধ্যে আবদ্ধ নয়। বিষয়টি গণস্বাস্থ্যের সূত্রে তথাকথিত জাতির স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষত সে জাতি পরাধীন আর তার বিদেশি শাসক নিজ জাতিস্বার্থ বিষয়ে যখন চূড়ান্ত একমুখী ও একাগ্র। বিদেশি শাসকের দৃষ্টিতে তার সংস্কৃতি মানে খাটো আর শারীরিক বলের দিক দিয়ে হীন। কাজেই সেখানে জাতীয়তাবাদী ভাবনায় দৌর্বল্যের বদনাম ঘোচানোর আগ্রহ পরিলক্ষিত হওয়াই স্বাভাবিক। তাই প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী তাঁর ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার (প্রথম খণ্ড নিরামিষ)’ বইতে পরামর্শ দিচ্ছেন, “রন্ধনকার্য এবং আহারের সংশ্রবে যখন ভৃত্যেরা আসবে, তখন যেন তাহারা দূষিত মলিন বসন আদৌ পরিধান করিতে না পারে,… এ বিষয়ে হিন্দু বিধবাদের অনুকরণ করা সকলের সর্বতোভাবে কর্তব্য।… হিন্দু বিধবাদিগকে অন্ন রাঁধিবার সময় দেখিয়াছি যে তাঁহারা স্নানান্তে স্বতন্ত্র শুদ্ধ বসন পরিধান করিয়া অন্ন রাঁধিতে প্রবৃত্ত হয়েন। দূষিত অথবা মলিন বসনে আহার পরিবেশন অথবা পাককার্যে প্রবৃত্ত হওয়া নিতান্ত ঘৃণার কথা, শুধু ঘৃণার কথা নয়, তাহা ভোক্তার স্বাস্থ্যেরও হানি করে। দাস-দাসীরা অনেক সময়ে অবহেলায় ও অযত্নে সত্বর কার্য সারিতে গিয়া অশুচিভাবকে প্রশ্রয় দেয়, হয়তো জলপাত্র প্রভৃতির ভিতরে অঙ্গুলি ডুবাইয়া জল কি দুধ খাইতে দিল।… অপরিচ্ছন্নতাই অধিকাংশ রোগের বীজ বহন করিয়া আনে।” ‘পাচক’ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমতটিও এখানে উদ্ধৃত হল — “এমন অনেক ব্রাহ্মণ পাচক আছে যাহারা দেখিয়াছি গর্ব করে যে তাহারা রোস্ট, চপ প্রভৃতি বিদেশী রান্না অধিকাংশই জানে কিন্তু বস্তুত তাহারা কিছুই জানে না। তাহারা ভাবে, রোস্ট, চপ, কি কারি রাঁধিতে হইলেই বুঝি যত বেশি বেশি গরমমশলা ঝালমশলা প্রয়োগ করা আবশ্যক। কিন্তু ইহা তাহাদের নিতান্ত ভ্রম। সাদাসিধা অল্প মশলাতেই এ সকল রান্না ভাল হয়। কি আমিষ, কি নিরামিষ সকল আহার্য দ্রব্যই প্রস্তুত করিবার কালে ভাল পাচকেরা মশলার উপর ততটা নির্ভর করে না যতটা আপনার ‘আক্কেলের’ উপর নির্ভর করে। গৃহকর্মে ভৃত্যদিগের যেমন পরিচ্ছন্নতা গুণ থাকা আবশ্যক সেইরূপ পাচকদিগেরও ইহা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পাচকদিগের অসাবধানতা দোষে এমন কত সময় হইয়াছে যে, ভাতের ভিতরে মক্ষিকা পতঙ্গ সিদ্ধ হইয়া রহিয়াছে, ডালে এক চুল পড়িয়াছে।” আবার শরৎচন্দ্র দাসের ‘বিশুদ্ধ পাক-প্রণালী’-এর উপক্রমণিকায় ঘরের মেয়েদের রান্নার কাজে স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে যোগদানের পক্ষে অভিমতটি এখানে উল্লেখ্য, সেখানে রান্নায় শারীরিক শ্রমের বিষয়কে ব্যায়ামের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, “বঙ্গদেশীয় রমণীদিগের মধ্যে অবরোধ প্রথা বহুদিন হইতে প্রচলিত হইয়া আসিতেছে। ভ্রমণ বা পুরুষোচিত ব্যায়াম কার্য্য তাহাদিগের দ্বারা সম্ভব নহে বলিয়াই তাহাদিগের হস্তে গৃহস্থালীর যাবতীয় কার্য্যের ভার দেওয়া হইয়াছে। রন্ধন কার্য্যে রমণীদিগের সকল অঙ্গই পরিচালিত হইয়া থাকে।… অধুনা বেতনভোগী পাচক পাচিকার প্রচলন হইয়াছে এমন কি সামান্য গৃহস্থের বাড়ীতেও আজকাল এইরূপ পাচক পাচিকা দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাতে যে কেবল অর্থ ব্যয় হয় তাহা নহে, স্বাস্থ্য-রক্ষারও ব্যতিক্রম হইয়া থাকে।”
চার
উনিশ শতকে প্রকাশিত রান্নার অধিকাংশ বইতেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক পরামর্শ ভিন্ন ভিন্ন রূপে সংযোজিত হয়েছে। রোগীর পথ্য, শিশুর উপযোগী খাদ্য, ঋতু অনুযায়ী বিশেষত গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালের উপযোগী খাদ্যতালিকা বা ক্রমণী, বাজারজাত বা অন্যান্য ভেজাল খাদ্য বর্জন ও তার বিকল্প খাদ্য প্রস্তুত প্রণালী — নানা ভাবে লেখক-লেখিকারা তাঁদের পাঠকবর্গকে সতর্ক করেছেন। বাঙালি জাতির সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার পরামর্শমূলক একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। সমকালীন পত্র-পত্রিকাতেও স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। রান্না বা খাদ্য সংক্রান্ত গ্রন্থগুলিতে এই যে পথ্য বিষয়ের সংযোজন, এই ধরন আমরা ‘পাকরাজেশ্বরঃ’ গ্রন্থেও পেয়েছি। কিন্তু তার ধরন বা প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে বিশেষ কিছু রোগের (অজীর্ণতা বা বদহজম) নিবারণার্থে ‘টোটকা’ (উপশম) লিপিবদ্ধ হয়েছে (দেশজ গাছগাছড়া বা মশলা সাহায্যে)। কিন্তু উনিশ শতকের পরবর্তীকালে প্রকাশিত বইগুলিতে পাঠক-পাঠিকাকে শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ বোঝানো হচ্ছে, প্রয়োজনে সচিত্র বর্ণনা তুলে ধরা হচ্ছে। খাদ্য কী, তার প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতার দিকগুলি বিজ্ঞানসম্মতভাবে সরলভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। রান্নার পদ্ধতিকে স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে, রান্নার উপকরণ নির্বাচনে জোর দেওয়া হচ্ছে। স্বাদের বিষয়কে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে না, কিন্তু সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার বিষয়ই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সাধারণকে সচেতন করা বা সচেতনতার এক ধরনের জোয়ার পরিলক্ষিত হয়েছিল, তার স্বরূপকে বুঝতে গেলে আমাদের একটু অতীতের দিকে ফিরে যেতে হবে।
শিল্পবিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডে উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণের হার বহুগুণ বেড়ে যায়। ফলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে কাঁচামালের চাহিদাও পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছিল। ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের পর ইংরেজ শাসক ও লন্ডনের ব্যবসায়ীদের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ভারতের কাঁচামাল ইংরেজদের কাছে ছিল খুবই লাভজনক। ভারত থেকে সস্তায় কাঁচামাল নিয়ে গিয়ে আবার কারখানায় উৎপাদিত দ্রব্য ভারতেই বিক্রি করার নীতির কারণে ভারত বিদেশি শাসকের চোখে কাঁচামালের স্বর্ণভূমি ও কারখানাজাত দ্রব্য বিক্রির বিশাল বাজারে পরিণত হয়েছিল। নিজেদের স্বার্থেই এই কাঁচামাল তারা দেশে নিয়ে যাবে এবং সেই কাঁচামাল থেকে তৈরি দ্রব্যসমূহ ভারতের বাজারে বিক্রি করে প্রচুর লাভ করতে পারবে — এই নীতির উপর ভিত্তি করে তারা শাসনব্যবস্থায় কাঠামোগত রদবদল শুরু করে। প্রথমেই দৃষ্টি পড়ে এখানকার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর, কেননা এর মাধ্যমে দেশীয় মানুষদের তাদের চাহিদামতো গড়ে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নকালে চিকিৎসাবিজ্ঞানও বাদ পড়ল না। সেই সময়ে শিক্ষাদানের দায়িত্বে থাকা কবিরাজ ও ইউনানি শিক্ষকদের পরিচালিত চিকিৎসাপদ্ধতিকে বাতিল করে পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলনে জোর দেন। নানা বাধার মধ্যে শেষ পর্যন্ত বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হয়। শাসন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আমলাদের স্বাস্থ্যের প্রতি শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি আর সেই কারণেই ভাষার সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়সাধন। এদিকে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি দেশীয় ব্যক্তিদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রমে চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রবণতা বাড়তে থাকে। কেবল মানুষই নয়, ক্রমে ক্রমে গৃহপালিত (মূলত গোরু) পশুচিকিৎসারও প্রসার ঘটল। রাজ্যশাসন ও বাণিজ্যের কারণে এদেশে ইউরোপীয়দের যাতায়াত বাড়তে থাকার কারণে পাশ্চাত্য চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রসার ঘটতে থাকে। ইংরাজি ও বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বিজ্ঞানের পত্র-পত্রিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। আর্থিক কারণে এদেশীয় মানুষ যাঁরা কলকাতায় বসতি স্থাপন করেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই ইউরোপীয় বা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত দেশীয় চিকিৎসকদের ‘গৃহচিকিৎসক’ হিসেবে নিযুক্ত করতেন। আবার কোনও অঞ্চলে কলেরা অথবা অন্যান্য রোগের কারণে মড়ক দেখা দিলে সেখানে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত চিকিৎসকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাশ্চাত্য চিকিৎসকদের দক্ষতার অভাবে ইউরোপীয় ওষুধ বারবার ব্যবহার করেও ফল না পাওয়া গেলে রোগের তীব্রতাকে দায়ী করা হত।
ক্রমে শাসনকার্যের স্বার্থেই গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। রাজত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানের নতুন ধরনের আবহাওয়া, জলবায়ু ও স্থানীয় রোগের সম্মুখীন হতে হয়। কখনও কখনও সেইসব রোগ-ব্যাধিকে বুঝতে গিয়ে, তার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেশীয় ইংরেজি-শিক্ষিত চিকিৎসকদের মতামত ও অভিজ্ঞতার সাহায্য নিতে হয়েছে। পাশ্চাত্য ও দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতির এই ধরনের সমন্বয় বা আদান-প্রদান থেকে আরও নতুন ভাবনা উঠে আসতে থাকে। গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভারতবর্ষের ওষুধ, শল্যবিজ্ঞান এসবের সূত্রে প্রাচ্য দেশীয় চিকিৎসার ইতিহাসচর্চা চলতে থাকে। ‘ইন্ডিয়ান অ্যানালস অব মেডিক্যাল সায়েন্স’, ‘দ্য জার্নাল অব দ্য বেঙ্গল ব্রাঞ্চ অব দ্য ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’, ‘দ্য ক্যালকাটা জার্নাল অব মেডিসিন’, ‘দ্য ক্যালকাটা মেডিকেল নিউজ’ প্রভৃতি ইংরেজি পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি ‘ভিষক দর্পণ’, ‘চিকিৎসা সংগ্রহ’, ‘চিকিৎসাদর্শন’, ‘চিকিৎসাদর্পণ’ — তৎকালীন বাংলা ভাষায় প্রকাশিত চিকিৎসাবিজ্ঞানভিত্তিক পত্রিকাগুলির এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। উইলসন, ওয়াইজ, পিটার ব্রেটন, উইলিয়াম ব্রুক ওসানেসি, জন টাইটলারদের মতো খ্যাতনামা চিকিৎসকরা কিন্তু এদেশীয় কবিরাজ ও হাকিমদের চিকিৎসা পদ্ধতিকে পুরোপুরিভাবে বাতিল করতে পারেননি। মধুসূদন গুপ্ত, জগবন্ধু বসু, কানাইলাল দে, রাধাগোবিন্দ কর, রাজেন্দ্রকুমার সেন, রমানাথ বরাট, গণনাথ সেন প্রমুখ দেশীয় চিকিৎসকরা পাশ্চাত্য চিকিৎসাপদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হয়েও গবেষণামূলক চিকিৎসায় দেশি-বিদেশি দুই পদ্ধতির আদান-প্রদানে সম্মতি প্রকাশ করেছিলেন।
ইউরোপীয় ওষুধের অভাবজনিত কারণে ইউরোপীয় ওষুধের চড়া দামের কারণে ইচ্ছে থাকলেও বহু ক্রেতা তা কিনতে অসমর্থ হওয়ায় ইংরেজ সরকার বিকল্প হিসেবে পাশ্চাত্য ভেষজের প্রতি আগ্রহী হতে শুরু করে। কারণ এতে ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা প্রভূত লাভবান হবে। ওসানেসি কমিটির পক্ষ থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আবার দেশীয় গাছগাছড়ার প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এসব ভেষজ আমদানি খরচসাপেক্ষ ছিল আর ভারতের মাটিতে পরীক্ষামূলকভাবে জন্মালেও তার গুণাগুণ বজায় থাকার সম্ভাবনা কম ছিল। ইউরোপীয় ওষুধের বিক্রির ব্যাপারে উদ্গ্রীব সরকার গ্রামের জনসাধারণের সুবিধার জন্য অল্প দামে ইউরোপীয় ওষুধ বিক্রি করতে তৎকালীন লেফ্টেন্যাণ্ট গভর্নর আদেশ দেন। ওষুধ বিক্রেতাদের অজ্ঞতা সম্পর্কে তারাপ্রসন্ন রায় মন্তব্য করেন, “দেশীয় ভেষজকে যত্ন সহকারে শুকনো ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হলেও অনেকদিন ফেলে রাখলে তার জৈব চিকিৎসামূলক গুণগুলি নষ্ট হয়ে যায় এমনকী তৈরি অবস্থায় অরিষ্ট ও আরক জাতীয় ওষুধগুলিও অকেজো হয়ে পড়ে।” আবার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতে, “কলকাতার ঔষধের বাজার প্রধানত অশিক্ষিত স্থানীয় এবং পশ্চিমা মুসলমানদের হাতে ছিল। ইহাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র স্বদেশ প্রীতি ছিল না এবং ইহারা স্থানীয় ভেষজ প্রস্তুতকারকদের উপর অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করিতে ছাড়িত না।”
অন্যদিকে দেশীয় ভেষজ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি সরকারের অনীহা অপ্রকট ছিল না। কলকাতা, বর্ধমান, হাওড়া, ঢাকা জেলার যেসব টোলে সংস্কৃত ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হত, সেগুলির প্রতি সরকারের বিরূপ মনোভাবের কারণে সেখানকার শিক্ষার্থীরা সব পরীক্ষায় বসতে পারত না। টোলগুলিতে রোগের কারণ, পূর্ববর্তী ইতিহাস, বর্তমান লক্ষণ, রোগের প্রকৃতি অথবা পরিবর্তন, রোগের নিরাময় ব্যবস্থা, ওষুধ ও ব্যবহার পদ্ধতি, খাদ্য তালিকা, পথ্য, ওষুধের শারীরিক প্রতিক্রিয়া ও স্বাস্থ্য, চিকিৎসাবিজ্ঞানের শব্দগুলির আলোচনায় এভাবে আদ্যন্ত বিশ্লেষণমূলক চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষাদান করা হত।
বিদেশি ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি বহু মানুষের সমর্থন থাকলেও তা ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। ওষুধের দাম, দুষ্প্রাপ্যতা প্রভৃতি কারণে পত্র-পত্রিকাগুলিতে এই সমস্যার সমাধানে নানা মত, তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকলেও একটা বিষয়ে কম-বেশি সহমত লক্ষ করা গেল— সকলেই অসুস্থতা থেকে রেহাই বা মুক্তির আগে সুস্থতা বজায় রাখার ব্যাপারে জোর দিতে বলছেন। সাধারণ ‘হিন্দু’ বাড়িতে পালনীয় ধর্মীয় আচারের তুলনায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর অভ্যাস অনুশীলনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। শিশুর স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তার শরীরের যত্ন নেবার জন্য মায়েদের প্রতি নানা পরামর্শ বর্ষিত হচ্ছে। এসব থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, অসুস্থতার হার যদি কমানো যায়, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যদি সাবধানতা অবলম্বন করা যায়, তাহলে নিত্যদিনের নানা রোগব্যাধির কবল থেকে মুক্ত থাকা খুব কঠিন কাজ নয়। এবং এই সত্য সাধারণ মানুষ যাতে উপলব্ধি করে তার জন্য আলোচনা-পরামর্শ পত্র-পত্রিকায় স্থান করে নিতে থাকে।
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে সমাজে স্ত্রীশিক্ষার যে জোয়ার এসেছিল, সেখানে মেয়েদের পাঠ্যপুস্তকে যখন ‘গৃহ পরিচালনা’-র নানা খুঁটিনাটি জায়গা করে নিচ্ছে, তখন এই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচেতনতার বার্তা সেখানে পাঠ্য রূপে তুলে ধরা হচ্ছে। ক্রমে ‘গৃহ’, ‘পরিবার’ এই শব্দগুলি যতো বেশি আলোচনায় প্রাধান্য পেতে থাকল, তার সঙ্গে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তাও এই আলোচনায় বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করতে থাকল।
উনিশ শতকের রান্নার বইগুলিতে তাই শুরুতেই রান্নার উপকরণ বা পদ্ধতি নয়, কীভাবে রান্নাঘরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুবিন্যস্ত রাখতে হবে সেই সম্বন্ধে লেখক-লেখিকারা আলোচনা করেছেন। ‘গৃহবিজ্ঞান’ বা ‘পরিবার পরিচালনা’-র বইতেও রান্নার কাজকে গৃহস্থালীর অঙ্গরূপে দেখা হয়েছে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়ির মহিলাদেরই গৃহ পরিচালনার ভার নিতে হয় বা নেওয়া উচিত বলে তাঁরা মনে করেন, তাই বাড়ির মহিলাদের শরীর-স্বাস্থ্যের ভালো মতো জ্ঞান থাকা আবশ্যক বলেই মনে করছেন। নতুন পরিবার-এর ধারণায় মেয়েদের হাতে গৃহের প্রত্যেকের (পরিবারের শিশু থেকে বয়স্ক মানুষ এমনকি শয্যাশায়ী সব বয়সী সদস্যের) সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়।
বিনয়ভূষণ রায় তাঁর গ্রন্থে জানিয়েছেন, “হিন্দুসমাজে স্বাস্থ্যের দায়িত্ব শুধুমাত্র কবিরাজদের উপরেই ন্যস্ত ছিল না।… ওষুধের ব্যবহারে গৃহবধূর গুরুত্বও কম ছিল না। সমস্ত প্রকার শিশু এবং মহিলাদের বিশেষ ধরনের চিকিৎসায় তাঁর দায়িত্ব ছিল। রন্ধনশিল্প ও সমাজের অন্যান্য কাজের সঙ্গে ওই সমস্ত ক্ষেত্রে একজন গৃহবধূর জ্ঞান থাকার প্রয়োজন হত। বয়স্কদের কাছ থেকে ছোটোরা এ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করত। নৈতিক উপদেশ ও ব্যবহারের মাধ্যমে এক প্রজন্ম অন্য প্রজন্মের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করত। এক অথবা একাধিক ভেষজের ক্কাথ ও রসের সাহায্যে সেই সমস্ত শিশুর বেশির ভাগ রোগের চিকিৎসা করা হত। আট থেকে দশ বছর বয়সের কম শিশুদের চিকিৎসার ভার থাকত ওই সকল মহিলাদের উপর। তার থেকে বেশি বয়সের শিশুদের দায়িত্ব নিত কবিরাজগণ। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ক্ষেত্রে একজন ভালো গৃহবধূর সেবা ছিল অতি মূল্যবান।”
উনিশ শতকের বাংলা পত্র-পত্রিকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বাসগৃহকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে দেখাশোনা করা, রোগীর পরিচর্যা, পথ্য প্রস্তুতপ্রণালী প্রভৃতি বিষয়গুলি বারেবারে এসেছে। এইভাবে উনিশ শতকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক তুলনামূলক সরল সংস্করণের ধীরে ধীরে হাসপাতাল থেকে গৃহে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। একে প্রদীপ বসু ‘পরিবারের মেডিকালাইজেশন’ বলে অভিহিত করেছেন। মানুষের নানা সমস্যা যা আপাতদৃষ্টিতে চিকিৎসাক্ষেত্রের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, সেসবই এই প্রক্রিয়ায় চিকিৎসাবিদ্যার অন্তর্গত হয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় সমাজের প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচরণ চিকিৎসাবিধির আধিপত্য, প্রভাব ও নজরদারির আওতায় চলে আসে। ফলে যৌনতা, সন্তান প্রসব, বার্ধক্য, মৃত্যু, প্রাকৃতিক ও ব্যক্তিগত জীবনের উপাদান, সবই এই চিকিৎসাবিদ্যার নজরদারির আওতাভুক্ত হতে থাকল। আগে এই প্রাকৃতিক ও নৈতিক জীবনযাত্রা, এমনকি সামাজিক জীবনযাত্রাও ‘ধর্ম’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। আগে যা পাপ বা অধর্ম বলে গণ্য হত, এখন তা অসুস্থতা বা ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকল। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এক ধরনের আত্মসংযমের কথা বলে, যা হৃদরোগ, যৌনরোগ, মানসিক চাপ প্রভৃতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ফলে এক অর্থে হিতকারী জীবনের কথাই বলা হচ্ছে আর সে কারণে নৈতিক জীবন ধর্মীয় অনুশাসনের পরিবর্তে চিকিৎসাবিধি দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। কেননা স্বাস্থ্যবিধির মূল কথা হল শরীর রক্ষা, দীর্ঘ জীবন লাভ, সুস্থ ও স্বচ্ছন্দ থাকা, দেহের পূর্ণবিকাশ লাভ, দেহযন্ত্রের সচলতা ও সামঞ্জস্য রক্ষা ইত্যাদি। নতুন প্রস্তাবিত চিকিৎসাবিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে নারীর দুই রকম ভূমিকা ছিল। প্রথমত তাকে পরিবারের স্বাস্থ্যরক্ষার ভার নিতে হবে। দ্বিতীয়ত তার নিজের স্বাস্থ্যের দিকেও তাকে মনোযোগ দিতে হবে। পুরোনো দিনের নানা দেশজ চিকিৎসাপ্রণালী সম্পর্কে বাড়ির মহিলাদের প্রজন্মগতভাবে পাওয়া সাধারণ জ্ঞান থাকত, অনেক সময় দাসীরাও এসব টোটকায় পারদর্শী হত। আগের ব্যবস্থায় পরিবার ও চিকিৎসাশাস্ত্রের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের ফলে, অন্যান্য শিক্ষাজগৎ দাসদাসী ও ঠাকুমা-দিদিমার আয়ত্তাধীন ছিল। পরিবারে চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে ‘মাতা’ বিশেষ অধিকার ও গুরুত্ব লাভ করে এবং পরিবারের শিক্ষিকা ও চিকিৎসকের সহযোগীর ভূমিকায় উন্নীত হন। এখানে পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিধি প্রধান হলেও কিছু মাত্রায় দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতিও অনুসৃত হয়। সমকালীন লেখাপত্রে নারীকে বারবার সতর্ক করা হয় তাঁর এই নতুন অবস্থান সম্পর্কে। তাঁর কাজ যে সহজ নয় এবং কেবল পরীক্ষা পাশ যথেষ্ট নয়, এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ও গার্হস্থ্য স্বাস্থ্য বিষয়ে যথার্থ শিক্ষিত হতে হবে, একথা বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হতে থাকে। অর্থাৎ তাকে নিজের শয়ন-ভোজন-ব্যায়াম-বিশ্রাম নিয়ম মেনে করতে হবে, আবার জননী-পত্নী-গৃহিণী হিসেবে পরিবারের প্রতি সদস্যের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হতে হবে, এভাবে সার্বিক গৃহকল্যাণের মধ্যে দিয়েই সমাজ তথা জাতি তথা দেশের মঙ্গল সাধন সম্ভব। সমাজের হিতের জন্যে তাদের একদিকে যেমন প্রাণীবিদ্যা, শরীরসংস্থান সম্পর্কে অল্প-বিস্তর জ্ঞান, শুশ্রূষা, আঘাত বা ক্ষতের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার সময় কোনও প্রকার ছোটাছুটি বা ব্যাকুলতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে স্থির প্রত্যয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও উপযোগী কর্তব্য, গৃহের পরিচ্ছন্নতা ও বায়ুর চলাচল, খাদ্য ও তার উপযোগিতা বুঝে ব্যবহার, রন্ধনপ্রণালী, পথ্যের ব্যবহার, সুষম আহার, বিশুদ্ধ বায়ু, সার্বিক পরিচ্ছন্নতা, উপযুক্ত ব্যায়াম, বিশ্রাম, পারিপাট্য বিষয়ে সম্যক জ্ঞানলাভ করতে হবে, আবার রোগীসহ বাড়ির প্রত্যেকের কল্যাণার্থে শুশ্রূষাকারিণী হিসেবে বিবেচনা, প্রফুল্লতা, ধৈর্য, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, আত্মসংযম, সাহস প্রভৃতি গুণেরও অধিকারিণী হতে হবে।
পরিবারে এইভাবে স্বাস্থ্যবিধির প্রচলনে দেখা গেল, যা কিছু স্বাস্থ্য ও পীড়ার সঙ্গে যুক্ত সেসবই সামাজিক নজরদারির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ল। এভাবেই নারীর প্রজনন, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, বন্ধ্যাত্ব, গর্ভপাত, প্রসূতি অবস্থা, সন্তান প্রসব, শিশুপালন এসব কিছুই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিয়ন্ত্রণের গণ্ডি পেরিয়ে সামাজিক বিধি তথা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের আওতাভুক্ত হয়ে পড়েছে। তাই গর্ভবতী জননীর আহার-বিশ্রাম-ব্যায়াম-ভালোমন্দ যেমন নতুন চিকিৎসাবিধির নজরদারির অধীনস্থ, তেমনই সেই জননীকেও তার গর্ভস্থ শিশুর সম্পূর্ণ খেয়াল রাখতে হচ্ছে, শিশুর জন্মের পরও সেই নজরদারি বহাল থাকছে। স্তন্যপানবিধি, শিশুর আহার-নিদ্রা, অঙ্গ সঞ্চালন, ব্যায়াম, ধাত্রী দ্বারা শিশুপালনের অপকারিতা, প্রথাগত শিশুর তত্ত্বাবধানের সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে মাকেও আহারে-বিহারে স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। পরিবারে শিশুর গুরুত্ব আগেও ছিল, কিন্তু নতুন স্বাস্থ্যবিধি রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নবজাত, শিশু যাতে চিররুগ্ন না হয়, তার জন্য একদিকে শাসকও যেমন বিধি আরোপ করছে, আবার দেশের স্বাধীনতা যে সুস্থ সবল জাতির দ্বারাই আনা সম্ভব সে সত্য অনুধাবন করে পরাধীন মানুষ নবজাতকের স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে শিশুর অকালমৃত্যুর বিপুল হারের অন্যতম কারণ মায়েদের স্বাস্থ্যহীনতা। তাই জননীর স্বাস্থ্যজ্ঞান থাকার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে, তাকে পদে পদে সতর্ক করা হচ্ছে, তার সন্তান-সন্ততির রোগ-আরোগ্য, সবলতা-দুর্বলতা, বিকলাঙ্গতা, অঙ্গসৌষ্ঠবতা, অকালমৃত্যু বা দীর্ঘজীবন, তাদের সম্ভাব্য শুভাশুভ এসবই মায়ের স্বাস্থ্যজ্ঞানের উপর নির্ভর করে। অনেক আলোচক আবার ইতিহাস বা ভূগোল শিক্ষার পরিবর্তে শিশুসহ গৃহের সকলের সেবা-শুশ্রূষা, প্রাথমিক চিকিৎসা, বয়স ও শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাদ্য, সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে পালনীয় কর্তব্য, বাড়িঘর স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী পরিচ্ছন্ন রাখা, সময় মেনে পরিশ্রম-বিশ্রাম এসব শেখাই অত্যাবশ্যক বলে মত প্রকাশ করেছেন।
পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে শিক্ষামূলক প্রকাশিত লেখায় প্রায়ই এক ধরনের অভিযোগ দেখা যেত, যে আগেকার দিনের সংসারের মেয়েরা গাছগাছড়ার ব্যবহার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন, সেসবের সাহায্যে পরিবারের মানুষের পীড়া বা ব্যাধির উপশম করতে পারতেন, কিন্তু এখন তাঁদের এসব বিষয়ে কোনও জ্ঞানই নেই। ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায় একটি রচনায় লেখা হয়েছে, “অতি অল্পদিবস পূর্ব্বে আমাদের দেশের স্ত্রীলোকদিগের সকলেই নানা প্রকার পীড়ার কিছু কিছু ঔষধ জানিতেন। এটা তাঁহাদের সাংসারিক অন্যান্য কার্য্যের ন্যায় একটা শিক্ষণীয় কার্য্য ছিল। বাটীর মধ্যে কাহারও পীড়া হইলে প্রথমে চিকিৎসকের সাহায্য না লইয়া গৃহিণীরা তাঁহাদের শিক্ষিত ঔষধ দ্বারা পীড়া শান্তির চেষ্টা করিতেন এবং অনেক স্থলে তাহার সুফলও দেখা গিয়েছে। কিন্তু বর্ত্তমান সময়ে যে বালিকারা বিদ্যালয়ে গিয়া বিদ্যা শিক্ষা করিতেছে, তাহারা এই সকল বিষয়ে কিছুই শিক্ষা লাভ করিতেছে না।” প্রদীপ বসুর মতে, “আসলে এই জ্ঞান আর ফিরে আসবার নয়। কারণ যা ছিল সাধারণ জ্ঞান, মোটামুটি সকলের আয়ত্তের মধ্যে, তা-ই এখন বিশেষজ্ঞের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেছে। তার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা, বুদ্ধি প্রয়োজন। আগে যে-জ্ঞান শুধু বাড়ির গৃহিণীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, দাসদাসী, পরিবারের অধীনস্থ নিম্নবর্গের মানুষরাও অনেক সময় এ ব্যাপারে সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করতে পারতেন, সেই জ্ঞানের চরিত্র কিন্তু ক্রমশই পালটে যেতে থাকল। এ এক নতুন বিশেষীকরণ, যা জন্ম দিয়েছে নতুন এক্সপার্টদের। মজার কথা হল, যাঁরা লিখছেন পুরোনো বিদ্যা ভুললে চলবে না, তাঁরা যখন পরিবারে যথাযথ ভূমিকা পালনের জন্য নারীকে কী কী শিখতে হবে তার তালিকা উপস্থিত করেছেন তখন দেখা যাচ্ছে তাঁরা আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার কাঠামোর মধ্যে থেকেই করছেন।” ফলত এক ধরনের বিপরীতমুখিনতা কিন্তু এই চিন্তাধারা মধ্যে স্পষ্টই লক্ষ করা যায়। পুরোনো ও নতুন-এর কতখানি রাখবেন, কতখানি ছাড়বেন সেটা স্থির করে উঠতে পারছেন না অনেকেই। কিন্তু সমাজের-পরিবারের মঙ্গল-কল্যাণ প্রভৃতির ভিত্তিতে নারীর ভূমিকাকে জটিল থেকে জটিলতর অবস্থানে নিয়ে গেছেন প্রত্যেকেই। স্ত্রী শিক্ষার প্রসারের সূচনায় নারীর সমানাধিকারের কথা বলা হলেও আদতে তা কখনোই কার্যকরী হয়নি। নারীর শিক্ষার লক্ষ্য যেন কখনোই ব্যক্তিগত হিত না হয়, পরিবার বা সমাজের হিতই তার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। অন্দরমহলের ভিতরে তার সমস্ত বুদ্ধিবত্তা ও শারীরিক-মানসিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে পরিবারের মঙ্গল সাধনের মধ্যে দিয়ে সমাজ ও জাতির বৃহত্তর মঙ্গলকে সূচিত করাই নারীশিক্ষার শেষ কথা হওয়া উচিত মনে করতেন এই লেখকদের একটা বড়ো অংশ। তাই নারীর পাঠ্যক্রমে গৃহপরিচালনা-রন্ধন-শিশুপালন-শিশু মনস্তত্ত্ব-প্রাথমিক চিকিৎসার মতো বিষয় অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
উপনিবেশের শাসননীতিতে শাসিত মানুষজনের সংখ্যা, জন্ম-মৃত্যুর হার বা অন্যান্য আঞ্চলিক ও কালিক বৈশিষ্ট্য এসবই শাসকের নজরাধীন ছিল, অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যু, জনবৃদ্ধি, জনসংখ্যার সঙ্গে ধন উৎপাদনের সম্পর্ক, বিয়ে, বংশবৃদ্ধি অর্থাৎ সন্তান উৎপাদন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রভৃতি। এইসব কিছুর মধ্যে দিয়ে এটা স্পষ্ট যে ‘শরীর’-কে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে এক নতুন সম্পর্ক, এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে। সবল-দুর্বল, স্বাস্থ্যবান-অসুস্থ শুধু এরকম সরল বিভাজন নয়, কারা বেশি উপযোগী, কারা বেশি দিন বেঁচে থাকছে, কাদের রোগের হার বেশি বা কম, কারা বেশি প্রশিক্ষণ পাবার উপযুক্ত, অর্থাৎ জনসংখ্যার জৈব লক্ষণগুলি শাসকের অর্থনৈতিক পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আর সেই সূত্রেই পরিবারে শিশুর স্বাস্থ্যের উপর এত গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
শুধু তাই নয়, নতুন চিকিৎসাবিধি পরিচালিত পরিবারে মনস্তত্ত্ব যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ, তাই শিশুর ‘শৈশব’ আলাদা মনোযোগ আকর্ষণ করে। শিশুর পালনকে কেন্দ্র করে এত লেখালেখি বা গর্ভবতী নারী ও জননীকে বারবার সতর্ক করার একমাত্র কারণ শিশুকে বড়ো করে তোলার ক্ষেত্রে পালনীয় কাজগুলি বা প্রকৌশলগুলি সঠিকভাবে যাতে মানা হয়। শিশু সঠিক পরিবেশে বড়ো হচ্ছে কিনা, তার সাবালকত্ব অর্জনের উপযোগী শারীরিক ও অর্থনৈতিক শর্তাবলি পালন হচ্ছে কিনা, তার সঙ্গে কীরকম আচরণ করা উচিত— বাংলা পত্র-পত্রিকা ও এবিষয়ক বইপত্রে শিশুপালন নিয়ে লেখা দেখলেই বোঝা যায় সাধারণের মধ্যে এবিষয় নিয়ে সচেতনতা জাগরণের পটভূমির স্বরূপটিকে।
এটা স্পষ্ট যে স্বাস্থ্যপরিচালনার এই প্রক্রিয়া বা প্রচেষ্টা শাসক ও শাসিত দুই তরফ থেকেই ছিল। এই ক্ষেত্রটি পরিবার ও সমাজের মানুষজনের পারস্পরিক সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসাবিধির কর্তৃত্ব ছিল আংশিক, মানুষের গ্রহণযোগ্যতা ও আচরণও শেষপর্যন্ত নিয়ন্ত্রক। গৃহের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত লেখাপত্রে বিস্তারিত নির্দেশাবলিতে বঙ্গদেশের বাসগৃহ কেমন হওয়া উচিত, গৃহের পয়ঃপ্রণালী কেমন হওইয়া উচিত, বাড়িতে আলোবাতাস সমাগম ও নিকাশি ব্যবস্থা কীরকম হওয়া উচিত, বাড়ির চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জনসংখ্যার ঘনত্ব-পরিচ্ছন্নতা এসবই নতুন স্বাস্থ্যবিধির আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্গত ছিল। এভাবে জীবনের নানা ক্ষেত্রকে বিধিসম্মত ভাবে পরিচালনার বিষয়টি ক্রমে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে এই প্রাথমিক বিধিপালনের স্তর অতিক্রম করে বাঙালি শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষজন স্বাস্থ্য বিষয়ে বইপত্র কিনে পড়ছেন, নিজের বাড়িতে যথাসম্ভব সেসব কেতাবি পরামর্শ আরোপ বা পালনের ব্যবস্থা করছেন। বাঙালির স্বাস্থ্য বা সমগোত্রের নামাঙ্কিত একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে, যেখানে কম খরচে ছাত্র-যুবকদের জন্য দেশি খাদ্যর বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণভিত্তিক বই লেখা হয়েছে। সেখানে জনস্বাস্থ্যের ভগ্নদশার কারণ দর্শাতে গিয়ে খাদ্যের অপ্রতুলতা, আর্থিক অসচ্ছলতা, রোগ ব্যাধির প্রকোপ, অসচেতনতার পাশাপাশি অনুপযুক্ত খাদ্যের কথা বারবার উঠে আসছে। খাদ্যাভ্যাসে পাশ্চাত্যের অনুকরণে পুষ্টির অভাবের কথা প্রাধান্য পাচ্ছে। সুস্বাস্থ্য প্রসঙ্গে দেশীয় খাদ্যরীতিকে গ্রহণীয় করে তোলার ক্ষেত্রে সরকারি তরফে প্রচারিত পুস্তিকার ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। কম খরচে পুষ্টিকর খাদ্যের তালিকায় মুড়ি-চিঁড়ে-ছাতু-মুড়কি-মোয়া-ছোলা স্থান করে নিচ্ছে। বাড়ি থেকে দূরে পাঠরত ছাত্রদেরও এই স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কেবল খাদ্যাভ্যাস নয়, সুস্বাস্থ্যের জন্য শারীরিক অনুশীলন বা ব্যায়ামের বিষয়েও জোর দেওয়া হচ্ছে।
জাতিচেতনার আলোচ্য দিকগুলি ক্রমে ক্রমে আমাদের জীবনযাপনের মধ্যে এমন ভাবে মিশে গেছে যে সচেতনতা বা নিয়ম ছাড়া আজ একে আলাদা করে চেনা যায় না। কিন্তু বর্তমানে আমাদের স্বাস্থ্যবিধির প্রতি যে মান্যতা যার মধ্যে খাদ্য-বিশ্রামসহ দৈনন্দিন নানা সাধারণ অভ্যাস একসঙ্গে মিশে আছে, আংশিকভাবে হলেও উনিশ শতকীয় জাতীয়তাবাদের মতাদর্শই তার উৎস। প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর মতো বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র দাস, শরৎকুমার রায় প্রমুখেরা যে রান্নার বইয়ের ধারার সূচনা করেছিলেন, তার অনেকখানি জুড়ে আছে বাঙালিত্বের বোধ, যার আঁতুড়ঘর মূলত স্বদেশি ভাবধারা।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি :
১। দাস শরৎচন্দ্র, ‘বিশুদ্ধ পাক-প্রণালী’, (দে গৌতমকুমার, সম্পাদিত), কলকাতা, পরশপাথর প্রকাশন, ২০১৪ (মূল গ্রন্থ দ্বিতীয় সং ১৩৩৬ সন)।
২৷ দেবী সুরমা, ‘ভোজন বিচার’, কলকাতা, প্রকাশক : শ্রীশচন্দ্র শর্ম্মা, ১৯৩১।
৩৷ পাল রুদ্রেন্দ্রকুমার, ‘বাঙালীর খাদ্য’, কলকাতা, চক্রবর্ত্তী, চ্যাটার্জ্জি এন্ড কোং লিমিটেড, ১৯৪৯।
৪। বসু চুনীলাল, ‘খাদ্য’, সাহিত্য সম্ভার গ্রন্থাবলী, সংখ্যা ১, কলকাতা, স্ট্যান্ডার্ড প্রেস, ১৯১১।
৫৷ বসু প্রদীপ, ‘পারিবারিক প্রবন্ধ : বাঙালি পরিবারের সন্দর্ভ বিচার’, কলকাতা, গাঙচিল, ২০১২।
৬। বিশ্বাস ডক্টর হরগোপাল, ‘জাতিগঠনে খাদ্য’, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রচার বিভাগ দ্বারা প্রকাশিত, ১৯৩৬।
৭। ভট্টাচার্য্য চারুচন্দ্র, ‘বাঙালীর খাদ্য’, কলকাতা, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স, ১৯৪৩।
৮৷ ভট্টাচার্য জয়ন্ত (সম্পাদিত), ‘ভারতের পটভূমিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা’, কলকাতা, অবভাস, ২০০৯।
৯। সুর ড. অতুল, ‘বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন’, কলকাতা, সাহিত্যলোক, ২০০৮।
১০। সুর নিখিল, ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পটভূমি’, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ২০১২।
১১। সেন ইন্দুভূষণ, ‘বাঙ্গালীর খাদ্য’, কলকাতা, প্রকাশক: ‘আরোগ্য নিকেতন’, পঞ্চম সংস্করণ, ১৯২৮।
১২। Ray Krishnenedu and Srinivas Tulsi, ‘Curried Cultures : Globalization, Food, and South Asia’, Volume 34 in the series ‘California Studies in Food and Culture’, Published by University of California Press, 2012.
১৩। Sengupta, J., ‘Nation on a Platter : The Culture and Politics of Food and Cuisine in Colonial Bengal’, Modern Asian Studies, 44(1), 81-98, 2010.