আক্রান্ত স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার মায় সংবিধান

অম্বিকেশ মহাপাত্র

এক

ভাইরাসকুলের নবতম সংযোজন নব্য করোনা। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ক্ষমতা অত্যন্ত দ্রুত। অসুখের নাম কোভিড-১৯। মৃত্যুর হার ২  শতাংশের আশেপাশে। এই প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী করোনা-আতঙ্ক। সঙ্গে অতিমারি। মোকাবেলায় জরুরি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো সহ আনুষঙ্গিক কাঠামো গড়ে তোলা। সেকারণেই প্রাথমিক পদক্ষেপে প্রয়োজন দেশব্যাপী লকডাউন। তাই বলে প্রস্তুতি এবং আগাম সতর্কতা ছাড়াই? আকস্মিক লাগু হয়ে গেল দেশজুড়ে টোটাল লকডাউন, মাত্র চার ঘণ্টার নোটিশে! শুধুই আকস্মিক? অপরিকল্পিত এবং একতরফাও! টোটাল লকডাউন টানা ৬৮ দিন, ৪ দফায়। তাতে যা হওয়ার তাই-ই ঘটল। অনিবার্য পরিণতি — কোটি কোটি মানুষের রোজ গেল, রোজগার গেল, ভাত-রুটির সংস্থানও গেল। লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার পড়লেন অভূতপূর্ব এবং অবর্ণনীয় দুর্দশায়। অসহায় পরিবারগুলি প্রাণ বাঁচাতে, অনন্যোপায়ে ফিরতে চাইলেন জন্মভিটায়, পরিজনদের কাছে। অভিবাসীদের ফেরাতে সরকারের হেলদোল নেই! সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন-পিটিশন, তারও শুনানি নেই! সুপ্রিম কোর্টেও কার্যত লকডাউন! মরিয়া অভিবাসী শ্রমজীবী পরিবারগুলি ফিরবেন জন্মভিটায়, দরকারে শত শত কিলোমিটার হেঁটে! কোলে বাচ্চা এবং কাঁধে-পিঠে-মাথায় বোঝা! পথেই মরলেন শত শত অভিবাসী, পথ-কুক্কুরের মতো, কী অমানবিক দৃশ্য! দেশের অর্থনীতির কথা নাই-বা বললাম। রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর পদে টিকতে পারেননি অর্থশাস্ত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রঘুরাম রাজন, এমনকি উর্জিত  প্যাটেলও! পদ তো আর খালি থাকে না। অবশেষে ইতিহাসের শক্তিকান্ত দাশ! আর দেশের সম্পদ? আত্মনির্ভর ভারত গড়তে, দেশের তথা জনগণের সম্পদ বেচেই চলেছেন তথাকথিত একদা চা-ওয়ালা, বর্তমান দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র দামোদরদাস মোদি! 

দুই

দ্বিখণ্ডিত জম্মু-কাশ্মীরে সেনারাজ-এর তৃতীয় বর্ষপূর্তি আসন্ন! প্রথম ১০০ দিনেরও বেশি সময়কাল রাজ্যে সবকিছু বন্ধ! নো কমিউনিকেশন সিস্টেম, নো নেটওয়ার্ক! নেটওয়ার্ক ফিরলেও 2G! অতিমারির আবহে আপনি 4G নেটসহ ঘরবন্দি অবস্থায় হাঁপিয়ে উঠছিলেন, তাই না? ভাবুন, জম্মু-কাশ্মীরবাসীদের কথা। ভাবুন, মেহবুবা মুফতির কথা। বিজেপি জোটের মুখ্যমন্ত্রী, Peoples Democratic Party (PDP) দলের নেত্রী। এক বছরের উপর Public Safety Act (PSA) ধারায় জেলবন্দি! জম্মু-কাশ্মীরবাসীদের গণতন্ত্র, বাক্-স্বাধীনতা, স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার? ভ্যানিশ! সংখ্যার জোরে জম্মু-কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বিলোপ এবং টোটাল লকডাউনের বর্ষপূর্তির দিনে রামমন্দিরের ভূমি-পূজন! তথ্য-নির্ভর নয়, দেশের সুপ্রিম কোর্টের বিশ্বাস-নির্ভর ঐতিহাসিক রায়ে! পুরাতাত্ত্বিক সৌধ বাবরি মসজিদ ভেঙে রামমন্দির নির্মাণ! কী আনন্দ, অতিমারির স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করেই প্রধানমন্ত্রী ভূমি-পূজন করেছেন! 

তিন

অতিমারিতে দেশের গণপরিবহন বন্ধ। মানুষের দুর্দশা চরমসীমা অতিক্রম করেছে। মানুষের সামনে দুর্দশার সমাধান বা নিয়ন্ত্রণের কোনও সোনালি দিশা নেই! দিশেহারা অবস্থা! স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারা স্পষ্ট। দেশবাসী গভীর সংকটে! দায়ী কে? প্রধানত কেন্দ্রীয় সরকার। সংবিধান মতে দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষার দায়িত্ব যার। তারপর অবশ্যই রাজ্য সরকারের। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সরকারের অগ্রাধিকার নেই! তাহলে অগ্রাধিকার কী? অগ্রাধিকার, এই সুযোগে দলের অ্যাজেন্ডা পূরণ। স্বাস্থ্যবিধির ‘দৈহিক দূরত্ব’ পরিবর্তে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখার পরিকল্পিত অবৈজ্ঞানিক নিদান! এই অবস্থায় মিছিল, মিটিং, জমায়েত, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, প্রতিরোধের সুযোগ নেই। সেই সুযোগে দেশকে দাও বেচে! সংসদ এড়িয়ে শ্রম আইন বদলে দাও, শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নাও! যারা অতীতে সরকারের সমালোচনা করেছে, প্রশ্ন করেছে বা এখনও করছে, তাদের সমঝে দাও, সহবত শেখাও। সবার মুখ বন্ধ করো, কন্ঠরোধ করো। দেশ বিরোধী তকমা দাও। গোদি মিডিয়া তো আছে খোল-করতাল নিয়ে নির্দেশ মতো সঙ্গত করে মগজ ধোলাই করবে, অ্যাজেন্ডামাফিক। আর গণতন্ত্র? পরে বুঝে নেওয়া যাবে! আইন, সংবিধান, বিচার-ব্যবস্থা? নিয়ন্ত্রণ করো, নিয়ন্ত্রণ করো। নিয়ন্ত্রণে অসুবিধা কোথায়? আমরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কীসের জন্য? ৩৭০ হটিয়েছি, জম্মু-কাশ্মীরকে দু-টুকরো করেছি, জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যের স্ট্যাটাস কেড়ে নিয়েছি, গণতন্ত্র কেড়ে নিয়ে সেনারাজ চালু করেছি। অতিক্ষিপ্রতায় NPR, NRC, CAA পাস করেছি। আরবান নকশাল তকমা সেঁটে সমালোচকদের জেলে ঢুকিয়েছি, বেরোতে দিচ্ছি না! বাকিদের দেশদ্রোহিতার অপরাধে মামলায় জেরবার করে ছাড়ব! সেজন্যে UAPA-এর প্রয়োজনীয় সংশোধন করে নেওয়া আছে। 

চার

রিজার্ভ ব্যাংক, নির্বাচন কমিশন, নীতি আয়োগ, … সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে কে হবেন প্রধান? কেন্দ্রীয় সরকার মায় আমার দল ঠিক করে দিচ্ছে। সকল রাজ্যের রাজ্যপাল মহোদয় নিয়োগও সেই নিয়মে। তাই যেমন নির্দেশ তেমন কাজ! উদাহরণ? কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, জম্মু-কাশ্মীর। জনাদেশ বিপক্ষে গেলে, সাময়িক অসুবিধা। বিহার, গোয়া, মণিপুর, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশে জনাদেশ বিপক্ষে ছিল, কিন্তু এখন ক্ষমতায় আমরাই। মহারাষ্ট্রে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে, আমরা ছাড়ছি না, প্রচেষ্টা অব্যাহত। ভাত ছড়ালে আবার কাকের অভাব? ভাতের জোগান দিচ্ছে নোটবন্দি, ইলেকটোরাল বন্ড, পিএম কেয়ারস ফান্ড, ব্যাঙ্কের ঋণখেলাপি রাঘববোয়ালরা, এছাড়া ধান্ধার পুঁজিতন্ত্রে বড়ো বড়ো পুঁজিপতিরাও তো রয়েইছে। নীতা বহেনজিদের রিলায়েন্স, জিও-দের এত সুবিধা দিচ্ছি। বৃথা যায় কখনও? রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার সবই আমাদের পছন্দের লোক। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সাংবাদিক সম্মেলনে সমালোচনা করেছিলেন। পরে হন প্রধান বিচারপতি। রামমন্দির যেখানে চেয়েছিলাম, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সেখানেই ভূমি-পুজো করেছি। অবশ্যই অবসরের পরে প্রাইজ পোস্টিং, রাজ্যসভায় মনোনীত সাংসদ! 

পাঁচ

ইন্দিরা গান্ধির ‘গরিবি হটাও’ পরিবর্তে ‘আচ্ছে দিন’ মানুষের মগজে বেশি দাগ কেটেছে। ইন্দিরা গান্ধির ‘কথা কম, কাজ বেশি’ থেকে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’ জনগণ ভালোই খাচ্ছে, খাবেও। ১৯৭৫ সালের ১২ই জুন, এলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরা গান্ধির লোকসভার সদস্যপদ খারিজ করেছিল। প্রধানমন্ত্রী পদ রক্ষা করতে ইন্দিরা গান্ধি সংবিধান-এর ধারায় ২৫শে জুন মধ্যরাতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবে মুখ পুড়িয়েছিলেন! ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা, এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা’ স্লোগানের ৫-বছর পরে ইন্দিরা ভ্যানিশ। নির্বাচনে তার দল গো-হারা। আর এখন হাইকোর্ট কেন, সুপ্রিম কোর্টে প্রচুর হেবিয়াস করপাস মামলা পড়ে! জরুরি অবস্থা জারি করে মুখ পোড়ানোর কি দরকার? বরং আমাদের পথ, উগ্র জাতীয়তাবাদ সামনে নিয়ে এসে ফল ভাল। এই পুলওয়ামা-বালাকোট ধরনের আর কি? ফল তো হাতেনাতে। সেকারণেই তো ৫-বছর পর নির্বাচনে একক নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা। তাই তো ভারতীয় সংবিধান পুজো করে দ্বিতীয়বার সংসদে প্রবেশ। সংবিধান অপ্রাসঙ্গিক করতে হবে। তার রূপায়নে আর পরনির্ভর নই, এখন আমার দল যথেষ্টই আত্মনির্ভর। ইন্দিরা গান্ধির স্বৈরাচার প্রকাশ করতে বলিউড ‘কিস্যা কুর্সি কা’ ছায়াছবি বানিয়েছিল। প্রদর্শন আটকাতে সেন্সর বোর্ড, নেগেটিভ পুড়িয়ে নষ্ট করতে উদ্যোগ নিয়েছিল ইন্দিরা-পুত্র সঞ্জয় গান্ধি। এখন বলিউড সাহসই পাবে না, ঐ ধরনের ছায়াছবি বানাতে।    

ছয়

মুক্তমনা সমালোচকদের পৃথিবী থেকে সরানোর কাজ শুরু হয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে। তালিকায় প্রথম নরেন্দ্র দাভোলকর, তারপর গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গি, সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ ও সুজাত বুখারি, গবেষক রোহিত ভেমুলা, সোহরাবুদ্দিন সেখ খুন-মামলার বিচারপতি ব্রিজগোপাল হরকিষণ লোয়্যা, দাদরি গণপিটুনি-খুনে তদন্তকারী পুলিশ অফিসার সুবোধ কুমার সিং, সাংবাদিক বিক্রম যোশি, ….। প্রয়োজনমতো তালিকা দীর্ঘতর হবে। অসুবিধা কী? আরবান নকশাল তকমায় কবি ভারভারা রাও, আদিবাসীদের উন্নয়নে নিবেদিত ফাদার স্ট্যান স্বামী, ট্রেড ইউনিয়নিস্ট ও লেখক-মানবাধিকারকর্মী সুধা ভরদ্বাজ, মানবাধিকারকর্মী গৌতম নভলখা, নাগপুর ইউনিভার্সিটির ইংরেজির অধ্যাপিকা সোমা সেন প্রমুখদের জেলবন্দি করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। স্ট্যান স্বামী তো জেলবন্দি অবস্থায় মারা গেলেন। কিছু হই-চই হল; কাস্টোডিয়াল ডেথ নিয়ে অভিযোগ এল। তাতে কি যায় আসে? সময়ের সঙ্গে সব থেমে যায়, এখানেও থেমে গেছে। আর দেশদ্রোহী মামলায় জেরবার করার প্রয়াস অব্যাহত, জোরদার। তালিকায় কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ, শেহলা রসিদ, ডাঃ কাফিল খান, …. প্রমুখ।

সাত

করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা যখন প্রতি দু-দিনে এক লক্ষেরও বেশি, মৃত্যু প্রতিদিন এক হাজার ছাড়াচ্ছিল, দেশবাসী কীভাবে করোনা থেকে বাঁচবে? অনাহার থেকেই বা কীভাবে বাঁচবে? প্রধানমন্ত্রী থালি-ঘন্টি বাজানোর পরামর্শের পর বলেছিলেন — “১৮ দিনে কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধে জয় এসেছিল, করোনা-যুদ্ধে জয় হাসিল করতে ২১ দিনের লকডাউন দরকার”। যেমন নোটবন্দির সময় বলেছিলেন — “পঁচাশ দিন চাহিয়ে, স্রিফ পঁচাশ দিন”। সঙ্গে আচ্ছে দিন আয়েগা, বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও, “কালাধন বাপস আনু্ঙ্গা আউর হর দেশবাসিওকা ব্যাংক একাউন্ট মে একসাথ পঁদরা লাখ রূপয়া ডালুঙ্গা, না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা”, বছরে দু-কোটির কর্মসংস্থান, জিএসটি চালু হলে অর্থনীতি হু-হু করে চাঙ্গা হবে, …! প্রথম দফার ২১ দিনের পর চার দফায় ৬৮ দিন লকডাউন। এরমধ্যে দিয়া-মোমবাতি-আলো জ্বালানোর দাওয়াই, ২০ লক্ষ কোটি টাকার স্টিমুলাস প্যাকেজ ঘোষণা, এসবই হয়েছে! কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়েছে কি? আজ বরং দেশের পরিস্থিতি অনিবার্যকারণে শুধুই ভয়াবহ নয়, গভীর উদ্বেগজনক! সেকারণে গুরুত্বপূর্ণ ইলেকটোরাল বন্ডের মামলার শুনানি হচ্ছে না। প্রচুর সংখ্যায় হেবিয়াস করপাস (Habeas Corpus) মামলা পড়ে রয়েছে, যে মামলা দ্রুততার সঙ্গে শুনানি নিয়ে রায় জানাতে হয়, ফেলে রাখা যায় না।

আট

‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ আমাদের দেশ ভারতবর্ষ। দেশের অখণ্ডতা রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী সংবিধানের চতুর্থ স্তম্ভ অর্থাৎ সংবাদ জগৎ। বর্তমান সময়কালে সংবাদমাধ্যমের ধারা মূলত তিনটি — খবরের কাগজ; কেবল্ (Cable) টিভি; এবং e-বিশ্বের ডিজিটাল প্লাটফর্ম। ডিজিটাল প্লাটফর্মের আবার অনেকগুলি ধারা— ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব চ্যানেল, নিউজ পোর্টাল, …। প্রথম এবং দ্বিতীয় ধারাকে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে পারে, করেওছে, পরিকল্পনামাফিক। তৃতীয় ধারার চরিত্র যেহেতু আন্তর্জাতিক, সেহেতু সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। মানুষের অধিকার রক্ষায় যে সকল সাংবাদিক কাজ করতে চান, তাঁদের অধিকাংশ খবরের কাগজ এবং কেবল্ টিভি চ্যানেলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছিলেন না। প্রবীণ সাংবাদিক বিনোদ দুয়া (যিনি সাম্প্রতিককালে প্রয়াত হয়েছেন), করণ থাপার, সিদ্ধার্থ বরদারাজন, পুণ্য প্রসূন বাজপেয়ি, বরখা দত্ত, আকাশ ব্যানার্জি, অভিলাষ শর্মা, আরফা খানুম শেরওয়ানি, প্রমুখ খবরের কাগজ এবং কেবল্ টিভি চ্যানেলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায়, সকলেই ডিজিটাল প্লাটফর্মে আসতে বাধ্য হন! এবং ডিজিটাল প্লাটফর্মের সংবাদ শুধুই বিশ্বাসযোগ্য নয়, দ্রুততার সঙ্গে জনপ্রিয়ও হয়েছে। 

বিশ্বব্যাপী নজিরবিহীন মহামারি, দেশব্যাপী লকডাউন, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ স্বাস্থ্যবিধি অবমাননা করলেন, অযোধ্যায় রামনবমী উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে! সেই খবর জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ‘The Wire’ গুরুত্ব সহকারে সম্প্রচার করে। ফলস্বরূপ, ‘The Wire’-এর কর্ণধার সাংবাদিক সিদ্ধার্থ বরদারাজনের বিরুদ্ধে উত্তর প্রদেশ পুলিশের FIR দায়ের, ১০ই এপ্রিল ২০২০ দিল্লিতে সিদ্ধার্থ বরদারাজনের বাড়িতে উত্তর প্রদেশ পুলিশ! ১৪ই এপ্রিল উত্তর প্রদেশে উপস্থিত হতে নোটিশ! উত্তর প্রদেশ সরকারের প্রতিহিংসামূলক FIR-এর বিরুদ্ধে এন রাম (চেয়ারম্যান, দি হিন্দু গ্রুপ), সোনিয়া সিং (ডিরেক্টর, NDTV) বিজয় শংকর (এডিটর, ফ্রন্টলাইন), রাজদীপ সরদেশাই (ইন্ডিয়া টুডে গ্রুপ), ওম থানভি, প্রেম শংকর ঝা, হরিশ খারে, জন দয়াল, নীরজ চৌধুরি, সাগরিকা ঘোষ, নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় সহ প্রায় ২০০ জন খ্যাতনামা সাংবাদিক প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু FIR প্রত্যাহৃত হয়নি!  

সাংবাদিক এবং স্বনামধন্য বিনোদ দুয়া দিল্লিবাসী বরিষ্ঠ নাগরিক। ৫ই জুন ২০২০ বিশ্ব পরিবেশ দিবস, বিজেপি দিল্লি শাখার মুখপাত্র নবীন কুমারের বিনোদ দুয়ার বিরুদ্ধে FIR দায়ের! দিল্লি পুলিশ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩টি (২৯০, ৫০৫, ৫০৫(২)) ধারায় মামলা রুজু করে। আবার ১২ জুন সকালে হিমাচল প্রদেশের পুলিশ উপস্থিত বিনোদ দুয়ার বাড়িতে, নোটিশ নিয়ে! দেশদ্রোহিতার অভিযোগ! পরের দিন সকালে সিমলার কুমারসাঁই থানায় উপস্থিত হতে হবে! উল্লেখ্য, (১) দিল্লি থেকে সিমলা ১৪ ঘন্টার পথ। (২) Red Zone থেকে অন্যত্র পৌঁছানোর আগে ১৪-দিনের কোয়ারান্টিন অবশ্য পালনীয়। (৩) ডাক্তারের পরামর্শে বরিষ্ঠ নাগরিক বিনোদ দুয়ার বাইরে যাওয়া বারণ। কারণ বিনোদ দুয়া বিভিন্ন ঔষধের উপর রয়েছেন। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের নির্বাচিত সরকারের অমানবিক পদক্ষেপ কেন? বুঝতে পারছেন না? ডিজিটাল প্লাটফর্মকেও যেনতেন প্রকারেণ নিয়ন্ত্রণে আনা, আর কী? 

নয়

অতিমারির উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কারণে সুপ্রিম কোর্ট প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি নিতে পারছে না। হেবিয়াস করপাস মামলাও না! খুব, খুবই জরুরি মামলা ছাড়া শুনানি নয়, এমনই সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টের। সেই পরিস্থিতিতে ২২শ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রবৃত্ত আদালত অবমাননাকর ফৌজদারি মামলা দায়ের করে! মানবাধিকার রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরী এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এবং সোশ্যাল মিডিয়া, Twitter Communications India Pvt Ltd-এর বিরুদ্ধে! কারণ? গত ২৭শে এবং ২৯শে জুন প্রশান্ত ভূষণের দু-টি টুইট। যথাক্রমে (১) “When historians in future look back at the last 6 years to see how democracy has been destroyed in India even without a formal Emergency, they will particularly mark the role of the Supreme Court in this destruction, & more particularly the role of the last 4 CJIs” এবং  

(২) পাশের আলোকচিত্র সহ — “CJI rides a  50 Lakh motorcycle belonging to a BJP leader at Raj Bhavan Nagpur, without a mask & helmet, at a time when he keeps the SC in lockdown mode denying citizens their fundamental right to access justice!” ঠিক দু-দিন পর ২৪ জুলাই, ২০০৯ সালে প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা, ২০১২ সালে যে মামলার শেষবার শুনানি হয়েছিল, তারপর গত ৮ বছর কোনও শুনানির দিন ধার্য্য করা হয়নি, সুপ্রিম কোর্ট সেই মামলার শুনানির নির্দেশ দিল! মামলার বিষয়? প্রশান্ত ভূষণ-এর তেহেলকা ম্যাগাজিনকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার। দু-টি মামলার শুনানির তারিখ যথাক্রমে ৫ এবং ৪ আগস্ট। দু-টি মামলার শুনানি নেবেন বিচারপতি অরুণ কুমার মিশ্রের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের বেঞ্চ। অতিমারিতে ঘরবন্দি পাঠক বুঝতে পারছেন — খুব, খুবই জরুরি মামলার শুনানি নিতে পারছে না সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু টুইটারের মন্তব্যের উপর স্বতঃপ্রবৃত্ত মামলা দায়ের করে দ্রুত শুনানি করতে, শুধু তাই নয়, গত ৮ বছর যে মামলার শুনানি হয়নি, সেই মামলার দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা! সমস্ত নিয়মকে ছুড়ে ফেলে, সুপ্রিম কোর্টের অতিসক্রিয়তার কারণ অনুমেয়। আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে — কোনও প্রশ্ন নয়, কোনও সমালোচনা নয়, চাই কেবল আনুগত্য! তারসঙ্গে “মাস্টার মশায় আপনি কিছুই দেখেন নি”। মূলস্রোতের অধিকাংশ খবরের কাগজ এবং টিভি চ্যানেল সরকারের আনুগত্য মেনেই নিয়েছে, যে কারণে ‘গোদি মিডিয়া’ বহুল ব্যবহৃত নতুন শব্দবন্ধ! প্রশান্ত ভূষণ (পিতা শান্তি ভূষণ, বরিষ্ঠ আইনজীবী এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী)-এর বিরুদ্ধে জোড়া মামলা, বার্তা পাঠাচ্ছে — প্রতিবাদীর কন্ঠরোধের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদেরও সতর্ক করা সুপ্রিম কোর্টের জরুরি দায়িত্ব! হোক না সমালোচনা, হোক না লকডাউন, থাক না পড়ে হেবিয়াস করপাস! 

দশ

আমাদের রাজ্যেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম হয় রাজ্যের শাসকদল নতুবা কেন্দ্রের শাসকদলের আনুগত্য বজায় রেখে সংবাদ পরিবেশনে ব্যস্ত! এখন রাজ্য সরকারের দরকার ডিজিটাল প্লাটফর্মকে নিয়ন্ত্রণে আনা। বাংলার বার্তা-র কর্ণধার সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর শারীরিক নির্যাতন, গ্রেফতার, মামলা দায়ের, জেলহাজত, গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ তথা ডিজিটাল প্লাটফর্মকে নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনামাফিক সচেতন প্রচেষ্টাই! অনুরূপে পুলিশের অতিসক্রিয়তায় রাতারাতি, লকডাউনের মধ্যে আরামবাগ টিভির কর্ণধার সেখ সফিকুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী আলিমা খাতুন এবং সহযোগী সুরজ আলি খানদের ভোরের আগে থানায় নিয়ে আসা। পুলিশ হাজতবাস থেকে জেলহাজতের ব্যবস্থা এবং এসবের পক্ষে পুলিশ সুপারিন্টেডেন্টের সাংবাদিক সম্মেলন, সবকিছু সেই নিয়ন্ত্রণে আনার মরিয়া প্রচেষ্টা। আর আমার বিরুদ্ধে গত ১০ বছর ধরে ফৌজদারি মামলা চলছে সেই ধারায়, যে ধারা আজ থেকে ৭ বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট চিরতরে বাতিল করেছেন! কী প্রমাণ করে? বিচার-ব্যবস্থা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন?  

এগারো

আপনি ভাবছেন কয়েকটি ঘটনা। সুতরাং বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মোটেই তা নয়। ঘটনার ঘনঘটা, সব ঘটনা উল্লেখ করতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘গোদি মিডিয়া’ অধিকাংশ ঘটনাই আপনাকে জানতে দিচ্ছে না, বিপরীতে আপনাকে বিভ্রান্ত করছে! অর্থাৎ গণতন্ত্র তথা মুক্তকন্ঠ তথা সাংবাদিকের স্বাধীনকন্ঠের টুঁটি টিপে হত্যার পরিকল্পনা! পাশাপাশি বিক্ষোভরত কৃষকদের উপর মন্ত্রীপুত্রের গাড়ি চালিয়ে খুন কিংবা বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে রাতের আধাঁরে আনিস খান খুন এবং আনিস খুনের বিচার চাওয়ায় মীনাক্ষী সহ ছাত্র-যুবদের গ্রেফতার করে জেলবন্দি, পাশাপাশি কালা কানুনে জেলবন্দি করে স্বাধীন কন্ঠরোধের প্রয়াস তো অব্যাহত! অর্থাৎ শুধু গণতন্ত্র বা স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার নয়, আক্রান্ত ভারতীয় সংবিধানও। 

বারো

সংবিধানের বিশেষ ধারা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি নেই এবং গণতন্ত্র হত্যার প্রকাশ্য ঘোষণা নেই। কিন্তু সংবিধান নির্দেশিত সবকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আজ আক্রান্ত, আক্রান্ত ভারতীয় সংবিধান। এই অবস্থায় শেষ রাস্তা, দল-মত নির্বিশেষে এবং জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে সংবিধান রক্ষা করা। যে পথের সন্ধান দিয়েছে শাহীনবাগ এবং ৩৭৮ দিনের ঐতিহাসিক কিষান আন্দোলন সঙ্গে ৬৭০ জন কিষানের শহিদের মৃত্যু। ভাবুন, শাহিনবাগে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে অভয়দাত্রী ৯২ বছরের বৃদ্ধা রাতদিন সাতদিন, দিনের পর দিন সামনের সারিতে। দু-মাসের শিশু কোলে প্রেরণাদাত্রী মাও রাতদিন সাতদিন, দিনের পর দিন সামনের সারিতে। আসুন, সেই পথে আমাদের দেশের সংবিধান রক্ষা করি, দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করি। ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ দেশের বৈচিত্র্য, ধর্ম-নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র মায় সংবিধান রক্ষা করি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান