ভাষামুখোশ ও জাতীয়তাবাদ

সত্রাজিৎ গোস্বামী

এক 

একটা দেশের যদি একটার বদলে তিনরকম নাম থাকে, তাহলে সে দেশের জাতীয় মনোভাবটাও তিন-ত্রিক্কে নয় রকম হয়ে ওঠা অসম্ভব নয়! আমরা একসময় মহাভারতের ভরতরাজা আদিপুরুষ বিবেচনা করে আমাদের দেশের নাম রেখেছিলাম ‘ভারতবর্ষ’। মধ্যযুগপর্বে আবার দেশের নামটা হয়ে উঠল ‘হিন্দুস্তান’। হিন্দুদের আবাসভূমি বলেই এ দেশ ‘হিন্দুস্তান’ কিনা, সেটাও আজ আর তেমন স্পষ্ট নয়। কারণ মুসলমান ধর্মযোদ্ধা বা সাম্রাজ্যবিস্তারের স্বপ্নে মত্ত মুসলমান রাজারা এদেশে এসে যখন জাঁকিয়ে বসলেন, তখন দেখলেন, বিজিত দেশের মানুষগুলো নিজেদের ‘হিন্দু’ বলে। তাদের ধর্মবিশ্বাস, রীতিনীতি, আচার-ব্যবহারের সঙ্গে বিজয়ী শাসনকর্তাদের রীতি-আচারের তেমন মিল তো নেই-ই, বরং ব্যাপারটা খানিক আদায়-কাঁচকলায়! তবু মারামারি-কাটাকাটি পর্ব শেষ করে রাজপাট পেতে বসতে গেলে তাদের ধর্মপরিচয়টিকে আদর দিয়ে সেই নামের আদলেই দেশটাকে ডাকলে প্রজানুরঞ্জনের কাজটাও হয়, আর রাজাপ্রজার সম্পর্কটাতেও কিছুটা তাপ্পিরিফু পড়ে! 

তবে শোনা গেছে, সেই কোন্ কালে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার নাকি এদেশে এসে রাজা পুরুর কাছে ঠেকে গিয়েছিলেন। যে গল্পটা পাঠ্যবইয়ে আজও জাঁকিয়ে বসে আছে, তার সত্যিই কোনও ঐতিহাসিক নথি আছে কিনা, সেসব আপাতত তলিয়ে দেখায় আমাদের প্রয়োজন নেই। যাই হোক, সেই আলেকজান্ডারের দেশের লোকজনেদের জিভ নাকি এমন আড়ষ্ট ছিল, যে ‘স’-কে বলত ‘হ’। তো, তারা যখন সিন্ধু নদীর আশপাশ জুড়ে ঘাঁটি গাড়লো, তখন উচ্চারণদোষে ‘সিন্ধু’ হয়ে দাঁড়াল ‘হিন্দু’। আর সিন্ধুর অববাহিকায় যারা বাস করে, তাদেরই বলা হতে থাকল ‘হিন্দু’। আলেক-রাজা ফিরে গেলেও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের এদেশে রেখে গিয়েছিলেন কায়েমী পদমর্যাদা দিয়ে। আমরা অবশ্য সাবলীল ‘স’ বলতে পারি, কিন্তু মাঝেমধ্যে এখনও আলেকরাজার ভাষাভঙ্গিও আমাদের জিভে হানা দেয় বৈকি! নাহলে ‘সপ্তাহ’-কে আলগা ভাষায় ‘হপ্তা’ বলি কি করে?

সতেরো-আঠেরো শতক নাগাদ ইউরোপীয় বণিকদের আর মিশনারি পাদ্রিদের যখন আনাগোনা বেড়ে গেল এদেশে, তখন আবার সেই ‘হিন্দ্’ বা ‘হিন্দয়া’র নাক থেকে ‘হ’-টাকেই টেনে ছিঁড়ে নিয়ে তারা দেশটাকে ডাক দিল ‘ইন্দ্’ বা ‘ইন্দয়া’ বলে। ইংরেজের বর্ণমালায় আবার ধ্বনিচিহ্নের বড্ড আক্কারা ! ওদের ‘দ’-এর জন্যে আলাদা কোনো চিহ্নই নেই, ‘দ’ আর ‘ড’-দুটোর জন্যেই একটামাত্র ‘D’ আছে। তাই ‘ইন্দয়া’ হয়ে পড়ল ‘ইন্ডিয়া’। বোঝো কাণ্ড! এখন ‘ভারত’, ‘হিন্দুস্তান’ ‘ইন্ডিয়া’ — এই ত্রহ্যস্পর্শে আমরা জেরবার, আমাদের জাতীয়তাবাদের দফারফা!

ভারতবাসীর কিংবা বঙ্গজনের সত্যিকার দেশপ্রেম তথা জাতীয়তার বোধটাই আছে কিনা, সেটাও তো একটা মহা তর্কের বিষয়। তার ব্যাখ্যা একদিক দিয়ে করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি দেখিয়েছিলেন, চলিত বাংলায় ‘জাতি’ বলতে যেমন ‘বর্ণ’ (Caste) বোঝায়, তেমনি ‘জাতি’ বলতে ‘রেস’-ও (Race) বোঝায়। কিন্তু ‘নেশন’ বা ‘ন্যাশনাল’ শব্দটির কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই। নেই, কারণ ভারত বা বাংলায় শুধু নয়, গোটা পৃথিবীতেই প্রাচীনকালে কোনো ‘নেশন’ ছিল না। পরে রোম সাম্রাজ্য কিছুটা ‘নেশন’-এর আদল নিতে নিতেই বর্বরদের আক্রমণের মুখে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এই বহুধাবিভক্ত অংশগুলোই যখন বহুবছরের সাধনায় অনন্য এক ভাবাদর্শে ঐক্যবদ্ধ ভাবসম্মিলনে বাঁধা পড়েছে, সেই ভাবৈক্যের দ্বারা গ্রন্থিবদ্ধ নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকেই বলে ‘নেশন’ (‘Nation’)। বাংলা প্রতিশব্দের অভাবে ইউরোপীয় ‘নেশন’ শব্দটিই রবীন্দ্রনাথ অকুন্ঠভাবে ব্যবহার করতে আগ্রহী ছিলেন। ফরাসি দার্শনিক ও রাষ্ট্রনীতিবিদ রেনাঁর ব্যাখ্যা অনুসরণে রবীন্দ্রনাথ ‘নেশন’ সম্পর্কে যেটা বলেছেন, তা এইরকম — “জাতি, ভাষা, বৈষয়িক স্বার্থ, ধর্মের ঐক্য ও ভৌগোলিক সংস্থান, নেশন-নামক মানস পদার্থ-সৃজনের মূল উপাদান নহে।… নেশন একটি সজীব সত্তা, একটি মানস পদার্থ। দুইটি জিনিস এই পদার্থের অন্তঃপ্রকৃতি গঠিত করিয়াছে।… একটি হইতেছে সর্বসাধারণের প্রাচীন স্মৃতিসম্পদ, আর-একটি পরস্পর সম্মতি, একত্রে বাস করিবার ইচ্ছা—যে অখণ্ড উত্তরাধিকার হস্তগত হইয়াছে তাহাকে উপযুক্ত ভাবে রক্ষার ইচ্ছা।” [১] 

‘নেশন’ সম্পর্কিত এই যৌথ আবেগকেই আমরা বলে থাকি ‘জাতীয়তাবাদ’ বা ‘Nationalism’। রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করেই আজ আমরা বিশ্বাস করি, ন্যাশনালিজমের ধারণাটা পুরোপুরি বিদেশ থেকে আমদানি। পাশ্চাত্যের অনুকরণে এদেশে ন্যাশনালিজম্ বা জাতীয়তাবোধের প্রকাশ ঘটল উনিশ শতকে মিশনারি পাদ্রি আর ইউরোপীয় বেনিয়াদের হাত ধরে। নেহাৎ খ্রিস্টধর্মের প্রচার আর ব্যাবসাপত্তরের কেজো দরকারেই দুটো ভিন্ দেশের মধ্যে ভাষা-বিনিময় ঘটে গেল একটু একটু করে। আর সেটার মাধ্যমেই পাশ্চাত্য সাহিত্য ইতিহাস দর্শনের সূত্র ধরে ন্যাশনালিজমের ধারণাটা এদেশের ইংরেজিশিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মানুষের বোধের ভিতরে চারিয়ে গেল। মার্কস কথিত ‘ইতিহাসের যন্ত্র’-র এক অনিচ্ছাকৃত ভেল্কিবাজি আর কি! বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে রঙ্গলাল, মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র হয়ে একটু একটু করে সেই স্বদেশবোধ বা জাতীয়তাবাদ একেবারে স্বদেশিযুগে এসে পৌঁছেছে। 

জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে এই যে ধারণাটা, মানে হিন্দু-বৌদ্ধ যুগে বা তার পরে মুসলমান শাসনের সময়ে কী–ভারত কী–বাংলায় কোনও নির্দিষ্ট জাতিসত্তা কিংবা অখণ্ড দেশসত্তার বোধ জমাট হয়ে ওঠেনি, এটাও একটা একচোখো ধারণা বলেই আমাদের বিশ্বাস। ‘একচোখো’ এইজন্য বলছি, জাতীয়তাবাদ বা ‘ন্যাশনালিজম’ শব্দটার মতো এ সংক্রান্ত ধারণাটাও আমরা ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ বা ভাবুকদের কাছ থেকে ধার নিয়েছি। ধারণাটা বিদেশের বা স্বদেশের এলিটক্লাসের সুপার-স্ট্রাকচারাল বিদ্যেবুদ্ধির বুকর‍্যাক থেকে নামানো। 

কিন্তু দেশীয় সংস্কৃতির নিবিড়তর বিচারে এই দেশভাবনাটার ভিন্নতর একটা ছবিও তো পাওয়া সম্ভব। যে সময়ে জল-জমিনির্ভর লোকজীবনে পৃথিবী সম্পর্কিত জ্ঞানটাই চারপাশের বিশপঞ্চাশ ক্রোশের মধ্যে আটকে ছিল, তখন তার দেশভাবনাটাও নিজের গাঁ-গঞ্জ কিংবা সামন্তরাজের অধিকারসীমা অথবা অস্পষ্ট ও পরিবর্তনশীল একটা প্রদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকাটাই স্বাভাবিক। উনিশ শতকে তো বটেই, বিশ শতকেও গ্রামসমাজের ঠাকুমা-দিদিমাদের মুখে তো আমরা শুনেইছি যে, তাঁদের কাছে প্রদেশান্তরে যাওয়াটাই ছিল বিদেশযাত্রা। জাতীয়তাবাদের এই আঞ্চলিক বা লৌকিক রূপটার কথা কেন-যে এ পর্যন্ত কোনও নিম্নবর্গীয় ইতিহাসকারও ভেবে দেখলেন না, সেটাই রীতিমতো আশ্চর্যের! অথচ ভারতের ইতিহাসে এমন প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক দেশচেতনার উদাহরণ ভুরি ভুরি ছিল! অর্থাৎ আমরা বলতে চাইছি, জাতীয়তাবাদ বিষয়টাকে কেবল উচ্চমার্গীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে অঞ্চলিক নিম্নবর্গীয় চোখ দিতেও তো দেখা সম্ভব!

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে, বিশেষ করে সম্রাট চন্ডাশোক ধর্মাশোকে পরিণত হলে (২৬০-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) প্রায় সমগ্র ভারত যে বৌদ্ধ-কল্যাণরাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছিল, সেখানে অসূয়ামুক্ত ভেদাভেদহীন (“সব মুনিসে পজা মমা” অর্থাৎ “সব মানুষই আমার প্রজা বা সন্তান”) সমাজমানসে একধরনের দেশ ও মানবকল্যাণনির্ভর জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটা অস্বাভাবিক ছিল না।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা গুপ্তরাজ বিক্রমাদিত্যের রাজত্বকাল সম্পর্কেও এমন অনুমান হয়তো অসঙ্গত হবে না। ‘হিন্দুস্তান’ নামক একটি রাষ্ট্রের ধারণা যে অন্তত ১০২০-২৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ খানিকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণকালে মধ্যএশিয়ার পণ্ডিত অলবিরুনির ‘তহকিক্-ই-হিন্দ্’ বা ‘কিতাবুল হিন্দ্’ গ্রন্থটি।

গোটা ভারতের প্রেক্ষিতে না হলেও বাংলা বা ‘বঙ্গ’ নামটাও ইতিহাসে নানা পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করছে। ঐতরেয় আরণ্যকে বাংলার অধিবাসীদের ‘বায়াংসি’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ‘বায়াংসি’ শব্দের অর্থ পক্ষীজাতীয় মানুষ বা যাদের টোটেম ছিল পাখি। সেইসঙ্গে জানানো হয়েছে, এই পাখি টোটেমধারী মানুষগুলোর দেশ ছিল বঙ্গ ও বগধ — “…বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চের…” [২] 

আবার বৌধায়ন ধর্মসূত্রে জানতে পারছি ‘পুণ্ড্র’ নামক দেশ ও কৌমগোষ্ঠীর কথা। অর্থাৎ সেকালে ‘বঙ্গ’ আর ‘পুণ্ড্র’-দেশের কথা আর্যরা জানত। বঙ্গদেশকে আর্যরা ‘ব্রাত্যভূমি’ নামে অভিহিত করেছিল। জৈনদের আচারাঙ্গসূত্রে ‘লাঢ়’ বা ‘রাঢ়’-এর নাম পাচ্ছি জলাজঙ্গলে ভরা রাঢ়ভূমির বর্বর মানুষের নাকি জৈনধর্মপ্রচারক মহাবীরের দিকে কুকুর লেলিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দ নাগাদ আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকালে ‘গঙ্গারিডি’ বা গঙ্গারাঢ় নামে স্বাধীন শৌর্যশালী নগরের কথা আমরা জেনেছি। আচারাঙ্গসূত্রের গল্পটার সত্যিমিথ্যে জানা না থাকলেও একটা কারণে ঘটনাটাকে প্রাচীনকালে বহুরটিত আখ্যান বলেই মনে হয়।

কি সেই কারণ? আমরা জানি, পাহাড়-জঙ্গল-নদী-জলার দেশ বৃহত্তর বাংলার আদি অধিবাসীরা প্রধানত অস্ট্রিক গোত্রের মানুষ ছিল। এদের ভাষা ছিল খেরওয়ালি। মুণ্ডারি ভাষায় ‘খের’ বা ‘চের’ শব্দের অর্থ পাখি। ‘খেরওয়াল’ বা ‘খেরওয়ালি’ শব্দটা তাই আর্যভাষীদের বঙ্গভূমিকে ‘বায়াংসি’ সম্বোধনের বিষয়টাকে স্পষ্ট সমর্থন করে। সাঁওতালি, মুণ্ডারি, হো ইত্যাদি ভাষা আসলে খেরওয়ালিরই রূপবৈচিত্র‍্য। শ্রদ্ধেয় ইতিহাসবিদ ড. অতুল সুর ‘বাঙলা’ নামের উদ্ভব সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, 

“ ‘বঙ্গ’ কোন্ ভাষার শব্দ তা আমরা জানি না।… অনেকে আবার ‘বঙ্গ’ শব্দটি মুণ্ডারী ভাষার শব্দ বলে মনে করেন।” [৩]

ড. অতুল সুর মশাইয়ের অনুমান বোধহয় যথার্থই ছিল। সাঁওতালি অভিধানে দেখছি ‘বাংলা’ বা ‘বাঙলা’-র কাছাকাছি শব্দগুলির মধ্যে আর্যভাষীদের ধারণা কিংবা জৈনদের আচারাঙ্গ সূত্রের রটনার একটা আভাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা এখানে এরকম কয়েকটি সাঁওতালি শব্দ অর্থসহ তালিকাবদ্ধ করছি। পাঠক অনায়াসেই আমাদের বক্তব্যের মর্মার্থ অনুমান করতে পারবেন —  

সাঁওতালি শব্দ             বাংলা অর্থ

‘বাং’                                 না                                   

‘বাংলে’                       না যাওয়া

‘বাংগলা’              খড় বা পাতার ছাউনিবিশিষ্ট কুঁড়েঘর (bungalow) 

‘বাংগরায়’                          কালো      [৪]

বাংলার অস্ট্রিক গোত্রের মানুষগুলোর গায়ের রঙ কালো এবং সেই ব্রাত্যভূমিতে যাওয়া নিষেধ (‘না’ / ‘না যাওয়া’), তারা বাস করে পর্ণকুটিরে (ইংরেজিতে ‘বাংলো’ শব্দটাই সম্ভবত বাংলার এই আদি অধিবাসীদের ভাষাভাণ্ডার থেকে ঋণ নেওয়া, বিখ্যাত ‘হবসন জবসন’ অভিধানে তার সমর্থন মিলবে), মহাবীরকে কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাঁকে ঢুকতে বাধা দেওয়ার একটা লোকস্মৃতিও বোধহয় লুকিয়ে আছে ‘বাংলা’ শব্দের মধ্যে।

হিন্দুবৌদ্ধকাল থেকে বাংলার নানা জনপদবিভাগের কথা — যেমন রাঢ় (মধ্য-পশ্চিমবঙ্গ), বঙ্গ (পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গ), অঙ্গ (উত্তর-পশ্চিম বাংলা), কলিঙ্গ (ওড়িশা ও সন্নিহিত অঞ্চল), পুণ্ড্র (উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পুর্ববঙ্গ), প্রাগজ্যোতিষপুর (আসামের কামরূপ অঞ্চল) ইত্যাদি আমরা জেনেছি। অর্থাৎ বঙ্গদেশ তখনও বিশিষ্ট অখণ্ড জাতিপরিচয়ে সংহত হতে পারেনি। বাংলার ক্ষেত্রে একটি সংহত আত্মচেতনা প্রথম দেখা গিয়েছিল সম্ভবত শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের (পূর্ব নাম আমীর হাজী ইলিয়াস) আমলে (১৩৪২-১৪১৫ খ্রিস্টাব্দ)। বৈমাত্রেয় ভাই সুলতান আলাউদ্দিন আলী শাহকে হত্যা করে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ লখনৌতির সিংহাসনে বসেন। লখনৌতি ছাড়াও তিনি সাতগাঁ, কাঠমাণ্ডুসহ নেপালের কিছু অংশ, ত্রিহুত, চম্পারণ, গোরক্ষপুর, কাশী, উড়িষ্যাসহ এক স্বাধীন একতাবদ্ধ বাংলার পত্তন করেছিলেন। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহও তাঁকে প্রতিরোধ করতে না পেরে ‘বাংলার স্বাধীন সুলতান’ হিসেবে মেনে নিতে একরকম বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর সুলতানিতেই হিন্দু-মুসলিম-নির্বিশেষে বাংলার বহু বিশিষ্ট জ্ঞানীগুণী মানুষ প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নিয়োজিত হন। সুলতানি পৃষ্ঠপোষণায় বাংলাভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় গতি আসে এবং বাংলার এক পৃথক জাতিসত্তা গড়ে উঠতে থাকে। বাঙালি জাতিসত্তা আরও স্পষ্টতা পায় তাঁর উত্তরসূরী রুকউদ্দিন বরবক শাহের সময় (১৪৫৯-১৪৭৫)। ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পাঠান সুলতানরা এই প্রদেশটিকে ‘বঙ্গালহ’ নামে চিহ্নিত করতে শুরু করেন। ইলিয়াসশাহী আমলেই লখনৌতি ‘বাঙ্গালা’ নামে অভিহিত হতে থাকে। 

মুঘল-ভারত সাম্রাজ্য অন্তত আকবর শাহের সময়ে (১৫৫৬-১৬০৫) সমগ্র ভারতেই প্রায় অনুভূমিক বিস্তৃতি পায়। সেইসঙ্গে বাদশাহের ধর্মীয় ঔদার্য তাঁর রাজত্বকালে সমগ্র ভারতে একটা উল্লম্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐক্য-সম্ভাবনাকে মেলে ধরায় ভারত অনেকটা জাতীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে উঠছিল বলে অনুমান করেছেন ঐতিহাসিকরা। প্রতিষ্ঠিত দেশি-বিদেশি ইতিহাসকারের উদ্ধৃতি না দিয়ে আমরা বরং ভারতীয় চিন্তাবিদ এস. ওয়াজেদ আলীর মন্তব্যটি উদ্ধার করি — “রাষ্ট্র কোনো শ্রেণীর বা জাতির বা ধর্মের সম্পত্তি নয় সে হচ্ছে সকলের যৌথ সম্পত্তি; আর রাষ্ট্রনায়ক হচ্ছেন তাদের বিরাট এই এজমালী সম্পত্তির Trustee  —অছি। যে রাষ্ট্রে এই আদর্শ স্থানলাভ করেছে, তাকেই প্রকৃতপক্ষে জাতীয় রাষ্ট্র বা National State বলা চলে। আকবরই ভারতবর্ষে National State বা জাতীয় রাষ্ট্রের প্রবর্তন করেন। রাষ্ট্রকে গোষ্ঠী এবং ধর্মের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে… সে যুগের বিশ্বে বিপ্লবাত্মক এক পরিবর্তন আনয়ন করেছিলেন।” [৫] 

আরও মনে রাখতে হবে, আকবরের আমলেই বাংলা একটা বিশেষ সুবার মর্যাদা পায়। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবরের নির্দেশে তোডরমল রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য যে ‘আসল-ই-জমা-তুমার’ নামক এক তালিকা তৈরি করেন, সেখানেই দেখা যাচ্ছে, বাংলাকে উনিশটি সরকারে ভাগ করা হয়েছিল। মুঘল দরবারে সমগ্র বাংলা থেকে ১,০৬,৯৩,০৬৭ আকবরশাহী টাকা রাজস্ব হিসেবে পাঠানো হত।

যাই হোক, আমরা যে একটু আগে জাতি- জাতীয়তা বা অখণ্ড দেশসত্তা সম্পর্কে একটা লোক-দৃষ্টিকোণ অথবা নিম্নবর্গীয় ধারণার প্রস্তাব রেখেছিলাম, তার একটা সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে জোসেফ ভিসারিওনোভিচ স্টালিনের জাতি বা নেশন সম্পর্কিত বক্তব্যে। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, অধিকৃত ভূখণ্ড বা অঞ্চল, অর্থনৈতিক জীবন, ভাষাব্যবহার, এমনকি মনোগঠনের দিক থেকেও একটা দৃঢ়বদ্ধ ঐক্যবোধের মধ্যেই জাতিসত্তার উদ্ভব হয়। এর মধ্যে কোনও একটারও খামতি জাতিসত্তা বা নেশনের অস্তিত্বের পক্ষে সংশয় তৈরি করতে পারে — “A nation is a historically constituted, stable community of people, formed on the basis of a common language, territory, economic life, and psychological make-up manifested in common culture… it is sufficient for a single one of these characteristics to be lacking and the nation ceases to be a nation.” [৬] 

সে দিক থেকে দেখলে, বহুভাষী, বহুধর্মী, নৃতাত্ত্বিক বিচারেও বিভিন্ন, মনোগঠনেও পরস্পরবিরোধী ভারতবাসীর ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদের প্রথাগত ধারণাটা যতটা আরোপিত, যতটা স্বপ্নকল্পনা, বাস্তবে ততটা সত্যি নয়। এই সংহতি অথবা ঐক্যচেতনা অনেকখানি লক্ষ্য করা যাবে আঞ্চলিক স্তরে। ধর্মীয় বিশ্বাস বা রীতি-আচারগত পার্থক্য সত্ত্বেও স্বনির্ভর গ্রামীণ সমাজে এই পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার সম্পর্কটা যে সংহতি তৈরি করে, নিতান্ত ছোটো আঞ্চলিক গণ্ডিতে আবদ্ধ বলে তাকে উপেক্ষা করাই হয়তো আমাদের ইতিহাসচেতনার বড়ো ভুল।  

সেই লোকস্তরকে সরিয়ে রেখে বৃহত্তর ভারত বা অখণ্ড বাংলাকে জাতীয় চেতনার নিরিখ ধরলে সেটা কী পরিমাণ অলীক হয়ে ওঠে, তার ভুরি ভুরি অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’ বলে আমাদের মধ্যে সেই নেশনের ঐক্যচেতনাটা যতই চাগিয়ে তোলার চেষ্টা হোক না কেন; ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে কুঁকড়ে যাওয়া, দুর্ভিক্ষে-মন্বন্তরে-চিরস্থায়ী বা অন্যতর ইজারা ব্যবস্থার চাপে মৃতপ্রায় একটা দেশকে ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’ লেবেল লাগিয়ে ‘সকল দেশের সেরা’ বলে যতই বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে দেশবাসীর আবেগকে চেতিয়ে তোলার জন্যে কবিরা হদ্দ চেষ্টা চালিয়ে যান, আসলে আমাদের জাতীয়তাবোধের স্বপ্নের মধ্যে কালাচের বিষ ঢেলে দিয়েছে একদিকে ধর্ম-বর্ণ-জাতপাত-ভাষা-রুটিরুজি-খাদ্যাভ্যাসের জগাখিচুড়ি, অন্যদিকে বেনিয়া-ইংরেজ ও তার এদেশীয়-সহযোগীদের শাসন-শোষণ এবং তারই উল্টোদিকে কৃষক-শ্রমিক-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত অসংখ্য প্রজাসাধারণের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত। সেইসঙ্গে কী–ধর্মাচরণে, কী–সামাজিক বা আর্থিক কল্যাণচিন্তায়, কী–রাজনৈতিক মতাদর্শে আত্মস্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থ কিংবা দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থটাকে বোধহয় চিরকালই আমরা দেশের থেকে, জাতির থেকে, প্রদেশের থেকে, মানুষের যথার্থ কল্যাণের থেকে অনেক বেশি ভালোবেসেছি। 

দুই 

এতক্ষণ এ-সব তো গেল অহেতুক ধানাইপানাই, যাকে ভদ্দরলোকের ভাষায় বলে ‘গৌরচন্দ্রিকা’। নেশন কি বা কেন, অথবা আমাদের দেশটা আদৌ একটা নেশন কিনা, সেটা আমার আলোচনার এক্তিয়ারের মধ্যেই পড়ে না। সম্পাদকমশাই আমাকে আদেশ করেছেন ‘জাতীয়তাবাদের ভাষা’ নিয়ে দু’চার কথা বলতে। অধিকারের বাইরে গিয়ে আমি আপনাদের ধানাইপানাইয়ের রাস্তায় একচক্কর হাঁটিয়ে আবার সেই ‘আমড়াতলার মোড়ে’ যে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছি, সেজন্যে পাঠক আমার প্রশংসা করবেন আশা করতে পারি। কারণ, চারদিকে দেশের হালের মাঝিদের মধ্যে তো ওই ‘আমড়াতলার মোড়ে’ পৌঁছে দেওয়াটাই দস্তুর!

তবু এটুকু না বললে আমাদের জাতীয়তাবাদের চেহারা-চরিত্রটার ঠিকঠাক মাপজোখ করা যাবে না বলেই এত বিস্তর ধানাইপানাই।

এবার আসল কথায় আসা যাক। খ্রিস্টপূর্ব সময়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের শেকল ছিঁড়তে চেয়েছিল যে দুটি ভারতীয় দর্শন, সেই জৈন ও বৌদ্ধদের জীবনচেতনা সম্ভবত প্রথম দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে জাতিধর্ম-নিরপেক্ষভাবে একধরনের সাম্যনীতির ভিতের ওপর বাঁধতে চেয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম যেখানে বেদনির্ভর বর্ণভেদের ভিত্তিতে আত্মগোষ্ঠীর স্বার্থে ক্রমাগত গোটা সমাজকে স্তরে-উপস্তরে ফালাফালা করতে চাইছিল, তারই বিরুদ্ধে মাথা তুলেছিল জৈন ও বৌদ্ধেরা। পার্শ্বনাথশিষ্য শেষ তীর্থংকর বর্দ্ধমান মহাবীরের আবির্ভাব খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের সূচনাকালে মগধ তথা উত্তর-বিহারে, আর বুদ্ধদেব তার এক দশক পরে (সম্ভবত ৫৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নেপালের কপিলাবস্তুতে। আপাতভাবে বৈদিক ঈশ্বরকল্পনা ও যাগযজ্ঞনির্ভর ধর্মাচারের বিরুদ্ধে জৈনধর্ম আত্মপ্রকাশ করেছিল। তার সঙ্গে পশুবধ এবং যজ্ঞাগ্নিতে পশুমাংস ও বসা (চর্বি) আহূতি দানের মতো হিংসাপ্রবণ ধর্মভাবনাকেও সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিল জৈনরা। জৈনধর্মের বেদবিরোধিতার মূলসূত্র হিসেবে এই লক্ষণগুলিকেই এযাবৎ বহুলপ্রচারিত। আমরা তারই সঙ্গে জৈনধর্মের বর্ণাশ্রম-বিরোধিতা, সন্ন্যাসকে অস্বীকার করে গার্হস্থ্যধর্মনির্ভরতা, দেশভাষার জীবনধর্মের প্রচার এবং ক্ষমতা-ঔদ্ধত্য ও পীড়নসর্বস্ব রাজশাসনকে অস্বীকারের বিষয়গুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। শেষোক্ত বিষয়টির মধ্যেই একটি সামাজিক-রাজনৈতিক লোকবিপ্লবের বীজ লুকিয়ে ছিল বলে আমাদের বিশ্বাস। জৈন আগমগ্রন্থগুলির মধ্যে উত্তরজঝুয়ণসুত্ত-র নবম অধ্যয়নের নমী রাজার প্রব্রজ্যার আখ্যান থেকে নমী-ইন্দ্র কথোপকথনের আংশিক উদ্ধৃত করতে চাই —

ইন্দ্র : “আমোসো লোমহারে যে গণ্ঠীতেএ য় তক্করে।

        নগরসস খেমং কাউণং তউ গচ্ছসি খত্তিয়া।।”

নমী : “অসইং তু মনুসসেহিং মিচ্ছা দণ্ডো পজুংঈ।

         অকারিণোত্থ বজঝান্তি মুচ্চঈ কারউ জনো।।”

অর্থাৎ — ইন্দ্র নমীকে বললেন, যারা ধরে কেড়ে নেয়,যারা মেরে কেড়ে নেয়, যারা গাঁট কাটে, চুরি করে, তাদের প্রতিহত করে নগরের কল্যাণসাধন করে তবে যেও। 

তার উত্তরে নমী জানালেন, মানুষকে প্রায়ই অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়। এখানে নিরপরাধেরা শাস্তি পায়, আর অপরাধী লোক মুক্তি পেয়ে ঘুরে বেড়ায়। [৭] 

প্রায় সমসময়েই বুদ্ধবেবও মনুষ্যজীবনের দুঃখ থেকে মুক্তির উপায় সন্ধান করতে গিয়ে পৌঁছেছিলেন মানুষের সার্বিক সততা ও আড়ম্বরহীন অহিংস কল্যাণমুখী জীবনাচরণের ওপর। অষ্টাঙ্গিক মার্গ ও পঞ্চশীল সেই সৎ জীবনাচরণেরই নির্দেশিকা। কোনও জীবনবিবিক্ত অপ্রাকৃতলোকের বা যাগযজ্ঞবহুল ধর্মাচার নয়, এই নির্মোহ সৎ নির্লোভ অসূয়াহীন জীবনবোধের মধ্য দিয়েই দুঃখরহিত প্রশান্তি তথা নির্বাণ লাভ সম্ভব বলে বুদ্ধদেব মনে করেছিলেন। বেদবিহিত ব্রাহ্মণ্যপ্রাধান্যের এবং ভোগপ্রবণ ক্ষত্রিয় রাজাদের প্রতিপত্তিকে অস্বীকার করে বুদ্ধও সর্বজাতি সর্ববর্ণকে সমদৃষ্টিতে দেখেছেন। উচ্চবর্ণের প্রতিও তিনি বিদ্বেষ পোষণ করেননি, আবার ক্ষত্রিয় রাজারাও তাঁর করুণা লাভ করেছেন, সম্পন্ন কৃষক থেকে বণিক ও শ্রেষ্ঠীরাও তাঁকে সহায়তা দিয়েছেন, আবার ক্ষৌরকারপুত্র উপালিকেও তিনি সঙ্গী করেছিলেন।

চৈতন্যদেবের বহু পূর্বেই বুদ্ধদেব জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণত্ব স্বীকার করেননি — “ন জচ্চা হোতি ব্রাহ্মণো”— জন্মের দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ হয় না; “কম্মুনা বসলো হোতি, কম্মুনা হোতি ব্রাহ্মণো”— কাজের দ্বারাই কেউ পাপী, কেউ বা ব্রাহ্মণ হয়। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য যাগযজ্ঞ, সংসারবিযুক্ত সন্ন্যাস কিংবা তপস্যার দ্বারা পরমার্থ সন্ধানে বুদ্ধের আপত্তির মধ্যেই কেবল তাঁর বেদবিরোধিতা নিহিত নেই, তাঁর বেদ বিরোধিতা ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মধ্যেই নিহিত। বণিকদের সমুদ্রযাত্রায় অনুমোদন, নারীদের — বিশেষত আম্রপালীর মতো বারবণিতাকেও নারীসংঘে গ্রহণ, দেশভাষায় উপদেশ দান, গৃহীদের জন্য নিষেধবিরহিত ধর্মাচার, বিশ্বব্যাপী করুণার বিস্তারেই বুদ্ধদেবের বৈপ্লবিক আদর্শ শুধু ভারতীয় নয়, ভারতের বাইরেও বহুদূরব্যাপী বিস্তার লাভ করতে পেরেছিল।

‘সচিপটঠানসুত্ত’-তে ‘মহাবিজিত’ বলে একটি শব্দ আছে। তার অর্থ, ‘যার রাজ্য বিস্তৃত’। এখন প্রশ্ন ওথে, কার রাজ্য সত্যিই বিস্তৃত? উত্তর, যে মহাযজ্ঞের অধিকারী। আবার প্রশ্ন, মহাযজ্ঞ কাকে বলে? তার উত্তর, যে যজ্ঞের প্রধানতম বিধি, রাজ্যের অধীন কোনো ব্যক্তিকে কর্মহীন রাখা যাবে না। 

পাঠকের মনে হতে পারে, ‘জাতীয়তাবাদের ভাষা’ প্রসঙ্গে এইসব ধর্মতত্ত্বের অবান্তর আলোচনা কেন? আজকের জাতীয় বা প্রাদেশিক রাজনীতির বিকারগ্রস্ত চেহারাটির প্রেক্ষিতে বৌদ্ধধর্মের এই নিদানটির মর্মার্থ উপলব্ধি করলে যথার্থ জাতীয়তাবাদী রাজ্য বা রাষ্ট্রের চেহারাটা কেমন হওয়া উচিত, তার একটা আভাস মিলতে পারে।

‘চক্কবত্তিসীহ্নাদসুত্ত’-তে আছে দৃঢ়নেমি নামক এক রাজচক্রবর্তী তাঁর সন্তানকে রাজ্যভার দিয়ে উপবনে যোগসাধনায় নিয়োজিত হন। তিনি সন্তানকে প্রজাদের প্রতি সমদৃষ্টি ও করুণার সঙ্গে রক্ষণের পরামর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন। দৃঢ়নেমি রাজার প্রাসাদে রাজ্যের সমৃদ্ধির চিহ্নস্বরূপ একটি চক্র ছিল। পিতৃআদেশ অনুযায়ী কল্যাণকর রাজকার্য পরিচালিত হওয়ায় সেই চক্রও সাতপুরুষ ব্যাপী সুস্থিত ছিল। কিন্তু সপ্তম পুরুষে নবীন রাজা কল্যাণব্রত পোষণ করলেও সমস্ত প্রজার কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থা করলেন না। ফলে একদিন সেই চক্র অন্তর্হিত হল। কর্মহীনতার জন্য দরিদ্র মানুষ চুরিচামারি শুরু করল। এক চোর ধরা পড়লে সে রাজাকে তার অভাব ও ক্ষুধার কথা জানাতে করুণাবশত রাজা তাকে বহু দানে তুষ্ট করলেন। ফলে চুরি করলেই রাজার করুণা পাওয়া যাবে আশা করে বহু লোক চৌর্যবৃত্তিকেই আশ্রয় করল। তখন রাজা প্রচণ্ড শাস্তির ব্যবস্থা করতে চোরেরা সশস্ত্র ডাকাতি শুরু করল। দারিদ্র‍্য বাড়ল, চুরি বা লুন্ঠন বন্ধ হল না, অভাবী মানুষের হাতে অবৈধ অস্ত্র পৌঁছে যেতে লাগল, রাজ্যে হত্যার সংখ্যা বেড়ে চলল, মিথ্যাচার-প্রতারণা-ব্যভিচার বাড়ল, কুকথা ও মারামারি কাটাকাটিরও অন্ত রইল না। সারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হল। এর প্রতিবিধানের জন্য রাজা পুরোহিতের কাছে বহু ব্যয়সাপেক্ষ মহাবিজিত যজ্ঞের প্রস্তাব করলেন। পুরোহিত জানালেন, ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞের প্রয়োজন নেই। রাজ্যের লোকগুলোর জন্যে সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মের সংস্থান করলেই মহাবিজিত যজ্ঞ সামাধা হবে। [৮] 

অর্থাৎ আজকের দুর্নীতিগ্রস্ত, প্রতারণাপ্রবণ, পারস্পরিক হিংসায় অস্থির রাষ্ট্রকাঠামোর অসুখ যে কর্মসংস্থানের ব্যবহার পরিবর্তে ব্য্যবহুল আনন্দযজ্ঞের বহুল্যের ভিতরে প্রধানত নিহিত, আমাদের জাতীয় চেতনার মধ্যে এই যে কুৎসিত ভাষাপ্রয়োগের ও ছলনার এত বাড়াবাড়ি, তার একটা পথনির্দেশ বুদ্ধের বাণীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বলা বাহুল্য।

এই বৌদ্ধধর্মকে আশ্রয় করেই সম্রাট অশোক রক্তপাতহীন প্রীতিময় সাম্রাজ্যবিস্তারে অগ্রণী হতে পেরেছিলেন, যে রাজ্যসীমা ভারতবর্ষের সীমা অতিক্রম করে যেতে পেরেছিল। অশোকই বোধহয় প্রথম একেবারে প্রায়োগিকভাবে জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতাকে আন্তর্জাতিক তথা বিশ্বজনীন স্তরে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

পাঠান আমলে রুকউদ্দিন বরবক শাহ এবং মুঘল রাজত্বকালে আকবরশাহের জাতীয় রাষ্ট্রনীতির উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। কিন্তু এই মুসলমান রাজত্বকালে বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রীচৈতন্যদেবের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা না বললে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

পঞ্চদশ শতকে বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কেমন ছিল, তা নিয়ে নতুন করে বলবার আর প্রয়োজন নেই। মুসলমান শাসনাধীনে প্রশাসনিক উচ্চবর্গীয়দের প্রতিপত্তি ও ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলভোগ করতে হত সাধারণ মানুষকেই। সেইসঙ্গে সমগ্র হিন্দুসমাজও তান্ত্রিক ব্যভিচার, পাণ্ডিত্যাভিমানী পাষণ্ডাচার, লৌকিক স্তরে প্রশ্নহীন হৃদয়ানুভববর্জিত ধর্মাচারে চৈতন্যহীন এক জাতিতে পরিণত হয়েছিল। চৈতন্যদেব এই অচেতন আত্মবিস্মৃত দেশে প্রেমভক্তি-আন্দোলনের মাধ্যমে মানসিক নবজাগৃতির সূচনা ঘটালেন। শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মবাদের মধ্যে জগতের বাহ্যিক প্রকাশকে, জৈবিক জীবনকে মায়া বলে অস্বীকার করার তত্ত্বকে খণ্ডন করে ভক্তিবাদের প্রচার করেছিলেন রামানুজ, নিম্বার্ক, মাধবাচার্য এবং বল্লভাচার্য। সেই ভক্তিবাদকেই প্লাবনের মতো সমাজশরীরে বইতে দিলেন চৈতন্যদেব। তাঁর প্রবর্তিত ভক্তিবাদে মুসলমান বিরোধিতার মতো সংকীর্ণতা ছিল না, ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকেন্দ্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ভয়বিহীন স্বার্থবিহীন প্রতিবাদী স্বর, যাকে সে-যুগের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক প্রতিবাদ বললে অত্যুক্তি হয় না। চৈতন্যের জাতিধর্মনির্বিশেষে আলিঙ্গন, ব্রাহ্মণ্য পূজাচারের অস্বীকৃতি, পাষণ্ডীদের প্রতিও করুণা ও হরিকীর্তনকে প্রায় গণসংগীত হিসেবে ব্যবহার, নিত্যানন্দের সহায়তায় নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যেও প্রেমভক্তিবাদের প্রচার সে যুগের বাঙালিকে নতুনভাবে আত্মশক্তিতে উদ্দীপ্ত করে তুলতে পেরেছিল।

তারুণ্যের প্রথম পর্বে তর্কপ্রবণ নৈয়ায়িক পরিণত বয়সে কূট শাস্ত্রীয় তর্ককে পরিহার করেছিলেন বলে ভক্তিবাদেরও কোনও দার্শনিক ব্যাখ্যা বা গ্রন্থ রচনা করেননি। কিন্তু অনুগামীদের মুখে তাঁর আটটি উপদেশ ‘শিক্ষাষ্টক’ নামে প্রচারিত হয়। সেখানে কয়েকটি শ্লোকে চৈতন্যের বৈপ্লবিক চিন্তার পরিচয় মেলে। “চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তি পরায়ণঃ। / হরিভক্তিবিহীনশ্চ দ্বিজোহপি শ্বপচাধমঃ।।” তাছাড়া “তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুণা।/ অমানিনা মানদেন কীর্ত্তনীয়ঃ সদা হরিঃ।।” — তে মানহীন মানুষকেও সম্মানদানের পরামর্শের মধ্যে বহুযুগ পরের সাম্যবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটেছিল বলেই মনে হয়।

তিন 

উনিশ শতকের আগে বিজাতীয় শাসকের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর তীব্র মুক্তিকামনার ভিতর থেকেই প্রাদেশিক স্তরে জাতীয় চেতনার প্রকাশ ঘটেছিল। সত্যি কথা বলতে গেলে, ভারতের জাতীয়তাবাদী চৈতন্য যে শব্দগুচ্ছটিকে আশ্রয় করে প্রথম যথার্থ আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেটি নিঃসন্দেহে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের সেই বিখ্যাত সঙ্গীত — “বন্দে মাতরম্।/  সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং / শস্যশ্যামলাং মাতরম্।”

আনন্দমঠের সন্ন্যাসী ভবানন্দের গাওয়া এই আপাত শান্ত-মধুর গানটি স্বদেশসাধকদের প্রাণে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দিতে পেরেছিল, তার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদল শুধু নয়, জাতীয় কংগ্রেসের গান্ধিবাদী অহিংস রাজনীতিও এই গানের সম্মুখ-পঙক্তিটুকুকে তাঁদের রাজনৈতিক অভীপ্সার সারমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ স্বাধীনতাপূর্ব ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রথমতম ধ্বনিচিহ্ন হয়ে উঠেছিল ‘বন্দে মাতরম্’।

‘আনন্দমঠ’ বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হয়েছিল ১২৮৭-র চৈত্র থেকে ১২৮৮-র আশ্বিন (১৮৭৯-১৮৮১) পর্যন্ত। গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৮৮২। গানটি রচিত হয়েছিল সম্ভবত ১৮৭৫ নাগাদ, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর ‘আমার দুর্গোৎসব’ রচনার সমকালেই। [৯] 

কিন্তু সমস্যা হল, ব্রিটিশ উপনিবেশের উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা বঙ্কিমচন্দ্র বিপ্লবাত্মক স্বদেশপ্রেমের কথা রচনা করতে গিয়ে কিছুটা কৌশলী হয়ে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরকালে ‘যবন’-রাজের বিরুদ্ধে হিন্দু সন্ন্যাসীদলের সংগ্রামের আখ্যান সাজিয়েছিলেন। আর সেই আখ্যানসূত্রেই এসেছে যবনরাজের অপশাসনের প্রসঙ্গ। সেই যবনশাসনকে আমূল উচ্ছেদের সংকল্পই সন্ন্যাসীদলের একমাত্র লক্ষ্য। এই স্বদেশসাধনার সূত্রেই উপন্যাসে সংযোজিত হয়েছে বছরকয়েক আগে লেখা হিন্দুদের দেবীস্বরূপিনী দেশমাতৃবন্দনার গান ‘বন্দে মাতরম্’। সন্ন্যাসীদলের অন্যতম ভবানন্দ এই গানে অঙ্কিত মাতৃমূর্তির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জিজ্ঞাসু মহেন্দ্রকে বলেছেন — “আমরা অন্য মা মানি না — জননী জন্মভূমশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী। আমরা বলি জন্মভূমিই জননী…”। প্রসঙ্গত, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর ‘আমার দুর্গোৎসব’ রচনাতেও দেশরূপা এই মাতৃমূর্তির বর্ণনা আছে।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এই মাতৃধ্যানেই দেশপ্রেমের পথে পরবর্তীকালে অগ্রসর হয়েছে। স্বদেশি যুগে রচিত গানগুলো সেই মাতৃরূপা দেশবন্দনারই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। যেমন —

১। “চল্ রে চল্ সবে ভারত-সন্তান                                                                                                  
    মাতৃভূমি করে আহ্বান।”— জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর;
২। “মাগো! যায় যেন জীবন চলে                                                                                                          
    শুধু জগৎ-মাঝে তোমার কাজে                                                                                                             
    বন্দে মাতরম্ বলে।” —কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ;
৩। “যেদিন সুনীল জলধি হইতে                                                                                                                      
    উঠিলে জননী ভারতবর্ষ!                                                                                                                        
    উঠিল বিশ্বে সে কি কলরব —                                                                                                                    
    সে কি মা ভক্তি, সে কি মা হর্ষ!” — দ্বিজেন্দ্রলাল রায়;
৪। “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়                                                                                                                 
    মাথায় তুলে নে রে ভাই,                                                                                                                             
    দীন দুখিনী মা-যে তোদের                                                                                                                                   
    তার বেশি আর সাধ্য নাই।” — রজনীকান্ত সেন ইত্যাদি। 

এমনিতে পাশ্চাত্যের পিতৃভূমিসাধনার সমান্তরালে প্রাচ্যের এই মাতৃভূমিসাধনাকে খাটো করে দেখার কোনও কারণ ঘটেনি। কিন্তু ভারতীয় এই জাতীয়তাবাদী মাতৃভাবনার অন্ত্রে-তন্ত্রে মিশে ছিল হিন্দু-ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের দীর্ঘ ছায়া। সেখানে অন্য ধর্মের বা ব্রাহ্মণ্যবাদের চোখে বর্ণেতর জনগোষ্ঠীর, ভারতের আদি অস্ট্রিক জনসাধারণের তেমন হৃদয়ের যোগ ছিল না।

ফলে এই গান স্বদেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠা ভারতীয়-মুসলমানদের কাছে রুচিকর হবে না, এটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ-প্রকাশক ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিগুচ্ছটি কোনওভাবেই হিন্দু-মুসলমানের যৌথসংগীত হয়ে উঠতে পারেনি। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সূচনালগ্নেই তার অঙ্গে অবচেতনভাবেই লেগে গিয়েছিল হিন্দুত্বের তিলকচিহ্ন। 

তবে এই সংকীর্ণ হিন্দু-জাতীয়তাবাদের সূচনা ঘটে গিয়েছিল অন্তত আরও ৬৭ বছর আগে ১৮১৭-তে হিন্দু স্কুল বা কলেজের প্রতিষ্ঠার সময়ে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণের মধ্যে অবচেতনভাবেই মিশে গিয়েছিল হিন্দু-জাতীয়তাবাদের গন্ধ। আর তারও পঞ্চাশ বছর পরে ১৮৬৭-তে হিন্দুমেলাতেও অবচেতনভাবেই সেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ধারা অব্যাহত থেকেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যেও সেই ধারাই বহমান। এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এবং পরবর্তীকালে স্বদেশমন্ত্র হিসেবে ব্যাপক স্বীকৃতি পেলেও ‘বন্দে মাতরম্’ গান সম্পর্কে এই একদেশদর্শিতার অভিযোগ ও আপত্তি আজ পর্যন্ত নাহলে উঠছে কি করে?   

বঙ্কিমচন্দ্রের এই সন্ন্যাসীদলের অনুশীলন তত্ত্বের এবং তাঁর অনুশীলন ধর্মের প্রভাবেই ১৯০২-তে যে ‘অনুশীলন সমিতি’-র প্রতিষ্ঠা হয়, সেখানেও স্বভাবতই সেই হিন্দুত্বেরই প্রকট ছায়া। অনুশীলন সমিতির সদস্য হবার প্রথম শর্তই ছিল হিন্দুত্ব। এই সমিতির অনুশাসনে বলা ছিল যে, অনুশীলন সমিতিতে এমন কোনও ব্যক্তিকে সদস্য করা হবে না, যিনি অহিন্দু বা কোনওভাবে হিন্দুবিরোধী ধারণা পোষণ করেন। অর্থাৎ কেবল অহিন্দুরাই নয়, হিন্দুধর্মের প্রতি আনুগত্যহীন অথবা সন্দেহবাদী উদারপন্থী হিন্দুকেও এই স্বদেশব্রতীরা স্পষ্টভাবে বাতিল করে দিয়েছিলেন।

সে যুগের গুপ্তসমিতি বা অনুশীলন সমিতির মতো ‘সিক্রেট এজেন্সি’গুলোর কর্মপদ্ধতির বিস্তৃত বিবরণ আছে হেমচন্দ্র কানুনগোর বইতে। সেখানে তিনি লিখেছেন, “হিন্দুধর্মের মধ্য দিয়ে ভারত উদ্ধারের মানে যে হিন্দুধর্মের তরফে উদ্ধার, এ সহজ কথা মুসলমান ভায়াদের বুঝিয়ে দিতে হয় না; পরন্তু এ তাঁদের আঁতে যে কি রকম ঘা দেয়, তা বলা বাহুল্য মাত্র। এতে মুসলমানগণ এ আন্দোলনে যে কেবল যোগ দিতে বিরত থাকতে পারেন তা নয়, তাঁরা ইংরেজের অপেক্ষাও হিন্দুদের প্রবল শত্রু না হয়ে পারেন না। কারণ ইংরেজের বদলে হিন্দুদের অধীন হওয়ার ধারণা করাও তাঁদের পক্ষে একেবারে অসম্ভব বললে অত্যুক্তি হয় না।” [১০] 

১৮৮৫-তে তৈরি হল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। কংগ্রেসের ধ্যানধারণা ও কর্মসূচিও হিন্দু মানসিকতাকেই ক্রমাগত পোষণ করেছে এবং ভারতের অন্তত শিক্ষিত এলিট শ্রেণির মুসলমানদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটিয়েছে। সকলেই জানেন, ১৯০৬-এ যে ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠী ও তাদের মুখপত্র ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সূত্রপাত, সেটিরও চারিত্র‍্যলক্ষণ ছিল অনুশীলন সমিতিরই অনুরূপ। সেখানেও ‘আনন্দমঠ’-এর প্রেরণা, বিবেকানন্দের ‘রাজযোগ’-এর আদর্শ আর ‘গীতা’-র বাণী উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছিল। 

আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জানানো হয়েছিল, ভারত একটি সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু যে রাষ্ট্রের জন্ম হয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ভস্ম গায়ে মেখে, সেখানে সেই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বারে বারে লঙ্ঘিত হতে বাধ্য। বিশেষত ক্ষমতা ও রাজ্যপাট কায়েম রাখতে যখনই তোষণের প্রক্রিয়া চলতে থাকে প্রশাসনিক তরফেই, যেখানে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আজও তার সর্বস্তরের আদালতে হিন্দুদের ধর্মসংহিতাস্বরূপ ‘গীতা’ স্পর্শ করে সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণপর্ব শুরু করে, সেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের চারাগাছ অচিরেই বিষবৃক্ষে পরিণত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। হিন্দু বেনারস ইউনিভার্সিটি, মহমেডান ক্লাব ইত্যাদি নামকরণের মধ্যেও তো কৌশলে পুঁতে দেওয়া হয় বিভেদেরই বীজ! সেই বিষবৃক্ষের ভয়ঙ্কর রূপ আমাদের যেমন দেখতে হয়েছে স্বাধীনতার আগে-পরে বীভৎস লুন্ঠন ও নরমেধে। হিন্দুদের পক্ষ থেকে তখন যেমন জাতিরক্ষার নামে আওয়াজ উঠেছে ‘বন্দে মাতরম্’, তেমনি অন্যপক্ষে ধ্বনি উঠেছে ‘নারায়ে তকদির’, ‘আল্লাহু আকবর’ কিংবা ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। তারপরেও কতবার কত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভারতের মাটিতে হয়েছে, তার পরিসংখ্যান দেওয়ার এখানে প্রয়োজন নেই।

স্বাধীনতার পর থেকে একদিকে ভারত তথা বাংলার দ্বিখণ্ডীকরণ, উদ্বাস্তুস্রোতের কারণে উদ্ভূত সমস্যা, দুর্নীতিপ্রবণ কালোবাজারি ও মজুতদারদের রাষ্ট্রীয় তোষণ, ভয়াবহ আর্থিক সংকট ভারতবর্ষের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ঔজ্জ্বল্যকে বিস্বাদ করে তুলেছিল। ফলে স্বাধীন ভারতবর্ষের জনমানসে জাতীয়তাবাদের যথার্থ উৎসার ঘটতেই পারেনি। কংগ্রেসের ভুয়ো উন্নয়নের বার্তা, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, সরকারিস্তরে দুর্নীতি ইত্যাদি গণমনে ক্রমশ বিরূপতা সৃষ্টি করছিল। এই মুহূর্তে যথার্থ জাতীয় মুক্তির জন্য বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটে গেল তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে। পূর্ব-বাংলা তথা পূর্ব-পাকিস্তানের এই জাতীয়তাবাদের অভ্যুত্থান করল প্রধানত ভাষাপ্রশ্ন। বাংলা ভাষার অধিকারের দাবিতেই একটা দেশ উগ্র সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের বিপুল সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নিজের ক্রমক্ষীয়মান জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের এই অভূতপূর্ব সুযোগটাকে হাতছাড়া করল না। পূর্ব-বাংলার স্বাধীনতার লড়াইতে নৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। পূর্ব-বাঙলার বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধে (১৯৬৯-৭১) এই সহায়তার দৌলতেই ইন্দিরাজি ‘দুর্গা’-স্বরূপিনী এক ভাবমূর্তি নির্মাণ করে ফেললেন এবং বিপুল ভোটে নিজের আসনটি পাকা করে তুললেন, অন্যদিকে পূর্ব-পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল।

কিন্তু দেশের মানুষকে প্রকৃত সুশাসন দিতে না পারলে রাষ্ট্রের স্থিতাবস্থা রক্ষা করা অসম্ভব, সেকথা আমরা বৌদ্ধ গাথাসূত্রেই আগে দেখেছি। বিক্ষুব্ধ জনগণের অদন্তোষ ও আপত্তিকে স্তব্ধ করে দিতে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে ১৯৭৫-এর ২১ মার্চ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন ইন্দিরা গান্ধী। স্বাধীন ভারতের নাগরিকদের যাবতীয় মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে ক্ষমতাকে সুরক্ষিত করতে চাইলেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত একুশ মাস স্থায়ী হল এই দমননীতি। বেতারে রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গান পর্যন্ত সেন্সার করা হচ্ছিল এই জরুরি অবস্থার সময়!

তবে গণতন্ত্রের কন্ঠরোধ করে ‘মহাবিজিত’ হওয়া যায় না, তা আরও একবার প্রমাণিত হল ১৯৭৭-এর নির্বাচনে কংগ্রেসের সমূহ পতনে। ভারতীয় লোকদলের নেতৃত্বে কংগ্রেসবিরোধী দলগুলিকে নিয়ে গঠিত হল জনতা মোর্চা এবং মোর্চাই সরকার গঠন করল।

চার 

তারপর ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। তার সব কথা আমাদের প্রয়োজন নেই। তবে আমাদের জাতীয়তাবাদের ভিতরে ভিতরে সাম্প্রদায়িক বিভেদবাসনার বিষ তিরোহিত হল না। স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৪৬ থেকেই অখিল ভারতীয় রামায়ণ-মহাসভা বাবরি মসজিদকে নিয়ে একটা বিতর্কের সূচনা করেছিল। ১৯৪৯-এর ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদের একটা অংশে রাম-সীতার মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পুলিশের উপস্থিতিতেই। তারপর বিতর্ক এড়াতে বিতর্কিত মন্দিরটি তালা বন্ধ অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল দীর্ঘকাল। সেই ধর্মোন্মাদনা আবার চাগিয়ে উঠল ১৯৮৪-তে রাম জন্মভূমি অ্যাকশন কমিটি গঠন আর ‘তালা খোলো’ আন্দোলন শুরু হবার পর থেকে। ১৯৮৯ থেকে শুরু হয়ে গেল রামমন্দির নির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রতোকী শিলাপুজা। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে ভারতের আকাশ-বাতাস-জল-মাটি কেঁপে উঠল। রামভক্ত করসেবকদের আগ্রাসী ধর্মীয় উন্মাদনা আর পবিত্র রামশিলাসহ মিছিলের দাপটে শুরু হল দাঙ্গা আর গণহত্যা। প্রাণ গেল ১১৭৪ জন মানুষের। পরের বছরেই লালকৃষ্ণ আদবানিজির রথযাত্রায় দলিত হলেন আরও ৬৯৩ জন। আর ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্রের বুকে লেখা হয়ে গেল এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। আবার সারা দেশে ২২৬ টি দাঙ্গা ঘটে গেল আর গণহত্যায় প্রাণ গেল ১৮০১ জনের। [১১] 

অতএব, সাম্প্রদায়িকতার ক্ষত এ দেশে এখনও শুকোবার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কেননা, যতদিন রাজনীতিতে মসনদ দখলই পাখির চোখ হিসেবে কায়েম হয়ে থাকবে, ততদিন সাম্প্রদায়িক উসকানি আর পারিস্পরিক ধর্মীয় বিদ্বেষই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই ব্যবহৃত হতে থাকবে। 

ভারতবর্ষের স্থিতাবস্থাকে বিঘ্নিত করতে দীর্ঘদিন থেকেই চূড়ান্ত ধর্মান্ধ ইসলামি সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলি তাদের নির্মম হিংসামূলক জিহাদি-কর্মসূচি সংঘটিত করে চলেছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য — কেবল ভারতে নয় — সমগ্র বিশ্বটাকেই এক ও অভিন্ন ‘ইসলামিক স্টেট’ হিসেবে গড়ে তোলা। ঠিক তারই বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ক্রমশ হিন্দুত্ববাদের বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে। স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে যেটা ছিল অবচেতন হিন্দুত্ববাদ, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সেটাই হয়ে উঠেছে হিন্দুত্ববাদ প্রচারের সচেতন সাংগঠনিক সক্রিয়তা। বিশ্বহিন্দু পরিষদের মূলমন্ত্রই হয়ে উঠেছে হিন্দুত্ববাদের প্রচার ও হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। তাদের সাংগঠনিক লোগোটিতে জ্বলজ্বল করছে “ধর্ম রক্ষতি রক্ষিতঃ”। অর্থাৎ, দেশ বা জাতি রক্ষার একমাত্র লক্ষ্য ও উপায় ধর্ম। তবে রবীন্দ্রনাথকথিত ‘মানবধর্ম’ নয়, এ ধর্ম একান্ত সংকীর্ণ উগ্রবাদী হিন্দুধর্ম। এই হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনের আগ্রাসী ধ্বনি — ‘জয় শ্রীরাম’! এই কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদেরই বীজস্বরূপ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ আর তারই সতীর্থ সংগঠন ভারতীয় জনতা পার্টি। সমগ্র দেশকে জাতিধর্মনির্বিশেষে যথার্থ ঐক্যের বন্ধনে বাঁধার বা আর্থসামাজিক সমতার ভিত্তিতে কর্মোদ্যোগ গ্রহণের কিংবা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ও শিল্পোদ্যোগের যাবতীয় কর্মসূচি — সবই এদের কাছে হিন্দুত্ব ও হিন্দুধর্মের সনাতনী মধ্যযুগীয় সুরে বাঁধা। এদের ধ্বনি বা শ্লোগান তাই ‘জয় শ্রীরাম’-এর সমান্তরালে ‘জয় বজরঙ্গবালী’। 

একুশ শতকের আগে থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তাদের দলেরই তরুণ কর্মী নরেন্দ্র দামোদর মোদিকে ভারতের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সামনে রেখে প্রচার শুরু করে। তার আগে লালকৃষ্ণ আদবানি বা অটলবিহারী বাজপেয়ীজির মধ্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দলীয় কর্মসূচির ঊর্ধ্বে কিছু উদারনৈতিক বা দলনিরপেক্ষ প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পাচ্ছিল, যা ধর্মান্ধ কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের তেমন পছন্দসই ছিল না। তাই স্বয়ংসেবক সংঘের সক্রিয় প্রচারক মোদিকেই দিল্লির মসনদে বসানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। দেশের প্রথম সারির পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদেরও মোদিজিকেই পছন্দ ছিল। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শিল্পবিকাশের নিরিখে তখন তিনি রীতিমতো খ্যাতি কুড়িয়েছেন। তাঁর সাম্প্রদায়িক মনোভাবের দৃষ্টান্তগুলোকে আড়াল করে দিচ্ছিল গুজরাটের সমৃদ্ধি। মোদির গুজরাটের ‘হিন্দুত্ব নয়, উন্নয়ন’ ব্যাপারটাই ছিল শিল্পপতিদের কাছে সারা ভারতে মুনাফার স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্নচাবি। ‘গুজরাত মডেল’ মোদির নেতৃত্বে সমগ্র ভারতে বিস্তৃত হলেই তাঁদের স্বপ্নপূরণ সম্ভব, এরকম একটা অলীক কল্পনা তাঁদের প্ররোচিত করেছিল। শ্লোগানের ‘হিন্দুত্ব নয়…’ অংশটি ছিল নিতান্তই অসত্যভাষণ। পরবর্তী অংশ ‘… উন্নয়ন’-এর ধ্বনিটার মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছিল পছন্দের শিল্পপতিদের মুনাফা বৃদ্ধির ইচ্ছেপূরণের আশ্বাস। যেটা পরবর্তীকালে এই দেশনায়কের পছন্দের শিল্পপতিদের ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া বা কয়েক বছর ধরে সরকারি কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানকে অবহেলা করে ক্রমশ সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিয়ে পছন্দের কোনো বেসরকারি সংস্থার হাতে প্রায় সার্বিক নিয়ন্ত্রণ তুলে দেবার কৌশলী পদক্ষেপ দেখে মানুষের কাছে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। 

২৫ মে ২০১৪ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন নরেন্দ্র মোদি। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রতিটি প্রচারসভায় গোরক্ষার জিগির তুলতে শুরু করে। রাণা প্রতাপ গোরক্ষাব্রত নিয়েছিলেন; গো-পালক কৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা গুজরাটেরই অন্তর্গত, মোদিজি সেই গুজরাটের তথা দ্বারকারই সন্তান — ইত্যাদি প্রচারগুলি আসলে স্বয়ংসেবক সংঘের গোরক্ষা এজেন্ডারই প্রস্তুতিপর্ব ছিল।

২৩ মে ২০১৭-র কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক গেজেট-বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানিয়ে দিল, এখন থেকে গবাদি পশুর নির্বিচার হত্যা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ঘোষিত হল ‘প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলিটি টু অ্যানিম্যালস রুলস, ২০১৭ (পিসিএ)’। এই কড়া নির্দেশিকার ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল গবাদি পশুর অবৈধ ব্যাবসা বা চোরাচালান বন্ধ করা, অকারণ গোহত্যা বন্ধ করা, কর্মক্ষমতাহীন গরুগুলিকে কসাইদের হাতে তুলে দেবার অমানবিক অভ্যাসে লাগাম পরানো। অবৈধভাবে গরু-পাচারের ব্যাপারে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলোর তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের নাম উপরের দিকেই ছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্দেশিকাকে মেনে নিতে অস্বীকার করলেন ও একই সঙ্গে পুলিশকে গরুপাচার বন্ধ করতে কড়া বার্তা দিলেন। অর্থাৎ তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন। তবে গোহত্যা ও গোমাংস ভক্ষনের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের এই নিষেধাজ্ঞাটি মেনে নিতে স্বাভাবিকভাবেই অস্বীকার করলেন। কেন্দ্রীয় বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও বিরোধিতা এল। কারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাসের ওপর এভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সংবিধানবিরোধী। এতে একদিকে যেমন বিদেশে মাংস রপ্তানি বা চামড়া রপ্তানির মতো লাভজনক ব্যাবসা মার খাবে, তেমনি দেশের অগণিত দরিদ্র মানুষ সস্তার পশুখাদ্য থেকে বঞ্চিত হবে। এ নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে, তখন গেজেট প্রকাশের একমাস ছ’দিনের মাথায় (২৯ জুন ২০১৭) ঝাড়খণ্ডের রামগড়ে আসগর আনসারিকে পিটিয়ে হত্যা করা হল গোমাংস পাচারকারী সন্দেহে। ২০১০ থেকে ২০১৭-র ২৮ জুলাই পর্যন্ত এমন আক্রমণ ঘটেছে ৭০ টি। [১২] তবে মজার কথাটা হচ্ছে, এই অপরাধগুলোর মধ্যে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মাত্র ৫% ক্ষেত্রে আর ২১% ক্ষেত্রে আক্রান্তই অভিযুক্ত!

এই প্রবল হিন্দুত্ববাদের প্রয়োগ নিশ্চিতভাবেই দেশের প্রধানতম সমস্যা কাশ্মীর প্রশ্নটাকেও আরও অগ্নিগর্ভ করে তুলছে স্বাধীনতার পরবর্তী বছরের পর বছর। স্বাধীনতার আগেই শিখ-সাম্রাজ্যের ভগ্নাবশেষের প্রতিনিধি ডোগরা রাজা হরি সিং ১৯৪৬-এ মাত্র ৭৫ লাখ টাকায় ইংরেজের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের রাজত্ব। তখন থেকেই হরি সিং-এর রাজশাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। আওয়াজ ওঠে ‘কাশ্মীর ছাড়ো’। ১৯৪৭-এর অক্টোবর থেকে দু’মাস ধরে হরি সিং কাশ্মীরি প্রতিবাদীদের ওপর দমননীতি নামিয়ে আনে। তৎকালীন দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী তখন প্রায় ১ কোটি ২ লক্ষ কাশ্মীরি মানুষ নিহিত হয়েছিল। আরও জানা যায়, নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ছিন্নমূল হতে হয় ২ লক্ষ—মতান্তরে ২ লক্ষ ৩৭ হাজার মানুষকে। [১৩] মনে রাখতে হবে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বিদ্রোহী কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে হরি সিংকে সামরিক সহায়তাদানের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে একটি সংযোজন চুক্তি (Instrument of Accession) করিয়ে নিয়েছিলেন (২৬ অক্টোবর ১৯৪৭), যার শর্ত ছিল হরি সিং পাকিস্তান-ভুক্তির কোনো স্বাক্ষর করবেন না, ভারত-ভুক্তিরই আবেদন করবেন। এই চুক্তির পরদিনই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৪৮-এর অগস্টে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। তখনও ভারতের শাসনতন্ত্র ও প্রশাসনিক বিষয়ে পরামর্শদাতা লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শক্রমে ১৯৪৮-এই কাশ্মীর প্রসঙ্গে যে চুক্তি হয়, তাতে বলা হয়েছিল, কাশ্মীরের মানুষই ভবিষ্যতে গণভোটে তাঁদের অবস্থান নির্ধারণ করবে। কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন বা স্পেশাল স্ট্যাটাস ভারত সরকারের কোনোদিনই পছন্দ ছিল না। তবু ১৯৫১-তে কাশ্মীরের সংবিধান সভা গঠন ও ১৯৫৭-তে কাশ্মীরের সংবিধান প্রণয়নের সময় থেকেই সংবিধানের ৩৭০ ধারা মোতাবেক কাশ্মীর তার স্পেশাল স্ট্যাটাস বা স্বায়ত্বশাসন ভোগ করেছে। মনে রাখতে হবে, জগমোহন মালহোত্র জম্মু-কাশ্মীরে দ্বিতীয় বারের জন্যে রাজ্যপাল মনোনীত হয়ে (১৯৯০) প্রথম কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে মিলিটারি অভিযানের অজুহাতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাশ্মীর ত্যাগের নিদান দিয়েছিলেন। 

এই সময় থেকেই ভারত সরকারের দমনপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জেকেএলেফ কাশ্মীরে তাদের জঙ্গি কার্যকলাপ শুরু করে এবং পরে সেই দায়িত্বভার নেয় হিজাবুল মুজাহিদিন ও লস্কর-এ-তইবা জঙ্গিগোষ্ঠী।

ফলে ১৯৯০ থেকে টানা ছ’বছরের জন্যে কাশীরে রাষ্ট্রপতি শাসন বলবৎ করা হয় ও ভারতের অধীনতা থেকে মুক্তিপিপাসু কাশ্মীরি মানুষদের বিরুদ্ধে তীব্র করা হয় পাশবিক দমননীতি। ১৯৯৮-এ ওয়ান্ধামাতে ও গান্দেরবালে নির্মমভাবে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা করা হয়। এই সব নির্মমতা সংঘটিত হয়েছে কংগ্রেস তথা অবিজেপি আমিলেই। ২০১৪ থেকে শুরু হল মোদি-শাহ নিয়ন্ত্রিত বিজেপি শাসন। ১৯১৯-এর ৫ অগস্ট থেকে কাশ্মীরবাসীর বেতার-টেলিফোন-ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে বিশ্বের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হল।

স্বাভাবিকভাবেই এমন নির্মমতার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ‘সন্ত্রাসবাদী’ ইত্যাদি তকমা দিয়ে কারারুদ্ধ করে বা মিলিটারি অভিযানের নামে হত্যা করে এই প্রতিশোধস্পৃহাকে এই চরম ক্ষোভের দাবানলকে থামানো কি সম্ভব? কাশ্মীরের ৩৭০ ধারায় প্রাপ্ত স্বায়ত্বশাসনের সুযোগ লোপ করেও কি কাশ্মীরকে শান্ত করা গেছে? এভাবে কাশ্মীরের মানুষের কাছ থেকে কোন্ জাতীয়তাবাদী আচরণ প্রত্যাশা করতে পারি আমরা? কোন্ জাতীয়তাবাদী ভারতবন্দনার ভাষা উঠে আসতে পারে তাদের মুখে?  

ইউপিএ আমলে আর্থিক সংস্কারের গতি ছিল স্লথ। ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট, খাদ্য সুরক্ষা আইন, বনাধিকার আইন ইত্যাদি পুঁজিপতি শিল্পপতিদের খুশি করতে পারেনি। বাজপেয়ীর এনডিএ সরকার এই সংস্কার কিছুটা দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতায় সেটা সফল হতে পারেনি। মোদি-শাহ শাসিত বিজেপি জমানায় সেই আর্থিক সংস্কারের কাজ সার্বিক উন্নয়নের চমৎকার মুখোশ পরিয়ে সুচতুর কৌশলে শুরু হল। এ যেন শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে চিতার গুঁড়ি মেরে নিঃশব্দে পা টিপে এগিয়ে আসা । ২০০০ সাল থেকেই কিভাবে রাষ্ট্রীয় মদতে এই আর্থিক সংস্কারের তথা দেশের সম্পদ বেসরকারি হাতে তুলে দেবার প্রক্রিয়া কিভাবে শুরু হল, তার কিছু দৃষ্টান্ত আমরা দেখে নিতে পারি।

“আপনি এ মুহূর্তে একজন দেশদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলছেন।” [১৪] — বিবিসি-র সাংবাদিককে বলেছিলেন ফাদার স্ট্যান স্বামী। তিন দশক ধরে ঝাড়খণ্ড আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করেছিলেন তিনি। ২০০১ রাঁচিতে বাগাইচায় জেস্যুইট চার্চ ক্যাম্পাস তৈরি করে সেখানে আদিবাসীদের হাতেকলমে কাজের ট্রেনিং দিচ্ছিলেন। পৃথক ঝাড়খণ্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয় ২০০০ নভেম্বর। ফাদার লক্ষ করছিলেন, সরকারের আদিবাসী উন্নয়নের পরিকল্পনাগুলোর উদ্দেশ্য প্রকৃতপক্ষে আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বিহার-ঝাড়খণ্ড-বাংলা জুড়ে প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদের অমিত ভাণ্ডার বিপুল অর্থের বিনিময়ে বহুজাতিকদের হাতে তুলে দেওয়া। সেজন্য দ্রুতগতিতে একাধিক বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে মউ স্বাক্ষরও শুরু হল বনাঞ্চল রক্ষা, আদিবাসীদের স্বাধিকার ও পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্ত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে। ২০০১-১০ সালের মধ্যে ১০০-টির মতো মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ১.৪ হেক্টর জমি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হয়ে গেছে। ২০১৭-তেই ৩ লাখ কোটি টাকার ২০৯-টি মৌ সম্পাদিত হয়েছে। এই কুচক্রান্তের বিরদ্ধে ২০০৪ থেকেই আদিবাসী জনজাতিরা আন্দোলন শুরু করেছিল। ২০২০-এ তা গণআন্দোলনের চেহারা নিলে ২০১১-এর ১০ মার্চ সরকারি তরফে ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ বা ‘অপারেশন আনাকোন্ডা’ নাম দিয়ে বলপ্রয়োগ করে, আন্দোলনকারীদের জামিনঅযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার করে, দমনপীড়ন চালিয়ে কার্যসিদ্ধি করার চেষ্টা চলল।

বনাঞ্চল ও খনিজসম্পদ ছাড়াও ঝাড়খণ্ড-ওড়িশা-ছত্তিসগড় জুড়ে বিশাল অঞ্চলটা আসলে একটা মিনারেল করিডর। সেই মিনারেল করিডরটাকেও কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেবার জন্যে আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, তাদের ফলশস্য ও ওষধির ভাণ্ডারস্বরূপ বনসম্পদ নির্মূল করে, যাবতীয় জীববৈচিত্র‍্যের মাতৃগর্ভ পাহাড়গুলোকে ডিনামাইটে উড়িয়ে দিয়ে রচনা করা চলছিল আদিবাসী উন্নয়নের ভুল স্বরলিপি। স্ট্যান একে বলেছিলেন ‘মানুষ শিকার’। ফলে আদিবাসীদের প্রতিরোধকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে চিহ্নিত করে ফাদার স্ট্যানকে সেই সন্তাসবাদী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হল। রাঁচির জনজাতি অধিকার রক্ষা কমিটির নেত্রী বাসবী কিরো বললেন, “ফাদার স্ট্যানের মতো যাঁরাই দলিত ও জনজাতিদের হয়ে লড়াই করছেন, তাঁদেরই ‘আর্বান নকশাল’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছে সরকার।”

এরই প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে নাকি আমার বাংলাতেও? পুরুলিয়াতেও তো আদিবাসী উন্নয়নের নামে একই কাণ্ড চলছে! গড়ে উঠেছে নামিদামি রিসর্ট, হোটেল, বার, রেস্তোরাঁ, আর গুঁড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড় জঙ্গল, পিছু হটে যাচ্ছে আদিবাসীরা আরো প্রত্যন্ত অঞ্চলে, অথবা কর্পোরেট সংস্থার নিয়োজিত কন্ট্রাকটরের কুলিশ্রমিকে পরিণত হচ্ছে কিংবা নিজেরই জমির ওপর তৈরি হোটেল বা রসর্টের খিদমতগারি করছে। নাগরিক জীবনের পাঁক আর ময়লা জড়ো হচ্ছে তাদের শরীরে-মনে। তাদেরও নিজস্ব সংস্কৃতির মাটি থেকে শেকড় উপড়ে যাচ্ছে বড়ো বড়ো বনস্পতিগুলোর মতোই। আদিবাসীদের পবিত্র ভূমি হিসেবে পরিচিত অযোধ্যা পাহাড়ের একটা অংশকে ডিনামাইট আর বুলডোজার চালিয়ে ধূলিসাৎ করে তৈরি হয়েছে দ্বিস্তরীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। সেই পবিত্র পাহাড়ের ছিন্নভিন্ন শরীর এখন পর্যটকদের কাছে মনোরম ‘মার্বেল লেক’! 

পাঁচ 

ক্ষমতার ভাগবাঁটোয়ারার স্বার্থে অর্জিত ছেঁড়াখোঁড়া স্বাধীনতাকে, বিদেশি সাম্রাজ্যবাদেরই হাতের পুতুল হয়ে থাকা প্রশাসনযন্ত্রকে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে (২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮, স্থান কলকাতার মহম্মদ আলি পার্ক) বার্মার (বর্তমানে মায়নামার) কমিউনিস্ট নেতা থাকিন থানটুন আওয়াজ তুলেছিলেন, “আসুন, ১৯৪৮ সালকে আমরা মুক্তির বছরে পরিণত করি।” এরই পাশাপাশি হিন্দি বলয়ের কর্মীরা যে বলেছিলেন, “লাখো ইনিসান ভুখা হ্যয়, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যয়” — সেই স্বাধীন সার্বভৌম জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধ শ্লোগানটা কি খুব-একটা ভুল ছিল? কিংবা কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে লিখেছিলেন, “হেসে দিতে পারি স্বদেশের স্বাধীনতা” অথবা নবারুণ ভট্টাচার্য যখন লেখেন, “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না” — তখন তাকে কি দেশদ্রোহ বলব? আজ পর্যন্ত ভারতের স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা যে চালে চলছে, তাকে কোন্ যুক্তিতে একটা কল্যাণরাষ্ট্র বলে চিহ্নিত করব আমরা? কি করে একবুক আশা নিয়ে গাইব — “ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে”? কি করে স্বর্ণগর্ভা বাংলার মানুষ হিসেবে বলব — “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”? নির্মমভাবে নিহত কাশ্মীরিদের পরিজনেরা কিভাবে ভাবতে পারে ‘কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ’? অসমের এনআরসির কোপে পড়ে যে মানুষগুলো নিজদেশেই পরবাসী বা অনুপ্রবেশকারী বলে দাগি বনে গেছে, তারাও কি গলা খুলে কোনও দিন ভারতবন্দনা গাইতে পারবে? আনিসের বাবা কিংবা দাদা কি বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে ছাড়া বাংলার সুশাসন বা উন্নয়ন নিয়ে আপাতত ভাবতেও পারবে। বিরুদ্ধকথা উচ্চারিত হলেই যেখানে হয় ‘সন্ত্রাসবাদী’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ অথবা ‘মাওবাদী’ দেগে দেওয়া হয়, যেখানে ক্ষমতাবান কখনও জনমতের তোয়াক্কা করে না, যেখানে ভিন্ন মত শোনার মতো নমনীয়তা বা সহিষ্ণুতা অনুপস্থিত, যেখানে কোনো দলীয় সদস্যের বা উচ্চপদাধিকারীর স্পষ্ট প্রমাণিত অপরাধকে আড়াল করার জন্যে প্রশাসনিক প্রধানকেই অতিসক্রিয় হতে দেখা যায়, সেখানে আর যা কিছু থাক, জাতীয়তাবোধের কোনও অস্তিত্ব টিকে থাকতেই পারে না। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে ‘বন্দে মাতরম্’, ‘ভারত মাতা কি জয়’, ‘জয় হিন্দ’, ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি জাতীয়তাবাদের পরিচিত ধ্বনিগুলো আসলে কোনো অর্থই বহন করে না। বরং শব্দগুলোকে যেন দেশপ্রেমের আলঙ্কারিক মুখোশ বলে মনে হয়।

আপাতভাবে উচ্চারিত কিছু শ্লোগানকে এখন আর জাতীয়তাবাদী স্বর বলে চেনা যায় না। শুনলেই হিংস্র আক্রমণোদ্যত রণউল্লাস বলে মনে হয়। যেমন — ‘জয় শ্রীরাম’, ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’, ‘ইয়ে তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যয়, কাশী মথুরা বাকি হ্যয়’ কিংবা ‘খেলা হবে’ ইত্যাদি।

আরও আছে। স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে অথবা রাজ্যকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে ক্রমোন্নত করার যে আওয়াজ বা ঘোষণাগুলো আজ চোখের বা কানের ওপর জ্বলজ্বল করে, সেগুলো কি কেবলই বিজ্ঞাপনী মিথ্যাচার বলে মনে হয় না? যখন আপনি শুনবেন বা দেখবেন বা পড়বেন — ‘স্বচ্ছ ভারত’, ‘মেরা ভারত মহান’, ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’, ‘স্বনির্ভর ভারত’, ‘মোদী হ্যয় তো মুমকিন হ্যয়’, ‘আচ্ছে দিন’, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’, ‘বেটি বঁচাও, বেটি বঢ়াও’, ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট ম্যাক্সিমাম গভর্নেস’, তখন সেগুলোকে কথার কথা বলে উপহাস করলে আপনিও ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন না তো? অথবা যখন আপনি জ্বলজ্বলে সাইনবোর্ডে ‘সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল’ বা ‘বিশ্ববাংলা’-র চমৎকার লোগোটা দেখবেন; ‘যুবশ্রী’-‘কন্যাশ্রী’ বা ‘লক্ষ্মীভাণ্ডার’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’-র প্রকল্পের আওয়াজ পাবেন কিংবা টিভির পর্দায় রাজকীয় সমারোহে বিশ্ববাংলা বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে আবেগমথিত কন্ঠে ‘বাংলাই শিল্প বিনিয়োগের যোগ্য ভূমি’ শুনবেন আর কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ ও লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি পেয়ে পূর্ব-অভিজ্ঞতা থেকে বক দেখানোর ভঙ্গিতে শূন্যঝুলির ছবি দেখাবেন, তখন হয়তো আপনিও ষড়যন্ত্রকারী নেতিবাদী মাও-অনুগামী বলে খুব তাড়াতাড়িই আদরযত্ন পেয়ে যাবেন!

সে যাহোক হবেখন, আপাতত আসুন, সব্বাই মিলে একবার প্রাণ ভরে গলা তুলে বলি — ‘ভারত মাতাকি জ্যয়!’ বলি — ‘জ্যয় বাংলা! জ্যয় মা, বাংলার মাটির জ্যয়, এই মানুষ-জন্ম এবারের মতো ক্যনোক্রমে তরিয়ে দাও ম্যা!’

প্রসঙ্গসূত্র :

১। “নেশন কী”; ‘আত্মশক্তি ও সমূহ’; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

২। ঐতরেয় আরণ্যক ২/১/১। 

৩। ‘বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন’; ড. অতুল সুর; সাহিত্যলোক, ১৯৮৬।

৪। ‘Trilingual Dictionary / Santali – English – Bengali’; Paschimbanga Santali Academy, Tribal Development Department, Govt. of West Bengal; 2017p. 943.

৫। ‘আকবরের রাষ্ট্র সাধনা’; এস. ওয়াজেদ আলী; নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, বাংলাদেশ; ২০১৮।

৬। Works of J. V. Stalin, Vol. II; 1946.

৭। ‘জৈন শাস্ত্র-সাহিত্য’, সুকুমার সেন; ‘বাংলা ভাষায় জৈনধর্ম-চর্চা’; তপনকুমার ঘোষ সংকলিত; প্যাপিরাস, ২০১৮; পৃষ্ঠা ১০২। 

৮। দ্রষ্টব্য- ‘ভগবান বুদ্ধ’; ধর্মানন্দ কোসম্বী; অনুবাদ- চন্দ্রোদয় ভট্টাচার্য; সাহিত্য অকাদেমি, ২০০৭; পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৭।

৯। দ্রষ্টব্য- বঙ্কিম রচনাবলী, ১ম খণ্ড; সাহিত্য সংসদ, ভূমিকা, যোগেশচন্দ্র বাগল।

১০। ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’; হেমচন্দ্র কানুনগো; চিরায়ত প্রকাশন, ২০০৭; পৃষ্ঠা ৪১।

১১। ‘দুঃসময়ের আখ্যান’; দেবাশিস আইচ; দ্য কাফে টেবল, ২০২০; পৃষ্ঠা ৭১।

১২। ‘দুঃসময়ের আখ্যান’; পৃষ্ঠা ৩৯।

১৩। ‘দ্য স্পেক্টেটর’, ১৬ জানুয়ারি ১৯৪৮ এবং ‘টাইমস লন্ডন’, ১০ অগস্ট ১৯৪৮।

১৪। ‘দুঃসময়ের আখ্যান’; পৃষ্ঠা ৫৩।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান